ছন্দ ছাড়া বৃষ্টি পর্ব ২

#ছন্দ_ছাড়া_বৃষ্টি
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০২
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তিহানকে রুমে দেখতে পেলাম না। কোথায় গেছে কে জানে! তিহান রুমে না থাকায় কিছু স্বস্তি অনুভব করলাম। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আধঘন্টা পর তিহানের আগমন ঘটলো রুমে। ওর হাতে লাইটার দেখে অনুমান করে নিলাম হয়তো সিগারেট টানতে গিয়েছিলো। আমি পাশ ফিরে শুয়ে আছি বিধায় তিহান আমার মুখটা দেখতে পায়নি। হয়তো ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়েছি।

কিছুক্ষণ পর টের পেলাম ও আমার পাশে শুয়েছে। তিহান ঝুঁকে আমার দিকে আসার চেষ্টা করতেই আমি নড়ে উঠলাম। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
সারারাত আমার এপাশ ওপাশ করেই কাটলো। দু’চোখে ঘুম নেই। সকাল হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলাম।

কিন্তু শেষ রাতের দিকে কীভাবে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না। যখন আমার ঘুম ভাঙলো দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাতটা বেজে দশ মিনিট। এদিকে তিহানও একদম ঝাপটে ধরে আছে আমায়। আমি নিজেকে ওর থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ও নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বললো। কিন্তু সেটা স্পষ্ট না হওয়ায় আমি আর শুনতে পারলাম না। আমি যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছি, ও ততই আরো শক্ত করে আমায় ধরে রাখছে। সকাল সকাল মেজাজ গরম করিয়ে দিচ্ছে।

আমি এবার উঁচু স্বরে বললাম,
‘উফ ছাড়ুন তো। আর কতো ধরে রাখবেন?’

আমার কন্ঠ পেয়ে তিহান দ্রুত চোখ খুললো। তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়ে অপরাধী কন্ঠে বললো,
‘সরি, ঘুমের ঘোরে কখন তোমায় জড়িয়ে ধরেছিলাম বুঝতে পারিনি।’

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। এমনিতেও মুড ঠিক নেই। তন্ময় ভোরে দেখা করতে বলেছে আর আমি সজাগই হয়েছি বেলা করে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে আসলাম। এতক্ষণে বাড়ির প্রায় সবাই উঠে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে তন্ময়কে খোঁজার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোথাও দেখলাম না। মা এসে আমাকে বসতে বললেন। আমি না বসে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘মা, রান্নাঘরটা কোনদিকে? ব্রেকফাস্ট কী বানাবো?’

শাশুড়ি মা হেসে জবাব দিলেন,
‘তোমায় এখন কিছুই করতে হবে না। তুমি বসো এখানে। আমি তিন্নিকে দিয়ে তোমার জন্য চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

এ বলেই উনি রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে যেতে চাইলেন। আমি পিছন থেকে বললাম,
‘মা, আমিও আসি আপনার সাথে?’

উনি এবার সম্মতি জানালেন। আমি মায়ের সাথে রান্নাঘরে যেতেই তিন্নি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
‘ভাবী, তুমি এখন ঠিক আছো তো? তুমি কেন এখানে আসতে গেলে? আমি নিজেই তো তোমার জন্য চা নিয়ে যাচ্ছিলাম।’

ওর কথার জবাবে আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম,
‘ঠিক আছি আমি।’

সবার সাথে হেসে হেসে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। আমার চোখ দু’টো সারাক্ষণ তন্ময়কে খুঁজে যাচ্ছিলো। কিন্তু ওর দেখা পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যে তিহানও ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাইনিংয়ে চলে এসেছে।

উনি আসা মাত্রই আমি নিজেকে কিছুটা শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। বাবা এতোক্ষণ নিজের ঘরেই ছিলেন, এই মাত্র এসেছেন। আমি বাবাকে দেখেই সালাম দিলাম। উনি চেয়ারে বসতে বসতে সালামের জবাব দিলেন। মোটামুটি সবাই-ই ডাইনিংয়ে চলে এসেছে। কিন্তু তন্ময়ের আসার নাম নেই।
হঠাৎ করে তিন্নি চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘ওহ শিট! আম্মু তোমাকে একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি। ছোট ভাইয়া একটু বেরিয়েছে। বলেছে, দুপুরে ফিরবে বা বিকেলও হতে পারে।’

তিন্নির কথার পিঠে তিহান বললো,
‘কখন বেরিয়েছে তন্ময়? আর কোথায় গিয়েছে কিছু বলে গেছে?’

তিন্নি ঠোঁট উলটে বললো,
‘ছোট ভাইয়া কি কাউকে কোনো কৈফিয়ত দেয়? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে কোথায় যাচ্ছে। জবাবে ও আমাকে একটা ধমক দিয়ে বলেছে, ওর ব্যাপারে যাতে এতো বেশি প্রশ্ন না করি।’

তিন্নির কথাশুনে আমি অবাক হলাম। তন্ময় বাড়িতে এমন ব্যবহার করে? কই, আমার সাথে তো কখনো এমন রেগে কথা বলেনি।

এর মাঝে মা আফসোস করে বলতে লাগলেন,
‘ছেলেটা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। দেশের বাইরে পাঠিয়েও ঠিক করতে পারলাম না।’

এদের সবার কথাগুলো আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। মা কেন এ কথা বললো, দেশের বাইরে পাঠিয়েও তন্ময়কে ঠিক করতে পারলো না? সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কিছু তো একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু সেটা কী?
এসব সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যেই তিহান আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘মৃদুলা, তোমার বাবা ফোন দিয়েছিলেন। উনারা তো বৌভাতের অনুষ্ঠানটা আজ করছেন না। তাই বলেছে, বিকেলে তোমাকে নিয়ে একবার ঘুরে আসতে ও বাড়ি থেকে। তুমি রেডি থেকো।’

‘আচ্ছা।’

কথাটা বলেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। দু’কদম এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। আবারও বললেন,

‘ওহ হ্যাঁ, তোমার ফোন কোথায়, মৃদুলা? তোমার বাবা না কি অনেকবার ফোন করেছে, বাট তুমি ধরোনি।’

তিহান ফোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই আমার টনক নড়লো। কাল ও বাড়ি থেকে আসার সময় যে হ্যান্ড ব্যাগে ঢুকিয়েছি আর বের করিনি ফোনটা। রাতে তন্ময়ের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আর নিজের মধ্যে ছিলাম না আমি। আমি শীতল গলায় বললাম,
‘হ্যান্ড ব্যাগ থেকে বের করিনি।’

তিহান আমার কথা শুনে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন,
‘এক্ষুণি বের করে বাবাকে ফোন দাও। উনারা তোমায় নিয়ে টেনশনে আছেন।’

আমি মাথা নাড়িয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। তন্ময়ের ব্যাপারগুলো আমার স্বাভাবিক ঠেকছে না। কোথায় ও? এতো সকালে কী কাজের জন্য ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হলো? না কি আমি সকালে উঠতে পারিনি দেখে আমার উপর রাগ করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে?

এসব ভাবতে ভাবতেই আমার ফোন হাতে নিলাম। সর্বনাশ, বাড়ি থেকে কল এসেছে পঞ্চাশের উপরে। তাড়াতাড়ি বাবাকে কল ব্যাক করলাম। ও পাশ থেকে বাবার ঝাঁঝালো কন্ঠ ভেসে আসলো,

‘তোকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি মানে এই নয় যে তুই এভাবে আমাদের পর করে দিবি। কাল থেকে আমি, তোর মা আর মাহি কতোটা টেনশনে আছি, জানিস তুই?’

বাবার ধমকে আমি থতমত খেয়ে বললাম,
‘সরি বাবা, আসলে কাল ব্যাগ থেকে ফোর বের করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর মাথাটাও বড্ড ধরেছিলো, তাই আর কি। আমি ঠিক আছি, তোমরা টেনশন করো না। আম্মু আর মাহি কোথায়?’

বাবা আমার কথার উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনের ওপাশে মাহির গলা শুনতে পেলাম।

‘হ্যালো আপু, তোরা আজ বিকেলে আসছিস তো?’

আমি বুঝতে পারলাম ও বাবার থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়েছে। আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘হ্যাঁ, যাবো। আচ্ছা মাহি, তুই কি এখন বাবার পাশে?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটু সরে যা তো। তোর সাথে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে।’

মিনিট দু’য়েক পর মাহির জবাব পেলাম।
‘সরে এসেছি। বল্ কী কথা? সব ঠিক আছে তো ঐদিকে?’

‘না রে কিচ্ছু ঠিক নেই। তন্ময় ফিরে এসেছে। আর জানিস তন্ময় তিহানের আপন ছোট ভাই। আর তিহানের জন্যই নাকি তন্ময় এতোদিন দেশের বাইরে ছিলো।’

‘কী বলছিস তুই এসব? তন্ময় ভাইয়ার বড় ভাই আছে? কই এটা তো আগে তুই আমায় বলিসনি। ‘

‘বলিনি, তার কারণ তন্ময় ওর বাড়ির লোক সম্পর্কে আমাকে তেমন কিছুই বলতো না। ওর বাড়ি কোথায় বা ওরা ভাই বোন কয়জন? এসব কিছুই না। আমি জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যেতো। একদিন হঠাৎ ওর একটা ফোন আসে আর আমি ফোনের স্ক্রিনে বড় ভাইয়া লিখা দেখতে পাই। তখন ওকে চেপে ধরতেই বলেছিলো, ওরা তিন ভাই-বোন। তখনই জানতে পারি ওর ভাই আছে। কিন্তু সেটা যে তিহান, তা তো জানতাম না। তার কিছুদিন পরেই তো ও নিজেই উধাও হয়ে যায়। সেই সিচুয়েশনে তোকে ওর ভাইয়ের কথা কীভাবে জানাতাম বল্?’

‘তো এখন তুই কী করতে চাইছিস?’

‘আমি তন্ময়ের কাছে তিহানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছে, সেগুলোর প্রমাণ চেয়েছি। ও বলেছে আজ ভোরে দিবে। কিন্তু আমিই ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। আর যখন উঠেছি তখন শুনলাম ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।’

ওপাশ থেকে মাহির দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেলাম। আমি আবারও বললাম,
‘আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে রে মাহি। তন্ময়ের কথাগুলো মনে হলেই তিহানকে সহ্যকে করতে পারছি না। কী করবো আমি?’

দরজার ওপাশ থেকে তিহানের কন্ঠ পেয়ে চমকে তাকালাম আমি। উনি আমাকে চমকাতে দেখে বললেন,

‘আরে কী হলো চমকাচ্ছো কেন? আর ফোনে কাকে বলছিলে যে তুমি কী করবে। কোনো সমস্যা হয়েছে মৃদুলা?’

উনার কথায় তাড়াতাড়ি আমি ফোন কেটে দিলাম। তারপর অন্যদিকে ফিরে ঢোক গিললাম। আমতা আমতা করে বললাম,
‘ম-ক-কই কিছু হয়নি তো।’

উনি যেনো আমার কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। ভ্রুদ্বয় কুঞ্চন করে রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।

.
(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here