এক মুঠো গোলাপ পর্ব ১৪+১৫

এক মুঠো গোলাপ
sinin tasnim sara
১৪-১৫
১৪
___
আমার ধারানুযায়ী কোনো কাপলই তিন সাড়ে তিন মাসের সম্পর্কে ততটা সহজ স্বাভাবিক নয় যতটা আমরা হয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের সাবলীল কথাবার্তা, আমার নিদ্রর প্রতি কেয়ারনেস, অবসেশন এসব এত জলদি কারোরই মাঝে আসতে পারেনা। আমার কেবলই মনে হতো নিদ্রর জন্য ভালোবাসাটা আমার মনে প্রত্যেকদিন শতগুণ করে বেড়ে যায় । একা বসে থাকতে থাকতেই মনে হয় আমার নিদ্রকে সামনে চাই , এই মুহুর্তে চাই। এক পলক দেখতে না পেলে বুঝি মরেই যাবো।
দিন নেই রাত নেই ওকে দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা পেত।
শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার এই আবদার পুরো করতে তাকে আসতে হতো সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে ।
আমি ছুটে গিয়ে তার বুকে জায়গা করে নিতাম, সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো_”প্লিজ সুপ্ত কন্ট্রোল ইওর সেল্ফ”
প্রতুত্তরে আমি কিছুই বলতাম না। কিছু বলবার প্রয়োজন নেই। নিদ্রর শরীরের ঘ্রাণ শুষে নেয়াটাই সুপ্তর মূল কাজ।
এর বাইরে সুপ্ত কিচ্ছু শোনেনি , কিচ্ছু জানেনা।
,
এইচএসসি পরীক্ষার দু সপ্তাহ আগে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে নিদ্র, ঢাকায়।
ও ঢাকায় যাবে শুনেই আমার দম বন্ধ অনুভূতি হতে শুরু করলো।
ইনসিকিউরড ফীল করছিলাম আমি। ঢাকায় তো নুহা আছে। নুহা যদি নিদ্রকে বিয়ে করার জন্য কোনো টিক্স খাটানো শুরু করে? নুহা তো ওর মামাতো বোন। ওর মায়েরও অগ্রাধিকার আছে এখানে। ও যদি ওর মায়ের কথা ফেলতে না পারে তাহলে!
এসব ভাবতে গেলেই আমার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করতো।
ঘুম উবে গেল একপ্রকার ।
ওর ঢাকায় যাওয়ার আগের রাতে আমি বিরাট একটা কাজ করে ফেললাম।
ইনসিকিউরিটির তাড়নায় মধ্য রাত দুটোর দিকে বেরিয়ে পড়লাম ওর বাসার উদ্দেশ্যে।
পথে যে আমার বিপদ হতে পারে এরকম কোনো খেয়াল আমার নেই। মাথায় স্রেফ ঘুরপাক খাচ্ছিলো যতক্ষণ না আমি বোঝাতে পারবো আমি ওকে কতখানি চাই; আমার মনে ওর জন্য ভালোবাসা কতখানি, ততক্ষণ অবধি আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না।
ভাগ্য সহায় ছিল বলে পথে কোনো বিপদাপদ হলো না আমার।
ওদের বাসার নিচে গিয়ে যথারীতি কল করলাম নিদ্র কে। এত রাতে কল পেয়ে সে খানিকটা অবাকই হয়ে গিয়েছিল হয়তো, কারণ রাত্রি বারোটার মধ্যেই স্ট্রিক্টলি ঘুমোতে বলেছিল আমাকে।
আমিও ওর কথা রাখতে ফোন বন্ধ করে শুয়েছিলাম কিন্তু আনফরচুনেটলি ঘুমোতে পারিনি।
যাহোক কল রিসিভ করে ও শক্ত গলায় বললো_
–এখনো ঘুমোওনি সুপ্ত?
— আমি তোমার বাসার নিচে। একটু আসো না, একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় করে।
— হোয়াট!
চেঁচিয়ে উঠলো ফোনের ওপাশ থেকে । ছুটে এলো ব্যালকনিতে। আমি তখন ব্যালকনির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ওকে দেখামাত্র হাত নেড়ে ইশারা করলাম। ও ভীষণ রেগে বললো _
— এই মেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? এত রাতে একা একা আসতে কলিজা কাঁপলো না তোর?
আমি মিনমিন করে বললাম _
— প্লিইজ নিদ্র পরে বকা দিও। আমাকে ওপরে নিয়ে যাও এখন।
ও পুনরায় ধমক দিয়ে বললো_
— একা একা এসেছিস। একা একাই ফিরে যাবি। না তোকে বাসায় ঢুকতে দিবো আর না তোর সাথে কথা বলবো আমি।
ফোন কেটে ভেতরে চলে গেলো নিদ্র।
আমি অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু মনে মনে শিওর ছিলাম ও ঠিকই নিতে আসবে আমায়।
দু মিনিট পর আমার ধারণা কে সত্যি করে বাসার মেইন গেইট টা খুলে গেলো।
চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো নিদ্র। আমি ছুটে গিয়ে ওর গলায় ঝুলে পড়লাম।
দু চারটে শুকনো চুমু খেয়ে বললাম_
— আ’ম রিয়্যালি স্যরি। আমার যে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই তো এসেছি।
ও ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আমায় দু’হাতে আগলে নিলো।
— এত পাগলামি কেউ করে সুপ্ত? কত ডেঞ্জারাস একটা স্টেপ নিয়েছো আইডিয়া আছে তোমার!
— উঁহু । কত ভালোবাসি তোমাকে সেই আইডিয়া আছে। শুনতে চাও?
— এটাকে ভালোবাসা না। পাগলামি বলে সুপ্ত। তোমার কিছু হয়ে গেলে কি হতো আমার!
— স্যরি নিদ। আর কক্ষনো এমন হবে না।
ও নিশ্চুপ রইলো।
আমি ওর বুকে পর পর আরো কয়েকটা চুমু খেয়ে আহ্লাদী গলায় বললাম_
— আই প্রমিস আর পাগলামি করবো না। এবারের মত মাফ করে দাও?
— চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি।
— উঁহু আজ আমি তোমার সাথে থাকবো।
— এক থাপ্পড় দিয়ে সব কটা দাঁত ফেলে দিবো।
— বকা দাও মারো যাই করো আমি কোত্থাও যাবো না।
ওকে ছেড়ে রাস্তায় বসে পড়লাম আমি। ও কপাল চাপড়ে নিজে নিজেই বললো_”পাগল রে আমারে শান্তি দিলি না”
এরপর টুপ করে কোলে তুলে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো।
আমি গলা জড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকলাম।
,
পরদিন সকালের গাড়িতেই যাবে বলে সব প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছে। সাজানো লাগেজ টা দেখে আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো একদম।
ও আমার বিষণ্ণতা দেখে প্রশ্ন করলো_
— মুখটা অমন পেঁচার মত করে আছো কেন?
— তুমি কতদিনের জন্য যাচ্ছো নিদ?
— এক সপ্তাহ তো বটেই।
— আমি থাকবো কি করে তোমাকে ছাড়া?
— আমি কি একেবারেই চলে যাচ্ছি? মাত্র সাতদিনের ব্যাপার। আর তাছাড়াও ডেইলি ভিডিও কলে কথা হবে আমাদের ।
— ভিডিও কলে কি তোমার গায়ের ঘ্রাণ টা পাবো?
আসন্ন কষ্টের কথা চিন্তা করে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি।
ও আমার সামনে মেঝেতে বসে আমার হাতদুটো নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো_
— তুমি এত ভীতু কেন সুপ্ত? আমি তোমারই আছি আর তোমারই থাকবো। কেউ কখনোই আমাদের লাইফে এন্টার করতে পারবে না। আর এমন ছোটোখাটো বিরহ সব সম্পর্কেই থাকে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কেও। আমরা সামাজিক জীব সুপ্ত। সমাজের কতগুলো রুলস ফলো করতে হয় আমাদের । খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হলো খুব পরিশ্রম করতে হয়। স্রেফ ভালোবাসা দিয়েই পেট ভরে না, একটা শেল্টার পাওয়া যায় না।
আজ এতটুকু দূরত্ব মেনে নিতে না পারলে জীবনভর সাথে থাকাটা যে হবেনা । আমার এত প্রচেষ্টা আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই তো।
আমি তো বারবার বলি আমি তোমার আছি, তোমারই থাকবো। আমি ছাড়াও তোমার লাইফে অনেক কিছু আছে সুপ্ত। শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে পড়ে থাকলে লাইফটা থেমে যাবে তোমার। লাইফ টা নিয়ে কত পরিকল্পনা করেছিলে একসময়, আজ সব ভুলতে বসেছো। দিনে দিনে এত ডেস্পারেট হচ্ছো যে ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছো। অথচ তোমার পরীক্ষার বিষয়টা মাথায় রেখে পড়াশোনায় মগ্ন হওয়া উচিৎ ।
ভালোবাসাটাকে অর্জন করতে কত স্যাক্রিফাইস করতে হয়।
আজ একটু কন্ট্রোল করো নিজেকে, অবসেশন টা একটু কমিয়ে দাও। লাইফ গোলের দিকে ফোকাস করো, আ’ম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ। আই প্রমিস।
— তুমি সত্যি আমার হয়ে থাকবে তো?
— থাকবো সুপ্ত। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমার হয়েই থাকবো।
নিদ্রর করা ওয়াদা শেষ অবধি আমায় স্বস্তি দিলো। আমি একটু হলেও বুঝতে পারলাম, আশ্বস্ত হলাম সে শুধুই আমার। তাকে পাওয়ার জন্য এত পাগলামির দরকার নেই।
গম্ভীর পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে নিদ্র বললো_
— আমার চাঁদ। অসীম আকাশকে সাক্ষী রেখে- জ্যোৎস্নার আলোয় গা ভাসিয়ে কিছু স্মৃতি জড়ো করা যাক চলো?
আমি কান্নার মাঝেই হেসে দিলাম। ডান হাতটা ওর হাতের পানে বাড়িয়ে দিলে ও একরাশ মুগ্ধতা কণ্ঠে মেখে বললো_
— প্রেয়সী তুমি কি জানো! তুমি হাসলে তোমার চোখও হাসে। তোমার হাসির ঝংকার আর চঞ্চল চোখজোড়ার প্রেমেই কিন্তু পড়েছিলাম আমি।
— চোখ আবার হাসে নাকি!
— হাসে। চোখ সকল অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে।
— কীভাবে?
— সেটা আরেকদিন বোঝাবো। আজ চলো ভালোবাসা মেখে আসি।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় কোলে তুলে নিলো নিদ্র।
ব্যালকনিতে ডিভানে বসিয়ে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো_
— গান শুনবে?
আমি ওর ডান বাহুতে মাথা রেখে বললাম_”হু”
আকাশে প্রস্ফুটিত সেই এক ফালি চাঁদের আলোয় গা ভাসাতে ভাসাতে ভরাট কন্ঠে গেয়ে উঠলো_

তোমায় ছাড়া মনের কিনারা
পথেই হারায় পাড়া বে-পাড়া।

তোমার নামে মেঘের খামে
পাঠাই আমি নরম ইশারা
কেন এভাবে আমার সারাদিন
তোমায় ছুঁয়ে যে যায়।

নানা বাহানায়, নানা বাহানায়
নানা বাহানায়, নানা বাহানায়।

তোমার চিলেকোঠা রাতে
খোলা জানালাতে কতবার
আমার জেগে থাকা টুকু
আজ হারায় ঘুম তাঁর
পড়ে নিও চোখ সে তোমাকে গায়।

নানা বাহানায়, নানা বাহানায়
নানা বাহানায়, নানা বাহানায়।

তোমার আনাচে কানাচে
জোনাকি ছোঁয়াচে কি রঙিন
আমার অভিমানী হাওয়া
বুক ভাসায় দেখোনি
পড়ে নিও চোখ সে তোমাকে চাই।

নানা বাহানায়, নানা বাহানায়
নানা বাহানায়, নানা বাহানায়।
,
আমি বিভোর হয়ে ওর গান শুনছিলাম। একটা মানুষ সবদিক দিয়ে এত পারফেক্ট হতে পারে নিদ্রকে না দেখলে বোঝা যেত না।
গান শেষ হলেও গানের রেশটাই যেন কাটছিলো না। আমি চোখ বন্ধ করে পুরো সময়টা রোমন্থন করছিলাম এর মাঝেই ও আমাকে দু’হাতে আগলে নিয়ে প্রশ্ন করলো_
— ঘুম পাচ্ছে? বাসায় যাবে?
আমি ওর গায়ের ওম নিতে নিতে বললাম_
— উঁহু । আচ্ছা নিদ আমরা বিয়ে কবে করবো?
— এইচএস টা দাও আগে। ভার্সিটিতে ওঠো।
— নাহ্ আমরা পরীক্ষার শেষ দিনই বিয়ে করবো।
— হ্যাঁ তারপর লেখাপড়া ছেড়ে দিবা, আ্যাডমিশন প্রিপারেশন হবে খারাপ আর কোনো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবা না তাই তো!
— ওভাবে বলছো কেন?
— তুমি যে নম্বর ওয়ান পড়া চোর সেটা আমি এই কদিনে বুঝে গিয়েছি। শোনো আমার কাছে একটা ভালো প্রপোজাল আছে। তুমি যদি পাবলিকে চান্স পাও তাহলে রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার পরপরই আমি মিষ্টি আর সম্বন্ধ নিয়ে আসবো তোমাদের বাসায়।
— অত্ত দেরিই?
— জ্বীইইই। রাজি থাকলে বলো নতুবা তোমার অনার্স কামপ্লিট হওয়ার পর।
— এই না না আমি রাজি। প্লিজ প্লিজ অত দেরি না।
— গুড গার্ল। তাহলে আমি কাল ঢাকায় গিয়েই মায়ের সাথে কথা বলছি।
— সত্যি?
— সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি।
— ইয়ে কি মজা!
আমি আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।
ও হাসতে হাসতে বললো_
— তোমার মত বিয়ে পাগল এই পৃথিবীতে বুঝি আর একটাও নেই সুপ্ত।
— আমি ওয়ান পিস ই আছি এই পৃথিবীতে হুহ্
— আই আ্যাগ্রি উইথ ইউ।
আমি মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিদ্রর বুকে ঘুমোতেও শান্তি । জানিনা কোন ভালো কাজের উপহার স্বরূপ এই মানুষটাকে জীবনে পেয়েছি। কিন্তু এটা জানি, তাকে আমার জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে চাই। প্রতিটা নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে সে শুধুই আমার হয়ে থাকুক।

এক মুঠো গোলাপ
১৫
___

সময়টা শেষ বিকেল। সূর্যের নরম রোদ জানালার কাচ ভেদ করে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে আদুরে মুখে।
জানালার কার্নিশে মাথা ঠেকিয়ে আলোর ছটাগুলো হাতের মুঠোয় আগলে নেবার চেষ্টা করছি, কখনোবা ফিসফিসিয়ে আহ্লাদী গল্প জুড়ে দিচ্ছি তাদের সাথে । পাগলামি হলেও কাজটা আনন্দ দিচ্ছে বেশ।
পশ্চিম আকাশ লাল আবিরে ছেয়ে গেছে। দলবেঁধে কিছু শঙ্খচিল মনের সুখে উড়ো উড়ি করছে আকাশের বুকে। অস্তমিত টুকটুকে সূর্যটাকে তারা এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে দূর থেকে মনে হচ্ছে যুবতীর গলায় সূর্যমুখী লকেট।
,
এমনই কোনো এক বিকেলে নিদ্রর সাথে ওদের বাসার ছাদে বসে গল্প করছিলাম।
আকাশের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘ গুলোর দিকে ইশারা করে ও বলেছিল,
— সুপ্ত ঐ দেখো আকাশজুড়ে তোমার পোট্রেট।
— আমার পোট্রেট! কই?
— দেখো আমার চোখ দিয়ে দেখো, ভালোবাসার দৃষ্টি মেলে দেখো। বিশাল আকাশে তোমার আদুরে মুখটা ভাসে। ঐ যে শঙ্খচিলটা উড়ে যায় ও হলো তোমার চিবুকের তিল।
ওর কথা শুনে আমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম, সাথে আনন্দও লাগছিল । এমন ভালোবাসাময় বাক্য ওর মুখ থেকে কদাচিৎ বেরোয়।
আজ প্রায় দেড়মাস হলো আমাদের দেখা নেই। ক্যারিয়ার সাজাতে মানুষটা কি ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছে।
কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে, নেটে পাওয়া যায় না। এখন আবার ফোন কানে নিলেই পড়ার গান। “সুপ্ত কয়টা বই কমপ্লিট করলে? কতবার রিভাইজ দিলে, কনফিডেন্স তৈরি হয়েছে তো? এ প্লাস আসবে না!”
এমন কত কত প্রশ্ন, সব পড়াশোনা নিয়ে। মাঝেমধ্যে মনে হয় একটা রাগী টিচারের সাথে পড়ার সাজেশন নিতে ফোন দিয়েছি।
নিদ্রর কথা মনে পড়তেই মনটা আনচান করতে শুরু করলো।
সেই মুহুর্তেই কর্ণকুহরে একটা বিরহী গানের কয়েকটা লাইন ভেসে আসলো,
“রঙ্গিলা রঙ্গিলা, রঙ্গিলা রে
আমারে ছাড়িয়াড়ে বন্ধু কই গেলা রে”
ভ্রু কুঁচকে আমি ছুটে গেলাম ব্যালকনিতে।
গলির মোড়ের চায়ের দোকাটায় কয়েকটা ছোকরা সাউন্ডবক্সে গানটা বাজাচ্ছে ।
মাই গড, হোয়াট আ টাইমিং!
দারুণ বিস্মিত হয়ে গেলাম আমি।
“তোর বিরহের খবর পুরো শহরে ছড়িয়ে গেলো নাকি সুপ্ত!”
বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো, এ ছাড়া আর কিছুই তো করার নেই।
___
রবী ঠাকুরের “শেষের কবিতা” বইটা হাতে নিয়েছিলাম পড়তে। কিন্তু আমার চোখ ইদানীং কোনো প্রকার বই ই সহ্য করতে পারেনা। কোনো বইয়েরই এক পাতা কোনো শেষ করামাত্র জোঁকের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুম। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। অজান্তেই ঘুমের সাগরে তলিয়ে যাই।
আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দেড় ঘন্টার গভীর ঘুমটা ভেঙে যায় ফোনের ভয়ানক শব্দে।
ধড়ফড় করে উঠে আগে ঘরের লাইটটা জ্বালাই। এত বিলম্বের পরেও ফোনটা বাজা বন্ধ হয়না। ডেস্ক টেবিলের ওপর থেকে ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনে আভার নামটা ভেসে ওঠে। বিরক্তি যেন আরো বেড়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করে ধমকের সুরে বলি_
— কি হয়েছে এমন ননস্টপ কল করে যাচ্ছিস কেন অসময়ে?
— ধমকা ধমকি ছাড় আগে বল তো মিষ্টি কবে খাওয়াবি?
— মানেহ?
— এখন মানে মানে করে লাভ নেই চান্দু। আমার ভাইকে দিওয়ানা আশিক বানিয়ে ছেড়েছো, সে তো তোমায় ছাড়া কিছু বোঝেই না। রিলেশনে গেলা ট্রিট অবধি পাইনি। এখন শুনছি ভাই তোদের রিলেশানের ব্যাপারটাও ফ্যামিলিতে জানাবে।
মামণিকে অলরেডি বলেছে। তাহলে মিষ্টি তো আমার প্রাপ্য তাই না?
— মানে যা-তা। তোদের ভাই বোন দুটোকে স্রেফ কঞ্চির বাড়ি দেয়া উচিৎ । ওটাই ডিজার্ভ করিস তোরা। একজন আমাকে ইগনোর করে, ফ্যামিলির সামনে কনফেস করছে। আরেকজন আসছে মিষ্টি চাইতে। মাইর চিনিস?
— এই এই খবরদার আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যাচার করবি না। ইগনোর করলে এত রোম্যান্টিক স্ট্যাটাস দিতো বুঝি!
— রোম্যান্টিক স্ট্যাটাস! কোথায়?
— আ্যাক্টিং হচ্ছে না! কিছুই জানো না তুমি।
— আমি আসলেই জানিনা। অনেকদিন থেকে নেটে যাচ্ছি না তো।
— বলিস কি! তাহলে তো সারপ্রাইজ নষ্ট করে দিলাম আমি।
— সারপ্রাইজ!
— হুম। তুই নেটে আয় নিজেই দেখে নে।
— তুই বল না?
— না বাবা আমি বলে আরেক অপরাধ করতে পারবো না।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই কল ডিসকানেক্ট দিলো আভা।
মুখ বাঁকিয়ে দু চারটে গালি দিয়ে ডাটা অন করলাম। আমারও তো দেখা উচিৎ রাগী টিচার টা কি সারপ্রাইজ রেডি রেখেছে আমার জন্য।
,

ডাটা অন করা মাত্র মেসেঞ্জার-হোয়াটস আ্যাপে মেসেজের ঝড় উঠলো। সকল ঝড় ঝাপটা সামলে ইন্সটায় লগ ইন করে নিদ্রর প্রোফাইলে ঢুকে আমি সত্যিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম। মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমার একটা ছবি পোস্ট করেছে সে। ক্যাপশনে লেখা,
“you are the aura that blooms my life”

এটা তো শিউলির আপুর হলুদের ছবি। সেদিন সন্ধ্যায় নিদ্রর থেকে আ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য হলুদ নিয়ে পিছু পিছু ঘুরছিলাম। কোনো এক বাহানায় ওর গালে খানিক হলুদ ছুঁইয়েছিলাম। বিনিময়ে কি ভয়ানক একটা ধমক দিয়েছিলো আমাকে।
ধমক খেয়ে স্টেজের একপাশে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। সেই গোমড়ামুখো ছবিটাই আপলোড করা।
এই মুহুর্তের ছবি ও পেলো কোথায়? আর কোন ফটোগ্রাফারই বা এটা ক্যাপচার করলো। নাকি ও নিজেই..
অদ্ভুত!
ওর প্রোফাইল ঘাটাঘাটি করার পর দেখা গেলো এই ক’দিনে আমার বেশ কয়েকটা ছবিই আপলোড করা হয়েছে, ওর সাথে ছাদে বসে গল্প করা মুহুর্তের ছবিও আছে। তবে একটাতেও আমার ফেইস স্পষ্ট না। কোনো ছবিতে সাইড থেকে কোনোটা পেছন থেকে।
কমেন্টসে ওর বন্ধুবান্ধবরা আমাকে দেখার জন্য রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। নিদ্র সবাইকে এক বাক্যে রিপ্লাই দিয়েছে, “বিয়ের স্টেইজে দেখিস”
এই ছেলে বদমাশও কম না!
আইডি স্ক্রল করতে করতেই হেসে ফেললাম আমি। অনেকদিন আবদার করেছি ওর প্রোফাইলে আমাদের মোমেন্টসগুলো শেয়ার করতে। হ্যাঁ না কিছু বলেনি তবে আজ এসব দেখে আমার বড্ড আনন্দ লাগছে।
আনন্দের অতিশয্যে ডাটা অফ করে কল দিয়ে ফেললাম তাকে।
একবার রিং বাজতেই রিসিভ করে সে।
— ম্যাম আজ অসময়ে?
— কোথায় তুমি?
— বাসায় ফিরছি।
— তোমার অফিস তো শেষ হয় সাড়ে পাঁচটায়। এত লেইট কেন?
— আ্যাকচুয়ালি ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডায় বসেছিলাম।
— কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?
— ঘন্টাখানেক তো লাগবেই, প্রচুর জ্যাম আজ।
— আচ্ছা তাহলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে কল কোরো।
— পড়া ফাঁকি দিয়ে প্রেম হুমম?
— নট এভরিটাইম নিদ। তুমি এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারো না আমার সাথে।
— ওকে বাবাহ ওকে। আজ কথা বলবো।
— এখন তবে রাখি।
— রাখো
— আচ্ছা শোনো
— হ্যাঁ বলো।
— আ’লাভ ইউ।
— জ্যাম ছেড়ে গেছে সুপ্ত।
— বদমাশ একটা। আর কতো তড়পাবা তুমি আমাকে?
— এর উত্তর তুমি পাবে না।
— নিষ্ঠুর, জঘন্য লোক একটা।
— থ্যাংক্স ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট। বাই
আলতো হেসে কল কেটে দিলো নিদ্র।
_____
এইচএসসি পরীক্ষার ডেইট ঘোষণা করা হয়েছে। কলেজে নোটিশও টানিয়ে দিয়েছে আ্যাডমিট কার্ড কালেক্ট করতে হবে আর রেজিস্ট্রেশন পেপারটা লাস্টবার চেইক করতে হবে।
পরীক্ষার ডেইট শোনার পর থেকে আপু বারবার কল করছে আমাকে। ওর নাকি টেনশনে পেট গুড়গুড় করছে, গলা বারবার শুকিয়ে আসছে। অদ্ভুত, পরীক্ষা তো আমার। ওর এত টেনশন কেন?
আপুর এমন অস্থিরতা দেখে বাপি-মা হেসে খুন। সবাই মিলে ওকে বুঝিয়ে কোনো কাজ হয়নি। একরোখা সে একটু আগেই কল করে জানালো সন্ধ্যের ফ্লাইটে রংপুরে আসছে।
ওর এরকম ভুলভাল সিদ্ধান্তে আমার রাগ লাগছে। ঢাকা টু রংপুর বাই এয়ারে আসতে গেলে সৈয়দপুরে নামতে হবে। সৈয়দপুর থেকে আবার অন্য গাড়ি করে। এমন পাগলামির দরকার আছে! ভাইয়ার গাড়ি করে ডিরেক্ট আসতে পারতো। কিন্তু নাহ্ তার নাকি হাজবেন্ডের টাকা খরচ করতে আত্মসম্মানে লাগে। নিজে ইনকাম করে নিজের পয়সায় চলবে।
সব মানুষের আত্মসম্মানবোধটা ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে না। কেউ সুযোগ পায়না কেউবা আত্মসম্মান কি জিনিস বোঝেই না। সেদিক থেকে আই মাস্ট সে আপুর মত ব্যক্তিগুলোর কাছে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। বাট সময়ে-অসময়ে, সুবিধা-অসুবিধায় পার্টনারের থেকে হেল্প নেয়া ভুল নয়। এটা তো আমাদের অধিকারের মাঝেই পড়ে বরং।
কিন্তু কে বোঝাবে এই মহান মানুষটাকে? তার যেটা ভালো মনে হয় সে সেটাই করেছে আজ অবধি, বোধকরি ভবিষ্যতেও করবে। আর
আমরা বসে বসে টেনশন করবো।
,
ঘন্টাখানেক পর ফোন দিচ্ছি বললেও অর্ধেক রাত পেরিয়ে গেলো নিদ্রর খবর নেই। অভিমানে বুক ভারী হয়ে উঠছিলো আমার।
কপল বেয়ে দু এক ফোঁটা অশ্রুজলও গড়িয়ে পড়ছিল খানিক পর পর।
পরমুহূর্তে ওড়নায় চোখ-মুখ মুছে পড়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করছিলাম আমি। কিন্তু প্রেমের খেয়ালে কি আর পড়া হয়?
নিদ্র রংপুরে থাকলে সব বাঁধা পেরিয়ে ওর বাসায় উপস্থিত হতাম। কাছে নেই তাই সুযোগ পেয়ে গেছে ।
বই বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সিলিং ফ্যানের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে হ-য-ব-র-ল ভাবনার মাঝে শিয়রে সশব্দে ফোনটা বেজে উঠলো।
নাম দেখার প্রয়োজন নেই আমি জানি সে কে।
আন্দাজে রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই কাঙ্ক্ষিত কন্ঠে ডাক_
— সুপ্ত?
অজানা আবেশে চোখ মুদে নিলাম আমি। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রুজল। ওপাশ থেকে সে মৃদু হেসে বললো_
— আমার অভিমানী প্রেয়সী, কেঁদো না;আজ সারাটা রাত আমি তোমার নামে লিখে দিলাম।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here