তাহারেই পড়ে মনে পর্ব ৬

#তাহারেই_পড়ে_মনে
পর্ব ছয়
প্রিন্স বেশ আনন্দ নিয়েই আস্তে আস্তে বললো ‘বিবিজান?’
মিষ্টির পিঠের পেছন দিয়ে, মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি শিরশির করে নেমে গেলো। কতকটা ভালো লাগা, কতকটা বিরক্তি, কতকটা লজ্জ্বা আর কিছুটা ভয়ের সংমিশ্রণে ও ফ্রিজ হয়ে গেলো – ঘরভরা মানুষের সামনে! সাথে এ-ও বুঝে গেলো ও ধরা পড়ে গেছে! ওর মনের কথাটা সামনে দাঁড়ানো অভদ্র ছেলেটার কাছে আর অজানা নেই। ও নার্ভাস হয়ে গেলো।

মিষ্টিকে দেখে প্রিন্সের মনের এতোদিনের দ্বিধাবোধ একসাথে মুছে গেলো – মিষ্টির মুখে কিছু উচ্চারণ করার দরকার হলো না। গত কয়েকটামাস প্রিন্স প্রায় প্রতিসপ্তাহে চারঘন্টা বাইকজার্নি করে মিষ্টির কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো – সামনে যাওয়ার সাহস পেতো না। কোনো কোনোদিন হয়তো কলেজ থেকে বেরুনোর সময়ের একমিনিটের ওই দেখাটুকুও পেতো না – মিষ্টি কলেজে না আসলে। তবুও ওর ভালো লাগতো। ও আচ্ছন্ন হয়ে কতকটা রোদ-হাওয়াই গায়ে মাখতো – ওই আলোবাতাসই হয়তো মিষ্টিকে ছুঁয়ে গেছে ভেবে রোমাঞ্চিত হতে হতে! মিষ্টির চোখে চোখ রাখতে ওর বড় সুখ হলো আজকে – ও জেনে গেছে মিষ্টি আজ এখানে ওর জন্যই এসেছে। ‘বিবিজান?’ আবার ডাকলো প্রিন্স।

মিষ্টি সংকোচে নানির সাথে মিশে গেলো। ‘নানি, চলোনা বাড়ি যাবো।’ মিষ্টির কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি প্রিন্স ক্ষেপে গেলো ‘তাহলে তুই এসেছিস কেনো?’
মিষ্টি কাঁদোকাঁদো হয়ে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। মিষ্টির নানি তাড়াতাড়ি বলে উঠলো ‘ভাই, তুমি ওরে বিরক্ত কইরো না। ও তোমাদের মতো না। অনেক নরম মেয়ে।’

‘বুড়ি, তুমি চুপ করো। তোমার নাতনি কী জিনিস তা তুমি জানো? আমারে খুন করতে ও দুইবার ভাববে না। অর্ধেক তো মেরেই ফেলেছে।’

বৃদ্ধা এতোকথা বুঝলেন না কিন্তু প্রিন্সের সাথে মিষ্টিকে কথা বলতে দিতেও তার মন সায় দেয় না। তিনি মিষ্টির হাতটা শক্ত করে ধরলেন আরও। নিজের পাশেই বসিয়ে রাখলেন।

‘তোমার নাতনিরে সিন্দুকেই ঢুকিয়ে রাখো, বুড়ি। দেইখো পিঁপড়ায় না কাটে আবার।’ প্রিন্স রেগে গিয়ে বেরিয়ে গেলো। একটু বাদে বাইক স্টার্টের শব্দও শোনা গেলো!

অসভ্য ছেলেটাকে মিষ্টির সহ্যও হয়না আবার যেইনা বাইকের শব্দ পেলো মনটা বিষাদে ছেয়ে গেলো। পঁচা শামুকেই পা কাটলো তাহলে! এখানে কে পঁচা শামুক আর কে পা সেটা বলা মুশকিল। প্রিন্সের মায়ের কাছে কোটি টাকার পাল্লায় নিজের উড়নচণ্ডী ছেলেই ওজনে বেশি হবে যেখানে মিষ্টির পরিবারেও এই অসম সম্পর্কে মিষ্টির পাশে প্রিন্সের যোগ্যতা নেহায়াতই ঠেলাওয়ালা! এই হয়, যা নিষিদ্ধ – তাই আকর্ষণ করে বেশি। ইস্পাত-দৃঢ় ষোড়শী – লম্পট, অত্যাচারী জীবানন্দের প্রেমে অলকা হয়ে মরেছিলো! আজ মিষ্টিও মরলো, একেবারে গলায় কলসি বেঁধে বড় যত্ন করে ডুবে মরলো!

‘আমি কিন্তু সব জানি, ভাইয়া সব বলেছে আমাকে। ভাইয়ার কথা সব জানি, তোমারটা তো জানিনা। আমার বিয়েতে এসো কিন্তু, আমার খুব ভালো লাগবে, ভাইয়ারও। আর ভাইয়া কিন্তু খুব রাগি, তুমি ওকে চেতাইওনা, বুঝছো? কী করতে কী করে ফেলবে কে জানে।’ মিষ্টির হাতে ধরে কানে কানে বললো জিনিয়া, যখন সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সাথে সাথেই এলো গেইট পর্যন্ত।
জিনিয়ার কথার ইঙ্গিত বুঝলো না মিষ্টি কিন্তু জেদ লাগলো মনে মনে, কী করবে প্রিন্স ওর? আবার লজ্জাও লাগলো, কাকে কাকে কী বলে রেখেছে কে জানে!
রাস্তার দিকে তাকাতেই হালকা আলোয় হাইওয়ের মাঝখানটা চিঁড়ে একটা বাইক প্রচুর স্পিডে আসতে দেখা গেলো, তার উপরে দুই হাত দুপাশে মেলে ছেলেমানুষি স্টান্ট দেখাতে দেখাতে একেবারে ওদের সামনে এসে কঠিন ব্রেক কষে দাঁড়ালো প্রিন্স। বাইকের উপর ওর অদ্ভুত নিয়ন্ত্রণ! মিষ্টির দিকে তাকালোও না, গ্যাটগ্যাট করে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।

সাবিহা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মিষ্টিকে ‘মেয়েরা বড় হলে মায়ের কাছেই পর হয়ে যায়। দুইদিন পরে বিয়ে হয়ে গেলে মায়ের কাছেই হয়তো বছর না ঘুরলে আর আসবানা। এই খালার বাড়ি কি আর কোনোদিন আসবা, মা? জিনিয়ার বিয়েতে অবশ্যই আসবা, তোমার মাকে তো আমি দাওয়াত পাঠাবোই।’ হয়তো নিজের মেয়ের বিয়ে হয়ে চলে যাওয়ার কথা ভেবেই ছলছল চোখে পাঁচশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিতে গেলো মিষ্টির হাতে। ও তাড়াতাড়ি না, না বলে ফিরিয়ে দিতে গেলেই মহিলা বলে উঠলেন ‘ওই *** ঘরের **। তোর মারে জিজ্ঞেস করিস সাবিহা কী জিনিস! আদর করে মেয়েরে দুটো টাকা দিচ্ছি তাতে মেয়ের ভাব দেখো! ফকিরনির ঝি, নে? মা- খালারা কিছু দিলে ফেরাতে হয় না, মা।’ মিষ্টি হতভম্ব হয়ে গেলো। এরা কোন জগতের মানুষ!

নানির ঘরের টিনের চালের নীচে শামিয়ানা খাটানো। লাল রঙের সালু কাপড়ের শামিয়ানা। চারপাশে কুঁচি দেওয়া ঝালর। তার নীচে শুয়ে শুয়ে মিষ্টি নিজেকে উলোটপালোট করে ভাবতে লাগলো। দুইদিক থেকেই স্রোতের টানে বেসামাল ও। একবার মনে হচ্ছে যা হচ্ছে ভুল হচ্ছে। প্রিন্স, ওর মা, ওদের পরিবার আর ওদের আচার ব্যবহার কিছুই মিষ্টির পরিবারের সাথে যায় না। ওদের কাছে যেটা খুব স্বাভাবিক সেটা মিষ্টির শিক্ষা, ওর ভদ্রতা জ্ঞানকে এক লহমায় ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। ভুল করাটা মিষ্টিকে মানায় না। ও ধীর, শান্ত, বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমতি। কিন্তু বয়সের খেয়ালে সেই ভাবনার পাল ভীড় জমায় আবার প্রিন্সের খেয়ালে, ওর মনের কথাও তো জানা হলো না মিষ্টির! দোদুল্যমান মন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে না পেরে নির্ঘুম রাতই কাটলো।

নির্ঘুম রাতও প্রিন্সের কাটলো কিন্তু বড় আনন্দে। বাড়ির ছাদটা ওর খুব প্রিয় জায়গা। একাকিত্বের অবসর ওর জীবনে আসেনা – সুখ, দুঃখের অনুভূতিও আবছার উপর ঝাপসা। শুধু একটা অনুভূতিই ও প্রবলভাবে অনুভব করেছে, তা হলো মিষ্টি! ও রোদে ভিজে, বৃষ্টিতে কেঁদে, আঁধারকে জড়িয়ে ধরে এই অনুভূতির স্বাদ নিতো। ওর সাথে লেগে থাকা ইয়ার দোস্তদের প্রিন্সভাইর এই হাহাকার ভালো লাগতো না। প্রায়ই ওরা এসে উৎসাহ দিতো ‘ভাই একবার বলেন, তুলে নিয়ে আসি।’ প্রিন্স কিছু বলতো না। মেয়েদের সম্মান করা, ভালোবাসার মহত্ত্ব এতো গালভরা বুলি ও জানেনা, ভাবনায়ও আসেনা – শুধু এইটুকু জানতো মিষ্টিকে জোর করা যায় না – জোর করতে হয় না!

আজকে ওইদিকেরও সাড়া আছে জেনে মন বাকবাকুম। যার অনুভূতি মোটাদাগের তার প্রকাশও সেইরকম স্থূল! তাই সাউন্ডবক্সের হিন্দি সুরে হাইওয়ে কেঁপে উঠলো, ছাদে উদ্দাম নেচে আনন্দ করে ক্লান্ত হলো প্রিন্স নিজের দলবলসহ আর মাদুরপেতে সেখানেই ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে ভোর হলো।

মিষ্টির ঘুম ভাঙতে আজ দেরিই হলো। বেলার দিকে তাকিয়ে ওর মন খারাপ হলো। বাড়িতে কাজিনরা কেউ নেই। কেউ স্কুলে গেছে কেউ কলেজে। নানিকেও পেলো না কোথাও। সকালে খেয়েদেয়ে পান মুখে দিয়ে পাড়াবেড়ানো অভ্যাস ওর নানির। ও চোখেমুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরে গেলো।
রান্নাঘরে বড়মামানি দুপুরের রান্নার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। পিঁড়ি টেনে বসে ও রান্না দেখতে লাগলো। মাটির চুলায় শুকনো পাতা দিয়ে রান্না। কী সুন্দর করে মামানি একটা মোটা কাঠি দিয়ে পাতা টেনে নিচ্ছেন আর ঠেলে দিচ্ছেন চুলার ভেতর। পটপট করে পাতা পুড়ে চুলার আগুন গনগন করে উঠছে। পাতা দেওয়ার টাইমিং ও আছে আবার একটু পরপর চুলার ছাই খুঁচিয়েও দিতে হচ্ছে। অভিজ্ঞতা ছাড়া এভাবে পাতা দিয়ে রান্না করা, আগুনের তাত কন্ট্রোল করা সম্ভবই না। মিষ্টিকে দিলে ওতো সব পাতা একসাথেই পুড়িয়ে ফেলবে! আগুনের লাল আলো মামানির মুখে এসে পড়ছে, ঘর্মাক্ত মুখ কী সুন্দর লাগছে!
‘কী হইছে মা, আজকে এতো দেরি করে উঠলে তুমি। রাইতে ঘুমাও নাই? পড়ছো বুঝি? এতো কী পড় তুমি? আমাগো পোলাপাইন এট্টাও যদি তুমার মতো হইতো!’

‘মামানি, বড়মামা কখন আসবে?’

‘কেন মা? কিছু লাগবে? সেতো আসবে বৈকালবেলায়। কিছু লাগলে কও, কাউরে দিয়া বাজারে পাঠাই।’

‘না, মামানি, কিছু লাগবে না। আমি বাড়ি যাব।’

‘কেন, এতো তাড়াতাড়ি যাইবা? বইনের জন্য মন কেমন করে বুঝি? আচ্ছা যাইয়ো। তোমার মামা আসলে তারে বইলা, সামনের সাপ্তায় চইলা যাইয়ো।’

‘না মামানি, আমি কালকেই যাবো।’

‘এইডা কী কও? তোমার মার জন্য নারকেল পাড়াইতে হবে। পিঠা বানানির আছে। পুবপাড়ার জমিতে ক্ষিরাই উঠবে, তোমার মার অনেক পছন্দ। কালকে কিভাবে যাবা?’

‘না মামানি আমি কালই যাবো। আপনি যা পারেন আজকের ভিতরই গুছিয়ে দেন।’

মিষ্টি নিজেকে খুব কঠিন শাসনে বেঁধে এনেছে। এভাবে এলোমেলো স্রোতের তোড়ে কিছুতেই নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে দেবেনা ও। সামান্য দুর্বলতাকে জীবনের উপর, স্বপ্নের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না ও কিছুতেই। রান্নাঘর থেকে বেরোতেই ও মুখোমুখি হলো প্রিন্সের। কখন এসেছে কে জানে। উজ্জ্বল হাসি মুখে নিয়ে বললো ‘মিষ্টি, তোর বই। কালকে বাড়িতে রেখে এসেছিলি। দিতে আসলাম। সকাল সকাল ঘুম ছেড়ে উঠতে হলো। বই না পেয়ে, শোকে তুই যদি পাগল হয়ে যাস আবার!’
মিষ্টি তাকিয়ে দেখলো নাইন টেনের হিসাব বিজ্ঞান বই ওর হাতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিন্সের দিকে তাকালো ও। ছেলেটা জানেও না, ও কী পড়ে। আর এই আজব জন্তুকে নিয়ে ও কীসব ভেবে বসে আছে!

‘কীরে, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলা যায়? কী করলাম আমি আবার?’

‘এটা আমার বই না, প্রিন্সভাই। আমি সায়েন্সের ছাত্রী।’

‘তাতে কী? তোর তো বই হলেই হয়। আর আমিতো জানিই এটা তোর বই না। আসবো যে একটা অজুহাত লাগে না, বিবিজান?’ গলা নীচে নামিয়ে বললো প্রিন্স ওকে।

মিষ্টি ঠান্ডা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো একটুখানি সময়। সারারাত ভেবে ভেবে নিজেকে যতটুকু গুছিয়ে এনেছিলো সেই পাহাড় গলতে শুরু করেছে ও টের পায়। ‘হুম, ওইখানে বসি আসেন।’

‘তুই না আমাকে তুমি করে বলতি?’

‘ন্যাকামি কম। আমি নাটক, সিনেমা পছন্দ করি কিন্তু রিয়েল লাইফে না।’ বেশ ধমকের সুরেই বললো মিষ্টি।

‘এইরকম ধমক যদি আমাকে অন্য কেউ দিতো, এতক্ষনে সে রামথাপ্পর খেয়ে শুয়ে পড়তো।’

মিষ্টি বুঝলো এই জংলিকে মানুষ করতে যাওয়া পণ্ডশ্রম বৈ অন্য কিছু না। ও রাগ গিলে ফেলে মৃদু হাসলো। ঘাড় কাত করে সুন্দর করে বললো ‘আমি নিশ্চয়ই অন্য কেউ না, ঠিক কীনা?’

প্রিন্সকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠোনের সামনের বড়ঘরের বারান্দায় উঠে বসলো। বড় কাঠের চৌকি বসানো বারান্দায়। ভোরবেলায় সব বাচ্চাকাচ্চা জড়ো হয়ে সুর করে আরবি পড়ে এখানে বসে। আরবি সেশন শেষ হলে সকালের পড়াশুনোও এখানেই লাইন ধরে। বাড়ির পুরুষেরা দুপুরের খাবারও এখানেই সারে আর প্রায়ই ভাতঘুমের নির্দিষ্ট জায়গাও এটাই। মিষ্টি ওই চৌকিরই এককোণায় পা ঝুলিয়ে বসলে প্রিন্সও পাশে গিয়ে বসলো। অনেক লম্বা করে শ্বাস নিলো মিষ্টি, একেবারে বুক ভরে। ‘দেখো প্রিন্সভাই, আমার মনে হয় আমাদের আরেকটু সময় নেওয়া দরকার। প্রথমত আমার পড়াশুনা মাত্র শুরু। তারপরে তোমার নিজেরও কিছু করা উচিত। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা, তা হলো আমাদের দুইজনের পরিবার আর আমাদের লাইফস্টাইল একদম আলাদা।’ একদম সোজাসাপটা বলাই পছন্দ করলো মিষ্টি।

‘তো, তুই কী বলতে চাস? এইসব কথার মানে কী? পরিবার আলাদা মানে কী? দেখ মিষ্টি, আমার সাথে এইগুলা করিস না।’

‘আমি কিছুই করছি না। তুমি আমাকে নিয়ে কী ভাবো সেটা আমাকে বলেছো, আর আমি কী ভাবি এতক্ষণে তুমি বুঝে গিয়েছো। এখন আমি শুধু আমার পড়াশুনায় ফোকাস করতে চাই।’

‘তো আমি কী তোকে আটকে রেখেছি নাকী কোলে করে ধরে রেখেছি!’

‘এইসব অশ্লীল কথা খবরদার আমার সামনে বলবা না।’ থমথমে শোনায় মিষ্টির গলা। কিন্তু যাকে বলা হলো সে বুঝলোই না অশ্লীলতা কোথায়!

‘আমি কালকে চলে যাবো, তোমার সাথে যোগাযোগ সম্ভব না যেমন তেমন আমি এখন চাইছি ও না।’ অনেক দৃঢ়সংকল্প মিষ্টি।

‘যোগাযোগ সম্ভব না কেন? তোকে না দেখে থাকতে পারবো না, বিবিজান!’ কাতর হয় প্রিন্স।

‘এতোদিন থাকোনি?’

‘কই, আমিতো প্রায়ই তোর কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মারিস কীনা সেই ভয়ে সামনে যেতাম না।’

ওর কথার ভঙিতে হেসে ওঠে মিষ্টি। তারপর হাসি চেপে চোখ কটমট করে তাকায় আর একটু ভাবে। ভিতরে ভিতরে ভালোলাগার যে পলিমাটি জমতে শুরু করেছে তাকে আবার ভাসিয়ে দেয় ‘আর যাবা না।’

‘তাহলে, তোর সাথে কীভাবে কথা বলবো? আজব তো? তোদের বাসায় তো ফোন নেই।’

‘কথা হবে না। আমার ভর্তিপরীক্ষা সামনে। আমি ডিসট্রাক্টেড হতে চাই না এখন। এমনিতেই অনেক বেশি পাগলামি করে ফেলেছি। নিজের লিমিট ক্রস করে ফেলেছি।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি তোরে ডিস্টার্ব করলাম না। কিন্তু কতদিন, মিষ্টি?’ অধীর হয় প্রিন্স। কোথায় দুটো ভালোবাসার কথা বলবে, একটু ছুঁয়ে দেবে মিষ্টিকে, চোখে চোখ রেখে একটু হাসবে তা না কঠিন কঠিন কথা। পড়ালেখা আর জীবন নিয়ে এতো চিন্তা করা যায় তাই তো ও জানেনা। ওর বন্ধুরা কী সুন্দর প্রেম করে, পার্কে বা নির্জনে, অন্তত বাইকের পিছনে বসেও তো একবার ঘুরে আসা যেতো!

‘পড়াশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। অন্তত পাঁচ বছর!’

‘তুই আমাকে জবাই দে তাইলে। এমন আজাইরা কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি।’

‘খবরদার বলছি গালিগালাজ করা যাবে না, একেবারে।’ প্রিন্সকে উদ্ধত হতে দেখে থামায় মিষ্টি।

‘দেখো প্রিন্সভাই, আমার প্রতি তোমার ফিলিংস যদি সত্যি হয়, তুমি অবশ্যই আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর আমিও ভালোভাবে বুঝে নিতে চাই, আসলেই তোমার জন্য আমার বুকের ভিতর যে কষ্টটা হয়, সেটা কতখানি সত্যি। প্লিজ তুমি আমাকে দুর্বল করে দিওনা। যদি সত্যিই আমাকে চাও তবে নিজে এসব হুড়োহুড়ি ছেড়ে কাজ করো। তুমি প্রিভিলেজড, খালুর কোনো একটা ব্যবসায় তার সাথে থেকে কাজ শুরু করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ দিতে পারো। আর আমিও নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারি। প্লিজ, তোমার জন্য আমার যে সুন্দর অনুভূতিটা সেটাকে আমার দুর্বলতা বানিয়ে দিও না, যেন লোকে বলতে না পারে তোমার জন্যই আমার পা পিছলে গেছে! প্লিজ!’

প্রিন্স যেনো বুঝলো মিষ্টির আকুতি, ‘কিন্তু পাঁচবছর বেশি হয় না মিষ্টি? আমার তো পাঁচদিনও কষ্ট হবে। দেখিস পারবো না। দুম করে চলে যাবো তোকে দেখার জন্য, দেখিস তুই। এতোটা কঠিন হতে নেই। তারপর শুনবি আমি ঠাশ করে বুক ফেটে মরে গেছি!’ তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো প্রিন্স। তারপর দ্রুতবেগে হেঁটে চলে গেলো, যেনো মনে হলো চোখের পানি লুকোলো।

বাইক স্টার্ট হওয়ার শব্দে মিষ্টির চোখেও পানি এসে গেলো ‘তুমি মরবে না প্রিন্সভাই, আমি মরে গেছি, এক্কেবারে মরে গেছি।’ ফিসফিস করে নিজেকেই বললো মিষ্টি।

চলবে…

(অনেক দিন অপেক্ষা করায় ফেলেছি, আশা করি মনের অবস্থা সবাই বুঝবেন…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here