হৃদয়ের দহন পর্ব ৮

#হৃদয়ের দহন
#পর্বঃ৮
#সামিরা পপি

সামিরা উঠে ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসে।এসেই দরজা খুলে।মামনি হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে বলে,
—-“কিরে সামু তোর কি হয়েছে?কলেজ থেকে এসেই সোজা রুমে ঢুকে গেলি।”
সামিরা টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে সেটা হাতে নিয়ে বলে,
—-“আরে মামনি কিছুই হয়নি।আসলে মাথা ব্যাথা করছিল তাই এসেই ওয়াসরুমে ঢুকেছি।চিন্তা কর না।আমি ঠিক আছি।”
রোমানা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—-“যাক তাহলে ঠিক আছে।আমি তো আরো ভাবলাম কি না কি হলো।আচ্ছা আমার সাথে আয় কিছু খেয়ে যা।”
—-“আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।”
—-“ঠিক আছে।”
রোমানা চলে গেলে সামিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আজকের পর থেকে সব ভূলে যাবে।নাবিলের আসে পাশেও যাবে না সে। নাবিলের খুশিতেই তার খুশি।ভাবতে বুক ভার হয়ে আসছে সামিরার।কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না তাকে।নাবিলের খুশির জন্য এইটুকু সেক্রিফাইজ সে করতেই পারে।ভাবতে ভাবতে চোখ দু’টো বন্ধ করে আবার খুলল।টাওয়ালটা শুকাতে দিয়ে মামনির কাছে গেল।মামনি তাকে নুডুলস দিল।সামিরা বলল,
—-“এখন নুডুলস কেন মামনি?একটু পরেই তো ভাত খাওয়ার সময়।তার থেকে ভালো তুমি আমাকে ভাত দাও।আমি খেয়ে একটু ঘুমাবো।পরে আবার কোচিং আছে তো।”
—-“কিন্তু নুডুলস ত তোর জন্যই বানিয়েছি আমি।”
—-“কিছু হবে না বিকেলে খাব।এখন ভাত দিয়ে ফেল।”
—-“আচ্ছা।”
সামিরা ভাত দিলে সে খেয়ে চলে যাই নিজের রুমে।মাথাটা কেমন যেন ব্যাথা করছে।হয়তো টেনশনের কারনে।না আর টেনশন করা যাবে না।যেভাবেই হোক ঘুমাব।শোয়ার কিছুক্ষন পর সামিরা ঘুমিয়ে পড়ে।আড়াইটার দিকে ঘুম ভাঙে মামনির ডাকে।উঠে হাত মুখে ধুঁয়ে রেড়ি হয়ে কোচিং এ চলে যাই।আবার যথা সময়ে কোচিং থেকে চলেও আসে।কিন্তু এর ভেতর একবারের জন্যও নাবিলের সাথে দেখা হয় না।বিকেলে সামিরা আর মামনি বসে টিভি দেখছিল আর রাতের রান্নার জন্য মামনি তরকারি কাটছিল।সাথে সামিরাও একটু আধটু হ্যাল্প করছিল।তখন নাবিল ঘরে ঢুকে।নাবিলকে দেখে সামিরা চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দেয়।ব্যাপারটা নাবিল খেয়াল করে কিন্তু পাত্তা দেয় না।নাবিল রোমানাকে বলল,
—-“আম্মু খিদে লেগেছে একটু নাস্তা দাও।”
রোমানা বলল,
—-“সামু যা তো।নুডুলস গুলো গরম করে নাবিলকে দে আর তুইও খা।সাথে চা ও বানিয়ে নিস।”
সামিরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাবিল বলল,
—-“কেন আম্মু তুমি দিলে কি সমস্যা?থাক দিতে হবে না।”
বলেই হনহন করে নাবিল নিজের রুমে চলে যাই।এদিকে রোমানা বেশ অবাক হয় নিজের ছেলের আচরনে।সামিরা তো বুঝতে পারে তাই সে চুপ করে বসে আছে।রোমানা সামিরার দিকে তাকিয়ে বলিল,
—-“কি বল তো ছেলেটার?হঠাৎ রেগে গেল কেন?তোর সাথে কি রাগ করেছে?”
সামিরা মামনিকে কি বলবে বুঝছে না।এদিক ওদিক আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—-“না মামনি তেমন কিছু না।হয়তো অন্যকোন কারন হতে পারে।আমিও জানিনা কি কারন।”
রোমানা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
—-“ওহ।আচ্ছা তুই বস আমি নাস্তা নিয়ে আসি।”
—“ওকে মামনি।”

কেঁটে গেছে চারদিন।এই চারদিনে সামিরা কখনও ইচ্ছে করে নাবিলের সামনে যাইনি।নাবিলকে বিরক্তও করেনি।না নাবিলের দিকে তাকিয়েছে।কলেজে গেলেও কখনও নাবিলের সামনে যাইনি।যথা সম্ভব নাবিল থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে।সামিরার এমন আচরনে সবাই অবাক হয়। সবাই বলতে নাবিলের ফ্রেন্ডরা।তারা কখনও ভাবেনি যে সামিরা এমন বদলে যাবে আর এইভাবে নাবিলকে বিরক্ত করা বন্ধ করে দিবে।নাবিলও কিছুটা অবাক হয়।তবে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না।সে আরো মনে মনে খুশি হয় এইভেবে যে, সামিরা তাকে আর বিরক্ত করেনা।এইবার সে নিজের মতই ঠিক আছে।এক বছর সামিরা তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে।অবশেষে আপদ বিদেয় হলো।তবে সামিরার জন্য একটু হলেও খারাপ লাগে।কিন্তু সেও কি করবে?সে তো পপিকে ভালবাসে।আগামীকাল পপির বার্থডে তাই নাবিল অনেক এক্সাইটেড। কারন সে পপিকে প্রোপোজ করবে। তাই তার এক বন্ধুকে কল দেয়।তখন রাত।সবাই যার যার রুমে।সামিরা উঠে রুম থেকে বের হয় পানির জন্য।তখনি নাবিলকে কারো সাথে কথা বলতে শুনে সামিরা দরজার পাশেই দাঁড়ায়।নাবিল বলে,
—-“হ্যাঁ আমি ওকে আগামীকাল প্রোপোজ করব।কিন্তু আমার কেমন জানি নার্ভাস লাগছে।”
অপর পাশ থেকে কি বলল শুনল না সামিরা।নাবিল বলল,
—–“আরে না না।সামিরার চিন্তা করতে হবে না এখন আর।ও এখন নিজেই আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করে দিয়েছে।এতেই আমি খুশি।আমিই বা কি করব বল?আমি তো অন্যজনকে ভালবাসি তাই তো সামিরাকে মেনে নিতে পারিনি।তবে আমি প্রার্থনা করি সামিরার জীবনে যেন এমন কেউ আসে যে সামিরাকে অনেক ভালবাসবে।”
——-
—–“হুম আচ্ছা।এখন রাখি।”
সামিরা নাবিলের কথাগুলো শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না।প্রচুর কান্না আসছে তার।নাবিল অন্যকেউকে ভালবাসে বলেই তাকে মেনে নেয়নি।আর সে এই কথাটা বুঝতেই পারল না?সামিরা বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে লাগল।কান্নার এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে।সারারাত ঘুমোইনি।নানা রকম চিন্তা করে গেছে।শেষে একটাই সিদ্ধান্ত নিল।সে আর এইখানে থাকবে না চলে যাবে।তাও কালকেই চলে যাবে সে।নাবিলকে বারবার চোখের সামনে দেখলে সে নিজেকে আঁটকাতে পারবে না।এমন হাজারো ভাবনা চিন্তা করে সকালের আজানের পর ঘুমিয়ে পড়ে।কিন্তু সকাল আট্টার দিকে ঠিকই ঘুম ছুটে যাই।উঠে একেবারে গোসল করে রেড়ি হয়ে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য।আয়নায় নিজের চেহেরা দেখে নিজে চমকে উঠে।সারারাত না ঘুমানোর ফলে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে।মুখ শুকিয়ে আছে।কেমন যেন বিধবস্ত লাগছে।আর না ভেবে ব্যাগ নিয়ে বের হয়।মামনি এসে নাস্তা দেয় আর বলে,
—-“সামু তোর এই অবস্থা কেন?রাতে কি ঘুমোস নি?”
মামনি তার কত খেয়াল রাখে।এই মানুষটাকে নিজের মা’য়ের জায়গায় বসিয়েছে সামিরা।কত আদর যত্ন করে।কত ভালবাসে তাকে।আর সে এই মানুষটাকেই ছেড়ে চলে যাবে আজ।ভাবতেই কান্না আসছে তার।কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মলিন হেসে বলল,
—-“আসলে ঘুম আসেনি মামনি তাই।মামনি তুমিও বস আমার পাশে একসাথে নাস্তা খায়।”
—-“আমি পরে খাবো আগে তুই খা।”
—-“কিছু হবে না মামনি।প্লিজ খাওনা।আমার একা একা খেতে ইচ্ছে করছে না।”
—-“আচ্ছা।”
দুইজনে খাচ্ছে।সামিরা মামনিকে বলল,
—-“আচ্ছা মামনি আমি যদি চলে যাই তুমি কি আমাকে মনে রাখবে?”
মামনি মুখে রুটির টুকিরো দিচ্ছিল।সামিরার কথা শুনে আর দেওয়া হয়নি।সামিরার কথা শুনে বুকে চেৎ করে উঠল।বলিল,
—-“সামু তোর কি হয়েছে আজ?এমন কথা কেন বলছিস?আর তুই কোথায় যাবি?আমি তোকে কোথাও যেতে দিব না।”
সামিরা মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসল।কিন্তু মুখে প্রকাশ হলো না।বলল,
—-“বারে মেয়েদের বুঝি বিয়ে দিতে হয় না?তখন ত তারা এমনিতেই চলে যাই।”
—-“বিয়ের কথা এখন থাক।যখন বিয়ে হবে তখন দেখা যাবে।”
সামিরা আর কথা বাড়াল না।কলেজে চলে গেল।যাওয়ার আগে মামনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।সামিরার কাজে মামনি অবাক।কলেজে যাওয়ার সময় সামিরা আনমনে রাস্তায় হাঁটতে লাগল আর ভাবতে লাগল, কোথায় যাবে সে?কার কাছে যাবে?কোথায় থাকিবে?কিছুই মাথায় আসছে না।পরে তার ক্লাসমেট বান্ধবী সোমার কথা মনে পড়ল।তার সাথে সামিরার সম্পর্ক বেশ ভালো।কয়দিন তাদের বাসায় থাকবে আর একটা জব খুঁজে নিবে।জব পেলেই সে আলাদা বাসা নিবে।হুম এখন এই একটাই করবে সে।ভাবতে ভাবতে সব কিছুই ভুলে গেছে।ধ্যান ফিরে হাতে টান পরায়।হাতের দিকে তাকিয়ে আবার সামনের মানুষটার দিকে তাকায়।দেখে পপি।পপি চিল্লিয়ে বলে,
—–“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?দেখে চলতে পারো না?কি এত ভাবছিলে যে গাড়ি আসছে তাও খেয়াল করনি?এখন যদি এক্সিডেন্ট হয়ে যেত তাহলে কি হত?চুপ কেন বলো?”
সামিরা এতক্ষন পপির কথা গুলো শুনছিল।তারপর পপির দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলিল,
—-“আসলে খেয়াল করিনি আপু।একটু চিন্তায় ছিলাম তাই।”
—–“তা কি এমন চিন্তা করছিলে শুনি?”
সামিরা আনমনে বলিল,
—-“নাবিলের কথা।”
সামিরার কথা শুনে পপির ও কষ্ট লাগল।আবার মুচকি হেসে বলল,
—–“আচ্ছা বাদ দাও।আজকে আমিই তাড়াতাড়ি কলেজে আসছিলাম তোমার সাথে কথা ছিল বলে।যাক ভালোই হলো এইখানে দেখা হয়ে গেছে।”
—–“কি কথা আপু?”
—–“তুমি আমার সাথে চলো গেলেই বুঝতে পারবে।”
পপি সামিরাকে নিয়ে কাছের একটা পার্কে গেল।সামিরাকে নিয়ে গেল একটা ছেলের কাছে।ছেলেটা পেছনে মুখ ঘুরিয়ে রেখে মোবাইল টিপছে।সামিরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল পপির দিকে।আর ভাবছে,আপু আমাকে এইখানে কেন নিয়ে এল?আর এই ছেলেটা কে?”
পপি ছেলেটার উদ্দেশ্য হাসি মুখে বলল,
—–“আমরা এসে গেছি।”
পপির কথা শুনে ছেলেটা মুখ ঘুরালো।আর ছেলেটাকে দেখে সামিরা অবাক হয়ে গেল।সাথে ছেলেটাও।সামিরা ছেলেটাকে “ভাইয়া” বলে কান্না করে দিয়ে ঝাপ্টে ধরল।ছেলেটাও ঝাপ্টে ধরল।ছেলেটা রিহান।সামিরার মামাতো ভাই।দুই ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।আর পপি তা মুগ্ধ হয়ে দেখছে।তখনি পপির মোবাইলে কল আসে নাবিলের।পপি এক পাশে গিয়ে রিসিভ করে,
—–“হ্যাঁ নাবিল বলো।”
নাবিল বলিল,
—–“তুমি কোথায়?”
—–“আমিতো কলেজের পাশে পার্কে আছি।”
—-“ওখানে কি করছ?”
—–“একটা ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে আসছি।”
—–“ওহ আচ্ছা।তুমি থাকো আমি আসছি।আমি আসলে প্রব্লেম হবে না’তো?”
—–“আরে কি যে বল।কিসের প্রব্লেম হবে?আসো আমি ওয়েট করছি।”
—–“ওকে দুই মিনিটেই আসছি।”
পপি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রিহান সামিরাকে দেখছে।দুই ভাই বোন একটা বেঞ্চে বসে আছে।সামিরা রিহানের কাঁধে মাথা রেখে বসেছে।এতদিনের জমানো সবকথা বলছে।কথার এক পর্যায়ে সামিরা জিজ্ঞেস করল,
—–“ভাইয়া তুমি পপি আপুকে কেমনে চিনো?আর আমি যে তোমার বোন সেটাই বা আপু কেমনে জানল?”
—-“পপি আমার গার্লফ্রেন্ড।ওর সাথে আমার দুই বছরের সম্পর্ক।কিন্তু সেটা তেমন কেউ জানেনা।আসলে আমিই বলতে নিষেদ করেছি।কারন আমি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।এখন আমি অনেক ভাল জব করি তাই সবাইকে বলব ভেবেছি।তুই চলে আসার পর আমি প্রচুর ভেঙে পরেছিলাম।তখন পপিই আমাকে শান্ত্বনা দিত।কিন্তু ও তোকে কখনও দেখেনি।তোর কথা প্রায়ই হয় আমাদের।গতকালও হয়েছে।তো পপি আমাকে জোর করেছে তোর একটা পিক ওকে দিতে।ও তোকে দেখতে চাই।তাই আমিও দিয়েছি।সেটা দেখে পপি আমাকে বলে,
—–“একে তো আমি চিনি!এতো সামিরা!
তখন আমি কি বলব বুঝছিলাম না।তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলিলাম,
—–“তুমি ওকে কেমনে চিনো?ওতো আমার বোন।আর ওকে তো তুমি চিনার কথা না?”
——“আরে কি যে বলো।ওকে আমি দুইবছর ধরে চিনি।আমার খালার বাসায় থাকে।আর আমাদের কলেজেই পড়ে।”
তখন আমি অনেক খুশি হয়েছি।খুশিতে সারারাত ঘুমাতে পারিনি।তাই পপি আমাকে বলেছে এইখানে চলে আসতে। আর এসেছি সকালে।তখন পপি তোকে নিয়ে এসেছে।”
দুই ভাইবোন আবার একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।সামিরা কান্না করতে থাকে।নাবিল পার্কে আসলে প্রথমে সামিরার দিকে চোখ যাই।সে সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।এক দৃষ্টিতে সামিরার দিকে তাকিয়ে।মনে মনে বলল,
——“ছিঃ এতদিন আমার পিছে ঘুরেছে।যখন আমি পাত্তা দেয়নি এখন আরেকজনের পিছে লেগেছে।লেগেছে ভালো কথা।অন্যকারো সাথে রিলেশন হয়ে গেলে আমার জন্যই ভালো।কিন্তু এইখানে খোলা জায়গায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে….ছিঃ ছিঃ”
এইসব ভেবে সামিরার দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।আর না দাঁড়িয়ে পপির কাছে যাই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here