#হয়ত
পর্ব:- ১৭
.
আজ তনয়া বেগমের চোখের সামনে ভাসছে কিছু পুরনো দৃশ্য। দুজন বালিকা মেয়ে পুকুরে শাপলা তুলছে, সাঁতরে বেড়াচ্ছে নিজেদের মতো। পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে। গ্রীষ্মের দুপুরের কড়া রোদকে উপেক্ষা করে বাগানে কাঁচা আম পাড়ছে। সেই কাঁচা আম নুন মরিচ দিয়ে কচলে কচলে মাখিয়ে খাচ্ছে। বালিকা দুজন তনয়া তনিমা।
আহা কী সুখের দিন ছিল!
তবে সুখের দিন বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশ একসময় এসে আছড়ে পড়ে তনয়াদের পরিবারে। তনয়া জানতে পারে বিগত তেরো বছর ধরে মা ডেকে আসা মানুষটা তনয়ার নিজের মা নয়। জন্মদাত্রী মা যে জন্ম দিয়েই প্রেমিকের হাত ধরে রাতের আঁধারে পাড়ি জমিয়েছিল দূর অজানায়। তনয়ার ছোট মনটা তখন কাচেঁর ন্যায় চুরমার হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে মা ডেকে আসা মানুষটা ধীরে ধীরে ছোটমা হয়ে যায়। বিদেশ বিভুয়ে বাবা কাশেম হাওলাদার তখন দেশের বাড়ির পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞাত। নতুন সনাক্ত হওয়া সম্পর্ক নিয়ে বিচলিত তনয়ার অন্তরে এক সময় হিংসার গুটি পোকা বাসা বাঁধতে থাকে। বোন তনিমার সাথে দহরম-মহরম সম্পর্কে ছেদ পড়তে শুরু করে। কিন্তু বাচ্চা তনিমার মিষ্টি বুবু ডাক তনয়াকে কখনো কঠোর হতে দেয়নি। তনিমার সামনে কখনো অন্তরে প্রোজ্জ্বলিত হিংসার অনল ফুটিয়ে তুলতে পারেনি তনয়া।
তবে অন্তর আত্মায় জ্বলমান হিংসার বাঁধ একসময় ভেঙে যায়।
ঘটনা ঘটে পাত্রপক্ষের তনয়াকে দেখতে আসার দিন। বিয়ে ঘটিত কারনে ছেলেপক্ষ বা মেয়েপক্ষ আসে পাশের পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ছেলে বা মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ নেয়। তনয়ার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। তবে তনয়ার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মায়ের পরপুরুষ সম্পর্কিত দোষ ছিল। তবুও পাত্রপক্ষ ঠিকই তনয়াকে দেখতে এসেছিল। দেখতে আসার কারন ছিল তনিমা।
তনয়া তনিমা দুজনের চেহারাতে মিল স্পষ্ট। তাহলে আগত পাত্রপক্ষের তনয়াকে কেন পছন্দ হলো না এই বিষয়টা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না তনয়া ।
কাশেম হাওলাদার তখন দেশে। বড় বোনকে দেখতে এসে ছোট বোনকে পছন্দ করার ঘটনা মেনে নিতে পারেননি কাশেম সাহেব। তিনি কোন মতেই ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নয়।
কিন্তু আত্মীয় স্বজনের মতে এমন পাত্রকে না বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। এমনিতেও মায়ের কুকীর্তির কারনে তনয়ার বিয়েতে সমস্যা হবে। সেই সমস্যার কথা মাথায় রেখে তনিমার কথা চিন্তা না করা বোকামি। এক প্রকার চাপে পড়েই বিয়েতে রাজি হন কাশেম হাওলাদার।
.
সদ্য তারুণ্যে পা রাখা তনিমার মন ছিল তখন অন্য কারো দখলে। সহপাঠী ফরিদ আহমেদ নামক ছেলেটি ওর স্বপ্নের রাজ্যের একমাত্র রাজকুমার। মিষ্টি খুনসুটিময় প্রেম সম্পর্কে সবটাই জানতো তনয়া। বুবুর কাছে কখনোই কোন কথা গোপন রাখতে পারতো না তনিমা। বিয়ে ভাঙার এই উপগমন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি তনয়া। বোনের প্রতি অন্তরে জন্ম নেওয়া পূর্ববর্তী হিংসা এসময় অগ্নিকুণ্ডে রূপ নেয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ” বিয়ে করলে তাকে দেখতে আসা ছেলেকেই করবে, অন্য কাউকে নয়।”
.
বিয়ের দিন ক্রন্দনরত তনিমাকে বিয়ের আসর ছেড়ে পালানোর জন্য প্রভাবিত করতেই কনের ঘরে গিয়েছিল তনয়া। তারুণ্যে পদর্পন করা তনিমা পরিবারের কথা ভেবে মেনে নিয়েছিল এই অপ্রত্যাশিত বিয়ে। তবে বুবুর সহায়তায় ভালোবাসার মানুষটির সাথে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় সে। বাড়ির সবাই তখন পাত্রপক্ষের খাতির দারিতে ব্যস্ত।
কনে পালিয়েছে কথাটা যেন বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল। কনে ছাড়া পাত্রপক্ষের ফিরে যাওয়া চরম অপমানের। বাধ্য হয়েই সে সময় তনয়াকে তনিমার জায়গায় বউ সাজে সজ্জিত করা হয়। তিন কবুলের মধ্য দিয়ে সফল হয় তনয়ার পরিকল্পনা। তবে শ্বশুর বাড়িতে মন পাওয়া যাচ্ছিল না কারও। শাশুড়ির মন পেতেই দ্রুত বাচ্চা নেয় সে। ধীরে ধীরে সকলের মনে ঠিকই নিজের জন্য জায়গা করে নিতে সমর্থ হয় তনয়া।
তবে ছোট বোনটার খোঁজ নেওয়ার কোন চেষ্টাই সে করেনি। ভয় পাচ্ছিল, যদি তনিমা সবাইকে বলে দেয় পালিয়ে যাওয়াতে তনয়ার হাত আছে? তখন কী হবে? এত বছরের সাজানো সংসার বোনের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে যেয়ে যে ভেঙে যাবেনা তার নিশ্চয়তা কী?
.
বিছানায় বাম পাশে কাত হয়ে শুয়ে আছেন তনয়া বেগম। কিছু অতীত সত্যি বেদনাময়। এক সূক্ষ্ম ব্যাথা তার অন্তরে জ্বালা সৃষ্টি করছে। স্মৃতির দৃশ্যপটে ভেসে আসছে পাউসার নামক গ্রামটা। তনয়া বেগমের বাপের বাড়ি।
চার বছর হলো কাশেম হাওলাদারের মৃত্যুর। অনেক সম্পত্তি করে ছিলেন তিনি মৃত্যুর আগ অবধি। মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন তনয়া বেগম। তবে তনয়া বেগম বাপের সম্পত্তি একা ভোগ করতে চাননি কখনো। এই সম্পত্তি তার একার নয়। ছোট বোনের অধিকারও আছে। তিন বছর আগে তনিমা বেগমের সাথে দেখা করে উনার সম্পত্তির ভাগ উনাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তবে ছোট বোনটা সেদিন শুধু বলেছিল,
‘বুবু তুমি নিজে এসেছো এটাই আমার কাছে অনেক বড়। আমার এই সম্পত্তি লাগবে না। তুমি কী একটু বসবে আমার সামনে? কত দিন তোমাকে দেখি না। এখন প্রাণ ভরে দেখবো তোমাকে।’
তনয়া বেগম সেদিন তার সুন্দরী বোনকে চিনতে পারছিলেন না। শরীর শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। ছোট দুই কামরার বাড়িতে তিনজন মানুষ থাকে। ডায়নিং টেবিল, ফ্রিজ কিছুই নেই ঘরে। শুধু একটা ঘরে খাট আছে। আরেকটা ঘর ফ্লোরিং বেড পাড়া। সোফাটার নড়বড়ে অবস্থা; দুজন বসলেই ভেঙে পড়বে। একটা আলনা রয়েছে যাতে কাপড়ের স্তুপ। প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়ে সেলাইমেশিন আর তার পাশে অর্ধ ভাঙা চেয়ারে অনেক কাপড়।
তনয়া বেগম ছোট বোনের হাতের দিকে তাকান। রুক্ষ এব্রো থেব্রো হাতের গঠন। সুন্দরী বোন আর সুন্দর নেই।
বুকের ভেতর থেকে কান্না বেড়িয়ে এসেছিল সেদিন। ওই টুকু বয়সে মেয়েটাকে কুবুদ্ধি দিয়ে বাড়ি ছাড়া করা উচিত হয় নি তার। পাপ করেছিলেন তিনি।
রাজশাহী থেকে ফিরে বোনের সাথে কথা বলতে দ্বিধা লাগতো। ফোন দিলেও ফোনটা ধরেননি। তনিমা বেগমের মৃত্যুর দিন তাপৌষি মেয়েটা উনাকে অনেক বার ফোন দিয়েছিল। সেদিনও উনি ফোন ধরেন নি। এক দিকে সংসার ভাঙার চিন্তা অন্যদিকে বোনের অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবা। সব দিক দিয়ে যেন শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল তনয়া বেগমের জন্য।
তবে বোনের মৃত্যুর কথা শোনা মাত্র রাজশাহী চলে যান তিনি। ফরিদ আহমেদকে বাড়িতে পাওয়া যায় নি। তাপৌষির সাথে অপরিচিত এক বুয়া নাকি তিনদিন ধরে থাকে! খুটিয়ে খুটিয়ে তাপৌষিকে দেখছিলেন তিনি। অনেক দিন পর পরিচিত মুখ দেখলে যেমন মানুষ হামলিয়ে পড়ে গায়ের উপর, তাপৌষিও সেদিন কাঁদতে কাঁদতে হামলিয়ে পড়েছিল তনয়া বেগমের উপর।
তনয়া বেগম মোট চারদিন ছিলেন রাজশাহীতে। শেষ দিন ফরিদ আহমেদ ফিরলে তনয়া বেগম তাপৌষিকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তার নিকট ব্যক্ত করে। তবে ফরিদ আহমেদ সেদিনই তনয়া বেগমের ইচ্ছা নাকোচ করে দেয়। দুইদিন পর তাপৌষি নিজেই ঢাকা আসতে চায় বলে তনয়া বেগমকে ফোনে জানায়। কমলাপুর স্টেশনে নিজে যেয়ে তিনি তাপৌষিকে নিয়ে আসে।
.
.
চলবে…