. #মেঘের_বিপরীতে
পর্বঃ ১৩+১৪
শুক্রবারের শুরুটা অন্যসব বারের মতো হয় না। একটু আলাদা হয়। এইদিনে ব্যস্ততা তুলনামূলক কম থাকে। খুব সকালে ঘুম থেকে না উঠলেও চলে। ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার তাড়া নেই। চাকুরীজীবীদের অফিসে যাওয়ার ভেজাল নেই। তাই মন মানসিকতা স্বাভাবিক থাকে। ব্রেনেও চাপ পড়ে কম।
অর্চিতার ঘুম ভাঙ্গলো শাহরিনের ফোনে। দুপুরে তাদের বাসায় যেতে বলছে অর্চিতাকে। একসাথে লাঞ্চ করবে। শাহরিনের কন্ঠে উদ্দীপনা স্পষ্ট। অবশ্যই কিছু হয়েছে। আর সেটা অর্চিতার সাথে শেয়ার করতে চায় সে।
আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা আবহাওয়া। ঘুম ঘুম পরিবেশ। অর্চিতা ঘড়ির দিকে তাঁকালো। নয়টা বাজে। এমন আবহাওয়ায় বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। তার এখন ইচ্ছে করছে ঘন্টাখানিক আরো ঘুমিয়ে নিতে। তারপর ফ্রেশ হয়ে এক মগ কফি বানাবে। জানালার পাশে বসে কফি খাবে। মাকে বলবে দুপুরে ঢিলা খিচুড়ি রান্না করতে। মেঘলা আবহাওয়ায় ঢিলা খিচুড়ির ওপর আর কোনো খাবার হতেই পারে না! এই খিচুড়িতে পানির পরিমাণ বেশি দেওয়া হয়।ট্যালট্যালে হয়। একেক এলাকায় এই খিচুড়ি একেক নামে পরিচিত। অর্চিতার মা বলে ঢিলা খিঁচুড়ি। এই খিঁচুড়ি উপভোগ করতে চাইলে এক চামচ আচারই যথেষ্ট। অর্চিতা উঠে জানালা খুলে দিলো। সাথে সাথে দমকা হাওয়া তার চোখে মুখে আছড়ে পড়লো। সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অনুভব করতে লাগলো।
“ঘুম ভাঙ্গলো?”
অর্চিতা পেছোন ফিরলো। রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি। কফি অর্চিতার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আমি তো ভেবেছি আজকে বারোটার আগে তোর ঘুমই ভাঙ্গবে না!”
অর্চিতা মগ হাতে নিয়ে বললো,
“এসবের কি দরকার ছিলো, মা?”
“তুই কফি পচ্ছন্দ করিস তাই ভাবলাম বানিয়ে নিয়ে আসি।”
“আমি নিজেও বানিয়ে নিতে পারতাম। ডাক্তার তোমাকে রেস্ট নিতে বলেছে।”
“এতদিন তো নিলাম। প্রতিদিন একভাবে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। আগামীকাল থেকে স্কুলে যাবো।”
“চৌদ্দ দিনের ছুটি নিলে। এক সপ্তাহ হলো কি হলো না আগামীকালই ক্লাস নিতে যাবে?”
রেবেকা করুন কন্ঠে বললো,
“দেখ মা, পড়ানোর বিষয়টা কেমন যেনো নেশার মতো। আমি যখন ক্লাসে ঢুকবো, বাচ্চাগুলোর মুখ দেখবো, মার্কার দিয়ে হোয়াইট বোর্ডে লিখবো আমার অসুস্থ্যতা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তুই আমাকে না করিস না।”
অর্চিতা হাসিমুখে এগিয়ে আসলো। মাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আচ্ছা যেও। কিন্তু সাবধানে।”
রেবেকাও হেসে বললেন,
“ঠিকাছে। এখন তুই কফি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। ঢিলা খিঁচুড়ি রান্না করেছি। গরম গরম না খেলে কিন্তু মজা লাগবে না।”
অর্চিতা অবাক হয়ে বললো,
“ঢিলা খিঁচুড়ি রেঁধেছো? আমি আরো তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম দুপুরে রান্না করো। আমি হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিতাম। কিন্তু শাহরিন ফোন করে ওর বাসায় লাঞ্চের দাওয়াত দিলো।”
“এখন আবার ধানমন্ডি যাবি?”
অর্চিতা মগে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,
“ঢিলা খিঁচুড়ি না খেয়ে যাচ্ছি না।”
রেবেকা হেসে ফেললো। মায়ের গালে চুমু দিয়ে মগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি টেবিলে বসো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
রেবেকা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অর্চিতা ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
অন্যদিন জ্যামের কারণে গুলশান থেকে ধানমন্ডি যেতে প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো লেগে যায়। জ্যামের পরিধি বৃদ্ধি পেলে কখনো কখনো আরো বেশি সময় লাগে। আজ রাস্তা বেশ ফাঁকা। গুলশান থেকে শাহরিনের বাসায় পৌঁছাতে অর্চিতার ঠিক বিশ মিনিট লেগেছে।
শাহরিন সাদা রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পড়েছে। তাকে খুব পবিত্র দেখাচ্ছে আজকে।
সে লাজুক কন্ঠে বললো,
“আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।”
অর্চিতা উত্তেজিত হয়ে বললো,
“কনগ্রেচুলেশনস। জিসানের বাসা থেকে প্রপোজাল পাঠিয়েছে?”
“না।”
অর্চিতা বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলো। সে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“মানে বুঝলাম না। বিয়ের কথা চলছে আবার জিসানের বাড়ি থেকে প্রপোজাল পাঠায় নি! ঘটনা কি?”
শাহরিন অর্চিতার গায়ে চিমটি কেটে বললো,
“মানেটা খুব সহজ। আমি জিসানকে বিয়ে করছি না। যার সাথে বিয়ের কথা চলছে সে বাবার বন্ধুর ছেলে।”
অর্চিতা যেনো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলছে। ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে আছে। শাহরিন নিজের মতো বলে চলেছে,
“ছেলে নিউ ইয়র্ক থাকে। সরকারি চাকরি করে। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। প্রচুর টাকা পয়সা। এই ছেলেকে বিয়ে করলে ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
অর্চিতা বললো,
“জিসানও তো চাকরি খুঁজছে। পাশাপাশি এমবিএ টাও করে ফেলছে। দুইটা বছর অপেক্ষা করে দেখ। ভবিষ্যতে ও হয়তো আরো ভালো কিছু করবে।”
শাহরিন সহজ গলায় বললো,
“এতদিন অপেক্ষা করা সম্ভব না। তাছাড়া আমি এতদিন প্রেম করে যা বুঝেছি জিসান নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে মোটেও সিরিয়াস না। এখন কি এরকম অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে? প্রেম করা আর বিয়ে করা এক না। বয়ফ্রেন্ড হিসেবে জিসান পার্ফেক্ট ছিলো, হাজবেন্ড হিসেবে পার্ফেক্ট না।”
অর্চিতা হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না। শাহরিনের এই সিদ্ধান্ত তার মোটেও পচ্ছন্দ হয় নি। জিসান ছেলেটা শাহরিনকে অনেক ভালোবাসে। প্রেমিকার বিয়ের খবর শুনে তার অবস্থা কি হবে কে জানে! হয়তো কান্নাকাটি করবে। কয়েকদিন পাগলামি করবে। তারপর বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। সাথে নিয়ে যাবে কিছু খারাপ স্মৃতি। মেয়েরা ভালো না, গোল্ড ডিগার এই জাতীয় ধারণা। শাহরিন সাউন্ড বক্সে গান বাজাচ্ছে। সব ওয়েস্টার্ন সং। একটু পর পর গানের সাথে নিজের গলা মেলাচ্ছে। তাকে অন্যদিনের তুলোনায় আজ অনেক বেশি উত্তেজিত দেখাচ্ছে। অবশ্য দেখানোটা অস্বাভাবিক নয়। বিয়ে ঠিক হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত ছেলে। শাহরিন নিজেও অসম্ভব সুন্দরী। গ্র্যাজুয়েশন শেষ। যেকোনো ছেলে তাকে পচ্ছন্দ করতে বাধ্য। শাহরিন অর্চিতার পাশে এসে বসলো।
“আন্টির শরীর এখন কেমন?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
“রিপোর্ট ভালো এসেছে তো?”
“হুঁ। সব নরমাল।”
“সেদিন তোর বস আন্টিকে দেখতে গিয়েছিলো তাই না?”
অর্চিতা বললো, “হুঁ। গিয়েছিলো। এডভান্স দিতে।”
“তোর বস নিজের থেকে দেখতে গিয়েছে। আবার এক মাসের এডভান্স ও নিয়ে গিয়েছে। এত যত্নশীল! দেখিস এর পেছোনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেনো না থাকে।”
“কেমন উদ্দেশ্য?”
“মনে কর বাড়িতে বউ না থাকলে তোকে ডেকে নিবে। তুই বসের কপালে হাত বুলিয়ে দিবি।”
“এসব কি বলছিস?”
“আরে মজা করছি।”
অর্চিতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তবে শাহরিনের কথা একদম ফেলে দিতে পারলো না। দুপুরে বেশ জম্পেস খাওয়া দাওয়া হলো। শাহরিনের মা অনেক ভালো রাঁধুনি। চিকেন বিরিয়ানি রান্না করেছেন। সাথে ফ্রুট সালাদ।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর শাহরিন অর্চিতাকে নিয়ে ছাদে গেলো। শাহরিনের মা ছাদে ছোটখাটো সবজি বাগান করেছেন। কিছু ফলের গাছও লাগিয়েছেন। ছাদের এক কোণায় ক্যাকটাসের মতো একটি গাছ দেখতে পাওয়া গেলো। দুটো গাঢ় গোলাপি রঙের ফল ঝুলে আছে। ফলগুলো দেখতেও অন্যরকম। অর্চিতা কোক খেতে খেতে বললো,
“ওটা ড্রাগন ফ্রুট না?”
“হ্যাঁ।”
“খেয়েছিস আগে কখনো?”
“না। তবে শুনেছি কোনো স্বাদ নেই।”
“খেয়ে দেখবি?”
“না। ইচ্ছে করছে না। আমার চলে যেতে হবে।”
“এখনি? মাত্র সাড়ে চারটা বাজে।”
“আজ শুক্রবার। পুরো সপ্তাহ রোবটের মতো খাটার পর মানুষজন বউ বাচ্চা নিয়ে মুক্ত বাতাসের খোঁজে বের হবে। একবার জ্যামে পড়লে আজ আর বাসায় যেতে হবে না।”
“কথা খারাপ বলিস নি। এই কংক্রিটের বিল্ডিং এ জীবন যাপন করা খুব কষ্টের।”
অর্চিতা হেসে বললো,
“যেখানে বিয়ে বসতে যাচ্ছিস সেখানকার জীবন যাপন আরো কঠিন। চাইলেই মা-বাবাকে দেখতে পারবি না। কাজের মানুষের সাহায্য পাবি না।”
শাহরিন কপাল কুঁচকে বললো,
“তাও। আমেরিকা তো আমেরিকাই।”
অর্চিতা এগিয়ে এসে শাহরিনের হাত ধরে বললো,
“তোর খুশিতেই আমরা সবাই খুশি। কিন্তু বিয়ে মানুষ একবারই করে। একটা মানুষ সারাজীবন তোর সাথে থাকবে। সুখ, দুঃখের ভাগীদার হবে। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় রে। অনেক বিবেচনা করতে হয়। নিজের অপছন্দকে পছন্দে পরিণত করতে হয়। তাই যে সিদ্ধান্তই নিবি একটু ভেবে নিস! কেমন?”
শাহরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্চিতাকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড পর অর্চিতা বললো,
“এখন ছাড়! সন্ধ্যা নেমে আসবে একটু পর। আমার যেতে হবে।”
শাহরিন অর্চিতাকে ছেড়ে দিলো। তার চোখের কোণায় পানি। অর্চিতা অবাক হয়ে বললো,
“কাঁদছিস কেনো?”
শাহরিন বললো,
“ভালো বন্ধু পাওয়া অনেক বড় ভাগ্যের বিষয়। যেটা আমি পেয়েছি। তোকে অনেক মিস করবো।”
অর্চিতা শাহরিনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “আমিও করবো। আর কোনো কান্নাকাটি না। এখন আমাকে যেতে দে। আসছি।”
শাহরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। অর্চিতা আর কথা বাড়ালো না।
শাহরিনদের বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে সোজা ধানমন্ডি সাতাশ এ চলে এলো। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। গুলশান যেতে যেতে অন্ধকার নেমে আসবে। আজকাল সন্ধ্যায় লোকাল বাসে যাতায়াত করাও বেশ ভয়ের। বাসের যাত্রী থেকে শুরু করে বাস কন্ট্রেকটারও এমন ভাবে তাঁকিয়ে থাকে, যেনো চোখ দিয়ে একটি নারী শরীর ভোগ করা গেলে তারা তা করতে একটুও দ্বিধা বোধ করতো না। বেশ কিছুক্ষণ পর বাস পাওয়া গেলো। অর্চিতা ভয়ে ভয়ে বাসে উঠলো। বাসে অনেক মহিলা যাত্রী রয়েছে। এদের বেশিরভাগ গার্মেন্টস কর্মী। অর্চিতার ভয় কেটে গেলো।জানালার পাশের একটি সীট ফাঁকা পাওয়া গেলো। সেখানে গিয়ে বসলো। বাস ছেড়ে দিয়েছে। অর্চিতা সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মাথা ব্যাথার উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আগামীকাল থেকে ছয় দিন আবার ভোর সাতটায় উঠতে হবে। অফিস যেতে হবে। রোজগার করা কত কষ্টের। টাকা পকেটে এনে জমাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। সময় লাগে। অথচ ব্যয় করতে সময় বা পরিশ্রম কোনোটার প্রয়োজনই পড়ে না।
(চলবে…)
. #মেঘের_বিপরিতে
(পর্বঃ ১৪)
গ্রামের বাড়িতে আজ নন্দিতার শেষ দিন। আগামীকাল সে ঢাকা ফিরে যাবে। তার একটি বিশেষ কারণ আছে। আগামীকাল রেহালের জন্মদিন। অবশ্য, জন্মদিন নিয়ে এতটা উৎসাহী হওয়ার কিছু নেই। প্রতিটি জন্মবার্ষিকী মানে মৃত্যুর এক ধাপ নেকট্যে গমন। তবুও, নন্দিতা ছাড়া রেহালের ঢাকায় কেউ নেই। এই দিনে মেয়েটা ভালো মন্দ রান্না করে। পুরো বাসা নিজের মতো করে সাজায়। এবার সে রেহালকে না জানিয়ে ঢাকা ফিরবে। তাকে সারপ্রাইজ দিবে।
তবে আজকে সারাদিন নন্দিতার অনেক কাজ। দুপুরে কলাপাতায় চড়ুইভাতি খাওয়া হবে।বিকালে ঘুড়ি উড়ানো হবে। আর রাতে নাইফ মুরগীর বার-বি-কিউ করে খাওয়াবে। রান্নার দায়িত্ব আবার পড়েছে নন্দিতার কাঁধে। উঠোনে মাটির চুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নাইফ কিছু শুকনো কাঠ আর বাঁশের কঞ্চি এনে দিয়েছে। তা দিয়ে মাটির চুলো জ্বালানো হয়েছে। খিচুড়ি, ডিম এবং বেগুন ভাজি করা হবে। নন্দিতা রান্নায় যে খুব পারদর্শী তা নয়। তবে যখন যেটাই রান্না করে, যত্ন নিয়ে করে। খেতে মজা হয়। বড়রাও এই চড়ুইভাতিতে অংশগ্রহণ করছেন। নন্দিতার দুই চাচা এবং চাচী চলে এসেছেন। ড্রইংরুমে তিন ভাই মিলে আলোচনা করছেন। সবই রাজনৈতিক আলাপ। কোন সরকার বাংলাদেশের জন্য কি করেছে? সাধারণ নাগরিকদের প্রতি কোন সরকারের অবদান অধিক? এ জাতীয় কঠিন সব বিষয়। শারমিনের ঘরে তিন জা এর আড্ডার আসরও আজ জমে উঠেছে। তারাও আলোচনা করছেন। তবে সব সাংসারিক আলাপ। নাইফের বিয়ের বিষয় নিয়েও কথা হচ্ছে। ছেলে আংশিক রাজী হয়েছে।
পুরোপুরি রাজী কিভাবে করা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে।
নন্দিতা ডিমের তরকারি রেঁধে ফেলেছে। এবার বেগুন ভাজবে। মিতিকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কলাপাতা জোগাড় করতে গিয়েছে। বেগুন কেটে ধুয়ে রাখা আছে। কিন্তু পানি এখনো ঠিকমতো ঝরে নি। উঠোনে দুটি শালিক পাখি অনেকক্ষণ ধরে লাফাচ্ছে। নন্দিতার আশেপাশে উড়াউড়ি করছে। নন্দিতা উঠে রান্নাঘরে গেলো। পাতিল থেকে কিছু সাদা ভাত হাতে নিয়ে এলো। উঠোনে ছিটিয়ে দিয়ে আগের স্থানে গিয়ে বসলো। পাখি দুটো এবার ভাতের দানা গুলো খুঁটে খেতে লাগলো। নন্দিতা অন্যমনস্ক হয়ে গরম তেলে বেগুন ছেড়ে দিলো। সাথে সাথে গরম তেল ছিঁটে এসে তার হাতে পড়লো।
নাইফ সবেমাত্র মুরগী কিনে বাজার থেকে এসেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই সে নন্দিতার আর্তনাদ শুনতে পেলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বললো,
“কি হয়েছে?”
নন্দিতা শাড়ির আঁচলে হাত ঢেকে ফেললো। হাসার চেষ্টা করে বললো,
“তেমন কিছু হয় নি। সামান্য তেল ছিটে এসেছে।”
নাইফ দেখলো নন্দিতার চোখ ছলছল করছে। গ্রামে বড় হলেও তাকে খুব একটা কাজ করতে দেওয়া হতো না। নন্দিতা একটু অসুস্থ্য হলে রফিক সাহেব ডাক্তার আনতে চলে যেতেন। শারমিন মেয়ের মাথার পাশে বসে চোখের পানি ফেলতেন। তাকে ননীর পুতুল বলে আখ্যায়িত করা হলেও ভুল হবে না। সেই মেয়ে মাটির চুলায় রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলবে, বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়।
নাইফ কোনো কথা না বলে হনহন করে বাড়িতে ঢুকে গেলো। ফিরলো বরফ হাতে নিয়ে।
“দেখি হাত দে।”
নন্দিতা অবাক হয়ে বললো, “কেনো?”
“তুই বড্ড বেশি কথা বলিস!”
একথা বলে নাইফ নন্দিতার হাত ধরে নিজের দিকে এগিয়ে নিলো। বেশ কিছু জায়গায় লাল হয়ে গেছে। ফোসকা পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি বরফ চেপে ধরলো। নন্দিতার শরীর কেঁপে উঠলো। হালকা জ্বালাপোড়া করছে। নাইফ মাথা নিচু করে বসে আছে। নন্দিতাও কোনো কথা বলছে না। নাইফের দিকে অপলকে তাঁকিয়ে আছে। হয়তো কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ বেগুন পুড়ে যাওয়ার তীব্র গন্ধ দুজনের নাকে এসে লাগলো। নন্দিতা ব্যস্ত হয়ে অন্য হাতের খুন্তি দিয়ে বেগুন উলটে দিলো। নিজের হাত ছাঁড়িয়ে নিতে চাইলো। নাইফ বাঁধা দিলো।
“তুই এখানে বোস। হাতে বরফ ঘষতে থাক। আমি বেগুন ভেজে দিচ্ছি।”
“না, না। তোমার ভাজতে হবে না। আমি ভাজতে পারবো।”
“কথা না বলে চুপটি করে পাশে বসে থাক।”
নন্দিতা আর কথা বাড়ালো না। জায়গা বদল করে নিলো। নাইফের রান্নার হাত ভালো। ছোটবেলায় যে কয়বার চড়ুইভাতি খাওয়া হয়েছে, হয় নন্দিতার বড় চাচী রান্না করেছে নাহয় নাইফ। নন্দিতা হাতে বরফ ঘষতে ঘষতে বললো,
“নাইফ ভাই, আমাদের হবু ভাবী কিন্তু অনেক ভাগ্যবতী। তুমি রান্না করতে পারো। আবার সবার এত যত্ন নাও।”
“হবু ভাবী মানে?”
“নেকামি করো না তো। ছেলে মানুষের নেকামি আমার একদম সহ্য হয় না।”
“নেকামি কোথায় করলাম?”
“মা বললো মেয়েকে দেখতে যেতে রাজী হয়েছো।”
নাইফ অবাক হয়ে বললো,
“দেখতে যাওয়া আর বিয়ের জন্য রাজী হওয়া এক?”
নন্দিতা অন্যদিকে তাঁকিয়ে বললো,
“এক না। তবে আমার মন বলছে তুমি রাজী হয়ে যাবে। মেয়েটির ছবি দেখেছি আমি।”
নাইফ কোনো উত্তর দিলো না। নন্দিতা উদাস কন্ঠে বললো,
“অপরিচিতার হরিশ যদি এই মেয়েকে দেখতো তাহলে নির্ঘাত বলিতো_ মেয়ে চলনসই।”
নাইফ নন্দিতাকে কঠিন কিছু বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তার আগেই কারো আগমন স্পষ্ট বোঝা গেলো। কলপাড়ে পানি পড়ার কলকল শব্দ আসতে লাগলো। মিতি কলাপাতা নিয়ে চলে এসেছে। নাইফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
বেগুন ভাজির পর চুলায় খিঁচুড়ি চড়ানো হলো। ধীরে ধীরে সবাই বাড়ির উঠানে চলে এলো। বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে দেওয়া হলো। উঠোনে ছায়া দেখে তিনটি চেয়ার ফেলা হলো। বাড়ির কর্তারা চেয়ারে বসে খাবেন। খিঁচুড়ি হয়ে গেছে। কলাপাতায় গরম গরম খিঁচুড়ি, বেগুন ভাজি আর ডিমের তরকারি পরিবেশন করা হলো। জহির খাওয়ার মাঝে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন,
“রান্না খুব মজা হয়েছে, নন্দিতা। পাঁকা রাঁধুনি হয়ে গেছিস দেখা যায়।”
রফিক উত্তর দিলেন,
“মেয়ের রান্নার ধাঁচ মায়ের মতো।”
জহির বললেন,
“শুধু রান্না কেনো ভাই? চেহারা, বাচনভঙ্গি সব ভাবীরটা পেয়েছে।”
জহিরের কথা শুনে আচমকা রফিক সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেলো। তার ছেলের কথা মনে পড়তে লাগলো। নন্দিতার বড় ভাই দীপু। ছেলেটা দেখতে একদম তার মতো হয়েছিলো। তখন গ্রামে প্রতিবছর শীতকালে বিশাল মেলা বসতো। অন্য গ্রাম থেকে লোকজন আসতো। দীপু খুব বেপরোয়া ঘুরাঘুরি করতো। একদিন বিকালে সে বন্ধুদের নিয়ে মেলায় ঘুরতে গেলো। আর ফিরে এলো না। নন্দিতা সেবার মাত্র দুই বছরে পদার্পণ করেছে। তার বড় ভাইয়ের বয়স ছিলো পাঁচ। নন্দিতার মা ছেলে হারানোর শোকে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। রফিক সাহেব কাজ কর্ম ফেলে দীর্ঘদিন বাড়িতে বসে ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে ছেলে হারানোর ক্ষত শুকিয়েছে। তবে ক্ষতের দাগ এখনো রয়ে গেছে। ছেলেটা কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানে না। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও অজ্ঞাত। শফিক ছোট ভাইয়ের অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। তিনি দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে বললেন,
“নন্দিতা, তাহলে আগামীকাল ফিরে যাচ্ছিস?”
“জ্বি চাচা।”
“রেহাল নিতে আসবে নাকি?”
“না ও আসবে না। আসলে ওকে না জানিয়ে ফিরছি চাচা।”
শফিক অবাক হয়ে বললেন,
“না জানিয়ে ঢাকা ফিরছো? কেনো? রাস্তাঘাটে কোনো বিপদ আপদ হলে?”
নন্দিতা লজ্জা পেয়ে গেলো। প্রত্যুত্তরে কি বলা উচিত খুঁজে পেলেও কিভাবে শুরু করবে তা ইন্দ্রিগ্রাহ্য হলো না। শারমিন হাসতে হাসতে বললেন,
“জামাই বাবার জন্মদিন আগামীকাল। মেয়ে আমার সারপ্রাইজ দিবে।”
শারমিনের কথা শুনে সবাই উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। শুধু নাইফ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। রোকেয়া বললেন,
“যাচ্ছো ভালো কথা। নাইফের বিয়েতে কিন্তু রেহালকে নিয়ে আসতেই হবে।”
নাইফ খাওয়া থামিয়ে বললো,
“মা, হচ্ছে কি এসব?”
রোকেয়া চুপসে গিয়ে বললেন,
“রাগ করিস কেন? বিয়েতে বংশের বড় জামাই আসবে না?”
“সেটা বলছি না। খাওয়ার সময়ও তোমাদের বিয়ে নিয়ে কথা বলতে হবে?”
জহির বললেন,
” ভাইস্তা দেখি এখনি লজ্জায় মরে যাচ্ছে! মেয়ে দেখতে গিয়ে তো কথাই বলতে পারবি না।”
নাইফ অসহায়ের মতো বসে রইলো। এদের সাথে বাক্যালাপে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। হাসি ঠাট্টায় মুখরিত হয়ে আছে পুরো বাড়ি। এত মানুষের ভীড়েও নন্দিতা কল্পনায় হারিয়ে গেলো। সে দেখলো তার পাশে রেহাল বসে আছে। তার চোখ লাল। ঠোঁট দুটো গোল করে ঝালে শোসাচ্ছে।
“ডিমের তরকারিতে এত ঝাল দিয়েছো কেনো?”
“গ্রামে সবাই ঝাল খায়। আজকের দিনটা একটু কষ্ট করে খাও?”
“এই যে কষ্ট করে খাবো প্রতিদানে কি পাবো?”
“কি চাও?”
রেহাল আরেক লোকমা মুখে নিয়ে বললো,
“যা চাই তাই দিবে?”
“হুঁ। যা চাও তাই দিবো।”
“ভেবে বলো।”
নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তোমার দুষ্টুমির স্বভাব কি যাবে না?”
রেহাল বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়লো। ছেলেটার ঠোঁট লাল হয়ে কাঁপছে। নাকের পানি চোখের পানি মিলেমিশে একাকার অবস্থা!
দুপুর পর্যন্ত বাতাসের বেগ খুব একটা ছিলো না। কিন্তু বিকাল হতে না হতেই দক্ষিণা বাতাস বইতে লাগলো। নন্দিতা মিতিকে নিয়ে মাঠে চলে এসেছে। বিশাল বড় মাঠ। একপাশে কিছু বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। আরেকপাশে মেয়েরা চিঁ বুড়ি খেলছে। বাচ্চাদের একেকটি দল একেক খেলায় মগ্ন। মাঠের পরেই ক্ষেত। নন্দিতা মিতিকে বললো,
“আমি মাঠে ঘুড়ি উড়াতে পারবো না।”
“তাহলে কোথায় উড়াবে?”
“ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে।”
“দৌঁড় দিতে পারবে?”
“আমি না পারলে তুই নাটাই হাতে দৌঁড় দিবি। চেষ্টা করে তো দেখি আগে!”
মিতি রাজি হলো। মাঠ পেরিয়ে ক্ষেতের সামনে দাঁড়ালো নন্দিতা। বাতাসে সবুজের ঢেউ খেলে যাচ্ছে চারিদিকে। নন্দিতা শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে কোমড়ে গুঁজে নিলো। মিতি ঘুড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নন্দিতা নাটাই থেকে কিছু সূতা আলগা করে নিলো। তারপর বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ক্ষেতের আইলের মাঝ দিয়ে দৌঁড় দিলো। ঘুড়ি উড়লো না। দ্বিতীয়বারের চেষ্টাও বিফলে গেলো। তৃতীয়বার ঘুড়ি আকাশ স্পর্শ করলো। নন্দিতা বাচ্চাদের মতো উত্তেজিত হয়ে গেলো। উচ্চস্বরে বলতে লাগলো,
“মিতি দেখ! ঘুড়ি উড়ছে! আমি পেরেছি উড়াতে।”
নীল আকাশের মাঝে লাল রঙের ঘুড়িটি উড়তে লাগলো। কয়েকটি পাখি ঘুড়িকে কেন্দ্র করে উড়ছে। মাঠ থেকে আরো কিছু বাচ্চা ছুটে এসেছে। নন্দিতার ঘুড়ি উড়ানো তারা অবাক হয়ে দেখছে। এই দৃশ্য তাদের কাছে বিরল। তাদের বয়সের দ্বিগুণ বয়সী কোনো মেয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে, আবার বাচ্চাদের মতো হট্টোগোল করছে এমন দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
নন্দিতা বাড়ি ফিরলো মাগরিবের আজান দেওয়ার একটু আগে। শাড়ি পালটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিলো সে। উঠোনে এখন বার বি কিউ এর জন্য চুলার প্রস্তুতি চলছে। নন্দিতার ছোট চাচী মরিয়ম আর রোকেয়া ঘরে রুটি বেলছেন এবং তার মা রুটি ভাজছেন। রফিক সাহেব বাজার থেকে কোক কিনে নিয়ে এসেছেন। বাড়ির উঠোনের লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া উঠেছে। নন্দিতা পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। আগামীকাল থেকে আবার সে কংক্রিটের দালানে বন্দী হয়ে যাবে। বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিতে পারবে না। খোলা মাঠে দৌঁড়াতে পারবে না। নৌকায় চড়ে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকতে পারবে না। নিজের বাড়িতে এতদিন সে মেহমান হয়ে ছিলো। মেয়েরা জন্মগত ভাবেই ঘর ছাড়া। তাদের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। বাবার বাড়ি অথবা শুশুড়বাড়ি কোনোটাই তার নিজের বাড়ি নয়। সে চাইলেও নিজের বলে দাবী করতে পারবে না।
(চলবে…)
পর্বটি কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাবেন।
লিখাঃ #আতিয়া_আদিবা