ছন্দ ছাড়া বৃষ্টি পর্ব ১

প্রথম দিন শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেই চমকে গেলাম আমি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমারই চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক। আমি থমকে দাঁড়ালাম। তন্ময় আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলো আমার সামনে থেকে। ওর ভালোবাসার স্মৃতি নিয়েই এতো বছর ছিলাম আমি। কিন্তু ইদানিং আব্বু খুব বেশি অসুস্থ হওয়ায় উনার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে উনাকে একটু শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এ আমি কী দেখলাম? তন্ময় এখানে কেন? বিড়বিড় করলাম।

পিছন থেকে তিহান অর্থাৎ আমার স্বামী আমায় ডাক দিলেন। আমি পিছু ঘুরতেই উনি ইশারায় কিছু একটা দেখালেন। কিন্তু সেদিকে আমার দৃষ্টিগোচর হলো না। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি বসে পড়লাম পাশে থাকা আলিশান সোফায়। এভাবে হঠাৎ করে বসে পড়াতে আমার শ্বশুরসহ বাড়ির সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। শাশুড়ি মা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বউমা, তোমার শরীরটা কি খারাপ লাগছে?’

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। আমাকে তাড়াতাড়ি তিহানের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। বিশাল এক রুম। চারপাশে বইয়ের শেলফ। লোকটা নিশ্চয়ই বই খাদক! আমার ননদ তিন্নি আমায় বেডের উপর বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এমন সময় তন্ময়ের উপস্থিতি টের পাই আমি। আমি বেড থেকে নেমে এসে দরজার সামনে উঁকি দেই। না তন্ময় নেই। তাহলে আমার কেন মনে হলো তন্ময় এখানেই আছে?

তন্ময়কে দেখতে না পেয়ে আবার চুপচাপ বেডের দিকে পা বাড়ালাম। দরজার আড়াল থেকে হুট করে কেউ একজন আমায় হ্যাঁচকা টানে তার দিকে টেনে নিলো। আমি আকস্মিক এমন ঘটনায় ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

মিনিট দু’য়েক পরে চোখ খুলে আরো বেশি চমকালাম। আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। মেরুদন্ড দিয়ে কোনো শীতল কিছু বয়ে গেলো। কাঁপা গলায় বললাম,

‘তু-তু-তুই?’

তন্ময় বাঁকা হেসে বললো,
‘বিয়ে করে দিব্যি শ্বশুর বাড়ি চলে এলি? আমার কথা একবারও ভাবলি না মৃদু? আমার প্রতি তোর ভালোবাসাটা কি এতোটাই ঠুনকো ছিলো?’

আমি অনেক কষ্টে আমার কান্নাটা আটকালাম। সেগুলো গলায় দলা পাকিয়ে রইলো। কড়া গলায় বললাম,
‘সিরিয়াসলি তন্ময়? আমার ভালোবাসা ঠুনকো ছিলো? আর তোর ভালোবাসা বুঝি খুব মজবুত ছিলো? তাহলে চার বছর আগে আমাকে একা ফেলে রেখে ওভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিলি কেন? তারপর থেকে একবারের জন্যও তো আমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করিসনি। উলটো আমি যাতে তোর কোনো খোঁজ না নিতে পারি, সেই ব্যবস্থাই করে গিয়েছিলি। আর এখন এসেছিস আমার ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করতে?’

‘তুই আমায় ভুল বুঝছিস মৃদু। আমি তোকে ছেড়ে পালিয়ে যাইনি।’
শীতল কন্ঠে তন্ময় বললো।

‘ওহ আচ্ছা, তুই ছেড়ে যাসনি? তাহলে এতোগুলো বছর কোথায় ছিলি তুই?’

‘সে অনেক কথা। আমি তোকে সব বলবো।’

‘বল্, আমি শুনছি। দেখি কী কী এক্সকিউজ সাজিয়ে এনেছিস তুই।’

‘মৃদু, আমি তোকে এক্সকিউজ কেন দিবো ইয়ার? আমি তোকে ভালোবাসি মৃদু। সত্যিই অনেক ভালোবাসি।’

‘নাটক করিস না তন্ময়। তুই আমার শ্বশুর বাড়িতে কেন এসেছিস সেটা বল্? গত চার বছর আমার জীবনটা তুই শেষ করে দিয়েছিস। এখন আমার শ্বশুর বাড়িতেও চলে এসেছিস আমার জীবন ধ্বংস করতে?’

কিছুটা চেঁচিয়েই বললাম কথাটা। হয়তো আশেপাশের মানুষজনও শুনতে পেয়েছে আমার কন্ঠ। এক্ষুণি হয়তো সবাই ছুটে আসবে এটা জিজ্ঞেস করতে, নতুন বউ কেন এভাবে চেঁচাচ্ছে? কিন্তু না; এমন কিছুই হলো না। তন্ময় আমার কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে আছে। চোখে পানি টলমল করছে ওর।

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
‘চার বছর আগে আমাকে না বলে উধাও হয়ে গিয়ে নিজেকে কাপুরুষ প্রমাণ করেছিস। আজ আবার এভাবে কেঁদেও সেইম জিনিসটা প্রমাণ করছিস। তুই কাপুরুষ আমি জানি। এখন আমার প্রশ্নের জবাব দে।’

তন্ময় খপ করে আমার হাত ধরে ফেললো। আমি ওর হাত থেকে এক ঝটকায় আমার হাত ছাড়িয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলাম ওর গালে। তন্ময় আমার এমন রূপে অভ্যস্ত নয়। তাই অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। আমি চড় মেরেও ক্ষান্ত হয়নি। উঁচু গলায় বললাম,
‘তোর সাহস কী করে হয় আমাকে স্পর্শ করার? আমি এখন বিবাহিত তন্ময়, ভুলে যাস না এটা। আর তুই আমার শ্বশুর বাড়িতেই দাঁড়িয়ে আছিস।’

তন্ময় এবার মুখ খুললো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
‘হ্যাঁ, জানি আমি এটা তোর শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু সেই সাথে এটা আমারও বাড়ি।’

তন্ময়ের কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। ওর থেকে দু’কদম পিছিয়ে গেলাম। অবাক কন্ঠে বললাম,
‘কীহ্!’

‘হ্যাঁ তোর স্বামীর একমাত্র ছোটো ভাই আমি।’

ওর কথাগুলো শুনে আমি নতুন করে আবারও অবাক হচ্ছি। কী বলছে ও? ও তিহানের ছোটো ভাই? তাহলে ওকে বিয়েতে দেখলাম না কেন?

‘এখন আবার নতুন করে কথা বানাচ্ছিস তুই, তাই না? তিহানের ভাই তুই? তাহলে এতোদিনে তোকে একবারও দেখলাম না কেন?’

তন্ময় হাসলো। বললো,
‘দেখবি কী করে? তোর স্বামীই তো আমাকে চার বছর আগে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তোর দিকে ওর নজর ছিলো। তাই আমাকে তোর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।’

‘তন্ময় মুখ সামলে কথা বল্। তুই উনার নামে যে অভিযোগ গুলো আনছিস, এগুলোর প্রমাণ আছে তোর কাছে?’ রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।

‘মৃদু, আমার কথা গুলো সত্যি প্রমাণ করার জন্য তোকে প্রমাণও দেখাতে হবে? এতোটা অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে গেছি আমি তোর কাছে?’

‘তোকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ আর নেই এখন। আর তুই আমার স্বামীর নামে অভিযোগ তুলেছিস; তোকে প্রমাণ করতেই হবে এগুলো সব সত্যি। না হলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’

‘ঠিক আছে দেবো প্রমাণ। তবে এরপর আমি যা বলবো, তোকে তাই শুনতে হবে। কাল সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই তুই ছাদে আসবি। আমি ওখানেই তোর জন্য প্রমাণ নিয়ে অপেক্ষায় থাকবো।’

তন্ময়ের কথাগুলো শুনে আমার আপাদমস্তক জ্বলে উঠলো। ও এতো আত্মবিশ্বাসের সহিত কীভাবে বলছে প্রমাণ দিবে? তাহলে সত্যিই কি তিহান অপরাধী? আর তিহানের জন্যই আমি তন্ময়কে, আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছিলাম? কথাগুলো ভাবতেই আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। দরজার বাইরে থেকে কারো একটা পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এদিকে আসছে বলেই মনে হচ্ছে। তন্ময় তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে আবারও বলে গেলো,
‘মৃদু আমি তোকে এখনো খুব বেশি ভালোবাসি৷’

এবার যেনো ওর মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে আমার হৃদয় কেঁপে উঠলো। তাহলে কি সত্যিই তন্ময় ঠিক আর তিহান বেঠিক?

__________
চোখের পানি মুছে দরজার দিকে তাকালাম। তিহান এসেছে। উনি দরজা লক করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু একটু আগে তিহানের নামে যেসব অভিযোগ শুনলাম, সেগুলোর পর আর উনার প্রতি একটুও শ্রদ্ধা কাজ করছে না আমার। বরং কেমন জানি ঘৃণা হচ্ছে। যদি সত্যিই কাল তন্ময় সব প্রমাণ করতে পারে, ও নির্দোষ ছিলো; তাহলে আমি আমার সামনে থাকা মানুষটার সাথে সারাজীবন সংসার করবো কীভাবে?
এগুলো ভাবতেই উনি আমার পাশে এসে বসলেন। উনি বসা মাত্রই আমি খানিকটা সরে গিয়ে বসলাম।

উনি একটা রিং হাতে নিয়ে আমার হাতে পরিয়ে দিতে চাইলে আমি মৃদু স্বরে বললাম,
‘এটা আজ থাকুক। অন্যদিন দিয়েন না হয়।’

আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে তাকালেন। উনার সাথে চোখাচোখি হতেই কেমন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো আমার সারা শরীরে। মানুষটার চোখে অদ্ভুত এক মায়া রয়েছে। যা আমাকে বিশ্বাস করতে দিচ্ছে না উনি দোষী। কিন্তু তন্ময়ের কথাগুলো তো এর বিপরীত! কাল সকালেই আমার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। উনি হয়তো আমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা শুনতে পেলেন।

হাতের রিংটা রেখে দিয়ে বললেন,
‘তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বেনারসি ছেড়ে হালকা ড্রেস পড়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর একটা লম্বা ঘুম দাও। দেখবে সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় উবে যাবে টেরও পাবে না।’

কথাটা বলেই উনি নিঃশব্দে হাসলেন।
পুরুষ মানুষের হাসি এতো সুন্দর হয়? না হলে উনার হাসি এতো সুন্দর কেন? আমি উনার দিকে তাকিয়েই ভাবনায় ডুবে যাচ্ছি। এ মানুষটা সত্যিই আমাকে ঠকিয়েছে? বিড়বিড় করে বলে উঠলাম। উনি আবার বললেন,
‘কিছু বললে?’

আমি উনার কথার জবাব না দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। উনি পিছু ডাকলো,
‘মৃদুলা?’

আমি ঘুরে তাকালাম না। জানি পিছু ঘুরলেই উনার মায়ায় আটকে যাবো। যা আমি এ মুহুর্তে মোটেও চাচ্ছি না। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিলাম। আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। একদিকে আমার প্রাক্তন আর অন্যদিকে স্বামী। আমি কার পক্ষে লড়বো?

.
(চলবে…)
.
#ছন্দ_ছাড়া_বৃষ্টি
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব_০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here