#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(১৮)
**********************************
সবাই সাদাতে’র দিকে ফিরে তাকালো । তাবাসসুম বললেন –
তুমি কী করে চেনো ছেলেটাকে ?
স্কুলে পড়তো আমাদের সাথে । আমাদের দুই ক্লাস ওপরে ছিল, পরে ফেল করে একই ক্লাসে পড়েছে আমাদের সাথে । জারা ওকে কোথায় পেলো ?
আমি যতটুকু জানি, ছেলেটার সাথে জারা’র পরিচয় ফেসবুকে । ছেলেটা কেমন সাদাত ? ওর বাসা কোথায়, ফ্যামিলি কেমন ? ওর ফোন নাম্বার আছে তোমার কাছে ? অস্থির হয়ে একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেললেন তাবাসসুম ।
জারা’র সাথে কেমন করে এই বাটপার রফিকের পরিচয় হলো আর জারা ওর পাল্লায় পড়লো এটা ভেবে বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছে না সাদাতে’র । ছেলেটা কেমন সেই বিষয়ে এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না । সবাই এমনিতেই অনেক টেনশনে আছে তার ওপর বাড়তি টেনশন দেয়ার দরকার নেই এখন । নিজের ওপর সাদাতে’র ভীষণ রাগ হচ্ছে এই মুহূর্তে । সেদিন হাসপাতালে রফিক যখন তার মোবাইল নাম্বার চাইছিল তখন যদি নাম্বারটা দেয়া নেয়া করতো তাহলে এক্ষুনি ওকে ফোনে পাওয়া যেতো । ইশ কী আফসোস হচ্ছে যে এখন ।
তাবাসসুম বললেন –
সাদাত আদিত্যের নাম্বার নেই তোমার কাছে, বাসা কোথায় ওর ?
খালা রফিকের সাথে তো আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না, শুধু দুই বছর একই ক্লাসে পড়েছি । আমার যতটুকু মনে পড়ছে স্কুলে থাকতে ওরা শেওড়াপাড়ার দিকে থাকতো ।
এখন তো নিকুঞ্জে থাকে ।
ও আচ্ছা । স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগ বা কখনো দেখাও হয়নি । তবে কয়েকদিন আগে হাসপাতালে দেখা হয়েছিল । ওর বোনকে নিয়ে এসেছিল ।
কোথায়, কোন হাসপাতালে ? ওখানে যেয়ে ওর এড্রেস, ফোন নাম্বার বের করা যায় না ?
ও তো বোনকে নিয়ে এসেছিল আর আমি তো ওর বোনের নাম জানি না খালা । এভাবে তো কারো এড্রেস বের করা যায় না । খালার উতলা ভাব দেখে সাদাতে’র সত্যিই খুব খারাপ লাগলো ।
তোমার কোনো বন্ধুর কাছে ফোন করে দেখো না সাদাত, কারো কাছে যদি ছেলেটার কনট্রাক্ট নাম্বার থাকে, কেউ যদি ওকে চেনে ?
আমি দেখছি খালা কারো সাথে ওর যোগাযোগ আছে কি-না ।
কথাগুলো বলে সাদাত রুমের আরেক কোনায় যেয়ে ওর মোবাইলে থাকা স্কুলের বন্ধুদের নাম্বারগুলো চেক করতে থাকলো ।
তাবাসসুম স্বামীর কাছে যেয়ে বললেন –
তুমি এতো দেরি করছো কেন ? জারা’র কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন ?
আমি জহিরকে জানিয়েছি তাবাসসুম । ওর কাছে জারা’র ছবিও পাঠিয়েছি । জহির ঐ ছেলেটার একটা ছবি আর ওর সম্পর্কে যে কোনো ইনফরমেশন থাকলে জানতে চাইছিল । আমি তো কিছুই বলতে পারলাম না ।
কেন নিকুঞ্জে থাকে এটা বলনি ?
হ্যাঁ তা বলেছি কিন্তু কোনো কিছু না জেনে নিকুঞ্জে কোথায় যেয়ে খুঁজবে বলো ? এখন তো আবার সাদাত বলছে এটা না-কি তার নামই না ।
তাবাসসুমের অস্থিরতা দেখে কায়সার রোজাকে ডেকে বললেন তাঁকে রুমে নিয়ে যেতে । মেয়ের টেনশনে এমনিতেই তাঁর নিজের মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না, এখন যদি আবার তাবাসসুম অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে নতুন ঝামেলা শুরু হবে ।
কায়সার সাদাতের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন –
কোনো খোঁজ পেলে ছেলেটার ?
না খালু । যে কয়জনকে ফোন করলাম তারা কেউই রফিকের কথা বলতে পারলো না ।
আরো একটু চেষ্টা করে দেখো । কোনোভাবে যদি কারো কাছ থেকে একটা ইনফরমেশন পাওয়া যায়…….
আমি দেখছি খালু । বন্ধুদের সবাইকেই নক করছি ।
কায়সার সবাইকে নিচে রেখে ওপরে চলে এলেন । বন্ধু জহিরকে আবারো ফোন করলেন । জহির সাহেব তাঁকে জানালেন যে আশপাশের সবগুলো থানায় আর হাসপাতালে তিনি জারা’র ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন । কোথাও থেকে কোনো রকম খবর পাওয়া মাত্রই তিনি কায়সারকে জানাবেন । কায়সার থানায় আসতে চাচ্ছিলেন কিন্তু জহির সাহেব তাঁকে বাসাতেই থাকতে বললেন । শুধু শুধু থানায় এসে তো কোনো লাভ হবে না ।
কায়সার কথা শেষ করে রুমে এসে দেখলেন তাবাসসুম বিছানায় শুয়ে আছে, রোজা মা’র পাশে বসে জারাকে নিয়ে কথা বলছে । রুমে না ঢুকে জারা’র রুমে এসে ঢুকলেন কায়সার । রুমটা পরিপাটি করে গোছানো । সবকিছু আছে জায়গা মতো শুধু তাঁর মেয়েটা নেই । কোথায় গেল জারা ? তাঁরা যে ছেলেটার সাথে চলে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ করছেন তেমন তো না-ও হতে পারে । জারা’র তো অন্য কোনো বিপদও হতে পারে । জহিরই এই সম্ভাবনার কথা বলেছেন তাঁকে । এটা শোনার শোনার পর থেকে তাঁর বুকের ভেতরটা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠছে বারবার । বাচ্চাটা যেখানে আছে, তাঁর কাছে যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে । জারা কী আসলেই ঐ ছেলেটার সাথে কোথাও গেছে ? যদি যেয়েও থাকে এতক্ষনে তো তার ফিরে আসা উচিত । ছেলেটা কেমন তার কিছুই জানেন না কায়সার । ছেলেটা কী জারা’র কোনো ক্ষতি করতে পারে ? মেয়েটার ওপর একটু অভিমানও হলো কায়সারের । মেয়ের সাথে সেই ছোট্টবেলা থেকে একদম বন্ধুর মতো সম্পর্ক তাঁর । জারা সবসময় সবকিছু শেয়ার করেছে তাঁর সাথে । তাবাসসুমের চেয়ে তাঁর সাথেই বেশি সহজ ছিল জারা’র সম্পর্কটা । সেই মেয়ে যে তাঁদের আড়ালে এমন কিছু করে ফেলবে সেটা চিন্তা করেননি কায়সার । এই বয়সে প্রেম হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু জারা খুব সচেতনভাবে বারবার বিষয়টা গোপন করেছে তাঁদের কাছ থেকে ! এটা কায়সারকে খুব কষ্ট দিয়েছে । এই বয়স পর্যন্ত জারাকে তিনি কখনো ধমক দিয়ে কথা বলেননি, সবসময় সব বিষয়ে মেয়েকে বুঝিয়ে বলেছেন অথচ এখন এসে মেয়েকে তাঁর একবার বকাও দিতে হয়েছে শুধুমাত্র এই ছেলেটার কারণে ।
রুমের চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন কায়সার । বিছানায় জারা’র পুতুলগুলো সাজানো, পড়ার টেবিলে খুটিনাটি কতো কিছু যে রাখা বইয়ের পাশাপাশি, দেয়ালে তাঁর আর তাবাসসুমের সাথে শাফিন আর জারা’র হাসিমুখের ছবিটা ঝুলে আছে । নিউইয়র্কে ছবিটা তুলেছিলেন তাঁরা । যেদিকেই তাকাচ্ছেন তাতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে কায়সারের । জারা’র রুমের বারান্দাটায় যেয়ে ইজি চেয়ারটায় বসলেন তিনি । আকাশের দিকে তাকালেন, বিশাল বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে । রাত বাড়ছে ধীরে ধীরে, কায়সারের ভয়ও বাড়ছে আনুপাতিক হারে । একটু পর রাত আরো গভীর হবে । তাঁর মেয়েটা কী রাত গভীর হওয়ার আগে ফিরে আসবে না তাঁদের কাছে ?
.
.
আদিত্যর কথা শুনে জারা’র মন আবার ঘুরে যাচ্ছে । একবার তার মনে হচ্ছে সে যা করছে তা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, মা আব্বু ভীষণ কষ্ট পাবেন তার এই আচরণে কিন্তু পরক্ষনেই মনে হচ্ছে এটাই ঠিক আছে । তার পুরো অধিকার আছে নিজের মতো করে বাঁচার ।
বিন্তী আর রুদ্র যেয়ে জারা’র জন্য একটা ড্রেস কিনে এনেছে । ড্রেসটা জারা’র ভীষণ পছন্দ হলো । যদিও এতো বেশি লাল রঙ তার পরা হয়নি আগে কখনো কিন্তু এই ড্রেসটার লালের ওপর সোনালি কাজ খুব সুন্দর করে ফুটে আছে । তার যে একটু পরে বিয়ে হবে এটা নিয়ে কোনো রকম কোনো ফিলিংস কাজ করছে না জারা’র ভেতর । সে আসলে এখনো বুঝতে পারছে না তার জীবনে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষনের মধ্যে ।
সন্ধ্যার পর পরই মোটা খাতা হাতে একজন হুজুর এসে ঢুকলো তানভীরের সাথে রুদ্র আর কাফির ফ্ল্যাটে । আদিত্য যখন রুমে এসে জারাকে বললো যে কাজী সাহেব চলে এসেছেন বিয়ে পড়াতে সেই প্রথম তার কাছে মনে হলো সবকিছু ছেড়েছুড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো । এটা কী হচ্ছে তার সাথে ! কয়দিন আগে আপুর বিয়ে হলো কী বিশাল আয়োজন করে, কতো আনন্দ করেছিল তারা সবাই আর তার বিয়ে হবে এরকম অজানা, অচেনা কতোগুলো মানুষের সামনে, ফকিরের মতো ।
জারা কথাটা আদিত্যকে বলতেই সে বললো –
তুমি কেন এমন করছো জারা ? তোমারও সব হবে, সব অনুষ্ঠান, সব আনন্দ হবে তোমার বিয়েতে । আমরা কেন আজকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি, তুমি জানো না ? তাছাড়া এরা সবাই আমার বন্ধু । অপরিচিত কেউ তো নেই এখানে । ওরা নিজেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবকিছু করছে সেটা কী তুমি খেয়াল করেছো ? তোমার কী ওদের এই আনন্দটা চোখে পড়ছে না জারা ? একদম মন খারাপ করো না প্লিজ জারা । দেখো আজকের পরে সব একদম ঠিক হয়ে যাবে । বিশ্বাস রাখো আমার ওপর । এখন আর সময় নেই এসব কথা বলার । এখনই বিয়ে পড়াবেন হুজুর । ওনার আরো দুই জায়গায় যেতে হবে বিয়ে পড়াতে । ওঠো, উঠে ড্রেসটা চেঞ্জ করে নাও । আমি বাইরে আছি ।
আদি তোমার বন্ধুরা তোমাকে রফিক নামে ডাকছিল কেন ?
কথাটা শুনে একটু হকচকিয়ে গেল আদিত্য । বললো –
আরে ঐটা কিছু না । বন্ধুরা মাঝে মধ্যে দুষ্টামি ফাইজলামি করে একেকটা নাম দেয় না । এটা তেমনই একটা ।
কিন্তু রফিক কেন ?
এটা ওদের জিজ্ঞেস করে তোমাকে বলবো । এখন আর কথা বলো না । দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ।
আদিত্য বেরিয়ে গেলে জারা ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিলো । তার কিছুক্ষন পর বিন্তী এসে তাকে নিয়ে গেল লিভিংরুমে ।
সবাই সোফায় বসে আছে । জারা ধীর পায়ে হেঁটে যেয়ে আদিত্যের পাশে বসলো । আকাশী রঙের খাতাটায় ততক্ষনে সবকিছু লেখা হয়ে গেছে । হুজুর কথা বলতে শুরু করলেন । কথাগুলো জারা’র কান দিয়ে ঢুকছে কিন্তু মাথা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না । তার কেবলই মনে হচ্ছে সে এমন একটা জগতে আছে যেখানে সে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অন্য কারো দ্বারা । তার নিজের হাতে কিছু নেই, কিচ্ছু না । দুপুর পর্যন্ত তো সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু বিকেলের পর থেকেই সব কেমন ঝাপসা আর দূরের মনে হচ্ছে । একটা বিষয় নিয়ে ভাবছে কিন্তু ভাবনাটা বেশিদূর এগোতে পারছে না । অন্য একটা ভাবনা এসে আগের ভাবনাটাকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে ।
কাজী সাহেব একের পর এক নাম বলে যাচ্ছেন । জারা তার নামটা শুনলো সাথে আব্বুর নামটাও । বাকি নামগুলো অচেনা লাগছে । আদিত্যের নামের সাথে কী একটা নাম বললেন, জারা ঠিক বুঝতে পারলো না । তাকে যা বলতে বলা হলো সে মুখস্থ বলার মতো করে কবুল, আলহামদুলিল্লাহ বলে কাগজে সাইন করে দিলো । সেখানে কী লেখা আছে তা পড়ে দেখার প্রয়োজন বা ধৈর্য কোনোটাই নেই তার ।
টাকা-পয়সা নিয়ে কাজী বিদায় নিলে সবাই জারা-আদিত্যের বিয়ে সেলিব্রেশন শুরু করলো । কাফি প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছে । বেশ কিছুক্ষন জমিয়ে আড্ডা দেয়ার পর সবাই ডাইনিং টেবিলে যেয়ে বসলো । জারা’র কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না । তার খুব বেশি ঘুম পাচ্ছে । একটু ঘুমাতে পারলে খুব ভালো লাগতো কিন্তু এভাবে সবার সামনে থেকে চলে গেলে সেটা খুব খারাপ দেখায় তাই তার কষ্ট হলেও বসে থাকলো ।
বিন্তী আর কাফি মিলে খাবার সার্ভ করছে । আদি এসে জারা’র পাশের চেয়ারটায় বসে বললো –
মনটা এতো খারাপ করে আছো কেন ?
জারা কোনো কথা না বলে সেভাবেই বসে থাকলো ।
কী হলো ? বলেই আদি জারা’র হাতটা ধরে চমকে উঠে বললো –
হায় হায় তোমার শরীর এতো গরম কেন? কী হলো, জ্বর আসলো না-কি ? একটু আগেও তো ভালো ছিলে । আচ্ছা কখন জ্বরটা আসলো বলো তো ? আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না ।
বিকেলের দিকে এসেছে বোধহয় । তখন থেকেই খারাপ লাগছে ।
জ্বর তো মনে হচ্ছে অনেক । এই কাফি থার্মোমিটার আছে তোদের ?
কাফি বললো –
থার্মোমিটার দিয়ে কী করবি ? এখন তো থার্মোমিটারের কাজ না ।
থাকলে নিয়ে আয় । জারা’র শরীরটা খুব গরম হয়ে আছে ।
বাসায় থার্মোমিটার ছিল না, কাফি যেয়ে থার্মোমিটার আর জ্বরের ওষুধ নিয়ে এলো ।
জ্বর মাপার পর দেখা গেল ১০৫° দেখাচ্ছে থার্মোমিটারে । তানভীর বললো –
এখনই ওষুধ খেতে হবে ।
আদি বললো –
ও তো সেই দুপুরের পরে আর কিছু খায়নি । খালি পেটে ওষুধ খেলে কাজ হবে? জারা’র হাতটা ধরে বললো –
কোনটা খাবে বলো । আমি খাইয়ে দিচ্ছি ।
জারা একবার তাকিয়ে টেবিল ভরা খারবারগুলো দেখলো । সেগুলো দেখেই তার আরো বেশি অস্থির লাগলো । মনে হলো যে কোনোটা মুখে দিলেই বমি হয়ে যাবে । সে আদিকে বললো –
আমি একটু ঘুমাবো, আর থাকতে পারছি না ।
ওষুধ তো খেতেই হবে নইলে এতো জ্বর তো কমবে না । কিছু একটা খাও । একবার মুখে দাও তারপর ওষুধ খেয়ে নাও ।
প্লিজ আমাকে জোর কোরো না । আমি আর বসে থাকতে পারছি না ।
বহু চেষ্টায় জারাকে এক টুকরো রুটি খাওয়ানো গেল । এরপর ওষুধ খেয়ে জারা যেয়ে শুয়ে পড়লো কাফি’র বেডরুমে ।
কাফি বড় বাটিতে করে ঠান্ডা পানি এনে রাখলো জারা’র মাথার সামনে । আদিত্য রুমাল ভিজিয়ে জারা’র কপালে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে । হঠাৎ কেন এমন মাথা খারাপ জ্বর আসলো জারা’র আদি কিছুই বুঝতে পারছে না । জারাকে জিজ্ঞেস করলো –
এখন কী একটু ভালো লাগছে জারা ?
দু’বার জিজ্ঞেস করার পরেও জারা যখন উত্তর দিলো না আদি বুঝলো জারা ঘুমিয়ে গেছে । সে আরো কিছুক্ষণ রুমাল ভিজিয়ে জারা’র কপালে দিলো ।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে কাফি গেছে বিন্তীকে পৌঁছে দিতে । রুদ্র সবকিছু গোছগাছ করছে । তানভীর বারান্দায় বসে কথা বলছিল ফোনে । কথা শেষ করে ফিরে দেখলো রফিক সোফায় বসে আছে । তানভীর বললো –
জারা’র জ্বর কমলো ?
হুম একটু কমেছে মনে হয়, ঘুমিয়ে গেছে ।
ওখানে বসে আছিস কেন, এখানে আয় ।
রফিক বারান্দায় এসে তানভীরের পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো ।
তানভীর বললো –
এবার বল তোর কেমন লাগছে ?
কেমন আর……
সেটাই তো জানতে চাইছি । এই যে এমন হুট করে কাজটা করে ফেললি, মেয়েটার বাসায় কী হচ্ছে কে জানে । তোর বাসায় জানিয়েছিস ? আচ্ছা একটা কথা বল তো তোর এই আদি নামটা কোত্থেকে আমদানি হলো ? জারাকে দেখলাম সারাক্ষণ আদি আদি করছে আবার কাজী সাহেবও তোর নামের সাথে আদি লাগালো । ব্যাপারটা কী রে ? এটা কী জারা’র দেয়া ভালোবাসার নাম ?
রফিক কথা ঘুরিয়ে বললো –
বাসায় জানাইনি । আব্বা এমনিতেই সারাদিন দূর দূর করতে থাকে আমাকে, বিয়ের কথা বললে আমার খবর আছে ।
তাহলে এখন কী করবি ?
ভেবে দেখিনি এখনো ।
এখানে না-হয় দু-একদিন থাকতে পারবি বড়জোর এক সপ্তাহ কিন্তু তারপর ?
থাকার টেনশন করছি না রে । আমি ভাবছি অন্য একটা বিষয় নিয়ে ।
কী বিষয় ? টাকা পয়াসা লাগবে তোর ?
না তা-ও না ।
বলবি তো কী বিষয় ?
আমি আসলে জারা’র কাছ থেকে কিছু বিষয় হাইড করেছি ।
জারা’র কাছ থেকে ! কোন বিষয় ?
আমি আমার পরিচয়টা লুকিয়েছি জারা’র কাছ থেকে ।
পরিচয় আবার লুকায় কেমন করে ? কী বলেছিস তুই জারাকে ?
আমি যে এই আমি, জারা সেটা জানে না । জারা জানে আমি অন্য কেউ ।
মানে কী দোস্ত ! সব তো আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে । ঠিকমতো বলবি সমস্যাটা কোথায় বাধিয়েছিস ?
জারা’র কাছে আমি আমার ফ্যামিলির পরিচয়টা গোপন করেছি দোস্ত । জারা জানে আমার বাবা’র বড় ব্যবসা আছে । বড় আপা ইউএস থাকে ফ্যামিলি নিয়ে । আমার রফিক নামটা জারা জানেই না । ও শুধু আদিত্যকে চেনে ।
মানে কী ! মিথ্যে বলেছিস কেন মেয়েটাকে ? ও কী এই মিথ্যেকে সত্যি জেনেই এতোদিন রিলেশন চালালো, তোকে বিয়ে করলো ? এইটা তুই কী করলি রফিক ?
করে ফেলেছি দোস্ত । জারাকে আমি সত্যিই অনেক ভালোবাসি । নিজের অবস্থানটা বলে জারাকে আমি হারাতে চাইনি ।
তোর কী ধারণা মেয়েটার কাছ থেকে তুই খুব বেশি দিন এসব লুকিয়ে রাখতে পারবি ? ও যখন জানতে পারবে, আমি সিওর ও তোকে লাত্থি দিয়ে চলে যাবে । তুই এইটা কী করলি ? এখন তো তোর সাথে আমরাও ফেঁসে যাবো যদি কোনো কিছু হয় ।
কী হবে ? খামোখা কেন যে এতো ভয় পাচ্ছিস তুই ? দু’একটা দিন যাক তারপর আমি জারাকে সব বুঝিয়ে বলবো ।
খুব খারাপ একটা কাজ করেছিস । আমি যদি জানতাম তাহলে কিছুতেই এই বিয়েটা হতে দিতাম না । তুই তো ফাঁসবি আমি নিশ্চিত, আমরাও ফেঁসে যাবো । কাবিননামায় আমাদের সবার সাইন আছে তো । ইশ কী যে হবে, কী যে বিপদে পড়বো আল্লাহ ই জানেন । আচ্ছা আচ্ছা তাই তো বলি জারা তোকে সারাক্ষণ আদি আদি করছিল কেন ! আমরা আরো সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম আদি নামটা শুনে । রুদ্র আমাদের তখন বলেছিল যে তুই নিশ্চয়ই নিজের ভাব বাড়ানোর জন্য রফিক নামটা লুকিয়েছিস জারা’র কাছ থেকে । আমরাও তাই তোর নাম ধরে তখন ডাকিনি । এখন তো দেখি নাম না, পুরো প্রোফাইলই পাল্টে ফেলেছিস তুই ।
ধুর ব্যাটা , তোর কাছে বললাম নিজেকে একটু হালকা করার জন্য । কোথায় বুদ্ধি দিবি, তা না করে উল্টো ভয় দেখিয়ে দিচ্ছিস ।
বড়লোকের মেয়ে পটিয়ে বিয়ে করেছিস । এইসব লোকজনের অনেক দূর পর্যন্ত ওঠাবসা থাকে । জারা যখন তার বাপ-মা’র কাছে গিয়ে বলবে, তুই কী মনে করেছিস তারা চুপচাপ বসে থাকবে ? বাংলাদেশে এখন মেয়েদের সুরক্ষার জন্য অনেক কড়া আইন হয়েছে । যে কোনো একটায় একবার ঢুকিয়ে দিলে তোর হাড্ডি ঝরঝরা হয়ে যাবে । তুই জাহান্নামে যা, তোকে নিয়ে আমার চিন্তা নাই । তোর নাম আসলেই তার সাথে আমাদের নাম আসবেই আসবে । তুই এই কাজটা কেন করলি রফিক ?
এখন এটা চেপে যা দোস্ত । আজকে কাউকে বলিস না কথাটা , প্লিজ তানভীর ।
.
.
বড় খালা রয়ে গেছেন জাফরিনকে নিয়ে । সাদাতও বাসায় যায়নি । পুরো বাড়ির পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে । ছোট খালা তো রাতের খাবারও খেলেন না । বাকি সবাই কোনোমতে খেয়েছে । খালুকে দেখে সাদাতে’র খুব মায়া হলো । এখানে আসার পর থেকে সে মানুষটাকে একটিবারের জন্যও বসতে দেখেনি । সারাক্ষণ শুধু পায়চারী করেছেন আর ফোনে কথা বলেছেন । খাওয়ার সময় দুই মিনিট বসে এক গ্লাস দুধ খেয়েই আবার পায়চারী শুরু করেছেন ।
সাদাত একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে যতো বন্ধুর সাথে যোগাযোগ আছে তাদের সবাইকে । তাদের কেউই রফিকের খবর জানে না । এর মধ্যে কয়েকবার রফিকুল ইসলাম লিখে আইডি সার্চ দিয়েছে কিন্তু ঐ নামের যতোগুলো আইডি পেয়েছে তার কোনোটার প্রোফাইল পিকচারে রফিকের ছবি নেই । কন্ট্রাক্ট লিস্টে যেয়ে সবগুলো নাম আবার চেক করলো সাদাত । কেউ যদি বাদ পড়ে থাকে । হঠাৎ খেয়াল হলো নাফিজকে ফোন দেয়া হয়নি । নাফিজের সাথে রফিকের খুব খাতির ছিল । সাদাত ঘড়ি দেখলো, বেশ রাত হয়েছে , তবুও প্রয়োজনে সে বন্ধুকে ফোন করতেই পারে । নাফিজকে কল করলো সে । নাফিজ ফোন ধরে বললো –
কী রে দোস্ত তোর কী এতো রাতে আমার কথা মনে পড়লো ? কেমন আছিস ?
ভালো আছি রে ৷ সরি নাফিজ এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য । একটা দরকারে ফোন করলাম ।
কী দরকার বল ।
আচ্ছা তোর কাছে কী রফিকের মোবাইল নাম্বার আছে ?
কোন রফিক রে, খেলোয়াড় ছিল যে ফেল্টুস রফিক ?
হুম সেই রফিক । ওর কোনো নাম্বার আছে তোর কাছে ?
আছে তো । গত মাসেও কথা হলো ওর সাথে । ওর সাথে কী দরকার বল তো ? ঐ ব্যাটা তো আর মানুষ হলো না । আমাকে কতো কাহিনি শুনিয়ে দশ হাজার টাকা নিয়েছে সাত দিনের কথা বলে অথচ তিন মাসের বেশি হয়ে গেল । এখন আর আমার ফোন ধরে না । তুইও কী টাকা পাস না-কি ওর কাছে ?
আরে না না , অন্য একটা ব্যাপারে দরকার ছিল । নাফিজ তুই ওর নাম্বারটা আমাকে এখনই সেন্ড করে দে প্লিজ । খুব দরকার ।……………………………