#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
নূর ভাইয়া আর আমি মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মারু আমাদের ক্রস করে ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে ড্রইং রুমের সোফায় বসে আপেল চিবুচ্ছে।
আমি দৌঁড়ে মারুর পাশে বসলাম। মারু ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে টিভির স্ক্রীনে তাকিয়ে আছে। আমি মারুর মাথায় গাড্ডা মেরে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,,,,,,
—–“আর ইউ ক্রেইজি মারু? জানিস তুই কতোটা অনর্থ করেছিস? মৃন্ময় ভাইয়া সাংঘাতিক রাগী। তোকে বাড়ির পিছনের শিমুল ফুলের গাছে বেঁধে বেধরক পিটাবে। তোর আর রক্ষে নেই।”
মারু আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা বেঁকিয়ে বলল,,,,,,
—–“আহা সে আমাকে পিটাবে আর আমি ললিপপ চুষব? সাহস আছে নাকি আমার গাঁয়ে হাত তুলার? এর আগেই আমি ওকে নিজের বশে করে ফেলব। তুই তো এই মারুকে খুব ভালো করেই চিনিস রে চাঁদু।”
কথাগুলো বলেই মারু আবারো টিভির স্ক্রীনে মনযোগ দিলো আমি ওকে বুঝানোর আশা ছেড়ে দিয়ে সোজা কিচেনে চলে গেলাম। নূর ভাইয়া পিছন থেকে চেঁচিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
—–“চাঁদপাখি….. সবজি আমি কাটব। প্লিজ তুমি ছুরিতে হাত দিও না। আমি জাস্ট দু মিনিটের মধ্যে আসছি।”
নূর ভাইয়া আর দাঁড়াল না। দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। আমি উনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। দুই মিনিটে উনি কি এমন কাজ করে আসবে তাই ভাবার চেষ্টা করছি। ধারালো ছুরিটা হাতে নিয়ে ও হাত থেকে রেখে দিলাম। তিন বছর আগের কথা মনে পড়ে গেলো। একদিন সন্ধ্যায় ডিম ভাজার জন্য পেয়াজ কুঁচি করছিলাম। ঐদিন সন্ধ্যায় নূর ভাইয়া বাড়িতে ছিলো। আমি ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটছিলাম, সাথে কাঁচা মরিচ ও ছিলো। আচমকাই ছুরি এসে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলে লেগে গেলো। অনেকটা জায়গাই কেটে যায়। আমি আবার চোখের সামনে রক্ত দেখতে পারি না। মাথাটা কেমন ঘুড়ে আসে। ঐদিন ও তাই হলো। মাথা ঘুরিয়ে ধপাস করে ফ্লোরে ছিটকে পড়ি। নূর ভাইয়া ড্রইং রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। কিছু এক্টা পড়ার আওয়াজ পেয়ে নূর ভাইয়া কিচেনে ছুটে এলো। এসেই দেখে আমি সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছি। সাথে হাত থেকে ও রক্ত পড়ছে। নূর ভাইয়া সাংঘাতিক ভয় পেয়ে আমাকে কোলে তুলে সোফায় শুইয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়, স্যাভলন লাগিয়ে। এরপর আমার চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে আমার হুশ ফেরায়। রাগ করে টানা দুই দিন নূর ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে নি। আমার দিকে ফিরে ও তাকায় নি। কারণ, আমি উনার কথা শুনি নি। উনি আমাকে বারণ করেছিলো কাটাকুটি না করতে, ছুরি না ধরতে। আমি শুনি নি উনার বারণ। তাই উনি ও বিপুল পরিমান রাগ নিয়ে আমার সাথে দুইদিন কথা বলে নি। দুই দিন পর নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলেছিলো। তবে ঐ দুইদিনে রোজ রাতে গিয়ে নূর ভাইয়া লুকিয়ে লুকিয়ে আমার রুমে ঢুকে আমার কপালে চুমো খেয়ে আসত। ভাবত আমি বুঝব না, গভীর তন্দ্রায় আছি। আদৌ কিন্তু না। আমি ঘুমোতাম না। ঘুমোনোর ভান ধরতাম। নূর ভাইয়ার ভালোবাসায় আমি কখনো রাগ, জেদ খুঁজে পাই নি। পেয়েছি খানিক অভিমান। তাও লোক দেখানো। আড়ালে কিন্তু অভিমানটা ও ছিলো ধোঁয়াশা।
পেছনে ফেলে আসা স্মৃতি গুলো খুব মধুর হয়। সুখের ও হয়। তবে আমার বর্তমানটা ও মধুর, সুখময়। নূর ভাইয়া যতো যুগ আমার পাশে থাকবে, তত যুগ আমি সুখে, শান্তিতে থাকতে পারব। নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারব। যেদিন শ্বাস থমকে যাবে ঐ দিন নিজেকে পুরোপুরি অন্ধকারে সোঁপে দিবো। নূরের আলো তখন আমার পিছু ছাড়বে।
এর মাঝেই নূর ভাইয়া হম্বি তম্বি হয়ে কিচেন রুমে ছুটে এলো। হাতে উনার জ্যাকেট। বিরক্ত লাগছে খুব। এই জ্যাকেট আনার জন্যই কি উনি উপরে গিয়েছিলো। উনার মনের ভাবটা যদি আগে থেকেই জানা থাকত তবে কখনো উনাকে উপরে যেতে দিতাম না। জোর করে আমাকে জ্যাকেটটা পড়িয়ে দিলো। নিজের কাছে নিজেকেই বিশ্রী লাগছে। এখন আমার ওজন মেবি দু কেজি বেড়ে গেছে। এতো ওজন নিয়ে আমি খুন্তি নাড়ব কি করে?
মুখটা ভাড় করে সাইডে দাঁড়িয়ে আছি। নূর ভাইয়া ফ্রিজ থেকে মাটন বের করল সাথে বড় রুই মাছ। পানিতে কিছুক্ষন ভিজিয়ে রেখে নূর ভাইয়া চিকেন গুলোতে লবন, হলুদ মেখে তেলে ছেড়ে দিলো। গাজর পিছ পিছ করে কেটে নূর ভাইয়া আমার মুখে পুড়ে দিচ্ছে আর বলছে,,,,,,
—-“চাঁদপাখি….তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি জাস্ট দেখো আর গাজর খাও।”
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাজর চিবুচ্ছি আর নূর ভাইয়ার রান্না দেখছি। বেশ ভালোই রাঁধতে পারে নূর ভাইয়া। পড়ালেখা করতে যখন দেশের বাইরে গিয়েছিলো, তখন উনি নিজের খাবার নিজেই রান্না করে খেতো। এক্টু, আধটু রাঁধতে রাঁধতে প্রায় অনেকটাই শিখে গেছে।
প্রায় এক ঘন্টা পর নূর ভাইয়ার সম্পূর্ণ রান্না শেষ হলো। এর মাঝেই বাড়ির গার্ডেনে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ হলো। বুঝতে পারলাম, বাড়ির বাকিরা ফিরে এসেছে। আমি কিচেন রুম থেকে দৌঁড়ে গেলাম সদর দরজার দিকে। দরজা খোলার জন্য। এর আগেই মারু হন্ত দন্ত হয়ে সোফা থেকে উঠে দৌঁড়ে গিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালো। মারু বাঁকা হেসে বলল,,,,,,
—-“চাঁদু বেইবি। তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি মৃন্ময়কে ওয়েলকাম করে আসি।”
কথাগুলো বলেই মারু চুলটা ভালো করে সেট করে দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মৃন্ময় ভাইয়া নিচের তাকিয়ে ফোনে কিছু এক্টা করছে। সামনের দিকে না তাকিয়ে মৃন্ময় ভাইয়া মারুকে ক্রস করে যেই না ড্রইং রুমে পা রাখতে যাবে অমনি মারু মৃন্ময় ভাইয়াকে এক পা দিয়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে নিলেই মারু ফের নিজেই ওর দুহাত দিয়ে মৃন্ময় ভাইয়াকে বাঁচিয়ে নিলো। মৃন্ময় ভাইয়া অস্থির দৃষ্টিতে মারুর দিকে তাকিয়ে আছে। মারু পিটপিট করে চোখ মেলে মৃন্ময় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,
—-“এমা….আমি না ধরলে তো আপনি এখনই পড়ে যেতেন। পুষ্টি জাতীয় খাবার দাবার খান না নাকি? শরীরে তো একদমই শক্তি নেই।”
মৃন্ময় ভাইয়া মারুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চোখ লাল করে মারুর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,,,,,,
—-“হাউ ডেয়ার ইউ? আপনার সাহস হয় কিভাবে আমাকে ল্যাং মারার? নিজেই আমাকে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন আবার নিজেই আমাকে বাঁচালেন? আপনার আসল মোটিভটা কি বলুন তো? তাছাড়া আপনি কে? দুপুর থেকেই দেখছি আমাদের বাড়িতে ঘুরঘুর করছেন। চা দোকানে আমার জন্য বাকি ও টুকে এসেছেন। হু আর ইউ ম্যান? হু আর ইউ?”
মৃন্ময় ভাইয়া রাগে ফুসছে। চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে গেছে। ভয়ে আমি ঢকঢক করে কাঁপছি। মারুর চোখে, মুখে কোনো ভয় দেখছি না। উল্টে ওর পুরো মুখে ভুবন ভুলানো হাসি লেগে আছে। আচমকাই মারু মৃন্ময় ভাইয়ার গাল দুটো টেনে আহ্লাদি কন্ঠে বলল,,,,,
—-“হাউ সুইট। রাগলে তো আপনাকে দারুন লাগে। ঠিক পুচকি এক্টা বাবুর মতো। আপনার গাল গুলো খুব সফট সফট। কেবল টেনে দিতে মন চায়।”
মৃন্ময় ভাইয়া রাগ ভুলে বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় দুই মিনিট পর মৃন্ময় ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,
—-“চাঁদদদদদ….এই মেয়েকে আমার চোখের সামনে থেকে সরা বলছি। আমি জাস্ট নিতে পারছি না। ভীষণ বিরক্ত লাগছে আমার। রাগের বশে কখন মাথা ফাটিয়ে দেই বলা যায় না।”
আমি দৌঁড়ে গেলাম মারুর কাছে। মারু এখনো খিলখিল হেসে মৃন্ময় ভাইয়ার গাল টানছে। আমি কিছুতেই একে টেনে মৃন্ময় ভাইয়ার কাছ থেকে সরাতে পারছি না। এক পর্যায়ে মৃন্ময় ভাইয়া রেগে আগুন হয়ে মারুর হাতে বসিয়ে দিলো এক কামড়। মারু তাড়াতাড়ি করে মৃন্ময় ভাইয়ার গাল থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিলো। হাতটাতে মৃন্ময় ভাইয়ার তিন দাঁতের দাগ পড়ে গেছে। মৃন্ময় ভাইয়া জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,
—-“সি ইজ টোটালী সাইকো। এই সাইকো মেয়েটা আমাদের বাড়িতে কি করছে চাঁদ?”
আমি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,,,,,,
—–“মৃন্ময় ভাইয়া….এ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মারু। আমার সাথে এসেছে এই বাড়িতে। কয়েকদিন থেকেই চলে যাবে।”
এর মাঝেই মারু চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,
—-“ইয়েস লাভ বাইট। মৃন্ময় আমাকে লাভ বাইট দিয়েছে। আস্তে আস্তে আমার ঠোঁটে চুমো ও খাবে। এরপর শুরু হবে ভালোবাসা বাসি, কাছে আসা আসি। চাঁদু রে….তোর বেস্টু শীঘ্রই তোর জা হবে।”
নূর ভাইয়া আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। মৃন্ময় ভাইয়া কপাল চাঁপড়াতে চাঁপড়াতে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে ঢুকে ঠাস করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আ’ম সিউর মৃন্ময় ভাইয়া এখন রুমে ঢুকে জিনিসপএ ছুড়াছুড়ি করছে। রাগে মাথার চুল টানছে। আমার ফ্রেন্ড বলে মারু এই যাএায় বেঁচে গেলো। না হয় ব্যাপারটা সাংঘাতিক পযায়ে যেতো।
মারু বাইটের দাগটাতে হাত বুলাচ্ছে আর দাঁত কেলিয়ে হাসছে। নূর ভাইয়া জোরে জোরে করতালি দিয়ে মারুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,
—-“বাঃহ শালী সাহেবা বাঃহ। প্রথম দিনেই ছকা মেরে দিলেন?”
মারু লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাথা নাঁড়ালো। দোলা আপু আর ফুফু মনি হনহনিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকল। দুজনই আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,,,,,
—-“শুধুমাএ তোর জন্য সাকিবের আজ এই অবস্থা হলো। ছেলেটা আধমরা হয়ে বেডে শুয়ে আছে। কি খারাপটাই না লাগছে আমাদের।”
আমি মাথাটা নিঁচু করে রেখেছি। নূর ভাইয়া তেড়ে এসে ফুফুমনি আর দোলা আপুকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,
—–“আম্মু, আপু শুনো। তোমরা যা বলার আমাকে বলো। কজ আমিই সাকিব ভাইয়াকে মেরেছি। চাঁদপাখি আমাকে শিখিয়ে দেয় নি সাকিব ভাইয়াকে মারার জন্য। তাছাড়া…… সাকিব যে অপকর্ম করেছে এর ফল ই হলো কেলানী। এবার অন্তত চরিএটা এক্টু ঠিক হবে।”
কথাগুলো একটানা বলেই নূর ভাইয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,
—–“যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্লিজ তোমরা খাবে চলো। এসব ভেবে আর কাজ নেই।”
নূর ভাইয়া একে একে সবাইকে টেনে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দিলো। ফুফু মনি আর দোলা আপু ভ্রু কুঁচকে মারুর দিকে তাকিয়ে আছে। মারু মুখটা বাঁকা করে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফুফু মনি আর দোলা আপু এতক্ষনে মারুকে খেয়াল করেছে। দোলা আপু মারুর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,,,,,,
—-“হু ইজ সি নূর? উনাকে তো চিনলাম না।”
নূর ভাইয়া কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম,,,,
—-“দোলা আপু… সিইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড মারু। আমার সাথে কয়েকটা দিন থাকতে এসেছে।”
দোলা আপু মুখটা বাঁকা করে বলল,,,,,,
—-“ওহ্ আই সি। খুব ভালো খুব ভালো। আরো দু, একজন বেস্ট ফ্রেন্ড থাকলে নিয়ে আসতে পারিস। আমরা মাইন্ড করব না। আমাদের অঢেল টাকা পয়সা। সারাজীবন এদের ফ্রি তে খাওয়ালে ও কমবে না।”
প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো আমার। কিন্তু কিছু বলছি না। নূর ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মারু চোখ, মুখ লাল করে কিছু বলতে নিলেই আমি ওর হাত ধরে থামিয়ে দেই। আমি এখনই চাইছি না কারো মুখোমুখি হতে। কোঁমড় বেঁধে নামতে চাই আমি। অনেক গুলো সত্য আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। যথেষ্ট প্রমাণ লাগবে। এর জন্য আমাকে আপাতত মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতে হবে।
মারু মাথাটা নিঁচু করে রেখেছে। বুঝতে পারলাম ওর ব্যাপারটা খুব খারাপ লেগেছে। নূর ভাইয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে দোলা আপুকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,
—–“আপু….তোর ঐ ছোট মনটা এখনো প্রশস্ত হলো না। সবসময় সংকীর্ণ ই থাকবে। একচুয়েলি তুই জানিস ই না কিভাবে কার সাথে কথা বলতে হয়। নিজেকে পাল্টা এখনো সময় আছে। শ্বশুড় বাড়ি গিয়ে অন্তত শ্বশুড়, শ্বাশুড়ীর সাথে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারবি। না হয় দিনের মধ্যে হাজারটা নালিশ আসবে এই বাড়িতে। শুধু পড়ালেখার দাগ থাকলেই তুই শিক্ষিত না, সৌজন্যতার দাগ ও থাকতে হয়। তবেই তুই শিক্ষিত।”
দোলা আপু চোখ মুখ লাল করে নূর ভাইয়াকে কিছু বলতে নিলেই ফুফুমনি দোলা আপুকে হাত দিয়ে থামিয়ে মারুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,,,,,,
—–“বাহ্ চাঁদের বেস্ট ফ্রেন্ড তো দেখতে ভারী মিষ্টি। মারু মা এখানে এসো। আমার পাশে বসো। ডিনার করবে।”
ফুফুমনির আচরণ আমার মোটে ও সুবিধের লাগছে না। মারু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার সম্মতি চাইছে। আমি মিষ্টি হেসে মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। মারু মলিন হেসে ফুফুমনির পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। নূর ভাইয়া আমার হাত ধরে মারুর পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো। নূর ভাইয়া আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার প্লেইটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। পর পর সবাইকে খাবার বেড়ে দিলো। রুই মাছের বড় পিস টা নূর ভাইয়া আমার প্লেইটে বেড়ে দিলো। দোলা আপু আর ফুফুমনির ব্যাপারটা ভালো লাগে নি। উনার রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি মাথাটা নিচু করে ফেললাম। সবাই নিজেদের মতো প্লেইটে খাবার নিচ্ছে। মারু বার বার উঁকি চুকি মেরে মৃন্ময় ভাইয়ার রুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছি মারু মৃন্ময় ভাইয়াকে খুঁজছে।
নূর ভাইয়া মাছের কাঁটা বেছে আমার প্লেইটের চারপাশে জড় করছে। মাছের কাঁটা বেছে খেতে আমার খুব বিরক্ত লাগে। বরাবরই আমি অলস। ইনিয়ে বিনিয়ে মাছের কাঁটা বেছে খাবার খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। বাড়ির গার্ডেনে আবারো গাড়ির হর্ণ বাজল। নূর ভাইয়া ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে সদর দরজাটা খুলে দিলো। নূর ভাইয়ার আব্বু আর সাকিব ভাইয়ার আব্বু নূর ভাইয়াকে ক্রস করে ড্রইং রুমে ঢুকল। দুজনই চোখ লাল করে নূর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সানোয়ার আংকেল মানে নূর ভাইয়ার আব্বু নূর ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,
—-“এটা তুমি কি করলে নূর? নিজের আপন চাচাতো ভাইকে এতোটা নির্মমভাবে পিটালে? বিবেকে বাঁধে নি তোমার?”
নূর ভাইয়া মাথাটা নিচু করে রেখেছে। সাকিব ভাইয়ার আব্বু মানে রেজাউল আংকেল গলার টাই টা টানছে আর কড়্ড়া কন্ঠে সানোয়ার আংকেলকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,
—-“ভাইয়া এভাবে চলতে থাকলে কিন্তু আমি বাধ্য হবো বাড়ি ছেড়ে চলো যেতে। যেখানে আমার ছেলে, বউ, মেয়ে সেইফ না সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।”
নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছি আমি। আমার জন্য ওদের ফ্যামিলিতে ভাঙ্গন ধরছে। মারু অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছি। ফুফু মনি আর দোলা আপু শকুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নূর ভাইয়া গলাটা ঝাঁকিয়ে রেজাউল আংকেলকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,
—–“চাচ্চু…. আমি মানছি আমি অন্যায় করেছি। বড় ভাইয়ার গাঁয়ে হাত তুলা আমার উচিত হয় নি। তবে অন্যায়কারীকে ও প্রশয় দেওয়া আমি শিখি নি। সাকিব ভাইয়া অন্যায় করেছে। উনি চাঁদপাখির সাথে জোর জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছিলো। এসব সইতে না পেরে চাঁদপাখি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। সাকিব ভাইয়াকে এই শিক্ষাটা দেওয়া খুব জরুরী ছিলো চাচ্চু। না হয় ভবিষ্যতে ও এই ভুলটা সাকিব ভাইয়া বার বার রিপিট করত। এতে অবশ্য আমাদের ফ্যামিলির মান সম্মান নিয়েই টান দিতো।”
রেজাউল আংকেল নূর ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,
—–“এক্টা বাইরের মেয়ের জন্য তুমি আমার ছেলের গাঁয়ে হাত তুললে? কি এমন আছে এই মেয়ের মধ্যে? যার জন্য তুমি আমার মেয়ে সানায়াকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছ না? আমার মেয়েটা কিন্তু তোমার জন্য প্রচন্ড পাগল নূর। এখনো সময় আছে নূর। চাঁদকে ছেড়ে সানায়ার প্রপোজালে রাজি হয়ে যাও।”
হেচকি তুলে কেঁদে উঠলাম আমি। তিন বছরে তাহলে এসবই চলছিলো। নিজের চাচাতো বোনকে বিয়ে করার ধুম চলছিলো। সানায়া আপু তাহলে সত্যি সত্যি নূর ভাইয়াকে ভালোবাসে? বুকের ভিতরটা কেমন যেনো জ্বলে জ্বলে উঠছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সব কষ্ট মেনে নেওয়া যায়। তবে ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারো সাথে মেনে নেওয়া যায় না। আমার কান দুটো আগুনের ফুলকির মতো গরম হয়ে আছে। কান দুটো এই অপ্রিয় সত্যটা মানতে পারছে না। ফুফুমনি আর দোলা আপু আমার দিকে তাকিয়ে মজা নিচ্ছে। দুজনই মনে মনে পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠেছে। মনে হচ্ছে ওরা বসে বসে কোনো কমেডি ফিল্ম দেখছে। আঁচ করতে পারছি আমি। মারু চোখের জল অলরেডি ছেড়ে দিয়েছে। নূর ভাইয়া নিজেকে শান্ত রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছে। কিন্তু হয়ে উঠছে না। নিজের মনের সাথে না পেরে নূর ভাইয়া রেজাউল আংকেলকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
—–“চাচ্চু…..চাঁদপাখি কোনো বাইরের মেয়ে না। চাঁদপাখি আমার মামাতো বোন প্লাস আমার ভালোবাসা। সানায়া আমার আপন চাচাতো বোন। সানায়ার দিকে আমি সবসময় বোনের দৃষ্টিতে তাকিয়েছি। এর বাইরে অর নাথিং। সানায়াকে আমি এই ব্যাপারে অনেকবার বুঝিয়েছি। এরপরে ও যদি সানায়া না বুঝে এতে আমার কিছু করার নেই। তোমাকে আমি ওয়ার্ণ করছি চাচ্চু। নেক্সট টাইম আমার চাঁদপাখিকে বাইরের মেয়ে বলবে না। মাথা গরম হয়ে গেলে তোমাদের সবাইকে আমি এই বাড়ি থেকে ঠেলে ঠুলে বের করে দিবো।”
সানোয়ার আংকেল চোখ, মুখ লাল করে নূর ভাইয়ার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,,,,,,,
—-“আমার ভাইকে তুমি এই বাড়ি থেকে বের করে দেবে মানে? তোমার সাহস কিন্তু দিন দিন বাড়ছে নূর।”
নূর ভাইয়া চিল্লিয়ে বলে উঠল,,,,,
—-“তোমরাই আমাকে বাধ্য করছ সাহস দেখাতে। সময় থাকতে তোমাদের সবার উচিত ছিলো সাকিব ভাইয়াকে সংযত করা।”
আমি আর বসে থাকত পারলাম না। দৌঁড়ে গিয়ে নূর ভাইয়ার পাশে দাঁড়ালাম। নূর ভাইয়া নিজেকে কিছুটা শান্ত করে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে সানোয়ার আংকেলক উদ্দেশ্য করে বললাম,,,,,,
—–“আংকেল প্লিজ তুমি আর নূর ভাইয়াকে কিছু বলো না। উনাকে মেরো ও না। আমি চলে যাবো এ বাড়ি ছেড়ে। আমার জন্য তোমাদের মধ্যে প্রবলেম হচ্ছে। সাংসারিক ভেজাল হচ্ছে। আমি চলে গেলেই সব সলভড।”
সানোয়ার আংকেল অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নূর ভাইয়ার আব্বু আমাকে অনেকটাই ভালোবাসে। তবে প্রকাশ করতে পারে না বাড়ির বাকিদের জন্যে। আমার এক্টা জিনিস খুব অবাক লাগছে। নূর ভাইয়াকে চড় মারার পরে ও ফুফুমনি কিভাবে এতোটা শান্ত হয়ে বসে আছে? শুধু আজ না। এর আগে ও আমি অনেকবার এই জিনিস গুলো খেয়াল করেছি। ফুফুমনি নূর ভাইয়ার প্রতি একদমই কেয়ারিং না। এর সঠিক অর্থ আমি খুঁজে পাই না। রেজাউল আংকেল আমার দিকে তেঁড়ে এসে বলল,,,,,
—-“তা দাঁড়িয়ে আছো কেনো এখনো? শীঘ্রই এই বাড়ি থেকে বিদেয় হও।”
নূর ভাইয়া চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে মুদ্যু চিৎকার দিয়ে বলল,,,,,
—–“এই কি দরকার তোমার…. আমাদের মাঝখানে এসে পাকামো করার? যাও গিয়ে খাবার টেবিলে বসো। আমাদের প্রবলেম আমরা নিজেরাই সলভ করব। চাচ্চুর রাইট আছে আমার গাঁয়ে হাত তুলার। এছাড়া সবাই একসাথে থাকতে গেলে এক্টু আধটু ঝগড়া হবেই। এতে অবশ্য তোমার কোনো দোষ থাকতে পারে না। কেউ এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না ওকে?”
আমি নূর ভাইয়ার ভয়ে কাঁপছি আর মাথা নিচু করে কাঁদছি। নূর ভাইয়া এখনো আমাকেই সাপোর্ট করে যাচ্ছে। আমার জন্য চড় পর্যন্ত খেয়েছে। নিজেকে খু্ব অপরাধী মনে হচ্ছে। এর মাঝেই মৃন্ময় ভাইয়া নিচে নেমে এলো।
#এক_আকাশ_ভালোবাসি
#পার্ট_৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
আমি নূর ভাইয়ার ভয়ে কাঁপছি আর মাথা নিচু করে কাঁদছি। নূর ভাইয়া এখনো আমাকেই সাপোর্ট করে যাচ্ছে। আমার জন্য চড় পর্যন্ত খেয়েছে। নিজেকে খু্ব অপরাধী মনে হচ্ছে। এর মাঝেই মৃন্ময় ভাইয়া নিচে নেমে এলো।
মৃন্ময় ভাইয়া শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নূর ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,
—–“নূর প্লিজ স্টপ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসবের মাঝে তোর ও খানিক দোষ আছে। সাকিবকে এতোটা কেলানো তোর উচিত হয় নি। আমি মানছি সাকিব অন্যায় করেছে। এর উপযুক্ত শাস্তি হিসেবে তুই ওকে চাচ্চুর হাতে তুলে দিতে পারতি। দেখতাম চাচ্চু কি করে। যদি ফলপ্রসু না হতো তখন না হয় তুই আর আমি মিলে সাকিবকে গন ধোলাই দিতাম। তখন নিশ্চয়ই কেউ তোর আর আমার এগেইন্টসে মুখ খুলতে আসত না।”
বেশ বুঝতে পারছি মৃন্ময় ভাইয়া আমাদের পক্ষে আছে। রেজাউল আংকেল দাঁত কিড়মিড় করে মৃন্ময় ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
—–“বাঃহ্ ছোট ভাইকে উস্কানি দিচ্ছিস। খুব ভালো, খুব ভালো। তোদের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস নেই আমার। কজ তোদের বাবাই তোদের স্যাল্টার দিয়ে রেখেছে।”
কথা গুলো বলেই রেজাউল আংকেল হন হন করে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সানোয়ার আংকেল মৃদ্যু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,
—–“কেমন আছিস চাঁদ মা?”
আমি মলিন হেসে বললাম,,,,,
—-“ভালো আছি আংকেল। তুমি কেমন আছো?”
—-“ভালো আছি।”
সানোয়ার আংকেল মাথাটা নিচু করে বলল,,,,,
—-“এই সব কিছুর জন্য আ’ম স্যরি চাঁদ মা। পারলে আমায় মাফ করে দিস। প্লিজ এবার আর অভিমান করে কোথাও যাস না। আমাদের সাথেই থেকে যা।”
কথা গুলো বলেই আংকেল নিজের রুমে চলে গেলো। মৃন্ময় ভাইয়া সোজা ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে গেলো। নূর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম নূর ভাইয়ার ফর্সা গালে পাঁচ পাঁচটে আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে। সানোয়ার আংকেল চড় টা বেশ জোরেই মেরেছে। নূর ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে এখনো ভুবন ভুলানো হাসি লেগে আছে। আমার চোখে পানি টলমল করছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে। বেশ অবাক লাগছে, কিভাবে পারে লোকটা আমার জন্য এতোটা যন্ত্রণা সহ্য করতে? বুকের ভিতর কি সামান্যতম ব্যাথার অনুভূতি ও হয় না? নাকি ছেলে বলে প্রকাশ করতে চায় না? ভিতরে ভিতরেই নিগূঢ় যন্ত্রণা সহ্য করে নেয়? কিছুটা বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো। আমি কেনো পারি না এতোটা সেক্রিফাইজ করতে? কেনো সামান্য এক্টু কষ্টেই চোখে কোণে জলরাশির ছুটাছুটি শুরু হয়? কেবল আমি মেয়ে বলেই কি উপর ওয়ালা আমার চোখে সমুদ্রের জল ঢেলে দিয়েছে?
আমার ভাবুক লুক দেখে নূর ভাইয়া মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে আমার নাক টেনে বলল,,,,,
—-“ওহো চাঁদপাখি। এতোটা ফ্যাড আপ হওয়ার কি আছে? জাস্ট চিল ওকে? তুমি কিন্তু মোটেও ভেবো না, বাড়ির কেউ তোমাকে পছন্দ করে না। বাড়ির সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করে কেবল সাকিব ভাইয়ার আচরনের জন্য সবাই বিগড়ে গেছে। দু, এক দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার আগের মতো মিলে মিশে এই বাড়িতে থাকব। শুধু মাএ কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। শুভ সময় আসতে বেশি দেরি নেই।”
নূর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলাম। আর মনে মনে বললাম,,,,,,,
—-“নূর ভাইয়া…..আর কখনো কিছু ঠিক হবে না। তুমি মিছে আলেয়ার পিছু ছুটছ। আমার প্রয়োজন এই বাড়ি থেকে অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। তুমি আর আমি হাজার চাইলে ও কিছু আর আগের মতো হবে না। সময় এখন আমাদের বিপরীতে। সময় ও কিছু করতে পারবে না। যতোদিন যাবে ঠিক এভাবেই তিক্ততার ঝুলি পূর্ণ হতে থাকবে। এক্টা সময় পর সব সম্পর্কে চিড় ধরবে। ঐ দিন হয়তো তুমিও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।”
এর মাঝেই রেজাউল আংকেল ড্রেস আপ চেইন্জ্ঞ করে নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা ফুফু মনির দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,
—-“ভাবী….আমি হসপিটাল যাচ্ছি। কাল সকালে একেবারে সাকিবকে নিয়ে বাড়ি ফিরব।”
ফুফু মনি ভাতের লোকমা মুখে নিয়ে রেজাউল আংকেলকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
—–“আরে রেজা আগে তো খেয়ে নাও। এরপর না হয় যেও।”
রেজাউল আংকেল হিংস্র দৃষ্টিতে আমার আর নূর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,
—-“না ভাবী। ইচ্ছে নেই।”
রেজাউল আংকেল আর দাঁড়াল না। সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো। সানোয়ার আংকেল ফ্রেশ হয়ে আমাকে আর নূর ভাইয়াকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে গেলো। মারু মৃন্ময় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ভাতের লোকমা মুখে পুড়ছে। মৃন্ময় ভাইয়া নিজের মতো করে খেয়ে চলছে। ফুফুমনি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকাচ্ছে তো কিছুক্ষন প্লেইটের দিকে তাকাচ্ছে। দোলা আপু ডানে, বামে কোথাও তাকাচ্ছে না। কেবল খেয়েই যাচ্ছে। আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। নিজেকেই নিজের কাছে বোঝা মনে হচ্ছে। কোনো কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। কারো চোখে চোখ মেলানোর সাহস ও পাচ্ছি না। নূর ভাইয়া ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,,
—-“চাঁদপাখি প্লিজ তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নাও। সবার সামনে আমি তোমাকে খাইয়ে দিতে পারছি না। তুমি তো জানোই দোলা আপু কতোটা জঘন্য। হয়তো এ নিয়ে তোমাকে আর আমাকে অনেক কথা শুনাবে। তাই বলছি তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নাও।”
নূর ভাইয়ার কথা মতো খেয়ে নিচ্ছি। খুব কষ্টে ভাতের লোকমা গুলো গিলছি। অন্তত নূর ভাইয়ার কথা রাখার জন্য হলে ও আমাকে খেয়ে নিতে হবে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। ফুফুমনি ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠছে আর আমাকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি হেসে বলছে,,,,,,
—-“চাঁদ মা। টেবিলটা এক্টু সুন্দর করে গুছিয়ে নিও। দেখো চাঁদ…. আমার কথায় আবার মাইন্ড করো না। তুমি তো এই বাড়ির ই মেয়ে। বাড়িটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা তোমারই দায়িত্ব। আমি আসছি কেমন?”
ফুফুমনি দোলা আপুকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো। সানোয়ার আংকেল ও টেবিল ছেড়ে চলে গেলো। মৃন্ময় ভাইয়া টেবিল ছেড়ে উঠে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,,,
—-“আম্মু আস্তে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে চাঁদ। আমরা সবাই আবার আগের মতো মিলে মিশে হাসি খুশিতে এ বাড়িতে থাকব। তুই এসব নিয়ে আর ভাবিস না। খামোখা কষ্ট ও পাস না।”
কথাগুলো বলেই মৃন্ময় ভাইয়া মারুর দিকে একবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। এর মাঝেই নূর ভাইয়ার ফোন বেজে উঠল। নূর ভাইয়া ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে মলিন হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,
—-“চাঁদপাখি অফিসিয়াল কল। আমি আসছি।”
নূর ভাইয়া ফোনটা নিয়ে বাড়ির গার্ডেনে চলে গেলো। আমি বুঝি না নূর ভাইয়াদের এতো বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকতে নূর ভাইয়া কেনো অন্যের আন্ডারে কাজ করে? এই ব্যাপারে ফুফুমনি আর ফুফা ও কিছু বলে না। নূর ভাইয়াকে অন্যের আন্ডারে কাজ করতে বারণ ও করে না। আমি যদি নূর ভাইয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করি তাহলে উনি বলে উঠবে, নিজের কোম্পানিতে চাকরী করার কোনো মজা নেই। যতোটা মজা অন্যের অধীনে চাকরী করার মধ্যে আছে। আলাদা এক্সপেরিয়েন্স হয়। আলাদাভাবে সঞ্চয় ও করা যায়। নিজের ভালো,মন্দ নিজেই ডিসাইড করা যায়।
আমি আপাতত ভাবনা গুলোকে পিছনে রেখে ডাইনিং টেবিল গুছাতে লেগে পড়লাম। মারু তেড়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,,,,,
—–“এই চাঁদ তোর হয়েছে কি বল তো? এই বাড়িতে এসে এতোটা চুপচাপ হয়ে গেলি কেনো? কারো কথার ই কোনো প্রতিবাদ করছিস না। রাজশাহী থাকতে তো চুন থেকে পান খসলেই প্রতিবাদ করতে লেগে পড়তিস। তাহলে এই বাড়িতে কেনো ভিজে বেড়াল হয়ে আছিস?”
আমি মলিন হেসে মারুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,
—–“মারু শোন….. অনেক সময় পড়ে আছে প্রতিবাদ করার। আগে পরিস্থিতি আয়ওে নিয়ে নেই। অনেক অজানা সত্যি জানার বাকি আছে আমার। এতো তাড়াতাড়ি বিরোধী দলকে চটালে হবে না। না হয় অনেক গোপন সত্যির মুখোমুখি হতে পারব না। তুই প্লিজ নিজেকে সংযত রাখিস। হুটহাট প্রতিবাদ করে বসিস না। যখন সময় হবে তখন আমি নিজেই মুখ খুলব।”
মারু আমার সাথে রাগ দেখিয়ে গেস্ট রুমে চলে গেলো। আমার শরীরটা ও কেমন ঝিম মেরে আসছে। আমি ও মারুর পিছু পিছু গেস্ট রুমে চলে যাই। রুমের দরজাটা হালকা ভেজিয়ে লাইট অফ করে আমি আর মারু শুয়ে আছি। মারু আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,,,,,,
—-“চাঁদ….. এই বাড়ির সবাই খুব খারাপ। তুই প্লিজ আমার সাথে আমার বাড়িতে চলে আয়। তুই এখানে মোটেও সেইফ না।”
আমি মলিন হেসে মারুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,
—–“তা আর এই জন্মে সম্ভব না। নূর ভাইয়ার সাথে শত জনমের বন্ধনে বাঁধা পড়েছি আমি। ব্যাটার হাফ হই আমি নূর ভাইয়ার। আমি ছাড়া নূর ভাইয়া বড্ড একা, নিসঙ্গ। এই মুহূর্তে নূর ভাইয়ার পাশে আমি থাকতে চাই। সারাটা জীবনের জন্য থাকতে চাই নূর ভাইয়ার সাথে। আমি আমার জীবনের সব সত্যি জানতে চাই। এর জন্য হলে ও আমাকে এই বাড়িতে থাকতে হবে।”
—-“এক কাজ কর চাঁদ। তুই নূর ভাইয়াকে সব সত্যি জানিয়ে দে। দেখবি নূর ভাইয়া ই তোকে হেল্প করবে বাকি সত্যি গুলো জানতে।”
—-“আমি ও তাই ভাবছি। সময় এসেছে মুখ খোলার।”
মারু খুব উৎসাহ নিয়ে আবার বলল,,,,,
—-“শুন না চাঁদু। সাথে আমার সেটিং টা ও করে দে। আমি মৃন্ময়কে সত্যিই ভালোবাসি।”
—-“তুই ভালোবাসলেই তো হবে না মারু। মৃন্ময় ভাইয়ার মনে ও তোর জন্য কিছু থাকতে হবে। এর জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। কয়েকটা দিন থেকে দেখ কি হয়। ভালোবাসা হুটহাট করে হয়ে যায় না। কিছুটা সময় দিতে হয়।”
—-“হুম ঠিক বলেছিস। সময় তো লাগবেই। ওকে আমি না হয় আরো কয়েকটা দিন ওয়েট করি। দেখি কি হয়।”
মারু এবার অন্য পাশ ফিরে চোখ বুঝে ফেলল। আমার ও কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমের রাজ্যে পা বাড়ালাম। এভাবে ঠিক কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুমের মাঝেই আচমকা মনে হলো আমি হাওয়ায় ভাসছি। খানিক ভয় পেয়ে চোখ জোড়া খুলে ফেললাম। অন্ধকারে কিছু দেখছি না। তবে বুঝতে পারছি আমি কারো কোলে আছি। এক্টা চেনা স্মেল নাকে ভেসে আসছে। মনে বলছে নূর ভাইয়া। উফফ অনেকখানি নিশ্চিন্ত হলাম। চোখ জোড়া বন্ধ করে নূর ভাইয়ার কাঁধে দুই হাত ঝুলিয়ে দিলাম। নূ্র ভাইয়া আমাকে নিয়ে উনার রুমে ঢুকে গেলো। রুমের দরজা আটকে নূর ভাইয়া আমাকে বেডে শুইয়ে দিলো। রকমারী লাইটের ঝাপসা আলোতে নূর ভাইয়ার মুখটা অস্পষ্ট ভাবে দেখছি। নূর ভাইয়া আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচমকা নূর ভাইয়া আমার বুকে মাথা রেখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠল,,,,,,
—–“চাঁদপাখি….আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শুধু এক্টা ঠিকঠাক জব পেয়ে নেই। রানিং জবটার পাশাপাশি অন্য ভালো এক্টা জবের ট্রাই করছি। দেশের বাইরে ও ট্রাই করছি। দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয়।”
আমি নূর ভাইয়াকে বুক থেকে উঠিয়ে শোয়া থেকে বসে পড়লাম। নূর ভাইয়ার গালে হাত দিয়ে নূর ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,,,
—-“কি হয়েছে নূর ভাইয়া? আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে কিছু হিডেন করছ। কি হিডেন করছ নূর ভাইয়া? প্লিজ আমাকে বলো।”
নূর ভাইয়া আমাকে ঝাপটে ধরে কান্না চেঁপে মলিন কন্ঠে বলল,,,,,
—-“কিছু হয় নি চাঁদপাখি। আসলে কিছু কিছু কেনোর উওর হয় না। জীবনের সব অধ্যায়ের সমীকরণ মিলানো যায় না। কিছু কিছু অধ্যায় সঠিক সূএের অভাবে অপূর্ণ থেকে যায়। তার মানে এই না যে জীবন থমকে গেছে। প্র্যাক্টিকাল লাইফে সূএের অমিলের কারণে কিছু থেমে যায় না। জীবন তার আপন গতিতে চলতে থাকে। জীবনের এক্টা নিজস্ব ধারা থাকে। আমরা দুজন সেই ধারাতেই চলব।”
নূর ভাইয়া কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,,
—-“চাঁদপাখি…… আর কখনো আমাকে এই ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করো না প্লিজ। কারণ বার বারই তোমাকে হতাশ হতে হবে। ঐ কেনোর উওর আমার কাছে নেই।”
নূর ভাইয়া কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলল,,,,,,
—–“চাঁদপাখি…..আমি এক্টু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাই। তোমার বুকে। আমার চোখ দুটো বেশ ক্লান্ত। এক্টা শান্তির ঘুম চাই।”
আমার চোখ জোড়া জলে ভিজে এলো। কেনো জানি না মনে হচ্ছে নূর ভাইয়া আমার মতোই সমব্যথী। আমার মতোই কাঙ্গাল। দুজনের ভাগ্য বুঝি এক। কিছু না বলা কথার অর্থ মন দিয়ে বুঝে নিতে হয়। যদি দুটো মনের কানেকশান থাকে তো। আমাদের মনের কানেকশান সেই কবে থেকেই জুড়ে আছে। তাই আমি কিছুটা হলে ও আঁচ করতে পারছি। নূর ভাইয়া কিছু ভয়ংকর সত্য জানে, যা আমি জানি না। হয়তো আমার জানার প্রয়োজন নেই। তাই নূর ভাইয়া বলছে না। তবুও অজানা কিছু জিনিস জানার জন্য প্রবল উৎসাহ কাজ করে আমাদের মধ্যে। ব্যাপারটা না জানলে মনে হয় যে, পেটের ভাত হজম হয় না। যেকোনো মূল্যেই হোক জানতে হবে। আমি ব্যাপারটাকে আপাতত আমলে না নিয়ে নূর ভাইয়ার কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,,,,,,,
—-“রাত অনেক হয়েছে নূর ভাইয়া। আমার বুকেই শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি।”
নূর ভাইয়া আর দেরি করল না। আমাকে নিয়েই শুয়ে পড়ল। আমার বুকে চুপ করে শুয়ে আছে নূর ভাইয়া। আমি নূরর ভাইয়ার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি। মনের ভিতরটায় কেমন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঐ খালি জায়গাটা এতোদিনে তার কর্তাকে খুঁজে পেয়েছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। নূর ভাইয়া আমাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। নূর ভাইয়াকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমার বুকের উপর থেকে নূর ভাইয়ার মাথাটা উঠিয়ে নূর ভাইয়ার কপালে চুমো এঁকে দিলাম।
নূর ভাইয়া মলিন হেসে আমার ঠোঁটে এক্টা চুমো খেয়ে বলল,,,,,,
—-“ঘুমিয়ে পড়ো চাঁদপাখি। দুজনেরই রেস্ট দরকার।”
নূর ভাইয়ার গালে এখনো চড়ের দাগটা স্পষ্ট হয়ে আছে। গালটাতে অজস্র চুমোতে ভরিয়ে দিলাম। শান্তি লাগছে ভীষণ। খুব ভালোবাসি আমি এই ছেলেটাকে। একদিন খুব ঘটা করে নূর ভাইয়াকে আমার মনের কথাটা জানাবো। ঐদিন নূর ভাইয়া খুব অবাক হয়ে যাবে। খুশিতে হয়তো পাগল ই হয়ে যাবে। আমি চাই নূর ভাইয়া পাগল হোক, “আমার ভালোবাসায়।”
নূর ভাইয়া মুচকি হেসে আমার বুকে শুয়ে পড়ল। আমি ও আর দেরি না করে নূর ভাইয়াকে বুকে নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম।
#চলবে,,,,,,,,,,,
#চলবে,,,,,,,,