বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব-০৪
#Taniya Sheikh
অষ্টমঙ্গলার আগেই বাড়ি ফিরছে রজনী। সাথে আছে সৌমিত্র। ঢাকার ব্যস্ত সড়ক ছেড়ে গাড়ি চলছে সাভারের নিরব, জনশূন্য রাস্তা দিয়ে। রজনীর শরীর তেমন ভালো নয়। গত দু’দিন প্রচন্ড জ্বরে ভুগেছে সে। আজ কিছুটা কমলো বলেই রওনা দিয়েছে ওরা। একদিকে অসুস্থ দূর্বল শরীর,অপরদিকে ভবিষ্যৎ ভাবনা। এই দু’য়ে মিলে যথেষ্ট পীড়া দিচ্ছে রজনীকে। রজনী চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল। সামনের লুকিং গ্লাসের স্থির চোখজোড়া একবার দেখল রজনীকে। এভাবেই এই চোখজোড়ার নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিল সে এতোক্ষণ। রজনী বুঝেও চুপ রইল। তার এখন বলার কিছুই নেই। যা বলার, করার এই মানুষটাই বলেছে, করেছে। বিয়ের রাত পর্যন্ত মানুষটাকে নিয়ে তার যে ভাবনা ছিল, এখন তা বিস্তর পাল্টেছে। দূর থেকে কতো কিছুই ভাবে মানুষ। কাছে গেলেই ভাবনার গড়মিল শুরু হয়। এই যেমন রজনীর হচ্ছে।
সেদিন রাতে চেতনা ফেরার পর নিজেকে চাদরে ঢাকা পায়। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তখনও প্রচন্ড ব্যথা। দু’হাতে বিছানা ঠেসে উঠে বসার চেষ্টা করেও পারে না। তখনই একটা হাত সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। আঁতকে ওঠে সে। ভাবে এই বুঝি আবার! কিন্তু না। তার ভাবনা পাল্টে দিল সৌমিত্র। দু’হাতে খুব যত্ন করে বালিশ ঠেকিয়ে বসাল। রজনী কাঁপছিল কিছুটা। সৌমিত্রের বড় বড় চোখে চোখ পড়তেই ভ্রুকুটি করল রজনী। ভয় পাবার মতো কিছুই নেই ও চোখে। বরং সেখানে তাকাতেই রজনী শান্ত হয়ে গেল। যেন চোখের ভাষায় এই বুঝাতে চাচ্ছিল। নিজ হাতে রজনীর গায়ের কাপড় ঠিক করে উঠে দাঁড়াল। দুজনই নিরব ছিল এই সময়টুকুতে। লজ্জায় অবনত মস্তকে বসেছিল রজনী। দরজা খোলার শব্দে মাথা তুলে তাকিয়ে হাজার ভাবনা ভাবল। কূলকিনারা একটারও পেল না। একটু আগে যে ব্যথা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ কী হলো তার? এতো দয়াদাক্ষিণ্য কিসের জন্যে? সে অচেতন হয়ে পড়েছিল বলেই কী এতো মায়া? নাকি ভিন্ন কিছু? রজনী আনমনা হয়েছিল। সৌমিত্রের পায়ের আওয়াজে নড়েচড়ে বসল ফের। একগ্লাস গরম দুধ,কিছু ওষুধ নিয়ে হাজির হয় সৌমিত্র। রজনীর সামনে ট্রে’টা রেখে পাশের সোফাটাতে বসে। রজনী হেট মাথায় বসেছিল। এভাবে অনেক্ষণ পেরিয়ে গেলেও সৌমিত্রের কোনো সাড়া না পেয়ে ভীরু চোখে তাকাল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে ওঠে। একদৃষ্টিতে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে সৌমিত্র। রজনী চট করে চোখ ঘুরিয়ে নিল। সাথে সাথেই কানে এলো গম্ভীর গলার স্বরে বলা,
” মিথ্যা কেন বলেছ আমাকে? সত্যিটা জিজ্ঞেস করেছিলাম না? বলো?”
রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করল সৌমিত্র। রজনী চমকে ওঠে। ঢোক গিলতেই সৌমিত্র “অনু, অনু” বলে চেঁচাতে লাগল। অনুপমা ঘুমিয়ে ছিল বোধহয়। সৌমিত্রের চেঁচানোর শব্দে বিছানা ছেড়ে ছুটে এলো বাইরে। সারদার চিন্তায় ঘুম হচ্ছিল না। সবেমাত্র চোখদুটো লেগে এসেছিল। তখনই বাইরে সৌমিত্রের চড়া গলার শব্দ শুনে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। সৌমিত্রের এই বিয়ের ব্যাপারটা আত্মীয় স্বজনের তেমন কেউ জানে না। যারা দু’একজন জানত তারা অতি কাছের। সন্ধ্যার আগে আগেই তারাও সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। বাড়িতে এখন যারা আছে সব বাড়ির লোক। সৌমিত্র রুমে এসে বসল। তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ রজনীর কান অব্দি এসে লাগছে। ভয়ে জড়সড় মানুষটির হঠাৎ পরিবর্তনে। সৌমিত্রের ছোট ভাই সার্থক স্ত্রী অনুপমা সহ দাদার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। তাদের পাশে এসে দাঁড়াল সারদা দেবীও। তিনজনেই শঙ্কিত, চিন্তিত। সৌমিত্র উচু গলায় ওদের ভেতরে ঢুকতে বললো।সংকোচ নিয়ে তিনজনই ঢুকল ভেতরে। রজনীকে বিছানায় ওমন অগোছালো ভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল অনুপমা। সারদা ছেলের মুখ দেখেই বুঝলেন কিছু একটা গন্ডোগোল বেঁধেছে। তা না হলে এমন রাত দুপুরে চেঁচানোর ছেলে তার নয়। তারপর আজ ছিল ফুলসজ্জা। মা’কে তাকাতে দেখে সৌমিত্র চড়া গলায় বললো,
” আমি তোমাকে কী শর্ত দিয়েছিলাম মা?”
” এখন ওসব কথা কেন?” সারদা রজনীর দিকে চেয়ে ইতস্তত করল। সৌমিত্র বেশ বুঝল মায়ের বিব্রতভাব। তাচ্ছিল্যভরা হাসি হেঁসে বললো,
” কথাটা বলতে তোমাকে বিব্রত হতে হচ্ছে তাই না মা,অথচ এই কিছুক্ষণ আগে আমাকে চরম লজ্জার মধ্যে ফেলেছ তুমি। এতোটা লজ্জা যে, নিজের মুখ দেখতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার।” সামনের সেন্টার টেবিলটা লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সেন্টার টেবিলের কাচ ভেঙে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। সৌমিত্র ওর মধ্যে হেঁটে আসতেই রজনী ছাড়া বাকি সবাই চেঁচিয়ে ওঠে। সৌমিত্র তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না। ব্যথা তার লাগার পরিবর্তে বাকি সবারই লাগল। সৌমিত্র নির্বিকার অনুপমার দিকে তাকিয়ে বললো,
” এই মেয়েকে জিজ্ঞেস কর অনু। জিজ্ঞেস করো কেন বিয়েতে রাজি হয়েছে সে। কেন মিথ্যা বললো আমাকে?”
” সোম দা,”
” অনু তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো।” চোয়াল ফুলে ওঠে সৌমিত্রের।
অনুপমা রজনীর মুখের দিকে তাকাতেই রজনী ফুঁপিয়ে ওঠে। তারপর যা হয়েছে তার সাথে সবই বললো। সৌমিত্র কটমট করে চেয়ে রইল মায়ের দিকে। সারদা চোখে জল ছেড়ে দিয়েছেন ছেলের পায়ের রক্তাক্ত অবস্থা এবং চোখের তেজ দেখে। এমনটা হবে ভাবেন নি তিনি কখনো। এক সৌমিত্র বাদে উপস্থিত সবাই বিস্মিত, বাকরুদ্ধ রজনীর কথা শুনে। রজনী থেমে থেমে কাঁদছিল। তার ভয় হচ্ছে এরা এখনই তাকে বের করে দেবে নতুবা তার মাসির ক্ষতি করবে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। সৌমিত্র মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
” ওর সাথে কতোবড় অন্যায় করতে গিয়েছিলাম জানো তুমি? জানো না। তুমি ঠিক করো নি মা। খুব খারাপ করেছ। খুব৷”
রক্তাক্ত পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সৌমিত্র অনুপমার দিকে চেয়ে বললো,
” ওর শরীরে মারের ঘা এখনও দগদগে। পারো তো ওষুধ লাগিয়ে দিও।”
রজনী চোখ বড় করে ফেলল। এই আঘাতের চিহ্ন প্রমাণ করেছ সে মিথ্যা বলেছে। তার সত্যিটা এই আঘাতগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে! রজনীর মনে হচ্ছে ব্যথা দ্বিগুন বেড়ে গেল। কষ্ট হচ্ছে খুব। অনুপমা দু’হাতে জড়িয়ে নিতেই ডুকরে কাঁদল। সারদা পড়েই যাচ্ছিল সঠিক সময় সার্থক তাকে না ধরলে। মা’কে ধরে রুমে নিয়ে গেল সে।
এরপর দু’দিন শয্যাশায়ী ছিল ব্যথা আর জ্বরের কারনে রজনী। পুরো বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। এরমধ্যে অনুপমা এসে তাকে জানাল সৌমিত্রের সিদ্ধান্ত। সৌমিত্র তাকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। তার যেন সমস্যা না হয় সেই ব্যবস্থাও করে দিয়ে আসবে সৌমিত্র। রজনী নিরবে শুনে গেল। তার আগেও কিছু বলার ছিল না। এখনও নেই।
অতীত ভাবতে ভাবতে পেছনের সিটে ঘুমিয়ে পড়ল রজনী। ওদিকে নিশ্চুপ, নির্বাক বসে গাড়ি ড্রাইভ করছে সৌমিত্র। তার মন দ্বিধান্বিত। একবার চাচ্ছে যা হয়েছে মেনে নিতে। আবার ভাবছে অন্য কথা। গত কয়েকদিন সে নির্ঘুম কাটিয়েছি শুধুমাত্র এই ভাবনা চিন্তায়। বুকে ব্যথা করছে থেকে থেকে। করবে না কেন? নিকোটিনের ধোঁয়ায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে হয়ত ফুসফুস। কী এক জীবন তার। অনিশ্চিত! এই জীবনে কাওকে না জড়ানোই ঠিক। সৌমিত্র লুকিং গ্লাসে আরেকবার ঘুমন্ত রজনীর মুখটা দেখল। চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই।
চলবে,,,
দু’টো গল্প লিখেছি একদিনে। ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন।