#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৮
গলাটা ফ্যানের সাথে ঝুলানো ওড়নার সাথে আটকে দিলাম। পায়ের নিচের টুলটা ফেলে দিবো এখন।
এমন সময় হুট করে তারানা আপা রুমে ঢুকে গেলেন। আমাকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে আমাকে নিচে নামালেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই তারানা আপা আমার দুই গালে দুইটা থাপ্পড় দিলেন। তারপর উঠে গিয়ে দরজা লাগালেন তারানা আপা। আমি নির্বাক হয়ে বসা রইলাম। আমার চোখ দিয়ে কোনো পানি বেরুলো না। অসার অবস্থায় বসে রইলাম। তারানা আপা আমার মুখ উপরে তুলে জিজ্ঞেস করলো,
“এগুলো কী হচ্ছে?”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। তারানা আপা আমার গালে আরেকটা থাপ্পড় দিলো। আমার বাহুতে ধরে ঝাড়া দিয়ে আমাকে বললো,
“কী হয়েছে আমাকে বলবি তো?”
আমি হুট করে ঝড়তে শুরু হওয়া বৃষ্টির মতো গলে তারানা আপাকে জড়িয়ে ধরলাম। হাপাতে হাপাতে ফুপড়ে কেঁদে কেঁদে বললাম,
“আমি এই জীবন রাখতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই না। আমাকে মরতে দেউ তুমি।”
তারানা আপা আমার কোনো কথা না শুনে বিছানার উপর রাখা টুলে উঠে ওড়নাটা ছাড়িয়ে আনলো। টুলটা নিচে রাখলো। আমাকে বললো,
“জীবন শুধু তোর একার?”
আমি নির্বাক থেকে রইলাম ফেলফেল দৃষ্টিতে ফ্লোরের টাইলসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সাদা মার্বেল টাইলসে নিজের প্রতিলিপি আবছায়া ভেসে আসছে। আমি দেখলাম আমার চুলগুলো উশখুশ করে ছড়ানো।
তারানা আপা আমার পেটে হাত দিয়ে বললো,
“তোর জীবনে সাথে এখন আমাদের জীবনও জড়িত নুপুর। তুই যদি মরে যাস তাহলে আমরা কী নিয়ে বাঁচবো?”
আমি এবারও কোনো জবাব দিলাম না। আমার নির্বাকতা তারানা আপাকে অসহ্য করে তুললো। তারানা আপা উঠে গিয়ে সুলতানা আপাকে নিয়ে আসলেন। সুলতানা আপাকে এনে আমার সামনে বসিয়ে আমি কী করতে গিয়েছিলাম সব বললেন। সুলতানা আপা আমার মুখ তুলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“জীবনে আর কোনোকিছু করা বাকি আছে তোর?”
আমি জবাব দিলাম না। সুলতানা আপা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না করতে করতে বললো,
“বোন রে জীবনে কখনো মা হতে পারিনি। এই মা না হওয়ার যন্ত্রণা আমাকে একজীবন তারা করে বেড়াবে। তোকে কখনো জামাইর বিয়ে করে নিয়ে আসা সতীন ভাবিনি।”
তারানা আপা বললো,
“যখন এই ঘরে বউ হয়ে আসি, তখন আমিও জানতাম না যে আমার সতীন ঘরে আছে। অভাবী বাবার মেয়ে আমি। জীবনে কখনো সুখ বলে কিছু আছে সেইটা বুঝেই উঠতে পারিনি। বড় আপাকে আমি কখনো সতীন ভেবে উঠতে পারিনি। আমার বড় বোন ছিলো। রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় সে। বিয়ে করে এসে আমি নতুন আরেকটা বোন পেয়েছি। বড় বোন। জীবনের সুখ দুঃখ সব আমরাই আমাদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিই। তুই যখন আসলি আমাদের সতীন হয়ে তখন আমরাও এইটা মানিয়ে নিয়েছি। এই মানিয়ে নেয়া থেকেই তোকে আপন করেছি রে।”
আমি কান্না করতে করতে সুলতানা আপাকে বললাম,
“আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। দুঃখের মধ্যে সুখ খোঁজা যায় আমি সেইটা ভুলে গিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
তারানা আপা তার ওড়না দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিলো। সুলতানা আপা পানি এগিয়ে দিলেন। তারানা আপা জড়িয়ে ধরে বললেন,
“জীবনে আর কখনোই এরকম করবি না এরকম করার চিন্তাও করবি না ”
এমন সময় শাশুড়ি এসে দরজায় টোকা দিলেন। তারানা আপা শাশুড়ির গলা শুনে আমাকে বললো,
“নুপুর তোর চোখ মুখ ঠিক করে নে। তাদের বুঝতে দেওয়া চলবে না যে তুই সুইসাইড করার মতো কোনো কিছুর চিন্তা করেছিলি।”
সুলতানা আপা গিয়ে দরজা খুললো। শাশুড়ি রুমে ঢুকেই শুরু করলেন,
“এই তোমরা এখনও এখানে কী ফন্দি আটতেছো? তোমরা জানো না যে আজ মুনাকে দেখতে আসবে? আর চাল বসিয়েছিলো কে?”
তারানা আপা আমতা আমতা করে বললো,
“আমি”
“অহ আচ্ছা। তাইতো বলি পটর পটর করা মেয়েটা চাল বসিয়েছে ঠিক তবে চালের খোঁজ রাখতে পারে নি। সাধে কি আর বলি বাজা মেয়েরা ঘর সংসার করতে পারে ন”
শাশুড়ি আমার রুমের এসি অন দেখে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
“একী এখনও এসি অন? সারা ঘর ঠান্ডা বরফ হয়ে গেলো! এই মেয়ে তোর জ্বর আসে যদি?”
সুলতানা আপা শাশুড়িকে বললেন,
“জ্বর আসবে না। আমি এইমাত্র ছেড়েছি এসি।”
“জ্বর আসবে না বললেই হলো? বাচ্চা পেটে ধরেছিলি? বাচ্চা ধরার সময়ে শরীরের অবস্থা কেমন হয় জানিস?”
শাশুড়ির কথা শুনে সুলতানা আপা চেপে গেলো। উত্তর দিলো না। শাশুড়ি রুম থেকে যাবার সময় সুলতানা আপাকে বললেন,
“তোর বিয়ের সময় যে গহনা গুলো দিয়েছিলাম সেগুলো সব বের করে এনে দে। মুনার সাথে দিবো আর তারানা, তোর বিয়ের ডায়মন্ডের আংটিটা দিয়ে দে। মুনা বলেছে এইটা তার পছন্দের।
সন্ধ্যার সময় মুনাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসলো। পাত্রের মা, আর তিন বোন এসেছে। জামাই আমেরিকা থাকে এখনও দেশে আসেনি। আগামী সপ্তাহে দেশে আসবে।
আমি উপরে ছিলাম। শাশুড়ি আমাকে ডাক দিলেন। বললেন,
“মুনাকে নিয়ে নিচে আসো বউমা।”
আমি মুনাকে নিয়ে নিচে নামলাম। শাশুড়ি আমাকে দেখিয়ে পাত্রের মাকে বললেন
“বড় লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। আমার ছেলের বউ কম, মেয়ে মানি তাকে।”
পাত্রের মা হেসে হেসে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আপনার মেয়েকে বিয়ে করিয়ে আমার ছেলের বউ করে ঘরে নিলে তাকে বউ কম মেয়ে মানবো আমি।”
শাশুড়ি বললেন,
“না না আমি এভাবে বলিনি কথাটা।”
“না এভাবেই বলেছেন।”
তারপর পাত্রের মা মুনার দিকে তাকিয়ে মুনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“গহনা পরার খুব শখ নাক?”
শাশুড়ি পাশ কাটিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ হ্যাঁ। এই যে গলায় হীরার হারটা দেখছেন, সেইটা তার ভাই গতকাল এনে দিয়েছে। দাম শুনেছি দুই লক্ষ টাকা।”
পাত্রের মা আবার হাসলেন। শাশুড়িকে বললেন,
“বেয়াইন, আমার হাতে এই যে আংটি দেখছেন, এইটা নীলকণ্ঠ পাথর। আফগানিস্তান থেকে আনানো। আর দাম শুনেছি লাখ তিনেকের কম না।”
তারপর পাত্রের মা তার আঙুল থেকে নীলকণ্ঠ পাথরের আংটিটা মুনার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। মুনার মাথায় হাত রেখে বললেন,
” গহনায় মুড়িয়ে নিয়ে যাবো বউমাকে।”
শাশুড়ি বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
উপর থেকে সুলতানা আপা নাস্তা নিয়ে নিচে নামলেন। সুলতানা আপাকে দেখে মুনার হবু শাশুড়ি বললেন,
“ওনি কে?”
শাশুড়ি জবাব দিলেন,
“আমাদের বাসার কাজের মেয়ে। অনেকদিন থেকে আছে।”
আমি খেয়াল করলাম সুলতানা আপা তার ওড়না দিয়ে মুখ ঘুরে নিচ্ছে। তার চোখের কোণে জল চলে এলো।
মুনার হবু শাশুড়ি বললেন,
“কী মেয়ে, কান্না করছো কেনো? এখানে তো খাবার দাবার সব আছে। তাহলে কান্না করার কী? কাজের মেয়ের কান্না মানায় না।”
সুলতানা আপা জবাব দিলেন না। এমন সময় একটা অঘটন ঘটে গেলো। এই অঘটনের জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এসেছে। ড্রাইভারের হাতে একটা ব্যাগ। আমি জিজ্ঞেস করলাম
“এইটা কী?”
“কুরিয়ার এসেছে।”
“কার?”
“বড় ভাবীর।”
এই বলে ড্রাইভার ঘরের ভেতরে ঢুকে মেহমানদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুলতানা ভাবীর সামনে গিয়ে বললো,
“ভাবী কুরিয়ার থেকে আপনার এই পার্সেল এসেছে।”
ড্রাইভার চলে গেলো। ড্রইংরুমে বসা সবার মুখ থ বনে গেলো। মুনার হবু শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,
“ড্রাইভার ওই কাজের মেয়েটাকে বড় ভাবী বললো কেনো?”
উপর তলা থেকে তারানা আপা আকস্মিক এসে বললো,
“আমি মেঝো ভাবী।”
তারপর আমার বাহুতে হাত রেখে বললো,
“এইটা মুনার ছোটো ভাবী। আমার ছোট সতীন। আর উনি আমার বড় সতীন। তিন সতীন একসাথে এক জামাইর ঘর করছি এখানে।”
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)