#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৭
রুশিদের ছোট্ট বসার ঘরটায় এখন মানুষে ভর্তি, কিছুক্ষণ পুর্বেও গুটিকয়েক মানুষ ব্যতীত কেউ ছিলো না কিন্তু এখন ঘর ভর্তি মানুষ কিছু বাইরেও দাঁড়িয়ে। আশেপাশের প্রতিবেশিরাও উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ঠিক কি হচ্ছে এখানে।রুশি এই কালো পোশাকে থাকা একজনকেও চিনে না কিন্তু ধারণা করতে পারছে এরা কারো বডিগার্ড, প্রত্যকটা বডিগার্ড হাতে বিভিন্ন কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে যেমন শাড়ি, গয়না আরো কত কি!
রুশির পালক মায়ের চোখ যেনো কপালে, একসাথে এতোকিছু কখনোই দেখেনি সে। অতি খুশিতে তিনি পাথর হয়ে বসে আছেন। রুশির বাবাই ঠিক রুশির মতই সবকিছু বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কিছুক্ষনের মাঝেই সকল বডিগার্ড সরে গিয়ে রাস্তা করে দিলো আর একজন সুদর্শন যুবক ধীর পায়ে হেটে আসলো ঘরে। চোখে সানগ্লাস, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ফর্মাল ড্রেস পরা সায়ানকে রুশির কাছে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে মনে হলো। মনে কোন চিত্রকরের আঁকা শ্রেষ্ঠ চিত্র এটি যার দিক থেকে দৃষ্টি সরানো অসম্ভব। রুশির সেই ঘোরলাগা দৃষ্টির সাথে সায়ানের বাদামি চোখ জোড়ার মিলন ঘটলো, বিনিময়ে সায়ান হাল্কা মুচকি হেসে রুশির ঠিক পাশের খালি স্থানে বসে পড়লো।
রুশি এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, ওর আজকে বিয়ে এটা সায়ান জানলো কি করে?আর এতোকিছু নিয়ে আসারই বা মানে কি?পরে মনে পড়লো সায়ান কালকেই বুঝিয়েছিলো,,
“সায়ান জামিল খান পারেনা এমন কিছু নেই”
কিন্তু সায়ান সে দিকে তাকিয়ে নেই। সায়ান তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মাঝবয়সী লোকটির দিকে, ঠিক মাঝবয়সী না তবে আবার নওজোয়ানও না। বয়স আনুমানিক চল্লিশের কাছাকাছি যা দেখে সায়ান ভারি খুশি, সারা রাস্তায় ভেবে এসেছিলো যদি ছেলেটি ওর থেকে বেশি হ্যান্ডসাম হয় তবে কি ওই মেয়েটি বিয়ে করে ফেলবে? তাইতো এতো আয়োজন যাতে যদি সুন্দর দেখতেও হয় ওর টাকা দেখে মেয়ের বাবা ওর হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দেয়। কিন্তু ছেলেকে দেখে বুঝলো ছেলে ওর কাছাকাছি নেই তাই আরাম করে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলো। বিজনেস ডিল হোক মেয়ে নেয়ার ডিল হোক, হি উইল নেভার লুজ!
সায়ানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে লোকটি দাঁত কেলিয়ে হাসলো, লোকটি সায়ানকে চিনতে পারেনি এটাই স্বাভাবিক কারণ সায়ান জামিল খান নামটা সবার মুখস্থ থাকলেও মুখ দেখে অনেকেই চিনে না। লোকটি কিছুটা ক্যাবলাকান্তের মতো বললো
“আপনি কি এদের আত্মীয় হন?আপনি মেয়ের কি হন?”
সায়ান ঠিক একই অবস্থায় থেকে গম্ভীর স্বরে বললো
“এর পুর্বে আমাকে এরা কখনো দেখে নি আর মেয়ের এখনো কিছু হইনা তবে…”
রুশির দিকে তাকিয়ে বললো
“ভবিষ্যতে হতে পারি”
লোকটির মাথার উপর দিয়ে সবটা গিয়েছে তা চেহারা দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে, কিছুটা হচকিত গলায় বললো
“মানে?তাহলে কি করতে এসেছেন আপনি এখানে?”
সায়ান প্রশ্নের জবাবে কিছুটা হাসলো তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলো
“আপনি কেনো এসেছেন এখানে?”
“অবশ্যই মেয়ে দেখতে!”
সায়ান চেহারায় গ্রেট ইন্টারেস্ট ঝুলিয়ে বললো
“ওহ হোয়াট আ কো ইন্সিডেন্ট! আমিও মেয়ে দেখতে এসেছে, শুধু দেখতে আসিনি, বিয়ে করে সাথে করে নিয়ে যেতেও এসেছি”
লোকটি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো
“মানে?কি বলতে চাইছেন আপনি?”
“যা বলেছি খুব সোজাসাপ্টা ভাবে বলেছি, বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষা বুঝা উচিৎ। যাইহোক, ইউ হ্যাভ টু অপশনস। ওয়ান, নিজে সম্মানের সহিত এখান থেকে বেরিয়ে যাবে আর টু,আমার বডিগার্ড আপনাকে উঠিয়ে নিয়ে বাইরে ফেলে রেখে আসবে।তাড়াতাড়ি একটা চুজ করুন, আমার এতো বেশি সময় নেই”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো সায়ান, লোকটি কিছু বলতে গিয়েও বিশালদেহি বডিগার্ডদের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস পেলো না তাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। যাওয়ার পুর্বে রুশির ফেমিলিকে আচ্ছামতো শাশিয়ে গেলো যে সে মানহানির মামলা করবে। কিন্তু তাতে কারো বিশেষ মনোযোগ নেই, সবার কৌতুহল সামনে থাকা সুদর্শন ব্যাক্তিটিকে নিয়ে। রুশির পালক বোন নিহা এই নিয়ে তিনবার মেকাপ চেক করেছে, যদি একটু এটেনশন পাওয়া যায়!
সবার মাঝে সবচেয়ে স্বস্তি নিয়ে বসে আছে রুশি ঠিক নিরব দর্শকের মতো। যেনো এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথাই নেই তার। বসার রুমের এই কঠিন স্তব্ধতা ভেঙে রুশির বাবাই কথা বলে উঠলেন
“তুমি কে বাবা? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না!”
“আমাকে আপনার চিনার কথাও নয় আংকেল,তবে আমি আপনাকে খুব ভালো করে চিনি। আপনি খুব ভালো মানুষ আংকেল দেখেই বুঝা যায় তবে কেনো নিজের ঊনিশ বছর বয়সী বাচ্চা মেয়েটিকে এমন একজন লোকের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন?”
“তুমি যখন বিয়ের কোন এক পর্যায় আমার অবস্থানে আসবে তখন আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারবে বাবা”
সায়ান আর কথা বাড়াতে চায়নি বরং সোজা কথা বলে দিলো
“আংকেল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি,আর সেটা আজ এখনি করে ওকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। আমি চাইনা এই একইভাবে দ্বিতীয়বার কারো সামনে বসুক, আশাকরি আপনি বুঝতে পারছেন”
সায়ানের কথা শুনে নাহার বেগম মনে মনে বেশ রেগে গেলেন, যেখানে নিজের মেয়ের জন্য এমন রাজপুত্র আসলো না সেখানে এই অনাথ মেয়ে নাকি রাজরানি হবে! ক্ষোভের বসে বলেই ফেললো
“আমি আমাগো মাইয়ার বিয়া ওহন দিমু না”
“একটু আগেই তো দিচ্ছিলেন”
নাহার বেগম মুখ বাকিয়ে বললো
“দেখতে আইলেই তো বিয়া হইয়া যায় না, আমরা বড়জনরে রাইখা ছোট জনরে দিতাম নাহি?”
“তাহলে বড় জনকে রেখে ছোট জনকে কেনো সং সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছেন? এনিওয়ে আমি আপনার সাথে তর্কে জড়াতে আসিনি। কতো টাকা হলে রুশানিকে আমার সাথে যেতে দিবেন?”
নাহার বেগম যেনো চোখে সরষে ফুল দেখছেন, টাকার কথা শুনতেই তার চেহারার রঙ পালটে গেলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো
“দশ লাক দিলেই হইবো, আমার আবার এতো টাহার লোভ নাইকা”
সায়ান মহিলাটির দিকে তাকালেন, আর যাইহোক এই মহিলার মাঝে মাতৃত্ব বলতে কিছু নেই, সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে মেয়েকে অন্যের কাছে তুলে দিলো। নিজের মেয়ে না হোক এতোগুলা বছর এই মেয়েটিকে বেড়ে উঠতে দেখেছে, একসাথে থাকতে দেখেছে অথচ কখনো আপন ভাবতে পারেনি। সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বডিগার্ডকে ইশারা করে টাকা নিয়ে আসতে বললো। সায়ান বডিগার্ডের নিয়ে আসা স্যুটকেস দেখিয়ে বললো
“এতে পঞ্চাশ লাখ টাকা আছে, আশাকরি এতেই চলবে আপনার!ভবিষ্যতে রুশানিকে বিরক্ত করবেন না দয়া করে”
নাহার বেগম মুখ বাকিয়ে হাতে টাকার স্যুটকেসটা নিলো তারপর বললো
“এতোবছর যে আমরা টাকা খরচ করেছি তা কি মাত্র পঞ্চাশ লাখ নাকি?নিহাত আমার মন বড় তাই এর বেশি দাবি করিনি”
রুশির বাবা চড়া গলায় চিৎকার করে বললো
“নাহার! টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দাও। রুশি আমার মেয়ে ওকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমি টাকা নিবো এটা তুমি ভাবলে কি করে?”
“তোমার মেয়ে হতে পারে কিন্তু আমার নয়”
বলেই টাকাগুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো সাথে নিহাও। রুশির বাবা অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। বউকে খুব বেশিই ভালোবাসতেন তিনি তাই তার সকল অন্যায় আবদার মেনে নিতেন কিন্তু পরে বুঝতে পারেন উনি দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছেন, তবে ততদিনে তার গলার জোর এই ঘরে কমে গিয়েছে!
উনি সায়ানের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ বউয়ের আচরণের জন্য ক্ষমা চাইলেন তারপর সায়ান আর রুশির বিয়ের সাক্ষী হিসেবে তিনি ছিলেন। আপাদত রেজিট্রির মাধ্যমে বিয়েটা হয়েছে,হুজুর ডেকে পরে বিয়ে করে নিবে বলে সায়ান কথা দিয়েছে। রুশি পুরোটা সময় চুপ ছিলো একটা কথাও বলেনি, হয়তো বলার মতো কিছুই নেই।
একে একে সবাই যখন ঘর ছাড়ছিলো তখন রুশি ওর পালক বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, আর ধরে আসা কন্ঠে বললো
“তোমাকে খুব মিস করবো বাবাই! ভালো থেকো, বেচে থাকলে আবার দেখে হবে ”
বলেই ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো, রুশির বাবার খুব বলতে ইচ্ছে করেছিলো
“ধুর পাগলি, এমন কথা কেউ বলে নাকি!তুই চাইলেই আমি দেখা করে আসবো তোর সাথে”
কিন্তু বলা হয়নি, শব্দগুলো কেমন যেনো গলায় দলা পাকিয়ে গিয়েছে। চোখে টলমল জল নিয়ে রুশির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার ছোট্ট রুশি যে কিনা প্রতিদিন সকালে হঠাৎ করে এসে জড়িয়ে ধরে বলতো “বাবাই কেমন আছো?” কাল সকাল থেকে নিজে হাতে কেউ আর চা বানিয়ে খাওয়াবে না আর বকার স্বরে বলবেও না
“বাবাই তুমি তোমার ঔষুধ খেয়েছো? নিশ্চই খাওনি! এতো ভুলে যাও কেনো তুমি?এই নাও খাও। আমি যদি না থাকি তবে এই রোজরোজ তোমাকে ঔষুধের মনে করিয়ে দিবে কে শুনি?বড্ড অবুঝ তুমি”
উনি কাঁপা পায়ে এগিয়ে গিয়ে সায়ানের হাত চেপে ধরলেন আর ধরা গলায় বললেন
“আমার মেয়েটা বড্ড কষ্টে এতোগুলা বছর পার করেছে ওকে কখনো কষ্ট দিওনা। খুব ভরসা করে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি, আমাকে নিরাশ করো না। খেয়াল রেখো ওর”
সায়ান তার হাত চেপে ধরে আশ্বাস দিয়ে বললো
“আপনি চিন্তা করবেন না আমি সবসময় ওর পাশে থাকবো, ওর খেয়াল রাখবো। জরুরি নয় স্বামী হিসেবেই পাশে থাকতে হবে বরং বন্ধু হিসেবেও পাশে থাকা যায়!”
পরের কথাগুলো সায়ান মনে মনে আওড়ালো, আর যাইহোক এই মেয়েটিকে ও কষ্ট পেতে দিবে না। ও যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে বাচতে পারে সেটার জন্য ও সবকিছু করবে। স্বামী হিসেবে না হোক বন্ধু হিসেবে হলেও করবে!
রুশি গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে, সায়ান গাড়িতে চড়তেই গাড়ি নিজ গন্তব্যে চলা শুরু করলো। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে গলা ঝেড়ে বললো
“মন খারাপ?”
রুশি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো
“আমার আর মন খারাপ!সেটাও সম্ভব নাকি?বরং আমার তো খুশি হওয়ার কথা। আমাকে কেউ পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে আর আরেকজন বিক্রি করে দিয়েছে। আমার জীবনের মুল্য পঞ্চাশ লাখ টাকা!এও বা কম কিসে?আমার তো খুশিতে ধেইধেই করে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে। আই এম সো হ্যাপি রাইট নাউ”
#চলবে
(ছোট হয়েছে বোধহয়, স্যরি।ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)