চতুর্থা পর্ব ১

ছোটগল্পঃ
চতুর্থাঃ (১ম খন্ড)
মোর্শেদা হোসেন রুবীঃ
~~~~~~~~~~~~~

-“এই পারুল শুনেছিস কিছু..?” মায়ের ব্যগ্র কন্ঠে ঘুম ছুটে গেলো পারুলের। এমনিতেই গত রাতে একটা ফোঁটা ঘুমাতে পারেনি। সকাল থেকেই মাথাটা ভার হয়ে আছে। এর মাঝে মায়ের এই জ্বালাতন। একটু আগেও ইসতিয়াকের সাথে ফোনে তুমুল ঝগড়া হয়েছে তার। গত রাত থেকেই সে একটু পরপর ফোন করে চলেছে। মন-মেজাজ তখন থেকেই অসম্ভব খিঁচড়ে আছে পারুলের।
এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
কোনো জবাব না দিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে রইলো পারুল। কারন মা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে পারুল জেগে আছে তাহলেই খবর আছে। গত পাঁচ বছরের কাহিনীর পুঁথিপাঠ শুরু হবে তার। কাজেই সাড়াশব্দ না করাই এখন নিরাপদ। পারুল নির্দিষ্ট ছন্দে বেশ মসৃণ একটা নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো যা দেখে মনে হলো ও সাউন্ড স্লিপ ঘুমাচ্ছে। আর নিজের অভিনয় প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলো সে। সত্যিই সে বেশ ভালো অভিনেত্রী। অস্কার পাবার মতো পারফরমেন্স জানে সে তবে তার অভিনয় দক্ষতার কথা শুধু মা’ই নয় আর কেউই জানে না।

অতি সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো পারুল। দুচোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে আবার। নিজেই অবাক হলো, এখনো চোখে পানি আসে ভেবে ! সে ভেবেছিলো গত পাঁচ বছরে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও বোধহয় শুকিয়ে গেছে । কিন্তু আজ চোখের পানিটা তবে কেন ঝরতে চাইছে বুঝে আসছে না। এ কি কষ্টের কান্না নাকি আফসোসের…? পারুলের সমস্ত ভালোবাসা অপাত্রে দেবার জন্যেই কি এই আফসোস!

বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো মুছে যাওয়া দিনগুলি। যেগুলি কখনোই ওকে আর পিছু ডাকে না।
ইসতিয়াক যাকে সংক্ষেপে সবাই ইসতি বলেই ডাকে সে’ই হলো পারুলের জীবনের সব সর্বনাশের মূল। কবি কি ভেবে ঐ কবিতাটা লিখেছিলেন পারুল জানে না, তবে এটা মনে আছে যে, সেদিনটি প্রহর শেষের আলোয় রাঙা চৈত্র মাস ছিলো না যেদিন পারুল ইসতির চোখে নিজের সর্বনাশ দেখেছিলো।

ইসতি পারুলের আপন ফুপাতো ভাই। মেজফুপীর একমাত্র ছেলে সে। পারুলের মোট তিনজন ফুপীর মধ্যে বাকি দুজন বিয়ের পর নিজ নিজ শ্বশুড়বাড়ী চলে গেলেও মেজফুপীই বাবার বাড়ীতে রয়ে গেছেন। তার কারন মেজফুপার অতিমাত্রার ঘরকুনো স্বভাব। এই স্বভাবটার জন্য তিনি সারাটা জীবন কাজকর্ম বাদ দিয়ে একরকম ঘরে বসেই কাটিয়ে দিলেন। পরিশ্রম, চাকরী ব্যবসা আয় উন্নতি রোজগার শব্দগুলো তাঁর ধাতে নেই। তারই অলসতার কারনে যে মেজফুপীকে অনেক লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে সেটা যেন তার বোধগম্যই হয়নি কোনোদিন। দাদাবাড়ীর এই মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুই মেজফুপীর সব। শ্বশুড়বাড়ী থেকে ভাগে পাওয়া অংশটুকু বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন ফুপী। সেই ভাড়াতেই একমাত্র ছেলে ইসতির পড়াশোনা সহ তাদের তিনজনের সংসার চলেছে। ইসতি বরাবরই মেধাবী ছাত্র বলে মেজফুপীকে ওর পড়াশোনা নিয়ে বিশেষ পেরেশানী পোহাতে হয়নি। আজ যে ইসতি লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরী করছে এসবই মেজফুপীর অবদান। ইসতিকে জন্ম দেয়া ছাড়া ফুপার এখানে কোনো ভূমিকাই নেই। একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে মেজফুপীর চেষ্টার কোনো অন্ত ছিলো না। মূলতঃ ইসতিকে নিয়ে তার স্বপ্ন দেখার কোনো শেষ নেই। ফুপী সবসময়ই বলতেন, আমার রাজপুত্রের মতো ছেলেকে আমি রাজবাড়ীর মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো। রাজকন্যা আনবো রাজকন্যা। ফর্সা আর সুন্দরী..!

ফলে একই পারিবারিক পরিমন্ডলে ইসতির সাথে বেড়ে উঠলেও পারুল মেজফুপীর চোখে কোনোদিনই রাজকন্যা হতে পারেনি। কারন পারুল শ্যামলা আর পারুলের বাবা কোনো রাজাধিরাজ নয়, একজন সাধারন ব্যবসায়ী। তার উপর পারুল বাবার সম্পত্তির একাকী মালকিনও নয় বরং সে তার বাবার ছয় সন্তানের একজন।

তারপরেও একদিন সবার অগোচরে ইসতির সাথে ওর প্রণয় ঘটেই গিয়েছিলো। হয়তো সেদিন ইসতি ভালোলাগা আর ভালোবাসার পার্থক্য করতে পারেনি। আর তাই কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে পারুলকে মন দিয়ে বসেছিলো।

ঘটনার শুরু পারুলের এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে। দশম শ্রেনীতে উঠার পরপরই একদিন বাবা মেজফুপীকে ধরেছিলেন, ” সাহিনা, ইসতিটা যদি একটু সময় করতে পারে তাহলে আমার পারুলকে একটু অংক আর ইংরেজীটা দেখিয়ে দিতে বল্ না। পারুলটা অঙ্ক আর ইংরেজীতে খুবই কাঁচা। আমি বাইরের মাস্টারকে বেতন যা দিতাম ওকেও তাই দেবো। ওর তো আবার অঙ্কের হাত খুব ভালো। ”

বাবার কথায় মেজফুপীর রাজী না হবার কোনো কারনই ছিলো না কারন বাড়ী বসে ছেলের এই বাড়তি আয়টুকু অগ্রাহ্য করার মতো আর্থিক পরিস্থিতি ফুপীর ছিলো না। ফুপী অবশ্য সেটাকে চাপা দিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলেছিলেন,” বেতন টেতন আবার কি। তোমার উপকার হলে ও করবেনা কেন ভাইজান, তাছাড়া ওর নিজেরও তো একটা চর্চা হবে”।

সেই ছিলো শুরু। পারুলের সর্বনাশের। দুজনে ভেসে গিয়েছিলো এক প্রতিরোধ্য জীবনের গতিময়তায়। লোকচক্ষুর সামনে তারা মনোযোগী ছাত্রী শিক্ষক হলেও আসলে ছাত্রী তখন শিক্ষকের কাছ থেকে অঙ্কের চেয়ে প্রেমের পাঠটাই বেশী নিচ্ছিলো। প্রথম দিকে চোখে চোখে কথা হতো দুজনে। ধীরে ধীরে হাত ধরা শুরু হলো। তারপর মনের দাবী বাড়তে শুরু করলো দুজনেরই। হয়তো একারনেই মুরুব্বীরা বলেন আগুন আর ঘি একসাথে রাখতে নেই।

পারুলের এস এস সি পরীক্ষা তখন দোরগোরায়। দিনে দু’বার করে বসা হচ্ছিলো পড়তে। সেসময় ইসতি মাঝে মধ্যেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইতো। পারুলকে আরেকটু নিজের করে পাবার লোভে। এরই মাঝে একদিন ছাদের নির্জনে পারুলকে জাপটে ধরে ইসতি। পারুল তখন তার উঠতি যৌবনের ফাগুন বনে আগুনের আঁচ টের পাচ্ছিলো। ওর নিজেরো সাধ হচ্ছিলো জ্বলে পুড়ে মরবার। কিন্তু অজানা একটা ভয় গ্রাস করেছিলো ওকে। কচি মনে একটা ভয়ই বারবার হানা দিচ্ছিলো।
বলেও ফেলেছিলো, “না ইসতি ভাই..! চুমু খেলে যদি পাপ হয় !”

ইসতি রেগে গিয়ে বলেছিলো, ” চুমু খেলে পাপ হবে কেন। কে বলেছে এসব কথা। তাছাড়া একদিন তো আমরা বিয়ে করবোই। আমাদের ভালোবাসা পূত পবিত্র! ”

তবু পারুলের ভয় কাটে না। ফলাফল সাময়িক বিচ্ছেদ। ইসতি ওর সাথে বাড়তি কথা বলা বন্ধ করে দিলো। এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করার জন্যে। তবে পড়াতে বসতো, অংক টংক দেখিয়ে দিয়েই চলে যেতো। বাড়তি কোনো কথা বলতো না। পারুলও মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে এস এস সি পরীক্ষাটা দিলো।

পরীক্ষা শেষ হবার পর শুরু হলো বিরহের লম্বা সফর। ইসতি ওকে দেখলেই আড়চোখে তাকিয়ে সরে যেতো। পারিবারিক আড্ডায় সব কাজিনরা একত্রিত হলে ইসতি যেন পারুলকে দেখিয়ে দেখিয়েই অন্যান্য কাজিনদের সাথে বাড়তি খাতির দেখাতো। ফলে পারুলের কষ্ট একটা সময় রাগে রূপ নিলো। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো কখন ইফতিকে একা পাবে। কখন ওর বুকের লোমগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারবে।

একদিন একা পেয়েও গেলো। পারুলের বড় চাচার মেয়ে তৃণার বিয়ে উপলক্ষে সবাই যেবার খুলনা বেড়াতে গেলো সেদিন । উপলক্ষ ছিলো বিয়ে খাওয়া। কিন্তু সবাই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে হঠাৎ করেই সুন্দরবন বেড়াতে যাবার প্ল্যান করে বসলো। বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ যান নি সেদিন। সব কাজিনরা রওনা দিয়েছিলো। সেখানেই এক সুযোগে ইফতিকে একা পেয়ে নিজেদের সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো পারুল।

ইফতি গোঁয়ারের মতো বলেছিলো,” তুমি তো আমাকে বিশ্বাসই করো না। ভালোবাসায় বিশ্বাসটাই তো আসল ! ”

পারুল জবাব দিয়েছিলো, “তাহলে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখো। চলো, বিয়ে করি আমরা। হালাল হয়ে যাই পরস্পরের জন্য! ”

-” তারপর..? মাত্র তোমার এস এস সি, এখনি বিয়ের কথা শুনলে বড়রা মানবে? আম্মা তো হার্টফেল করবে শুনলে। তুমি তো জানো , আমি আম্মার কতখানি!”

-” তাহলে আমার অবস্থান কোথায়..? ” পারুল না বলে পারলো না।

-“উফ্, তুমি আম্মার সাথে নিজের তুলনা দিচ্ছো কেন। কি করা যায় সেটা ভাবো। বিয়ে করেও তো চোরের মতোই দেখা করতে হবে! তো বিয়ে করে লাভ কি..?”

” তা হোক তবু তো পাপ থেকে বাঁচবো। লাভ নেই কে বললো..!”

-“এতো পাপ পূণ্যের হিসাব কবে শিখলে বলো তো, যত্তসব। কাঠমোল্লা হয়ে গেছো নাকি। শোনো, নিয়্যত ঠিক থাকলে ওসব কিছু না।” ইসতির কণ্ঠের অসহিষ্ণুতা পারুলকে থামিয়ে দিলো।

সে মৃদু স্বরে বললো,” বিয়ে হলে নিজেকে বোঝাতে পারবো ইসতি। তাছাড়া আগামী দু’এক বছরে আমার এইচ এস সি হতে হতে তোমার অনার্সটা কমপ্লিট হয়ে যাবে তখন একটা চাকরী বা ব্যবসার চেষ্টা করতে পারবে। কি বলো..?”

-“ওকে, রাজী..!” ভাবতে দু’সেকেন্ড সময়ও নেয়নি সেদিন ইসতি।

পরদিনই মার্কেটে যাবার নাম করে দুজনে লুকিয়ে খুলনার এক অখ্যাত কাজী অফিসে গিয়ে সই সাবুদ করে বিয়ে করে ফেলেছিলো। সাক্ষী নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিলো কিন্তু ইসতি সেটারও বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলো, ওর নাকি কোন বন্ধু খুলনাতে থাকে। তাকে ধরে নিয়ে এসেছিলো সেদিন। আরেকজনকে কাজী অফিস থেকেই হায়ার করেছিলো। তারপর নীল কাগজে দুজনের দুটো স্বাক্ষর। পারুল আর ইসতি বাধা পড়েছিলো এক বৃত্তের আবর্তে। লোকচক্ষুর অগোচরের স্বামী আর স্ত্রী রূপে।

এরপরের ঘটনা মনে হলে পারুলের বুকের পাজরে আঘাতের চিহ্নগুলো আজও স্পষ্ট হয়ে উঠে। খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরে কয়েক দিন বাদেই শুনলো বড় চাচার মেয়ের শ্বশুড়বাড়ী থেকে তাদেরই এক দুর সম্পর্কের কোন আত্মীয়া নাকি ইসতিকে তাদের মেয়ের জন্য পছন্দ করেছেন। মেয়ের বাবা জানিয়েছেন, ছেলে নাকি তার খুবই পছন্দ। অমন শিক্ষিত আর ভদ্র। তাছাড়া ছেলেকে তারা ব্যবসা করার জন্য টাকা দিবে আর মেয়ের নামে ফ্ল্যাটও কিনে দেবে।

পারুল মেজফুপীর হাতে মেয়েটার ছবিও দেখেছিলো। অসম্ভব ফর্সা ছিলো মেয়েটি। মেজফুপীর আনন্দ যখন উপচে পড়তে শুরু করেছিলো তখন পারুল বহু চেষ্টায় একফাঁকে ইসতিকে নিভৃতে আঁকড়ে ধরেছিলো। দুচোখের লোনাজনের স্রোতের কারনে কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিলো বারবার।
ইসতি বিড়বিড় করে বলেছিলো,” এজন্যেই তো বিয়ে করতে রাজী ছিলাম না। তুমি জেদ না করলে..!” সপাটে চড় নেমে এসেছিলো ইসতির মুখের ওপর।

তারপরের ঘটনাটা ইসতির জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিলো। একটি চড় দুজনের মাঝে বিচ্ছেদের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যেন। ইসতি বিয়ে করেছিলো মাঈষা নামের সেই রাজকন্যাকে যে অর্ধেক রাজত্ব সহ ইসতির জীবনে এসেছিলো। মেজফুপীর পুত্র লালনপালন স্বার্থক রূপ লাভ করেছিলো। ইসতির বৌ এর নতুন ফ্ল্যাটে উঠে গেলেন তারা। পারুল বেঁচে রইলো জীবন্মৃতের মতো। কাউকে কিছু বলতে না পারার যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে কুঁড়ে খাচ্ছিলো ওকে। কিন্তু কোন মুখে বলবে! বলে হয়তো ইসতিকে ফাঁসাতে পারবে কিন্তু তাতে ওর বাবা মায়ের মানসম্মান ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। বলা যায়না, বাবাকে হারাতেও হতে পারে। এমনিতেই তিনি হার্টের রুগী। তাছাড়া ইসতিকে পাবার কোনো আকাঙ্খাই আর আজ ওর অবশিষ্ট নেই। ঘনিষ্ট বান্ধবী ঈষিতা পরামর্শ দিয়েছিলো, কেস করে দে ওর নামে..!”

পারুল অথর্বের মতো বলেছিলো,” তাতে লাভ..? ওকে হাঁটু পানিতে নামাতে গেলে আমাকেও তো কোমড় পানিতে নামতে হবে! আমার তো সেই সাধ্য নেই। ”

-” তাই বলে, সে অতবড় অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবে? ডিভোর্স দে অন্তত। নিজেকে কেন বেঁধে রাখছিস ঐ পুতুল খেলার বিয়েতে!”

পারুল কোনো জবাব দেয়নি। তারপর কেটে গেছে একটি বছর। ঐ সময় ইসতির সাথে কোনো যোগাযোগই হয়নি। মেজফুপী ছেলে আর বৌ নিয়ে তাদের বাড়ী বেড়াতে এলেও পারুল সযত্নে সরে থেকেছে। আর ইসতি থেকেছে চোরের মতো একটা ভাব নিয়ে। যেন সে এ বাড়ীর কিছু চুরি করে পালিয়েছিলো।

এর মাঝেই হঠাৎ একদিন শুনতে পেলো, ইসতির বৌ’ নাকি মেজফুপীর সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। ইসতির সাথেও নাকি তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। মায়ের মুখে খবরটা শুনে পারুল কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। নির্বিকারে সব শুনেছে কেবল। তার কয়েক মাস পরই একদিন শুনলো ইসতি মেয়েটিকে ডিভোর্স দিয়েছে কারন মেয়েটা নাকি মেজফুপীর গায়ে হাত তুলেছিলো। খবরটা শুনে আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারেনি পারুল। বরং একা একা অনেক কেঁদেছিলো সেদিন।

বান্ধবী ঈষিতা বলেছিলো ,” আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর ! উচিত শিক্ষা হইসে। লোভীর দল ! ”

পারুল মুখে কিছু না বললেও এক অপ্রত্যাশিত আকাঙ্খার জোয়ারে ভাসছিলো সেদিন ওর মন। মনটা বলছিলো হয়তো ইসতি এবার তার কথা তুলবে বাড়ীতে। হয়তো ওরা আবার ফিরে আসবে এ বাড়ীতে ওদের ফ্ল্যাটে। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষনই দেখা যায়নি মেজফুপীর পরিবারে।
বরং হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বজ্রপাতের মতো খবর এলো, ইসতি বিয়ে করেছে তারই এক বন্ধুর বোনকে। নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো সেদিন পারুল। কোনোভাবেই নিজেকে থামাতে পারছিলো না। বাথরুম থেকে বেরোলে দু চোখ লাল দেখে মা জানতে চেয়েছিলেন চোখ লাল কেন? ” পারুল মাথা ব্যথা বলে এড়িয়ে গেছে।

মনের গভীর গোপন আশা ভরসার যে নিভু নিভু প্রদীপটি শত ঝড় ঝাপটার মাঝেও ক্ষীণ হয়ে জ্বলছিলো সেটিও এক ফুঁয়ে নিভে গিয়েছিলো সেদিন। এতোদিন নিজেকে নিয়ে ভাবনার কোনো প্রেষনা যে মনের মধ্যে জাগে নি তা নয়। তার উপর শ্যামলা মেয়ে বলে ভালো বিয়ের প্রস্তাবও এতোদিন আসেনি। যেগুলো আসতো সেগুলোতে রাজী হবার চেয়ে একা থাকাটাকেই শ্রেয় মনে হয়েছিলো। কয়েক বছরের বিরহী মনোভাব এবার স্থায়ী রূপ নিতেই চেয়েছিলো কিন্তু আত্মীয় সমাজ আর বন্ধু পরিজনের চাপে একা থাকার শেষ ইচ্ছেটুকুও জলাঞ্জলি দিতে হলো।

মা ব্যগ্র হয়ে তার জন্য একের পর এক পাত্র যোগাড়ে ব্যস্ত হলেন। এরে তারে বলে রাখেন। তারাও এমন একেকজন পাত্র আনে যেন সাগর সেঁচে মুক্তো তুলে এনেছে। এদের সাথে দেখা দিতেও পারুলের রুচিতে বাঁধে কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা না বোঝার মতো বোকা পারুল নয়। উপরন্তু মায়ের বারবার মনে করিয়ে দেয়া যে, “সারাজীবন বাপের ঘাড় মটকাবি..” বাক্যটা পারুলকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। তবু শেষ রক্ষাটুকু আর হয়না। অবশ্য তার জন্য দায়ী পারুল নিজেই। বিয়ে ঠিকঠাক হবার এক পর্যায়ে উড়ো ফোন কলে জানিয়ে দেয় মেয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো। ব্যস্, তাতেই বিয়ে ভেঙ্গে যায়।

মা অবশ্য প্রতিবারই সকল আত্মীয় স্বজনকে শাপশাপান্ত করতে থাকেন এই বলে,” কে যে আমার মেয়ের বিয়েটা ভাঙ্গানী দেয়। যদি একবার হাতের কাছে পেতাম তো পুতা দিয়ে ওর মুখ ছেঁচে দিতাম। কত্ত বড় মিথ্যা আমার পবিত্র মেয়েটার নামে। জীবনে কোনো ছেলের সাথে হেসে কথা বললো না মেয়ে আমার আর তার কিনা এমন বদনাম। আল্লায় সইবো না, এমন শত্রুতা আল্লায় সইবো না। আল্লাহর গজব পড়বো যে এসব বদনাম দিয়া আমার মেয়েটার বিয়া ভাঙ্গায়।”

পারুল নিরবে সেসব শুনে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমাকে মাফ করে দেন দয়াময়। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। যে কথা কাউকে বলতে পারছি না সেকথা আপনাকে বলছি। আমার উপর দয়া করুন দয়াময়। আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দিন। আমাকে একা করে কবরে দিয়েন না মালিক। ”

দোয়াটা নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মাঝে মধ্যে মনের গহীনে কেউ একজন বলে উঠে, “তুই তো পাপীষ্ঠা। তাই তোর শাস্তি হচ্ছে। ”

কথাটা বিশ্বাস হতে মন চায়। আবার যখন মনে পড়ে আল্লাহ বহু তওবা কবুলকারী, তখন মনটা আশায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ নিশ্চয়ই ওর তওবা কবুল করবেন। কাঁচা বয়সের একটা ভুলে আজ অন্তর্জ্বালায় জ্বলছে সে। বারবার ক্ষমা চাইছে রবের কাছে। তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন এই আশা পারুলের আছে। তাছাড়া বিভিন্ন মহিয়সীদের জীবন কাহিনী যখন পড়ে তখন মনকে বলে, তাঁরা এতো নিষ্কলুস থেকেও কতো কষ্টই না জীবনে সয়েছেন। সে তুলনায় তুই তো মহাপাপী। গুনাহগার। তাের শাস্তি তো আরো বেশী হবার কথা। ”

আশা নিরাশার দোলাচলে চমকহীন জীবনে তৃতীয়বারের মতো চমক আসে পারুলের জীবনে। গতরাতেই খাবার সময় মা বাবাকে বলছিলেন, “ইসতিটার কপালটা দেখো। এই বউটাও টিকলো না। কেমন মেয়ে রে বাবা। কি এমন পেলি যে, আরেক ব্যটার হাত ধরে ভাগলি। মেজআপা তো ফোনে বললো, মেয়েটা নাকি বাঞ্জা, আপদ বিদেয় হয়েছে ভালোই হয়েছে। ”

বাবাকে কোনো মন্তব্য করতে শোনে নি পারুল। কিন্তু রাতে শোবার আগে মায়ের একটা কথা শুনে পারুল পাথর বনে গেছে। মা ফিসফিসিয়ে বলছিলেন, ” তোর মেজফুপীর কথাবার্তা যেন কেমন ঠেকলো আমার কাছে। মনে হলো কিছু যেন বলতে চায়। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। আমার তো সন্দেহ হয়, তোকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব না দিয়ে বসে। দিলে দিবে। অসুবিধা কি। আরে বাবা, বড়ই গাছ বাড়ীতে থাকলে লোকে দু একটা ঝাঁকি দিবেই। মেয়ের মা যখন হইছি তখন সবরকমের প্রস্তাবই সহ্য করতে হবে। আর ইসতি কি কোনো খারাপ ছেলে..!”

এ পর্যন্ত শুনেই পারুল উঠে বসেছিলো। কিছৃটা রূঢ় স্বরে বলেছে, “আমাকে ঘুমাতে দিবে মা? রাস্তার মোড়ে রোজ একটা ল্যাংড়া ফকির বসে, আমি অফিস যাবার সময় হা করে তাকিয়ে থাকে। ঐটাকেও ডেকে আনতে পারো। সমস্যা নাই। আপাতত আমাকে ঘুমাতে দাও।”

এ পর্যন্ত সবকিছু একরকম ঠিক ছিলো। রাত বারোটার পর পরই একটা ফোন এসে পারুলের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো। সেই ফোনটা ছিলো ইসতির..!

~আগামী পর্বে সমাপ্য ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here