হৃদয়ের সম্পর্ক পর্ব ১৯

#হৃদয়ের_সম্পর্ক (পর্ব ১৯)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
— সত্যি পাপায় ? আমাকে আপুনি এনে দিবা ?
— হ্যা বাবা। চলো আমরা এখন গোল্ড ফিস কিনে আনবো।
আর আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললো,
— এতো নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। তোমার সাথে হিসাব এখনো বাকি আছে।
.
তারপর ও আয়াতকে নিয়ে চলে গেল। আর আমি ভাবছি এতোকিছুর পরও আবার কিসের হিসাব কিতাব ?
মা আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে তার রুমে নিয়ে গেল। আমাকে উনার বিছানায় বসিয়ে আমার চোখের পানি গুলো মুছে নিলো আঁচলে। আমার দুই হাত তার হাতে নিয়ে চুমু খেলো। আর বলতে লাগলো,
— জানো মা, তোমার চিন্তা ভাবনায় আমার রাগ হচ্ছে তবে কোথায় জানি খুব শান্তিও লাগছে। তুমি কি জানো যে তুমি একজন সার্থক মা। আয়াতকে নিজের সব টা দিয়ে ভালোবাসো। এটা আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে। যদিও এ প্রমাণের কোনো দরকার ছিলো না।
— কিন্তু আরিয়ান এর শাস্তি দিচ্ছে আমাকে।(অভিযোগ করলাম)
— মা আমার পাগল ছেলেটা যে তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। তোমাকে ছাড়া এক দন্ডও থাকতে পারে না। দেখোনা তুমি যখন তোমার আম্মুর কাছে যাও, তোমাকে একটা রাতও ওখানে থাকতে দেয় না। সাথে করে নিয়ে চলে আসে। (মায়া ভরা কন্ঠে)
— আসলেই পাগল। (মুখ ভাঙ্গিয়ে)
— ও হয়তো এটা ভেবে রেগে আছে যে তুমি ওকে ভালোবাসো না তাই ওর সন্তানকে এর্বোট করতে চেয়েছো।
— এমন টা না মা।
— আমি বুঝি তোমাকে। তবে, আজ আমি মা হয়ে তোমার কাছে চাইছি, আমার ছেলেটাকে একটু সামলে নেও। ও যে তোমার কাছে শান্তি খুঁজে পায়। ওকে একটু শান্তি দাও। আজ যদি আয়াত তোমার কাছে কিছু চাই, তুমি কি পারবে ওকে তা না দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে। তাও যদি এমন রাগী আর জেদি হয়।
— ……….( নিশ্চুপ, ভাবছি আসলেই মা হয়ে সন্তানের কষ্ট দেখা খুবই কঠিন। আয়াতের জন্য আমি পৃথিবীর সব সুখ আমার জীবনের মূল্যে কিনতে রাজী)
— আমি একজন মা হয়ে তোমার কাছে মিনতি করছি, আমার ছেলেটা কে আর কষ্ট দিও না। ও সহ্য করতে পারবে না।
— মা আমি আপনার ছেলেকে কষ্ট দিতে চাইনি। আর ওকে ঘৃনাও করি না। ও তো নিজের দাপটে আমার বুকে জায়গা করে নিয়েছে। একদম গেঁড়ে বসে আছে আমার বুকটায়। আমাকে না বুঝেই শুধু বকে।(চোখটা আবারও ভরে উঠলো)
— তাই ? তোমাকে না বুঝেই শুধু বকে ? কিন্তু তুমি কি একবারও ওকে বুঝতে দিয়েছো যে তোমার বুকটায় ওর বসবাস ?
— জ্বী ? (অবাক হয়ে)
— আমার পাগল ছেলেটা তোমাকে বুঝে না। কারণ তুমি ওকে কখনো নিজেকে বুঝতে দাওনি। তুমি কি ওকে একবারও বলেছো যে তোমার ভালোলাগে ওকে, ভালোবাসার প্রথম ধাপে তুমি পদার্পন করেছো এটা কি জানিয়েছো ? (শান্ত কন্ঠে)
— …… (নিশ্চুপ। মনে মনে ভাবছি, আসলেই তো ওর কাছে এ অন্যরকম অনুভূতির কথা কখনও প্রকাশই করিনি। হয়তো সে এই অনুভূতির কথা জানতেই এতো উতলা, এতো তড়পাচ্ছে। আমি তো শুধু ওকে অধিকারের অনুমতি দিয়েছি।)
.
তারপর মা আমার মুখটা উঁচু করে ধরে কপালে একটা চুমু দিলেন। এবং বললেন,
— মনের আবেগ মিশিয়ে তোমার হৃদয়ের অনুভূতি আমার ছেলের কাছে প্রকাশ করো মা। দেখবে তোমার করা এই অন্যায়টা ভুলে যাবে আরিয়ান।
অতঃপর সে চলে গেলো। আর আমি ভাবতে লাগলাম, এইভাবে তো আমার কোনো কাছের বন্ধুও আমাকে বুঝাতে পারতো না।
.
দুপুরে আমাকে কিছু রুলস্ করে দিয়ে গেল কড়া গলায় আরিয়ান। আর বলে গেলো রাতে আমার বিচার সভা হবে। রুলস্ গুলো কিছুটা এরকম,
১. সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা যাবে না।
২. আয়াতকে কোলে নেওয়া যাবে না। এমন কি বসেও না। তবে কোলের কাছে নিয়ে শুয়ে থাকা বা ওকে ঘুম পারানো যাবে।
৩. আইসক্রিম বা ক্লোড ড্রিংস খাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ঠান্ডা কিছুই খাওয়া যাবে না।
৪. আয়াতের সাথে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করা যাবে না।
৫. ওস্তাদী করে রান্নাবান্না বা ভারী কাজ করা যাবে না।
৭. ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।
.
এরকম কিছু রুলস সে বলে গেলো। তবে এর মাঝে আয়াতকে নিয়ে যে গুলো বলা হয়েছে তা মানতে আমি নারাজ। তবে আপাতত চুপ থাকলাম। ওকে আর রাগাতে ভালো লাগছে না।
.
আজ রাতে আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। রুমের লাগোয়া বারান্দাটা চাঁদের আলোতে ভিজে সেঁতসেঁতে হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম এই চাঁদের আলো গায়ে মেখে, আরিয়ানের কাছে আমি কামিনী ফুল হয়ে ফুটবো। ওর সব রাগ ভাঙ্গাবো। ওকে জানাবো আজ আমার মনের চঞ্চল অনুভূতি। কেন সে আমার হৃদয়ে এ অনুভূতির জাগরণ ঘটিয়েছে, তার হিসাবও চাইবো।
.
আরিয়ান ফোন করে জানিয়েছে আজ রাতে তার আসতে দেরি হবে। আয়াতকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। তারপর গোসল করে নিলাম। এখন নিজেকে বেশ সতেজ লাগছে। তবে গালের থাপ্পড়ের দাগটা কেমন জানি দগদগে হয়ে উঠেছে। হালকা গোলাপি রঙের একঢালা একটা জর্জেট শাড়ি পরলাম। সাথে কালো রঙের হাফহাতা ব্লাউজ। হাতাটা একটু বেশিই ছোট, আর ব্লাউজের গলাটা একটু বেশিই বড়। তবে আজ আমি আর আমার পিঠ ঢাকতে আঁচল তুললাম না। ভেজা চুল গুলো হাতের আঙ্গুল দিয়েই আঁচরিয়ে নিলাম। চোখের পাতাই কাজল আর কপালে ছোট একটা কালো টিপ পরলাম। ঠোঁটের কি ব্যাবস্থা করবো এটা ভেবে আয়নায় ঠোঁটটা দেখেই হেসে দিলাম। আমার ভেজা ভেজা ঠোঁটটা এমনিতেই আবেদনময়ী লাগছে।
.
সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছি। আরিয়ান বাড়িতে আসলো প্রায় রাত ১২ টায়। ও রুমে ঢুকতেই আমি দাড়িয়ে পরলাম। আমাকে দেখেই ওর পা থেমে গেলো। কিছুক্ষন অপলক আমাকে দেখে চোখ বন্ধ করে মাথাটা নিচু করে ফেললো। এদিকে আমাকে দেখে ওর এমন রিএক্টে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। ওর রাগ ভাঙ্গানো দূরে থাক, আমি তো ওর সামনে কথায় বলতে পারবো না। তবুও নিজেকে শক্ত করে ওর কাছে গেলাম, ওর মাথার টুপি আর রিভলবার টা নিয়ে ওকে বললাম,
— আপনি ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে আসুন, আমি আপনার খাবার গরম করছি।
— আজ আমি বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছি। (কথাটা বলার সময় একটা ঢোক গিললো)
— ওহ। ফ্রেশ তো হয়ে আসুন।
— হুম।
.
চলে গিয়েও আবার ফিরে আসলো। আর আমাকে বললো,
— তুমি যদি মনে করে থাকো, তোমার রূপ দিয়ে আমাকে দূর্বল করে নিজের অন্যায়টা আমার মন থেকে ভুলিয়ে দিবে তাহলে তুমি ভুলের শহরে বাস করছো।
তারপর গটগট করে চলে গেলো।
.
উফফ্। ওর এই রাগের আমি কি করবো ? তারপর আরিয়ান ফ্রেশ হয়ে আসলে আমি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম বারান্দায়। আজ ওকে বলতে চাই যে, আমার মনে সে ধীরে ধীরে তার প্রেমের একটা গর্ত খুঁড়েছে। এখন আমি চাই, তাকে আমার মনের মধ্যে পুরে, সেই প্রেমের গর্তে কবর দিতে। তারপর বললাম,
— আমার কিছু বলার আছে।
— হুম বলো। (কথাটা বলে আমার শাড়ির নিচে হাত দিয়ে কোমর ধরে কাছে টেনে নিলো)
— আপনি আমাকে কেন ভুল বুঝছেন ? (কাঁপতে কাঁপতে বললাম)
— তাহলে সঠিক টা বুঝিয়ে দাও। (এটা বলে আমার ঘারে মুখ গুজলো)
— আমি আপনার সন্তানকে ইচ্ছা করে এর্বোট করতে চাইনি।
— তুমি কি জানো, আমি তোমার থেকেও তোমাকে বেশি চিনি। আমি তোমাকে ভুল বুঝছি না পাখি। শুধু কষ্ট লাগছে যে তুমি একবারও আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না ?
— কেননা আমি জানতাম, আপনি কখনো আমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবেন না।
— কিভাবে সমর্থন করতাম বলো ? আমার ভালোবাসার চিহ্নকে মিটিয়ে দিতে ?
.
এটা বলেই আমার গলায় জোরে করে একটা কামড় দিলো। আমি ব্যাথা পেলাম। কিন্তু এই ব্যাথায় সুখ সুখ নামের একটা যন্ত্রণাও মিশে আছে। এতোটায় সুখ যে আমার চোখের কাজল মুছে যেতে লাগলো আমার চোখের পানিতে।
.
আমি কান্না জড়িত কন্ঠে বললাম,
— আমি আর কখনো এমন করবো না। কথা দিচ্ছি। আপনি আমাকে ভুল বুঝে নাই তো !
— না। (গলায় ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে)
— আমার উপর রাগ করে নাই তো আপনি ?
— না। (আরও একটা ছোট্ট কামড় দিলো গলায় আর আমার কমড়টা খাঁমচে ধরলো)
— কোনো রকম অভিমান করে নাই তো ?
— না। ( আবারও একটা কামড় দিলো)
— আমি আপনার রাগ, অভিমান সহ্য করতে পারবো না। এটা খুব কষ্টকর।
— কেন ? (আবারও একটা কামড় দিলো)
— কারন আমরা কখনোও কাছের মানুষের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে পারি না। (আহ্লাদী সুরে)
— আমি তোমার কাছের মানুষ ? (বিদ্যুৎ গতিতে আমার গলা থেকে তার মুখ তুলে নিলো, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো উত্তরের)
— হ্যা। আপনি আমার মনের খুব কাছের।
— কতটা কাছের ?
— আমার চোখ থেকে স্বপ্ন যতটা কাছের ঠিক ততটা।
.
কথাটা শুনে আমাকে নিজের বুকের মধ্যে ভরে নিলো। কিছুক্ষণ আমাকে ওর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন গুনতে দিলো। আর বললো তোমাকে কাঁদলে এতো মায়াবী লাগে কেন বলো তো ? তারপর আমার চুলের মাঝে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আমার ঠোঁটটা ওর মুখের সামনে ধরলো। অতঃপর আমার ঠোঁটের নদীতে ডুব দিলো।
.
আমার জীবনের ভালোবাসার মধুর রাতের মধ্যে, এ রাতটাও নিজের জায়গা করে নিলো। সকালে আয়নার সামনে যেতেই দেখলাম আমার পুরো ঘার, গলা, বুক লাল লাল দাগ হয়ে আছে। আমি আমাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। সাথে সাথে সব ভালোবাসা রাগে পরিনত হলো…….
·
·
·
চলবে……………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here