#অশ্রুমালা
Part–15 (বোনাস)
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
–এটা কি চা নাকি অন্য কিছু রোদেলা? (শান্ত গলায় বলে উঠে আবেগ)
রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, সর্যি?
আবেগ চায়ের কাপ টেবিলে শব্দ করে রেখে বলে, আমি যতদূর জানি চায়ের মূল উপকরণ হলো চিনি। কিন্তু তোমার বানানো চায়ে এর কোন ছিটেফোঁটা ও নেই।
রোদেলা মাথা নিচু করে নিল। এমন না যে সে রান্না পারে না। বরং রোদেলাকে ছোট খাটো একজন সেফ বলা যায়। সে ইচ্ছা করেই আবেগের চায়ে চিনি দেয় নি।
আবেগ বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে সামনে এগাতে চাইলে রোদেলা মুখ ফুটে বলে উঠে, চা খাবে না?
–না।
আর কিছু না বলে আবেগ বাথরুমে গোসল করতে গেল। সকালে নাস্তা সেরে এক কাপ চা খেতে চেয়েছিল আবেগ। সে তো ময়নার মাকে বানাতে বলেছে৷ কিন্তু বানিয়ে আনল রোদেলা। চা বানালো ভালো কথা। চিনি কেন দিবে না?
চিনি ছাড়া এতো বিদঘুটে হয়! মুখটার স্বাদই নষ্ট হয়ে গেল তার।
রোদেলা চায়ের কাপটা হাতে নিল। কাপে সম্পূর্ণ চা ই পড়ে রয়েছে। আবেগের যে রাগ! মনে তো হয় না এই চা দ্বিতীয়বার মুখে দিবে। মামা-মামী দুজনেরই ডায়বেটিকস। আবেগের ও সুগার বর্ডার লাইন বরাবর। অথচ চিনি ছাড়া নাকি সে চা খায় না। ডাক্তার হওয়ার পর ও এমন গাফলতি কিভাবে করতে পারে সে
!
রোদেলা ছোট করে চায়ে চুমুক দিল। আসলেই চিনি ছাড়া চা খেতে মজা না কিন্তু আবেগ যেভাবে রিয়্যাক্ট করেছে এতোটা করার মতো খারাপ ও না। রোদেলা চা খেতে লাগলো। কোথায় যেন শুনেছে, স্বামীর খাওয়া কাপ বা প্লেটে খেলে নাকি মোহাব্বত বাড়ে।
আচ্ছা এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা কি? তেমন কিছু তো দেখছে না। কেবল স্বামীর মুখের ব্যাকটেরিয়া গুলোই স্ত্রীর মুখে ট্রান্সফার হবে! এই যা দেখছে সে!
আমরা সবসময় যা দেখি সেটাই সবসময় ঠিক হয় না।
রোদেলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
যেহুতু সে এই বাড়ির বউ হয়েই এসেছে সুতরাং আগেভাগেই রান্নাঘরের দায়িত্ব টা নিয়ে নেওয়া উচিত।
ময়নার মা আদা বাটছে। তাকে দেখে বলে, আরে নতুন বউ তুমি? কি লাগবে?
রোদেলা কাপটা ধুয়ে নিয়ে বলে, না। আজকে রান্না আমি করব।
–আচ্ছা।
এমন সময় মামা-মামীর আওয়াজ ভেসে আসল।
মামা মামীকে কিছু বলছেন এতে ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে মামী।
রোদেলা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতেই মামা তাকে দেখে ফেলে এবং তিনি উচ্চস্বরে বলে, দেখ তো মা। তোর মামী নাকি কোয়ান্টামে যাবে না। ওখানে গেলে মনোবল বাড়বে কিন্তু এই মহিলা যাবে না।
মামী ঠোঁট বাকিয়ে বলে, আমার মনোবলের দরকার নাই।
–অবশ্যই আছে। রোদেলা তোর মামীকে বল নামাজ পড়ে এসে আমরা বেরুব। রেডি থাকে যেন৷
মামী জোড় গলায় বলে, আমি যাব না। ওরা কিসব বলে মাথা ওয়াশ করে ফেলে।
মামা বিড়বিড় করে বলে, তোমার মাথাটা ওয়াশ করাই উচিত তাও রিন পাউডার দিয়ে।
মামী কিছু শুনতে না পেয়ে বলে, কি বলছো তুমি?
মামা হাসিমাখা মুখে বলে, বলছি চল আমরা বুড়া-বুড়ি একটু রোম্যান্স করে আসি।
মামীর চেহারা তখন দেখার মতো ছিল। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় আবেগ ও কেন যেন বেরিয়ে ছিল। সে সব শুনে খুকখুক করে কাশতে লাগলো৷
মামী রাগী চোখে মামাকে বলে, বুড়ো বয়সে এসব কি ভিমরতী লাগিয়েছো শুনে?
মামা আবারো মামীকে লজ্জা দেওয়ার জন্য বললো, আহা ভিমরতী কেন হবে গো? প্রেমে পড়েছি আমি তোমার! তুমি কি সিনামার নায়িকার চেয়ে কম! আমার কাছে তুমি শাবানার চেয়ে সুন্দরী।
আবেগ একথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে। হন্তদন্ত হয়ে মাথা চুলকাতে থাকে।
রোদেলা এবার শব্দ করে হেসে ই দিল। তাকে হাসতে দেখে ময়নার মা ও হোহো করে হাসতে লাগলো। রোদেলা আর ময়নার মাকে হাসতে দেখে মামাও হেসে দিলেন৷
আসলে হাসি সংক্রামক রোগ বটে তাই তো আবেগ ও হেসে ফেলে। বেচারা হাসি চাপিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল প্রথম থেকেই কিন্তু পারল না ।
রোদেলা মুগ্ধ চোখে আবেগকে দেখতে থাকে। ছেলেটাকে হাসলে বড্ড স্নিগ্ধ লাগে!
মামী জোড়ে একটা ধমক দিলেন আর সবাই চুপ হয়ে গেল। হাসির আর একটা শব্দ ও মামীর কানে গেল না।
মামী লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে সুরসুর করে তার রুমে চলে গেল।
ইমতিয়াজ সাহেব ইচ্ছা করেই তার মিসেসকে ছেলের বউয়ের সামনে লজ্জা দিল। এখন এই লজ্জা এড়াতে জাবেদা খাতুন কোয়ান্টামে যাবে।
কোয়ান্টামে যাওয়া খুব জরুরি তাদের জন্য। পাড়ার কয়েকটি শিক্ষিত ছেলে মিলে এই সংঘটা খুলেছে৷ এখানে খুব সুন্দর সুন্দর বানী, উক্তি বলা হয়। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা থেকে শুরু করে কিভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায় সবকিছু নিয়েই আলাপ করা হয়৷ মানসিক শান্তি কিভাবে পাওয়া সাবে সব কিছু নিয়ে নতুন জেনারেশনের ছেলেরা আলাপ করে৷
ইমতিয়াজ রহমান জানে তার মিসেস কিছু টা কুটনি! কথা লাগাতে পছন্দ করে সিরিয়ালের ভিলেন মহিলাদের মতো। তাই তো ছলে বলে কৌশলে তিনি এই পদক্ষেপ টি নিচ্ছেন। যদি কিছু পরিবর্তন আছে জাদেবা খাতুনের মাঝে!
★★★
রোদেলা গরুর মাংস বসালো। মামী সেই যে রুমে ঢুকেছে আর বের হননি!
গোল গোল করে আলু কেটে মাংসের মধ্যে ছেড়ে দিল। আবেগের গরুর মাংস খুব প্রিয়।
গরুর মাংস খাওয়ার একটা কায়দা আছে। এই খাবার কখনোই বাসি কিংবা ঠান্ডা খাওয়া যাবে না। সবসময় গরম গরম খেতে হবে৷ গরম ভাতের সাথে চুলা থেকে নামানো গরুর মাংস সাথে শশা।
রান্না করা শেষ করে রোদেলা রুমে গিয়ে দেখে আবেগ পাঞ্জাবি পড়ে রেডি। সম্ভবত মসজিদে যাবে।
সাড়ে বারোটা বাজতেই আবেগ তার ফোন হাতে নিয়ে সুইচ অফ করে দিল।
যা দেখে রোদেলা বুঝতে পারল আবেগ এখনি বের হবে।
আবেগ আড় চোখে রোদেলাকে দেখে নিল। রোদেলা বসে বসে কাপড় ভাজ করছে।
সে বড় বড় পা ফেলে সমুদ্রের কাছে গিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে রুম ত্যাগ করল।
সবটা ঘটলো রোদেলার সামনে। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তার ছেলে এতো ভাগ্যবান!
★★★
মামা আর আবেগ মসজিদ থেকে ফেরার পর দুপুরে খেতে বসেছে সবাই।কিন্তু আবেগ খেতে পারছে না কারন তার ডান হাত মচকে গেছে৷ নাড়াতেই পারছে না হাত। আর মুখে খাবার তোলা তো দূরের কথা। গরুর মাংস (বাঙ্গালী পদ্ধতিতে রান্না করা) এমন একটা খাবার যা চামচ দিয়ে খাওয়া যায় না।
সে অনেক ট্রাই করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না।
মামা বলে উঠে, এক কাজ কর তো মা। আবেগকে খাইয়ে দে।
একথা শুনে রোদেলার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সেই সাথে চোখ ও প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম।
আবেগ মাথা নিচু করে ফেলে। আব্বার আজকে হয়েছেটা কি? কি আবোলতাবোল বকছে৷
মামী কিছুক্ষন বিষ্ফরিত চোখে মামার দিকে তাকিয়ে থেকে কটমট গলায় বলে, ও কেন খাওয়ায় দিবে? আমি দিচ্ছি আমার ছেলেকে খাওয়ায়৷
মামা মামীর হাতটা ধরে বলে, আহা তুমি কেন দিবে ওকে খাইয়ে? রোদেলা খাইয়ে দিবে৷
মামী বলে৷ না আমি দিচ্ছি।
মামা।এবার দুষ্টুমি মাখা গলায় বলে, এতো শখ খাওয়ায় দেওয়ার তো আমাকে দাও না? দামড়া ছেলেটাকে না খাইয়ে দিয়ে আমার মতো বুড়ো মানুষ কে খাইয়ে দাও। আমার একটু সেবা-যত্ন করো।
এবারো মামীর চেহারা দেখার মতো৷ মামী বলে উঠে, আমার ছেলেকে আমি খাইয়ে দিব। রোদেলা কেন দিবে?
–কেন দিবে না বল? রোদেলা তো বউ হয় আবেগের। তোমার মনে নাই? বিয়ের প্রথম প্রথম তুমি আমাকে প্রতিদিন রাতে খাইয়ে দিতে। বাধ্যতামূলক ছিল আমাকে খাইয়ে দেওয়া।
মামীর তো চোখ-মুখ লাল হয়ে আসতে লাগে মামার কথা শুনে।
আবেগ কোনমতে এক ঢোক পানি খেয়ে উঠে পড়ল। সেই সাথে মামী ও৷
রোদেলা মামীকে পিছু ডাকলেও উনি শুনলেন না৷
রোদেলা মামাকে বলে, কি দরকার ছিল মামা এসব বলার? উনি রাগ করে না খেয়ে চলে গেলেন।
মামা তার প্লেট সরিয়ে বলে।,আজকে আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি বাইরে গিয়ে নান রুটি-শিক-কাবাব খাব। তুই আবেগ কে খাইয়ে দে। আমি যাই।
ইভানা মিটমিট করে হেসেই চলেছে তার বাবার কান্ড দেখে।
রোদেলা হালকা হেসে আবেগের প্লেট নিয়ে রুমে চলে আসল।
রুমে এসে দেখে আবেগ বিছানায় বসে ফোন চালাচ্ছে। সে আবেগের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। আবেগ একবার রোদেলা কে দেখে নিয়ে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রোদেলা ভাত মাখিয়ে আবেগের মুখের সামনে তুললে আবেগ প্রশ্ন করে, কি হচ্ছেটা কি এখানে?
রোদেলা মৃদ্যু গলায় জবাব দেয়, খাওয়াব তোমাকে।
–দরকার নেই। আমার খাওয়া হয়ে গেছে৷
–কিছু ই তো খাও নি। সম্পূর্ণ ভাত পড়ে আছে। এতোগুলো খাবার ওয়েস্ট করা কি ঠিক?
খাবার নষ্ট হবে শুনতেই ছোট বেলায় মায়ের বলা কথা মনে পড়ে গেল। আগে খেতে না চাইলে মা বলতেন,যে ক’টা দানা নষ্ট করবে ঠিক সে ক’টা দানা খাবার আখিরাতে সাপ হয়ে এসে ছোবল মারবে।
আবেগ প্লেটের দিকে তাকালো এবং ভাতের দানা গোনার মতো বৃথা চেষ্টা প্রয়াস করতে লাগলো।
রোদেলা বলে উঠে, তোমাকে কি এখন বাচ্চাদের মতোন ভুলিয়ে -ভালিয়ে খাওয়াতে হবে নাকি? সেই কখন থেকে ভাত নিয়ে বসে আছি। খেয়ে নাও।
আবেগ কি ভেবে যেন রোদেলার হাতে গোল করে রাখা ভাতের লোকমা টা তার মুখে পুরে নিল।
হুট করে আবেগের মুখের গরম ভাব পাওয়ায় কেপে উঠে রোদেলা। সে কিছুটা অপ্রস্তুত বনে যায়। কিন্তু আবেগকে বুঝতে দেয় না। আবেগ যদি একবার বুঝে যে রোদেলা তাকে খাইয়ে দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। ব্যস আর খাবে না। এসব ব্যাপারে খুব ঘাড়ত্যাড়া আবেগ।
আবেগের কাজ বলতে গেলে শুধু মুখের খাবার টা চাবিয়ে গিলে ফেলা। বাকি কাজ রোদেলা করছেই৷
আবেগ খেতে খেতে রোদেলার দিকে তাকালো। আবার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আবার রোদেলার দিকে তাকালো। এবং রোদেলার চোখ মুখ ঠোঁট, গাল পর্যবেক্ষন করতে লাগে নির্লজ্জের মতো!
আবেগ দেখল রোদেলার নাকে ছোট একটা নাক ফুল। নাক কবে ফুটো করেছে রোদেলা? রিশাদের সাথে বিয়ে করার আগে? নাকি পরে? কিছু তেই মনে আসছে না। আবেগের একটা সমস্যা আছে তা হলো যখন যেটা মনে করার চেষ্টা করে সেটা কোন দিন ও মনে করতে পারবে না!
রোদেলা শেষ লোকমা আবেগের মুখে তুলে দিল। তখনো প্লেটে একটা হাড্ডি অবশিষ্ট ছিল। তা দেখে রোদেলা বলে, হাড্ডি চাবাবে?
আবেগ পানি খেয়ে উত্তর দেয়, আমি এসব হাড্ডি চাবাই না।
রোদেলা হাড্ডিটা নেড়েচেড়ে বলে, এটা অনেক মজার হাড্ডি। শিনার হাড্ডি। মজা পাবে৷ চাবিয়ে।
–তুমি চাবাও৷
একথা শুনে রোদেলা সত্যি সত্যি হাড্ডি চাবাতে শুরু করে দিল খুবই সাবলীল ভাবে৷
আবেগ হতভম্ব হয়ে যায়। পরমূহুর্তেই হতভম্ব ভাবটা মুগ্ধতা টায় রুপ নিল।
হাড্ডি চাবানো অবস্থায় ও কাউকে এতোটা মায়াবতী লাগে!
আবেগের মনে হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদ কিঞ্চিৎ ভুল বলেছে, যে মেয়েকে ঘুমালে সুন্দর লাগে সে প্রকৃত সুন্দর নহে বরং যে মেয়েকে হাড্ডি চাবানো অবস্থায় সুন্দর লাগে সে-ই আসল এবং সত্যিকার অর্থে সুন্দরী। শুধু সুন্দরী না। সুন্দরীর আগে বিশেষন হিসেবে মারাত্মক বসবে!
★★★
মামা-মামী বের হতেই ইভানা এক প্রকার দৌড়ে এসে রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভাবী আমি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় যাব৷
রোদেলা সহজ ভাষায় বলল, যাও।
–না মানে সমুদ্র কে সঙ্গে নিয়ে যেতাম।
এবার আবেগ বলে উঠে, কেন ও নিবি সঙ্গে?
ইভানা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, আ,,,আমার ফ্রেন্ডরা খুব করে বেবিকে দেখতে চাচ্ছে। নিয়ে যাই না? সঙ্গে ফিডার নিব। কিচ্ছু হবে না। সমুদ্র তো গুড বেবি। একদম কান্না করে না। নিয়ে যাই না? প্লিজ!
প্লিজ!
আবেগ রাজি হচ্ছিল না। ইভানা অনেক জোড়াজুড়ি করে বিধানায় রাজি হয়ে যায়।
ইভানা দৌড়ে গিয়ে সমুদ্র কে কোলে নেয়।
আবেগ তাকে থামিয়ে বলে, জামা চেঞ্জ করে নিয়ে যা। রোদেলা ওকে ভালো দেখে একটা গেঞ্জি পড়িয়ে দাও।
রোদেলা মুখ ভার করে বলে, ওর তো সব এমন ই সুতি জামা। গেঞ্জি তো কেনা হয় নি।
আবেগের মেজাজ বিগড়ে গেল। এটা কেমন কথা? তার ছেলে প্রথম বার বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে অথচ এই ফুটপাতের জামা পড়ে যাবে?
আবেগের মন চাচ্ছে এখনি দোকানে গিয়ে একটা গেঞ্জি কিনে এনে পড়িয়ে দিক সমুদ্রের গায়ে। কিন্তু সেই সময় ইভানা দিল? বাবুকে নিয়ে চলে গেল বন্ধুর বাসায়।
ইভানা যেতেই আবেগ বলে উঠে, রেডি হও।
রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, কেন?
–কাজ আছে।
–খুব দরকারী?
–খুব প্রয়োজনীয়।
রোদেলা কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নেয়। বাসা তালা দিয়ে বের হল দুজনে।
কিছুক্ষন পর রোদেলা বুঝল আবেগের প্রয়োজনীয় কাজটা আসলে কি? তারা একটা বেবি শপের সামনে এসেছে৷
আবেগ দোকানে ঢুকে সমুদ্রের জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কিনল। সামনে শীত আসছে। তাই সুয়েটার। মুজা, টুপি, জুতা অনেক কিছু কিনল। সঙ্গে কিছু খেলনা কিনল। রোদেলা অনেকবার মানা করছিল৷ বারবার বলতে লাগে এতো খরচ করার কি আছে।
এক সময় আবেগ তাকে ধমক দিয়ে বলে, প্লিজ চুপ করো তো। মানলাম আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিলং করি তাই বলে এতোও কম সার্মথ্য না আমার। ঢাকা শহরের ডাক্তার আমি। একজন রুগীর ভিজিট ই পাঁচশ করে রাখি। সো কাইন্ডলি সাপ আপ ইউর মাউথ। ফর গড সেক।।
রোদেলা আর কিছু বলে নি৷ দোকানললং থেকে বের হয়ে আবেগের চোখ ফার্নিচারের দোকানে যায়৷ একটা রাজকীয় দোলনার দিকে চোখ আটকে যায় আবেগের। সে সেই দোকানে ঢুকে দোলনা কিনতে চায়।
এবার রোদেলা মুখ খুললো। দোকানদারের সামনেই বলে উঠে, এটা কেনা অযথা। বাবু কিছু দিন পর ই হাটা শিখবে। তখন কি করবে এটার?
দোকানদার ও কম না। পাইছে আবেগের মতো কাস্টমার। হাত ছাড়া করে কি কিভাবে? সে জোড় গলায় বলে, আরেকটা বাবু হবে যখন ওই বাবু দোল খাবে। টাকা উসুল হয়েই যাবে আপা দুই বাচ্চা দোল খেলে।
রোদেলার চোখ বড় বড় হয়ে আসল। সে ঢোক গিলল। অস্বস্তি বিরাজ করতে লাগলো তার চারপাশে। তৃষ্ণা পেয়ে গেল তার।
আবেগ এই কথায় রাগ করবে কি? আল্লাহই জানে!
#অশ্রুমালা
Part–16
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
পূর্নিমা হোটেল থেকে নান আর শিক কাবাব খেয়ে কোয়ান্টামে পৌছালো জাবেদা খাতুন আর ইমতিয়াজ রহমান। রহান সাহেবের মনটা কেন যেন আজ ফুরফুরে বেশ।
আগে প্রায়ই পূর্নিমা হোটেলে আসা-যাওয়া হত। কিন্তু এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে আর আসা হয় না। হোটেলটা অনেক পুরোনো। তাদের আমলের হোটেল। আভিজাত্য না বললেই চলে। কিন্তু খাবারের স্বাদ? যেকোন ফাইভ স্টার হোটেলকে হার মানাবে। নানরুটির সাথে একটা শশা দিয়ে সালাদ দেয় সেটার স্বাদ বলার বাইরে।
কোয়ান্টামটা একটা বাসার নিচ তলায়। তিনরুমের একটা বাসায় তাদের এলাকার কিছু ছেলে-মেয়েরা মিলে খুলেছে। যা টাকা আয় করে সেটা ডোনেট করা হয়৷ মূলত স্বেচ্ছাসেবা কেন্দ্র৷
ছোট হলে কি হবে? খুব পরিপাটি করে সাজানো। ঢুকলেই মনে হবে অন্য কোন জগতে চলে এসেছে৷ সবকিছু সাদা৷ কর্মীদের পরনে সাদা শার্ট আর মেয়েরা সাদা সালোয়ার। আর অবশ্যই সবসময় মুখে একটা হাসি ঝুলবেই।
খুব অদ্ভুত লাগে এদেরকে দেখলে জাবেদা খাতুনের! মনে হয় এরা ভীনগ্রহের ছেলে-মেয়ে!
রহমান সাহেব জাবেদা খাতুনকে নিয়ে বসলেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে একটা কমবয়সী যুবক ঢুকল।
তাকে দেখেই জাবেদা খাতুন মনমরা হয়ে যান। এই ছেলেটার কথা শুনলে তার নিজের ভেতর খুব লজ্জা আর অপমানবোধ হতে লাগে! ছেলেটার কথায় যাদুর মতো কিছু আছে। দেখতে সুদর্শন। সবসময় সাদা শার্ট ইন করে পড়বে। চুল গুলো গুছানো আর মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখবে। সপ্তাহে একদিন লেকচার দেয়। শুক্রবার করে।
ছেলেটা আসতেই একজন বয়ষ্ক মহিলা বেশ উৎসাহের সাথে বলে উঠে, শৌখিন বাবা, কালকে আমি এক ভিক্ষুকলে বাসায় ঢেকে বসে ভাত খাইয়েছি।
সাদা শার্ট পড়া ছেলে টা মানে শৌখিন মুচকি হেসে বলে, আমি এম সো প্রাউড অফ ইউ। সবাই ওনার জন্য করতালি দিন প্লিজ৷
ক্লাসের সবাই তালি দিল। শৌখিন হাসি হাসি ভাব রেখে বললো, তাহলে শুরু করি?
এরপর খানিকক্ষন চুপ থেকে বলে উঠে, আচ্ছা আমরা যে বলি, আমরা মানুষ। উই আর ম্যান। হিউম্যান। এই মানুষ বা হিউম্যান মানে টা কি? ম্যান ইজ ইমমরাল খুব তো বলি কিন্তু এই ম্যান মানে কি?
সবার মাঝে অবাক ভাব বিরাজ করল। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মানুষ মানে কি?
শৌখিন একজন কে উত্তর টা বলতে বলল। সে উঠে দাড়িয়ে বলল, যার দুটো হাত, দুটো পা আছে সেই মানুষ।
এই উত্তর শুনে শৌখিন বলে, পাখির ও দুটো পা আছে। তারপর ডলফিনের ও তো হাতের মতো দুটো অঙ্গ আছে তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী ওরাও তো মানুষ হওয়ার কথা।
এবার একজন বলল, যার মন আছে সেই মানুষ।
উত্তর শুনে শৌখিন আবারো হাসি হাসি ভাব রেখে বলল, আপনরা খেয়াল করেন কি না জানিনা। কেউ যদি কোন কুকুর বা বিড়াল বা ছাগল পালে তাহলে সেই অবুঝ প্রানি গুলো মালিক না থাকলে তাকে খুজে। কেন খুজে? তারপর আদর করলে বিনিময়ে তারাও আদর দেয়। কেন দেয়? আমরা কি এ হতে বলতে পারি না? অন্যান্য জীবদের ও মন আছে। জগতের সবারই একটা মন থাকলেও কেন মানুষ কে জীব না বলে মানুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে? উত্তর টা আমিই বলছি,
এরপর হুয়াইট বোর্ডে সে মানুষ লিখলো। কিছুটা স্পেস দিয়ে। এতে সবাই সহজে বুঝে গেল তিনটা আলাদা আলাদা শব্দ আছে
এবার শৌখিন মানুষ লেখাটা বরাবর সাহায্য লিখল।
সবাই ভ্রু কুচকে লেখা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর আগ্রহ নিয়ে৷
সে মুচকি হেসে বলে,মানুষ ও তিন অক্ষরের সাহায্য ও তিন অক্ষরের কিন্তু! আমরা মানুষ কারন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত এই বিশ্বজগতের প্রতিটা সৃষ্টিকে সাহায্য করে যেতে হবে। মানুষের কাজই সাহায্য করা। কি বুঝলেন তো এবার? মন সব প্রানীর ই আছে। হাত-পা ও কারো কারো আছে কিন্তু সাহায্য সবাই করতে পারে না। কেবল মানুষ করতে পারে। বিধাতা তাকে এই ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছে তাই তো আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব! আমরা যে বলি না? টাকা কামাব, বড়লোম হব। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকতে হবে আমি অনেক টাকা কামাব যেন এখন যতটা সাহায্য করতে পারছে, বেশি টাকা আন করলে যেন এর চেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারি। আমি বড়লোক হব কারন আমাকে অসংখ্য মানুষ বা জীবকে সাহায্য করতে হবে। মোট্ট যদি এটা হয় তাহলেই আপনি সৃষ্টির সেরা। অন্যথায় কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। মানুষ আর মানুষ থাকব্র না। আরো অনেক কিছু বলল ছেলেটা।
জাবেদা খাতুন মনযোগ দিয়ে শুনেই যাচ্ছেন।
শৌখিন এবার বলল, আপনাদের জন্য হোম টাস্ক হলো এই সাতদিনে সাতজন মানুষের মন ভালো করতে হবে। এই সাতজন যে কেউ হয়ে পারে। আপনার বাসার সাহায্যকমী। দারোয়ান, আবার আপনার মেয়ে, ছেলের বউ, স্বামী যেকেউ। কিন্তু মন ভালো করতে ই হবে। আমি কিন্তু আগামী শুক্রবার জিজ্ঞেস করব সবাইকে।কে কিভাবে আর কার মন ভালো করেছে। মনে থাকে যেন! আজকে এই পর্যন্তই । আসি তাহলে।
★★★
রিকশা আপন গতিতে চলছে। রোদেলা রিকশার হুট ধরে বসে আছে। পাশেই বসে আছে আবেগ। বিকেলের মিস্টি রোদ তাদের গায়ে পড়ছে। বেশ ভালোই লাগছে রোদেলার। পাশ থেকে আবেগের গায়ের কড়া মাতাল করা পারফিউমের গন্ধ রোদেলার নাকে আসছে। রোদেলা বুক ভরে গন্ধ টা নিচ্ছে।
আবেগ রোদেলাকে বলল, দেখো আমাদেরকে ফলো করতে পারছে তো ভ্যানটা। রোদেলা রিকশা থেকেই পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো, দোলনা যেই ভ্যানে করে আনা হচ্ছে সেটা তাদের পেছন পেছন আসছে কিনা।
দোকানে আবেগ কেন যেন কোন রিয়্যাক্ট করে নি। বেচারা দোলনাটার প্রতি এতোটাই মুগ্ধ যে দোকানদারের বলে উজবুক কথাও হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আবেগ দোকানদারকে প্রতিউত্তরে শুধু বলেছিল, আপাতত আমার প্রথম সন্তানই দোল খাক। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
এই সহজ কথাটা রোদেলা বুঝতে পারে নি। এর মানে কি? আবেগ কি চায় বুঝতে পারে নি এই কথার দ্বারা।।
হুট করে একটা ঝাকুনি লাগায় রোদেলা টাল সামলাতে না পেরে রিকশা থেকে পড়ে যেতে ধরে কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকায় আবেগ তার কোমড় জড়িয়ে ধরে।
রোদেলার চিৎকারে রিকশা চালক গাড়ি থামিয়ে দেয়।
আবেগ রোদেলাকে হাত দিয়ে টেনে এনে বসায় এবং প্রচন্ড ধমক দিয়ে, এখন যদি পড়ে যেতে তবে কি হত?
রোদেলা কাচুমাচু করে বলে, ভ্যানটা চোখে পড়ছিল না তাই একটু বেশিই ঝুকে গিয়েছিলাম বোধহয়
আবেগের চেহারায় ক্রোধ। সে রাগী গলায় বলে,
সবসময় একটা না একটা প্রবলেম ক্রিকেট না করলে তোর মন ভরে না তাই না?
রোদেলা একথা শুনে বিষ্মিত হয়ে গেল। সে কি এমন করল যে আবেগ তাকে এতো বড় একটা কথা বলে দিল৷
রোদেলা যন্ত্রের মতো করে বলে,কি করেছি আমি? তোমার আর নেহার মধ্যে এসেছি এইটাই তো। দোষ তোমার ও আছে। আমি কি জোড় করেছিলাম তোমাকে? কি দরকার ছিল বিয়ে করার আমাকে? আমি কখনোই কারো ক্ষতি চাই না। আর কারো জীবনেই প্রব্লেম ক্রিয়েট করি নি।
আবেগ রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে রেখেই অন্য পাশে মুখ ফিরালো। সে নিজেও বুঝছে না কেন হুট করে এই কথাটা বলে ফেলল? শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে বসল।
রোদেলার চোখে অটোমেটিক্যালি পানি চলে এসেছিল। এবার সে শব্দ করে কেদে দিল।
রোদেলার দিকে আবেগ বিষ্ফরিত চোখে তাকায়৷ মেয়েটা কাদছে!
কিন্তু তার কেন এতো শোক হচ্ছে? হুট করে আবেগের বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হতে লাগলো। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত না!
এর অপর কি ভালোবাসা নাকি করুণা?
চলবে হ্যাপি রিডিং। ]