জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ১১

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

১১.
‘শোনো,একটা কথা জিজ্ঞেস করব অনেকদিন থেকে ভাবছি। আলমারিতে একটা সবুজ রঙের প্যাকেট দেখলাম। সম্ভবত শাড়ি। কার জন্য?’ অজস্র কৌতুহল চোখে নিয়ে প্রশ্নটা করল রুহি। আরাফাত বারান্দার ফ্লোরে বসে চা খাচ্ছিলো। রুহির প্রশ্নটা শুনে মারাত্মক বিষম খেলো সে। কথা বলতে পারছেনা। রুহি দৌড়ে গিয়ে পানি এনে দিলো। পানি খেয়ে শান্ত হলো আরাফাত। পুনরায় চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সে। রুহি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘বললেনা?’

‘কী?’

‘আলমারির প্যাকেট…’

রুহিকে হাত দিয়ে থামতে ইশারা করে আরাফাত। তারপর চায়ের কাপটা ফ্লোরে রেখে সোজা হয়ে বসলো। রুহির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বলল, ‘আমি বিবাহিত নাকি অবিবাহিত?’

রুহি অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ?’

‘শুনতে পাওনি?’

‘অ… মানে, বিবাহিত।’

‘আমার ঘরে বউ আছে। তাই না?’

‘আছে।’

‘তাহলে আমি যদি মেয়েলি কিছু আনি, সেটা আমি কার জন্য আনব?’

পুরো বিষয়টি বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে দিলো রুহি। আরাফাতও হাসলো। রুহি বলল, ‘আমার জন্যই যখন, এটা ওভাবে রাখা কেন?’

‘এখনও দেয়ার সময় হয়নি তাই। এখন যাও আমি স্মোক করব।’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল আরাফাত।

‘আমি থাকি?’ কাচুমুচু মুখ করে বলল রুহি। আরাফাত শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো রুহির দিকে। রুহি মাথানিচু করে চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়ে গেল। আরাফাত একটা সিগারেট ধরিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ। এই শাড়িটা কিনেছিলো সে, আজ থেকে কয়েকমাস আগে। কে জানতো? সবকিছু হুট করে ধ্বংস হয়ে যাবে! এভাবে পাল্টে যাবে সবকিছু! বুকের ভেতর চাপা দীর্ঘশ্বাস খেলা করছে তার। আপনমনে ধোঁয়া উড়িয়ে ভাবছিলো সে, নিজের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার অধ্যায়।

‘আগামীকাল এগারোটায় তোদের কক্সবাজারের ফ্লাইট। সেখান থেকে টেকনাফে যাওয়ার জন্য বলে রেখেছি আমি একজনকে। সে গাড়ি নিয়ে থাকবে।’ টাইগারের বোতলে শেষ চুমুক দিয়ে বললো মাহফুজ। সৌমিক বসে গেইম খেলছিলো মোবাইলে। সে মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে থেকে বললো, ‘জাহাজ পাওয়া যাবে তো?’

‘হ্যাঁ, এই সময়টাতে জাহাজ পাওয়া যায়। ভালোই হয়েছে এখনই প্লানিং করেছি।’

নিহান কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো। কথা শেষ করে এসে বসলো সৌমিকের পাশে। তারপর বললো, ‘মাহফুজকে কিছু জিজ্ঞেস কর।’

‘কী জিজ্ঞেস করব?’ কপাল কুঁচকে বললো সৌমিক।

‘তুই এবার পাছায় লাথি খাবি।’ চোখ রাঙিয়ে তাকালো মাহফুজ। সৌমিক একবার মাহফুজের দিকে তাকালো, আরেকবার নিহানের দিকে তাকালো। তারপর বললো, ‘বুঝতে পারছিনা। বুঝা আমাকে।’

‘বলব, মাহফুজ?’ ভু উঁচায় নিহান। মাহফুজ বললো, ‘তুই বলবি কী বে? আমিই বলছি। ইছমিহা লেসবিয়ান।’

কথাটা শোনার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ঘর হাসির শব্দে ফেটে যেতে লাগলো। মাহফুজ মুখ ছোট করে বসে দেখছিলো ওদের হাসি। নিহান হাসতে হাসতে বললো, ‘কিস করতে গেছিলো মামা। মাইয়া নাকি চপাট করে থাবা দিছে।’ বলে হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিলো নিহান। সৌমিকও হাসির চোটে কথা বলতে পারছিলো না। নিহান আবার বললো, ‘তারপরে নাকি আবার বলে দিছে যে ওর পোলা ভাল্লাগেনা। তার মাইয়া ভাল্লাগে। ঐ মেয়েটার পিছে পইড়া ছিলো আমাদের কুলিশ বয় মাহফুজ।’

মাহফুজ এবার ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘এবার আমি চলে যাবো বলছি।’

সৌমিক হাসি থামিয়ে একটু দম নিলো। নিহান তখনও হাসছে। সৌমিক নিহানের পিঠে থাপ্পড় দিয়ে চুপ করতে বললো। তারপর মাহফুজের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার বউ রান্নাঘরে আগুনের ভাপ খেয়ে রান্না করছে। আর তুমি না খেয়ে চলে যাবা এটা আমি হতে দেব?’

‘এই, মনে পড়ছে। ভাই টাকাটা আমাদের জলে যাবেনা তো?’ নিহান সৌমিককে বললো একটা দুঃখভরা মুখ বানিয়ে। সৌমিক কিছু বুঝলোনা। মাহফুজ ঠোঁট টিপে হাসছে। সৌমিক বললো, ‘মানে?’

‘মানে, ঐ আরকি।’

‘কী?’

‘হানিমুনে পাঠাচ্ছি। বুঝলি তো?’

‘ওহ আচ্ছা। ঐটা?’ সবকিছু বুঝে ফেলছে এমন ভাব করে বললো সৌমিক।

‘হ্যাঁ ঐটাই।’

‘সেটা এক্ষুণি বলা যাচ্ছেনা।’

নিহান কিছু একটা বলতে যাবে তখনই মোহনা এসে ঢুকলো। বিনয়ী সুরে বললো, ‘আপনারা খেতে আসুন না।’

‘আরে ভাবি, আপনার সাথে তো ঠিকমতো কথাই হলোনা। আসলে সৌমিক কথা বলায় না বুঝলেন।’ বললো মাহফুজ।

‘হ্যাঁ ভাবি। এমন ভাব করে যেন আমরা…’ বলে আটকে গেল নিহান। সৌমিক হায়া হিয়ে তাকিয়ে দেখলো দুজনের পল্টি খাওয়া। নিহানের কথাটা মাহফুজ পুরো করে দিলো। বললো, ‘যেন আমরা নজর দিয়ে দেব।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কারেক্ট। আসলে ওর দোষ নেই। বউ সুন্দরী হলে হয়, এমন হয়।’ বললো নিহান।

লজ্জা ও অস্বস্তি একইসাথে ধরেছে মোহনাকে। সে একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘আপনারা আসুন।’ বলে বেরিয়ে গেল। মোহনা যাওয়ার পরে সৌমিক কোমরে হাত দিয়ে বললো, ‘তোরা কী রে?’

‘তোর বউয়ের দেবর। মানে আধা বর।’ বলে দুজনেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। সৌমিকও গেল পিছুপিছু।

খাবার টেবিলে মোহনার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। নিহান তো জিজ্ঞেসই করে ফেললো, ‘ভাবি আপনার কি ছোট বোন আছে?’

নিহানের প্রশ্ন শুনে মাহফুজ সৌমিকের কানেকানে বললো, ‘চান্স নেয়া শুরু।’

‘চান্স নাই। হেব্বি শক্ত শালি আমার।’ বলে খাবারে মন দিলো সে।

‘আছে তো, কেন?’ হেসে বললো মোহনা।

‘গ্রেট… নিউজ… এমনিই আরকি।’ বলে হেসে হেসে খেতে লাগলো নিহান। সৌমিক আর মাহফুজ হাসলো। ছেলেটা সবসময় এমন ধান্দায় থাকে।

রাত এগারোটা। বিছানা ঠিক করছিলো মোহনা। ওয়াশরুম থেকে শাওয়ারের পানি পড়ার ঝরঝর শব্দ আসছে। মোহনা ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বললো, ‘এতোক্ষণ ভিজছেন কেন? বেরিয়ে আসুন। ঠান্ডা লাগবে।’

ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলনা। একইভাবে পানি পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো সৌমিক, তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে। দেখলো মোহনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লোশন লাগাচ্ছে। তারপর বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলো রাতে তার আর মোহনার মাঝখানে যে কোলবালিশ দেয়া থাকে, সেটা নেই।

‘মাঝখানের কোলবালিশটা?’ এদিকওদিক তাকিয়ে মোহনাকে জিজ্ঞেস করলো সৌমিক।

‘কোনটা?’ সৌমিকের দিকে তাকিয়ে বললো মোহনা।

‘মাঝঝানে যেটা থাকে।’

‘স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে কিসের কোলবালিশ?’ বলে বিছানায় গিয়ে বসলো মোহনা।

‘অ্যাঁ?’ সৌমিক অস্ফুট একটা শব্দ করল। আবার বললো, ‘তুমি ঠিক আছো?’

‘কেন?’

‘মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। আসো তো চেক করি।’ বলে হেঁটে গিয়ে মোহনার কপালে হাত দিলো সৌমিক। সৌমিকের বরফ শীতল হাত মোহনার কপালে লাগতেই খানিক কেঁপে উঠলো সে। কিন্তু নড়লো না। ঠায় বসে রইলো। সৌমিক বললো, ‘বুঝতে পারছিনা। টেম্পারেচার ঠিকই আছে। তাহলে?’

‘সমস্যা কী আপনার?’ কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো মোহনা।

‘আচমকা মনে হচ্ছে, আমার একটা বউ আছে।’ সরু চোখে তাকিয়ে বললো সৌমিক।

‘মানে?’

‘মানে, চারিদিকে বউ বউ ঘ্রাণে মো মো করছে।’ বলে হালকা এগিয়ে আসলো সৌমিক মোহনার দিকে। সৌমিকের এগিয়ে আসা দেখে মোহনা বললো, ‘কী?’

‘ঘ্রাণটা আরো সুষ্ঠুভাবে নিচ্ছি।’ বলে সৌমিক একদম কাছে চলে আসলো মোহনার। নিশ্বাস অনুভব করা যাচ্ছে এমন কাছে। খনিকের জন্য মোহনার বুকের ভেতর সমস্ত নিশ্বাস আটকে গেল। সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ভারী নিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছিলো…

‘শোনো, কাল সকাল এগারোটার মধ্যে বেরোবো। এগারোটায় ফ্লাইট। আমি আমার প্যাকিং করে নিয়েছি। সাথে তোমারও করেছি। মেয়েলী জিনিস সহ। আমার পছন্দমতো কাপড় নিয়েছি তোমার জন্য। তোমার সমস্যা নেই তো?’ আস্তে আস্তে কথাগুলো বলছিলো সৌমিক। মোহনা চোখ খুলে তাকালো। সৌমিক আবার বললো, ‘তোমার যদি আর কিছু দরকার থাকে তাহলে নিয়ে নিও। গুড নাইট।’ বলে শুয়ে পড়লো সে অন্যপাশ হয়ে। মোহনা তখনও ঠায় বসে আছে মুর্তির মতো। কী ভেবেছিলো সে আর কী হলো! সে ভেবেছিলো সৌমিক তার ঠোঁটে… নিজের এমন বোকাবোকা ভাবনার জন্য নিজেকে একদফা বকে নিলো সে মনেমনে। তাৎক্ষণিক তার মাথায় ভাবনা এলো, অবচেতন মনে সে কি চায় এমনটা হোক? মাথা ঝাঁকুনি দিলো মোহনা। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লো। সৌমিকের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মানুষটা কেমন যেন। অনেক খেয়াল রাখে। নিজের প্যাকিং এর সাথে মোহনারও সবকিছু গোছগাছ করে রেখেছে আগেই। মুখে মুচকি হাসি নিয়ে চোখ বুজলো মোহনা। ভাবতে লাগলো। নিজের পছন্দকে মন উজাড় করে আপন করে তো দেখেই নিলো সে। এবার নাহয় বাবার পছন্দকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে দেখুক। সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যে কী রেখেছেন!

চলবে……
©ফারজানা আহমেদ
এই কদিন রেগুলার দেয়ার চেষ্টা করব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here