কক্সবাজার পর্ব ১

#কক্সবাজার
#পর্ব_১

আমার স্কুলে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ চলছে। আমি মা’কে নিয়ে কক্সবাজার যাবো প্ল্যান করেছি। আমার ছেলে সৌরভ কল্পনা করে কক্সবাজার বিচের বিশাল ছবি এঁকে ফেলেছে। আমার মেয়ে তুলতুল মহানন্দে লাফাচ্ছে, সে তখনো কক্সবাজার বলতে শিখেনি! দিনরাত কতবাজাল যাই, কতবাজাল যাই বলে বলে আমায় অস্থির করে তুলছে। যাবার দিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে ইউ এন ও স্যার আমায় ফোন করে ডেকে পাঠালেন। বললেন, খুব জরুরি। আমি পড়লাম মহাবিপদে। সাড়ে দশটায় আমার ট্রেন। ইউএনও স্যারের ফোন, না গেলেও হচ্ছে না। মা’কে, সৌরভ আর তুলতুলকে রেডী হতে বলে আমি স্যারের অফিসে দেখা করতে গেলাম।
আমি অফিস যেতেই দেখি, স্যার নিজে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমায় ওয়েলকাম করলেন। আনন্দিত হয়ে বললেন,
—নীরা ম্যাডাম, আসুন, আসুন… বসুন! ম্যাডাম আমি দু’বছর ধরে এই উপজেলায় অথচ আপনার সাথে ভালো করে পরিচিত হওয়াই হয়নি। আসুন, বসুন।
মুহূর্তেই স্যার তাঁর দপ্তরী’কে বলে নাশতা এনে টেবিল ভর্তি করে ফেললেন।
আমি মোটামুটি ভয় পেতে লাগলাম। সামান্য প্রাইমারি স্কুলের প্রধানশিক্ষক আমি। আর একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমার জন্য হঠাৎ এত গদগদ কেনো হয়ে পড়লেন কেন কে জানে?
স্যার নিজে আগ বাড়িয়ে আমার জন্য গ্লাসে জুস ঢাললেন, আমাকে ফল খোসা ছাড়িয়ে দিতে লাগলেন। আমি ভীষণ বিব্রত হয়ে বসে আছি। এদিকে আমার ট্রেন যায় যায়..! বুকের ভেতর ধপধপ করছে। খুবই আড়স্ট গলায় বললাম,
—স্যার, ছুটি তো.. আমার আজ কক্সবাজার যাবার কথা। ঘন্টাখানেক বাদেই ট্রেন। আমার বাচ্চা-কাচ্চা রেডী হয়ে আছে।
—আরে ম্যাডাম, রাখুন আপনার ট্রেন। কক্সবাজার টক্সবাজার সব ক্যানসেল। জানেন কাল কে আসছে আপনার সাথে দেখা করতে? বিভাগীয় কমিশনার স্যার! তিনি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে আসছেন।

আমি আরো চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বিভাগীয় কমিশনার আমাকে সারপ্রাইজ কেন দেবেন? আমি তাঁর কে? উনার সারপ্রাইজের আমার দরকারটা কী?
—আপনি স্যারের এত মাই ডিয়ার মানুষ অথচ কেউ জানেই না। তবে ম্যাডাম, একটা ঝামেলা আছে। ডিসি স্যার আমাকে মানা করেছেন, কমিশনার স্যার যে আসবেন সেটা আপনাকে জানাতে কড়া নিষেধ করেছেন। বললেন, আমি যাতে এমনি স্কুলে একটা পরিদর্শন রাখি আমার নিজের কথা বলে। কমিশনার স্যার তো জয়েন করলেন গত ন’তারিখে। আপনাদের ভ্যাকেশান শুরু হবার পর। ডিসি স্যারকে দিয়েই আপনার খোঁজ বের করলেন।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। সত্যি কথা বলতে কি নতুন বিভাগীয় কমিশনার স্যারের নাম পর্যন্ত আমি জানিনা তখন।
তাও আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,
—স্যার কাল কখন আসবেন?
—দুপুরের দিকে আসবেন। আমি আমার এখানে লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছি। আপনি কিন্তু ভুলেও কিছুর আয়োজন করবেন না। স্বাভাবিকভাবে স্কুলে থাকবেন। যেনো কিছু জানেনই না। স্যার যদি জানতে পারেন, আমার উপর খুব রেগে যাবেন। আপনাকে একটু আগে জানানোর কারণ, স্কুলে বন্ধ তো। একটু ডাস্টিং, ক্লিনিং এর ব্যাপার তো আছেই নাকি? স্কুল গ্রাউন্ড ফকফকা করে রাখবেন। ওয়াশরুমে সাবান, হ্যান্ডওয়াশ, টাওয়েল, টিস্যু । বুঝতেই তো পারছেন! ভি আই পি’রা স্যারের সাথে থাকবেন।

আমি হতাশার নিঃশ্বাস ফেললাম। এতদিনের প্ল্যান করা ট্রিপটা ভেস্তে গেলো। ভেতরটা খুব আহত হয়ে পড়লাম। আমার ছেলেটা কত মুখিয়ে আছে, মেয়েটা এত সাধ করে আছে, কক্সবাজার যাবে বলে। অথচ এই বিভাগীয় কমিশনার কিনা সব মাটি করে দিলো।

বাড়ি এসে যাওয়া হবে না বলতেই, সৌরভ বিচের ছবিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো। তুলতুল আকাশ ফাটানো কান্না শুরু করলো। মা মুখ অন্ধকার করে গোছানো ব্যাগের কাপড়চোপড় বের করতে লাগলেন। আমি এলাম স্কুলে। স্কুলের খাতাপত্র ক্লিয়ারেন্সেরও ব্যাপার আছে। স্কুল পরিষ্কার করালাম। বাকি স্টাফদের ইনফর্ম করলাম।
রাতে ল্যাপটপ খুলে বসলাম, আমার ট্যূর ধ্বংস করে দেয়া বিভাগীয় কমিশনার সম্পর্কে কিছু তথ্য অন্তত জানা যাক। কমিশনারের নাম জাকির হোসেন! নাম দেখেই আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে ফেললাম। ছবির দিকে তাঁকানোর মত মনের শক্তি আমার ছিলো না।সারারাত কাটলো আমার জেগে বসে। দশবছর আগে যে নাম আমায় ভুলতে হয়েছে, জোর করে ভুলতে হয়েছে। সেই নাম কেন আজ সামনে এলো?

পরেরদিন আমি একবার ভাবলাম স্কুলে না যাই। যা হবার হবে। পরে মনে হলো, যাওয়া দরকার। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তিনি এখন আমার উর্ধ্বতন। অনেকদিন আগে হয়তো তিনি আমার জীবনের সত্যি হওয়া সবথেকে সুখের কল্পনা ছিলেন।এখন সবথেকে বড় দুঃস্বপ্ন!

~চলবে~

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here