#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৬
“নুপুর যে কন্যাসন্তান জন্ম দিতে চলেছে এইটা গোপন করা হয়তো ঠিক হয়নি তারানা।”
“যদি আজ আম্মা, সালমান জেনে যেতো নুপুরের পেটে যে সন্তান বেড়ে উঠছে সে ছেলে না বরং মেয়ে, তাহলে তারা কি সেই সন্তানকে বাঁচতে দিতো?”
সুলতানা নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“তখন হয়তো তোর সাথে যা হয়েছিলো, তাই হতো নুপুরের সাথে।”
তারানা কান্নায় ভেঙ্গে গেলো। কান্না করতে করতে বললো,
“আল্লাহ তাদের শাস্তি দিবেন। আমার পেটের সন্তানকে শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ায় যারা দুনিয়ায় আনতে দেয়নি, তাদের বিচার আল্লাহর দরবারে একদিন হবেই হবে।”
বিকালে তারানা, নুপুরের রিপোর্ট দেখতে চলে যায় হসপিটালে। সেখানে গিয়ে নুপুরের রিপোর্ট দেখে তারানা ডাক্তারের কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে, ছেলে না মেয়ে?
ডাক্তার বললো,
“মেয়ে।”
এইটা শুনার জন্য তারানা প্রস্তুত ছিলো না। তারপর ডাক্তারকে এই রিপোর্ট সম্পর্কে তার স্বামীকে মিথ্যা কথা বলতে বললো। দোহাই দিলো যদি তার স্বামী জানতে পারে, নুপুরের পেটে যে সন্তান বেড়ে উঠছে সেই সন্তান ছেলে না হয়ে মেয়ে, তাহলে তারা সেই সন্তানকে পেটেই মেরে ফেলবে!
ডাক্তার তারানার অনুরোধে সালমানকে রিপোর্টের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলেছিলো।
আমি নিচ থেকে উপরে উঠে এলাম। সুলতানা আপার রুমে তারানা আপা বসা আছেন। আমি গিয়ে তাদের পাশে বসলাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখে খুশির হাসি এনে বললাম
“আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের ছেলে আসতে চলেছে।”
তারানা ভাবী আমাকে বললো
“যদি বলি এইটা ছেলে না বরং মেয়ে তাহলে?”
“মানে? কী বলছো তুমি?”
সুলতানা আপা তখন পাশ কাটিয়ে আমাকে বললো
“আরে না না তারানা বলছে যে যদি রিপোর্টে মেয়ে আসতো, তাহলে?”
“তাহলেও একই কদর করতাম আমি। আমি ছেলেমেয়ের মধ্যে কোন ফারাক দেখি না। রাখিও না।”
সুলতানা ভাবী আমাকে বললো,
“নিজের খেয়াল রাখতে হবে এখন থেকে। সময় আর খুব বেশি বাকি নেই।”
এমজ সময় মুনার গলার আওয়াজ পেলাম। মুনা তার আগের পরনের কাপড় সুলতানা ভাবীকে দিয়ে বললো,
“এগুলো ধুয়ে দিও। বাচ্চাতো দিতে পারানাই ভাইকে অন্তত এইটা তো ধুয়ে দিতে পারবে। নাকি?
আমার মেজাজ চটে গেলো। আমি মুনাকে বললাম,
“বারবার এরকম বলার মানে কী মুনা? আর সুলতানা আপা একবার কি না বলেছেন যে উনি ধুয়ে দিবেন না? এই বাড়িতে আসার পর থেকেই তো দেখছি, সুলতানা ভাবী আর তারানা ভাবী তোমার সম্পর্কে ভাবী হলেও ভাবীর কোন মর্যাদা কখনো পাননাই। আর যেকোন মানুষের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে মুনা?”
“অহ আচ্ছা। পেটে ছেলে আসার জন্য তোমার তেজ বেড়ে গিয়েছে বুঝি!”
“এখানে পেটে ছেলে আসার মধ্যে তেজের কী দেখলে তুমি?”
শাশুড়ি এমন সময় রুমে এলেন। মুনাকে বললেন
“তুই চুপ কর।”
মুনা আম্মাকে পালটা জবাব দিলো,
“কেনো চুপ করবো? আমার জবব দিক আগে।”
“না। জবাব সে দিবে না। এখন সে ছেলের মা হতে চলেছে। ছেলের মা হতে হলে সাহস লাগে, তেজ থাকা লাগে। ওর এরকম পরিবর্তন আবার দবে যাবে।”
তারপর শাশুড়ি আমার হাতে চিমটি মরে বললেন,
“বেশি বাড়ন্ত ভালো না। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।”
শাশুড়ি তারানা আপাকে ডেকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন। আমি আর সুলতানা আপা রুমে বসা আছি। কিছুক্ষণের মাথায় আমার জন্য গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে আসলো তারানা আপা। আমি মুখে তুলবো এমন সময় শাশুড়ি এসে হাজির। তারানা আমাকে বললেন,
“তোকে দুধ নিয়ে আসতে বলেছি?”
“না। তবে দুধতো নুপুরের জন্যই রেখেছেন।”
“তাতে কী? দুধ মুনা নিয়ে আসতো। জানি না এতে তুই কিছু মিশিয়েছিস কী না!
তারপর শাশুড়ি আমার হাত থেকে দুধের গ্লাস নিয়ে তারানা আপার সামনে তুলে ধরলেন। তারপর তারানা আপাকে বললেন,
“খা এখন। তুই খেলে বুঝবো, এইটায় বিষ নাই। নাহলে তুই নিষ দিয়েছিস ওকে এইটাই আমি ধরে নেবো।”
তারানা আপার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরতে লাগলো। সুলতানা আপার চোখের কোণে পানি চলে আসলো। মুনা সামনে এসে বললো,
“কী? খাও না। খেয়ে প্রমাণ দাও যে এতে কোন বিষ মেশাওনি।”
আমি মুনাকে বললাম,
“সম্পর্কে তারানা আপা তোমার ভাবী হোন আর বয়সে, সম্পর্কে দুই দিক দিয়েই তিনি তোমার বড়। বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না। ”
“হয়েছে হয়েছে। পেটে ছেলে এসেছে বলে নিজেকে বিড়াট কিছু মনে করে বসো না তুমি।”
শাশুড়ি পাশ থেকে মুনাকে বললেন
“উফ তুই চুপ কর।”
তারপর তারানা আপার মুখের সামনে নিয়ে জোর করে দুধ খাইয়ে দিলেন।
আমার সামনে তারানা আপার দুই চোখ দিয়ে কান্না ঝরে মাটিতে পড়তে লাগলো। মুনা বললো,
“মরেনাই মা। তারমানে সে বিষ মেশায় নাই।”
“হ্যাঁ তাই তো দেখছি। তবে এদের বিশ্বাস করা যায় না। মুনা তুই এই দুই বাজাকে চোখে চোখে রাখবি। আর তোমরা দুইটা নুপুরের কাছ ঘেষো না আর।”
শাশুড়ি ও মুনা একসাথে চলে গেলো রুম থেকে। তারানা আপা বিছানায় বসে গেলেন। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম
“আমার মা টাকার দায়ে আমাকে সতীনের ঘরে পাঠিতেছেন তবে তোমরা দুইজন আমার সতীন হওনি। আমি দুইটা বোন পেয়েছি এখানে এসে।”
তারানা আপা বললো,
“বোন রে, আমি একটাবার মা ডাকটা শুনার জন্য কাতর মনে বসে আছি তোর পেটে চেয়ে। আর সেই আমি তোর দুধে বিষ মেশাবো!”
আমি বললাম
“অসম্ভব। তারা যেমন তারা তেমন চিন্তা করে।”
সুলতানা আপা পাশ কাটিয়ে কান্না করতে করতে বললো,
“দেখেছিস সেই বাচ্চা মেয়েটা কীরকম কথা বলে? যখন এই বাড়িতে এসেছি, তখন সে হাঁটা শিখেছে নতুন। এই দুই হাতে ধরে তাকে হাঁটা শিখিয়েছিলাম। আর আজ সেই মেয়ের কাছে অপমানিত হই?”
তারানা আপাও কান্না করতে লাগলো । তারপর বললো,
“অভিশাপ দিচ্ছি, জামাই ঘর করবে তবে সুখের দেখা পাবে না কখনো সেই মেয়েটা।”
আমি সুলতানা আপা আর তারানা আপাকে চুপ করতে বললাম। অস্থিরতা কমাতে বললাম। সুলতানা আপা উঠে গেলো। আমাকে রুমে গিয়ে বিশ্রাম করতে বললো। যাবার সময় বলে গেলো,
“দুধ নিয়ে আসছি তোর রুমে।”
আমি তারানা আপার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম,
“তোমার ছেলে দেখুক যে তার মা কান্না করছে, এইটা তুমি চাও?”
তারানা আপা বললো,
“না।”
“তাহলে কান্না মুছো। আর কান্না করবে না কখনো। আম্মা আর মুনাতো এমন ই। সবসময় তারা এসব করে আসছে।”
তারানা আপা চোখ মুছে বললো,
“হ্যাঁ। ঠিক আছে আর কান্না করবো না। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। কী খাবি তুই বল।”
“কচুর লতিকা রান্না করে দিতে পারবে আপা?”
“খাবি? আমারও খুব পছন্দ কচুর লতিকা। তবে সুলতানা আপা খেতে পারে না। তার গলায় উশখুশ করে খেলে।”
“আমার ভালো লাগে যে”
“আমারও লাগে। আচ্ছা দেখছি, ড্রাইভার কে বলে লতা আর চিংড়ি আনিয়ে নেই। খাবো একসাথে মজা করে।”
আমি আবার জড়িয়ে ধরলাম তারানা আপাকে। জড়িয়ে ধরে বললাম,
“তুমি খুব ভালো গো! তোমার আর সুলতানা আপার মতো দুইজন বোন না থাকলে আমার যে কী হতো!
“ধুর বোকা মেয়ে। আর এই, তুই যে মা হতে চলেছিস সেইটা তোর মাকে ফোন করে বলেছিস?”
“না।”
“তাহলে বল এখন।”
“বলবো না।”
“বোকা মেয়ে। নিজের মাকে বলবি না তো কাকে বলবি?”
“বলবো না। যে মা তার মেয়ের জীবনের আগে টাকা দেখে সেই মাকে আমি বলবো না কখনোই।”
এমন সময় একটা অপ্রীতিকর খবর এলো। আমার শাশুড়ি এসে বললেন,
“তোর বাবা মারা গিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে।”
আমি মাটিতে বসে পড়লাম। আমার কোন অনুভূতি কাজ করছিলো না। সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান যখন ফিরে এসেছে তখন দেখলাম, তারানা আপা আর সুলতানা আপা আমার পাশে বসে আছেন। তারা দুজনে কান্না করছেন বসে বসে। আমার অনুভূতি অসার তখন। আমি বললাম,
“আমি বাবাকে দেখতে যাবো।”
শাশুড়ি বললেন,
“পোয়াতি বউ তুমি, পেটে বাচ্চা। পেটে বাচ্চা নিয়ে মরা দেখতে যাওয়া যাবে না।”
সুলতানা আপা শাশুড়িকে বললো,
“আম্মা নুপুরের বাবা মারা গিয়েছেন। বাবা। একটা মেয়ের কাছে তার বাবা মানেটা অন্যরকম”
শাশুড়ি হাসলেন। হেসে হেসে বললেন,
“বাবাতো দুই লাখ নিয়ে মেয়ে বিক্রি করেছে আমার কাছে।”
তারানা আপা বললো,
“চিহ! এতো বাজে ভাষা। বিক্রি করেছে? সালমান না নুপুরকে বিয়ে করে এনেছে?”
“হয়েছে হয়েছে। বাচ্চা পেটে নিয়ে মরা দেখা যাবে না।”
“আপনি বুঝছেন না কেনো? বাসাতো আর দূরে না রাস্তার ওপারেই বাসা। মেয়েটাকে যেতে দেন।”
সালমান এমন সময় বাসায় আসলো। আমি খাটে বসে বসে কান্না করতে ছিলাম। সালমান কান্না দেখে আমাকে অভয় দিলো,
“বাচ্চা পেটে রেখে বাপ মরা দেখা যাবে না। আমি যেতে দিবো না তোমাকে।”
সুলতানা আপা সালমানকে বললো,
“আচ্ছা মেয়েটার বাপ মরেছে। একটাবার দেখতে যেতে দাও না গো।”
“তুই বাচ্চা জন্ম দিয়েছিস? পেটে ধরেছিস? তুই কথা বলছিস কেন?
সালমান মাকে ডেকে বললো,
“এই বাজা মেয়েটাকে সরাও তো। সে এখনও আমার বাসায় পড়ে আছে কেনো?”
“আমি তোমার বিয়ে করে আনা বউ।এই অধিকারে আমি আছি এখানে।”
তারানা আপা বললো,
“হয়েছে হয়েছে।মেয়েটার বাবা মারা গিয়েছেন, মেয়েটাকে যেতে দাও।”
আমার চোখের সামনেই শাশুড়ি এসে তারানা আপার গালে একটা থাপ্পড় দিলেন। তারানা আপাকে বললেন,
“অলক্ষ্মী, মুখপুড়া মুখ বন্ধ কর।”
সেদিন আমার আর বাবার লাশ দেখতে যাওয়া হলো না। তারানা আপাকে আমার জন্য মার খেতে হলো। সুলতানা আপাকে গালি শুনতে এলো। আমার রুমের বারান্দা দিয়ে আমার বাবার বাসা দেখা যায়। যোহরের আজানের পর বাসা থেকে একটা খাটিয়া বের হলো। সাদা কাফন মোড়ানো লাশ। লাশটা আমার বাবার। হায়! তবে আমি দেখতে পারিনি লাশটা। আমার মা হয়তো আজ সাদা শাড়ি পরেছে। খুব কান্না করছে হয়তোবা। আমার ছোট ভাইটা, সেতো মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। সে কি কান্না করছে?
রুমে আসলাম। দরজা লাগালাম আমি। মাথার উপরের ফ্যান বন্ধ করলাম। ওড়না প্যাচানোর সিদ্ধান্ত নিলাম ফ্যানের মধ্যে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। নিজের শরীরের সাথে আরেকটা শরীরকেও শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে চিরতরে। এই জীবন আমার রেখে লাভ নেই….
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)