তুই হৃদহরণী পর্ব ১২

#তুই_হৃদহরণী
#সাদিয়া
পর্ব : ১২

আহরারের বুকের ভেতরটায় হাজারো কষ্ট নিয়ে বেড়ে উঠেছে ছোট থেকে। না পাওয়া, ভালোবাসা হীন, একাকিত্ব গ্রাস করেছে তাকে ছেলেবেলা থেকে। সব কিছুর কারণেই আজ সে এই আহরার। নয়তো এই আহরারের মাঝে অন্য একটা স্বত্বা থাকত। আহরার কষ্ট পাচ্ছে খুব। বুকের ভেতর ব্যথা লাগছে। শরীর অনেক ঘামছে। আস্তে আস্তে সিংহ আহরার কেমন গুটিয়ে আসতে লাগল। দাঁড়িয়ে তুরফা সবটাই দেখছে।

আহরার হঠাৎ খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিচে বসতে লাগল। তুরফা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দেখল তা। দ্বিধা থাকলেও সেটা আর পাত্তা দিল না। আগে জীবন। তাড়াতাড়ি করে সে নিচে আহরারের মাথার কাছে বসে পরল। নরম দুই হাতে আহরারের মাথা নিজের কোলে তুলে নিল।
“কি হয়েছে? কি হয়েছে আপনার?”

“….

“কি হলো?”

“….

“কি? মুখ ফুটে বলুন।”
তুরফা বুঝতে পারছে আহরার কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না তার। ঘামছে, সাদা মুখ টা কালছে হয়ে আসছে। তুরফার খুব ভয় হচ্ছে। ভেতরটা কাঁপছে তার। মানুষটার জন্যে মায়া লাগছে খুব। উঠানো হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিল তুরফা। করুণ গলায় জিজ্ঞেস করল,
“বলুন না কি বলবেন? চেষ্টা করুন।”

“….
আহরার বলতে পারল না।

“পানি? পানি দিব?”
আহরার মুখ দিয়ে “হ্যাঁ” বলতে পারল না। শুধু চোখের পাতা টা একবার বুজে নিয়ে ইশারায় সম্মতি জানাল। আলতো হাতে তুরফা কোল থেকে আহরারের মাথা টা নিচে রেখে এক প্রকার দৌড়ে গেল পানি আনতে। পানি হাতে নিয়ে এসে গ্লাস টা নিচে রাখল। আহরারের মাথা টা নিজের বাহুতে রেখে ডান হাতে একটু একটু করে পানি খায়িয়ে দিল তুরফা। আহরার অল্প করে পানি গিলল।

“আরেকটু খান।”

“….

তুরফা আরো একটু পানি খায়িয়ে দিল। বুঝতে পারছে না লোকটার কি হয়েছে। কিন্তু খুব ঘামছে। তুরফা গিয়ে ডাকতেও পারছে না কাউকে। জোর করে আরো একটু পানি খায়িয়ে দিল তুরফা। আহরার আধোআধো গলায় বলল,
“ল লবণ।”
তুরফা উঠে গেল। কয়েক সেকেন্ড ভেবে বুঝল মানুষটার প্রেসার লো হয়ে গিয়েছে।
“লবণ কোথায় পাবো?”

“টে টেব..”
আহরার জোরে জোরে নিশ্বাস নিল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। তুরফা টেবিলে গিয়ে দেখল ছোট একটা লবণ দানী রয়েছে। বুঝল, লোকটার প্রায় এমন হয়। লবণ নিয়ে গিয়ে আহরারের মুখে দিল। আহরার তুরফার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে মুখের লবণ চুষতে লাগল। তুরফা খানিক রাগে বলল,
“আপনার মাঝে মাঝেই এভাবে প্রেসার লো হয়ে যায় তাই না?”

“….

“লো প্রেসার সবসময় থাকলে এটা কিন্তু ক্ষতিকর। আশা করি আপনি জানেন এটার কারণ। পানিশূন্যতা, বদহজম, হার্টের সমস্যা, দুশ্চিন্তা, ভয়, ঠিক ভাবে খাবার না খাওয়া, অপর্যাপ্ত ঘুম আরো কিছু কারণে লো প্রেসার হয়। আপনি..”

আহরার মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল,
“চিন্তা, ভয়, না খাওয়ার জন্যেই হয়তো এমন হয় হৃদহরণী।”

“কেন হয়? আপনি তো সুখি একটা মানুষ।”

আহরার হাহা করে হাসল কষ্ট করে। তুরফা বোকার মতো সেই মেকি হাসি দেখছে। হাসি থামিয়ে আহরার বলল,
“আপনি বুঝবেন না হৃদহরণী।”
তুরফা খানিক চুপ থেকে বলল,
“ধরে উঠার চেষ্টা করুন আমায়।”

“….

“কি হলো?”

“তোমার শরীরে আমার নোংরা স্পর্শ লেগে যাবে না তুর?”

জবাবে তুরফা চুপ থেকে উত্তর দিল,
“মানুষের জীবন বাঁচানোও ফরজ কাজ।”
আহরার কিছু বলল না। তবে তৃপ্তির একটা হাসি দিল।

“যাক আহরারের জন্যে মিস তুরফার এক বিন্দু করুণা দেখেও শান্তি লাগল।”

তুরফা বিড়বিড় করে বলল,
“এক বিন্দু? আমি না থাকলে তো আপনি…”

“কিছু বলছো?”
বিব্রত হয়ে তাকাল আহরারের দিকে। আমতাআমতা করে জবাব দিল,
“ক কই না তো।”

“মনে হলো।”

“এত মনে হয় কেন আপনার?”

“মনেই যে হৃদহরণীর বাস।”

“…..

“কিছু বললে না যে?”

“আপনি গিয়ে সোফায় একটু বসুন। আমি কফি নিয়ে আসি।”

“নাদিম চাচা কে বললেই দিয়ে যায়। দাঁড়াও আমি বলছি।”

আহরার কে সোফায় বসিয়ে তুরফা কোনো জবাব না দিয়েই চলে গেল কেবিন থেকে। আহরার শুধু চেয়ে দেখল। ঠোঁট দিয়ে আপনাআপনি বের হয়ে এলো
“তুরফা, আসলেই তুমি বিরল বস্তু। খুব কম দেখা যায়। নামের সাথে তুমি তুরফা যথার্থ। যাকে বলে মেড ফর ইচ আদার।”

একটু পর তুরফা হাতে এক কাপ কফি আর একটা প্লেটে কিছু কিসমিস আর কাজু ও পেস্তাবাদাম নিয়ে আসল। আহরারের সামনে গিয়ে কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“কফি আর এ গুলি খেয়ে নিন শরীর টা একটু ঠিক হবে।”
বিস্ময় আর খুশিতে ঝলমল করা চোখ নিয়ে আহরার তুরফা কে দেখল। মনের মাঝে খুশির উতাল পাতাল ঢেউ হচ্ছে। আকস্মিক পাওয়া গুলি অতুলনীয় হয়। যার অনুভূতি শুধু অনুভব করা যায়। মুখে প্রকাশ করে শুধু কাউকে বুঝানো যায় না। আহরার আনন্দ ভরা নয়নে মুচকি হেসে কফির মগ টা নিল। চুমুক দিয়ে বাচ্চামি স্বভাবে বলল,
“আমি কাজু, পেস্তাবাদাম খাই না।”

কথার ধরণে তুরফার ভীষণ হাসি পেল। তা দমিয়ে মুখে বলল,
“তবে কিসমিস গুলি খেয়ে নিন শরীর টা ঠিক লাগবে।”

“তা হবে। কিসমিস তো আমার সেই পছন্দের খাবার।”

“আমারও..”

“….

“না ম মানে, আপনি খান।”

তুরফা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। আহরার তুরফার দিকে নেশাময় একটা দৃষ্টি দিল। তারপর কফির সাথে সাথে কিসমিস খেতে লাগল। আহরার কে এভাবে কিসমিস খেতে দেখে তুরফা ঠিক থাকতে পারছে না। বেশ পছন্দের খাবার যে এটা তারো। নিজের জিহ্বের পানি ঠিক রাখতে প্লেট থেকে কিছু কিসমিস তুলে নিল তুরফা। অথচ নেওয়ার আগে আহরার কে জানালও না, অনুমতিও নিল না। তুরফা পিছন ফিরে নেকাব উপরে তুলে মুখে দিল সেগুলি। আহরার হতভম্বের মতো বসে শুধু দেখল। তুরফার এই হুটহাট করা সাহস গুলি ভীষণ ভালা লাগার কাজ করে তার মাঝে। তুরফা তার দিকে ফিরলে সেই ঝলমল করা সাগরের ঢেউয়ের মতো চোখ দেখে আহরারের কি যেন হলো। ভেতরে একটা ঝাটকা দিয়ে উঠল। কি ভেবে নেশাভরা চোখ নিয়ে তুরফার কোমর পেঁচিয়ে নিল। বসা থেকেই হেঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো তাকে। আধো গলায় শুনা গেল,

“এভাবেই যত্ন নিবে আমার মিস হৃদহরণী।”

তুরফা আগুনের ফুলকির মতো রেগে গেল। দুই হাতে আহরারের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজে সরে এলো। রাগি লাল চোখের অগ্নিদৃষ্টি দিল আহরারের দিকে। কিন্তু চুপ করে চলে গেল পর্দার ওপারে। আহরার মাথা চুলকাতে লাগল। বিড়বিড় করছে,
“ইসস ওর সাথে ভুল হয় কি করে? আবেগের বসে আমি….”
এমন সময় রুমে এলো ফিরাত। আহরারের এমন চোখ মুখ দেখে ভয়ে দৌড়ে গেল সেখানে। হাটু গেড়ে বসে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই আহরার কি হয়েছে তোর?”

“….

“কিরে কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে? আহরার?”

“মোনতাহ্ কে?”

ফিরাত একটু সময় চুপ থেকে বলল,
“এটা বলার সময় চলে যায় নি। আগে বল তোর কি হয়েছে? চুপ থাকিস না। ইয়ার চিন্তা হচ্ছে আমার।”

“প্রেসার লো হয়ে গিয়েছিল।”

“আবার? ঠিক মতো খাস না ঘুমাস না কি হবে তোর বল?”

“পুরোনো ব্যথা যে জ্বালা দেয়।”

মৃদু সরে বলল আহরার। আহরারের পাণ্ডুর মুখ দেখে ফিরাত আর কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে রইল। কালো অতীত টা যে তারো জানা।

তুরফা এক নজরে দুজন কে দেখতে লাগল পর্দার ওপারো বসে। ভাবল, দুই বন্ধুর মাঝে কত টা ভালোবাসার সম্পর্ক। তুরফা আহরারের দিকে তাকাল। মুখের আড়ালে যেন সে একটা অন্য আহরার কে দেখতে পেল। একদম সাদা কাগজের মতো শুভ্র আহরার। ভাবতে ভাবতে, চোখ গরম করে তুরফা সেই ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু পানি খেলো। ফিরাত কে দেখে তার মনে পরল মোনতাহ্ র কথা। কল দিয়ে জানতে হবে সব নিয়েছে কি না। তবে অনেক টা বকা শুনতে হবে মোনের কাছ থেকে। তুরফা হেসে ফোন নিল। মোনতাহ্ র নাম্বারে কল দিল।
“কিরে সব কিনেছিস তো?”

“কি হলো কথা বলছিস না কেন?”

“এই কল দিয়েছিস কেন তুই? কল দিয়েছিস কেন? বেত্তমিজ, ফাউল মেয়ে একটা। বাসায় আয় তুই আজ দেখিস তোকে আমি কি করি। এ্যা উদ্ধার করে দিয়েছে আমায় একজন কে পাঠিয়ে। তোকে বলেছিলাম আমি কাউকে পাঠাতে? তুই আসবি না বলতি অন্য কাউকে পাঠাতে গেলি কোন দুঃখে? আমি বলেছি উনাকে পাঠাতে? ওটা মানুষ ছিল না আস্তো বিপদ একটা। দোকানের এক ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বলে সে কি ঝগড়া লাগিয়ে দিল। যেন মারবে মারবে। স্বয়ং বিপদ উনি। তুই জেনে শুনে আমায় বিপদে ফেলেছিস। ইচ্ছা করে ওমন বাঘ কে পাঠিয়েছিস আমার মতো নিরিহ মেয়ের কাছে। তোকে আমি, আজ বাসায় এলে দরজা খুলব না। সারা রাত বাসার বাহিরে থাকবি। দরজায় ঝাড়ু ঝুলিয়ে রাখব আমি তুই….”

তুরফা গট করে কল টা কেটে দিল। ওদিকে,
“হ্যালো, হ্যালো। তুরি হ্যালো..”
কানের কাছ থেকে ফোন নিয়ে যখন দেখল কল কেটে দিয়েছে মোনতাহ্ আরো রেগে গেল।
“আজ বাসায় শুধু আয় তুই।”

তুরফা ফোন রেখে চোখ বড়বড় করে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ল।
“বাব্বাহ্ না জানি আজ কি হয়। কি আছে কপালে আল্লাহ জানে। মহারানী রেগে হয়তো আগুন।”
ফিরাত আর আহরার তখনো কথা বলছিল। তুরফা মনে মনে ভাবল, “ফিরাত ভাইয়া কেই বলতে হবে লোকটার খেয়াল রাখতে। এভাবে থাকলে উনার বড় কিছু হয়ে যাবে।

তুরফা নিজের মতো করে কাজ করছে। নেকাব পরা অথচ সাদা পর্দার মাঝে আহরার মুগ্ধ নয়নে দেখে চলছে মুগ্ধকারিনী কে।

ফ্রেশ হয়ে এসে আহরার তার গুপ্ত রুমে গেল। ইয়া বড় বড় একেকটা ছবি। সব গুলির উপরে কাপড় টেনে দিয়েছে সে। অনেক দিন এই রুমে আসা হয় না তার। অফিসে থাকতেই কল করে বলেছিল রুম টা একটু পরিষ্কার করতে। কিন্তু ভুলেও যেন ছবির উপর থেকে কাপড় টেনে না সরায়। অনেকদিন পর আহরার এই রুমে এসে আশেপাশে দেখতে লাগল। কয়েক বছর হয়ে গিয়েছে এখানে আসা হয় না তার। তবে আজ খুব মন চেয়ে তার। মন টেনে নিয়ে এসেছে তাকে এখানে। বড় একটা প্রিন্টিং পেপার রয়েছে তার সামনে। পাশে অনেক গুলি রং ও তুলি রয়েছে। সব গুলি কে আহরার আলতো করে ছুঁয়ে দিতে লাগল। তার ছুঁয়াতে সব কিছু যেন প্রাণ পেতে শুরু করল। আহরার নীরবে বসল তার সেই টুল টায়। বসে উপরে তাকাল। চোখ বন্ধ করে কয়েক বার নিশ্বাস ফেলল। চোখের সামনে তুরফার নূরের মতো মুখ টা ভাসছে শুধু বারবার। আহরার ধপ করে চোখ মেলল। হাতে তুলে নিল তুলি। মন দিয়ে আঁকতে শুরু করল। রং এর খেলা শুরু করে দিল আহরার। একটা সিগারেটের নেশা পেয়েছে তাকে। তবুও সিগারেট হাতে তুলল না। যে উদ্দেশ্যে হাতে রং তুলি তুলেছে। তার মধ্যে সিগারেট স্পর্শ করে হাত দূষিত করতে চায় না এই মুহূর্তে। এক গালে হেসে আবার রুং তুলির খেলা চালাতে লাগল।

অসম্পূর্ণ রেখে উঠে পরল আহরার। আজ আর আসছে না কিছু। ফিরাত ঘুমিয়েছে অনেক আগে। সে ব্যালকুনিতে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দুইটা সিগারেট টানল আপন মনে। তারপর ঘুমাতে চলে গেল। তুরফা কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল।

প্রতিদিনকার মতো আজো আহরার সেই খোয়াব দেখল। ঘোলাটে ধোঁয়াশাপূর্ণ এক নারী। আহরার স্বপ্নের মাঝেই ছনবন করতে লাগল। হঠাৎ এক চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে উঠল আহরার।

চলবে….
(কষ্ট করে গল্প লিখি আপনাদের নাইস নেক্সট শুনার জন্যে নয়। আশা করি গঠনমূলক কমেন্ট করবেন। কপি করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here