#তুই_হৃদহরণী – ১৯
আহরারের ভেতরের দাবানল আর দহন মিলেমিশে বিশ্রী এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ভাবেই নিজেকে ঠিক করতে পারছে না। ফুসফুস করার কারণে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। সুবিধা না ঠেকে ফিরাত খাবলে নিয়ে নিল ফোন টা। আহরার অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নিল চোখ বন্ধ করে। যতই হোক টান তো একটু হলেও আছে। ফিরাত খানিক ভয়ে কল টা রিসিভ করল।
“হ্যালো।”
“জ্বি আঙ্কেল।”
ও পাশের ব্যক্তিটা আশাহত হয়েছে তা উনার নীরবতা সাক্ষী দেয়। ফিরাতও চুপ করে রইল।
“আঙ্কেল।”
“হুম? বলো বাবা।”
“কেমন আছেন?”
তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে জবাব দেয়।
“আছি আরকি। যার সব থেকেও নেই।”
“….
ফিরাতের মুখে আর কথা ফুটল না। ছোট থেকেই ওদের কাছে বড় হয়েছে সব টাই তার জানা। বিষয় টা ওদের জন্যে আসলেই মর্মান্তিক। আহরার কে চোখের সামনে এক বছর আগেও তিলেতিলে কষ্ট পেতে দেখেছে। আঙ্কেল রাজি না হলেও আন্টি জোর করেছিল তাই….
ফিরাত প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
“আন্টি কেমন আছেন?”
আহরারের রাগ কে আবার চড়া দিয়ে উঠল। সিটবেলটা খুলে সে বের হয়ে এলো রাস্তায়। ভেতরে বড্ড জ্বলন হচ্ছে। শান্তির খুব বেশি প্রয়োজন এখন। প্রকৃতি হয়তো তার কষ্ট টা কাছ থেকে বুঝেছে তাই তার প্রতি সহায়। খুব জোরে জোরে বাতাস বইছে আশপাশ দিয়ে। আহরার চোখ বন্ধ করে আছে। ভেতরে যে ঠিক কি রকম অনুভূতি হচ্ছে তা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না।
ওদিকে কল দাতা নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মাহিলা তখন হাত কচলাচ্ছে খানিক ভয় ও অফুরন্ত কষ্টে। কলদাতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে জবাব দিলেন
“যেমন থাকার কথা।”
“….
“ও ভালো আছে তো ফিরাত?”
ফিরাত একটু চুপ থাকে। পরক্ষণে জবাব দেয়।
“জ্বি। জ্বি আঙ্কেল ও ভালো আছে। চিন্তা করবেন না। ও ঠিক আছে।”
“তুমি বাবা একটু খেয়াল রেখো।”
বলতে বলতে উনার গলা আটকে আসছে বুঝল ফিরাত। কাঁদছেন হয়তো। কলদাতা চোখের পানি মুছে ফোন টা কেটে দিল। ভেতরে চাঁপা কষ্ট হচ্ছে উনার। মহিলার দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালেন তিনি।
“তোমার জন্যে আজ এই অবস্থা। শুধু তোমার জন্যে। এত কিছুর জন্যে একমাত্র তুমি দায়ী।”
মধ্যবয়সী মহিলা ভেতরের কষ্টে দুঃখে চলে গেলেন নিচ থেকে। পানি কলের মতো পড়ছে। তিনি খুব ভালো জানেন তিনি কি করেছেন। অনুতপ্তও তিনি নিজের কাজের জন্যে। তখন পাষাণ না হলে আজ এমন দিন দেখারও সুযোগ হতো না হয়তো। বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। নিজের রুমে বসে ডুকরে কান্না করছেন তিনি।
ফিরাত নিজেও গেল আহরারের কাছে। পাশে দাঁড়িয়েছে ২ মিনিট হলো এখনো সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। জেনেশুনে কিছু করতে না পাড়বার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল ফিরাত। ফোন টা আহরারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “যাবি না?” আহরার চমকে তাকায়। চোখ ঝাপসা লাগছে। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ফিরাত মুখে একটু মেকি হাসির আভাস তুলে বলল
“চোখের পানি লুকাতে চাইছিস?”
আহরার জবাব দিল না। কোণা থেকে এক বিন্দু পানি আঙ্গুলের ঢগায় তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এত মাঝেও যেন তার কত ক্ষোভ।
“আর কত এভাবে নিজের কষ্ট আর অভিমান নিয়ে থাকবি?”
“অভিমান নয় উনাদের প্রাপ্য।”
বেশ কড়া গলায় কথাটা শেষ করে আহরার গাড়িতে গিয়ে বসে।
বাড়ি পৌঁছে আহরার আগে ওয়াশরুম চলে গেল। আয়নার সামনে দুই হাতের উপর শরীরের উপরিভাগের শক্তি ঠেলে একটু ঝুঁকে আছে। দৃষ্টি তার আয়নার মাঝে নিজের চোখে।
“অভিমান! সত্যিই এটা অভিমান? মা বাবা হয়ে উনারা আমার সাথে যা করেছেন তার জন্যে আমি অভিমান করব? শুধুই অভিমান? এর বেশি কিছুই না? আরে উনাদের উপর রাগ টাই অতি নগণ্য হয়ে যাবে আর অভিমান বলে ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। পাড়ি না শুধু নিজ হাতে মেরে ফেলতে। আরে উনাদের উপর শুধু অভিমান করলে নিজের উপর অন্যায় আর বেইমানী করা হয়। কারণ উনারা আমার সাথে যা করেছেন..”
আহরারের শ্বাস নেওয়ার গতি বাড়ছে। চোখ মুখ শক্ত করে বাথটাবে বসে পড়ল। শরীর মন দুটোই যেন পুড়ার মতো জ্বলছে। মলম লাগালোর জায়গা যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না।
তখন তার মা বাবাই কল দিয়েছিলেন। ছেলে দেশে ফিরেছে অথচ একদিন সামনে থেকে দেখার সুযোগ হলো না উনাদের। আলতাফ চৌধুরী যতটা না কষ্ট পান তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি পান মিসেস মিলিফা চৌধুরী। মাতৃত্ববোধ, নিজের অসহায়ত্বে সব চেয়ে বড় ভুল করতে বাধ্য হওয়া, অনুশোচনা, সব চেয়ে বড় যেটা হলো সেটা নিজের সন্তান কাছে না পাওয়ার কষ্ট উনাকে তিলে তিলে কষ্ট দেয়। একই শহরে থেকেও সন্তান কে কাছে পাবে দূরের কথা কথাও বলে না সে। কত বছর যে ছেলের মোহময় কষ্ঠ শুনেন না তা উনার অজানা।
মোনতাহ্ চিন্তিত অবস্থায় বসে আছে ব্যালকুনিতে রাখা চেয়ারে উপর। চোখ বন্ধ কত কিছু ভাবছে মনে। ফিরাত ছেলে টা কে যে তার একে বারে অপছন্দ এমন টাও নয়। ভালো লাগে অনেক টা। দোষে নয় অনেকটা সেচ্ছায় বিয়ে করতে রাজি সে। একটা ভরসার হাত পাবে সাথে এক বুক ভালোবাসা। তখন তুরফা নাচতে নাচতে এলো তার কাছে। পড়নে টপস আর প্লাজু। খুশিতে গদগদ হয়ে এসেছে। মোনতাহ্ র পাশে দাঁড়িয়েই তাকে ঠেলে ডাক দেয়।
“কিরে এই মোন, শুনছিস? বিয়ের আগেই কি তুই দুলাভাইয়ের চিন্তায় পড়েছিস নাকি? এই মোন।”
“এত চেঁচামেচি করছিস কেন?”
“বারে একজন কে না পাওয়ার আগেই আমাকে তোর চেঁচামেচি মনে হচ্ছে?”
“তোকে মনে হবে কেন? আমি তোর কথা কে বললাম।”
“ঘুরে ফিরে সেই আমিই তো নাকি।”
মুখে মন খারাপের ভাব নিয়ে এসে বলল তুরফা। ফুলিয়ে রেখেছে মুখ। মুখের ভাব দেখে মোনতাহ্ ফিক করে হাসল। তুরফার গাল টেনে বলল,
“কখনোই না।”
“তোকে ছাড়া আমার একা একা থাকতে হবে। সেই আবার একা হয়ে যাবো।”
এবার সত্যিই মন খারাপ হয় তুরফার। মুখ কালো করে আনে। চোখ টলমল করছে তার। নিচের দিকে মাথা দিয়ে রয়েছে। মোনতাহ্ তার গালে হাত দিয়ে মুখ উপরে তুলার চেষ্টা করছে।
“তুরি। এই তুরি তাকা আমার দিকে।”
“….
“তুরি লক্ষ্মী বোন আমার এমন করিস না তাকা আমার দিকে।”
তখন তার ফোনে একটা কল আসে। আননোন নাম্বার। ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকায়। তুরফা নাক টেনে মুখ উপরে তুলে।
“কে ফোন দিল রে?”
“….
“কি রে?”
“চিনি না।”
“দেখি।”
তুরফা নাম্বার দেখে অবাক হলো।
“আরে এ তো ফিরাত ভাইয়ার নাম্বার।”
এই কথা শুনে মোনতাহ্ আরো ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“হ্যাঁ কিন্তু উনি তোর ফোন নাম্বার কোথায় পেল?”
“সেটাই ভাবছি।”
“তুই আবার নাম্বার দিস নি তো?”
“আরে আমি কেন দিব?”
“তা হলে পাবে কোথা থেকে?”
মোনতাহ্ কয়েক সেকেন্ড ভেবে রাগি চোখে তাকায় তুরফার দিকে।
“তুরি তুই..”
তুরফা ঢোক গিলল। অসহায় এর মতো মুখ করে বলল,
“বিশ্বাস কর আমি দেইনি। সত্যি বলছি ৩ সত্যি আমি দেই নি।”
“…..
“দেখ তর রোমিও নিজেই হয়তো নাম্বার জোগাড় করে ফেলেছে।
“কিন্তু..”
“পরে ভাবিস আগে কল টা দর।”
মোনতাহ্ কাঁপা হাতে ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে কল ধরল।
“হ্যা হ্যালো।”
“থাক তুই তোর রোমিওর সাথে টাঙ্কি মার আমি আসি।”
“তুরি তোকে আমি..”
তুরফা হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে গেল।
“কি করছে আমার চাঁদ?”
“….
“কি হলো? কথা বলো না কেন?”
“ব বলুন।”
“আহরার কে ধন্যবাদ দিলেও ছোট হবে আমার চাঁদ কে তবে কষ্টহীন হাতের নাগালে দিয়ে দিলো বলো।”
মোনতাহ্ চুপ। ভালো লাগার অনুভূতি হচ্ছে। ও পাশ থেকে হাসির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।
আহরার সেই যে রাগের বসে এসেছিল তারপর থেকে ঘুম। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে আছে। মুখে পানির দানা। কিছু চিন্তা করছে। পাশে নিজের ফোন টা দেখে হাতে নেয়। ডায়েল করে এক নাম্বারে। তুরফা তখন নিজের রুমের ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে ছিল মন খারাপ করে। আসলেই তার মন খারাপ হচ্ছে এত দিন মোনতাহ্ একা ছিল তাই এক সাথে বোনের মতো ছিল কিন্তু যদি বিয়ে হয়ে যায় তবে? তাহলে তো আর দরকার নেই। চোখে পানি নিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ফোনের আওয়াজ পেয়ে নাক টান দেয়। বিছানা থেকে ফোন টা নিয়ে আবার ব্যালকুনিতে যায়। ঝাপসা চোখে দেখতে পায় একটা আননোন নাম্বার। ভ্রু কুঁচকে ভাবে ধরবে কি ধরবে না। বলতে বলতে কল টা ধরল। ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো এক কন্ঠ শুনা যায়।
“একটা কল রিসিভ করতে এতক্ষণ সময় লাগে তোমার?”
খুব বেশি পরিচিত বলে মনে হচ্ছে কন্ঠ না। তুরফা একবার ফোনের স্কিনে তাকিয়ে আবার কানে ধরল সেটা। কিন্তু চুপ করেই রইল।
“কি হলো? কথা কানে ঢুকছে না হৃদহরণী।”
বুঝতে আর এক সেকেন্ডও লাগল না তুরফার।
“হৃদহরণী চুপ কেন? আশা করো নি বুঝি আমার কল টা?”
“….
“দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে তোমার ওই শুভ্র মুখ টা।”
“দে দেখুন আপনার কোনো দরকার না থাকলে কল রাখেন।”
“দরকারই তো খুব দরকার। খুব দরকার তোমায় আমার।”
“দে দেখু..
“তুরফা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছি।”
তুরফা স্তব্ধ হয়ে গেল ওই কোমল কন্ঠের ব্যথিত স্বরে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
“…..
“কি কি হয়েছে আপনার?”
“….
আহরার একটু চুপ থেকে কল টা রেখে দিল। চোখের কোণায় এক বিন্দু পানি জমেছে। চোখ বন্ধ করে দাঁত কটমট করে ভেতরের বৃষ্টি ভেতরেই রাখতে চাইছে। বুকের ভেতর টায় জ্বলন ধরছে। আহরার চেয়েও অনেক কষ্টে আজ চোখের দানা টা আটকে রাখতে পারেনি টুপ করে নিচে পড়ে গেল। ঠোঁট কাঁপছে। আজ বড্ড মনে পড়ছে শৈশব কে। একার সেই দিন গুলি কে। সেখানে সবাই মা বাবার আদরে বেড়ে উঠে সেখানে সে একা ওই বহু দূরে মানুষ হয়েছে। নিজের কাছের বলতে একটা মানুষ ছিল না তার কাছে। অসুস্থের সময় একা রাত কাটাতে হয়েছে তাকে। মায়ের পরশ হাত উঠে নি তার মাথায়। নিচ হাতে প্রতি টা সময় খেতে হয়েছে তাকে। বাবার হাত থেকে এক লোকমা ভাত জুটেনি মুখে। নিজের কষ্টের সময় টা একা একা রাতের আঁধারে পাড় করতে হয়েছে তাকে। সব কষ্ট যেন আজ মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। দুই হাত এক সাথে কচলাচ্ছে কষ্টের চুটে। বুক ভরা কষ্টের এক কণা আবার চোখ দিয়ে বের হয়ে এলো আহরারের।
চলবে….
#সাদিয়া
(ইডিট করার সময় হয়নি ভুল সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে নিবেন। কপি করা থেকে বিরত থাকুন।)