এক মুঠো গোলাপ
Sinin Tasnim Sara
৩১-৩২
৩১
____
বিয়ের পরপরই নিদ্রর নানা-নানি নাতবউকে দেখবার ইচ্ছাপোষণ করলেন। নিদ্রর নানা অসুস্থ বলে তারা আসতে পারেননি। ভবিষ্যতেও আসতে পারবেন কি না সন্দেহ! শারিরীক কন্ডিশন দিনকে দিন তার খারাপই হচ্ছে। মৃত্যুর পূর্বে আদরের নাতির সুখ দেখে যেতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক। নিদ্র তার নানাভাইয়ের ভীষণ ক্লোজ ছিলো। বাবা-র অবর্তমানে নানাভাই ঢালস্বরূপ দাঁড়িয়েছিল তার জীবনে। শুভ কাজে সেই প্রিয় মানুষটা সাথে ছিলো না বলে বড্ড মন খারাপ হয়েছিল নিদ্রর। মা-বাবার পাশাপাশি এই মানুষটারও আশীর্বাদ তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ।
তাই সে পরিকল্পনা করেছে সুপ্তকে নিয়ে সোজা রাজশাহীতেই চলে যাবে। ছুটি আছে আরো তিনদিন। ওখানে দু রাত থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে তারা রওয়ানা হয়ে যাবে।
অনিমা অবশ্য যাচ্ছে না ওদের সাথে।তার কিছু অফিশিয়াল কাজের জন্য আর্জেন্ট ঢাকায় যাওয়া প্রয়োজন। সেও আজই ঢাকা ফিরছে।
,
নিশাতের মনটা বেশ খারাপ। মেয়েকে এত জলদি বিদায় দেবার ইচ্ছে তার ছিলো না। আরো দু’টো দিন নিজের কাছে রাখতো, মন খুলে গল্প করতো। বিয়ে তো হয়েই গেলো। আগের মত কি আর কাছে পাবে!
সুপ্ত মায়ের বিষণ্ণতা আন্দাজ করতে পেরেছে। তার নিজেরও বেশ খারাপই লাগছে কিন্তু করার তো কিছু নেই। সব দিক সামলে চলতে হবে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মাত্রই এক দায়িত্ববোধ এসে গেছে ভেতরে।
আপাতত মাকে স্বান্তনা দেয়া ছাড়া অন্য কোনো অপশন নেই।
বেরুনোর মুহুর্তে বাবা-মায়ের থেকে আলাদা ভাবে বিদায় নিলো সুপ্ত। কবির সাহেব তো নিজেকে সামলে নিলেন কিন্তু নিশাত একদমই পারলেন না। মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সুপ্ত নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো,
“আমি খুব জলদিই আসবো আম্মু। তুমি একদম মন খারাপ করবে না। শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে”
কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, এত জলদি বড় হয়ে গেলি কেন মা? আমি সেই ছোট্টো সুপ্তটাকে কত মিস করি।
— ইশশ কাঁদে না। আজ তো তুমি ছোট্টো বনে গেলে। দেখি চোখ মোছো তো। তুমি কাঁদলে আমি যাই কি করে হুম!
ওড়না দিয়ে মায়ের চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিতে দিতে বললো সুপ্ত।
— স্যরি আর কাঁদবো না। সাবধানে যা তোরা। আমি দোয়া করে দিই।
চোখের পানিটুকু মুছে ফেললেন নিশাত। কবির সাহেব স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে তাকে সামলে নিলেন।
সুপ্ত বাবা-র পা ছুঁয়ে সালাম করে বিগত দিনের ভুলগুলোর জন্য মাফ চাইলো। কবির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন_
— আমি কিছু মনে রাখিনি বাবু। তোমার বয়সটাই এরকম ছিলো, হঠাৎ করে এমন ধাক্কাটা তুমি মানতে পারছিলে না। ওসব কথা বাদ দাও। সবসময় হাসিখুশি থাকো তুমি। তোমার সুখটাই আমার কাছে সবার আগে। তোমার মুখের হাসির জন্য তোমার বাপি সবকিছুই করতে পারে। যেকোনো সমস্যায় সবার আগে বাপিকে জানাবে। কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না ঠিকাছে?
— দোয়া করবে বাপি।
— আমার দোয়া সবসময় তোমাদের সাথে থাকবে মা।
— আসি বাপি?
— হ্যাঁ চলো
___
রংপুর টু রাজশাহী ছয় থেকে সাত ঘন্টা জার্নি। লং জার্নিতে নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলো নিদ্র। তার পরিকল্পনা ছিলো একা একাই যাবে বউ নিয়ে। কিন্তু রাফনিদ ঘোর আপত্তি জানালো। এতখানি পথ ড্রাইভ করতে গেলে শরীর খারাপ হতে পারে। সে চায়না বোন-জামাইয়ের সুন্দর মুহুর্ত গুলো অসুস্থতা এসে নষ্ট করুক।
বাধ্য হয়ে নিদ্রকে ড্রাইভার নিতে হলো।
গাড়িতে ওঠবার মুহুর্তে রাফনিদ সুপ্তর কানে ফিসফিসিয়ে বললো_
— অল দ্য বেস্ট ফর ইওর কাপঝাঁপ। ঢাকায় গিয়ে কথা হবে হ্যাঁ?
— তা হবে বাট, কাপঝাঁপ! হোয়াটস দ্যাট?
— আরে গুটুরমুটুর।
— এখন আবার গুটুরমুটুর কি?
বিরক্তিকর এক্সপ্রেশন দিলো সুপ্ত। রাফনিদ ওর মাথায় গাট্টা মেরে বললো_
— গর্দভ গেট লস্ট। এই অবুঝ মন নিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলি কেন?
— ছিঃ আপু। আজ তুমি আমায় গর্দভ বললে?
— ভুল হয়েছে। আগে বলতে হতো। তাহলে বেচারা নিদ্র’র সাথে এই না ইনসাফি টা হতো না।
— যাও তোমার সাথে কথা নেই।
মুখ ফুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো সুপ্ত। রাফনিদ পুনরায় গাড়ির দরজা খুলে সুপ্তর কান টেনে ধরে বললো,
— বুদ্ধু কাপঝাঁপ মানে হলো…..
সুপ্ত শোনা মাত্র কান চেপে ধরে বললো,
— এই ছিইইইই। আপু যাও তো যাও, আমাদের লেইট হচ্ছে ।
— আহা আমার ঢঙ্গীন বোনটা। কিছুক্ষণ আগেই কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে দিচ্ছিল এখন লেইট হচ্ছে!
— ঢঙ্গীন আবার কেমন শব্দ হুহ?
— আমার বানানো শব্দ। বিশ্লেষণ করতে হবে?
— না না দরকার নেই। তুমি বরং আরো কয়েকটা শব্দ জড়ো করে দুলাভাইকে বিশ্লেষণ করে শোনাও। আমরা আসি।
— আমি তো তোকেই শোনাব। তুই ঢাকায় আয় একবার।
দুষ্টু মাখা হাসি দিয়ে বললো রাফনিদ।
এক মুঠো গোলাপ
৩২
_____
মূল শহর থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে মফস্বলের দিকে নিদ্রর নানাবাড়ি। কাঁচা-পাকা মিলিয়ে রাস্তা৷ রাস্তার দু ধারে যতদূর চোখ যায় আবাদি জমি। জমিগুলোতে সবুজ-সোনালী ধানগাছ ঝলমল করছে। সুপ্ত মুগ্ধ চোখে বাতাসে দোল খাওয়া কচি ধানগাছের আনন্দ নৃত্য উপভোগ করছে। তার মনে হচ্ছে এই সুবাসিত কাদামাটি,হালকা শিশির ঝরা প্রকৃতি আর সবুজ ফসল নতুন বধূকে স্বাগতম জানাচ্ছে তাদের এলাকায়। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য আরো কাছে থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে সুপ্তর। সে বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে নিদ্রর হাত চেপে ধরলো।
— প্লিজ গাড়িটা থামাতে বলো। আমি ঐ ফসলগুলো কাছে থেকে দেখতে চাই।
সুপ্তর আঙ্গুলের ইশারা অনুসরণ করে নিদ্র তাকালো। মুচকি হেসে বললো_
— জমিগুলো আমাদের প্রতিবেশীদের। চিন্তা নেই। কাল একবার নিয়ে আসবো তোমায়।
— উঁহু এখনই প্লিজ।
— ম্যাডাম আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। নানা-নানি যে অপেক্ষা করছেন। তাদের অপেক্ষা আরো সুদূরপ্রসারী করতে চাও?
— না না তাহলে থাক।
— মন খারাপ করে না। কাল আরো নতুন নতুন জিনিস তোমায় দেখাবো। ধানের শিঁষে যখন শিশিরবিন্দু জমে থাকবে, প্রকৃতি যখন সম্পূর্ণ কুয়াশার চাদরে ঢাকা তখন এসব দেখতে আরো ভালো লাগবে।
— বাবা ঠিক কইছে বউমা। এই অসময়ে দেইখা মজা পাইবা না। সাঁঝ তো হইতেছে। তুমি বরং কাইল বিয়ানা সূর্যের আলোয় দেইখো।
লুকিং গ্লাসে সুপ্তর প্রতিবিম্ব’র দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন ড্রাইভার সাহেব।
সুপ্তও মাথা নেড়ে সায় দিলো।
মফস্বলে সচরাচর গাড়ি দেখা যায়না। এতদিন বাদে গাড়ির শব্দ পেয়ে ছোটো-ছোটো ছেলেপেলে খেলা ছেড়ে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, তাদের আগ্রহ দেখবে গাড়ি কোথায় যায়!
মোটামুটি মাঝারি সাইজের একটা গেটের সামনে গাড়িটা থামলো।
সুপ্ত গলা বাড়িয়ে দেখলো গেইটের এক পাশে গোল্ডেন কালারের নেমপ্লেট। তাতে কালো কালিতে লেখা “শান্তিনিকেতন”
— বাসার নাম শান্তিনিকেতন?
নিদ্রকে প্রশ্ন করলো সুপ্ত। নিদ্র উপরে নিচে মাথা নেড়ে বললো_
— হ্যাঁ। আমার নানী রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সবকিছুই তার বড্ড পছন্দের। পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে অবস্থিত রবী ঠাকুরের গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম শান্তিনিকেতন। যখন তিনি এই খবর পেলেন তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন কখনো যদি নিজের একটা বাড়ি হয় তাহলে তার নাম দেবে শান্তিনিকেতন।
— বিদ্যাপীঠের সাথে বাড়ির কি সম্পর্ক?
— নানী বলেন শিক্ষাই শান্তি, শান্তিই শিক্ষা । চির শান্তির স্থল আপন নীড়। তাহলে নীড়ের নাম কেন শান্তিনিকেতন নয়!
অবশ্য রবী ঠাকুরের সবকিছুই তো ওনার পছন্দ। এর পেছনেও নিশ্চয়ই আরো যুক্তিসঙ্গত কারণ তিনি দর্শাতে পারবেন। তুমি বরং তার থেকেই জেনে নিও।
,
নিদ্র-সুপ্তর কথোপকথন বন্ধ হয় গেইট খোলার শব্দে। তারা দু’জনেই গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এগোয় বাড়ির ভেতর দিকে। সুপ্ত চোখভরা আগ্রহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা তিন তলা বাসা এবং তার আশেপাশের পরিবেশ। বাসার একপাশে সুসজ্জিত ফুলের বাগান। অপর পাশে ছাউনির মতন কিছু একটা। সেখানে একটা টি টেবিল আর বেতের কয়েকটা মোড়া সাজানো । ছাউনি থেকে কিছুটা দূরে লোহার তৈরি দোলনা।
নিদ্র ঐ দোলনা দেখিয়ে সুপ্তকে বলে,
— ছোটোবেলায় আমি আর দাদাভাই ওখানে খেলতাম। কাদামাটি মেখে একাকার হয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন নানীমার সে কি রাগ। বারবার নিষেধ করতেন, এভাবে কাদামাটি নিয়ে না খেলতে৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আমরা তো খেলবোই। মার্বেল, ক্রিকেট আর কত রকমের খেলা আমাদের। একদিন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দাদাভাই এত জোরে বল ছুঁড়লো সোজা আমার বুকে এসে লাগলো। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারিনা। নানী ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে হসপিটালে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার বললো ভাগ্য ভালো বেঁচে গেছি।
নানাভাই বাসায় ছিলেন না, খুলনায় বিশেষ কাজে গিয়েছিলেন। এজন্য নানীর ভয় বেশি।
হসপিটাল থেকে বাসায় আসার পর ঐদিনই ডিক্লেয়ার করে দিলেন ওখানটায় দোলনা বসানো হবে। আমরা কত রিকোয়েস্ট করেছি আমাদের খেলার জায়গাটা নষ্ট না করতে। কিন্তু নাহ্ আমাদের কথা একদমই শোনা হলো না। বানানো হলো এই দোলনা।
কতশত স্মৃতি এই জায়গাগুলো জুড়ে। আমরা নেই কিন্তু আমাদের স্থান দখল করে আছে ইউশা।
— ইউশা কে?
— দাদাভাই মানে,আমার মামাতো ভাই ইয়াদের ছেলে। ভেতরে চলো তার সাথেও পরিচয় করিয়ে দেবো।
মৃদু হেসে সুপ্তকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেলো নিদ্র।
কলিংবেল বাজানোর পূর্বে সুপ্ত জিজ্ঞেস করলো,
— সব ঠিকঠাক আছে তো?
নিদ্র চোখ ঘুরিয়ে একবার পুরোটা দেখে নিয়ে বললো_
— মাথায় কাপড় দাও।
____
এতবড় বাড়িতে মানুষ মাত্র চারজন। নিদ্রর নানা ইব্রাহিম হোসেন, তার স্ত্রী আনজুমান হোসেন। ইব্রাহিম সাহেবের নাতবৌ নিধি ও তার ছেলে ইউশা ইয়াদ।
নিধি, ইব্রাহিম সাহেবের বড় ছেলে মুদাসসিরের একমাত্র পুত্র ইয়াদ ইব্রামের স্ত্রী।
বসার ঘরে পুরো পরিবারের বিশাল একটা ছবি টাঙানো। ছবির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে সুপ্ত চেনার চেষ্টা করলো কে কোনটা।
তার মনযোগ ভঙ্গ হলো এক কোমল হাতের স্পর্শে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো নানী আনজুমান।
আনজুমানই প্রথমে কথা বললেন।
— এসো বসো বুবু।
সুপ্তর হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিলেন উনি। নিদ্র পেছনে নানা ভাইয়ের হাত ধরে তার সাথে কথা বলতে বলতে আসছে। ওদের আসতে দেখে আনজুমান নিদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন_
— মাশাল্লাহ্ চাঁদের টুকরো মেয়েকে বিয়ে করেছিস নানুভাই। এত মায়া আমার নাতবৌয়ের মুখে, চোখ আমার জুড়িয়ে গেলো।
হঠাৎ প্রশংসায় লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো সুপ্ত। কর্ণলতিকা-গাল টসটসে লাল হয়ে গেল নিমেষেই।
নিদ্র ওর আরক্তিম বদন দেখে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলো।
ইব্রাহিম সাহেব ওপাশের সোফায় বসে হাসতে হাসতে বললেন_
— তুমি তো নাতবৌ কে লজ্জায় ফেলে দিলে আনজু।
— ও’মা লজ্জা কি! সুন্দরের প্রশংসা করবো না। আমরা তো নিজেরই মানুষ। এভাবে লজ্জা পেতে আছে বুবু?
সুপ্তর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন আনজুমান। সুপ্তর লজ্জার সীমানা আকাশ ছু্ঁই ছুঁই। না পেরে ও আনজুমানের বাহুতে মুখ লুকিয়ে ফেললো।
ওর এহেন কান্ডে আনজুমান হো হো করে হেসে উঠলো।
মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “পাগল মেয়ে”
,
— কি খবর নিদ্র কেমন আছো?
সুপ্তর পেছন থেকে মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ ভেসে আসলো।
তড়িৎ সকলের চোখ গেলো তার দিকে। নিদ্র সহাস্যে জবাব দিলো_
— একদম দারুণ। তোমার কি অবস্থা ভাবি?
— এইতো চলছে। নতুন বউ এসেছে?
সোফায় বসে থাকা সুপ্তকে উদ্দেশ্য করে বললো নারীটি। নিদ্র মাথা কাৎ করে সম্মতি দিতেই সে চপল পায়ে হেঁটে এসে সুপ্তর সামনে দাঁড়ালো।
আনজুমান সুপ্তকে বললেন,
— ও হলো আমার বড় নাত বৌ নিধি।
সুপ্ত একঝলক মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো কম বয়সী এক নারী। বুঝে উঠতে পারলো না তাকে কদমবুসি করবে নাকি মুখে সালাম দিবে। দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে উঠে দাঁড়ালো সে। নিধি হাসিমুখে বললো_
— সালাম করার পরিকল্পনা করছো? আমার কিন্তু বয়স এতটাও বেশি নয়। মুখে সালাম দিলেই হবে।
তার কথায় সুপ্তর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিলো। মুখে সালাম দিয়ে নরমাল আলাপচারিতা সেরে নিলো সে।
ইব্রাহিম তাড়া দিয়ে বললেন_
— ওদের ঘরে নিয়ে যাও বড় নাতবৌ। এতটা পথ জার্নি করে এসেছে। কিছু খায়ওনি হয়তো।
যাও যাও নানুভাই ফ্রেশ হও গিয়ে।
নিদ্র বসা থেকে কাত হলো সোফাতেই। নিধিকে জিজ্ঞেস করলো_
— ভাবি ইউশা কোথায় ?
— ও ঘুমায়।
— এই অসময়ে?
— কয়েকদিন থেকে জ্বর বাচ্চাটার। ঔষধ খাচ্ছে আর সময় অসময়ে ঘুম।
— তা তুই কেন এখানে শুয়ে পড়লি নানু?
আনজুমান ভ্রু কুঁচকে বললেন। নিদ্র নানীর দিকে তাকিয়ে রসিকতার ছলে জবাব দিলো_
— শান্তিনিকেতনে সব জায়গাতেই শান্তি নানী। আলাদা করে ঘরে যাওয়ার দরকার পড়বে না।
— ফাজিল। বউটা যে ক্লান্ত শরীরে একা একা বসে আছে। তাকে তো ফ্রেশ হতে হবে। যা ঘরে যা বউ নিয়ে।
নিদ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন আনজুমান।
নিদ্র উঠে বসে ওর নানীর হাতদুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের গালে চেপে ধরে বললো,
— তোমাদের খুব মিস করেছি মা।
— আমরাও তোকে খুব মিস করেছি।
আর্দ্র গলায় বললেন আনজুমান।
ইব্রাহিম সাহেব চোখ ভরে দেখছেন ব্যস্ততার দেয়ালে চাপা পড়া সেই পুরানো পারিবারিক মেলবন্ধন। আজ নিদ্রকে ছোট্টোবেলার নিদ্র মনে হচ্ছে৷ চোখের পর্দায় ভাসছে ফেলে আসা দিনগুলোর টুকরো টুকরো স্মৃতি । এভাবেই তো নানীর দুহাত নিজের গালে ঠেকিয়ে মা, মা করে ডাকতো ছেলেটা।
সময় কত দ্রুতই না গড়িয়ে যায়।
_____
সন্ধ্যার একটু পরেই দেখা হলো ইউশার সাথে। সাড়ে চার বছর বয়সী মিষ্টি একটা বাচ্চাছেলে। সুপ্তকে দেখা মাত্র দুহাত বাড়িয়ে বললো
— মামুণি কোলে নাও।
ইউশা ইন্ট্রোভার্ট মতন। অপরিচিত কারো সাথে মিশতে পছন্দ করে না। হাজার চেষ্টা করেও নিধি তাকে বাইরের বাচ্চাদের সাথে খেলতে পাঠাতে পারে না। অথচ আজ সুপ্তকে দেখে নিজে নিজেই তার কোলে ওঠবার বায়না করলো। নিধি তো অবাক।
সুপ্ত মুচকি হেসে ইউশা কে কোলে তুলে নিলে নিধি জিজ্ঞেস করলো_
— ইউশা মামুণি কে চিনতে পারলে কি করে?
— মামু চিনিয়েছে।
আধো আধো স্বরে বললো ইউশা।
নিধি দেখলো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে নিদ্র।
— আরে নিদ্র এ তো ম্যাজিক। যে ইউশা অপরিচিত কাউকে দেখলেই আমার আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকে সে নিজে থেকেই সুপ্তর কোলে উঠে গেলো!
— আসলে আমার বউটাই ম্যাজিক্যাল। যার সামনে পড়ে সে-ই ভালোবেসে ফেলে। তাইনা মামা?
সুপ্তর পাশে এসে দাঁড়িয়ে ইউশার গাল টেনে বললো নিদ্র।
ইউশা মাথা নেড়ে সুপ্তর কাঁধে মাথা রেখে আদুরে স্বরে ডাকলো,
— মামুণি।
সুপ্ত ইউশাকে পরম মমতায় আগলে নিয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে জবাব দিলো,
— বলো বাবাটা।
ইউশা অবশ্য আর কিছু বললো না চুপচাপ সুপ্তর কাঁধে মাথা এলিয়ে রইলো।
নিধি ওদের তাগাদা দিয়ে বললো,
–চলো তোমরা খাবে।
_________
খুব কম সময়ে ইউশা আর সুপ্তর বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ইউশা একমুহূর্ত সুপ্ত ছাড়া থাকছে না। ওর হাতেই খাবার খেলো, ঔষধ খেলো। নিধি ওকে কয়েকবার নিতে এলে তার সাথেও গেলো না। সুপ্ত বললো থাক ও আমার কাছেই।
ইউশা কে নিয়েই সুপ্ত খাওয়াদাওয়া কমপ্লিট করলো, সকলের সাথে বসে আড্ডাও দিলো।
ওদিকে নিদ্র নানাভাইকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসলো।
ক্লান্তিটা এখন উপলব্ধি করতে পারছে। জানালার থাইগুলো টেনে দিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো সে।
,
ঘড়ির কাঁটা বারো’র ঘরে পড়া মাত্রই ড্রয়িংরুমের বড় দেয়াল ঘড়িটা ঢংঢং করে বেজে উঠে সময় জানান দিলো। আনজুমান গল্প থামিয়ে বললেন,
— দেখেছো কত রাত হয়ে গিয়েছে। বুঝতেই পারিনি।
— সমস্যা নেই। আমার আপনার সাথে গল্প করতে ভালোই লাগছে।
আন্তরিক ভাবে বললো সুপ্ত। আনজুমান মৃদু হেসে বললেন_
— সারাদিন জার্নি করে আসলে। রাত জাগা ঠিক হবে না বুবু। আমরা কাল গল্প করবো। তুমি ঘুমাতে যাও।
নিধিও সাথেসাথেই বললো_
— ইউশা কে আমার কাছে দাও।
ইউশা তড়িৎ বিরোধিতা করে উঠলো। সে যাবেনা , সে আজ সুপ্ত মামুণির কাছে ঘুমোবে। কোনো কিছু করেই তাকে মানানো যায় না। ছেলের এমন কান্ডে নিধি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো। সুপ্তর হাত ধরে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো_
— স্যরি বোন আমার ছেলেটার জন্য তোমাকে এত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
ইউজুয়ালি ও কারো কাছেই যায়না কিন্তু আজ তোমায় কেন যে ছাড়তে চাইছে না বুঝতে পারছি না। ইউশা, আব্বুটা আসো মামুণি ঘুমোবে না?
শেষ চেষ্টাস্বরূপ ইউশাকে কোলে নেবার চেষ্টা করলো নিধি। কিন্তু গা মুচড়ে সরে গিয়ে সুপ্তর গলা জড়িয়ে ধরলো সে।
সুপ্ত ওর পিঠে আদর করে নিধির উদ্দেশ্যে বললো_
— ইটস ওকে ভাবী। আমি মাইন্ড করিনি। আর ঝামেলা কি, আমার বরং ভালোই লাগছে ইউশা কে নিয়ে টাইম স্পেন্ড করতে। এত ভদ্র একটা বাচ্চা, দেখলেই আদর পাচ্ছে। ডোন্ট ওয়ারি, আমি ডিস্টার্ব ফীল করছি না। বরং বাহানা খুঁজছিলাম ওকে কাছে রাখার।
— মামুণি ঘুমম
ইউশা আদুরে স্বরে বললো সুপ্তকে। সুপ্ত আর নিধির সাথে কথা বলতে পারলো না। আনজুমান আর নিধির থেকে বিদায় নিয়ে ওকে কোলে করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
____
ভীষণ টায়ার্ড থাকায় বিছানায় গা দেয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে নিদ্র। সুপ্ত রুমে এসে দেখে নিদ্র ঘুম। সন্তর্পণে ওর গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে দিয়ে ইউশাকে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো ।
ইউশা তখনো ওর গলা জড়িয়ে রেখেছে। সুপ্ত ওকে দু পায়ে বসিয়ে গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে বুকে নিয়ে গুনগুন করে ঘুম পাড়ানী গান করে ঘুম পাড়াতে লাগলো।
নিধি টাইম মেইনটেইন করে চলতে পছন্দ করে। ইউশাকেও সে রুটিন মেনে চলতে শেখাচ্ছে।
সময় মতো খাওয়া,গোসল-ঘুম। ইউশা রাত দশটার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেল।
সুপ্তর উষ্ণ স্পর্শ আর মিষ্টি স্বরের গুনগুনানো ইউশাকে দ্রুতই ঘুমের সাগরে নিমজ্জিত করে ফেললো। সুপ্তর গলার কাছটায় জামা শক্ত করে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
এদিকে সুপ্তর চোখে ঘুম নেই। গ্রামাঞ্চলে শীতের সময় ন’টা বাজলেই রাত। এখন তো বারোটা পার হয়েছে। পুরো এলাকাজুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এসে। তার সাথে বাড়িটাতেও। থেকে থেকে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছে না সুপ্তর।
বিছানায় তার পরম প্রিয় মানুষটা গভীর ঘুমে তলিয়ে। কোলে একটা ছোটো বাচ্চা সেও শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।
সুপ্তর কাছে সবকিছু কেমন অন্যরকম মনে হচ্ছে। রাত্রীর গভীরতা বাড়ার সাথেসাথে তার মনেও এক অদ্ভুত বাসনা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মা হবার বাসনা। কে জানে কেন আজ ইউশা কে কাছে পাওয়ার পর থেকে সুপ্তর ভেতরের মাতৃ সত্ত্বা জেগে উঠেছে। খুব করে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কবে তার কোল জুড়ে এমন মিষ্টি একটা প্রাণ আসবে?
তুলতুলে দেহ যেন তুলোর ন্যায়। ছোট্টো ছোট্টো চোখ, নিদ্রর মতন প্রশস্ত কপাল। বাঁশির মত চিকন ছোট্টো নাক, পাতলা ঠোঁটজোড়া আর আদুরে গাল।
ভাবতে ভাবতেই ঘুমন্ত ইউশা কে নিয়ে বিছানার দিকে গেলো সুপ্ত।
ওকে এক হাতে জড়িয়ে আস্তে করে নিদ্রর পাশে শুয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণ পর ইউশাকে ওদের দুজনার মাঝে শুইয়ে দিয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বললো_
— তোর মত তুলতুলে একটা বাবু আমার কবে হবে রে।
প্রতুত্তরে ইউশা তো কিছু বললো না কিন্তু নিদ্র ঠিক বললো, ঘুম জড়ানো কণ্ঠে_
— সময় হোক। আপনা থেকেই হয়ে যাবে।
— তুমি জাগলে কখন?
— তুমি আমার পাশে শোয়া মাত্র ।
চোখ খুলে বললো নিদ্র।
সুপ্ত ওর এক হাত নিদ্রর গালে ঠেকিয়ে আহ্লাদী স্বরে শুধালো
— আমাদের একটা বাবু কবে হবে?
— হবে, হবে।
— উফফ কবে সেটা?
— তুমি যখন একটা ধাঁধাঁর উত্তর দিতে পারবে।
— কোন ধাঁধাঁ।
— পৃথিবীতে কোন প্রাণীটা সকালবেলা চারপায়ে হাঁটে, দুপুরবেলা দু পায়ে হাঁটে এবং বেলা শেষে তিন পায়ে হাঁটে?
— তুমি জেনে বুঝে আমাকে কঠিন ধাঁধাঁ ধরেছো?
— খুব সহজ উত্তর। মাথা খাটালেই পেয়ে যাবে।
— আর আমার বাবু?
— উত্তরের পর।
ঠোঁট চেপে হেসে ব্ল্যাঙ্কেটটা ভালোভাবে মুড়িয়ে নিলো নিদ্র।
সুপ্ত ওর বাহুতে একটা কিল মেরে মুখ ফুলিয়ে বললো_
— বিশ্ব খারাপ তুমি।
— আই আ্যাম আ্যাগ্রি উইথ ইউ।
হামি দিতে দিতে বললো নিদ্র।
সুপ্ত বিষণ্ণ ভাবে ইউশা কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো। নিদ্রর সাথে আজ থেকে সবরকমের কথাবার্তা বন্ধ বন্ধ বন্ধ। হুহ্
চলবে,
[কেউ কি জানেন ধাঁধাঁর উত্তর? 🤔]