প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ১৯+২০

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_19
#Writer_TanhaTonu

সেদিনের পর দুটো দিন কেটে যায়।স্কুল থেকে আসার সময় তাড়াহুড়ো থাকায় সিদ্রাত আর শুনতে পারেনি আরশি কেন নিজেদের কারে করে আসা-যাওয়া করতে ভয় পায়।আরশিও হাফ ছেড়ে বাঁচে সিদ্রাত জিজ্ঞাসা না করায়।আরশি সিদ্রাতকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলো সিদ্রাত অনেক বিজি…

আগামীকাল আরশি পিকনিকে যাবে ভেবেই ওর যেনো আনন্দ ধরে না।তার থেকেও বড় কথা সিদ্রাতও যাবে অর্থাৎ সিদ্রাত নিশ্চয়ই আরশির খেয়াল রাখবে..চোখে চোখে রাখবে..এসব ভেবেই আরশি ব্লাশিং হচ্ছে আর চোখে কাজল দিচ্ছে..
ও এতোটাই ভাবনায় মশগুল যে প্রাইভেটের টাইম যে চলে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই…

এদিকে পড়তে সবাই এসে পড়েছে অথচ আরশি একই বাসায় থেকেও আসছে না কেন সেটাই ভাবছে সিদ্রাত।আর ওয়েট করতে না পেরে সবাইকে ম্যাথগুলো দেখতে বলে ও গেস্টরুমে উঁকি দিলো।কিন্তু সেখানে নেই আরশি।তাই আস্তে আস্তে মুনের রুমের দিকে এলো।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে দরজা লক করা না,,জাস্ট চাপানো।সিদ্রাত নক করে।কিন্তু আরশি এতোটাই ভাবনায় বিভোর যে ওর কানে সে আওয়াজ যায়না।আরও কয়েকবার নক করার পরও যখন কোনো সারাশব্দ পায় না তখন সিদ্রাত নক ছাড়াই রুমের ভিতর চলে যায়।রুমে কারও প্রবেশের আওয়াজ পেয়ে আরশি চমকে তাকাতেই ওর কাজলটা লেপ্টে যায়।সিদ্রাত চোখ সরু করে তাকায়।আরশি একবার আয়নার দিকে আরেকবার সিদ্রাতের দিকে তাকায়।চোখের নিচে অনেকটাই লেপ্টে গিয়েছে।সিদ্রাতের সামনে এমন বেশে দাঁড়াতে হবে ভেবে ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলে আরশি। সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির দিকে এগিয়ে আসে।আরশি জিজ্ঞাসু সূচক দৃষ্টিতে তাকায়। সিদ্রাত আরশির কাছে এসে একটা টিস্যু পেপার নিয়ে চোখের নিচের কাজলটা মুছে দেয়।আরশি হতভম্ব হয়ে যায়।সেই সাথে শকও খায়।ইদানিং সিদ্রাতকে এতোটা কাচ্ছে সহ্য হয়না আরশির।মনে হয় সিদ্রাতের স্পর্শেই যেনো মরণ ওর।সিদ্রাত হালকা হেসে জিজ্ঞাসা করল…
—”দেখো তো ঠিকাছে কিনা?”

আরশি ঘোরের মাঝেই আয়নায় তাকালো।লেপ্টানো কাজলটা আর নেই।আরশি হাত কচলাতে লাগল।ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর।সিদ্রাত বলল…

—”আজ কি প্রাইভেট পড়বে না?”

আরশি চমকে তাকালো আর সাথে সাথে বলল..
—”ওহহোও আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম…ইশশ”

সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল..
—”সমস্যা নেই।বই নিয়ে আমার রুমে আসো”
—”জ্বি”

সিদ্রাত আরশির দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলো।আরশি লজ্জা পেলো।তারপর ম্যাথ বই আর খাতাটা নিয়ে দৌড়ে সিদ্রাতের রুমে গেলো।আরশি খেয়াল করল ও প্রতিদিন যেখানে বসে তার পাশেই আজও বসেছে সিদ্রাত।আরশি নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সিদ্রাতের পাশে গিয়ে বসল।ইদানিং সিদ্রারতকে দেখলে যেনো একটু বেশিই লজ্জা লজ্জা লাগে।আরশি বই খুলছে আর ব্লাশিং হচ্ছে।সিদ্রাত হায়ার ম্যাথ ভেক্টরটা বুঝাতে লাগল।আরশি তো ম্যাথ আর কি বুঝবে অপলক সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে আছে…কি সুন্দর তার কথা বলার ধরণ..গেজ দাঁত বের করে হাসা,মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে হাসা..আরশির মনে হচ্ছে ও স্বপ্নের জগতে আছে যেখানে ও আর সিদ্রাত ছাড়া অন্য কেউ নেই।হঠাৎ মাথাটা টনটন করে উঠায় আরশি স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এলো।দেখল সিদ্রাতের হাতে একটা স্কেল।সিদ্রাত ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আর বাকিরা সবাই এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো আরশি কোনো এলিয়েন।সবার এমন চাহনী দেখে আরশি হতভম্ব হয়ে যায় আর বলে…

—”কি হয়েছে?সবাই এভাবে অামায় দেখছো কেন?”

তাশফি তো বলেই ফেলে…
—”তুই যেভাবে স্যারের দিকে তাকিয়েছিলি এতোক্ষণ তার তুলনায় তো এটা কিছুইনা”

তাশফির কথায় আরশির চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়।লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।একবার আড়চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।সিদ্রাত কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে আছে।আরশি ঢোক গিলে।নিজের উপরই নিজের রাগ হচ্ছে এটা ভেবে যে কেন সিদ্রাতকে দেখলে ও দিন-দুনিয়া ভুলে যায়।

এরপর আর তেমন কথা হলো না।সিদ্রাত চুপচাপ সবাইকে বুঝিয়ে দিলো।সিদ্রাতের এমন নীরবতায় আর কেউ বেশি কিছু বলার সাহস পায়নি..

ছুটি হয়ে গেলে যাওয়ার সময় ছোঁয়া আর নিরা ফিসফিসিয়ে আরশিকে বলতে লাগল….
—”ভালোই জমেছে প্রেম।এজন্যই তো বলি স্যার এতো তোর সাইড নেয় কেন?এই সত্যি করে বলত শরীর দিয়ে আবার বশ করিস নি তো?হাহা..ছেলেদের তো আবার শরীর হলে আর কিছুই চাইনা”

আরশির চোখদুটো রাগে লাল হয়ে গেলো।ওর নামে বলেছে বলেছে কিন্তু সিদ্রাতকে নিয়ে এমন কমেন্ট করায় আরশি শরীরের সব শক্তি দিয়ে ছোঁয়া আর নিরা দুজনকে দুটো চড় দিলো।সিদ্রাত টেবিল গুছাচ্ছিলো।হঠাৎ এমন কিছু হওয়ায় ও হতভম্ব হয়ে গেলো।আরশি চিল্লিয়ে বলতে লাগল…
—”তোরাই আসলে সস্তা মেয়ে।নিজেরা সস্তা এজন্যই অন্যদেরকে নিজেদের মতো ভাবিস।ছিইহ..বাবা-মা এগুলোই শিক্ষা দেয় তাইনা?শেষ পর্যন্ত স্যারকেও ছাড়লি না তোরা।শেম অন ইউউউ”.

আরশি বলে কাঁদতে কাঁদতে সোফায় বসে পড়ল।নিরা আর ছোঁয়া আরও দু’একটা কথা শুনাতে নিলে সিদ্রাতের রাগী ফেইস দেখে ভয়ে চলে গেলো।
তখনকার ঘটনার জন্য সিদ্রাত এমনিই গম্ভীর হয়েছিলো আর এখন আরশির এই কাজ দেখে অনেকটাই রাগ হচ্ছে।নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে আরশির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আর শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল…
—”এসব কি আরশি?”

সিদ্রাতকে নিয়ে এমন বাজে কথা বলায় আরশির প্রচুর রাগ হচ্ছে।রাগ থেকেই ও কাঁদছে।সিদ্রাতকে সামনে দেখে যেনো আরশির রাগ আরও বেড়ে গেলো।আরশি যেনো এখন নিজের মধ্যে নেই।ও দাঁড়িয়ে সিদ্রাতের কলার ধরে কেঁদে জোরে জোরে বলতে লাগল…

—”ওই অসভ্য মেয়ে দুটোকে কেন এখনো পড়াচ্ছেন?কেন?টাকার অভাব পড়েছে আপনার?এদের মতো অমানুষদেরকে পড়াতে হবে?বলুন অভাব পড়েছে?অভাব পড়লে ভিক্ষা করুন তাও এমন অমানুষ পড়াতে পারবেন না।এদের বাবা-মায়েরই কোনো শিক্ষা নেই তাহলে এরা,,,..”

ঠাশশ,,,

আরশি গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে তাকালো।ভিতরটা যেনো দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে।কখনো ও ভাবেওনি সিদ্রাত মারবে।সিদ্রাত হালকা চিল্লিয়ে বলল….
—”জাস্ট গেট লস্ট।এটা আমার বাসা কোনো চিড়িয়াখানা না আর না কোনো প্রেম-ভালোবাসা বা ঝগড়ার করার জায়গা।গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার..”

আরশি কয়েক মিনিট সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মলিন হাসি দিয়ে চুপচাপ মুনের রুম থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিজেদের বাসায় চলে এলো।।আরশি বাসায় এসে চুপচাপ মাগরিবের নামাজ পড়ে বেডের এক কোণায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।মনে হচ্ছে এখনি কাঁদবে।সত্যিই তাই হলো..আরশি আবারও কেঁদে দিলো…

—”আর বেশি ঘেষব না উনার সাথে।হয়ত উনি এসব লাইক করেন না তাই আজ এমনটা করলেন ।এটাই তো স্বাভাবিক।আমি উনাকে ভালোবাসি বলে কি আমার সবকিছু উনার ভালো লাগতে হবে?উনারও তো পার্সনাল লাইফ,পছন্দ-অপছন্দ আছে।আমিই একটু বেশি করছিলাম।আমি নীরবেই ভালোবাসব।তাছাড়া উনি তো ওই আপুটাকেই হয়ত ভালোবাসে তাই আমার এসব আচার-আচরণ ভালো লাগে না।নাহ আমি আর আমার অনুভূতিগুলো উনার সামনে প্রকাশিত হতে দিবো না।তাহলে সবাই-ই খুশি থাকবে এতে।জানি না আমি কতটুকু খুশি থাকতে পারব”

আরশি হুহু করে কেঁদে উঠল।কেমন যেনো অস্থির লাগছে সবকিছু।বায়োলজি বই নিয়ে বসল আরশি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। কিন্তু ঘুরে ফিরে মাথায় সিদ্রাতই আসছে।চেয়েও কেন যেনো মাথা থেকে সিদ্রাতকে সরাতে পারেনা মেয়েটা।আয়নায় একবার তাকিয়ে দেখল গালটা ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে। অারশির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল…

আরশি বুঝল বই-খাতা দিয়ে এখন কিছু হবে না।আরশি তাই মোবাইল নিলো।মনের ভেতর কয়েকটা লাইন খচখচ করছে।তাই ফেইসবুকে লিখে পোস্ট দিলো…

বেলা শেষে চাইনা তোমায়
সময় থাকতে যদি না আসো…
তখন ভালোবাসাগুলো যে ঝরাপাতা
অনুভুতি আমার বিবর্ণ…
কাঁদতে পারবে,পাগলামি করতে পারবে
কিন্তু ছুঁয়ে দেখতে পারবে না আর…
কি আছে তোমার মাঝে
আজও তাই খুঁজে ফিরে যত পাগলামী…
কি দেখে হারিয়েছি তোমাতে
তা ভেবেই দগ্ধ আমি..
যন্ত্রণার এই আগুন নীলে পুড়ছি
রাঙাতে নিজেকে তোমার ভালোবাসার ওই রঙ্ধনুতে..
তুমি কি জানো..
ভালোবাসার একটু স্পর্শের ব্যাকুলতায়
আজও কেঁদে উঠে এ মন…
আমি তো আজও ভালোবাসি,কালও ভালোবাসি
কিন্তু হায়!কি হবে এই ভালোবাসায়?
পূর্ণতা যদি না থাকে মোহনায়!

~তানহা তনু💕

লিখাগুলো লিখার সময় আরশির দুনয়ন বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছিলো।অনেক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদে মেয়েটা।পরে ক্লান্ত হয়ে বেডের এক কোণায় শুয়ে থাকে।চোখে-মুখে প্রচুর অভিমান সিদ্রাতের প্রতি যদিও জানে এগুলো মূল্যহীন….

আরশি শুয়ে শুয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলো।কলিং বেল বেজে উঠায় ও কিছুটা চমকালো।তারপর কি যেনো ভেবে আগের মতোই শুয়ে রইল…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_20
#Writer_TanhaTonu

দরজায় অনবরত কলিংবেল বেজেই চলেছে।আরশি কানে বালিশ চেপে রেখেছে।তাও কলিংবেল বাজছেই।এভাবে আওয়াজ হওয়ার পরও কি বসে থাকা যায়?যদিও শব্দের মাত্রা আশি ডেসিবলের বেশি হলে তাকে শব্দদূষণ বলা হয় কিন্তু আরশির মনে হচ্ছে এই কলিংবেলের আওয়াজ ১৬০ ডেসিবল অতিক্রম করে ফেলেছে।আরশি চোখটা মুছে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ফুটো দিয়ে দেখল ও যা ভেবেছিলো তা-ই।সিদ্রাত দাঁড়িয়ে আছে।আরশি নিজেকে শক্ত করে দরজাটা খুলে।সিদ্রাত আরশিকে দেখেই বুঝতে পারে কেঁদেছে এতক্ষণ।
—”আরশি স,,,”
সিদ্রাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশি মাথা নিচু করে ধরা গলায় বলে…

—”সরি স্যার।আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।ওরকম বিহেইভ করা আমার উচিত হয়নি”

আরশি এটা বলেই দরজা লাগিয়ে ফেলতে নেয়।কিন্তু তার আগেই সিদ্রাত ধরে ফেলে।আরশি জোর করে লাগাতে চায় কিন্তু সিদ্রাতের শক্তির সাথে পারেনা।সিদ্রাত ধাক্কিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়।আরশি ছিটকে দূরে সরে আসে।সিদ্রাত গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে।আরশি মাথা নিচু করে বলে…

—”সরি বললাম তো..তাও আবার এমন করছেন কেন”
—”কি সমস্যা তোমার?তুমি কি ছোট মানুষ?বাচ্চাদের মতো করলে হয়না।চলো ডিনার করবে”

আরশি এবার কেঁদেই দেয়।কাঁদতে কাঁদতেই বলে…

—”আমি খাবো না।আমার পেট ভরে গিয়েছে বিকালে আপনি যা খাইয়েছেন।সবাই এক রকম..কখনো কেউ সত্যিটা জানতে চায়না।কখনো জানতে চায়না আমি আসলেই অপরাধী কিনা?ফারাবিও কোনো কিছু জানতে চায়নি।চলে গিয়েছে অভিমান করে।সবাই শুধু রাগটাই দেখাতে পারে আমাকে”

আরশি কাঁদতে কাঁদতে সোফায় বসে পড়ে।দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদছে।সিদ্রাত কেমন যেনো নির্জীব চোখে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে।আপাতত যেনো ও অনুভূতিশূন্য।আর কিছু না বলে কোনো কিছু ভাবতে ভাবতে চলে যায়।আরশি হু হু করে কেঁদেই চলেছে…

কিছুক্ষণ পর মুন আসে আরশির রুমে।আরশিকে ওভাবে কাঁদতে দেখে ওর অনেক খারাপ লাগে।পাশে গিয়ে বসে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আরশি তাকায় না মুনের দিকে।আগের মতোই কাঁদছে।মুন আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে…

—”এই পাগল মেয়ে এভাবে কাঁদলে হয়?তুমি তো ভাইয়াকে ভালো করে জানো না তাই এতোটা কষ্ট পেয়েছো।ভাইয়া সহজে রাগে না।তবে রাগলে আর কোনো উপায় নেই।ভাইয়ার রাগকে আব্বুও ভয় পায়।যদিও আমি জানিনা ভাইয়া কেন তোমার উপর এতোটা রেগে উঠল!তুমি তখন ভাইয়ার কলার ধরে ওভাবে বলেছে সেজন্য রাগ করার কথা না ভাইয়ার..যাই হোক বাদ দাও।এতো কাঁদলে তো অল্প বয়সেই বুড়ি হয়ে যাবে।আমি কিন্তু আমার ভাইয়ের জন্য বুড়ি বউ নিবো না”

আরশি এবার মুনের দিকে ঠোঁট উল্টিয়ে তাকায়।মুন আরশির চোখের পানিগুলো মুছে দেয়।আরশি নিচের দিকে তাকিয়ে আবারও ফুঁপাতে লাগল আর ওভাবেই বলল…

—”বুড়ি বউ নিতে হবেও না।তোমার ভাইয়ার তো হলিউডের এক্ট্রেসদের মতো জিএফ আছে।আমি তো শর্টও.. তার বুক পর্যন্ত।আর ওই মেয়ে একদম উনার চোখ পর্যন্ত।উনি যেমন পাঁচ ফুট দশ সেও হয়ত পাঁচফুট ছয়..দেখতেও সুন্দর আর স্মার্ট।উনার সাথে পার্ফেক্ট।আমি তো আর উনার যোগ্য না”

মুন অবাক হয়ে আরশির কথা শুনে যাচ্ছে।ওর ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে এটা যেনো ওর কাছে অবিশ্বাস্য।মুন অবাক হয়েই জিজ্ঞাস করল..
—”তুমি দেখেছো ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডকে?তুমি বুঝলে কিভাবে তুমি যাকে দেখেছো সে ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড?”

আরশি মুখ ফুলিয়ে বলতে লাগল…
—”একদিন আমি ক্লাসরুম থেকে দেখেছি মেয়েটা উনার হাত ধরে আছে আর উনিও।দুজন মুচকি হেসে কি যেনো কথাও বলছিলো”

মুন সন্দিহান হয়ে চেয়ে রইল আরশির দিকে।এটাও বিশ্বাসযোগ্য!নিজের ভাবনাকে এক সাইডে রেখে বলল…
—”হয়েছে এদব বাদ দাও।এখন আমার সাথে চলো ডিনার করবে”
—”না আপু..আমি যাবো না।উনার থেকে এখন থেকেই দূরে থাকব।উনার প্রতি এখন যতটাই দুর্বল আছি না কেন জিন্দা লাশের মতো হলেও বাঁচতে পারব উনাকে ছাড়া।কিন্তু আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে হয়ত সুইসাইড করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।আমি সহ্য করতে পারিনা কাছের মানুষগুলোর দূরে সরে যাওয়াটা”

মুন অবাক হয়ে আরশির কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।এই পিচ্চি মেয়েটাও যে এতোটা ম্যাচিউরিটির সাথে কথা বলতে পারে তা যেনো ও ভাবতেই পারিনি।
মুন তাও আরশিকে জোর করে গিয়ে খেয়ে আসার জন্য।কিন্তু আরশি রাজি হয়না।ব্যর্থ হয়ে মুন বাসায় ফিরে আসে।রুমে প্রবেশ করতেই সিদ্রাতের সম্মুখীন হয়…
—”আনতে পারিসনি?”

মুন না সূচক মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যায়।মুন পিছন থেকে ডাকে…..
—”ভাইয়া ডিনারটা করে যাও।তুমি তো না খেয়ে থাকতে পারো না”

সিদ্রাত শুনে না মুনের কথা।রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।মুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবারগুলো ফ্রিজে উঠিয়ে রাখে।সন্ধ্যার দিকে খেয়ে নেয়ায় নিজেও আর খায়না…

সিদ্রাত রুমে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি আরশির বারান্দায়।হঠাৎ কি যেনো মনে করে মোবাইলটা নিয়ে আরশির আইডিতে ঢুকে।অনেক্ষণ ধরে স্ক্রল করতে থাকে।কিন্তু যা খুঁজছে তেমন কিছুই পায়না।আরও আধা ঘন্টা স্ক্রল করার পর একটা পিকে এসে সিদ্রাত থেমে যায়।পিকটা আরও এক বছর সাত মাস আগে পোস্ট করা হয় যেখানে ক্লিয়ারলি দেখা যাচ্ছে আরশি দুষ্টু হেসে তাকিয়ে আছে আর হয়ত ওরই বয়সী একটা ছেলে আরশির মুখে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ঢুকিয়ে দিয়েছে..ছেলেটা দেখতে মাশা আল্লাহ সুন্দর।
সিদ্রাত কমেন্ট বক্সে যায়।বনি কমেন্ট করেছে..”দোস্ত তোকে এই ফারাবি আজীবন এভাবেই জ্বালাবে আমি সিউর”
ফারহাও কমেন্ট করেছে “আমি তো সিইর ফারাবি যদি আরেকটু বড় হতো তাহলে আরশিকে এতোদিনে তুলে নিয়ে যেতো”
নূপুর নামের একটা আইডি থেকে কমেন্ট করা হয়েছে “তোমরা আমার নিষ্পাপ ভাইটাকে নিয়ে এসব বলো না তো।ওরা জাস্ট ফ্রেন্ড”

ফারাবি নামের আইডি থেকেই রিপ্লাইও আছে.. “আপু উল্টা-পাল্টা বলবা না।এই হাবলাটা আমার ফ্রেন্ড না।ওকে আমি বউ করব দেখে নিও।হাবলাটাকে চালাক বানাবো বিয়ের পর”
ফারাবির কমেন্টে আরশির এঙরি রিয়েক্ট প্লাস রিপ্লাইও..”এই ফারাবির বাচ্চা..তোকে আমি বিয়ে করলে তো হুহ! এইটুকুনি একটা ছেলে সে আবার বিয়ের কথা বলে!”
আবারও ফারাবির রিপ্লাই..”আরশি অপমান করবি না।আমি তোর থেকে দুই বছরের বড়।আমি জাস্ট একটু বড় হই।তোকে তোর রুম থেকে কিডন্যাপ করব দেখিস”

সিদ্রাত কমেন্টগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তখনই চোখ যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আরশির দিকে।সিদ্রাত আরশির দিকে তাকাতেই আরশি ভিতরে চলে যায়….

______________
আরশি বাসে বসে আছে।পুরো বাসে আরশি ছাড়া আরও চার পাঁচজন আছে।সাতটা বাজে মাত্র।বাস সাড়ে সাতটায় স্টার্ট দেয়ার কথা।সবাই এখনো আসেনি।আরও পনেরো মিনিট পর সিদ্রাত বাসে উঠে।আর আরশির পাশে গিয়ে বসে।আরশি পাশে তাকাতেই চমকে যায়…
—”স্যার আপনি?”
—”হুম কোনো সমস্যা?”

আরশি নিম্নস্বরে জবাব দেয়…
—”না,,”
আরশি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।ইতোমধ্যে প্রায় সবাই-ই বাসে উঠে গিয়েছে।একটা বাসে ত্রিশজন। দশটা বাস ভাড়া করেছে।ক্লাস টেনের স্টুডেন্ট শুধু।ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে ২৬৪জন স্টুডেন্ট আর স্কুলের টিচার।নয়টা বাসে স্টুডেন্ট আর একজন করে টিচার।আর বাকি আরেকটায় বাকি সব টিচাররা….

সিদ্রাত আরশির দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটা বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।আরও বিশ মিনিট পর গাড়ি চলতে শুরু করে।একদম সকাল হওয়ায় বেশিরভাগই সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে।আর‍ও যারা সজাগ তারাও চোখ বন্ধ করে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে।সিলেট যেতে চার ঘন্টা লাগবে।এভাবে সজাগ কে-ই বা থাকতে চাইবে এতসময়!

কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর সিদ্রাত বলে…
—”আরশি মুখ ভিতরে আনো।বুকে বাতাস লেগে ঠান্ডা লাগবে”

আরশি মাথা ভিতরে এনে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।স্কার্ফের সাইড দিয়ে ভেজা চুলগুলো পিছন থেকে সামনের দিকে এনে রাখে।সিদ্রাত ভ্রু কুচকে বলে…
—”এতো ভোরে শাওয়ার নিলে কেন?সুখে থাকতে ভূতে কিলায় তাইনা?”
আরশি মুখ ফুলিয়ে জবাব দিলো…
—”এখন শাওয়ার না নিলে আমি এতো লং জার্নি করতে পারব না।এমনিই আমার বমি হয় জার্নিতে”
—”তো চুল ভালো করে মুছবে না?দেখো তো এখনো হালকা পানি পড়ছে।সোজা হয়ে আমার দিকে পেছন দিয়ে বসো”

আরশি জিজ্ঞাসু সূচক দৃষ্টিতে তাকায়।সিদ্রাত আবারও বলে….
—”পিচ্চি মানুষদের এতো এভাবে তাকাতে হয়না।যেভাবে বসতে বলেছি বসো”

আরশি আর কিছু না বলে সিট থেকে মাথাটা তুলে সোজা হয়ে সিদ্রাতের দিকে পেছন দিয়ে বসে।সিদ্রাত আরশির স্কার্ফটা পিঠ থেকে কিছুটা উপরে তুলে চুলগুলো ঘাড় থেকে সামনে নিয়ে আসে।আরশি শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে ঘাড়ে আর চুলে সিদ্রাতের এমন কোমল স্পর্শ পেয়ে।সিদ্রাত চুলগুলো মুড়িয়ে আলগা পানিটা চুল থেকে ঝেড়ে নেয়।আরশি ঠোঁট কামড়ে চোখ খিচে সিদ্রাতের স্পর্শ ফিল করছে।চুল থেকে আলগা পানিগুলো ঝরে গেলে ওর রুমালটা দিয়ে যতটুকু পারা যায় চুলগুলো মুছে দেয়।তারপর মুচকি হেসে বলে…

—”হুম ঠিকাছে।এবার ঠিক হয়ে বসো”

আরশি যেনো এখনো নিজের দুনিয়ায়।চোখ বন্ধ করে ওভাবেই বসে আছে। সিদ্রাত মৃদু হেসে আরশির কাঁধ ধরে ঠিক করে বসায়।আরশি শিউরে উঠে ঠিক করে বসে চোখ নামিয়ে ফেলে।সিদ্রাত মুচকি মুচকি হাসছে আরশির কাজ দেখে…
অনেকটা পথ যাওয়ার পর.. প্রায় দেড় ঘন্টা পর আরশির কেমন যেনো লাগতে থাকে।মনে হচ্ছে বমি বুকে বেঁধে আছে।খুবই অস্বস্তি হচ্ছে।আরশি উশখুশ করছে।সিদ্রাত কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে আরশিকে জিজ্ঞাস করে…
—”আরশি তোমার কি খারাপ লাগছে?”

আরশি কিছু বলতে যাবে তার আগেই মুখে হাত চেপে জানালার কাছে এগিয়ে যায় আর বমি করে দেয়।সিদ্রাত আরশির মাথায়-পিঠে চাপড় দিতে থাকে।বমি করতে করতে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে যায়।শরীর নেতিয়ে পড়ে।বমি করা হলে আরশি ক্লান্তিমাখা চোখগুলো বন্ধ করে সিটে আবারও হেলান দেয়।সিদ্রাতের বড্ড মায়া হয় আরশির এই ফেইস দেখে।ও আরশিকে পানি খাইয়ে মুখটা ধুইয়ে দেয়।তারপর আরশির মাথাটা নিজের কাঁধে এনে রাখে আর মৃদু কন্ঠে বলে…

—”ঘুমিয়ে থাকো”

আরশি একবার সিদ্রাতের দিকে তাকায়।তারপর কাঁধে সুবিধা না হওয়ায় সিদ্রাতের বুকে মাথা রেখে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আর ক্লান্ত থাকায় মূহুর্তেই ঘুমিয়ে পড়ে।সিদ্রাত মুচকি হেসে নিজেও আরশিকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখে আরেকহাত পিঠে বুলাতে থাকে….

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here