#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_26
#FABIYAH_MOMO🥀🍁
৪.
মেঘের গর্জনে ঢেকে গেছে পরিস্কার আকাশ! আকােশর দিকে তাকালেই যেনো গা শিউরে উঠে! রাস্তাঘাট খালি হচ্ছে অতি জলদিতে! আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে নিউজ পোর্টাল! অতি শিগগিরি নিরাপদে সবার চলে যাওয়ার আহ্বান! বাতাসের তান্ডব শুরু হয়ে গেছে! মুগ্ধ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশটা দেখছে। ওর কাছে আকাশটা আজ মস্ত আশ্চর্যের বস্তু! বারবার ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে মন বেচইন করে ফেলেছে। মনে প্রশ্ন একটাই! কখন নিজের চোখদুটোতে একটু উষ্ণতা পাবে! তৃষ্ণায় চোখদুটো জ্বালাময় করছে। এই তৃষ্ণা কিন্তু পানির তৃষ্ণা না! অন্যকিছুর তৃষ্ণা! স্বাভাবিক তেষ্টায় মানুষের ঘিলু শুকিয়ে যায়! কিন্তু চোখের তেষ্টায় হৃদয়ের অলিন্দসমূহ খরা হয়ে যায়!
ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে আকাশ দেখছে মম। চোখদুটো আজ আকাশের মতো বিষন্ন। আকাশ যখন বিষন্ন হয়ে থাকে তখন ‘বৃষ্টি’ হিসেবে পৃথিবীতে জলকণা ছাড়ে। মানুষের বেলায়ও তাই। বৈরি আবহাওয়ার দারুন প্রবলে বাতাস ছুটছে জোরে জোরে। মুখের উপর ঝাপটানি খাচ্ছে খোলামেলা চুলগুলো। মুগ্ধ ওকে কাছে ভিড়তে দেয়না। দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় সবসময়। আজ এক সপ্তাহ হতে চলল মুগ্ধ বিছানায়। একটাবারো খোঁজখবর নিতে দেয়নি, নিজেকে দেখতে দেয়নি, কারনটা জানতে দেয়নি। কেন মুগ্ধ হঠাৎ পরিবর্তন হলো? এভাবে কারোর পরিবর্তন মেনে নেওয়া যায়না! ভালোবাসার মানুষের পরিবর্তন তো আরো আগেনা! তখন ইচ্ছে করে নিজের গলায় দড়ি দিতে! মরে যেতে! মম হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো। ভিজে যাচ্ছে চোখদুটো। আকাশের পানে তাকিয়ে অশ্রুপূর্ণ চোখদুটো দিয়ে নিশব্দ বার্তা পাঠালো..
‘
— মুগ্ধ তোর কল পিক করেনি, না?
— না।
— ওর কি হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিস?
— না।
— ও কি সুস্থ? তুই নিজের চোখে দেখেছিস?
— জানি না।
অর্পিতা ‘মম’ নামক মেয়েটার জেরা করা কিছুক্ষন অফ রাখলো। অর্পিতার মনে হচ্ছে ও একটা রোবটের সাথে কথা বলছে! ‘ইয়েস’ ‘নো’ ছাড়া ব্যতিক্রম আন্সার ফিচারে যেনো নেই।। বাইরে মুখলধারে বৃষ্টি। অর্পি দেখল মম কোলে বালিশ রেখে জানালার গ্লাসে বৃষ্টির ছাট দেখছে। অর্পি গুটিশুটি হয়ে মমর কোল থেকে বালিশ সরিয়ে কিছুটা কাছে আসলো। মমর থুতনিটা ধরে ওর দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
— মুগ্ধ ভাই তোর সাথে দেখা করছেনা দেখে তোর কি হাল হয়েছে আয়নায় দেখছিস? আঙ্কেল আন্টি পযর্ন্ত এখন ডাউট করছে তোর উপর। তুই জানিস তোর রুমে আসার আগে আন্টি আমাকে কি আস্ক করেছে? আস্ক করেছে তুই প্রেমটেম করিস নাকি, ছ্যাকা খেয়েছিস ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করছিলো। তুই বুঝ! তুই কেমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করছিস! আঙ্কেল আন্টি পযর্ন্ত তোর ফেস দেখে কারেক্ট গেস করে ফেলছে! এভাবে আর কতদিন চলবে? কিছুদিন পর এক্সাম! এক্সামে ভালো না করলে ড্রপ যাবে এক ইয়ার। প্লিজ নিজেকে ঠিক কর। এভাবে কোনোকিছুর সমাধান হয়না। মুগ্ধ নিজেই যেহেতু তোকে আর লাইফে চায়না। তুই কেন নিজেকে সস্তা বানাবি? তুই কি সস্তা? স্টিল কানে আসছে তন্ময় তোকে লাভ করে। পারলে তন্ময়কে মাফ করে ওর সাথে রিলেশনে যা। মুগ্ধকে জেলাস করা। তারপরও মুগ্ধ যদি ভুল বুঝতে না পারে সেটা অন্য হিসাব! মুগ্ধকে ভুলার জন্য তন্ময়কে ট্রায় কর!
মম ঝামটা দিয়ে অর্পির কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। চোখ শক্ত করে তাকিয়ে বললো,
— তন্ময়ের সাথে রিলেশনে যাওয়ার চাইতে আমি বিষ খাইতেও রাজি! আমি তন্ময়কে জীবনেও মাফ করবোনা!
— তুই কিন্তু ঘুরেফিরে একইদিকে যাচ্ছিস মম! তুই বারবার মুগ্ধের ফ্যাক্ট লাইফের সাথে জড়িয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস! তন্ময় মুগ্ধকে ওর বেয়াদবির জন্যেই মেরেছিলো! মুগ্ধ তন্ময়দের সাথে লিমিটলেস রুড বিসেভ করেছে। এমনেই ছেলেদের রক্ত গরম! সো মারামারিতে একদল জিতবে আরেকদল বাচবে এটাই নিয়ম!
— পুরো সত্য না জেনে তন্ময়দের সভ্য বলা উচিত না অর্পি! আধা সত্য মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর !
— পুরো ক্যাম্পাস কি মিথ্যা বলবে, বল?
— জানিনা! আমি জানতেও চাইনা! আমি জাস্ট জানতে চাই মুগ্ধ কেন আমায় ওর লাইফ থেকে হুট করে তাড়িয়ে দিলো! কেনো ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিজের রাস্তা রফাদফা করলো! আমি জাস্ট কারনটা জানতে চাই! পারবি হেল্প করতে? পারলে বলিস! নাহলে তোর কথার ঝুলি নিয়ে আজকের মতো যেতে পারিস!
অর্পি কিছুক্ষন ভেবেচিন্তে বললো,
— তুই কি সত্যিই চাচ্ছিস মুগ্ধের বদলে যাওয়ার কারন জানতে?
— হ্যাঁ চাচ্ছি।
— আমি হেল্প করবো! বাট তুই প্রমিস কর এরপর থেকে তুই ওর দিকে ফিরেও তাকাবিনা! মন ও মনোযোগ সবটা এক্সামের দিকে দিবি! প্রমিস কর!
— আই প্রমিস! বাট আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু নো হোয়াট হেজ হেপেন্ড টু মুগ্ধ!
রাত আটটার দিকে মম ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পা মেলে টিভির রিমোট হাতে ফিল্ম দেখছিলো। চুলায় ভাত বসিয়ে রুমে গেল মা। ওয়ারড্রবের উপর থেকে একটা পেটমোটা খাম এনে মমর সামনে টি-টেবিলে রাখলো। মমর সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত নেই। মা মমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— খামটা খুলে দেখ তো। কিছু ছবি আছে। যেটা ভালো লাগবে, আলাদা করে রাখিস।
মম রিমোটটা কোলের উপর রেখে খামটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। ভেতর থেকে কিছু ছবিসহ বায়োডাটার কাগজ বেরিয়ে এসেছে। মম গম্ভীর মুখে সব কয়টা ছবি উল্টেপাল্টে দেখে ভাবলেস ভঙ্গিতে আবারো খামে ভরে রাখলো। রান্নাঘর থেকে একটা শব্দ আসলো,
— ছবি দেখছিস তুই? কোনোটা পছন্দ হইছে?
মম উত্তর দিলো না। হঠাৎ ছোট ভাই দৌড়ে এসে মমর সামনে দাড়ালো। মমর দিকে ভাইব্রেট ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আপু আপু!! তোমার কল আসছে!! দেখো!!
ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে দেখল বড় করে ‘অর্পি’ লিখা। কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বললো,
— দোস্ত মুগ্ধ বাসা ছেড়ে চলে গেছে! ও বাসায় নেই!
— নেই মানে? কেমন কথা বলছিস ‘বাসায় নেই’?
— ওদের দলের সাঙ্গু রামিম ছিলো না? ওর সাথে এইমাত্র আমার রাস্তায় দেখা হইছে!ও বললো মুগ্ধ গত দুদিন আগেই বাসা ছেড়ে এব্রর্ড চলে গেছে!
— ইমপসিবল! জাস্ট ইমপসিবল! এ হতেই পারেনা!
— এটাই হয়েছে! হ্যালো? হ্যালো…তুই জবাব..
টুট টুট শব্দ শুনতে পেলো অর্পি! এই মেয়ে রাগের মাথায় অঘটন কিছু করে ফেলে কিনা কে জানে? টেনশন হচ্ছে অর্পির!
৫.
ভালোলাগা ও ভালোবাসার মধ্যে সুক্ষ্ম কিছু পার্থক্য থাকলেও দুটোর বেলায় মন খুব ছটফট ও অস্থির থাকে। সেটা ভার্চুয়ালে ভালোলাগা হোক বা রিয়েলে ভালোলাগা! দুটোর পরিনাম কিন্তু একটাই! “মন অসুখে আক্রান্ত হওয়া!” জেনি, রিমি, রামিম একাডেমিক ভবন-২’ এর দ্বিতীয় ফ্লোরে বসে আছে। সবার মধ্যে একরাশ ভয় ও মাথাভর্তি চিন্তা! কোন জরুরি তলবে মম ওদের একত্রে ডেকেছে কেউ জানেনা। সময় ঠিক মিনিট দশেক পেরুলো বৈকি, দরজা খুলার আওয়াজ ওরা সবাই শুনতে পেলো। সবাই দেখলো মম শান্তমুখে এদিকে আসছে। মম কাধের ব্যাগটা লোবেন্ঞ্চে রেখে ওদের সাথে নিজেও হাইবেন্ঞ্চে উঠে বসলো। জেনি সবার প্রথম বলে উঠলো,
— তুমি আমাদের ডেকেছো কেন?
— দরকার আছে তাই ডেকেছি। তোমাদের সকলের সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে এজন্যই প্রাইভেট বৈঠকে বসা!
রিমি বৈঠকের নাম শুনেই ফট করে বললো,
— কি বিষয়ে বৈঠক? কি বলতে চাও?
— রিল্যাক্স! সব খুলে বলছি। মুগ্ধ এব্রর্ড চলে গেছে কথাটা সত্যি?
রামিম বললো,
— চলে গেছে সত্যি। বট এব্রর্ডের ব্যাপারে সিউর না। মুগ্ধ যাওয়ার আগেরদিন আমার সাথে দেখা করেছে।
জোরে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। মুগ্ধের যাওয়ার নিউজ আমার কান পযর্ন্ত এলোনা এমন কি হলো ওর সাথে? জেনি আমার হাতের উপর ওর হাতটা রাখলো। আমি কিছুটা অবাক চোখে ওর দিকে তাকালাম। রিমি ওর ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতলটা এগিয়ে বললো, ‘পানি খাও।’ আমি বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেলাম। জেনি নম্রকন্ঠে বলে উঠলো,
— জানি তুমি কেমন পরিস্থিতির মধ্যে আছো। দেখো আমি মেয়ে আমিও বুঝি। তোমাকে আগে ঘৃনা করলেও তুমি কিন্তু মোটেও খারাপ না। উল্টো আমি মনে করি তুমি খুব ভালো। আমরা তোমার সাথে খারাপ আচরন করেছি। নিজের উপর ঘেন্না হয়।
রিমি বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
— মুগ্ধের এমন স্টেপে আমারই রাগ লাগছে মম। সামনে থাকলে দুটো থাপ্পর দিতাম। তুমি প্লিজ স্ট্রং হও। ভেঙ্গে পড়াটা জাস্ট তোমার সাথে যায়না।
কিছুকালব্যাপী নিরবতা কাটতেই রামিম ব্যস্ততার সুরে বলে উঠলো,
— ভাবী? আপনি চাইলে আমি বসের লোকেশন বের করতে পারি। শুরু করবো?
আমি মুখ তুলে রামিমকে কিছু বলবো তার পূর্বেই জেনি ও রিমি একসঙ্গে বলে উঠলো,
— কর! ইডিয়েট!
— যো হুকুম মেরে আকা! আমি মুগ্ধের লোকেশন বের করতে রওনা দিচ্ছি! কেমন?
৬.
‘ঢাকা-টু-গাজীপুর’ রোডে রওনা হয়েছি আমরা! গাড়িটা রিমির। রিমির ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। রিমি, জেনি দুইপাশে এবং আমি মাঝখানে বসে আছি। রামিম ড্রাইভারের পাশের সিটে। জেনির অবস্থা ভালো না, বমি করতে করতে শেষ। এতোবার বমি করলে কেউ সুস্থ থাকে? আমার কাধে মাথা হেলিয়ে জেনি ঘুমিয়ে আছে। মুগ্ধ কোনো এব্রর্ডে যায়নি, ও দেশেই আছে। আজ মনটা কেমন শান্তি লাগছে বলতে পারছিনা। যারা জেনি, রিমি, রামিমদের কখনো সহ্য করতো না, ভালো বলতো না…আজ এই মানুষগুলো নিজেদের সুধরে ফেলেছে। মানুষের ভালো হতে সত্যি কোনো সময় লাগেনা। লাগে একটা সুযোগ! সুযোগের সৎব্যবহারে মানুষ হতে পারে সর্বোত্তম।
গাড়িটা গাজীপুরের কলেজরোড সড়কে থামলো। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে একটা গলি ধরে হেঁটে যাচ্ছি। সরু একটা গলি, মেটো রাস্তা, ছিমছাম নিরিবিলি, মানুষজন খুব কম। রামিম আগেভাগে এসে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। জেনির খুব নাজুক অবস্থা, গাড়ি থেকে নামতেই দুইবার বমি করলো। রিমি ও আমি জেনিকে ধরে ধরে নিয়ে এসে বাড়িটার সামনে আসলাম। রামিম পকেট থেকে ফোনটা বের করতে বলে উঠলো,
— জেনি? তুমি কি খুব অসুস্থবোধ করছো? হসপিটালে নিয়ে যাবো?
জেনি থেমে থেমে অসুস্থ গলায় বললো,
— না রামিম। এখন হসপিটাল না। আ’ম ফাইন। তুমি প্লিজ আমার জন্য মুগ্ধের খোঁজ বন্ধ করোনা।
— ওকে।
রামিম ফোনের স্ক্রিন থেকে বাড়িটার ঠিকানা মিলিয়ে আমাদের দিকে ইশারা করলো পিছু পিছু আসতে। রামিম দরজায় কলিংবেল দিয়ে লুকিং মিররে হাত রেখে ঢেকে দিলো। জেনি খুব দূর্বল। সম্পূর্ণ ভর আমাদের দুজনের উপর ছেড়ে দিয়েছে। আরো কয়েকটা বেল দিতেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো একজন পুরুষ। তার চোখেমুখে কৌতুহল। লোকটা জিজ্ঞেস করলো,
— জ্বি? আপনারা কে?
— একচুয়েলি আমরা আমাদের এক বন্ধুকে খুজতে এখানে এসেছি। এইযে দেখুন ছবিটা..ছেলেটাকে দেখেছেন? এর নাম রাদিফ মুগ্ধ। ঠিকানা পেয়েছি ও এই বাড়িতে থাকে।
লোকটা রামিমের ফোন থেকে মুগ্ধের ছবিটা তীক্ষ্মভাবে পরোখ করলো। গলায় আশ্চর্য ভাব এনে বললো,
— এই ছেলের নাম মুগ্ধ?
— জ্বী আঙ্কেল। আপনি চেনেন? চিনলে প্লিজ বলবেন ও কোথায় আছে?
— এই ছেলে তো এখানে থাকেনা। কিন্তু হ্যাঁ তোমরা যেই নামটা বলেছো সেই নামে একজন এখানে থাকে। রাদিফ মুগ্ধ নাম।
রামিম পিছু ফিরে আমাদের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে আছে। রিমি ও আমি দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাইয়ি করলাম। মুগ্ধ আমাদের বিরাট গুল খাইয়েছে। গাড়ির কাছে ঘুরেফিরে উপস্থিত হলাম । জেনি খুব অসুস্থ বিধায় ওকে রিমির গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সাথে রিমির যাওয়ার কথা থাকলেও রিমি আমাকে একা শহরে ফেলে যাবেনা। কাজেই ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জেনিকে। আশেপাশের সব কয়টা বাসাবাড়ি ও অলিগলিতে ঢুকে তিনজন মিলে মুগ্ধের সন্ধান করলাম। কিন্তু কোনো হদিশ মেললো না! কেউ ওকে চিনেনা, জানেনা, দেখিনি আদৌ! দুপুরের কোল গড়িয়ে রাত্রির আধারে চারপাশ আচ্ছন্ন হতেই মাগরিবের আযান শুনছি।। ক্লান্ত শরীরে খিদা পেটে তিনজন গেলাম এসিওয়ালা রেস্টুরেন্টে। রামিম হোয়াইট সস পাস্তা খাচ্ছে, রিমি খাচ্ছে রামেন। আমি বসে বসে চাওমিনের কাটাচামচ ঘুরাচ্ছি। গলা দিয়ে খাবার নামছেনা একদমই। রামিম চামচভর্তি পাস্তা নিয়ে মুখে পুড়তেই বলে উঠলো,
— ভাবী? ফিরে যাবেন? মুগ্ধকে তো পাওয়া গেলো না।
রিমি রাগী সুরে চেচিয়ে বললো,
— তুই মুগ্ধকে পাসনি বলে ফিরে যাবো? এতো সহজ?
— রিমি তুমি থামবে! আমার উপর চিল্লাচ্ছো কেন? আমি কি জানতাম? মুগ্ধ আমাদের বাশঁ খাওয়াবে!
আমি দুজনকে থামিয়ে বলে উঠলাম,
— প্লিজ গাইজ অফ যাও! তর্কবিতর্ক শুরু করো না!
— ভাবী! আপনিই বলুন এখন আমরা কি করবো? রাতে নাহয় হোটেলে থাকলাম বাট? মুগ্ধ যদি এখানে নাই থাকে! আমাদের থেকে কি লাভ?
— রামিম শেষবারের মতো ওই বাড়িটা আবার চেক দিবে? আমার ইনটুশেন বলছে মুগ্ধকে ওই বাড়িতেই পাবো।
রিমি ও রামিম দুজন খাবারটুকু শেষ না করে বিল পে করে উঠে দাড়ালো। আমরা আবার ফিরে গেলাম ওই বাড়িতে। এবার একটা কৌশল করে আগে আমি কলিংবেল টিপলাম। মুখে সার্জিকাল মাস্ক পড়েছি যাতে চিনতে না পারে। লোকটা দরজা খুলে একইভাবে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে আমি লোকটাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকে যাই! লোকটা তেড়ে আসতে নিলে পেছন থেকে রামিম ও রিমি লোকটার হাত ও মুখ বেধেঁ দরজা লাগিয়ে দেয়। আমি সবকয়টা রুমে ঢুকে চেক করছি। ওরা লোকটাকে ধরেবেধে সোফার রুমে বসে আছে। প্রায় সব রুম চেক হলেও কোণাচে একটা রুম দেখা এখনো বাকি। আমি সেদিকে পা বাড়িয়ে দরজা খুলে উকি দিতেই কেউ ঘুমাবস্থা কন্ঠে ‘কে? কে?’ করে উঠলো! অলৌকিকভাবে সমস্ত শরীর হিমবাহে কেপে উঠলো! বুকের মধ্যে ধুকপুকনি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। শ্বাস নিতে যেয়েও গলা ধেয়ে আসছে। শ্বাস নিতে পারছিনা আমি। মুখের মাস্ক খুলারও শক্তি পাচ্ছিনা। প্রচুর দূর্বল লাগছে, জেনির থেকেও দূর্বল! হাটুর নিচ থেকে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে।
— হু আর ইউ! টেল মি! কে তুমি!
আমি মুখ থেকে মাস্ক খুলতেই মুগ্ধের চক্ষুতারা সজাগ হয়ে উঠলো! তোতলিয়ে বলে উঠলো,
— পাকনি..
মুগ্ধকে দেখে একদৌড়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। ফুপিয়ে কেদেঁ চলছি অনবরত। আজো ওর গা খালি কিন্তু নির্দিধায় দুহাতে চেপে ধরেছি। মুগ্ধ বারবার হতবিহ্বল সুরে বলে উঠছে,
— পাকনি তুমি ভেতরে ঢুকলে কিভাবে? তুমি চলে যাওনি..
আমি চুলে হাত ডুবিয়ে কাধে কপাল লাগিয়ে কাদছি। ওর কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিনা। মুগ্ধ মাথায় হাত বুলিয়ে চোখবন্ধ করে বলে ঊঠলো,
— চুপ কর। চুপ চুপ…
#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_26
#FABIYAH_MOMO🥀🍁
৪.
মেঘের গর্জনে ঢেকে গেছে পরিস্কার আকাশ! আকােশর দিকে তাকালেই যেনো গা শিউরে উঠে! রাস্তাঘাট খালি হচ্ছে অতি জলদিতে! আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে নিউজ পোর্টাল! অতি শিগগিরি নিরাপদে সবার চলে যাওয়ার আহ্বান! বাতাসের তান্ডব শুরু হয়ে গেছে! মুগ্ধ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশটা দেখছে। ওর কাছে আকাশটা আজ মস্ত আশ্চর্যের বস্তু! বারবার ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে মন বেচইন করে ফেলেছে। মনে প্রশ্ন একটাই! কখন নিজের চোখদুটোতে একটু উষ্ণতা পাবে! তৃষ্ণায় চোখদুটো জ্বালাময় করছে। এই তৃষ্ণা কিন্তু পানির তৃষ্ণা না! অন্যকিছুর তৃষ্ণা! স্বাভাবিক তেষ্টায় মানুষের ঘিলু শুকিয়ে যায়! কিন্তু চোখের তেষ্টায় হৃদয়ের অলিন্দসমূহ খরা হয়ে যায়!
ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে আকাশ দেখছে মম। চোখদুটো আজ আকাশের মতো বিষন্ন। আকাশ যখন বিষন্ন হয়ে থাকে তখন ‘বৃষ্টি’ হিসেবে পৃথিবীতে জলকণা ছাড়ে। মানুষের বেলায়ও তাই। বৈরি আবহাওয়ার দারুন প্রবলে বাতাস ছুটছে জোরে জোরে। মুখের উপর ঝাপটানি খাচ্ছে খোলামেলা চুলগুলো। মুগ্ধ ওকে কাছে ভিড়তে দেয়না। দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় সবসময়। আজ এক সপ্তাহ হতে চলল মুগ্ধ বিছানায়। একটাবারো খোঁজখবর নিতে দেয়নি, নিজেকে দেখতে দেয়নি, কারনটা জানতে দেয়নি। কেন মুগ্ধ হঠাৎ পরিবর্তন হলো? এভাবে কারোর পরিবর্তন মেনে নেওয়া যায়না! ভালোবাসার মানুষের পরিবর্তন তো আরো আগেনা! তখন ইচ্ছে করে নিজের গলায় দড়ি দিতে! মরে যেতে! মম হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো। ভিজে যাচ্ছে চোখদুটো। আকাশের পানে তাকিয়ে অশ্রুপূর্ণ চোখদুটো দিয়ে নিশব্দ বার্তা পাঠালো..
‘
— মুগ্ধ তোর কল পিক করেনি, না?
— না।
— ওর কি হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিস?
— না।
— ও কি সুস্থ? তুই নিজের চোখে দেখেছিস?
— জানি না।
অর্পিতা ‘মম’ নামক মেয়েটার জেরা করা কিছুক্ষন অফ রাখলো। অর্পিতার মনে হচ্ছে ও একটা রোবটের সাথে কথা বলছে! ‘ইয়েস’ ‘নো’ ছাড়া ব্যতিক্রম আন্সার ফিচারে যেনো নেই।। বাইরে মুখলধারে বৃষ্টি। অর্পি দেখল মম কোলে বালিশ রেখে জানালার গ্লাসে বৃষ্টির ছাট দেখছে। অর্পি গুটিশুটি হয়ে মমর কোল থেকে বালিশ সরিয়ে কিছুটা কাছে আসলো। মমর থুতনিটা ধরে ওর দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
— মুগ্ধ ভাই তোর সাথে দেখা করছেনা দেখে তোর কি হাল হয়েছে আয়নায় দেখছিস? আঙ্কেল আন্টি পযর্ন্ত এখন ডাউট করছে তোর উপর। তুই জানিস তোর রুমে আসার আগে আন্টি আমাকে কি আস্ক করেছে? আস্ক করেছে তুই প্রেমটেম করিস নাকি, ছ্যাকা খেয়েছিস ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করছিলো। তুই বুঝ! তুই কেমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করছিস! আঙ্কেল আন্টি পযর্ন্ত তোর ফেস দেখে কারেক্ট গেস করে ফেলছে! এভাবে আর কতদিন চলবে? কিছুদিন পর এক্সাম! এক্সামে ভালো না করলে ড্রপ যাবে এক ইয়ার। প্লিজ নিজেকে ঠিক কর। এভাবে কোনোকিছুর সমাধান হয়না। মুগ্ধ নিজেই যেহেতু তোকে আর লাইফে চায়না। তুই কেন নিজেকে সস্তা বানাবি? তুই কি সস্তা? স্টিল কানে আসছে তন্ময় তোকে লাভ করে। পারলে তন্ময়কে মাফ করে ওর সাথে রিলেশনে যা। মুগ্ধকে জেলাস করা। তারপরও মুগ্ধ যদি ভুল বুঝতে না পারে সেটা অন্য হিসাব! মুগ্ধকে ভুলার জন্য তন্ময়কে ট্রায় কর!
মম ঝামটা দিয়ে অর্পির কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। চোখ শক্ত করে তাকিয়ে বললো,
— তন্ময়ের সাথে রিলেশনে যাওয়ার চাইতে আমি বিষ খাইতেও রাজি! আমি তন্ময়কে জীবনেও মাফ করবোনা!
— তুই কিন্তু ঘুরেফিরে একইদিকে যাচ্ছিস মম! তুই বারবার মুগ্ধের ফ্যাক্ট লাইফের সাথে জড়িয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস! তন্ময় মুগ্ধকে ওর বেয়াদবির জন্যেই মেরেছিলো! মুগ্ধ তন্ময়দের সাথে লিমিটলেস রুড বিসেভ করেছে। এমনেই ছেলেদের রক্ত গরম! সো মারামারিতে একদল জিতবে আরেকদল বাচবে এটাই নিয়ম!
— পুরো সত্য না জেনে তন্ময়দের সভ্য বলা উচিত না অর্পি! আধা সত্য মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর !
— পুরো ক্যাম্পাস কি মিথ্যা বলবে, বল?
— জানিনা! আমি জানতেও চাইনা! আমি জাস্ট জানতে চাই মুগ্ধ কেন আমায় ওর লাইফ থেকে হুট করে তাড়িয়ে দিলো! কেনো ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিজের রাস্তা রফাদফা করলো! আমি জাস্ট কারনটা জানতে চাই! পারবি হেল্প করতে? পারলে বলিস! নাহলে তোর কথার ঝুলি নিয়ে আজকের মতো যেতে পারিস!
অর্পি কিছুক্ষন ভেবেচিন্তে বললো,
— তুই কি সত্যিই চাচ্ছিস মুগ্ধের বদলে যাওয়ার কারন জানতে?
— হ্যাঁ চাচ্ছি।
— আমি হেল্প করবো! বাট তুই প্রমিস কর এরপর থেকে তুই ওর দিকে ফিরেও তাকাবিনা! মন ও মনোযোগ সবটা এক্সামের দিকে দিবি! প্রমিস কর!
— আই প্রমিস! বাট আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু নো হোয়াট হেজ হেপেন্ড টু মুগ্ধ!
রাত আটটার দিকে মম ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পা মেলে টিভির রিমোট হাতে ফিল্ম দেখছিলো। চুলায় ভাত বসিয়ে রুমে গেল মা। ওয়ারড্রবের উপর থেকে একটা পেটমোটা খাম এনে মমর সামনে টি-টেবিলে রাখলো। মমর সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত নেই। মা মমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— খামটা খুলে দেখ তো। কিছু ছবি আছে। যেটা ভালো লাগবে, আলাদা করে রাখিস।
মম রিমোটটা কোলের উপর রেখে খামটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। ভেতর থেকে কিছু ছবিসহ বায়োডাটার কাগজ বেরিয়ে এসেছে। মম গম্ভীর মুখে সব কয়টা ছবি উল্টেপাল্টে দেখে ভাবলেস ভঙ্গিতে আবারো খামে ভরে রাখলো। রান্নাঘর থেকে একটা শব্দ আসলো,
— ছবি দেখছিস তুই? কোনোটা পছন্দ হইছে?
মম উত্তর দিলো না। হঠাৎ ছোট ভাই দৌড়ে এসে মমর সামনে দাড়ালো। মমর দিকে ভাইব্রেট ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আপু আপু!! তোমার কল আসছে!! দেখো!!
ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে দেখল বড় করে ‘অর্পি’ লিখা। কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বললো,
— দোস্ত মুগ্ধ বাসা ছেড়ে চলে গেছে! ও বাসায় নেই!
— নেই মানে? কেমন কথা বলছিস ‘বাসায় নেই’?
— ওদের দলের সাঙ্গু রামিম ছিলো না? ওর সাথে এইমাত্র আমার রাস্তায় দেখা হইছে!ও বললো মুগ্ধ গত দুদিন আগেই বাসা ছেড়ে এব্রর্ড চলে গেছে!
— ইমপসিবল! জাস্ট ইমপসিবল! এ হতেই পারেনা!
— এটাই হয়েছে! হ্যালো? হ্যালো…তুই জবাব..
টুট টুট শব্দ শুনতে পেলো অর্পি! এই মেয়ে রাগের মাথায় অঘটন কিছু করে ফেলে কিনা কে জানে? টেনশন হচ্ছে অর্পির!
৫.
ভালোলাগা ও ভালোবাসার মধ্যে সুক্ষ্ম কিছু পার্থক্য থাকলেও দুটোর বেলায় মন খুব ছটফট ও অস্থির থাকে। সেটা ভার্চুয়ালে ভালোলাগা হোক বা রিয়েলে ভালোলাগা! দুটোর পরিনাম কিন্তু একটাই! “মন অসুখে আক্রান্ত হওয়া!” জেনি, রিমি, রামিম একাডেমিক ভবন-২’ এর দ্বিতীয় ফ্লোরে বসে আছে। সবার মধ্যে একরাশ ভয় ও মাথাভর্তি চিন্তা! কোন জরুরি তলবে মম ওদের একত্রে ডেকেছে কেউ জানেনা। সময় ঠিক মিনিট দশেক পেরুলো বৈকি, দরজা খুলার আওয়াজ ওরা সবাই শুনতে পেলো। সবাই দেখলো মম শান্তমুখে এদিকে আসছে। মম কাধের ব্যাগটা লোবেন্ঞ্চে রেখে ওদের সাথে নিজেও হাইবেন্ঞ্চে উঠে বসলো। জেনি সবার প্রথম বলে উঠলো,
— তুমি আমাদের ডেকেছো কেন?
— দরকার আছে তাই ডেকেছি। তোমাদের সকলের সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে এজন্যই প্রাইভেট বৈঠকে বসা!
রিমি বৈঠকের নাম শুনেই ফট করে বললো,
— কি বিষয়ে বৈঠক? কি বলতে চাও?
— রিল্যাক্স! সব খুলে বলছি। মুগ্ধ এব্রর্ড চলে গেছে কথাটা সত্যি?
রামিম বললো,
— চলে গেছে সত্যি। বট এব্রর্ডের ব্যাপারে সিউর না। মুগ্ধ যাওয়ার আগেরদিন আমার সাথে দেখা করেছে।
জোরে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। মুগ্ধের যাওয়ার নিউজ আমার কান পযর্ন্ত এলোনা এমন কি হলো ওর সাথে? জেনি আমার হাতের উপর ওর হাতটা রাখলো। আমি কিছুটা অবাক চোখে ওর দিকে তাকালাম। রিমি ওর ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতলটা এগিয়ে বললো, ‘পানি খাও।’ আমি বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেলাম। জেনি নম্রকন্ঠে বলে উঠলো,
— জানি তুমি কেমন পরিস্থিতির মধ্যে আছো। দেখো আমি মেয়ে আমিও বুঝি। তোমাকে আগে ঘৃনা করলেও তুমি কিন্তু মোটেও খারাপ না। উল্টো আমি মনে করি তুমি খুব ভালো। আমরা তোমার সাথে খারাপ আচরন করেছি। নিজের উপর ঘেন্না হয়।
রিমি বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
— মুগ্ধের এমন স্টেপে আমারই রাগ লাগছে মম। সামনে থাকলে দুটো থাপ্পর দিতাম। তুমি প্লিজ স্ট্রং হও। ভেঙ্গে পড়াটা জাস্ট তোমার সাথে যায়না।
কিছুকালব্যাপী নিরবতা কাটতেই রামিম ব্যস্ততার সুরে বলে উঠলো,
— ভাবী? আপনি চাইলে আমি বসের লোকেশন বের করতে পারি। শুরু করবো?
আমি মুখ তুলে রামিমকে কিছু বলবো তার পূর্বেই জেনি ও রিমি একসঙ্গে বলে উঠলো,
— কর! ইডিয়েট!
— যো হুকুম মেরে আকা! আমি মুগ্ধের লোকেশন বের করতে রওনা দিচ্ছি! কেমন?
৬.
‘ঢাকা-টু-গাজীপুর’ রোডে রওনা হয়েছি আমরা! গাড়িটা রিমির। রিমির ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। রিমি, জেনি দুইপাশে এবং আমি মাঝখানে বসে আছি। রামিম ড্রাইভারের পাশের সিটে। জেনির অবস্থা ভালো না, বমি করতে করতে শেষ। এতোবার বমি করলে কেউ সুস্থ থাকে? আমার কাধে মাথা হেলিয়ে জেনি ঘুমিয়ে আছে। মুগ্ধ কোনো এব্রর্ডে যায়নি, ও দেশেই আছে। আজ মনটা কেমন শান্তি লাগছে বলতে পারছিনা। যারা জেনি, রিমি, রামিমদের কখনো সহ্য করতো না, ভালো বলতো না…আজ এই মানুষগুলো নিজেদের সুধরে ফেলেছে। মানুষের ভালো হতে সত্যি কোনো সময় লাগেনা। লাগে একটা সুযোগ! সুযোগের সৎব্যবহারে মানুষ হতে পারে সর্বোত্তম।
গাড়িটা গাজীপুরের কলেজরোড সড়কে থামলো। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে একটা গলি ধরে হেঁটে যাচ্ছি। সরু একটা গলি, মেটো রাস্তা, ছিমছাম নিরিবিলি, মানুষজন খুব কম। রামিম আগেভাগে এসে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। জেনির খুব নাজুক অবস্থা, গাড়ি থেকে নামতেই দুইবার বমি করলো। রিমি ও আমি জেনিকে ধরে ধরে নিয়ে এসে বাড়িটার সামনে আসলাম। রামিম পকেট থেকে ফোনটা বের করতে বলে উঠলো,
— জেনি? তুমি কি খুব অসুস্থবোধ করছো? হসপিটালে নিয়ে যাবো?
জেনি থেমে থেমে অসুস্থ গলায় বললো,
— না রামিম। এখন হসপিটাল না। আ’ম ফাইন। তুমি প্লিজ আমার জন্য মুগ্ধের খোঁজ বন্ধ করোনা।
— ওকে।
রামিম ফোনের স্ক্রিন থেকে বাড়িটার ঠিকানা মিলিয়ে আমাদের দিকে ইশারা করলো পিছু পিছু আসতে। রামিম দরজায় কলিংবেল দিয়ে লুকিং মিররে হাত রেখে ঢেকে দিলো। জেনি খুব দূর্বল। সম্পূর্ণ ভর আমাদের দুজনের উপর ছেড়ে দিয়েছে। আরো কয়েকটা বেল দিতেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো একজন পুরুষ। তার চোখেমুখে কৌতুহল। লোকটা জিজ্ঞেস করলো,
— জ্বি? আপনারা কে?
— একচুয়েলি আমরা আমাদের এক বন্ধুকে খুজতে এখানে এসেছি। এইযে দেখুন ছবিটা..ছেলেটাকে দেখেছেন? এর নাম রাদিফ মুগ্ধ। ঠিকানা পেয়েছি ও এই বাড়িতে থাকে।
লোকটা রামিমের ফোন থেকে মুগ্ধের ছবিটা তীক্ষ্মভাবে পরোখ করলো। গলায় আশ্চর্য ভাব এনে বললো,
— এই ছেলের নাম মুগ্ধ?
— জ্বী আঙ্কেল। আপনি চেনেন? চিনলে প্লিজ বলবেন ও কোথায় আছে?
— এই ছেলে তো এখানে থাকেনা। কিন্তু হ্যাঁ তোমরা যেই নামটা বলেছো সেই নামে একজন এখানে থাকে। রাদিফ মুগ্ধ নাম।
রামিম পিছু ফিরে আমাদের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে আছে। রিমি ও আমি দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাইয়ি করলাম। মুগ্ধ আমাদের বিরাট গুল খাইয়েছে। গাড়ির কাছে ঘুরেফিরে উপস্থিত হলাম । জেনি খুব অসুস্থ বিধায় ওকে রিমির গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সাথে রিমির যাওয়ার কথা থাকলেও রিমি আমাকে একা শহরে ফেলে যাবেনা। কাজেই ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জেনিকে। আশেপাশের সব কয়টা বাসাবাড়ি ও অলিগলিতে ঢুকে তিনজন মিলে মুগ্ধের সন্ধান করলাম। কিন্তু কোনো হদিশ মেললো না! কেউ ওকে চিনেনা, জানেনা, দেখিনি আদৌ! দুপুরের কোল গড়িয়ে রাত্রির আধারে চারপাশ আচ্ছন্ন হতেই মাগরিবের আযান শুনছি।। ক্লান্ত শরীরে খিদা পেটে তিনজন গেলাম এসিওয়ালা রেস্টুরেন্টে। রামিম হোয়াইট সস পাস্তা খাচ্ছে, রিমি খাচ্ছে রামেন। আমি বসে বসে চাওমিনের কাটাচামচ ঘুরাচ্ছি। গলা দিয়ে খাবার নামছেনা একদমই। রামিম চামচভর্তি পাস্তা নিয়ে মুখে পুড়তেই বলে উঠলো,
— ভাবী? ফিরে যাবেন? মুগ্ধকে তো পাওয়া গেলো না।
রিমি রাগী সুরে চেচিয়ে বললো,
— তুই মুগ্ধকে পাসনি বলে ফিরে যাবো? এতো সহজ?
— রিমি তুমি থামবে! আমার উপর চিল্লাচ্ছো কেন? আমি কি জানতাম? মুগ্ধ আমাদের বাশঁ খাওয়াবে!
আমি দুজনকে থামিয়ে বলে উঠলাম,
— প্লিজ গাইজ অফ যাও! তর্কবিতর্ক শুরু করো না!
— ভাবী! আপনিই বলুন এখন আমরা কি করবো? রাতে নাহয় হোটেলে থাকলাম বাট? মুগ্ধ যদি এখানে নাই থাকে! আমাদের থেকে কি লাভ?
— রামিম শেষবারের মতো ওই বাড়িটা আবার চেক দিবে? আমার ইনটুশেন বলছে মুগ্ধকে ওই বাড়িতেই পাবো।
রিমি ও রামিম দুজন খাবারটুকু শেষ না করে বিল পে করে উঠে দাড়ালো। আমরা আবার ফিরে গেলাম ওই বাড়িতে। এবার একটা কৌশল করে আগে আমি কলিংবেল টিপলাম। মুখে সার্জিকাল মাস্ক পড়েছি যাতে চিনতে না পারে। লোকটা দরজা খুলে একইভাবে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে আমি লোকটাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকে যাই! লোকটা তেড়ে আসতে নিলে পেছন থেকে রামিম ও রিমি লোকটার হাত ও মুখ বেধেঁ দরজা লাগিয়ে দেয়। আমি সবকয়টা রুমে ঢুকে চেক করছি। ওরা লোকটাকে ধরেবেধে সোফার রুমে বসে আছে। প্রায় সব রুম চেক হলেও কোণাচে একটা রুম দেখা এখনো বাকি। আমি সেদিকে পা বাড়িয়ে দরজা খুলে উকি দিতেই কেউ ঘুমাবস্থা কন্ঠে ‘কে? কে?’ করে উঠলো! অলৌকিকভাবে সমস্ত শরীর হিমবাহে কেপে উঠলো! বুকের মধ্যে ধুকপুকনি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। শ্বাস নিতে যেয়েও গলা ধেয়ে আসছে। শ্বাস নিতে পারছিনা আমি। মুখের মাস্ক খুলারও শক্তি পাচ্ছিনা। প্রচুর দূর্বল লাগছে, জেনির থেকেও দূর্বল! হাটুর নিচ থেকে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে।
— হু আর ইউ! টেল মি! কে তুমি!
আমি মুখ থেকে মাস্ক খুলতেই মুগ্ধের চক্ষুতারা সজাগ হয়ে উঠলো! তোতলিয়ে বলে উঠলো,
— পাকনি..
মুগ্ধকে দেখে একদৌড়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। ফুপিয়ে কেদেঁ চলছি অনবরত। আজো ওর গা খালি কিন্তু নির্দিধায় দুহাতে চেপে ধরেছি। মুগ্ধ বারবার হতবিহ্বল সুরে বলে উঠছে,
— পাকনি তুমি ভেতরে ঢুকলে কিভাবে? তুমি চলে যাওনি..
আমি চুলে হাত ডুবিয়ে কাধে কপাল লাগিয়ে কাদছি। ওর কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিনা। মুগ্ধ মাথায় হাত বুলিয়ে চোখবন্ধ করে বলে ঊঠলো,
— চুপ কর। চুপ চুপ…
-চলবে
#ফাবিয়াহ্_মম
(ডাটাপ্যাকের তাড়নায় গল্প দিতে দেরি! এক্সট্রা একটা সরি!)
-চলবে
#ফাবিয়াহ্_মম
(ডাটাপ্যাকের তাড়নায় গল্প দিতে দেরি! এক্সট্রা একটা সরি!)