হৃদয়ের দহন পর্ব ৭

#হৃদয়ের দহন
#পর্বঃ৭
#সামিরা পপি

সামিরা রাস্তায় বসা থেকে উঠে।নাবিলের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে দৌঁড়ে চলে যাই বাসায়।বাসায় এসে কেউকে কিছু না বলেই নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।দরজার পাশ ঘেষে বসে পড়ে আর ফুঁফিয়ে কান্না করতে থাকে।কি করে পারল নাবিল তাকে ভরা রাস্তায় এইভাবে চড় দিতে?সে না’হয় ভুল করেই ফেলেছে রাগের মাথায়।তাই বলে কি এইভাবে সবার সামনে থাপ্পড় মারবে?নাবিল কি বুঝেনা সে অন্য মেয়েদের সাথে মিশলে সামিরার কষ্ট হয়?প্রতিদিন নানা ভাবে অপমান করে ঠিক আছে। সব সামিরা মেনে নেয়।কিন্তু আজকেরটা?আজকেরটা কি করে মেনে নিবে সে?ভাবতে ভাবতে আরো জোরে কান্না বেড়ে গেলে।ঘরে মামনি শুনবে তাই মুখে উড়না গুজে দিয়ে কাঁদতে লাগল।যত কান্নার বেগ বাড়তে লাগল ততই নাবিলের প্রতি অভিমান বাড়তে লাগল।বুকের ভেতর অভিমান পাহাড় সমান হয়ে উঠল।কিছুক্ষন কান্না করার পর কান্না থামিয়ে চোখের পানি মুছে নিজেই নিজেকে বলতে লাগল,
—-“অনেক হয়েছে আর না।হয়তো আমিই উনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বেশি করে ফেলেছি।আমি উনাকে ভালবাসি তাই বলে এমনটা করা উচিত হয়নি আমার।আর উনিও আমাকে ভালবাসেন না।তাই কখনও আমার সাথে খুশি থাকবেন না।আর আমাকে ভালোও বাসবেন না।যদি ভালোবাসতো তবে আজ একবছর ধরে আমাকে এত কষ্ট করতে হতো না।আর আমিতো উনাকে ভালোবাসি।তাই আমার উচিত উনাকে খুশি থাকতে দেওয়া।উনি যেভাবে চাই সেভাবেই রাখা।যদি সামান্য উনার খুশির জন্য এইটুকু সেক্রিফাইজ করতে না পারি,তবে কেমন ভালোবাসলাম?আজ যদি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারতাম তবে উনার মত একজন বন্ধুকে হারাতে হত না।নিজেই নিজের হাতে সব শেষ করলাম।আর না।”
বলেই চলে গেল এক বছর আগের অতীতে।
সামিরা নাবিলদের বাসায় এসেছে প্রায় ছয় মাস।এই ছয় মানে সামিরাকে সবাই আপন করে নিয়েছে।সামিরা বুঝতেই পারেনা সে এদের বাড়ির মেয়ে না’কি অন্য বাড়ির।সামিরাকে নাবিলের কলেজে অনার্স ফাস্ট ইয়ারেও ভর্তি করে দেয় আজাদ সাহেব।সামিরা যখন তার মামার বাড়ি ছিল তখন ইন্টার পরিক্ষা দিয়েছিল।কিন্তু রেজাল্ট বের হওয়ার কয়দিন আগেই তাকে বের করে দেয় মামি।আজাদ সাহেব সামিরাকে তার পড়ালেখার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সামিরা সব বলে।সামিরা নাবিলদের বাসায় আসার কিছুদিন পর ইন্টারের রেজাল্ট দেয়।সামিরার রেজাল্ট ফোর পয়েন্টের কাছাকাছিই ছিল।একদিন সামিরাকে নিয়ে গিয়ে তার মামার বাড়ির সেখানের কলেজ থেকে টিসি নিয়ে আসে আজাদ সাহেব।তারপরেই নাবিলের কলেজে ভর্তি করে দেয়।সাথে কোচিং এও।নাবিল সামিরার এর মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যাই।নাবিল সামিরাকে নিয়ে একসাথে কলেজে যাই আবার আসে।নাবিলের সব ফ্রেন্ডের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়।সামিরার সব কিছুর খেয়াল রাখে নাবিল।নাবিলের এত কেয়ারিং দেখে সামিরা নাবিলের প্রতি অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ে।কিন্তু ততটা গুরুত্ব দেয় না।তাদের মধ্যে সব ঠিক তাকে।একদিন বিকেলে সামিরা কোচিং থেকে আসছিল। নাবিলদের বাসা কলেজ থেকে বেশি দূরে নয় তাই সামিরা হেঁটেই আসছিল।কোচিং এ সামিরা একাই আসা যাওয়া করে আজকেও তাই করছিল।কিন্তু কিছুদূর আসার পর সামিরার মনে হলো কেউ তাকে ফলো করছে।পেছনে ফিরে দেখে কয়েকটা ছেলে।সামিরা কি করবে ভেবে পায় না।ভয়ে তার হাত পা কাঁপতে থাকে।তখনি মনে হলো নাবিলের কথা।জট করে মোবাইলটা বের করে নাবিলকে কল দেয়।নাবিল রিসিভও করে কিন্তু সামিরা কথা বলতে পারে না।তার আগেই ছেলে গুলো সামিরাকে ঘিরে ধরে।এতে সামিরা আরো ভয় পেয়ে যাই।ওইদিকে নাবিল হ্যালো হ্যালো করতে থাকে।সামিরা ভয়ে ভয়ে ছেলে গুলোর উদ্দেশ্য বলে,
—-“কি ব্যাপার আপনারা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেন?সরুন আমি যাব।”
ছেলে গুলোর মধ্যে একজন বলে,
—-“হুম যাবে ত।কিন্তু তার আগে যে আমাদের সাথে যেতে হবে?”
নাবিল লাইনে থাকায় সব কথা শুনে।আর তার বুঝতে কষ্ট হয়না যে আসল ঘটনা কি।নাবিল কলেজের কাছেই ছিল। বন্ধুদের সাথেই আড্ডা দিচ্ছিল।মূলত সে প্রতিদিনই কলেজের পাশের মাঠে বিকেলে আড্ডা দেয়।নাবিল সব বুঝতে পেরে দৌঁড়ে আসে।নাবিলের দৌঁড় দেখে পিছিনে তার বন্ধুরাও আসে।
সামিরাকে ছেলেগুলো হাত ধরে টানাটানি করছে।সামিরা বারবার ছুটানোর চেষ্টা করছে আর কান্না করছে কিন্তু ছেলেগুলো ছাড়ে না।রাস্তায় কয়েকজন মানুষও আছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনা।সবাই তামাশা দেখতে থাকে।অবশ্য আমরা বাঙালীরা এমনি।অন্যের বিপদে এগিয়ে যাই না শুধু তামাশা দেখি।কিন্তু যখন নিজের সেম বিপদ হয় তখনি অন্যেদের খুঁজি।
কয়েক মিনিটের মাথায় নাবিল আর তার বন্ধুরা চলে আসে।নাবিল চারপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজে।রাস্তার পাশে ইট পেয়ে তা নিয়ে ছুড়ে মারে ওই ছেলে গুলোকে।একটা ছেলের পায়ে ইটটা পড়ে আর ছেলেটা জোরে চিৎকার করেই বসে পড়ে।সবাই নাবিলের দিকে তাকায়।সামিরা নাবিলকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পায়।তার ধরে রাখা হাত ঝাড়ি ধিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েই নাবিলের কাছে এসে ঝাপ্টে নাবিলকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।সামিরা এমন করায় নাবিল কয়েক কদম পিছিয়ে যাই।নাবিল বুঝতে পারে সামিরা বেশ ভয় পেয়েছে তাই সামিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।সামিরাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে যাই।ততক্ষনে তার বন্ধুরা মারা শুরু করে দিয়েছে।তারা সামিরাকে চিনে আর এইখানে কি হচ্ছিল তাও বুঝতে পারে।নাবিলও গিয়ে মারে।পরে সামিরাকে নিয়ে বাসায় চলে আসে।সামিরাকে অনেক কিছু বলে শান্ত্বনা দেয়।সামিরা আস্তে আস্তে শান্ত হয়।নাবিল না আসলে কি হত?ভাগ্যিস নাবিল লাইনে ছিল।
সেদিন রাতে সামিরার ঘুম হয়নি।ভয়ে নয় নাবিলের ভাবনায়।সেদিন নাবিলের প্রতি তার ভালো লাগা আরো কয়েকগুন বেড়ে যাই।যতই দিন যাচ্ছে সামিরা ততই নাবিলের প্রতি দূর্বল হচ্ছে।শেষে আর না পেরে সিদ্ধান্ত নিল।নাবিলকে সে তার মনের কথা বলবে।নিশ্চয় নাবিল মানবে।আর না মানার কি আছে?সামিরা কি কোন দিকে দেখতে খারাপ না’কি?শুধু ফ্যামিলির প্রব্লেম এই আরকি।আল্লাহ তাকে ফ্যামিলি দেয়নি এতে তার তো কোন দোষ নেই।নাবিল মানলে মানবে আর না মানলে জোর করে হলেও মানাবে।মোট কথা নাবিলকে তার চাই-ই চাই।যেই ভাবা সেই কাজ।সেদিন ছিল সোমবার।সামিরার প্রথম ক্লাস ছিল না।সেই সুযোগে নাবিলকে প্রোপোজ করবে বলে সুন্দর করে সেজে গুজে কলেজে যাই।নাবিলের সাথে নাবিলের ফ্রেন্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।যেহেতু গ্যাপ ক্লাস তাই সে এইখানেই আছে।সবাই যে যার মত কথা বলছিল।আর সামিরা ভাবছিল কথাটা কি করে বলবে।তখন পাশ থেকে পপি বলল,
—-“সামিরা তুমি অন্য মনষ্ক হয়ে কি এত ভাবছ?”
সামিরা পপির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
—-“না আপু তেমন কিছুই না।”
—-“তেমন কিছু না?তারমানে তো নিশ্চয় কিছু ভাবছিলে।তা কি ভাবছিলে শুনি?”
সামিরা আমতাআমতা করে বলে,
—–“আব উম না কিছু না।”
*—“উহুহ্ বিশ্বাস হয়না দেখি বলোতো।”
সামিরা মনে মনে বলল,
—–“হুম এইতো সুযোগ।সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবেনা।”
আবার পপিকে বলিল,
—–“বলব?”
—-“হ্যাঁ অবশ্যই বলো।”
—–“ওকে ওয়েট।”
বলেই নাবিলকে টেনে সামনে দাঁড় করালো।আর নিজে নাবিলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এক হাত বাড়িয়ে দিল।সামিরার এহেন কাজে সবাই অবাক সাথে নাবিলও।সবাই আগ্রহ নিয়ে সামিরার দিকে তাকিয়ে আছে।সামিরা বলতে শুরু করল,
—–“নাবিল আপনি জানেন?আপনাকে কতটা ইনোসেন্ট লাগে?আপনার সরলতা,সবার প্রতি সুন্দর মার্জিত আচরন,আপনার হাসি,কথা বলার স্টাইল সব আমার পছন্দ।পছন্দ না পছন্দ হয়ে গিয়েছে।আর আপনার ওই ঘোলাটে চোখ গুলোর দিকে যতবার তাকায় ততবারই কেমন যেন নেশা কাজ করে।আমি আপনার ওই চোখের নেশায়ও পড়ে গেছি।এই নেশা কাঁটানোর অনেক চেষ্টাও করেছি।কিন্তু পারিনি।বরং দিন দিন নেশায় আসক্ত হয়ে চলেছি।তাই আর না পেরে আজকে বলছি।আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।আপনি কি আমায় ভালোবাসবেন?”
সবাই সামিরার কথায় শকড।সামিরা কি বলছে এইসব?নাবিল তো কখনও কল্পনাও করেনি।এইদিকে পপি খুশি হয়েছে।কারন সে বুঝেছিল সামিরা নাবিলের প্রতি দূর্বল।নাবিলের কোন রেসপন্স না পেয়ে সামিরা বলিল,
—-“কি হলো কিছু বলছেন না যে?”
সামিরার কথায় নাবিলের রাগ উঠে গেল।চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল।সামিরার দু’বাহু ধরে তাকে উঠিয়ে মারল এক চড়।নাবিলের কাজে সবাই হতবাক।সবাই ভেবেছিল নাবিল সামিরাকে মেনে নিবে।কিন্তু এইটা কি হলো?সামিরা গালে হাত দিয়ে নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।নাবিল রাগে রীতিমতো কাঁপছে।আর বলিল,
—–“আসলে তোমাকে পশ্রয় আমি দিয়ে ফেলেছি।ভুল আমারি।তাই আজ এইদিন দেখতে হলো।তোমার সাথে বন্ধুত্ব কেন করেছি তাই তুমি ভালোবেসে বসে আছে।কিন্তু কান খুলে শুনে রাখো আমি তোমাকে ভালবাসি না আর না বাসব।আর হ্যাঁ আজ থেকে তোমার সাথে আমার বন্ধুত্বও শেষ।ভুলেও আমার চোখের সামনে আসিবে না।”
বলেই নাবিল হনহনিয়ে চলে গেল।আর সবাই নাবিলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল।সেদিনই সামিরা হয়ে উঠেছিল নাবিলের কাছে ঘৃণার পাত্রী।কিন্তু সামিরা হাল ছাড়েনি তবুও প্রতিদিন কোন না কোনভাবে নাবিলকে জ্বালাতন করেই।আর তার বিশ্বাস নাবিল তাকে একদিন ভালোবাসবে।কিন্তু সে ভুল ছিল।এক বছর হয়ে গেছে কিন্তু নাবিল তাকে মেনে নেয়নি।উলটো অপমান করে গেছে।আর আজ তো সবার সামনে রাস্তায় থাপ্পড় মেরেছে।
দরজার নক হওয়ার আওয়াজে সামিরা ভাবনা থেকে ফিরে।এতক্ষন এইসব ভাবছিল সে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here