জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ১০

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

১০.
যেদিন সৌমিক আর মোহনার এক্সিডেন্ট হয় সেদিন মোহনার মা মোহনাকে বলেছিলেন, ‘স্বামী হচ্ছে মেয়েদের জন্য একটা আস্থার জায়গা। বাবার পরে মেয়েদের মাথার উপর যে ছায়া থাকে সেটা হচ্ছে স্বামীর। বিয়ের আগে মেয়েদের সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে বাবা আগলে রাখে, সমস্ত ভরনপোষণ এর দায়িত্ব পালন করে। সব ইচ্ছা-অনিচ্ছা পূরণ করে। আর বিয়ের পর সেই সবকিছু স্বামী করে। স্ত্রীর ভালো মন্দ সবকিছুর দায়িত্ব নেয়। বিয়ের পর এতো এতো অচেনা মুখের ভীড়ে ঐ স্বামী নামক মানুষটাই তোমার সবথেকে আপন। তোমার ভেতরের অনুভূতি, তোমার অস্বস্তি তখন অন্য কেউ বুঝবেনা। বুঝবে তোমার স্বামী। স্বামী যদি তার স্ত্রীর সারাজীবনের সবকিছুর দায়িত্ব নিতে পারে, তাহলে স্ত্রী কেন সেই স্বামীকে খানিকটা মানসিক শান্তি দেবার দায়িত্বটা নিতে পারেনা? এই স্বামী কি খানিকটা ভালোবাসা চাইতে পারেনা তার স্ত্রীর কাছে? তোর অতীত জেনেও ছেলেটা তোর এতো খেয়াল রাখছে। এতো ভালোবাসছে। তোর কি উচিত না তাকে মেনে নেয়া? কতদিন এভাবে থাকবি তুই? কার জন্য এমন করবি? যে তোকে ওভাবে জীর্ণ শীর্ণ করে ফেলে চলে গেছে তার জন্য? তুই মরে গেছিস না বেঁচে আছিস সেটা একবারও ফিরে তাকিয়ে দেখলোনা, তার জন্য? আমি সব বুঝি। তুই সবার ওপর রাগ করে আছিস। কিন্তু আমরা যা করেছি সব তোর ভালোর জন্যই করেছি। সবার রাগটা এই বেচারার ওপর ঝাড়ছিস কেন? তার দোষ তো নেই। বরং সে তোর জীবনটাকে সাজিয়ে দিলো। এবার সব তোর হাতে। তুই চাইলে এই সাজানো জীবনটাকে আরো সুন্দর করে নিজেরমতো সাজাতে পারবি। আর চাইলে ভেঙে গুড়িয়েও দিতে পারবি।’

রান্নাঘরে তরকারি গরম করতে করতে ভাবছিলো মোহনা কথাগুলো। সত্যিই তো! কার জন্য সে এমন মনমরা হয়ে থাকবে? কার জন্য নিজের জীবনটাকে এভাবে ফ্যাঁকাসে, রঙহীন বানিয়ে রাখবে? কার জন্য? যে তাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলো মরার জন্য, তার জন্য এভাবে কেন থাকবে মোহনা? নিজের জীবন সাজাবে মোহনা। হ্যাঁ, নিজের স্বামীর সাথে ভালোভাবে জীবন কাটাবে। হয়তো, হয়তো ভালোবাসা হবেনা আর। কিন্তু এ কদিনে মায়া ঠিকই জন্মেছে। মায়া অনেক শক্ত অনুভূতি। একবার জন্মালে, সেটা কাটিয়ে ওঠা জনম জনমের তপস্যার বিষয়।

‘কীগো? তরকারি গরম হয়ে গেছে তো। ওদিকে সবাই বসে আছে টেবিলে খাবারের অপেক্ষায়।’ গ্যাস বন্ধ করে হাসলো রুমি। মোহনা যেন ভাবনায় ডুবে গেছিলো। রুমির কথায় হুঁশ আসে তার। আজ সে সৌমিকের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। আম আর কচু দিয়ে টক, সরষে ইলিশ, গরুর ভুরি ভুনা। সবকিছু নিয়ে যখন টেবিলে গেল, দেখলো সৌমিক টেবিলে নেই। রুহি সৌমককে ডাকতে যাচ্ছিলো তখনই দেখলো সৌমিক তৈরি হয়ে কোথায় যেন বেরোচ্ছে। নমিরুন বললেন, ‘কীরে? খাবার টেবিলে। কোথায় যাচ্ছিস এখন তুই?’

সৌমিক হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে বললো, ‘ফুপু, হঠাৎ অফিস থেকে ফোন এসেছে মনির ভাইয়ের। যেতে হবে। তাছাড়া ট্রিপে যাওয়ার আগে আজ সেখানে গিয়ে মনির ভাইকে সব বুঝিয়ে আসতে চাই।’

‘হ্যাঁ যাবি কিন্তু…’

‘ফুপু দেরি হচ্ছে। আল্লাহ হাফিজ।’ বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সৌমিক। কিন্তু দুম করে মোহনা গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। কোমরে দু’হাত রেখে চোখ ছোট করে তাকালো। সৌমিক প্রথমে কিছু বুঝলোনা। বললো, ‘কী ব্যাপার?’

‘খাবার।’

‘এসে খাবো। সরো।’

‘খেয়ে যাবেন। আসুন।’

‘আমার দেরি হচ্ছে।’

‘ট্রেন ছুটে যাচ্ছেনা।’ বলে সৌমিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে টেবিলে বসালো। নমিরুন আর রুমি নিঃশব্দে হাসছিলেন। টেবিলে তাকিয়ে অবাক হলো সৌমিক। তার পছন্দের খাবার। সে নমিরুনের দিকে তাকাতেই তিনি বলেন, ‘না খেয়ে চলে যাচ্ছিস তুই। তোর বউ কতো মেহনত করে এসব রান্না করেছে।’

‘আমার বউ? কে?’ অবাক কণ্ঠে বললো সৌমিক। কথাটা শোনামাত্র চোখ বড় বড় করে তাকালো মোহনা। অবাক হলেন নমিরুন আর রুমিও। রুমি বললো, ‘কে মানে? মোহনা রান্না করেছে ভাইয়া।’

‘ধুর ভাবি। মজা করো না তো। আচ্ছা দাও তাড়াতাড়ি দুই লোকমা খেয়ে যেতে হবে।’ বলে সৌমিক নিজের প্লেটে একটু ভাত নিলো। তারপর রুমিকে বললো, ‘গরুর ভুরিটা দাও। রাতে বাকিগুলো খাবো।’

‘কিচ্ছু দেবনা। যান আপনি। বেরোন।’ সৌমিকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো মোহনা। সৌমিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। মোহনার এহেন আচরণের মর্ম বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তার। নমিরুন বেগমের অনেক হাসি পাচ্ছিলো। তিনি রুমিকে বললেন, ‘আমার এখন খেতে ইচ্ছে করতেছেনা। একটু পর আমার ঘরে খাবারটা দিয়া যাইও রুমি।’ বলেই তিনি তার ঘরে চলে গেলেন। রুমি নিজের হাসি আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।

‘মোহনা, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমি না খেয়ে উঠি।’ বলে উঠতে নিচ্ছিলো সৌমিক। মোহনা ধমকে উঠলো, ‘এক পা এগোলে ঠ্যাং আস্ত থাকবেনা।’

সৌমিক এবার বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে তাকালো মোহনার দিকে। মোহনা ঝাঁঝ নিয়ে বললো, ‘কপাল কুঁচকাবেন না। আমি এতো কষ্ট করে ঘেমে-নেয়ে রেঁধেছি। আপনি একটু আগে ভাবিকে কী বললেন?’

সৌমিক এবার ধাক্কা খেলো। মোহনা তার প্রিয় খাবার রান্না করেছে? সৌমিক আমতাআমতা করে বললো, ‘না মানে, তুমি… রান্না… আসলে, স্যরি।’ বলে মাথানিচু করে ফেললো সৌমিক। মোহনা স্বাভাবিকভাবেই বললো, ‘হুম হয়। এমন হয়। সমস্যা নেই। খেতে বসুন এবার।’ বলে সৌমিকের প্লেটে তরকারি তুলে দিলো মোহনা। রুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ দৃশ্যটা দেখছিলো। তারপর মুচকি হাসি দিয়ে নিঃশব্দে একটা প্লেটে খাবার নিয়ে নমিরুনের ঘরের দিকে গেল। সৌমিক বসে খাওয়া শুরু করলো। তাড়াহুড়ো করে একটু আগেই চলে যেতে চাইলো, কিন্তু এখন বসে কী আস্তে-ধীরে বউয়ের হাতের রান্না খাচ্ছে! মোহনা মুচকি হাসছে আর সৌমিককে দেখছে।

‘কেমন হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলো মোহনা।

‘উম্মম! জোশ জোশ। অসাধারণ। এতো ভালো রান্না জানো জানলে আরো আগে বিয়ে করতাম তোমাকে।’ বলে খাবারে ডুবলো আবার সৌমিক। মোহনা হাসলো। তার এখন খুব ভালো লাগছে। সবকিছু ভালো লাগছে। এতো মন ভালো মন ভালো অনুভূতি কেন হচ্ছে তার? সে বললো, ‘আমি ফালুদা নিয়ে আসি। ডেসার্ট খেতে হবে তো!’

বলে রান্নাঘরে গেল মোহনা। সৌমিক চেয়ে চেয়ে মোহনার চলে যাওয়া দেখলো। হাসলো নিঃশব্দে। নিজের চুলে হাত বুলালো। মোহনার এই পরিবর্তন তার ভেতরের সত্ত্বাকে পুরোপুরিভাবে পাগল করে দিচ্ছে। উদ্ভ্রান্ত পাগল!

চলবে……
©ফারজানা আহমেদ
পর্ব আর বড় করা সম্ভব হয়নি। মাইগ্রেন এর ব্যথা সহ্য করে করে এতটুকু শেষ করেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here