কক্সবাজার পর্ব ৩

#কক্সবাজার
#পর্ব_৩

ইউ এন ও স্যারের কথায় ধ্যান সরলো আমার।
—ম্যাডাম আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন না, যান যান স্যারকে ওয়েলকাম করুন।
আমি এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলাম। পা সরছিলো না কিছুতেই। প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিথর হওয়া শরীর নিয়ে উনার সামনে গেলাম।

আজ খুব সাধারণ ফরমাল ওয়ার। মেরুন শার্ট, কালো প্যান্ট! এই শার্টটা পরার কি খুব দরকার ছিলো? বিয়ের দিনে তো এই শার্টটাই পরেছিলেন তিনি। ৭৫০টাকায় কেনা। আমি খুব বকেছিলাম। শার্ট পরে কেউ বিয়ে করে? একটা ভালো পাঞ্জাবি তো পরতে পারেন!
উনি উল্টো বলেছিলেন,
—উঁহু! আমার জীবনের সবথেকে প্রিয়দিনে পরা পোশাক। এটা আমি আমার জীবনের সব বিশেষ দিনে পরবো। আজ থেকে এটা আমার স্পেশাল কোড শার্ট!
মানুষটা বিদেশে যাবার দিন এই শার্টটা পরেই গিয়েছিলেন।
যাই বলার সময় বললেন,
—যেদিন ফিরে আসবো সেদিন তুমি বিয়ের দিনের জামাটা পরে থাকবে। আমিও এই শার্টটাই পরে আসবো।
—যদি মোটা হয়ে যাই!
—একদম না। আমার জন্য নিজের যত্ন করবে। তুমি এখন থেকে আমার জিনিস!
বেচারা এয়ারপোর্টে শেষ সময়ে একটা চুমু খাবার জন্য কি যে পাগল পাগল অবস্থা! লোকজনের জন্য পারছিলোই না। রাগে শেষমেষ বললো,
—যেদিন আসবো, একঘন্টা চুমু খেয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরুবো। ঘড়ি ধরে ৬০মিনিট। হোক মুখব্যথা।
—এক ঘন্টা চাইলেও চুমু খাওয়া যায় না।
উনি তক্ষুনি একটা কাগজে লিখলেন, “আমি তোমার স্বামী মোঃ জাকির হোসেন কথা দিচ্ছি, যেদিন আমি দেশে ফিরে আসবো আমাদের কাছে আসার প্রথম মুহূর্তে আমি আমার স্ত্রী নীরা হায়দারকে এক ঘন্টা চুমু খাবো।”
নিজের নাম সই করে ডেট দিলেন। আমি তো সেই কাগজটা কবেই ফেলে দিয়েছি। সব ভুলে এই আমি তো আজ ভালোই আছি।

আমি আরেকটু সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। আমার গলা কাঁপছিলো। বোধহয় কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিলাম। ডিসি স্যার বললেন,
—ম্যাডাম, এত নার্ভাস হবেন না। স্যার, খুবই ভালো মানুষ। এমনি আপনার স্কুল দেখতে এলেন। আপনার তো পাহাড়ের কাছে স্কুল। পাহাড় তো হরহামেশা ভাঙছে। বাচ্চাদের জন্য এক্সট্রিম রিস্ক।
তাই এক্স্যাক্ট লোকেশান দেখতে এলেন। একটা গার্ডওয়াল হবে কিনা…
আমি তাও কান্না আটকাতে যুদ্ধ করছিলাম। কথার স্বর বাজছিলোই না।
তিনি এবারে নিজের জায়গা থেকে একটু এগিয়ে এসে বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন,
—ডিসি সাহেব এত ফরমাল হবেন না, নীরা ম্যাডাম আমার খুব কাছের মানুষ। আত্মীয়।
তারপর আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
—দুঃখিত নীরা। ভ্যাকেশানে তোমাকে বিরক্ত করলাম। তোমার নিশ্চয়ই অন্য প্ল্যান ছিল? তোমার তো সবসময়ই অন্যরকম প্ল্যান থাকে, তাই না? এখন আমাকে ওয়েলকাম করতে তাই এত অসুবিধে!
আমি কোনোরকমে ঠোঁট কামড়ে বললাম,
—ওয়েলকাম স্যার। আসুন..
তিনি খুব সাবধানে দলবল এড়িয়ে খুব আস্তে স্বরে বললেন,
—এখানে কই থাকো? মানে তোমার বাসা!
—জি, স্কুলের পাশেই আমার বাড়ি।
তিনি ঠান্ডা স্বরে বললেন,
—তোমার বাড়ি যাবো নীরা। এবং একা যাবো। ড্রাইভারও না।
তিনি স্কুলে একটা ফরমাল ভিজিট সারলেন। এটা সেটা নিয়ে কথা বললেন। এরপর ডিসি সাহেবকে আলাদা ডেকে কি যেন বললেন। আমার তখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয় হয় অবস্থা। বাড়ি কেন যাবেন তিনি?
সবাইকে আলাদা রেখে তিনি গাড়িতে উঠে বললেন,
—উঠে এসো নীরা। আমি বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করবো না তোমার।
আমার মন কিছুতেই তাঁর গাড়িতে উঠতে চাইছিলো না। শুধু সিন ক্রিয়েটের ভয়ে উঠলাম। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে তিনি বললেন।
—ওখানে নয় নীরা। ড্রাইভিং সিটে বসো।
গাড়ি চালানো নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি?
আমি পাথর হয়ে বসলাম। সেই পারফিউম, সেই শার্টের কলারের কাছে জমে থাকা গলার বিন্দু বিন্দু ঘাম। লেফট সাইডলকের নিচের গাঢ় তিলটা যেন আরো গাঢ় হয়েছে। তিনি আঙুল ঠুকে গলার নিচটা চুলকালেন। সেই আগের মতই ঠোঁটের নিচে অস্পষ্ট মিষ্টি হাসিটা যেন মিশে দেবে আছে৷ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে কেশে ফেললাম।
গাড়ি স্টার্ট করতেই তিনি বললেন,
—বাহ্! কি পরিপাটি সেজেগুজে ঘুরে বেরাচ্ছো নীরা!তোমার সেই সাজগোজের অভ্যাস সব রয়ে গেছে। তবে ঠোঁটের লিপস্টিক তো আরও গাঢ় হয়েছে। কত রঙের জীবন তোমার, তাই না?
আমি হাসলাম। তিনি গিয়ারের উপর রাখা আমার বাঁ-হাতের চুড়ির উপর আঙুল বুলাতে বুলাতে ঠোঁট বাকিয়ে বললেন,
—তোমার কি ধারণা? তুমি সেদিন আমায় একটা চেইন বিক্রি করে কিছু টাকা দিয়েছিলে বলে আমি তোমার কেনা হয়ে গেছিলাম? আমি তোমার ইচ্ছের বস্তু হয়ে গিয়েছিলাম? কয়েকরাত আমার সাথে শুয়ে সব সাধ মিটে গিয়েছিলো, তাই না নীরা? হুহ…? মনে করেছো এবার তোমার নতুন টেস্টের কিছু চাই, তাই না? শোনো, আমি কিন্তু আমার নিজের যোগ্যতায় এত দূর এসেছি, কারো চেইন বিক্রির টাকায় নয়। আমার ভিক্ষুক বাবার ভিক্ষে কিন্তু আমি বিফলে যেতে দিইনি।
আমি একটাও কথা বলতে পারলাম না। কারণ মানুষের জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে যেখানে একটা স্টেজের পর কোনো ব্যাখ্যাই আর কারো কাছে কিচ্ছু ম্যাটার করে না। দরকারই পড়ে না। আমার তখন সেই মুহূর্ত জীবনের। আর তাঁকে দেওয়ার জন্য যে ব্যাখ্যাটা আমার কাছে আছে সেটা হয়তো আজ কোনো অর্থই রাখে না। আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালাম শুধু।

বাড়ি এসে তিনি আমার বসার ঘরে বসলেন না। বারান্দায় মোড়ায় বসলেন। আমার ছেলেমেয়ে মহা আগ্রহে তখন কমিশনার সাহেবকে দেখছে! পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। আংকেল.. আংকেল ডেকে আবার পর্দার আড়ালে লুকাচ্ছে।
—এরা তোমার ছেলেমেয়ে?
—হু..
—হাজবেন্ড কোথায়?
—ও বাইরে থাকে।
—বিদেশে?
—হুঁ
—কোন দেশে?
আমি জবাব দিলাম না।
—ভাবছো, বললে আমি তোমার স্বামীকে খুঁজে বের করে সব বলে দেবো। সংসার ভেঙে দেবো? এত ভয় তোমার সংসার নিয়ে? এত ভয়? যে সংসারের আদৌ কোনো বৈধতা নেই, সেই সংসার নিয়ে ভয়?
আমি কোনোরকম তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
—চা দিই?
কমিশনার সাহেব গর্জে উঠলেন।
—একদম না। চায়ে বিষ দিয়ে নিশ্চিত মারবে তুমি আমায়! মারার চেষ্টা তো তোমার সফল হয় নি আগে।
আমি উঠে চা বানাতে গেলাম। তিনি আমার ছেলেমেয়েকে ডেকে নিয়ে গল্প করতে লাগলেন।
আমি চা এনে রাখতে রাখতেই চুমুক দিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেললেন তিনি। থুঃ করে চা ফেলে মুখ ঠান্ডা করলেন।
—তুমি তো দেখি চা বানানোও ভুলে গেছো। ছিঃ… তা তোমার হাজবেন্ড নিশ্চয়ই এই বাজে চায়ের ভয়েই দেশে আসে না? চুমুক দিলেই মরে যেতে ইচ্ছে করে।

আমি ছেলেমেয়েকে ইশারায় সরিয়ে দিতে দিতে বললাম,
—না না আসে তো।
—তোমার ছেলেমেয়ে যে বললো, অনেকদিন আসে না! তোমার ছেলেমেয়ে তো বাবাকে দেখেইনি বললো।
—ওরা কি আর হিসেব বুঝে? একটু ব্যস্ত বলে এই কটা বছর ধরে আসতে পারছে না।
—এই যে এতদিন বিদেশে.. থাকছো কি করে এখন? আমি তখন বিদেশ যেতেই তো হামলে পড়ে বিয়ে করে নিয়েছিলে। শরীরের এত জ্বালা এখন কোথায় গেল নীরা? হুহ… শোয়ার আগ্রহ এখন কমে গেছে নাকি?কই শরীর দেখে তো একদম বুঝা যায় না!
আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম।
—আপনি একটু ঠান্ডা পানি খান। নিন.. ঠোঁট হয়তো জ্বলছে!
আমি গ্লাস এগিয়ে ধরলাম। কমিশনার সাহেব পানি ঠেলে আমার কোলের উপর ফেলে দিলেন।
—আমি জানি তোমার মত লোভী মেয়ের হাতে পানি থাকলে নিশ্চয়ই সেটা আগুন হয়ে যায়৷ ভালোই হয়েছে, তুমি সেদিন বিয়ে করেছিলে। আমার বউ তো দেখোনি? হীরের মত মেয়ে। তোমার তো সামনের দাঁতও উঁচু! বিদঘুটে।
আমি হাসলাম।
—শরীর তো দেখেছিই! কোনো স্পেশালিটিই তো ছিল না তোমার। সারা শরীর ভর্তি তিল। এখানে তিল, সেখানে তিল। লাল তিল, কালো তিল, সাদা তিল.… হাত দেবার তো জায়গাও নেই। নাভির পাশে এত বড় দেবে যাওয়া কাটা দাগ। আমার বউয়ের জানো একদম দাগহীন শরীর। একটাও তিল নেই।

আমি আরেক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলাম। এবার তিনি পানিটা হাতে নিলেন। এক চুমুকে পুরোটা শেষ করলেন।একটুও মেজাজ বদলায়নি মানুষটার।সব কিছু দ্বিতীয়বারে বুঝেন। আমি আবার চা বানানোর জন্য উঠে দাঁড়ালাম।
তিনি শার্টের কলার টেনে ঠিক করে বললেন,
—তোমার হাসবেন্ড তোমার এই শরীরে কি করে শান্তি পায়, বলো তো? আমার তো রাগ লাগতো। এটা কোনো ফিগার হলো?
আমি সোজা উনার চোখের দিকে তাঁকালাম। ঘন ঘন চোখের পাতা পড়ছে তাঁর।
আমি চা আনতে চলে গেলাম। পরের চা টা উনার হাতে দিতেই বললেন,
—আমার বউ ফাইভ সিক্স! তোমার থেকে হাইটও বেশি। হিলস পরলে তো কথাই নেই। চোখে ওসব কাজল ফাজল দেয় না। তুমি তো দেখছি এখনো দাও। আমার প্রিয় হলুদ গেঞ্জিটা তো এই কাজলেই নষ্ট হয়েছিলো। আমার জীবনের সব কালো করে দিয়েও কাজল ছাড়লে না!
তিনি এবারে চা-টা মেঝেতে ঢেলে দিলেন।
আমি আরেকটা মোড়া পেতে উনার সামনে বসলাম। আসলেই কি তাঁর বউ হীরের মতো! হবেই তো, বিভাগীয় কমিশনার কিনা।
—আপনার বউয়ের নাম কি? কি করেন তিনি?
তিনি প্রসঙ্গ বদলালেন।
—তোমার তো দেখছি রুচি আরও খারাপ হয়েছে। এই দরজা বরাবর কেউ গন্ধরাজের টব রাখে? কখন সাপ এসে ঘরে ঢুকবে! একটা ছোট্ট বাড়ি তাও ঠিক করে সাজাওনি। সবুজ রঙের মেঝে। পা রাখলেই মনে হচ্ছে ঘাসে পা দিচ্ছি। গরুর ঘাস খাওয়ার মাঠ। ভাগ্যিস আশেপাশে গরু নেই। আর এই যে গ্রিলে মেরুন কালার এটাও নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ? মেরুন কোনো কালার হলো?
আমি একবার ভাবলাম বলি, এত রাগ আমার উপরে, তো আমার দেয়া মেরুন শার্ট গায়ে কেন? বিয়ের দিনে তো এটা পরেই বেশ লাফাচ্ছিলেন। পরক্ষণেই ভাবলাম, থাক না। কি লাভ বলে? যার সাথে স্বপ্ন দেখেছিলাম ঘরের মেঝেটা হবে সবুজ রঙের। পা রাখলেই মনে হবে খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়েছি! ঘরের দরজার মুখে থাকবে গন্ধরাজ, ঘরে ঢুকবো ঘ্রাণে মাতাল হয়ে৷ অথচ তাঁরই আজ সব স্বপ্ন বদলে গেছে। থাক… না…

তিনি হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
—আমি যাই নীরা।
দরজায় বেরোবার সময় গন্ধরাজের টবেটা লাথি মেরে ফেলে দিলেন। ফিরে তাঁকিয়ে বললেন,
—সাপ আসবে। ঘরে তো বাচ্চারা আছে। তোমার কক্সবাজার ট্রিপটা আমার জন্য নষ্ট হলো, আমি আবার সব রি-প্ল্যান করে দিচ্ছি নীরা।
—না না… লাগবে না।
—তোমার ছেলেমেয়েরা বললো তোমাদের আজ যাবার কথা ছিলো। আমি আসবো বলে সব ডিসমিস হয়ে গেল। ওদের খুব মন খারাপ। তোমার ছেলে ওর আঁকা ছবিটা নিয়েও তো বেশ আপসেট।
—ইটস ওকে, আমরা পরের ছুটিতে যাবো স্যার।
—কেন? আমি এরেঞ্জ করে দিলে সমস্যা কি? তুমি যখন তোমার চেইন বিক্রি করে আমার টিকিটের টাকা দিয়েছিলে আমি তো মানা করিনি? এখন মানা করছো কেন? ভয় পাচ্ছো, টাকা দিয়ে তোমাকে শুতে বলবো? আরেকটা মিথ্যে বিয়ের কথা বলবো? নয়দিনের তৃষ্ণার সংসার, যেখানে আমরা মাত্র ছয়বার শুবো।
আমি হাত জোর করে তাঁকালাম। কমিশনার সাহেব তাও কথা থামালেন না।
—শোনো, নীরা আমি তোমার মত না। তুমি কয়টা টাকা দিয়ে আমার সাথে শুয়েছিলে। আমি কিন্তু নই? আমি বউ-ই মেনেছি তোমাকে… তোমার হয়তো মনে হয়েছে আমাকে টেস্ট করা তোমার শেষ। এখন নতুন পয়েন্টে টেস্টে যাবে… নতুন জিনিস, নতুন শোয়া!

আমি অপলক তাঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
কমিশনার সাহেব চলে গেলেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম, এই জীবনে আপনাকে আমি মনে মনে হাজারখানেক চিঠি লিখেছি। কাগজে লিখিনি বলে আপনি কিছুই জানতে পারলেন না। সেদিন আপনি চলে যাবার পর থেকেই আমার জীবনে সমস্ত কালো শুরু হয়েছিল।

~চলবে~

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here