#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_21
#Writer_TanhaTonu
আরশি ঘুমের মধ্যেই অস্পষ্ট একটা কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ ওকেই কিছু বলছে।কিন্তু আরশি বুঝতে পারছে না।সবই কেমন যেনো অস্পষ্ট লাগছে।মাথায়ও মনে হচ্ছে কেউ হাত বুলাচ্ছে।আরশি তেমন গুরুত্ব দিলো না।ঘুমের মধ্যে আর কতটুকুই বা কি বুঝবে।আরও কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরই যেনো আরশির চেতনা ফিরল।ও চোখ খুলে দেখল ওর সামনে সাদা একটা কি যেনো যাতে ও মাথা রেখে শুয়ে আছে।আরশির মাথায় কিছুই ক্যাচ করছে না।তাই ও সেই সাদা জিনিসটার উপর হাত বুলাতে লাগল।হঠাৎ কানে এমন একটা কথা এলো ওর…
—”আরশি ঘুম হয়েছে?আর দশ মিনিটের মধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবো।সবাই উঠে পড়ছে তো।তোমাকে আমার সাথে এভাবে দেখলে সবাই খারাপ ভাববে”
আরশির যেনো পুরোই চেতনা ফিরল।ও সাথে সাথে সিদ্রাতের বুক থেকে মাথা তুলে গোল গোল চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত হালকা হাসল আরশির এমন ফেইস দেখে।আরশি মুখটা ওরকম রেখেই জিজ্ঞাসা করল…
—”আমি এতোক্ষণ আপনার বুকে ছিলাম আর আপনার বুকে হাত বুলাচ্ছিলাম??”
সিদ্রাত আরশির অবস্থা দেখে মুখ টিপে হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।আরশি লজ্জায় একদম শেষ। আড়চোখে একবার আশেপাশে তাকিয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।সিদ্রাত হো হো করে হেসে দিলো।আরশি হাতের ভিতর মুখ রেখেই লজ্জামশ্রিত হাসল…
দশ মিনিট পরই সবাই বাস থেকে নেমে পড়ল।সকাল সকাল রওনা দেয়ায় কোনো জ্যাম পড়েনি। দশটা বিশের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেলো কাঙ্ক্ষিত জায়গায়।সবাই নেমে যাওয়ার পর সিদ্রাত আরশির হাত ধরে অতি সাবধানে নামালো।আরশির মনে মনে অনেক ভালো লাগছিলো কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না।
সবাই আগে একটা হোটেলে গেলো।বাস থেকে নেমেই আরশি ফারহা আর বনির কাছে চলে গিয়েছে।ওরা অন্য বাসে ছিলো বলে একসাথে আসতে পারেনি।সিদ্রাত আরশির পাশে না থাকলেও আরশিকে চোখে চোখেই রাখছে।স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষা সফরের জন্য একদিনের জন্য পুরো একটা রিসোর্ট আগেই বুক করে রেখেছিলো।প্রায় ত্রিশটার মতো রুম সবাই ভাগ করে নিয়েছে।কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ব্রেকফাস্ট করেই ওরা জাফলং যাবে…
আরশি ফারহা আর বনি গল্প করছিলো।এর মাঝেই ডাক আসল ব্রেকফাস্ট করতে যেতে।উপর তলাটা রেস্টরুমের জন্য আর নিচের ফ্লোর পুরোটা ক্যান্টিন.. আরশি বনি আর ফারহা নিচে গেলো।তিনজন এক সাইডে বসে পড়ল।আরও দুইটা সিট খালি।প্রতিটি টেবিলে পাঁচজন করে বসা যায়…
হুট করে ছোঁয়া আর নিরাও এসে আরশিদের পাশে বসে পড়ল।আরশির শরীর জ্বলে উঠল।ও দাঁতে দাঁত চেপে চাপা কন্ঠে জিজ্ঞাস করল…
—”নাটক করতে এসেছিস এখানে?নাকি ভরা মজলিসে আবারও চড় খেতে চাচ্ছিস?”
নিরা আর ছোঁয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খাওয়া শুরু করল।আরশির মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো।ও উঠে চলে যেতে নিলো।ফারহা আর বনিও পিছু পিছু আসতে নিলে আরশি হালকা রেগে বলল…
—”আমার মুখে কি মধু লাগছে যে পিছন পিছন আসছিস?না খেয়ে যদি পিছন পিছন আসিস তাহলে আন্টিকে বলব তুই সিলেট এসে বিএফের সাথে ঘুরেছিস”
ফারহার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।ও জিজ্ঞাস করল..
—”আমার আবার বিএফ আসল কোথা থেকে?”
—”সেটা তো আর আন্টি জানে না।আমি যেটা বলব সেটাই বিশ্বাস করবে”
ফারহা ভেঙচি কাটল আরশিকে।তারপর বনিকে নিয়ে খেতে চলে গেলো। এমনিতেও ওদের দুজনের পেটেই ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছিলো।আরশি রিসোর্টের পাশে একটা গাছের ধারে এসে বসে রইল…
বনি খেতে খেতে ফারহাকে বলল..
—”আরশি খেলো না অথচ আমরা খাচ্ছি।আমার ভালো লাগছে না”
ফারহা বিরক্তি নিয়ে বলল…
—”বলদের মা আমি আর তুই না খেলে আমাদেরকে খাইয়ে দেয়ার কেউ নেউ।কিন্তু আরশিকে একটু পর ঠিকই একজন খাইয়ে দিবে”
বনি হাসল।নিরা খোঁচা মেরে বলল…
—”সেটা নিশ্চয়ই আরশির প্রেমিক পুরুষ মিস্টার সিদ্রাত আজওয়াদ যাকে কিনা আমাদের আরশি শরীর দিয়ে বশ করেছে”
বনি আর ফারহা দুজনেরই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।বনি শয়তানি হেসে বলল..
—”তুই ওই গুন্ডা নিয়াজকে শরীর দিয়ে বশ করেছিস বলে কি সবাইকেই নিজের মতো ভাবিস?হুহ..অবশ্য পতিতারা তো সবাইকেই পতিতা ভাবে”
নিরার মাথা রেগে ফেটে যাওয়ার উপক্রম।ও বনির দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রেগে হনহন করে চলে গেলো।ওরা যেতেই ফারহা বনিকে জিজ্ঞাস করল…
—”কিরে তুই এসব কি বললি?”
—”যা বলেছি ঠিকিই তো বলেছি।যদিও ওরা ফিজিক্যাল রিলেশনে যায় নি তাতে কি!ওই নিয়াজকে তো ও সবই উন্মুক্ত করে দিয়েছে।নিয়াজ শরীরের যেখানে ইচ্ছা সেখানেই হাত দেয়..বাজে মেয়ে!”
ফারহার চোখগুলো রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেলো…
আরশি মন খারাপ করে বসে ছিলো।পাশে কেউ বসতেই ও তাকায়।সিদ্রাতের হাতে একটা ছোট্ট প্লেটে চিকেন সিজলিং আর অল্প ভাত..আরশি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল…
—”স্যার এগুলো কি?”
—”না খেয়ে চলে এসেছো কেন?খেয়ে নাও এগুলো।খাওয়ার সাথে রাগ করলে গুনাহ হয়”
—”কিন্তু সবাইকে তো স্যান্ডউইচ আর পাস্তা সার্ভ করা হলো।আপনি এগুলো পেলেন কোথা থেকে?”
সিদ্রাত মৃদু হেসে বলল..
—”তুমি তো ভাত পাগল মেয়ে।ওগুলোতে কি আর তোমার পেট ভরবে?”
আরশি অবাক হলো এটা ভেবে যে সিদ্রাত ওর জন্য.. ওর কথা ভেবে আলাদা খাবারের ব্যবস্থা করেছে।আরশির খেতে মন চাচ্ছে না।কিন্তু সিদ্রাত টিচার হয়েও ওর জন্য এতোকিছু করেছে তাই আর না করল না।জোর করেই খেলো।খাওয়া শেষ হলে একজন ওয়েটার এসে প্লেটগুলো নিয়ে গেলো
সিদ্রাত ভিতরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।এতে আরশিও উঠে দাঁড়ালো।সিদ্রাত যাওয়ার আগে বলে গেলো…
—”আর দশ মিনিট পরই জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া হবে।সাবধানে থাকবে ফারহা আর বনির সাথে”
আরশি সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল।সিদ্রাত চলে গেলো।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সিদ্রাতের কেয়ারগুলো খুবই ভালো লাগছে।এভাবে চুপ থাকতে ভালো লাগছে না।কিন্তু ও চুপই থাকবে না।বেশি ঘেষবে না সিদ্রাতের সাথে…
প্রায় এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট জার্নি করার পর ওরা জাফলং আসল।জাফলংয়ের মাটিতে পা রাখতেই আরশির পুরো সত্তা জুড়ে অন্যরকম ভালো লাগা বয়ে গেলো..
সিলেট জেলা থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত।পিয়াইন নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ,,,আশেপাশের সবুজের সমারোহে ঘিরা দৃশ্য.. গাছপালা পাহাড়..জাফলংয়ের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য পাথরে ভরপুর।নদীর উপরও ভেসে আছে অসংখ্য পাথর,,ঝুলন্ত ব্রিজের বাম পাশ থেকে বয়ে আসা সাদা পানির ঢল পিয়াইন নদীর নীলে মিশে যাচ্ছে…
অনেকে নদীর উপর পাথরগুলো ধরে দেখছে;আবার অনেকে সেগুলোর উপর দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখছে।আবার কেউ কেউ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে।আরশি ধীর পায়ে ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালো।ব্রিজে দাঁড়িয়ে যেনো মনে হচ্ছে প্রকৃতি তার নিজের সাথে মিশে যাচ্ছে।উপরে বিশাল নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর নিচে আকাশি রঙের পানিতে ধূসর,কমলা,আকাশি বর্ণের পাথর বিছানো।চারপাশে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা..আর মাঝখানে আরশি দাঁড়িয়ে।আরশি চোখ বন্ধ করে দুই হাত দুদিকে মেলে দিয়ে অনুভব করতে লাগল।আজ ওর কাছে পরিষ্কার কেন জাফলংকে প্রকৃতি কন্যা বলা হয়!
কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে আরশি হাত গুটিয়ে নিয়ে চোখ খুলল।তারপর পেছনে তাকাতেই সিদ্রাতকে দেখল।সিদ্রাত বলল…
—”প্রকৃতি অনেক পছন্দ করো?”
আরশি মৃদু হেসে বলে..
—”শুধু পছন্দই না।আমি পাগল প্রকৃতির রূপ দেখার জন্য।জানেন ছোট থেকেই জার্নিতে বমি হওয়ার কারণে আব্বু আম্মু কখনো কোথাও যেতে দিতো না।যখন এফবিতে চেনা পরিচিত মানুষেরা বিভিন্ন ট্যুরেতে গিয়ে ছবি পোস্ট দিতো আর আমি দেখতাম তখন আশেপাশের প্রাকৃতিক ভিউ দেখে আমার যে কত কষ্ট লাগত!মনটা উশখুশ করত সেই প্রকৃতির রূপ ছুঁয়ে দেখার জন্য।মাঝে মাঝে তো কেঁদেই দিতাম।আজ আমি এতো সুন্দর প্রাকৃতিক ভিউ দেখতে পারছি..আমার যে ভিতরে ভিতরে কত আনন্দ আর সুখ হচ্ছে আমি আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না”
সিদ্রাতও মুচকি হাসল।আরশির সাথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ব্রিজের উপর।কিছুক্ষণ পর বলল..
—”পাথর ছুঁয়ে দেখবে না?চলো যাই”
আরশি মুচকি হেসে সিদ্রাতের সাথে নিচে নেমে এলো।নদীর পানিতে ভেজানো পাথরে খালি পায়ে দুজনে দাঁড়ালো।আরশি পিছলে পড়ে যেতে নিলে সিদ্রাত আরশির হাত ধরে ফেলে।আরশি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো।সিদ্রাত আরশিকে ধরে রাখল।নদীর শীতল পানিগুলো পাথরের সাথে সাথে দুজনের পা-ও ছুঁয়ে দিচ্ছে।আরশি আশেপাশে তাকিয়ে দেখল অনেকে সেলফি তুলছে।অনেকে হাসি তামাশা করছে..সবাই প্রকৃতির ছোঁয়া পেয়ে নিজেরদের মধ্যে ডুবে আছে।
আরশি এবার নিচের দিকে তাকালো।সিদ্রাতের ভেজা ফরসা পায়ে লোমগুলো লেপ্টে আছে।প্যান্ট টাখনু পর্যন্ত।পানির স্পর্শ পেয়ে যেনো সিদ্রাতের পা অনেক বেশি এট্রাক্টিভ লাগছে।আরশির শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোত বয়ে গেলো।ও সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে সিদ্রাতের দিকে তাকাতেই থমকে গেলো।সিদ্রার অপলকভাবে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে।আরশির খুবই অস্বস্তি হচ্ছে।আরশি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সিদ্রাতকে ডাকল…
—”স্যার..?”
সিদ্রাতের ঘোর ভেঙে যায়।ও এতোক্ষণ কি করছিলো বুঝতে পেরে ইতস্তত করে অন্যদিকে তাকালো।আরশি গোপনে লাজুক হাসল…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_22
#Writer_TanhaTonu
সিলেট জাফলং মহাসড়কে শহর থেকে প্রায় ৪২ কিমি দূরে সারীঘাট। সারীঘাট থেকে সাধারনত নৌকা নিয়ে পর্যটকরা লালাখাল যায়।আরশিরাও সবাই সেই উদ্দেশ্যেই রওনা দিলো।স্থানীয় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় একঘন্টা পনেরো মিনিটের মতো সময় লাগে সারী নদীর উৎসমুখ পর্যন্ত যেতে। নদীর পানি পান্না সবুজ রঙের।নদীর মাঝখানেই জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট পাহাড়ের মতো।সেগুলোর মাঝ দিয়ে চলছে নৌকা।
দুই পাশে পাহাড় সারির ছায়া..
আরশি এত সুন্দর ভিউ দেখে পারে না নৌকার মধ্যেই লাফালাফি শুরু করে দেয়।ও তৃষ্ণার্ত চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে।মুখে খুশির জোয়ার।সিদ্রাত তা দেখে মুচকি হাসছে।আরশি উচ্ছ্বসিত হয়ে ফারহা আর বনিকে বলছে…
—”দোস্ত এতো সুন্দর কেন রে প্রকৃতি?আমার যে কেমন লাগছে!পানির দিকে তাকা একবার..বিদেশে যে একদম নীল রঙের পানি ঠিক হুবুহু তেমন..আমার না ইচ্ছা করছে নদীর পানিতে ডুব দিতে।তাতে মরণ হলেও আপত্তি নেই।এত ভালো লাগছে কেন আমার!”
ফারহা আর বনি আরশির এক্সাইটমেন্ট দেখে হেসে দেয়।সিদ্রাতও মুচকি মুচকি হাসছে।বনি দুষ্টুমি করে বলে…
—”একটা কাজ কর..লাফ দে পানিতে।এতে পানি তোর শরীরে মাখাও হবে আর আমরা বিনা টিকেটে মুভিও দেখতে পারব যখন সিদ্রাত স্যার তোকে বাঁচানোর জন্য লাফ দিবে”
আরশি বনির কথায় লাজুক হাসল।লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলল…
—”উনি কি সত্যিই লাফ দিবে আমার জন্য?”
ফারহা কপাল কুচকে বলল….
—”তুই কি সত্যি সত্যিই পানিতে ডুব দিবি নাকি?এমন কোনো চিন্তা মাথায় আনলে তোকে আমি মেরে তক্তা বানাবো।তোর জন্য আমাদের আর ঘুরাই হবে না পরে”
আরশি ফারহাকে মুখ ভেঙচিয়ে আবারও আশেপাশের প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করল।এর মাঝেই আড়চোখে একবার সিদ্রাতের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।আরশি লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকালো।সিদ্রাত নিশব্দে হাসল…
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা লালাখাল চা বাগানের সামনে চলে এলো।নৌকা থেকে নেমে কিছু দূর হাঁটতেই সবাই চা বাগানে প্রবেশ করল।সবাই খুবই এক্সাইটেড যা তাদের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।সিদ্রাত আরশির পাশে এসে হাঁটতে লাগল।আরশি পাশে তাকিয়ে দেখল বনি আর ফারহা নেই।সিদ্রাত ওর পাশে।আরশি মৃদু হেসে বলল…
—”স্যার দেখুন কত সুন্দর জায়গা।আপনি এতো সুন্দর ভিউ দেখেও এতো স্বাভাবিক কীভাবে?আমার তো নাচতে মন চাচ্ছে”
সিদ্রাত হেসে দিলো আরশির কথায়।আরশির মুগ্ধ হয়ে তাকালো সে হাসির দিকে।হাসার সময় কোণার চুকা দাঁতটা যখন দেখা যায় তখন এতো কিউট লাগে সিদ্রাতকে আরশির খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।আরশি মুচকি হেসে বলেই ফেলল…
—”স্যার আপনার হাসি এতো সুন্দর কেন?গেজ দাঁতটা আপনার হাসিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে।এভাবে প্লিজ হাসবেন না।এই হআসি দেখে আমার কিছু হয়ে গেলে আমার আম্মু কাঁদতে কাঁদতে শেষ,,,,”
আরশি এটুকু বলেই চোখ বড় বড় করে মুখে হাত দিলো।সিদ্রাত এতোক্ষণ রসগোল্লার মতো চোখ করে আরশির দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিলো।আরশি লজ্জায় এক দৌড়ে অন্য পাশে চলে গেলো।সিদ্রাত এবার শব্দ করেই হেসে দিলো…
আরশি কাঁদো কাঁদো মুখ করে হাঁটছে আর নিজেকে বকছে…
—”আরশির বাচ্চা তুই আর শুধরাবি না।উনার সামনে নিজেকে পুরোপুরি ছ্যাচড়া প্রুফ করেই তোর শান্তি হবে।ভালো লাগে না..আমার মনের কথাগুলো উনার সামনেই যে কেন মুখে আসে বুঝি না”
—”ওই ছিচকাঁদুনির মা..আবার কি ভেবে কাঁদছিস?”
আরশি বিড়বিড় করে হাঁটছিলো।পাশ থেকে আওয়াজ পেয়ে তাকাতেই দেখল বনি আর ফারহা।আরশি মুখ ফুলিয়ে জিজ্ঞাস করল…
—”কোথায় চলে গিয়েছিলি তোরা?তোরা সব নষ্টের মূল।তোরা চলে গিয়েছিলি বলেই তো স্যার আমার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে আর আমিও নিজের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়েছি”
বনি ভ্রু কুচকে তাকালো।আরশি ওদেরকে সব খুলে বলল।আরশির কথা শুনে বনি আর ফারহা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল
আরশি দুজনের পিঠে দুড়ুমদুড়ুম কিল বসিয়ে হাঁটা দিলো।বনি আর ফারহার মুখটা প্যাঁচার মতো হয়ে গেলো…
লালাখাল চা বাগান থেকে সবাই রওনা দিলো মালনীছড়া চা বাগানের উদ্দেশ্যে। প্রায় দুই ঘন্টা লাগল যেতে..
তখন কিল দেয়ায় ফারহা আর বনি মুখ ভাড় করে আছে।আরশির সাথে কথা বলছে না।আরশির একা একা ভালো লাগছে না।বাসে এতো মানুষ..ও কিভাবে নামবে সেটাই ভাবছে।কেমন যেনো লাগছে সবাইকে গা ঘেষে ঘেষে নামতে দেখে।কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আরশির মুখটা ভয়ে ছেয়ে গেলো।প্রায় সবাই নেমে যাচ্ছে।ও বাসেই বসে রয়েছে।নামতে ভয় লাগছে।হঠাৎ আরশির সামনে কেউ হাত বাড়িয়ে দিলো।আরশি তাকিয়ে দেখল সিদ্রাত।অবাক হয়ে তাকালো আরশি।সিদ্রাত যে একই বাসে তা আরশি জানত না।কারণ আরশি সিদ্রাতকে অন্য বাসে উঠতে দেখেছিলো..
—”কি হলো হাতটা দিবে নাকি এভাবেই বসে থাকবে?”
আরশির ধ্যান ভাঙল।ও কম্পমান হাতটা সিদ্রাতের দিকে বাড়িয়ে দিলো।সিদ্রাত খপ করে আরশির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।আরশির কেন জানি নিজেকে খুব সেইফ মনে হচ্ছে।সিদ্রাত আরশিকে নিয়ে বাস থেকে নেমে এলো।আরশিও সিদ্রাতের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।সিদ্রাত হাতটা আলগা করতে যেয়ে ফিল করল আরশি সিদ্রাতের হাত ছাড়েনি।শক্ত করে ধরে রেখেছে।সিদ্রাত আরশির হাতটা আলতো করে ধরে বলল…
—”এভাবে টিচারের হাত ধরে থাকলে সবাই খারাপ ভাববে না?”
আরশি এই ভয়টাই পাচ্ছিলো।সিদ্রাত কখন না জানি হাতটা ছেড়ে দেয়।কিন্তু আরশি যে ভয় পাচ্ছে সিদ্রাতের হাত ছাড়তে।বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক করছে।সিদ্রাত আবারও বলল…
—”কি হলো?”
আরশি করুণস্বরে বলল…
—”প্লিজ স্যার আমার হাত ছাড়বেন না।আমার ভয় হচ্ছে।ওই লোকটা আমায় মেরে ফেলবে”
সিদ্রাত অবাক হয়ে যায় আরশির কথায়।বিষ্ময় নিয়েই বলল..
—”আরশি কি বলছ এসব?তোমার কি খারাপ লাগছে?শরীরে জ্বর আসছে?উলটা পালটা বলছ কেন?”
আরশির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।ও কেমন যেনো অস্থির হয়ে যাচ্ছে।সবাই হেঁটে অনেকটা সামনে চলে গিয়েছে।সিদ্রাত কিছুই বুঝতে পারছে না।আরশির চোখের পানি মুছে দিতে বলল…
—”তুমি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছো?আর তোমাকে কেন কেউ মারবে বোকা মেয়ে?হাত ছাড়তে হবে না।আমি ধরে রেখেছি।তাও কান্না অফ করো”
আরশির চোখ দিয়ে তবুও পানি পড়ছে।ও ঝাপসা চোখেই দেখল সেই আতঙ্কটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে।আরশির শরীর অবস হয়ে আসছে।ও সিদ্রাতের হাত খামচে ধরে।তখনি একটা মধ্যবয়স্ক লোক আরশিদের কাছে এসে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে….
—”আরে আরশি মামনি না?কেমন আছো?কত বছর পর তোমায় দেখলাম?সেই ছোট্টটি দেখেছিলাম তোমায়”
আরশি সিদ্রাতকে শক্ত করে ধরে ওর শরীর ঘেষে দাঁড়ালো।আরশির মুখে আতঙ্কের ছাপ।ভয়ে ও শেষ।সিদ্রাত কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারল আরশি লোকটাকে ভয় পাচ্ছে।সিদ্রাত বলল….
—”সরি আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।আপনি আরশির কে হোন?”
লোকটা আরশির দিকে তাকিয়ে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বলল…
—”আমি দীর্ঘদিন মামনিদের গাড়ির ড্রাইভার ছিলাম।মামনির আব্বু তো আমায় খুবই বিশ্বাস করত।আর বিশ্বাস কি যাকে তাকে করা যায়।হয়ত বিশ্বাসযোগ্য ছিলাম তাই করেছে..তাই না আরশি মামনি?আরশি মামনিকে তো আমিই স্কুলে নিয়ে আসতাম..দিয়ে আসতাম।আমাদের মিষ্টি একটা মামনি..”
সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল..
—”ওহ তাই নাকি?তাহলে তো ভালোই।তো আপনি এখন কি করেন?এই এলাকায়ই থাকেন?”
—”আমার থাকার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।কখন কোথায় যাওয়া লাগে কাজের জন্য!”
সিদ্রাত বলল…
—”আপনার জন্য একটা অফার আছে।আপনি যেহেতু আঙ্কেলের বিশ্বস্ত ছিলেন তাহলে তো ভালো লোকই হবেন।আমারও কারের ড্রাইভার প্রয়োজন আমার ছোট বোনের জন্য।আপনি নিয়োগ নিতে পারেন।আমরা আরশিদের সাথেই থাকি”
আরশি অবাক হয়ে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত কি পাগল হয়ে গিয়েছে?আরশি সিদ্রাতকে কাঁদতে কাঁদতে না করল…
—”প্লিজ স্যার এমন করবেন না।অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।মুন আপুর বিপদ হবে”
লোকটা হালকা রেগে গেলো।তবুও তা প্রকাশ না করে হাসি দিয়ে সিদ্রাতকে বলল…
—”তো স্যার কবে থেকে জয়েন করব আমি?”
—আপনার নাম্বারটা দিন।আমি ফোন করে জানাবো।”
লোকটা গড়গড় করে নাম্বার বলে দিলো।সিদ্রাত বিদায় নিয়ে আরশিকে নিয়ে মালমিছড়া চা বাগানে প্রবেশ করল।আরশি মুখ ফুলিয়ে নাক টানতে টানতে হাঁটতে লাগল।সিদ্রাত বলল…
—”মন খারাপ?”
—”আপনি কেন ওই লোককে কাজ দিলেন?উনি ভালো না”
সিদ্রাত মৃদু হেসে বলল…
—”তুমি কি করে জানো সে ভালো না।তুমি তো ছোট থাকতেই উনি চাকরী ছেড়ে দিয়েছিলেন”
আরশি রেগে বলল…
—”তাহলে বুঝেন সে কতটা খারাপ যে আমি ছোট থাকতেই বুঝে গিয়েছি সে খারাপ!”
সিদ্রাত হালকা হাসল আরশির রাগ দেখে।কিছু বলল না।কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা অন্যদেরকে ধরে ফেলল।সবার সাথেই চা বাগানে ঘুরতে লাগল।আরশি বলল…
—”এই চা বাগানটা লালাখালের চেয়ে বড় আর সুন্দর”
সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল..
—”এটা সিলেটের সব চেয়ে প্রাচীন চা বাগান।প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিস্বত্ব সীমানায় উঁচু-নিচু টিলার পর টিলায় ভরা এই চা বাগানটি”
আরশি আশেপাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হলো।আজ বুঝি মুগ্ধতারই দিন।এতো সুন্দর দৃশ্য দেখে আরশি কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভুলে গেলো…
এই চা বাগানটি সবুজ ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর।আরশি যেন সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।উপরে বড় বড় ছায়া বৃক্ষ,,নিচে আধো আলো আধো ছায়ায় সবুজের চাদর।এ যেনো এক শৈল্পিক কারুকার্য! আরশির মনে হচ্ছে ও যেনো সবুজের গালিচায় হারিয়ে যাচ্ছে।উঁচু নিচু অসংখ্য ঢিলায় চা বাগান..আরশি হা করে সব দেখছে….
ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।এবার সবাই ফিরে যাবে যেখানে বাস থামানো।তারপর ওখান থেকে ডিরেক্টলি ঢাকায়…
সবাই একে একে বাসের কাছে যাচ্ছে।একটু দূরেই বাস থামানো।সিদ্রাত আর আরশিও বাসের কাছে যাবে তখনি সিদ্রাতের ফোন বেজে উঠল।সিদ্রাত বলল…
—”আরশি এক মিনিট দাঁড়াও।আমার খুবই ইম্পোর্টেন্ট একটা ফোন এসেছে।আমি একটু ওদিকে গিয়ে ফোনটা পিক করি।তুমি কিন্তু এক চুলও নড়বে না”
আরশি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোন পিক করে।প্রায় সাত মিনিট কথা বলার পর সিদ্রাত ফিরে আসে।আগের জায়গায় আসতেই সিদ্রাতের মাথায় যেনো বাজ পড়ল।আরশি নেই।সিদ্রাত সব জায়গায় খুঁজল।আরশি আশেপাশে কোথাও নেই।সবগুলো বাসেও চেক করেছে সিদ্রাত।সিদ্রাতের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।চোখগুলো লাল হয়ে গিয়েছে।ফারহা আর বনি কেঁদে দিয়েছে।সিদ্রাত ওদেরকে শান্তনা দিয়ে বলল….
—”তোমরা চিন্তা করো না।আমি আরশিকে নিয়েই বাসায় ফিরব।তোমরা বাসায় ফিরে যাও।আর কাউকে এ ব্যাপারে বলবে না কিছু।”
ফারহা আর বনি তবুও কাঁদছে।সিদ্রাত তারপর বাসে থাকা সবাইকে বলে গেলো কেউ যেনো এ ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলে।সিদ্রাত বাস থেকে নেমে গেলো।সবগুলো বাস ছেড়ে দিলো।সবাই যতটা আনন্দ নিয়ে এসেছিলো.. আরশি এভাবে হারিয়ে যাওয়ায় ততটাই বিষন্ন মন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে..
সিদ্রাতের নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।আরশিকে কোথাও পাচ্ছে না খুঁজে।মেয়েটা এতো রাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে কোথাও লাপাত্তা হয়ে গেলো?কি অবস্থায় আছে ও?সিদ্রাতের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।ও ছন্নছাড়া হয়ে খুঁজতে লাগল আরশিকে….
চলবে….
চলবে..