#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১৪
একটা বিশাল অরফানেজের ভেতরে পার্কিং লটে গাড়ির ভেতর বসে আছে সূর্য।অবশ্য একলা নই, গাড়ির ব্যাক সিটে মাথাটা এলিয়ে একহাতে পুতুলকে ধরে বসে আছে।ভোতা একটা কষ্টে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে সূর্যের।পুতুলকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় সূর্য।
তখন ছোট বাবার কবর জিয়ারত করে বাবাকে নিয়ে বের হতেই দেখে পুতুল মায়ের কোলে সেন্সলেস হয়ে আছে।ইচ্ছে করেই কেউ পুতুলকে জাগায় নি।ছোট বাবার বার্ষিকী উপলক্ষে প্রত্যেক বছর এই অরফানেজে আসে তারা।পুতুলকে একলা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়।তাই বাবা,,,,,মা আর টুকটুকিকে নিয়ে ভেতরে গেছেন।
চোখ বন্ধ থাকাকালীনই একটা মিষ্টি স্মেল বার বার নাকে ধাক্কা দিচ্ছে পুতুলের।কিন্তু স্মেলটা কোথা থেকে আসছে সেটা জানতে ইচ্ছে করছে না তার।মাথাটা ভীষণ ভারি লাগছে।তাই চুপচাপ পাশে থাকা উষ্ণতা আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে থাকে পুতুল।হঠাৎই বাবার সমাধির নেইম-প্লেট টা চোখের সামনে ভেসে উঠে, বাবার কথা মনে হতেই চোখ বন্ধ করেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে পুতুল।
কান্নার শব্দে পেয়ে চট করে সোজা হয়ে বসে সূর্য।পুতুল তার পাঞ্জাবির গলার খাঁজ খামচে ধরে চোখ বন্ধ করেই কাঁদছে।আর তার বন্ধ চোখ থেকেই অঝোরে পানি পড়ছে।সূর্যর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে, পুতুলের এই কান্না তার বুকে বুলেটের মতো ছেদ করছে।কী দিয়ে এই কান্না থামাবে সে, পৃথিবীতে এমন কী আছে যেটা দিয়ে সে এই কান্না থামাতে পারবে।উফফ তার মাথাটা মনে হয় আজ তাকে কোনো সাহায্যই করবে না, চোখটা আবার জ্বলছে।পুতুলকে দু’হাতে জাপটে ধরে একদম বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় সূর্য।পুতুলের মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিমেষে দুফোঁটা বৃষ্টি ঝরে পড়ে।হঠাৎই সূর্য ফট করে চোখ খুলে নিজের ফোন টা বের করে কাউকে কল দেয়।
বাচ্চার কান্নার আওয়াজে ফট করে চোখ মেলে তাকায় পুতুল।তার চোখের সামনেই সাত আট মাসের একটা ফুটফুটে বাচ্চা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে দেখে অবাক হয়ে যায়।বাচ্চাটার চোখ থেকে বড় বড় ফোঁটার পানি পড়ছে।পুতুল দ্রুত সোজা হয়ে বসে বাচ্চাটা কোলে নেওয়া ব্যক্তির দিকে তাকায়।সূর্য একহাতে বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।আর অন্য হাতে তাকে ধরে আছে।বাচ্চাটার কান্নার গতি বাড়তেই পুতুল ব্যস্ত হয়ে বলল,
-” কেপ্টেন, বাবু টা কাঁদছে তো।আর এটা কার বাবু? আপনার কাছে কেন?” বলেই সূর্যের মুখের দিকে তাকায়।কিন্তু সূর্য ভাবলেশহীন ভাবে পুতুলের ভিজে থাকা বড় বড় চোখের পাপড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।সূর্যর থেকে কোন জবাব না পেয়ে পুতুল আরো ব্যস্ত গলায় বলল,
-” দেখুন বাবুটা খুব কাঁদছে, ওর মনে হয় খুধা পেয়েছে।ওকে এখুনি ওর আম্মুর কাছে দিয়ে আসেন।” বলেই ঝটপট বাবুটার চোখ মুছে দেয় পুতুল।
-” ওর কেউ নেই।” সূর্যর কথা শুনে পুতুল মায়াবী চোখের ভেজা পাপড়ি মেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।সূর্য বাচ্চা টাকে দু’হাতে আগলে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
-” এই পৃথিবীতে ওর বাবা-মা কেউ নেই থাকলেও কেউ জানেনা তারা কে?ও এতিম।ওই যে সামনে গেইট টা দেখছো ওখানে ওকে কেউ ফেলে রেখে চলে গেছিল।(একজন মাদারকে দেখিয়ে) আর ওই যে মাদার উনিই ওর বর্তমান মা।”
কথা শেষে সূর্য বাচ্চাটার হাতে শব্দ করে চুমু দিল।তারপর নাকে চুমু দিতেই বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।আর পুতুল অবাক হয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে,বাচ্চাটা তার বড়ো বড়ো চোখে টলটলে জল নিয়ে সূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।সূর্য মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করতেই বাচ্চাটা তার দাঁত বিহীন মাড়ি বের করে শব্দহীন হাসি দিচ্ছে।কী নিষ্পাপ আর পবিত্র সেই হাসি, এরকম একটা পরী বাবুকে কী ফেলে দেওয়া যায়? ভাবনার মাঝেই সূর্য খুট করে দরজা খুলে বের হয়ে যায়।
সূর্যের বেরিয়ে যাওয়া দেখে পুতুল দ্রুত পিছু পিছু নেমে এসে সূর্যকে ডাকলো,
-” কেপ্টেন!”
সূর্য তাকাতেই পুতুল দ্রুত পায়ে হেটে তার কাছে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
-“আমি একটু ওকে নিই?” বলেই হাত বাড়িয়ে দিল পুতুল।সূর্য মৃদু হেসে বাচ্চাটাকে এগিয়ে দেয়, পুতুল আনাড়ি ভাবে কোনরকম বাচ্চাটাকে নিতেই কান্না শুরু করে।
পুতুলের আনাড়িপনা দেখে সূর্য হেসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এলোমেলো চুল গুলো উপর সাদা ওড়নাটা মাথায় দেওয়া,কেঁদে ভেজা থাকা চোখের পাপড়ি, লাল হয়ে থাকা নাক তার সাথে আনাড়ি ভাবে বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ায় অদ্ভুত সৌন্দর্যে ছেয়ে গেছে।পুতুল বাচ্চা টাকে থামাতে না পেরে কাঁদো কাঁদো হয়ে সূর্যের দিকে তাকায়।সূর্য বুঝতে পেরে পুতুলের পাশে গিয়ে আলতো করে বাচ্চা টাকে একহাতে ধরে মুখ থেকে অদ্ভুত শব্দ বের করতেই বাচ্চাটা চুপ হয়ে যায়।আবারও একইভাবে শব্দ করতেই বাচ্চাটা তার নিষ্পাপ হাসি দেয়।বাচ্চা টাকে হাসতে দেখে পুতুলের ঠোঁটে হাসিরা উপস্থিত হয়, সে বাচ্চাটার গালে টপাটপ কয়েকটা চুমু একে দেয়।পুতুলের হাসি দেখে অজান্তেই সূর্যের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বাচ্চাটা আবারও কাঁদতে শুরু করলে পুতুল বাচ্চাটাকে সূর্যের কাছে দিয়ে দেয়।কিন্তু এবার সূর্যও তাকে থামাতে পারছেনা।ঠিক তখনই দূরে দাড়িয়ে থাকা মাদারটা এসে বলল,
-” স্যার, মে আই?” সূর্য হেসে বলল,
-” সিয়র। এন্ড সরি, কেন যে কাঁদছে বুঝতে পারছি না।” বলতে বলতে বাচ্চাটাকে মাদারের কোলে তুলে দেয় সূর্য। মাদার মৃদু হেসে বলল,
-” ডোন্ট বি সরি।আসলে ওর খাবার টাইম হয়ে গেছে তাই কাঁদছে।( বলে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল) তাইনা সুখতারা?” জবাবে বাচ্চাটা তার ঠোঁট ফুলিয়ে বোঝালো তার খুধা পেয়েছে।
মাদার বিদায় নিতেই সূর্য পুতুলের দিকে তাকায়।পুতুল তখন ‘মেঘবৃষ্টি আশ্রম’ নেইম-প্লেটের দিকে তাকিয়ে ভাবছে অরফানেজ টার নাম মেঘবৃষ্টি কেন? ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে কারো স্পর্শে।সূর্য পুতুলের হাত ধরে অরফানেজের ভেতরে যেতে যেতে বলল,
-“অরফানেজ টা অনেক সুন্দর দেখবে চলো।”
-” বড় আম্মু, বড় আব্বু, টুকটুকি সবাই কোথায়? ”
-” ভেতরে আছে। ”
ভেতরে ঢুকেই পুরো অরফানেজ টাই চোখ বুলাই পুতুল।দোতলা বিল্ডিং এর চার ব্লকের মাঝখানে বিশাল একটা মাঠ।সেই মাঠের একটা কোণায় টুকটুকি বাচ্চাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে।কিছুদূর যেতেই একটা শুধু ছাউনি দেয়া লম্বা ঘরে বড় আব্বু আর বড় আম্মুকে দেখতে পায় পুতুল।বড় আম্মু অনেক গুলো বাচ্চাকে খাবার তুলে দিচ্ছে।আর বড় আব্বু একজন বয়স্ক লোকের সাথে কথা বলছিলেন, পুতুলকে দেখে মৃদু হেসে কাছে এসে একহাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় ভালবাসার পরশ একে বলল,
-” এখন কেমন আছে আমার মামনি?”
পুতুলও মৃদু হেসে বলল,
-” ভালো আছি বড় আব্বু।”
হঠাৎই চেচামেচির শব্দ শুনে পিছনে ঘুরে তাকায় পুতুল।মাঠের মাঝে কয়েকটা বাচ্চা সূর্যকে নিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর সূর্য তার ভূবণ ভোলানি হাসি দিয়ে ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করছে।সে খেয়ালই করেনি সূর্য কখন তার হাত ছেড়ে দিয়েছে।বড় আব্বু হেসে বললেন,
-” অবাক দেরি করে আসায় শাস্তি দিচ্ছে।”
ঠিক তখনই টুকটুকি দৌড়ে এসে পুতুলকে জাপটে ধরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আব্বু আমাদেরকে খেতে দেবে না? আমার তো খুব খুধা পেয়েছে।”
-” দেবো তো মা, ওদের হয়ে গেলে বাকিদের সাথে আমরা বসবো,কেমন? তুমি ততক্ষণ আপুর সাথে থাকো আমি ওদিকটা দেখি।” বলেই বড় আম্মুর কাছে চলে যান।
বাচ্চাদের সাথে খাবার খেয়ে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।কিন্তু পুতুলের ভীষণ তখনকার ওই পরী বাবুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।তাই মৃদু পায়ে সূর্যের সামনে যেয়ে দাড়ায়।সূর্য তখন বাচ্চাদের সাথে হাসাহাসি করছিল।পুতুলকে তার সামনে আড়ষ্ট ভাবে দাড়াতে দেখে হেসে বলল,
-” কিছু বলবে?”
-” কেপ্টেন, ঐ পরী বাবুটাকে কী আরেক বার দেখা যাবে?
পুতুলের কথায় সূর্য ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।পুতুল আবার বলল,
-” নাহ মানে তখন আমার কাছে এসে কাঁদছিল তো যদি না দেয়।” বলেই হাত কচলাতে শুরু করে পুতুল।
-” তুমি কী সুখের কথা বলছো, আই মিন সুখতারা?”
পুতুল মাথা নেড়ে হুম বলল।সূর্য হেসে উঠে দাড়ায় তারপর পুতুলের হাত ধরে বলল,
-” দেবে না কেন, অবশ্যই দেবে। চলো সুখের সাথে দেখা করে আসি।” বলে পুতুলকে নিয়ে হাটা শুরু করে।পুতুল হাটতে হাটতে প্রশ্ন করলো,
-” কেপ্টেন আপনি ওকে সুখ নামে কেন ডাকছেন? সুখ কারো নাম হয় নাকি? ওর নাম তো সুখতারা সেক্ষেত্রে ওকে তারা বলে ডাকা উচিত।”
মৃদু হেসে বলল,
-” আজকে ও আমাকে এক টুকরো সুখ উপহার দিয়েছে তাই ওকে আমি সুখ বলেই ডাকবো, বুঝলে।”
পুতুল জবাবে নিরব থাকলো।
সাত মাস আগে মাদার ডোনা সুখতারাকে অরফানেজ এর গেইটের সামনে পান ভোরে হাটতে গিয়ে।সুখতারা এখানকার সবথেকে ছোট বাবু বাচ্চা।তাই মাদার ডোনা তাকে নিজের কাছে রাখেন।সূর্য এসে জানতে পারে সুখতারা ঘুমচ্ছে,কিন্তু একথা শুনে পুতুলের মলিন মুখ দেখে সূর্য মাদারকে বলল,
-” মাদার, আমরা ওকে জাগাবো না শুধু একটু দেখেই চলে আসবো।”
মাদার ডোনা হেসে বলল,
-” এতো রিকুয়েষ্ট করতে হবে না স্যার।আপনারা অবশ্যই ওকে দেখতে পারেন, আসুন আমার সাথে।” বলে ওদেরকে সুখতারার কাছে নিয়ে গেলেন মাদার।
লাল টুকটুকে একটা সুতির ফ্রক পড়ে এক আঙুল মুখে পুরে ঘুমিয়ে আছে সুখতারা।ওকে দেখে ভীষণ চুমু দিতে ইচ্ছা করছে পুতুলের।কিন্তু ঘুম থেকে জেগে যাবে ভেবে ওকে দেখেই চলে আসে।
আশ্রম থেকে বের হয়ে পার্কিং লটের দিকে যেতে যেতে পুতুল হঠাৎ বলে উঠে,
-” আচ্ছা কেপ্টেন, আমরা যদি সুখতারাকে নিয়ে যেতে চাই ওরা কি আমাদেরকে দেবে?”
-” নিয়ে যেতে বলতে কোথায়, আমাদের বাসায়?”
-” হুম।”
পুতুলের কথায় সূর্য একটু শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,
-“দেবে তো, কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে।”
সূর্যের কথায় পুতুল ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকায়।সূর্য সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-” আমাকে বিয়ে করতে হবে, আই মিন আমাদের বিয়ে করতে হবে।”
সূর্যের কথায় পুতুল তব্দা খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সূর্য আরো সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-” এভাবে তাকাচ্ছো কেন? ঠিকই তো বললাম বিয়ে করে লিগাল স্বামী-স্ত্রী হলে তবেই না ওরা আমাদের সুখকে এডপ্ট দেবে।” বলেই পুতুলের নাক টিপে হাটা দেয় সূর্য।
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১৫
পুতুল নাকে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে সূর্যের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।তার ঠিক কী রিয়াকশন দেওয়া উচিত বুঝতে পারছেনা। বিয়ে!এতো নিঃসংকোচে কথাটা বলে দিল?আচ্ছা রাক্ষস টা কী সিরিয়াসলি বলল? আরে ধুর ইডিয়ট কেপ্টেনটা তো সবসময় তাকে বুদ্ধু বানায়।কিন্তু যদি সত্যি বলে? তার কী বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত? ছি কিসব ভাবছে সে, মাম্মার তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন আর সে কিনা বিয়ে করে বাচ্চা এডপ্ট করার কথা ভাবছে? বিয়ে করে মানে!! তবে কী মাম্মার স্বপ্ন পূরণ করতে না হলে সে বিয়ে করে সুখকে এডপ্ট করে নিতো?
হঠাৎ গাড়ির হর্ণে চমকে উঠে পুতুল।তার একদম সামনে তাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।সূর্য জানালা দিয়ে মাথা বের করে হেসে বলল,
-” কি হলো এভাবে স্টাচু হয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে না নাকি?”
সূর্যের হাসি দেখে তার আবার বুকে চিনচিন অনুভূতিরা মাথা চাড়া দেয়।উফফ এই স্টুপিড কেপ্টেনটা এতো দারুণ করে হাসে কেন? তার কী এই রাক্ষস টাকে জানানো উচিত তার হাসি মারাত্মক, রাক্ষসটা যেন তার সামনে না হাসে। হাসলে তার বুকে ব্যাথা করে, ভীষণ রকমের অদ্ভুত সে ব্যাথা।
-” এই মেয়ে, এই! কখন থেকে ডাকছি, কোন জগতে আছো? বধির মেয়ে একটা।” বলেই পুতুলের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দেয় সূর্য।
নিউইয়র্ক টাইম রাত ১২টা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতীক যুক্ত দুটো খাম হাতে ফ্লোরে বসে আছেন মিসেস প্রীতি।খাম দুটোর দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছেন আর সেই দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত চোখ থেকে ধীর গতিতে একভাবে নোনাপানির স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে।দুইটা চোখের পানির ধারাতে একটু উনিশ বিশ হচ্ছে না। যেন তারা কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে, তাই কেউ কারো থেকে কম পরিমাণ ঝরবে না। হঠাৎই মিসেস প্রীতি ডুকরে কেঁদে উঠেন বিড়বিড় করে বললেন,
-” আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই খাম খুলবো না মিহির, খুলবো না।আমি তোমার কাছে কিছুতেই হেরে যাব না।তুমি যেমন তোমার কথা রাখো নি আমিও রাখবো না।আমি কোনদিন তোমার এই লেখা পুতুলকে দিব না, আমি চাই, ও তোমাকে আমার থেকেও বেশি ঘৃণা করুক।” বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন মিসেস প্রীতি।
কান্নার আওয়াজ কমাতে নিজের হাত নিজেই কামড়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন মিসেস প্রীতি।এবার খাম দুটো বুকে জড়িয়ে ধরে অসহায় ভাবে প্রলাপ করতে শুরু করেন,
-” আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মিহির, ভীষণ। আমার বুকটা পুড়ে যাচ্ছে, উফফ,,,,,আমার এতো কেন কষ্ট হচ্ছে মিহির? তুমি প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো মিহির, প্লিজ ফিরে এসো। আমার আর কিচ্ছু চাই না মিহির শুধু তোমাকে চায়, শুধু তোমাকে।” বলেই আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।
বোনের দরজার সামনে দরজা ঘেঁষে ফ্লোরে চুপচাপ বসে আছেন মিসেস শীথি আহমেদ। মা-বাবা না থাকায় নিজের হাতে মানুষ করেছেন প্রীতিকে।বয়সে আট বছরের পার্থক্য হলেও নিজের সন্তানের মতো আগলে বড় করেছেন ছোট বোন টাকে।আর আজ ষোলো বছর যাবত সেই সন্তান সমতূল্য বোনকে চোখের সামনে প্রাণহীন ভাবে বাঁচতে দেখতে হচ্ছে।ভেবেই চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।ভেতর থেকে হাউমাউ করে কান্নার শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে দরজা নক করেন মিসেস শীথি,
-” প্রীতি!প্রীতি! প্লিজ দরজা খোল,প্লিজ আমার কথা শোন।” বলেই ডুকরে কেঁদে উঠেন।তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার বোন দরজা খুলবে না তারপরও বৃথা চেষ্টা করেন নিজেকে শান্তনা দিতে।
প্রচন্ড অস্বস্তিতে হঠাৎ ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসে পুতুল।প্রচন্ড অস্থির লাগছে, মাথাটা পুরো ব্লাঙ্ক হয়ে আছে।চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চোখ খুলে সাইড টেবিল থেকে ফোন টা নিয়ে টাইম দেখে নিল পুতুল।ভোর চারটা বাজে দেখে বিছানা থেকে নামতে গেলে বুঝতে পারে কেউ তার কোমড় পেচিয়ে ধরে আছে।ব্লাঙ্কেট সরিয়ে দেখে টুকটুকি তার কোমড় পেচিয়ে বেঘোরে ঘুমচ্ছে।টুকটুকিকে দেখে মনে পড়লো আশ্রম থেকে ফিরতে প্রায় নয়টা বেজে গেছিল।ক্লান্ত থাকায় কোনরকম ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। কিন্তু টুকটুকি কখন এসেছে বুঝতে পারেনি। ভ্রু কুঁচকে টুকটুকির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই হেসে দেয় পুতুল।টুকটুকি ভীষণ কিউট হয়ে ঘুমিয়ে আছে।এলোমেলো চুলের মাঝে ভ্রু দুটো কুঁচকে ঠোঁট উলটিয়ে বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।পুতুল তার চুল গুলো সরিয়ে টুপ করে কপালে চুমু একে দিতেই ভ্রু দুটো স্বাভাবিক করে ফেলে টুকটুকি।সেটা দেখে আবারও হেসে উঠে পুতুল।তারপর আলতো করে টুকটুকির হাত সরিয়ে উঠে দাড়ায় পুতুল।
ওয়াশরুম থেকে বিশ মিনিট ধরে চোখে মুখে পানি দিয়েও অস্থিরতাটা কমছে না পুতুলের।টাওয়েল দিয়ে হাত মুখ মুছে ফোন টা হাতে নেয় পুতুল। এখন তার মাম্মাকে দরকার, মাম্মার সাথে একটু কথা বলতে হবে।তাহলে হয়তো অস্থিরতাটা কমবে ভেবেই ফটাফট কল দেয় মাম্মাকে।কিন্তু ফোন টা আনরিচেবল দেখাচ্ছে।আরো চার পাঁচ বার দিয়েও একই কথা জানাচ্ছে ফোনের ভেতরের যন্ত্র- মানবী।অস্থির হয়ে রুমের ভেতর পায়চারি করতে করতে ফটো ফ্রেম গুলোর সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ায় পুতুল।বাবা-মা আর তার একটা ফটোতে হাত রেখে টলটলে চোখে তাকিয়ে বলল,
-” তুমি থাকলে এরকমটা হতো না বাবা, এখন মাম্মা আমার কাছে থাকতো।আমার তো তোমার কথা মনেই নেই তাই এতটা কষ্ট হচ্ছে।তাহলে মাম্মা কি করে এতটা কঠিন কষ্ট সহ্য করে বলতো? তুমি ভীষণ পঁচা বাবা, ভীষণ পচা।কেন ওই পঁচা জবটা করতে বলতো? কেন আমাদের রেখে চলে গেলে বাবা?” বলেই ঝরঝর করে কেঁদে দেয় পুতুল।
সকালে নাস্তার টেবিলে সকলে আপন মনে নাস্তা করছে।সূর্য এসে পুতুলের পাশের চেয়ারে ধপ করে বসলো।শব্দ শুনে পুতুল চমকে উঠে সূর্যকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।সূর্য সকলকে মর্নিং উইস করে খাওয়া শুরু করে।আড়চোখে পুতুলকে একবার দেখে মিটিমিটি হেসে পট করে টেবিলের নিচে পুতুলের পায়ে খোঁচা দেয়। পুতুল বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই সূর্য একটু এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” চলো আজই বিয়ে করে নিই।তাহলে কালই সুখকে নিয়ে আসতে পারবে।” বলে এক চোখ টিপ দেয় সূর্য।
সূর্যের কথা শুনে সাথে সাথে পুতুল বিষম খাই।মিসেস মধুমিতা দ্রুত পানির গ্লাস টা নিয়ে পুতুলকে খাইয়ে দিল।মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” অবাক, ওকে শান্তিতে খেতে দাও।খাবার সময় ফুসুরফাসুর করো কেন?”
সূর্য ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলল,
-” আমি আবার কী করলাম,আমি তো বলছিলাম আজ বি,,,,,,, আহ।”
সূর্য আর কিছু বলবে তার আগেই পুতুল পট করে তার পায়ে পাড়া দেয়।সূর্য ভ্র কুঁচকে তাকাতেই পুতুল ভাবলেশহীন ভাবে খেতে থাকে।মনে মনে কয়েক গুচ্ছ গালাগালি করতে শুরু করে।বিড়বিড় করে বলল,
-“অসভ্য ছেলে বিয়ে করবে? বলি সারাদিন টো টো ড্রাইভারি করে বাবার পয়সায় খেয়ে বিয়ে করলে বাচ্চা এডপ্ট কে দেবে রে? হুহ ঢং, আজই বিয়ে করলে কাল সুখকে নিয়ে আসবে!ইডিয়ট কোথাকার।”এসব বলেই বৃহৎ একটা ভেঙচি কাটলো।
সূর্য পাশে বসায় পুতুলের কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পেল।কথাগুলো শুনে সূর্য মুখে খাবার নিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে পুতুলের দিকে তাকায়।এই মেয়ে বলে কী!! সে যে এতো বড় একটা পোস্টে এতো গুলো বেতন নিয়ে নিযুক্ত রয়েছে আর এই মেয়ে বলে কিনা বাবার টাকায় খায়!! বলদ কোথাকার কিছু না জেনে আমাকে ইডিয়ট বলা হচ্ছে? দাড়াও তোমাকে দেখছি ভেবেই খাবার চিবতে শুরু করে।পরক্ষণেই মনে হলো বলদটা জানবে কী করে সে তো কখনো জানায়নি, আর সে জানাবেই বা কেন এই হাদিটা তো কখনো জানতে চায়নি।
নিউইয়র্ক হসপিটাল থেকে বের হয়েই গাড়িতে উঠে হাওয়ার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে আফনান আহমেদ। উদ্দেশ্য দ্রুত বাড়িতে পৌছানো।কিছুক্ষণ আগে মিসেস ফোন করে ভয়ানক ভাবে কান্নাকাটি করেছেন তার একমাত্র শালিকা দুদিন যাবত ঘর বন্দি হয়ে বসে আছে।নিজের উপর রাগ হচ্ছে আফনান সাহেবের, সার্জারি নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিল যে গতকালের তারিখ টাও মনে রাখতে পারেনি। মেয়েটা কী অবস্থায় আছে কে জানে ভেবেই কপাল ঘামতে শুরু করেছে। তার উপর সান্ত্বনার একমাত্র ঔষধ ‘পুতুল’ সেও তো নেই।কীভাবে যে কি করবে ভেবেই খুব অসহায় লাগছে। আফনান আহমেদ বাড়ির সামনে গাড়িটা কোনরকম পার্ক করেই দৌড়ে ভেতরে যান।প্রীতির রুমের সামনে চোখ মুখ ফুলিয়ে অসহায় ভাবে বসে আছে তার মিসেস।
-” শীথি সরে যাও আমি দেখছি।” বলেই শালিকাকে ডাকলেন,
-” প্রীতি!প্রীতি! প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর।প্লিজ দরজাটা খোল, দুলাভাই কী বলছি একবার শোন।বোন আমার কথাটা শোন।”
-” ওর কোনো সাড়া পাচ্ছি না তো দুই ঘন্টা যাবত, আমার ভয় করছে তুমি দরজা ভেঙে ফেলো প্লিজ।” বলেই কাঁদতে শুরু করেন মিসেস শীথি।মিসেস এর কথায় আফনান সাহেব দ্রুত দরজা ভাঙতে উদ্যত হন।কিছুক্ষণ পর অনেক চেষ্টা করে দরজা ভেঙে ভেতরে যান মি. এন্ড মিসেস আহমেদ।
চলবে
সারাদিন এতো বিজি ছিলাম যে লিখতে বসার ফুরসত হয়নি।এশা শেষে কোনরকম লিখলাম।ভুল থাকলে একটু এডজাস্ট করে নিবেন প্লিজ।হ্যাপি রিডিং😞
চলবে
পুতুল আর সূর্যের বিয়ে দিয়ে দিই?😉