তোমার পরিনীতা – ২
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ বিষয় বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো )
অফিসে ঢুকেই আগে গলায় টাইয়ের নটটা ধিলা করলো শ্রাবণ। দশটায় একটা মিটিং আছে, বেল টিপে অফিসের পিয়ন বাবুলকে ডাকলো ও। মিটিং এর পরে আবার কোর্টে ছুটতে হবে, তারপর বাবার বন্ধুর সেই জমি দেখতে।
মাথার যন্ত্রনায় কপালের দুপাশ কিছুক্ষন চেপে ধরে বসে থাকলো শ্রাবন। গত দুই দিন ধরে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না ওর ঠান্ডায়, এক নাক সব সময় বন্ধ হয়ে থাকছে। কফি না খেলে এখন মরে যাবে ও।
“জ্বী স্যার,” পিয়নের ডাকে চোখ তুলে তাকাল শ্রাবন।
“ম্যানেজার সাহেবকে বলো আমি ডাকছি”
“জ্বী স্যার।”
“আমাকে এক কাপ কফি দিতে বলতো”
“জ্বী স্যার।”
পিয়ন বেরিয়ে যেতেই চেয়ারে আরাম করে গা এলিয়ে দিল শ্রাবণ। কিন্তু টেবিলে রাখা মোবাইলটাও তক্ষনি নাচানাচি শুরু করে দিলো। বিরক্তির সাথে দুই সেকেন্ড সেটাকে দেখলো শ্রাবন। শেষে হাতটা বাড়িয়ে দিলো।
বড় ভাই শান্তনুর ফোন।
“হ্যালো বদ্দা বলো…”
“শ্রাবণ আমার টিন নাম্বারের কপিগুলো পাচ্ছি না, কোন ফাইলে যে রাখলাম, তোর কাছে কপি থাকলে একটা পাঠিয়ে দে।”
“আচ্ছা, তুমি কোথায়?”
“আমি রেজিষ্ট্রি অফিসের সামনে, রতনের কাছ থেকে সাড়ে সাত কাঠার প্লটটা নিয়ে নিলাম , তুই আর্জেন্ট কাগজটা পাঠা।”
“আচ্ছা…… ”
ফোনটা রাখতেই আবার ব্রি ব্রি করে ডিস্কো ড্যান্স করতে লাগলো অসহায় ফোনটা। স্ক্রীনে শ্রাবণের চোখ পড়তেই দেখলো আননোন একটা নাম্বার। শ্রাবণের মনে হলো একটা আছাড় দিয়ে ফোনটার চৌদ্দটা বাজায়। অফিসে এসে বসতে পারলনা শুরু হয়ে গেছে।কোর্টে ঢোকার আগ পর্যন্ত এখন এই অত্যাচার চলতেই থাকবে, ভাইব্রেশন বন্ধ না করলে। একবার মনে করলো ফোনটা ধরবেই না। কিন্তু নতুন কোন মক্কেল হলে বাবার ঝারি খেতে খেতে দিন যাবে, বিরস মুখে ফোনটা রিসিভ করলো শ্রাবণ।
ফোনের ওপাশ থেকে মৌমিতার গলার স্বর ভেসে এলো,” শ্রাবণ প্লিজ রাগ করিসনা অফিস টাইমে ফোনটা করলাম বলে, আমার আগের মোবাইলটা না টাটা বাই করেছে হাত থেকে পড়ে গিয়ে।”
মৌমিতা ব্যাানার্জী, কলেজে শ্রাবণের ব্যাচমেট আর ভীষন ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও। মৌমিতা দারুন সুন্দরী আর প্রান প্রাচুর্যে ভরপুর একটা মেয়ে। মৌমিতা কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করে, গিটার বাজিয়ে গান করে আবার ভালোবাসে নিজে কবিতা লিখতেও। বাড়ির কাছেই নিজের ছোটখাট একটা বুটিক খুলেছে। কপালে সবসময় ছোট্ট একটা টিপ পড়ে। সবাই বলে বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে ওদের দুজনের মধ্যে,কিন্তু শ্রাবণ আর মৌমিতা সেটা নিয়ে কখনই মাথা ঘামায়না।
“ধুস, তুই…. আমি তো মনে করলাম ”
“কি হ্যা? কি মনে করলি…? ”
“মনে করলাম রং চটা বিবর্ণ টেকো মাথা কোন আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ো বলবে, আমার জমি নিয়ে একটা কেস ছিলো বাবা।”
“ইশশশ… তাহলে তো তোর অনেক লস হয়ে গেলো। অমন টাকার খনির বদলে উল্টো ভিক্ষের ঝুলি হাতে এক শীর্ণ তরুনী বড়ই বেখাপ্পা। ”
“তা একটু বেখাপ্পা তবে তোর এই রিনরিনে সুরটা আমার মেজাজকে আইস কুল করে দিয়েছে.. নাউ অ্যাই ক্যান রান মোর দ্যান হান্ড্রেড মাইলস।”
“ওহ রিয়েলি.. নাকি আমাকে ফু দিয়ে বাতাসে উড়োচ্ছিস? আমি কিন্তু বেলুন না।”
“একদম সত্যি বলছি, তোর ফোনটা মনটা ভালো করে দিয়েছে। কিন্তু তুই ফোন কেন করেছিস সেটা আগে বল।”
“বলছি, আমাদের সাথে পড়তো লাবন্য মেয়েটার কথা মনে আছে।”
“হ্যা, ওকে মনে থাকবেনা কেন? কিন্তু হঠাৎ ওর কথা কেন? ”
“কারন আছে। আসলে ওর দিদির বিয়ে আগামী বুধবার, আমাদের সার্কেলের সবাইকে দাওয়াত করেছে। এখন ওদের বাড়ি থেকে আসতে তো রাত হবেরে অনেক, আমায় তুই একটু বাড়ি পৌছে দিতে পারবি? ”
“তো বিয়ের রাতে ফেরার দরকারটাই বা কি? লাবন্যদের বাড়িতে তো রাতভর লোক থাকবেই, তাদের সাথে মজা করবি।”
“সে থাকলেও আমাকে চলে আসতে হবে রে। বাবার শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে আজকাল। হুট হাট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে, দাদা বাড়ি নেই। আমি বাড়ি না থাকলে বাবা যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে মা একা কিছুতেই সামলাতে পারবে না।”
“বুঝলাম…. ”
“এখন তুই আমাকে রাতে বাড়ি দিয়ে যেতে পারবি কিনা বল, নইলে আমার যাওয়াও হবে না, ” মৌমিতার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো, লাবন্যদের বাড়ি অনেকটা দূর ওদের বাড়ি থেকে। কিন্তু বিয়েটাতে যেতে মন চাইছে। সব বন্ধুরাই প্রায় আসবে।
“তুই অমিয় কে বলে দেখতো একবার। ও না পারলে আমি দেখি আসার চেষ্টা করবো।আসলে সারাদিন কাজ করে আর বের হতে ইচ্ছে হয়না। আর লাবন্যর সাথে আমার ঠিক অতোটা বন্ধুত্বও কিন্তু নেই।”
“কিন্তু লাবন্য তোর কথা বলেছে বার বার, কার্ডও দিয়েছে।”
“আমি কিন্তু একটা ফোনও পাইনি ওর কাছ থেকে। আর এখন কার্ড কেউ দেখে নাকি?”
“লাবন্যকে ফোন দিতে বলবো? আমার কাছে তোর কার্ডটা দিয়ে দিয়েছে কিন্তু।”
“থাক লাগবেনা, সময় করতে পারলে যাবো, আর না করতে পারলে নাই।”
“তারমানে আমার যাওয়াটাও অনিশ্চিত।”
“মৌ তুই আমাকে জ্বালিয়ে খেলি।”
“তা একটু – আধটু জ্বালানোর অধিকার তোকে আমার আছে বৈকি, পরীক্ষার হলে তোকে কম হেল্প করিনি বাচ্চু। ”
শ্রাবণ হাসলো, ” আচ্ছা যা চেষ্টা করবো।”
“না কথা দে, না হলে আমি বেরোবই না।”
“ঠিক আছে বাবা আসবো… খুশি? এখন রাখ। ”
হুমম, মৌমিতা খুশিতে আটখানা। শ্রাবণ রাজি না হলে ও আসলে অত রাতে বাড়ি ফিরতেই পারবেনা। শ্রাবনটা হ্যা বললো মানে যে করে হোক আসবে।
…………………………………..
সুমন কোন ভাবেই শ্রাবনের জন্য শার্টের কাপড় পছন্দ করতে পারছেনা। আর যেটার কাপড় পছন্দ হচ্ছে তার রঙ পছন্দ হচ্ছে না। কি জ্বালায় পড়লো ও, না পেরে শ্রাবনকেই ফোন দিল আবার। কিন্তু ফোন কেবল বেজেই যাচ্ছে কেউ ধরছে না। কিন্তু শ্রাবনদা কোর্টে ঢুকলে ওকে বলে ফোন সাইলেন্ট করে। তাহলে?
বিশ বার কল করে করে শেষে বাদ দিলো সুমন। কোনটাই ওর তেমন মনে ধরছে না। আর এখন শ্রাবনদা ফোন ধরেনি এতেই ওর ভয় হচ্ছে।
এরআগে হালকা গোলাপি একটা কাপড় দেখেছিল শার্টের জন্য, বার বার কেবল সেটাই সুমনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একজনকে কিছু টাকা সাহায্য করতে চেয়েছিলো, শ্রাবনের শার্ট না কিনে সেটা করাও ঠিক হবে না। কান্না পাচ্ছিল ওর।
“ধুর ছাই.. কক্ষনো আমার ফোন ঠিকমতো ধরে না,” রাগে কোট দুটো নিয়ে গাড়ির দিকে হাটতে লাগলো সুমন। গাড়িতে কোট দুটো তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে চলে যেতে বললো বাড়িতে। সামনে একটা দোকানে অনেকগুলো নোট ফটোস্ট্যাট করতে দেয়া আছে সুমনের তিনদিন আগে। ব্যাটা ওরে খালি ঘুরাচ্ছে আজ দেই কাল দেই বলে। ব্যাটাকে আজকে একটা রাম ধমক দিতে হবে.. মন খারাপ করে ফটোস্ট্যাটের দোকানে ঢুকলো সুমন।
“দিদি দশটা মিনিট একটু বসেন, এতক্ষন কারেন্ট ছিল না কুনো কাজই করতে পারি নাই।” ফটোস্ট্যাট এর দোকানের লোকটা সুমনকে স্বান্তনার বানী শোনাল।
সুমনের মনে হলো রাগে বেলুনের মতো টাশ করে ফেটে যায়। মানুষ এতো খারাপ হয়? গতকালও বলেছিল আর দশ মিনিট। ক্লাসের দেরী হচ্ছিল বলে কাল নেয়নি সুমন আর আজকেও একই অবস্থা। কড়া করে একটা ধমক দিতে চেয়েছিল ফটোস্ট্যাটের লোকটাকে, কিন্তু এখন ওর চিল্লাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শ্রাবনদা ওকে কিছুই বলবেনা শার্টের কাপড় কিনে বানাতে না দেওয়ার জন্য কিন্তু এতেই ওর বেশি মন খারাপ হচ্ছে। ওর উপর বিশ্বাসটা অনেক বেশি বলেই হয়তো কিছু বলবেনা শ্রাবনদা আর ও সেই কাজটা না করেই চলে আসলো। কিন্তু ওই কাপড় পরে মেয়ে দেখতে যাবে, তাহলে কাপড়গুলো সুন্দর হওয়া উচিত না? শ্রাবনদাকেও তো মেয়ে পক্ষের পছন্দ হওয়া চাই।
সুমনের গম্ভীর মুখ দেখে দোকানের মালিক একটা কোকাকোলা আনিয়ে দিলেন দ্রুত পিচ্চি অ্যাসিস্টেন্টটাকে দিয়ে। কোকের বোতলটা হাতে নিতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো সুমনের। কোকাকোলা শ্রাবনদার ফেভারিট, সুমন কোল্ড ড্রিংস বেশিরভাগ সময় এভোয়েড করে। না খেয়ে আস্তে করে কোকের বোতলটা নিজের ব্যাগে চালান করে দিলো সুমন।
…………………….
কোর্ট থেকে বের হয়ে মোবাইল চেক করতে গিয়ে চোখ কপালে উঠলো শ্রাবনের। সুমন কল করেছে কম করে বিশ বার। মহারানীর কি এমন দরকার পড়লো ওকে যে বিশবার ফোন দিতে হলো, শ্রাবন বুঝলনা। সুমনকে রিং করতেই ওপাশের যান্ত্রিক স্বরটা ক্রমাগত বলতে লাগলো’ আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। ‘
“খেয়েছে… আজ বলা হয়নি ফোন সাইলেন্ট করার আগে,” নিজেকেই বিরবির করে বললো শ্রাবন।
গাড়ি স্টার্ট করতেই আবার পকেটের মধ্যে ধেড়ে ইঁদুরের মতো লাফাতে লাগলো ফোনটা। কলার আইডি চোখে পড়তে মুচকি হাসলো শ্রাবন। বড় বাঁচা বেচে গেছে, সুমো রাগ করেনি। নাহলে পুচকিটা নিজে থেকে কখনই ফোন করতো না, অভিমানী আছে বড্ড।
” হুমম বল ”
“শ্রাবনদা কোথায় তুমি? আমি কত্তোবার ফোন দিয়েছি তুমি জান? ”
“আমি কোর্টের মধ্যে বসে আসামীর সাথে হাই হ্যালো করছিলাম। এখন তুই কই সেটা আগে বল।”
“বাড়ি ফিরছি শ্রাবনদা… কিন্তু তুমি কই সত্যি করে বলো? ”
“আমি…
বাবার এক বন্ধু আছে বুঝলি, ওনার একটা জমি দেখতে যাবো, ওখানে অরেক লোক জোর করে মার্কেট করছে তাকে ঝেটিয়ে খেদাতে হবে।”
“ওহ… ”
“হুমম.. কিন্তু তুই ফোন করেছিলি কেন?”
“শ্রাবনদা…. ”
“কি ব্যাপার তোর গলার স্বরে অপরাধের গন্ধ পাচ্ছি কেন সুমো? কি করেছিস? ”
“তুমি বকবে না আগে বলো।”
“আচ্ছা….”
“দিব্যি… ”
কথাটা শুনে শ্রাবনের নিপাট ভালো মানুষের মতো কপালটা কুঁচকে গেল নিমেষেই।
“দিব্যি! দিব্যি কেন? ”
“না হলে আমি বলবোনা,তুমি যদি বকো”
“আমি বকি?”
“তুমি মারও.. আমার হাতে এখনো দাগ আছে”
“সো তো কতকাল আগে ”
“ওসব জানিনা আগে দিব্যি দাও”
“আচ্ছা….” সুমনের কাছে পরাস্ত হয়ে রাজি হতে হলো শ্রাবনকে।
“না না ওভাবে হবে না, বড়মার দিব্যি দাও যে তুমি আমাকে বকবে না।”
“সুমো… এবার তোকে আমি একটা আছাড় দিয়ে তোর নাটবল্টু সব খুলবো। তোর এতো বড় সাহস তুই আমার মায়ের নামে দিব্যি কাটতে বলছিস, ডেপো মেয়ে কোথাকার।”
শ্রাবনের ধমক খেয়ে সুমন চিন্তায় পড়ে গেল, না বড়মার দিব্যি দিয়ে কাজ নেই। শ্রাবনদা মিথ্যে বললে বড়মার কিছু হলে তখনতো ঘোর বিপদ।
“আচ্ছা তাহলে এমন কারো নামে দিব্যি দাও যাকে তুমি অনেক ভালোবাসো, তাহলেই হবে।”
“আচ্ছা তাহলে তোর নামে দিব্যি দেই কেমন, তোকেও তো অনেক আদর করি, ” শ্রাবন ইচ্ছে করে সুমনের নাম নিলো। সুমন এসবে খুব বিশ্বাস করে জানে শ্রাবন।
“না না শ্রাবনদা, আমাকে দিলে তো হবে না ”
“কেন আমি মিথ্যে বললে তুই মরবি তাই? কত নাম্বার চাল্লুরে তুই ”
“শ্রাবনদা আমার কান্না পাচ্ছে”
“তুই ঝেড়ে কাশ তো এতো বাহানা মারা বাদ দিয়ে। আচ্ছা কাউকে প্রেমপত্র দিসনি তো?” শ্রাবন হঠাৎ সিরিয়াস হলো, সুমো বড় হয়ে যাচ্ছে দিন দিন… খেয়াল রাখতে হবে। কবে যেন প্রাইভেট থেকে ফেরার সময় এক ছেলের সাথে গল্পে মশগুল ছিল, শ্রাবন পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে তবু সুমন খেয়াল করেনি। শ্রাবন অবশ্য খবর নিয়েছে পরে , ছেলেটা সুমনদের ক্লাসেরই ফার্ষ্ট বয় অজিত, তাই আর বেশি কিছু বলেনি। তবে রাস্তায় অমন গল্প করতে করতে চলা যে কত বিপদজনক সেটা সুমনকে বলতে ভুলেনি।
“আ.. আমি? আমি এতো খারাপ মেয়ে না।”
“গুড এবার বল কি সমস্যা পাকিয়েছিস? ”
“তোমার শার্টের কাপড় কেনা হয়নি, আমি না পছন্দই করতে পারিনি,” বলেই ভ্যা করে কেঁদে দিলো সুমন।
সুমনের কান্না শুনে ভ্যাবাচেকা খেল শ্রাবন।
” অ্যাই তুই থাম সুমো, এটা একটা কারন হলো কান্নার, আমি মনে করলাম কি না কি।”
“তুমি রাগ করনি শ্রাবনদা ”
“আমি তোর মতো বোকা নাকি যে সব কথায় ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদব ”
শ্রাবনের কথায় মনটা একটু শান্ত হলো সুমনের।
“আচ্ছা তাহলে আমি রাখছি ”
“হুমম.. আচ্ছা তুই কিনিসনি কেন কাপড়?”
“রঙ আর কাপড় কিছুই ভাল ছিল না।”
“তাহলে অন্য কোথাও দেখবি?”
“আচ্ছা কাল চেষ্টা করবো।”
“সুমি তুই এক কাজ কর… তুই আমার সাথে চল, জমিটা দেখে ওখান থেকে আসার সময় কাপড় কিনে দিয়ে আসলেই হবে।”
শ্রাবনের আমন্ত্রনে একশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে উঠলো সুমনের চেহারায়। শ্রাবনদা কোথাও নিয়ে যাওয়া মানে ভালো ভালো খাবার খাওয়া ফুচকা,আইসক্রিম, কেক আর বাড়িতে এসব কালে ভদ্রে জোটে সুমনের।
চলবে…
তোমার পরিনীতা – ৩
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮ + কন্টেন্ট বিদ্যমান…. কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো )
“শ্রাবনদা…. ”
“হুমম…”
“এই লোকগুলো এতো খারাপ কেন… অন্যের জায়গা জোর করে দখল নিয়ে নিচ্ছে।”
“হুমম… ”
“কি খালি হুম হুম করছো।”
সুমন যারপরনাই বিরক্ত। শ্রাবন একমনে কাগজের পর কাগজ ঘেটে যাচ্ছে। কি উদ্ধার করতে চায় কে জানে। অথচ ওদের আশেপাশের জায়গাটা কিন্তু খুব সুন্দর। ইচ্ছা হলেই ওরা নদীর ধারটা ধরে হেটে আসতে পারতো, এমনকি নদীর পাড়ের ছোট্ট নৌকাটা নিয়ে একটু ঘুরতেও পারতো। কিন্তু কাগজের গাদায় বসে থাকা উকিলকে সেটা কে বোঝাবে। পাশের বাড়ির রুমাবৌদি ঠিক বলে, তোর শ্রাবণদা নামেই বুদ্ধিমান কাজের বেলায় ঠনঠনা।
তবে এর আসল কারনটা সুমন জানে, রুমাবৌদি নিজের ঘরের জানালা থেকে প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে শ্রাবণদাকে দেখে, যখন সামনের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে শ্রাবনদা কফি খেতে খেতে কেস স্টাডি করে। শ্রাবনদা সেটা জানে কিনা সুমন জানেনা, তবে ফাইলে ডুবলে এই লোক তার সামনে না কিছু দেখে আর না কিছু শোনে।
ফুরেফুরে বাতাসে দূরের ধানক্ষেতটা তখন সমুদ্রের মতো দোল খাচ্ছে,সবুজ ক্ষেতের আল ধরে অলস ভঙ্গীতে হেলেদুলে হাটছে একটা মা ছাগল। তার পাশেই তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে চলছে ছোট দুটো ছানা। এর মাঝেই গোল চক্কর কেটে টুপটাপ বৃষ্টির মতোই কোন বাড়ির টিনের চালে ঝপঝপ করে বসে পড়ছে কবুতরের দল। সুমনের খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওখানে ছুটে যেতে। কিন্তু কাগজের স্তুপে ডুবে থাকা লোকটাকে বলতে কোনভাবেই সাহস হচ্ছে না, জানে তে কি ভীষন কাজ প্রিয় সে।
তাছাড়া সুমন এখন জানে যে, ও আর এখন আগের মতো ছোটটি নেই। তাই মনের খুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করা ওর আর সাজে না… তাই এখন আর আগের মতো আমগাছ, পেয়ারা গাছে টহল দিয়েও বেড়ায় না। ওর বাড়ন্ত শরীরটা দেখে যে অনেকেরই চোখ লোভে চকচক করে সেটা বোঝে এখন সুমন। মোড়ের দোকানটায় যাবার সময় তাই ওড়নাটা ভাল করে গায়ে জড়ায়, বিলু নামের এক কেন্নো প্রায়ই অশ্লীল কিছু বলতে চায় দেখলেই।
“কি রে অমন হুতোম প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেন?” শ্রাবন ফাইল থেকে একটা কাগজ বের করে তারিখ মেলাতে মেলাতে জিজ্ঞেস করে, পাশে রাখা ফটোকপির সাথে।
“এমনি। ”
“আর দশ মিনিট অপেক্ষা কর, এই জমিতে অনেক প্যাঁচ বুঝলি… যে মার্কেট করছে সেও এক রকম জমির দাবীদার বের হচ্ছে। কেসে জিততে গেলে অনেক প্রমান লাগবে।”
শ্রাবণের কথায় সুমনের মন তিল মাত্র প্রশান্তি পায় না। ওর ফুচকা খাওয়া আজ বুঝি আর হলোনা। এই করেই শ্রাবনদা আজ দিন পার করবে। এর চেয়ে তো বাড়ি গিয়ে, মোড়ের মাথার ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ঝালমুড়ি মাখা খাওয়া ঢেড় ভালো ছিল.….. শুধুই শুধুই ও মামীর কাছ থেকে কথা শোনার ব্যবস্থা করলো।
শ্রাবণ কাজ শেষ করে দেখে পুচকিটা রেগে টমেটো হয়ে গেছে। বুকের কাছে কলেজের ব্যাগটা ধরে রেখেছে যক্ষের ধনের মতো আর মাঝে মাঝে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছছে।
“কি রে সুমো কাঁদছিস কেন? মানুষ কি বলবে এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে ”
“আমি একটুও শব্দ করে কাঁদছি না শ্রাবনদা আর তুমি আমার সাথে আজ চিটিংবাজি করেছ। তোমার সাথে আমার কাট্টি, কথাই বলবো না।”
“ওই… মারব এক গাট্টা। কোথায়… কি চিটিংবাজি করলামরে? ” সুমনের কানের কাছে মারতে গিয়ে আবার হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে আসলো শ্রাবণ। নাহ বেচারি দুপুরে খায়নি,থাপ্পর খেলে ফিট লাগবে।সুমন ততক্ষণে ভয়ে মাথাটা দূরে সরিয়ে ফেলেছে।
“করেছ.. আমি সেই কখন থেকে এখানে বসে আছি, কিচ্ছু খাইনি,” সুমন ঠোঁট ফুলালো। আজ বড়মাকে না বলেছি তো আমার নাম সুমো না। বাদর একটা ছেলে বানিয়েছে, দুধ কলা খাইয়ে।
“তো……? ”
“কি তো….?”
“আমি খেয়েছি? আমাকে খেতে দেখেছিস? ”
এবার একটু বিপাকে পড়লো সুমন। শ্রাবনদাও খায়নি এটা ঠিক কথা কিন্তু ফুচকার ক্ষিধে শ্রাবনদার পায় কিনা সেটা তো সুমন জানে না। তাই উপায় না দেখে বললো, ” তুমি কত বড় একটা মানুষ, আমি কি অত বড় হয়েছি নাকি? ”
“বাহ বড় মানুষের তাহলে ক্ষিদে পায়না?”
“উমম… জানিনা। ও শ্রাবনদা আমি শুধু একপ্লেট ফুচকা খাব, আর কিছু লাগবেনা।”
“আগে তুই গাড়িতে ওঠ, এখন খালি পেটে ফুচকা মিলবে না। আগে শক্ত কিছু খেতে হবে তারপরেরটা পরে দেখা যাবে।”
“ইই…. না…… তুমিতো সেদিন বলেছিলে সুমো এরপর যেদিন বাইরে যাবো সেদিন ফুচকা কিনে দিব।”
“অ্যাই তুই উঠবি না আমি একাই যাব তোকে ফেলে।”
“উঠছি এতো বক কেন সব সময় ? আজ আমার বাবা – মা নেই বলে সবাই আমায় খালি বকে।”
“চুপ… একদম।”
সুমন এই যে মুখ গাড়ির জানালার দিকে ঘুরিয়ে বসলো, সেটা কফিশপে না যাওয়া পর্যন্ত সোজা হলো না। শ্রাবন অবশ্য কোনরকম চেষ্টাও করেনি, পাসতার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে সুমনের, বিড়াল তপস্বী ওটা দেখলেই তপস্বা ছেড়ে মর্তলোক থেকে ধরায় ফিরে আসবেন জানা কথা। তাই আর বাড়তি কথায় না যেয়ে একদম কফিশপের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করলো শ্রাবণ।
“এখন হয় একটা বার্গার নয় পাস্তা খাওয়াতে পারি। কাপড় কিনে যাওয়ার পথে চোখে পড়লে ফুচকা জুটবে আর না থাকলে না,” গাড়ির দরজাটা খুলে সুমনকে নিচে নামার ইঙ্গিত করলো শ্রাবণ।
বার্গার! পাস্তা! কিন্তু একটা কেন? এতো কষ্ট করলো সুমন, দুটোই কিনে দিলে কি এমন হতো ?
“কি এতেও হবেনা? না হলে আমার আর কিছু করার নেই। বাড়ি যেয়ে দুপুরের ভাত খাবি চল,” ঠাস করে আবার গাড়ির দরজাটা আটকে দিল শ্রাবণ।
“না, না হবে তো… কিন্তু…”
“কিন্তু? ”
“না কিছু না…. ” সুমন স্তিমিত স্বরে বললো। শ্রাবনদার গলা বিশেষ সুবিধার লাগছেনা।
“সুমো কোন কথা শুরু হলে তার শেষ হওয়াটা জরুরী, ফলাফল যাই হোক না কেন। ”
“হুমম”
“কি হুমম? আমি কি জানতে চাইছি? ”
“না মানে ইয়ে মানে… পাস্তা আর বার্গার দুটোই যদি খেতাম তাহলে আজ ফুচকা না হলেও হতো,” মিনমিন করে কথাগুলো বলেই আবার ব্যাগটা বুকের কাছে চেপে ধরলো সুমন। কিন্তু তাতেও লাভ হলনা। উত্তর দেওয়ার সাথে সাথেই চুলের বেনীতে জোরে একটা টান খেল সুমন।
“আবার কি করলাম যে মারছো?”
“মারবনা তো কি…. ছুঁচো কোথাকার। নে চল দুটোই দিব কিন্তু তার আগে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে হবে।”
“হ্যা হ্যা চলো চলো ”
“ভাত খাবেনা আর বাইরে আসলে খালি হাবিজাবি খাওয়ার জন্য খাইখাই করতে থাকে।”
শ্রাবনের বকা খেয়েও এবার সুমনের চেহারার ঔজ্জ্বল্য কমলো না, পাস্তা ওর ফেভারিট উমম… হোয়াইট সস দিয়ে গরম পাস্তার গন্ধটাই একদম আলাদা। ইস প্রীতির কথা খুব মনে পড়লো সুমনের, প্রীতিরও খুব পছন্দ পাসতা।
মঞ্জু মামী চিৎকার না করলে ও প্রীতিকেও নিজের সাথে আজকে নিয়ে আসতে পারতো।
………………
খাবার খেয়ে শার্টের কাপড় কিনে ওরা যখন গাড়িতে উঠলো সুমনের চোখদুটো তখন ঘুমের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই সুমন ঘুম৷ শ্রাবন অবস্থা দেখে সুমনের সীটবেল্টটা বেঁধে দিল তাড়াতাড়ি , না হলে জোরে ব্রেক কষলেই সোজা নাক ভাঙবে গাধীটা।
“পাগল একটা, ” শ্রাবণ একা একাই হাসলো। আসলে সুমনের নয় শুধু ওর নিজেরও প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘরে গিয়ে আগে কাপড় ছেড়ে ঘন্টাদুয়েক ঘুমাবে ও, তারপর কালকের কাজ নিয়ে বসবে।
বাড়ি পৌছে সুমনকে ডেকে তুলে দিয়ে নিজের একগাদা ফাইল নিয়ে ঘরে পৌছাতে পৌছাতে শ্রাবণের বিড়ম্বনার শেষ নেই। কোনমতে ফাইলগুলো বিছানা উপর ধপ করে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বের করলো শ্রাবন, কিন্তু সেই সাথে সুমন আর প্রীতির জন্য জমা রাখা দুটো চকলেটও উঠে এলো হাতে। কাজের লোকের হাতে চকলেট দুটো পাঠিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বালিশের পাশে ফোনটা বাজতে শুরু করলো।
ধরব না ধরবনা করেও তিন বারের বার কলটা ধরলো শ্রাবণ।
‘হ্যালো… ‘
“শ্রাবণ ”
“মৌমী তুই! আবার কি হলো?”
“কিছু হয়নি কিন্তু এবার হবে ”
“কি? ”
“প্রেম ”
“মানে… কার প্রেম? ”
” সেটা জানতে হলে তোকে অবশ্যই লাবন্যর দাওয়াতে যেতে হবে।”
“তোর ভয় নেই মানুষের প্রেমের গল্প জানি বা না জানি তোকে ঠিক দাওয়াতের পরে বাড়ি পৌছে দিব , তুই নিশ্চিত থাক।”
“সে আমি জানি বাছাধন, আমি তো জাস্ট তোকে একটা দারুন খবর বলতে চাচ্ছি।”
“মৌমী প্লিজ আমি ভীষন টায়ার্ড… আজ থাক, এইমাত্র বাইরে থেকে আসলাম। ”
“ওহ সরি সরি ” মৌমী সত্যিই লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হলো।
শ্রাবণ, মৌমীকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। কিন্তু মনের অজান্তেই মৌমীর কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগলো… ওকে কার প্রেমের গল্প শোনাতে চায় মৌমী? মৌমীর নিজের! নাকি লাবন্যর। লাবন্যর নামটা মনে হতেই সুজয়ের কথা মনে হলো শ্রাবনের। সুজয় খুব পছন্দ করে লাবন্যকে, কিন্তু বেচারাকে মোটে পাত্তাই দেয়না লাবন্য। কাকে পছন্দ করে এই মেয়ে কে জানে? নাক উঁচু অহংকারী মেয়ে একটা।
চলবে……