হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ৪

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ০৪)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
আয়াত আর আরিয়ানের দিকে তাকাতেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো,,,,,,,, এখন কি আমার পাশে আমার সন্তান আর ফাহাদের থাকার কথা ছিলো না ?
.
গাড়ির পেছন সিটে বসতে নিলেই আয়াত আমার সাথে বসার জন্য আমার পিছু লাগলো। তখনই আরিয়ানের ধমক,,,,, “আমি তোমাদের ড্রাইভার না”
আমরাও সুরসুর করে সামনে চলে গেলাম। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে আমি বসলাম, আমার কোলে আয়াত লাফিয়ে উঠে পরলো। যদিও প্রতি রাতে আমি এখানেই আরিয়ানের পাশে বসেই বাড়িতে যাই কিন্তু আজ আমি ওদের বাবা-ছেলেকে একান্ত সময় দিতে চাইলাম। তবে আমি জানতাম না, এদের ভালো করতে গিয়ে ধমক খাবো।….
.
হঠাৎ আরিয়ান আমকে বললো,
-তা কোথায় যাবে মিস পাখি ?
.
– তুমি ! তুমি করে বললো আমাকে ? এটা কি ঠিক শুনছি আমি ? নাকি আমার কানের সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেলো ? (মনে মনে)
.
-কি হলো চুপ করে আছো কেন, কিছু বলছো না কেন ? নাকি আমি সারা বিকাল সন্ধ্যা পথে পথে ঘুরবো ? (ধমকের সুরে)
.
-বাচ্চাদের যে ছোট পার্ক টা আছে সেখানে যাবো বলে আমরা বের হচ্ছিলাম। (আমতা আমতা করে)
সব সময় এতো ধমকায় কেন লোকটা ? অসহ্য,,,, (মনে মনে)
.
তারপর আরিয়ান আয়াতে সাথে কথা বলতে থাকলো। বের হওয়ার শুরু থেকেই আয়াত খুব খুশি। কিন্তু আমার কাছে চিন্তার বিষয় হলো আরিয়ানের গম্ভীর স্বভাব আজ আর নেই। আজ তার স্বভাব কিছুটা খোলা বইয়ের মতো লাগছে আমার কাছে। যেন সে চাইছে আমি তার স্বভাব দেখে ওনার মনটা পড়ে নিই। স্বভাবের প্রতিটা পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে খুব মনোযোগ দিয়ে পরি।
.
পার্কের সামনে গাড়ি থামতেই আমরা তিনজন নামলাম। পার্কের অপজিট সাইডে গাড়ি থামানো হয়েছিল অতএব আমাদের রাস্তা পার হতে হবে। হঠাৎ দেখলাম আরিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল রং ধারন করতে শুরু করেছে। হাত দুটো শক্ত করে মুট পাকানো। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম তিনটা মেয়ে রাস্তার অপজিটে দাড়িয়ে হাসাহাসি করছে। বয়সে তারা আমার থেকে দু তিন বছরের বড় মনে হলো। এই পঁচিশ ছাব্বিশ এমন। কিন্তু ওদের দেখে এভাবে রেগে যাওয়ার কি হলো বুঝলাম না।
.
তারপর আরিয়ান আয়াতের এক হাত ধরলো আর আমার এক হাত ধরলো। কিন্তু আমার হাতটা এতো জোরে ধরলো যেন হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরিয়ানের দিকে তাকায়ে দেখলাম, ওই মেয়ে গুলোকে এক পলক দেখে সামনে তাকিয়ে রাস্তা পার হতে লাগলো। কিন্তু সে আমার হাত এভাবে কেন ধরলো ? আমি তো একা রাস্তা পার হতে জানি। পার্কের গেইট দিয়ে ঢুকার সময় খেয়াল করলাম ওদের মধ্যে একটা মেয়ে, আমাকে যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। তার গায়ের চামড়া ফর্সা কিন্তু আমার মতো না। কেমন জানি ফ্যাকাসে। তবে তার সোনালী চুল গুলো গায়ের রং এর সাথে বেশ মানাচ্ছে।
.
মেয়েটাকে পরখ করে দেখার আগেই আরিয়ান আমার হাত ধরে ভিতরে ঢুকে গেল। ভেতরে ঢুকে আরিয়ান নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু হয়তো পারছিল না। তবুও আয়াতকে সময় দিচ্ছিলো। আমরা সবাই একসাথে অনেক গুলো রাইডে চড়লাম, আয়াতের সাথে খেলাধুলা, দৌড় -ঝাঁপ, আইসক্রিম, চকলেট….. খুব সুন্দর কাটলো আমার কাছে সময়টা। তারপর বাইরে থেকে আমরা রাতের খাবার খেয়ে বাড়িতে ফিরলাম। গাড়িতেই আয়াত ঘুমিয়ে গিয়েছিলো আমার কোলে, কাঁধে মাথা রেখে। ওকে কোলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে সোজা আয়াতের রুমে চলে গেলাম। বিছানায় ভালো করে শুয়ায়ে দিলাম। ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। টুপ করে একটা চুমুও দিলাম ওর কপালে। অনুভব করলাম আমার মাথায়ও কেউ হাত বুলাচ্ছে। খুব যত্নে। মাথা তুলে দেখলাম আন্টি। হাসি মুখে আমার পাশে বসে বললো,
-দেখেছো আয়াত এখন আর দশটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আগে কেমন চুপচাপ থাকতো।
.
-জ্বি হ্যা। (মিষ্টি করে হেসে)
.
-সবটাই তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে মা। আমি জানতাম ওর তোমাকেই খুব প্রয়োজন।
.
– ……….. (শুধু হাসলাম)
.
-আয়াতের মতো আমার ছেলেটাকেও একটুু স্বাভাবিক করে দেবে মা ? যেন ও আগের মতো হাসি খুশি আর চঞ্চল হয়ে যায় !
.
.
.
তার এই অদ্ভুত আবদারের কি উত্তর দিবো ভেবে পেলাম না। চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হয়তো তিনি আমার চোখ দুটো পড়ে নিলো। তার দুহাতের আঁজলায় আমার মুখটা তুলে ধরে কপালে একটা চুমু দিলো। আর বললো “নিজের মনকে প্রাধান্য দাও।”
কিছুক্ষন পর আমি তাকে মাথা নিচু করে বললাম,
-শাড়িটা পাল্টে আপনাকে দিচ্ছি।
.
-যদি আমার জায়গায় তোমার আম্মু তোমাকে শাড়িটা দিত তখনও কি তুমি তাকে শাড়িটা ফেরত দিয়ে দিতে ?
তার কথা শুনে আমি আবারও চুপ করে থাকলাম আর তিনি আবারও আমার কপালে একটা চুমু দিলেন। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেলেন।
.
আরিয়ান আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পার্স থেকে ফোন বের করার সময় আজও একটা চিরকুট পেলাম। তাতে লেখা ছিল,
“প্রকৃতির সৃষ্টি এতো সুন্দর আগে কখনো খেয়াল করে দেখিনি। বিধাতা হয়তো খুব সময় নিয়ে তোমাকে তৈরী করেছিল। আজ খুব সুন্দর লাগছিল তোমাকে।”
চোখ গেল আমার হাতের দিকে। যেখানে আরিয়ান শক্ত করে চেপে ধরে লাল করে আঙ্গুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে। ভাবছি যে হাত আমাকে ব্যাথা দিতে পারে, সেই একই হাত কি আমাকে প্রনয় পত্র লিখতে পারে ?……
.
খুব গভীর একটা ঘুমের প্রয়োজন আমার। কিন্তু ঘুমাতে পারলে তো। একটা সল্প মাত্রার ঘুমের অসুধ খেয়ে শুয়ে পরলাম। ভাবছি আয়াতের কথা, ওর মুখে মাম্মাম ডাক টা খুব সুন্দর মানায়।
.
হঠাৎ আমার রুমের দরজায় খুব জোরে জোরে করাঘাতের শব্দ পাচ্ছি। কেউ বার বার খুব জোরে দরজায় আঘাত করছে। আমার আম্মুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। রুমের লাইট জ্বালিয়ে ঘড়িতে দেখি রাত তিন টা বাজে। ঢুলতে ঢুলতে গিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম আমাকে হাত নেড়ে নেড়ে কিছু একটা বলছে। কিন্তু কি যে বলছে আল্লাহ্ জানে। এইবার আমার হাত টা জোরে করে ঝাঁকিয়ে বললো “বাইরের দরজার সামনে আরিয়ান আর আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। তোকে ডাকছে।”
বুঝতে পারছি না, আয়াতরা না হয় পাগলের বংশধর,,, তাই বলে শেষ মেষ আমার আম্মু টাও পাগল হয়ে গেল। রাত দুপুরে এই সব কি বকবক শুরু করলো। ঘুমে আমি তাকাতে পারছি না। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল আম্মু দরজার সামনে। তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই আরিয়ান আয়াতকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ান যেন খুব চিন্তিত আর ঘাবড়ে আছে। উফফ্,,,, সামনে গিয়ে বললাম,
-কি হয়েছে আপনাদের ?
.
-আয়াতের খুব জ্বর হয়েছে রাত থেকে। কোনো ভাবেই ওষুধ খাওয়াতে পারছি না। তাই জ্বর ও কমছে না। খুব কাঁদছে আর তোমার নাম ধরে ডাকছে। কোনো ভাবেই আমরা ওকে সামলাতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে তোমার কাছে আসলাম।
এরপর পাঁজা কোলা করে আয়াতকে আমার দিকে এগিয়ে দিলো।
.
কথাটা শুনে আমার ঘুম টুম সব উড়ে গেল। আয়াতের মুখটা এই কয় এক ঘন্টায় যেন উজ্জ্বলতা হাড়িয়ে বসেছে। শুকায়ে ঠোঁটের চামড়া টা শক্ত হয়ে আছে। পুরো মুখ কেমন লাল হয়ে আছে। নিঃশ্বাস ছারার সময় বুকটা খুব বিশ্রী ভাবে ভেতরে দেবে যাচ্ছে।
.
আয়াতকে এ অবস্থায় দেখে মনে হলো আমার ফুসফুসে কেউ এক বোতল এসিড ঢেলে দিয়েছে। খুব জ্বলছে বুকটা। ওকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলাম। এতে আরিয়ান শান্তির নিঃশ্বাস নিলো। ওকে দেখে মনে হলো আয়াতকে আমার কোলে দিয়েই ওর সব চিন্তা শেষ। আমার শরীরই যেন আয়াতের অসুস্থতার ওষুধ। আমার সংস্পর্সে এলেই ও সুস্থ হয়ে যাবে।
.
ওকে কোলে করে খুব দ্রুত আমার রুমে ঢুকলাম। পিছে আরিয়ান ও দৌড়তে দৌড়তে ঢুকলো……..
.
আয়াতকে আমার বিছানায় শুয়ায়ে দিলাম। ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি এনে ওর মাথা ধুয়ে দিলাম। আম্মু অল্প করে খাবার গরম করে এনে দিল। আস্তে আস্তে আয়াতকে খাওয়াতে লাগলাম। আর সেও চুপচাপ আমার কথা শুনে খেয়ে নিলো। তারপর ওকে ওষুধ খাওয়ায়ে দিলাম। আরিয়ানও এসবে আমাকে খুব সাহায্য করছিলো। তারপর ওর পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলাম। আস্তে আস্তে ও ঘুমিয়ে পরলো। এর মাঝে ফাহমিদা আন্টি বেশ কয় একবার ফোন করে আয়াতের খোঁজ নিয়েছে।
.
আরিয়ানও আমার অপজিটে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেল। আমার আম্মু অনেক আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, তার ব্লাডপ্রেশার এর সমস্যা আছে। আমি উঠে গিয়ে আমার রুমের দরজা টা ভলো করে খুলে দিলাম। তারপর আবার আগের জায়গায় বসে ওর মাথায় জলপট্টি দিতে থাকলাম।
.
ভাবছি আমার ভাগ্যের কথা। এই গভীর রাতে অন্য কারো স্বামী সন্তান আমারই ঘরে, আমারই বিছানায় ঘুমাচ্ছে। আর আমিও কত সুন্দর করে ওদের সেবা করছি। হায়রে আমার ভাগ্য……! মাথাটা ভনভন করছে। একে তো স্লিপিং পিল খেয়েছি তারউপর আমার কলিজার এই অবস্থা।
.
শেষ রাতে আমিও ওখানে আধ শোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। ঘুমের মাঝেই মনে হলো কারোর গরম নিঃশ্বাস আমার মুখের উপর পরছে। এতো ঘুম লাগছে যে চোখ দুটোও জোর করে খুলতে পারছি না……
·
·
·
চলবে………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here