#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৩০
[দুঃখিত গতকালের পর্বে আলভিকে সত্যের এক বছরের ছোট হিসেবে দেখিয়েছিলাম। আলভি সত্যের চেয়ে ১৯ দিনের ছোট মাত্র!]
সত্যকে নিয়ে রুমানা বেগম উপরে চলে গেলেন। সত্যকে নিজের রুমে বসিয়ে রেখে নিচে নেমে এলেন তিনি। নুপুরের সামনে দাঁড়িয়ে নুপুরকে বললেন
“এই তোর প্রতিদান? এই তোর ভালোবাসা?”
নুপুর নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। জবাব দিলো না। সুলতানা বলল
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?”
সুলতানার কথায় রুমানা বেগম চটে গেলেন। সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনি সেই মহিলা না যিনি একুশে পদক পেয়েছিলেন সেদিন? অহ আচ্ছা আমার তো আগেই বুঝা উচিত ছিলো এসব লোকের নিজের ঘর ঠিক থাকে না। কোথায় গেলো আগের সম্পর্ক? দুই যুগ আগের সম্পর্কের নতুন করে খোঁজ কেন এখন?”
তারপর রুমানা বেগন সালমানের সামনে গেলেন। নুপুরকে নিয়ে দাঁড় করালেন সালমানের সামনে। নুপুরকে বললেন,
“এই তোর স্বামী না? যে মেয়ে বাচ্চাকে অস্বীকার করেছিলো? আর তাকে আজ পেয়ে আমাদের অস্বীকার করছিস?”
সুলতানা পাশ থেকে আবার বলল,
“আপনাদের অস্বীকার করছে কোথায়?”
“ব্যস! আপনি মুখ বন্ধ রাখেন। আপনাকে আমার পরিবার নিয়ে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে?”
সত্য উপর থেকে বলে উঠলো,
“তাহলে আপনি আমার পরিবার?”
রুমানা বেগম সত্যের কথা শুনে থ বনে গেলেন। নুপুর উপরের দিকে তাকালো। আলতাফ চৌধুরীর চোখ দিয়ে পানি গরগর করে পড়তে লাগলো। সত্যের কথায় সবাই যেনো কেমন একটা শক খেয়ে বসলো। নুপুর তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিলো সত্যের গালে। থাপ্পড় দিতেই সত্য বলল,
“আমাকে আর কত চুপ করিয়ে রাখবা মা আর কত?”
নুপুর কান্না করে বলল,
“এই আমার শিক্ষা? এই আমার জীবন বিসর্জন? আজ তোর মুখ থেকে এমন কথা শুনতে আমি বেঁচে ছিলাম?”
“কেমন কথা?”
“তুই আমার মেয়ে সত্য। তুই কীভাবে কথা বলছিস? কাদের নিয়ে বলছিস? কিছু বুঝে উঠতে পারছিস?”
“কেনো পারব না মা? কে আমার পরিবার? দাদা? দাদি? তারা আমার আপন? আমার পরিবার?”
সত্যকে এবার জোরসে একটা থাপ্পড় দিলো নুপুর। নিচ থেকে রুমানা বেগম বললেন
“ওকে মারিস না নুপুর। ওকে মারিস না।”
আলতাফ চৌধুরী বললেন
“মারে আমার নাতিন কে মারিস না। আমার বুকে ধরে রে মা। বুকে ধরে।”
রুমানা বেগম সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সত্যের গালে হাত দিয়ে ধরে বললেন
“তুই এতোটুকুন ছিলি রে সত্য। আজ অনেক বড় হয়েছিস। যখন দাদি দাদি বলে ডাকতি তখন তোর এই দাদিই সব ছিলো রে। এই যে নিচে তোর দাদা বসা, জানিস তার প্রাণ তোর উপর ই।”
তারপর রুমানা বেগম নুপুরের হাত ধরে বললেন
“মনে আছে নুপুর যখন ও ক্লাস টেনে থাকতে কিডন্যাপ হয়েছিল, যেদিন ফিরে আসে সেদিন আমার গলার চেইন বিক্রি করে সেই টাকায় এতিম খাইয়েছিলাম। মনে আছে?”
নুপুর মাটিতে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। রুমানা বেগম নুপুরকে তুলে বললেন,
“জানিস রে মা পর ভাবিনি কখনো। তবে আজ সেই আপন সেই পর সব বুঝে গেলাম। সব। এই মেয়েটা, যাকে আমরা আমাদের মতো বড় করেছি সেই মেয়েটা আজ বলছে আমরা কে?”
আলতাফ চৌধুরী নিচ থেকে বলে উঠলেন,
“বন্ধ করো রুমানা। বন্ধ করো। আমরা তার কেউ না। কেউ না। আজ সে বুঝে গিয়েছে। আমরা তার কেউ না। কেউ কখনো ছিলাম ই না।”
নুপুর নিচে নেমে আলতাফ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবা এরকম বলো না। আমার মাথার উপর কেউ নাই। কেউ না। আমি তোমার মেয়ে। আমি তোমার মেয়ে বাবা।”
“না রে মা। আমি কেউ না। আমরা কেউ না। আজ আমার সত্য, আমার সত্য সেই সত্য যে এতোটুকু ছিলো আজ সেই সত্য তার জীবন সত্য জেনে আমাদের অস্বীকার করছে। আমরা কেউ না। কেউ না।”
পুরো ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। নুপুর হুট করে কেমন জানি তেজস্বী রূপ নিলো। সিঁড়ি বেয়ে সত্যের সামনে গিয়ে সত্যের হাত নিজের মাথায় নিয়ে বলল,
“আমার মাথায় হাত দিয়ে বল তুই আরিয়ানকে বিয়ে করবি। আলভিকে না।”
সত্য হকচকিয়ে গেলো। বলল
“কী করছো মা?”
“কী করছি এসব বুঝা লাগবে না। আমার জীবনের কসম তুই যদি আর একটাও কথা বলিস আমি তোকে আমার জীবন শেষ করে মৃত্যু দেখাবো।”
“মা কী বলছ তুমি?”
নিচ থেকে সুলতানা বলল,
“এসব কী হচ্ছে নুপুর?”
নুপুর বলল,
“আপনি আজ কথা বলবেন না আপা। আমার জীবন আমার সিদ্ধান্ত। আজ পঁচিশ বছর আমি এখানে আছি। আমার জীবন দিয়ে হলেও আমার বাবা মায়ের ঋণ শোধ অসম্ভব। আমি আরিয়ানের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো। আপনি কোন কথা বলবেন না।”
সত্য বলল,
“তাহলে আমার বিয়ে দিয়ে ঋণ শোধ হবে?”
“না হবে না। আমার মৃত্যু দেখে তোর ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। আর যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাস তাহলে এখনই মত দিতে হবে?”
আলভি বলল,
“মামি এসব কেন করছেন আপনি?”
নুপুর চিৎকার করে উঠলো। বলল
“তুমি চুপ থাকো। এখানে কোন কথা তুমি বলবা না।”
নুপুর আবার সত্যকে জিজ্ঞেস করল,
“তুই আরিয়ানের সাথে বিয়ের মত দিবি কিনা বল?”
সত্য বলে উঠলো
“আমার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে যদি এই ঋণ শোধ হয় তবে আমি এই বিয়েতে রাজি।”
নুপুর উপর থেকে সুলতানা, সালমান আর আলভিকে বলল,
“চলে যাও এখান থেকে। আর কখনোই আমি সেই জীবন ফিরে পেতে চাই না। কখনোই না। আমার এই জীবন আমার বাস্তবতা। আমার জীবন এখন আমার মতোই চলবে।”
সুলতানাকে জড়িয়ে ধরলেন রুমানা বেগম। সুলতানা কান্না করতে করতে বলল,
“মা আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমার মেয়ের কথা আমার শিক্ষার উপর আজ প্রশ্ন তুলল।”
সত্য বলল,
“আমার কথায় শিক্ষার উপর প্রশ্ন কেনো আসবে মা?”
“তুই চুপ কর। আর আপনারা চলে যান এখান থেকে। আর কখনোই আমার জীবনে আসবেন না।”
আলভি, সালমান আর সুলতানা চলে গেলো।
এদিকে কানাডায় মদের বারে নারী নিয়ে মত্ত হয়ে শুয়ে আছে আরিয়ান। মদ-নারী এই দুইয়ে আরিয়ানের জীবন ঘিরে আছে।
#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৩১
সত্য তার রুমে শুয়ে আছে। নুপুর সত্যের রুমে ঢুকলো। সত্যকে জড়িয়ে ধরল নুপুর। জড়িয়ে ধরে সত্যকে বলল,
“মারে আমার সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমার আর কোন রাস্তা ছিল না। যে আত্মমর্যাদার জন্য আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে তোকে নিয়ে একা একা এক বিশাল পথ পাড়ি দিয়েছিলাম, সেই আত্মমর্যাদা আমক আজও বিসর্জন দিতে পারবো না। আমার কথা, আমার সম্মান আমি সবার আগে দেখি রে মা।”
“তাই বলে আমার জীবন নিয়ে?”
“নারে মা এরকম কথা মুখেও আনবি না। এই মা কখনোই চায় না তার মেয়ের খারাপ হোক”
“তাহলে আমার অমতে বিয়ে দিয়ে তুমি খুশি হবা? আত্মমর্যাদাবান হবা?”
নুপুর জবাব দেয় না। রুমানা বেগম রুমে আসেন। সত্যকে দাঁড় করিয়ে সত্যের মুখে হাত দিয়ে হাতিয়ে দিয়ে বলেন,
“আমার ঘরটা আবার আলো করে দিস রে মা। আমার হারানো সংসার টা আবার পূর্ণ করে দিস”
সত্য এবার আর কোন জবাব দিলো না। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো নিচে। নুপুর সত্যকে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“কান্না করছিস কেন তুই?”
সত্য আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো সত্য। রুমানা বেগম পাশেই দাঁড়ানো। সত্যকে নুপুর কান্না করতে করতে বলল,
“মারে, মায়ের মাথা হেট হোক এরকম টা তো তুই কখনোই চাস না। তাইনারে?”
সত্য হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার জীবনটা শুধু তোমার জন্য মা। আমি তোমাকে ছাড়া আর কারোর কথা জানিও না মানিও না। আর তোমার সত্য বেঁচে থাকতে তোমার কথার দাম কখনো কমবে না। জীবন দিয়ে হলেও তোমার সত্য তার মায়ের মাথা হেট হতে দিবে না”
নুপুর সত্যের মুখের কাছে হাত এনে বলল,
“নারে মা, জীবন দিয়ে হলেও এরকম কথা বলিস না। আমার আর এই জীবনে কে আছে শুনি?”
সত্য আবার মাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না করল বেশ কিছুক্ষণ। রুমানা বেগম নুপুরকে বললেন রাতের রান্না করে নিতে।
গভীর রাত। সত্য শুয়ে আছে তার বিছানায়। মোবাইল হাতে নিচ্ছে না। পাশেই রাখা ছিলো। ওয়াইফাই কানেক্টেড। টুনকো টুনকো শব্দে তখন তখন মেসেজ আসছে। সত্য সেটা খেয়াল করেনি। হুট করে মেসেজ আসাটা কেমন যেনো বেড়ে গেলো। সত্য মোবাইল হাতে নিল। আলভি মেসেজ দিয়েছে সাতটা। আলভির মেসেজগুলা সত্য পড়তে লাগল। আলভির দেয়া মেসেজগুলা ছিলো,
“সত্য, আমি জানি তুমি আমাদের বিয়েটা মন থেকে অস্বীকার করোনি।”
“সত্য শুনো আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমিও আমাকে ভালোবাসো এইটা সত্য। এই ভালোবাসার চেয়ে উর্ধ্বে কোন সম্পর্ক হতে পারে না”
“আমাদের পারিবারিক ঝামেলা যেখানে মূখ্য না সেখানে কেন তুমি মামির কথা মেনে নিলে? মানছি তারা তোমাদের পঁচিশ বছর ধরে খেয়াল রেখেছেন তাই বলে এখন তোমাদের জীবন দিয়ে হলেও তাদের সেই খেয়াল রাখাটা পূরণ করতে হবে”
“আই লাভ ইউ সত্য। প্লিজ তুমি এমন করো না। প্লিজ সত্য।
“সত্য শুনো, তোমাকে এক্টিভ দেখাচ্ছে তবুও তুমি সিন করছো না। হুয়াটস ইউর প্রবলেম সত্য?”
“লাইফের ডিসিশিন এভাবে নিও না সত্য। ইভেন তুমি এই ডিসিশন নিতে পার না একা একা। আমিও তোমাকে ভালোবাসি আর এই ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি ছিলো আমরা একে অন্যের সাথে আজীবন থাকবো। সেখানে তুমি এসব কী শুরু করেছো?”
“সত্য, আই লাভ ইউ”
এতোক্ষণ সত্য এক নাগাড়ে আলভির দেয়া সাতটা মেসেজ পড়লো। তারপর সত্য রিপ্লাই দিল,
“আই এম সরি ”
ওপাশ থেকে আলভি সাথে সাথেই রিপ্লাই দিল,
“সরি মানে?”
“সরি মানে আমাকে ক্ষমা করে দাও”
“ক্ষমা? এসব কী বলছো সত্য? আই লাভ ইউ এন্ড ইটস দ্য ট্রুথ”
“আমার কাছে আমার মায়ের আত্মসম্মান সবচেয়ে বড়”
“আর আমার ভালোবাসা?”
এই মেসেজটা দেখে সত্যের চোখ দিয়ে পানি টলমল করে পড়তে থাকে। নিজেকে শক্ত করে নিয়ে সত্য জবাব দেয়,
“ভুলে যাও ভালোবাসা”
“ভুলে যাবো? এসব কী বলছো সত্য?”
“যা সত্য তাই। এটাকে মেনে নিতে হবে আলভি। আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা আর পসিবল না”
“পসিবল না? আর ইউ সিরিয়স?”
সত্য নিজেকে শক্ত করে কড়ায় গলায় একটা ভয়েজ মেসেজ রেকর্ড করে আলভিকে পাঠালো। মেসেজটা ছিলো এরকম,
“আমি কখন থেকে একটা কথা বারবার বলছি তোমাকে তুমি বুঝার চেষ্টা করছো না কেন অদ্ভুত! আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা এখন আর পসিবল না। আমাকে ভুলে যাও মিনস আমাকে ভুলে যাও। এই ভুলে যাওয়াটা এখন ভুলতেই হবে। অন্য কোন উপায় নেই। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ পর আলভি রিপ্লাই দিলো,
“আই ডোন্ট ওয়ান্ট ফ্যান্টাসি, ইমোশন এন্ড আদার থিংক, আই লাভ ইউ এন্ড ইটস ফাইনাল। ইউ আর অনলি মাইন সত্য”
“রাবিশ! আই হেইট ইউ”
“হেইট? আমাকে? সিরিয়াসলি? ”
“হ্যাঁ। আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না।”
“এতো সহজে বলে ফেললে সত্য?”
“হ্যাঁ। আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমাকে মুক্তি দাও প্লিজ।”
“মুক্তি? তোমাকে?”
“আই ওয়ান্ট দিস!”
“আমি মুক্তি নিয়ে নেই?”
“আমি কিচ্ছু জানি না। আমার পক্ষে আর তোমার সাথে কথা বলাও সম্ভব না।”
এই বলে সত্য আলভিকে ব্লক মেরে দিলো। ওপাশ থেকে আলভির দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কিছু বুঝে উঠার আগেই আলভি একটা সুইসাইড চিরকুট লিখলো। চিরকুটটা ছিলো এরকম,
“যেই জীবনে সত্য আমার হলো না সেই জীবন আমি আর রাখতে পারলাম না। আই এম সরি”
বিছানার চাদর টা দড়ির মতো করে ফ্যানের সাথে বাধলো আলভি। গভীর রাতের অন্ধকারে নিজেকে ফাশ লাগিয়ে দিলো ফ্যানের সাথে।
দ্বিরাগমন
মিদহাদ আহমেদ
#পর্ব_৩২
পরেরদিন সকালে রুমানা বেগম কল করলেন কানাডায় তার ছেলে আলিফ কে। আলিফ কল উঠালে রুমানা বেগম বললেন,
“ভালো আছিস বাবা?”
“হ্যাঁ। কী দরকার? আমি বাইরে যাবো।”
“এভাবে বলছিস কেনো বাবা? বৌমা ভালো আছে?”
“হ্যাঁ ভালো আছে।”
“আর আরিয়ান?”
“সে ক্লাবে গিয়েছিলো রাতে এখনও আসেনি।”
“বাবা একটা কথা বলার ছিলো।”
“কী কথা?”
“বাবা…”
“উফ! তোমাদের দেশের লোকজনের সমস্যা কোথায়? যা বলার সরাসরি বলে দিলেই তো হয়।”
“বাবা আমি নাতির জন্য মেয়ে দেখেছি।”
“হুয়াট? মেয়ে?”
“হ্যাঁ বাবা”
“তোমাকে কে বলেছে আমার ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে? হু সেইড ইউ?”
“বাবা এরকম বলছিস কেন? মেয়ে ভালো। ডাক্তার। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করা। দেখতে সুন্দরি। ”
এবার ওপাশ থেকে রুমানা বেগমের ছেলে হু হু করে হাসলো। হেসে হেসে জবাব দিল,
“কানাডিয়ান সিটিজেন আরিয়ান। সে বিয়ে করবে দেশে? হাউ ফানি মা”
“এভাবে বলছিস কেন বাবা? জীবনে কিছু চেয়েছি তোর কাছে?”
“চাওয়ার ইচ্ছা নাকি?”
“বাবা দেখ, নাতিটাকে নিয়ে একবারের জন্য দেশে আয়!”
এমন সময় আলিফের হাত থেকে আলিফের স্ত্রী মোবাইল কেড়ে নিলো। ঝাঁঝালো গলায় শাশুড়িকে বলল,
“কী কী কী? কার বিয়ের কথা হচ্ছে শুনি?”
” বৌমা এভাবে বলছো কেনো?”
“এভাবে বলছি মানে? আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন আমাকে?”
” আরিয়ান কি আমাদের কেউ না?”
“তো?”
“একটাবার বউ আমার ছেলে আর নাতিকে নিয়ে দেশে আসো। বড্ড ইচ্ছা হয় ছেলে আর নাতিকে দেখার!”
“দেখার জন্য দেশে আসতে হবে কেনো? আপনার জামাইকে তো গত পর্শুদিন ছবি পাঠিয়েছে আপনার ছেলে।”
“ও মা এভাবে বলছো কেনো?”
“কীভাবে বলছি আবার?”
“উনি তোমার শ্বশুর হোন মা”
” ও আচ্ছা আমার ভুল হয়ে গিয়েছে তাইলে। তাইনা?”
“না না বউমা এভাবে বলছো কেনো। একটাবার দেশে আসো না? আমি নাতিবউ পছন্দ করে রেখেছি। খুব সুন্দরি মেয়ে সে।”
পাশ থেকে রুমানা বেগমকে আলতাফ চৌধুরী ডেকে বললেন,
“মোবাইল টা আমার হাতে দাও রুমানা”
রুমানা আলতাফ চৌধুরীর হাতে মোবাইল দিলেন। আলতাফ চৌধুরী কল ধরে বউমাকে বললেন,
“মারে দেশে আয় আমার ছেলেকে নিয়ে”
“আসসালামুয়ালাইকুম আব্বা।”
“ওয়ালাইকুম আস সালাম। দেশে আয় রে মা”
“না আব্বা সম্ভব না। আর আরিয়ান এখানে বড় হয়েছে সে এসব কালচারের মানুষ। সে দেশে বিয়ে করবে সেটা আপনারা চিন্তা করেন কীভাবে?”
“একটাবার আয় মা দেশে।”
“না আব্বা। ইটস ইম্পসিবল ”
“আলিফ আছে? ”
“হ্যাঁ আছে। ধরেন। কথা বলেন।”
আলিফ কল ধরে বাবাকে সালাম দিয়ে বলল,
“কী হয়েছে আব্বা? সকাল সকাল কাজে যাবো তা না আপনাদের ঘেনঘেন শুরু হয়ে গিয়েছে।”
“বাবা দেশে আয় নাতিকে নিয়ে। নাতিকে দেশে বিয়ে দিবো।”
“বললাম না বাবা এইটা সম্ভব না। এভাবে আসা যাবে না এই সিজনে।”
আলতাফ চৌধুরী বললেন
“আমার সব জায়গা সম্পত্তি আমি আরিয়ানের নামে লিখে দিতে চাচ্ছি।”
“তো? এটা অসম্ভব বাবা”
আলিফকে পাশ থেকে তার স্ত্রী হাতে একটা চিমটি কাটলো চিমটি কেটে ইশারায় আলাপ চালিয়ে যেতে বলল। আলিফ এবার মিষ্টি সুরে বলল,
“জি আব্বা”
“বাবা দেশে আয় নাতিকে নিয়ে। আমি তার বিয়ে দিব আর তার নামে আমার এই বিশাল সম্পত্তি লিখে দিব।”
“কিন্তু আব্বা”
“কিন্তু কী?”
“এই মুহূর্তে দেশে আসা আর আরিয়ান কি মানবে এই বিয়ে?”
“মানবে বাবা। তুই তাকে নিয়ে দেশে আয়”
“আর সম্পত্তি কি…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সব লিখে দিবো। সব সব।”
“আচ্ছা আব্বা আমি আপনাকে জানাচ্ছি একটু পর।”
এক ঘন্টা পর আবার আলিফ কল দিলো আলতাফ চৌধুরীর মোবাইলে। আলতাফ চৌধুরীকে সে বলল,
“বাবা আমরা নেক্সট উইকে দেশে আসছি মাত্র দুই উইকের ছুটিতে। আরিয়ান ও আসবে। ও রাজি আছে”
আলতাফ চৌধুরী বলে উঠলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
আলতাফ চৌধুরী ডাক দিলেন,
“রুমানা… রুমানা শুনে যাও…”
“কী হয়েছে?”
“সামনের সপ্তাহেই ছেলে-বউ-নাতি দেশে আসছে। দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের আয়োজন করতে হবে যে আমাদের”
“আলহামদুলিল্লাহ। আমি নুপুরকে জানিয়ে আসি খবরটা।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও। যাও যাও। খুশির সংবাদ যে এসেছে”
এদিকে কানাডায় আরিয়ান তার ক্লাবের ফ্রেন্ডদেরকে বলছে,
“বাংলাদেশ যাবো। একটা মুরগি খাবো আবার চলে আসবো। দুই সপ্তাহের ট্রিপ একটা”
অন্যদিকে সুলতানা নুপুরের মোবাইলে কল দিয়ে জানালো আলভি আইসিইউ তে। রাতে সালমান পানি খাওয়ার জন্য উঠে আলভির দরজায় উঁকি দিলে দেখতে পায় আলভি ফাশ দিয়েছে গলায়। তারপর তড়িঘড়ি করে তাকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার তাকে ইমার্জেন্সি এয়ার এম্বুলেন্স করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা সিএমএইচ এ পাঠায়। এখন সেখানে আইসিইউ তে আছে আলভি। বাঁচবে কিনা মরবে সেটা জানে না। সুলতানা বারবার নুপুরকে অনুরোধ করল, আলভির সাথে যেনো সত্যের বিয়ে দিয়ে দেয়। সুলতানা নুপুরকে আলভির জন্য দোয়া করতে বলল। নুপুর কল কেটে দিলো। তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। নিজেকে মনস্ত করল, সত্যকে গিয়ে জানাবে আলভির কথা। এই কথাটা সত্য থেকে গোপন করবে না। আর সত্যকে বাধাও দিবে না এই বিয়েতে। নুপুরের একটুকু আত্মসম্মান বিসর্জনে যদি মেয়ের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, তাহলে মায়ের ভালোবাসাই পূর্ণতা পায় জয়ী হয়। আলভির সাথে সত্যের বিয়েতে আর সে কোন বাধা দিবে না। এজন্য রুমানা বেগম তাকে যাই বলুক না কেন সেটা সে মেনে নিবে তবুও মেয়ের ইচ্ছাতেই বিয়ে দিবে মেয়েকে।
নুপুর রুম থেকে বেরিয়ে সত্যের রুমে যাবে এমন সময় রুমানা বেগম নুপুরের সামনে এলেন। নুপুর দেখতে পেল মায়ের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। নুপুরকে জড়িয়ে ধরে রুমানা বেগম বললেন,
“আগামী সপ্তাহেই আমার ছেলে-বউ-নাতি দেশে আসছে। আগামী সপ্তাহেই সত্যের সাথে আরিয়ানের বিয়ে”
নুপুর শকড হয়ে গেল। বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো বলে মনে হচ্ছে। একদিকে আলভির জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ অন্যদিকে আরিয়ান দেশে আসছে সত্যকে বিয়ে করতে। এক কঠিন অবস্থার মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়লো নুপুর।
#দ্বিরাগমন
#মিদহাদ_আহমেদ
#পর্বঃ৩৩
সপ্তাহের মাথায় কানাডা থেকে আরিয়ানকে নিয়ে আরিয়ানের বাবা মা দেশে চলে আসল। এদিকে আলভি সেই যাত্রায় সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। স্কুল থেকে বিশেষ আবেদন করে এক মাসের ছুটি নিলো সুলতানা। আলভির সাথে সারাক্ষণ সময় দেয়ার চেষ্টা করে সে। একান্ত মনে সারাদিন ছবি আঁকায় কাটিয়ে দেয় আলভি। কখনো কখনো মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে বাচ্চাদের মতোন। সুলতানা আলভির কান্না দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেও আতকে উঠে। অথচ নিজের সেই অচৈতন্য ভাবটা সে আলভির সামনে প্রকাশ করে না। আলভিকে সাথে নিয়ে একসাথে রান্না করে সুলতানা। আলভি ভালো গিটার বাজায়। সন্ধ্যার পর আলভির ফ্রেন্ডদের বাসায় এনে তাদের সাথে গিটার আড্ডায় যোগ দেয় সুলতানা। সবসময় এই মানসিক ট্রমা থেকে আলভিকে দূরে রাখার চেষ্টা করে সুলতানা। তবুও রাতের আঁধারে কিংবা নির্জনতায় ভেতরে ভেতরে আৎকে উঠে আলভি। অগোচরে চোখের কোণে জল জমে আসে। তারপর সেই জল কখন গড়িয়ে বিছানায় পড়ে সেটা সে বুঝতেও পারে না। আলভির বিছানায় কয়েকদিন ধরে আলভির সাথে ঘুমায় সুলতানা। ঘুমের মধ্যে আলভি হুটহাট বলে উঠে,
“সত্য সত্য সত্য”
নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না সুলতানা। দুইদিন আগেও শেষবারের মতো নুপুরের কাছে কল করেছিল সুলতানা। ফিরতি মেসেজে নুপুর সত্যের বিয়ের কার্ডের একটা ছবি তুলে পাঠায় সুলতানাকে। শেষ, সুলতানা আর কোন কল করেনি নুপুরকে।
এদিকে রাতের আঁধারের নির্জনতা সাক্ষী দেয় সত্য কতটা অবসন্ন আর একা হয়ে গিয়েছে। কাওকে অভিমানের কথা বলে না সে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে চটপট করতে থাকা সত্য এখন কেমন জানি চুপসে গিয়েছে। সেদিন রুমানা বেগম সত্যের রুমে এসে ঢুকে সত্যের গলায় একটা সীতাহার পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“জানিস এইটা আমার নাতি বউয়ের জন্য বানিয়ে রেখেছিলাম?”
সত্য মুখে হাসি এনে বলল
“জা জানতাম না তো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ জানবি কীভাবে। এখন তোকে পরিয়ে দিলাম এখন তো জানতে পারলি?”
সত্য হাসলো। তারপর রুমানা বেগমের পায়ে ধরে সালাম করল। রুমানা বেগম জোরে জোরে বললেন,
“সত্যিই নুপুর তার মেয়েকে নিজের সংস্কার দিয়ে বড় করেছে। আমি বড়ই ভাগ্যবতী রে যে তোর মতো মেয়েকে নিজের নাতবউ হিসেবে পেতে চলেছি।
সত্য কোন কিছু বলল না। রুমানা বেগম রুম থেকে চলে গেলেন। নিজের মনে মনে একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল সত্যের, আজ তার একটা সিদ্ধান্তে আর একটা ভালোবাসার বিসর্জন দেয়ার মাধ্যমে সে তার মাকে গর্বিত করতে পেরেছে। তার মায়ের সংস্কার গর্বিত হতে পেরেছে।
নুপুর সত্যের রুমে আসল। সত্যের গলায় হারটা দেখে নুপুর জিজ্ঞেস করল,
“এইটা কে দিয়েছে?”
“দাদি”
“এতবড় হার!”
এই বলে নুপুর হারটা সত্যের গলা থেকে খুলে হাতে নিল।তারপর বলল,
“জানিস রে মা, এই হারটার মতোই আমার বিয়ের সীতাহার ছিল। তোর দাদি আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল আমার বিয়ের দিন। আমি তখন মাত্র ইন্টারের ছাত্রী ছিলাম। সতেরো বছর বয়সে তোর বাবার সাথে আমার বিয়ে হয়।”
“তুমি বাবাকে এখনও ভালোবাসো মা তাইনা?”
নুপুর সত্যের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“এই হারটা ওজনে দশভরির চেয়ে কম হবে না। আমার হারটা সেখানেই ফেলে রেখে এসেছি আমি। তোকে যে দেয়ার মতো আমার কিচ্ছু নাই রে মা”
সত্য নুপুরকে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার মায়ের আদর্শ আমার কাছে আছে। আমার আর কী চাই মা বল?”
নুপুর তার নাক থেকে নাকফুল খুলে সত্যের হাতে দিল। তারপর বলল,
“এইটা আমার বিয়ের। বিয়ে ঠিকিয়ে রাখতে তো পারলাম না রে মা। এই নাকফুলটা তোকে দিলাম।”
নুপুর চোখ বড়বড় করে মায়ের নাকফুলটা মায়ের নাকে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
“তুমি বাবাকে এখনও আগের মতোই ভালোবাস। শুধু তখন বাবার বোধ ছিলো না এখন হয়েছে। তাইতো?”
নুপুর নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিল। চোখের কোনে পানি জমে এসেছে। সেটা সত্যের থেকে আড়াল করতে হবে। নিচ থেকে আলতাফ চৌধুরী ডাক দিলেন,
“নুপুর…নুপুউউর…”
“আসছি বাবা”
এই বলে নুপুর চলে গেল। নুপুরের চোখের জল আর সত্য দেখতে পেল না। নিচে যেতেই হুইল চেয়ার টেনে এনে আলতাফ চৌধুরী নুপুরকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমি তোর কে হই?”
“কে মানে?”
“মানে আমি তোর কে?”
“বাবা”
“তাহলে তোর মেয়ে আমার কে?”
“নাতনি”
“বিয়ে এখন কার?”
“আপনার নাতনির”
“তার দায়িত্ব কার?”
নুপুর জবাব দিল না। এই দায়িত্বটা তার নিজের। নীরবতা ভাঙ্গলো আলতাফ চৌধুরীর চিৎকারে। তিনি বললেন,
“আমি কন্যাপক্ষ। আমার নাতনির বিয়ে আর আমার নাতনি এখনও শপিং করেনি! এটা কেমন কথা?”
নুপুর নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আলতাফ চৌধুরী নুপুরের হাতে দুই লাখ টাকার চ্যাক ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার নাতনিকে বলো এইটা দিয়ে শপিং করে আসতে। কেমন?”
“কিন্তু…”
“কিন্তু টিন্তু না। যা বলেছি তাই করো।”
“না বাবা। এইটা আমি করতে পারব না।”
“বাবা না আমি?”
“হ্যাঁ কিন্তু.”
“না। আমার নাতনির বিয়ে এইটা তোকে রাখতেই হবে”
উপর থেকে সত্য বলে উঠলো
“রেখে দাও মা”
নুপুর মেয়ের কথায় অবাক হল। উপরের দিকে তাকালো আরেকবার। নুপুরকে সত্য বলল,
“রেখে দাও মা। দাদা দিচ্ছেন তো”
আলতাফ চৌধুরী বললেন,
“দেখলি আমার নাতনি ঠিক আছে।”
“কিন্তু বাবা…”
“এই! সাবধান আর কিন্তু টিন্তু না!”
নুপুর দুই লাখ টাকার চ্যাক রাখলো। এমন সময় বাইরে থেকে আরিয়ান, আলিফ আর শারমিন বাসায় এসে ঢুকলো। তারা বাইরে গিয়েছিলো বেড়াতে। আরিয়ান বাসা ঢুকেই আলতাফ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“হেই ব্রো! হুয়াট আর ইউ ডুয়িং? ”
আলতাফ চৌধুরী নাতিকে জড়িয়ে ধরে হেসে হেসে জবাব দিলেন,
“বুড়ো মানুষ, কী আর করবো বল? তুই বিয়ে করে ফেল তখন তোর বউর সাথে আড্ডা দিবো জমিয়ে।”
আরিয়ান উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্য দাঁড়িয়ে আছে। সত্যের দিকে দুই আঙুল তুলে ইশারায় চুমু মতোন দিয়ে আরিয়ান বলল
“সুইটহার্ট, উম্মাহ! দাদুও তোমাকে চায়”
কথাটা এখানে সবার সামনে কেমন জানি শুনালো। নুপুর সামনে থেকে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে। সত্য তার রুমে ঢুকল। শারমিন নুপুরকে পেছন থেকে ডাক দিল,
“বেয়াইন সাহেবা, কী হলো আপনার?”
নুপুর দাঁড়িয়ে গেলো। মুখে হাসি হাসি ভাব এনে বলল,
“জি কিছু না।”
“এভরিথিং ইজ ওকে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি খাবার রেডি করছি আপনারা ফ্রেশ হয়ে আসেন।”
“অহ আচ্ছা। ঠিক আছে যান”
নুপুর যেতে যেতে দেখল, আরিয়ান ভ্যাপ সিগারেটে ফু দিয়ে ধোয়া উড়াচ্ছে ড্রইংরুমে সবার সামনে। আরিয়ানের সামনে তার বাবা মা দাদা দাদি সব বসা। অথচ এসবের কোন কেয়ার ই সে করছে না।
খাবার টেবিলে খাবার খাওয়ার সময় শারমির সত্যকে ডাক দিল। সত্য নিচে আসলে আঙুল থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি বের করে সত্যের আঙুলে পরিয়ে দিয়ে শারমিন বলল
“বউমার জন্য কিছু কিনে আনতে পারিনি। শর্ট টাইমে আসা তো! দেশ থেকে কিনে দিব সব। এই আংটিটা রাখ ”
নুপুর পাশে থেকে সত্যকে ইশারা করল, শাশুড়িকে পায়ে ধরে সালাম করতে। সত্য সালাম করল শারমিনকে। আরিয়ান পাশে বসা ছিল। হহুট করে বলে উঠল,
“হুয়াই আর ইউ সো মাচ কুল লেডি! বাট ইউর নেইম “সত্য”? হুয়াই?”
সত্য তাড়াতাড়ি সেখান থেকে প্রস্তান করল। নিজের রুমে চলে আসলো।
এদিকে নুপুরের যে ভাই নুপুরের বিয়ের সময় ক্লাস টেনে পড়তো সে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। যে ভাই ক্লাস ফোরে পড়তো নুপুরের বিয়ের সময়, সেই ভাই বিয়ে করেছে দুই বছর হলো। কানাডা থেকে একেবারে দেশে চলে এসেছে। উত্তরায় ফ্ল্যাট বানিয়েছে। সত্যের মা, সত্যের ছোট ভাই আর তার স্ত্রী একসাথে সেখানে থাকেন।
সিলেটের পুরো বাসাটায় আজ আলোকসজ্জা করা হয়েছে। ধুমধাম আয়োজন চলছে। বাসার ছাদে গায়েহলুদের আয়োজন। গতকালকেই সত্যের কাবিননামায় স্বাক্ষর হয়ে যায়। বিয়ের মোহর ছিলো সতেরো লাখ টাকা। শারমিন এতে আপত্তি করলেও আলতাফ চৌধুরী জোর গলায় বলেই সতেরো লাখ টাকা লিখিয়েছেন। নুপুর এখানে কোন কথা বলেনি। আইন মতো সত্য আর আরিয়ানের বিয়ে গতকালই শেষ হয়ে গিয়েছে। আজ গায়েহলুদ। পুরো বাড়িতে মানুষ ভর্তি। ইন্ডিয়া থেকে সত্যের বিয়ের লেহেঙ্গা নিয়ে আসা হয়েছে। আরিয়ানের মা শারমির নুপুরকে বিয়ের স্বর্ণের গহনা দেশ থেকে কিনে দিয়েছেন। দেশ থেকে দিলেও কম দেননি, সতেরো ভরি স্বর্ণ দিয়েছেন সব মিলিয়ে। সত্যের দাদি গায়েহলুদে আসা উনার কাছের আত্মীয়দের গহনা গুলো দেখাতে লাগলেন। সবাই বাহবা দিচ্ছিলো। একজন হাতের চূড় দুইটা ধরে বলল,
“বাহ! এতো মজবুত। কয়ভরি আছে এগুলায়?”
“ছয় ভরি”
“ছয় ভরি চূড়, গহনা সতের ভরি, আপনিও দিলেন একটা সীতাহার ? তাও কাজের লোকের মেয়েকে?”
রুমানা বেগম কথাটা এড়িয়ে গেলেন। নুপুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। “কাজের লোকের মেয়ে” কথাটা সে স্পষ্ট শুনতে পেলো। কোন কথা বলল না নুপুর।
গায়েহলুদের ধুমধাম আয়োজন চলছে। যতটুকু সম্ভব নিজেকে গুড়িয়ে একা লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে নুপুর। যেই এসে সত্যকে দেখতে যাচ্ছে, সবাই সত্যকে বলছে,
“ভাগ্য তো! যে বাড়িতে বড় হয়েছিস সেই বাড়ির বউ হতে যাচ্ছিস তুই”
এদিকে একটা কোণে ড্রিংকস এর আয়োজন করা হয়েছে। আরিয়ানের বাবা আলিফ আর মা শারমিনের হাতে দুইটা গ্লাস। আরিয়ানের বাবা বলছেন,
“ডিসকাস্টিং! এগুলা শেষ হলে বাসার দলিল হাতে পাই! এসব আমার আর ভালো লাগছে না।”
“হ্যাঁ। এসব দেখে আর ভালো লাগছে না আমারও”
স্টেজে বসা সত্য মুখে হাসি নিয়ে বসা আছে। আগামীকাল তার বিয়ে। নতুন জীবন শুরু হবে। কী অবলীলায় সে ভুলে গেলো আলভিকে। এদিকে আরিয়ান মদ্যপ অবস্থায় গাড়িতে শুয়ে আছে। তার কোন খোঁজ নেই।
#দ্বিরাগমন
লেখা: Midhad Ahmed
#পর্ব_৩৪
একটা নাগাদ সত্য পার্লার থেকে রেডি হয়ে সেন্টারে চলে যায়। গতকাল রাতে আরিয়ানকে গাড়ি থেকে মাতাল অবস্থায় বাসায় নিয়ে আসে আলিফ। সত্য পার্লার থেকে রেডি হয়ে যখন সেন্টারে যায়, আরিয়ানকে নিয়ে তখন তারা বাসা থেকে রওনা-ই হয়নি। নুপুর সেন্টারে চলে যায় আগে আগে। সত্য যখন সেন্টারে এসে পৌঁছে তখন সেন্টারে কেউ ছিলো না। একা একা গিয়ে স্টেজে বসে থাকে সে। নুপুর পাশে গিয়ে বসে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে তার তবুও জড়িয়ে ধরে না। সত্য মাকে জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে কেমন লাগছে দেখতে?”
নুপুর মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
“মাশাআল্লাহ। আমার মেয়ের উপর কারো যেন নজর না লাগে”
সত্য বলল,
“তোমার মেয়ে দেখতে হবে না? আমার উপর কার নজর লাগবে বলো?”
এমন সময় সত্যের কয়েকজন ডাক্তার ফ্রেন্ড সেন্টারে আসলো। তারা এসে ঘিরে বসলো সত্যকে। একজন জিজ্ঞেস করল,
“বিয়ে হচ্ছে সেটা আগে জানালে কী হতো?”
সত্য নিশ্চুপ থাকলো। আরেকটা ফ্রেন্ড সত্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“তা দুলাভাই কেমন দেখতে? এরেঞ্জ মেসের জানি তা এর মধ্যে লাভ টাভ আছে নাকি?”
“সত্য মুচকি হাসলো এবার।”
নুপুর পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনলো। নিজে নিজে উপলব্ধি করছিলো, তার মেয়েটা ঠিক কতোটা বুঝদার হয়ে উঠেছে। একজন বুঝদারের মতো আচরণ করছে। না কোন অভিমান দেখাচ্ছে, না কোন রাগ দেখাচ্ছে। অবলীলায় হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলে বেড়াচ্ছে।
দুপুর দুইটা নাগাদ হুইল চেয়ারে বসা আলতাফ চৌধুরী, রুমানা বেগম, আলিফ, আলিফের স্ত্রী আর আরিয়ানরা চলে আসলো সেন্টারে। মিডিয়ার লোকজনও এসেছেন। শিক্ষামন্ত্রীও আমন্ত্রিত ছিলেন। তিনিও তখন এসে উপস্থিত হয়েছিলেন সেন্টারে। ধুমধাম আয়োজন সহ কোন কিছুর কমতি ছিলো না বিয়েতে। সত্যের ফ্রেন্ডরা বলাবলি করছিলো সত্যের ভাগ্য নাকি খুব ভাল। আরিয়ানের মতো সুন্দর ছেলে নাকি খুব কম হয়।
নুপুর বারবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। মেয়েটার মুখে হাসির আড়ালে ঠিক কতোটুকু যন্ত্রণায় বুক ভরে আছে সেটার উপলব্ধি সে করতে পারছিলো।
যখন সবাই সেন্টার থেকে চলে যাবে তখন নুপুর সত্যকে এগিয়ে দিয়ে আসছিলো সাথে সাথে। আরিয়ানের মায়ের চাচাতো বোন বলে উঠলো,
“মাও তো মেয়ের সাথেই যাবা। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির কাজের লোক। তা এতো ভং ধরার কী আছে?”
সত্য মাকে ছাড়িতে তেড়ে আসলে সেই মহিলার দিকে। বলল,
“কী বললেন আপনি?”
“কেন ভুল বলেছি? এই মেয়ে তেজ দেখাবা না”
“তেজ? কী দেখেছেন তেজের? মুখে লাগাম দিন আপনি”
আরিয়ান সামনে এসে সত্যকে বলল,
“হুয়াট আর ইউ সেয়িং এবাউট হার? সি ইজ মাই আন্ট!”
“এই ডোন্ট নো হু ইজ সি বাট আই নো সি ইজ মাই মাদার এন্ড আই অনলি ডটার অফ মাই মাদার!
সত্যের শাশুড়ি সত্যকে বললেন,
“তেজ দেখাচ্ছো কোথায়?”
“তেজ? এখনও দেখাইনি। আর একটা শব্দও যদি আমার মাকে নিয়ে উচ্চারিত হয় তাহলে আজ সবাই দেখবে সত্য কেমন মানুষ। যেটা কেউ দেখেনি আজ পর্যন্ত!
সেখানে থাকা কেউ একজন বলল,
“দেখেছো দেখেছো কাজের লোকের মেয়ের কী তেজ!”
“কাজের লোকের মা ছিলেন উনি কিন্তু এখন উনি আমার বাড়িতে আমার সাথে থাকবেন। সম্মানে, অধিকারে”
“অধিকার? মেয়ের বাড়িতে থাকা মায়ের অধিকার? হাসালে সত্য হাসালে”
নুপুর এসে সত্যের মুখ চেপে ধরলো। কানের কাছে গিয়ে বলল,
“আর যদি একটা কথা বলেছিস তো আমি নিজেকে শেষ করে দিবো”
নুপুরের কথায় সত্য চুপ করে গেল। আর কোন কথা সে বলল না।
বাসায় মেহমান ভর্তি। সবাই গল্প করছে এখানে সেখানে বসে। নুপুর বারবার চিন্তা করতে লাগলো নিজেকে নিয়ে। সত্যিই তো। দিনশেষে নুপুর তার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে আছে। এটা কখনোই তার জন্য সম্মানের হতে পারে না।
রাতে সত্যের রুমে ঢুকে আরিয়ান সত্যের কাছাকাছি আসতে চাইলে সত্য তাকে দূরে সরিয়ে দিলো। সত্যের এক কথা, মোহরের সতেরো লাখ টাকা শোধ করার আগে সত্যের গা ছুতে পারবে না আরিয়ান। আরিয়ান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাকে বলল গিয়ে সত্য তার মোহরের টাকা চাইছে। সত্যের শাশুড়ি এসে তখনই সতেরো লাখ টাকার চ্যাক দিয়ে গেলেন সত্যকে। আলিফ তার বাবা আলতাফ চৌধুরীকে বলল,
“দেখেছো বাবা কাজের লোকের মেয়ে কী বলছে? বিয়ের রাতেই তার কাবিনের টাকা চাইছে সব!”
আলতাফ চৌধুরী আর জবাব দিলেন না। মনে মনে রুমানা বেগম চিন্তা করতে লাগলেন, সত্য আর নুপুরকে তিনি আজ পঁচিশ বছর ধরে চেনেন। অথচ সেই সত্যকে আর এই সত্যকে তিনি মেলাতে পারছেন না। নুপুরের কখনোই কোন চাহিদা ছিলো না। লোভ ছিলো না। অথচ আজ!
রাতের সেই কোলাহল দেখে নুপুর উপরের তলা থেকে মেয়ের রুমের দিকে তাকিয়ে রইলো দরজার আড়াল থেকে। সামনে এলো না। চক্ষুলজ্জায় আর আত্মসম্মান এর জালে নুপুরের মাথা যেনো হেট হয়ে আসলো। মেয়ের বাসর ঘরের সামনে গিয়ে মেয়ের এই অদ্ভুত কাবিনের টাকার দাবির মুখে নিজের কথাগুলো আর আপত্তি তুলতে পারলো না নুপুর।
রুমের ভেতরে সতেরো লাখ টাকার চ্যাক হাতে নিয়ে সত্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। টলমল করছে তার চোখ দুইটা। নিজের মনকে বলে উঠলো, মোহরের টাকা চেয়েও অন্তত নিজেকে আজকের রাত থেকে বাঁচাতে চাইছিলো সে। অথচ সেটা আর হলো না।
বাসর হলো আরিয়ান আর সত্যের। রাত গভীর হলো। দুজনের গভীরতা বাড়লো। সত্যের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে শুধু। অন্যদিকে আলভি মাঝরাতে উঠে গিটারে গান ধরলো,
“অভাগার বাসরে বন্ধু কেন আইলা না।
আতর গোলাপ সোয়া চন্দন সাজাইলা ফুল বিছানা
অভাগার বাসরে বন্ধু কেন আইলা না
ও আমার মন প্রাণ যৌবণ
করিলান অর্পন….”
সেই রাত শেষ হলো। সকাল এগারোটা নাগাদ যখন সবাই খুঁজ নিলো নুপুরের তখন জানা গেলো নুপুর বাসায় নেই। সত্য মায়ের রুমে গেলো। দরজা ভেতর থেকে খোলা। সবাই রুমে ঢুকলো। সারা বাড়িতে নুপুর নেই । নুপুরের খাটের উপর একটা চিরকুট। সেখানে লেখা,
“আমি চলে যাচ্ছি সত্য। এই ঘর এই সংসার সব তোর। আগলে রাখিস। আর ধ্রুব সত্য, মেয়ের সংসারে মায়ের থাকাটা মানায় না। আমার চিন্তা তুই করিস না। আমি আমার ভাইয়ের বাসায় চলে যাচ্ছি। দুয়েকদিন পর আমি কল দিব তোকে। চিন্তা করিস না। শুধু সুখে থাক তুই, এইটাই আমি চাই”
আরিয়ানের মা পাশ থেকে বলল,
“দেখো দেখো কাজের মেয়ে কিছু চুরি করে পালিয়েছে কি না। বলা তো যায় না এসবের কিছু। আজকাল যা দিন এসেছে…”
সত্য কান্না টলমল চোখ আর অগ্নিশর্মা চোখ নিয়ে শাশুড়ির দিকে ফিরে তাকালো। তারপর গলা বাড়িয়ে বলল,
“আমার বাড়ি থেকে এই মুহূর্তে তোমরা বের হয়ে যাও”
“তোর বাড়ি? কে বললো?”
“বিশ্বাস হয় না?”
এই বলে সত্য দ্রুত হেঁটে তার রুমে গেল। দলিল বের করে এনে শাশুড়ির সামনে দেখিয়ে বলল
“এই দেখেন, আরিয়ান কাল রাতে এই বাড়ি এই সম্পত্তি সব আমার নামে করে দিয়েছে। সব সব…”
(চলবে)
চলবে,,,,,,,,
(চলবে)
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)