মন পাড়ায় পর্ব ৩৫+৩৬

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“অর্থাৎ আজ ঝিনুকের জন্মদিন?” সৈকত রুহানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। রুহানি মাথা নাড়ালো। বলল, “ওকে জন্মের কয়দিন পর থেকেই ওর মা মারা যায়। এইজন্য ও কখনো জন্মদিন পালন করে না। আজ ওর জন্মদিন। আমাদের বন্ধুত্ব অনেক বছরের কিন্তু আমি তা জেনেছি গতবছর। ও কখনো এইমাস নিয়ে কথা বলে না। আর কখনো মন খারাপও করে না। ওর মন খারাপ হলে অন্যেরাও মন খারাপ করবে তাই।”
সৈকত সামনে তাকাল ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক তার বান্ধবীদের সাথে হেসে কথা বলছে, ছবি তুলছে, মারছে, মজা করছে। পার্কে এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে বুঝাই যায় না তার মাঝে এত বড় একটা শূন্যতা বিদ্যমান আছে। যে কেউ তাকে দেখলে বলবে তার জীবনও অন্য দশটা কিশোরী মেয়েদের মতো।
সৈকত রুহানির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর জন্মদিন পালন করতে চাও?”
রুহানিকে অনেকটা উৎসুক দেখাল। সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। সাথে বলল, “তা আর বলতে ভাইয়া? কিন্তু আমরা চাইলেই তো হবে না যদি ঝিনুক না চায় তাহলে কীভাবে হবে?” রুহানির কথা শুনে সৈকত দাঁড়িয়ে বলল, “একঘন্টার জন্য ওকে আটকে রেখো আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”
“আমি আসছি, তুমি অপেক্ষা করো।”
রুহানি কিছু বুঝলো না। সৈকত ইকবাল ও নীরাকে নিয়ে চলে গেল।

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর সেখানে পৌঁছায় সৈকত নীরার সাথে। তারা বেলুন, কেক ও প্যাকেটে আরও কয়েকটা জিনিস নেয়। তাদের দেখে ঝিনুক রুহানি এবং মিথিলাকে আলাদা নিয়ে রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কী ওকে বলেছিস আজ আমার জন্মদিন?”
মিথিলা মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমি এমন কেন করব?”
ঝিনুক তাকাল রুহানির দিকে। ভয়ে সে আশেপাশে তাকাচ্ছে শুধু।
ঝিনুক আবারও কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই বলেছিস রুহানি?”
“আমি….আমি…..”
রুহানির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই সৈকত উঁচু স্বরে বলে, “গাইজ আজকের দিনে এক বিশেষ উৎসব আছে। আমরা বন্ধুরা বছরে কয়েকটা দিন কিছু বাচ্চাদের সাথে জন্মদিন পালন করি। যাদের সামর্থ্য থাকে না সারাবছরে এইসব করার অথবা তারা জানেও না তাদের জন্মদিন কবে! তোমাদের সমস্যা না হলে তোমরা জয়েন করতে পারো। আমার বন্ধু ইকবাল বাচ্চাদের নিয়ে আসছে।”
রুহানি সাথে সাথে ঝিনুকের হাত ধরে বলল, “ভাইয়া আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা তো আরও খুশি হব।”
ঝিনুককে অনেকটা চিন্তিত দেখালো। সে আড়চোখে তাকাল রুহানির দিকে তারপর মৃদু হাসলো।
ইকবাল সাতটা বাচ্চাকে নিয়ে এলো। দূর থেকেই হাত দিয়ে ঝিনুকের দিকে ইশারা করল।

ঝিনুক স্বভাবগতই মিশুক ছিলো। অল্প সময়েই সব বাচ্চাদের সাথে মজা করতে শুরু করল। সবাইকে বেলুন ও কিছু খেলনা দিলো যা আনা হয়েছিলো। এইজন্যই হয়তো কেক কাটার সময় যখন দুটো বাচ্চা তাদের জোর করে নিয়ে এলো সে সন্দেহ করল না। একে অপরকে কেক খাওয়ালো। তারপর সবাইকে দুই প্যাকেট করে বিরিয়ানি দেওয়া হলো। অবশেষে যখন সন্ধ্যা নেমে এলো, লালিমা মেখে এলো আকাশের কোলে তখন সৈকত বলল, “তো বাচ্চারা তোমাদের আজ কে সবচেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছে? তাকে এক বিশেষ উপহার দেওয়া হবে।”
সব বাচ্চারা ইশারা করল ঝিনুকের দিকে।
মিথিলা বলল, “এইটা ঠিক না আমরা সবাই তো কত খেয়াল রাখলাম।”
একটা ছেলে হেসে বলল, “আফা মিথ্যা কইবেন না। আমনে তো বইয়া বইয়া ভাইয়ের লগে কেক খাইলেন হুদা। আমগোরে দেখছেন কহন?”
মিথিলা লজ্জা পেল অনেকটা সবার সামনে এইটা কথাটা বলায়। দোষটা রাজু’র উপর চাপিয়ে দিয়ে বলল, “সব দোষ তোমার। আমি মানা করেছিলাম না আমাদের এখন একা সময় না কাটিয়ে বাচ্চাদের দেখা উচিত।”
“তুমি কখন বললে?” রাজু বিস্মিত সুরে বলল।
মিথিলা রাজুর পেটে কনুই দিয়ে মেরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি বলি নি?”
রাজুর কিছুক্ষণ পেটে হাত দিয়ে দম আটকে রাখলো। তার মলিন মুখে বলল, “আমিই বলেছি। আমিই বলেছি।”
সবাই হেসে উঠলো একসাথে।
সৈকত একটি ব্যাগ থেকে ব্রেসলেট বের করে ঝিনুকের সামনে গেল। ঝিনুক ব্রেসলেটটা দেখেই বলল, “এত দামী ব্রেসলেট আমি নিতে পারব না।”
মিথিলা বলল, “আপাতত নিয়ে নেয় পরে আমাকে দিয়ে দিস।”
সৈকত ঝিনুকের হাত হাতে নিয়ে বলল, “এইটা আজকের দিনের স্মৃতি হিসেবে তোমার কাছে থাকবে সবসময়।”
ব্রেসলেটটা পরিয়ে চোখ উঠাতেই ঝিনুকের চোখে চোখ আটকালো। মিষ্টি হাওয়ার মাতাল ঘ্রাণে এক অদ্ভুত জাদু ছিলো। যা এই চোখ দুটোর মায়াজালে আটকে আরও গাঢ় হয়ে গেল।
অতীতের সে প্রথম অনুভূতি মনে করতেই সৈকতের বুক চিরে বেরিয়ে এলো আফসোসের নিশ্বাস। সে বুঝতে পারছে না। তার সাহসী স্বভাবের কিন্তু নম্র মনের ঝিনুকটা কোথায় হারিয়ে গেল? আজকের এই ঝিনুক তো তার কাছে ধাঁধার মতো। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে এই দুটো ঝিনুক একই না। মানুষ পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় তাদের স্বভাব। কিন্তু এতটা যে দুটো মানুষের মাঝে আকাশ পাতালের পার্থক্য থেকে যায় এতটা পাল্টে যাওয়াও মানানসই না।

ফোন বেজে উঠলো তার। সে পকেট থেকে ফোন বের করে প্রভার ফোন দেখে ফোন রিসিভ করে।
“জ্বি ভাবি, বলুন।”
“তুমি কোথায় সৈকত? এত রাতে চলে গেলে কেন?”
“কাজ ছিলো।”
প্রভার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল ফোনের ওপাড় থেকে। সে বলল, “ঝিনুকের কথায় গিয়েছ বুঝতে পারছি। ও এখনো ছোট সৈকত। ওর কথা মনে নিও না। আমি ওকে বোঝাব।”
“ভাবি আপনারা কখন রওনা দিবেন?”
“কাল সকালে।”
“কিন্তু ভাবি ঝিনুকের কাল অনুষ্ঠানে পার্ফোরমেন্স আছে।”
“ওকে বলেছি। কিন্তু ও যাবে না। আচ্ছা না গেলে কী সমস্যা হবে?”
সৈকত কিছুক্ষণ চিন্তা করে উওর দিলো, “না। আমি সব সামলে নিব। কোনো সমস্যা হতে দিব না। আচ্ছা ভাবি আপনার স্বামীকে একটু দিন তো।”
“মানে তোমার ভাই?”
সৈকত কাশলো একটু। তারপর বলল, “হুম। একটু দিন।”
প্রভা হাসলো সৈকতের এমন ব্যবহারে। সে জানে দুইজন একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে। সৈকত অর্কের ভীষণ সম্মানও করে যা একবার নিজের চোখে সে দেখেছিল কিন্তু নিজ থেকে কথা বলতে চায় না। দুই ভাই যতই ভিন্ন হোক দুইজনের ইগো তাদের থেকেও বড়।

প্রভা অন্যরুমে যেয়ে অর্কের দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। অর্ক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আপনার ছোট ভাই।”
সাথে সাথে অর্ক খপ করে ফোনটা নিয়ে নিলো। কানে লাগিয়ে বলল, “সৈকত কোথায় তুই? না বলে গেলি কেন?”
“এত অধিকার জমিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই আপনার। এতটুকু বলুন যে আপনি কীভাবে জানলেন যে পূর্বে আমার ও ঝিনুকের সম্পর্ক ছিলো।”
হকচকিয়ে গেল অর্ক। সে আমতা-আমতা করে বলল, “কী…কী বলছিস তুই?”
“ঢঙ করবেন না। আপনি লিটিলারি তখন বলেছিলেন যে আপনি ছিলেন না দেখে আগে একবার ঝিনুক আমার থেকে দূরে গিয়েছে আর যেতে দিবেন না।”
“আমি এমন কিছু বলি নি।”
“বলেছেন।”
“বলি নি।”
“বলেছেন।”
“দেখ সৈকত ঝগড়া করবি না। ভালো হবে না কিন্তু।”
“একশোবার করব।”
প্রভা হেসে উঠলো দুইজনের কান্ডে। সে বলল, “অদিন ও বিনুও চকোলেট বা টিভির জন্য এমনভাবে ঝগড়া করে। আপনারা একদম বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছেন। দুইজনই একরকম।”
অর্ক ও সৈকত দুইজন একত্রে বলল, “একদম না।”
সৈকত বলল, “আমি ফোন রাখছি।” বলেই কল কেটে দিলো।

অর্ক ফোন রেখে বলল, “অনেক হাসি আসছে তাই না?”
প্রভা দ্রুত মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে যেতে নিলেই অর্ক তাকে ধরে ফেলল। বাহু ধরে তার দিকে টান দিতেই প্রভা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। অর্ক বলল, “একটু আগে তুমি আমার গালে একটা গিফট দিয়েছিলে। রিটার্ন গিফট তো আমার দেওয়া উচিত তাই না?”
“লাগবে না।”
“আমি কারও ঋণ রাখি না তো।”
প্রভা বুকের ভেতর অজানা এক ঝড় উঠলো। সে চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায় মেখে গেল। আবার চোখ তুলতেই দেখে অর্ক তার অনেক কাছে এসে পরেছে। ঠোঁটের কাছে ঠোঁট আনতেই সে অর্কের ঠোঁটের উপর হাত রেখে বলল, “দরজা খোলা কেউ এসে পরলে?”
অর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। ভীষণ বিরক্ত বোধ করল। এমন সময় কেউ থামায়? তবুও ছুট দিলো তাকে।
প্রভা ছুট পেয়ে দৌড়ে গেল। দরজা দিয়ে বের হতে নিবে তখনই অর্ক বলল, “পালিয়ে কোথাও গেলে তোমার মা তোমার জন্য প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসবে।”
প্রভা থেমে গেল। অর্কের কথা ভুল নয়। দুইদিকেই ঝামেলা। অর্ক ছুঁলেই এমনিতেই সে লজ্জায় শেষ হয়ে যায় এর মধ্যে কাছে আসলে তো মরেই যাবে বোধহয়।
সে সুন্দর মতো দরজা লাগিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ করে তার কানের কাছে নেশায় মাখা এক কন্ঠে শুনে তার দমটা আটকে এলো, “তুমি কোথায় পালাচ্ছিলে?” বলেই অর্ক না সরেই পাশের সুইচ বোর্ড থেকে লাইট বন্ধ করে এক মৃদু আলোর নীল লাইট জ্বালায়।
অর্ক প্রভার চুলগুলো আলতোভাবে সরিয়ে তার পিঠে একখানা চুমু খায়। সাথে সাথে কেঁপে উঠে প্রভা। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।
প্রভা তার পেটে অর্কের আলতো হাতের ছোঁয়া পেতেই যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সাথে সাথে অর্কের দিকে ঘুরে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে। এক হাত দিয়ে খামচে ধরে তার গেঞ্জি।
অর্কও তার কোমরে দুই হাত আবদ্ধ করে। অর্ক প্রভার একটু ঝুঁকে প্রভার গলায় গাল ঘষে বলল, “প্রিয় বসন্তিকা, একটা প্রশ্নের উওর দিবে? পৃথিবীর কোনো নেশায় আমি আসক্ত হই না তবে তোমার নেশায় আমি এমনভাবে আসক্ত হই কেন যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি?”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩৬
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

“প্রিয় বসন্তিকা, একটা প্রশ্নের উওর দিবে? পৃথিবীর কোনো নেশায় আমি আসক্ত হই না তবে তোমার নেশায় আমি এমনভাবে আসক্ত হই কেন যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলি?”
কথাটা শুনতেই প্রভা চমকে উঠে। অতীতের কিছু স্মৃতি আবারও হানা দিয়ে যায় তার বুকে। কতগুলো বেদনার স্মৃতি। তার মনে আছে কয়েকবছর অন্যকেউও এমনই এক কথা বলেছিলো। সে সাথে সাথে অর্ককে ছেড়ে পিছিয়ে যায়। অনেকটা অস্বস্তি বোধ করে। সে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলল,
“রাত অনেক হয়েছে ঘুমিয়ে যাওয়া উচিত আমাদের। হ্যাঁ তাই ঠিক হবে। আসুন ঘুমিয়ে পরি আবার সকালে রওনা দিতে হবে। রাত এমনিতেই দুইটা বাজে।”
বলেই প্রভা বিছানায় শুয়ে পড়লো।

অর্ক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রভার দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের আচরণ এতটা পালটে যেতে পারে তা সে জানতো না। সে অনেকটা অবাক হলো তবে কিছু না বলে নিজেও যেয়ে শুয়ে পড়লো প্রভার দিকে পিঠ করে।
অর্ক অনেকটা সময় পর বলল,
“প্রভা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম।”
“তুমি কী এখনো বিনয়কে ভালোবাসো?”
প্রভা কিছু সময় নিয়ে উওর দিলো, “জানি না।”
“জানো না?”
“আমি জানি না আপনার আমার উপর এখন বিশ্বাস আছে না’কি এখনো বিশ্বাস নেই। কিন্তু এতটুকু বলতে পারব যে বিনয়কে আমি প্রচুর ভালোবেসেছিলাম। কেননা ও আমার জীবনের প্রথম পুরুষ ছিলো। ওর আগে আমার কোনো ছেলে বন্ধুও ছিলো না। তাই ওর সঙ্গ অতিরিক্ত ভালো লাগতো। তখন আরও আবেগের বসয় ছিলো তাই হয়তো আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম। বাস্তবতার সাথে কখনো মুখোমুখি হই নি। সে সাংসারিক জীবনেই বাস্তবতাকে খুঁজে পাই।”
“বিয়ে তাড়াতাড়ি হয় এইজন্য হয়তো কোনো বন্ধু বানানোর সুযোগ পাও নি। আর তুমি এমনিতেই শুধু থেকে ইন্ট্রোভার্ট টাইপের।”
” সত্যি বলতে আমার এই জীবনে শুধু একটি ছেলে বন্ধু আছে।”
অর্ক বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“কে? আমি কখনো জানতাম না যে তোমার কোনো বন্ধু আছে।”
প্রভা একটু হেসে বলল, “সৈকত। আপনি হয়তো জানেন না কিন্তু সৈকত ঝিনুক থেকেও আমার বেশি কাছের। বিনয়ের সাথে বিয়ের কয়েকবছর পর ও সবসময় এসে আমার খোঁজ নিতো, কথা বলত, সে সাংসারিক জীবনে আমি যদি কখনো হেসেছি তা শুধু সৈকত ও ফাতেমার জন্য। সৈকত থাকা অবস্থায় আমার কখনো আফসোস হয় নি যে আমার কোনো ছোট ভাই নেই।”
“তুমি আমার ভাইকে চুরি করেছ?”
প্রভা হাসলো এই কথা শুনে।
অর্ক আবারও জিজ্ঞেস করল, “বললে না যে?”
“চুরি করি নি তো।”
“এইটা না। এখনো বিনয়কে ভালোবাসো? উওরটা তো জানি না হতে পারে না। আমি জিজ্ঞেস করেছি এখনো, আগে কেন করেছিলে তা না। তুমি আমার বর্তমান, অতীত না।”
“আমি জানি না। এখন আর আগের মতো নিজের অনুভূতিকে বুঝতে পারি না। আমি ওকে ভালোবেসেছি, ওর ছোট বড় সকল আঘাতে বারবার ভেঙে যাওয়া ভালোবাসাকে আবারও গড়ে তুলেছি কিন্তু একবার ও আমার ভেতরটা এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে সে ছোট বড় সকল আঘাত মনে পড়লো আর ওর প্রতি আমার ভালোবাসা বিলীন হয়ে গেল অথবা বন্দী হয়ে গেল মন পাড়ার কোনো এক খাঁচায়।”
অর্ক জোরপূর্বক হেসে বলল, “আচ্ছা ঘুমিয়ে যাও।” বলে আবার অন্যপাশে ফিরে শুয়ে পড়লো।

প্রভার নিজের উপর জেদ উঠছিল। অর্ক এখন কী ভাববে তা ভেবে। শেষেদিকে তার মুখের ওপর এক বিষণ্ণতার ছায়া ছিলো কিন্তু এর কারণ ঠিক কি সে ধরতে পারলো না। সে অর্ককে ডাকতে চাইলো কিন্তু সাহস হলো না তার। আবার ফিরে অন্যদিকে শুয়ে পড়লো। তার চোখের সামনে কালো ধোঁয়া একত্রিত হলো। সে ধোঁয়া এক ভয়ানক রূপ নিলো। প্রভা চাদর চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। তার মনে পড়লো যেদিন প্রথম এই ভয়াবহ কল্পনার সম্মুখীন হয়েছিলো সে…..
সেদিনটা স্বভাবিকই ছিলো বাকি দিনগুলোর মতো। বিনয়ের এক বন্ধুর বাসায় তারা যেত দাওয়াতে। বিনয় বলেছিলো সেখানে ভালোমতো সেজে যেতে তাই তার ননদ ফাতেমাকে বলল সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিতে।
বিনু ও অদিনকে ফাতেমার কাছে রেখে তারা দুইজন রওনা দিলো। বিনয় রাস্তায় তার প্রশংসা করছিলো বেশ কিন্তু সেখানে যেয়ে তার মতামত পাল্টে গেল। সেখানে সবাই প্রভার থেকে অনেক মর্ডান পোশাক পরিধান করেছিলো। সাথে সজসজ্জাও ছিলো বেশ। সে অচানা লোকের ভিড়ে বিনয় নিজেও যেন অচেনা হয়ে গেল। সব অচেনা লোকের মাঝে ফেলে গেল তাকে একা।

বিনয়ের বন্ধু রাহান যার জন্মদিনের দাওয়াত ছিলো সে এসে বলল,
“আরে ভাবি আপনি এইখানে? আর বিনয় কোথায়?”
“সম্ভবত ব্যস্ত। অনেক বছর পর বন্ধুদের সাথে দেখা ব্যাস্ত থাকাটা স্বাভাবিক।”
“তাই বলে আপনাকে এইভাবে একা ছেড়ে যাবে? ভাবি আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আমার ওয়াইফের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আপনারও সময় কাটবে সাথে ওরও।”
“না ভাইয়া থাক। প্রয়োজন নেই।”
“আসুন না। আমার ওয়াইফ একটু অসুস্থ তাই আজ রুমে বসে আছে। আপনি এইখানে একা আর ও ওইখানে। দুইজনে একসাথে বসে গল্প করলে ভালো লাগবে।”
প্রভার তেমন ইচ্ছা ছিলো না যাওয়ার কিন্তু রাহানের জোর করায় তাকে সাথে যেতেই হলো। রুমে যেয়ে দেখে রুমে কেউ নেই। সে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার ওয়াইফ কোথায়?”
পিছনে ফিরতেই দেখে দরজা লাগাচ্ছে রাহান দরজা লাগাচ্ছে। প্রভা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “দরজা লাগাচ্ছেন কেন?”
রাহান উওর দিলো না। প্রভার বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরল। এক ভয় সাক্ষাৎ দিলো। আগে কখনো এমন জঘন্য পরিস্থিতিতে পরতে না হলেও সে লোকটার চোখদুটো দেখে তার বুক কেঁপে উঠছে। লোকটা যেন সে জঘন্য দৃষ্টি দিয়ে তাকে গিলে খাচ্ছে। তার হঠাৎ করে সম্পূর্ণ দেহ ঘিনঘিন করতে শুরু করল। সে দ্রুত দরজার কাছে যেতে নিলো আর লোকটা তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রভার সে মুহূর্তে উঁচু স্বরে বলল, “ছাড়েন আমাকে, নাহলে ভালো হবে না কিন্তু।”
“উফফ আপনি জানেন আপনার প্রতি এইজন্যই আকর্ষণ হয়। সহজে পাওয়া জিনিসের মূল্য কারও কাছেই থাকে না। এইতো দেখেন বিনয়ের কাছেও আপনার মূল্য নেই। কিন্তু চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই আপনার মূল্য দিব।”
“আপনার লজ্জা লাগা উচিত। সবাই আপনার এই রূপ জানলে কী হবে আপনি জানেন?”
“আপনাকে একবার হলেও পাওয়াটা আমার নেশা। যা হবে আপনাকে পাওয়ার পর দেখা যাবে।”
প্রভা যখন নিজেকে ছাড়াতে যেয়েও পারলো না তখন নিজের কনুই দিয়ে সজোরে মারল রাহাতের পেটে। যখন রাহান একটু ঢিল দিলো তখন পরপর চারবার মারল। আর পায়ে কয়েকটা লাথি মারলো।
রাহাত তার পেটের উপর হাত রেখে পিছিয়ে গেল। পরের মুহূর্তে সে রাগে বলে উঠলো,
“শালী তোর এত বড় সাহস! তোর তারিফ করসি দেইখা সাহস বাইড়া গেছে? ভাবছিলাম ভালোবেসেই নিজের তৃষ্ণা মেটাব কিন্তু তোর দেখি পাখনা লেগে গেছে। দাঁড়া তোর পাখনা কাটতিছি।”

মুহূর্তে এক জানোয়ার মতো রাহান তার দিকে এগিয়ে এলো। প্রভা নিজেও ছুটে বেড়াল। চিৎকার করলো অনেক। কিন্তু বাহিরের উঁচু স্বরের গানের তালে প্রভার কন্ঠ এই চার দেয়ালেই চেপে গেল। সে প্রভাকে ধরে ড্রেসিং টেবিলে ঠেকাল।
প্রভা সে প্রথম বুঝল অশোভন ছোঁয়ার অর্থ। তার নিজের শরীরকে ঘৃণা লাগছিলো এমন ছোঁয়ায়। মঅনে হচ্ছে কতগুলো কীটপতঙ্গ তার দেহের উপর রাখা হলেও এতটা ঘিন লাগতো না যা এই ভয়ঙ্কর বিশ্রী ছোঁয়াতে লাগছে। প্রভা নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করল। অনেক ভিক্ষা চাইলো কিন্তু সে মানুষরূপী জানোয়ারটার বুকে মায়া ছিঁটেফোঁটাও নেই। অবশেষে সে দেখতে পেল তার পাশের টেবিলে থাকা এক কাঁচের ফুলদানি। সে এক মুহূর্তে না ভেবে সে ফুলদানি উঠিয়ে মারলো রাহানের মাথায়।

প্রভা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছিল। রাহান তাকে ছেড়ে দুই’পা পিছিয়ে গেছে। মাথা ধরে আছে। টুপ টুপ করে ঝরছে শুধু রক্ত। তার কান, মুখ, গলা, সারা শরীর ধরে বয়ে মেঝেতে পরছিলো রক্ত। রাহান নিজেও মেঝেতে বসে পড়লো।

যে মেয়ে সারাজীবনে কাওকে কথা দ্বারাও আঘাত করে নি সে মেয়ের আজ একজনকে এতটা আঘাত করার পরও বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছিলো না তার।

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here