প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ১৭+১৮

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_17
#Writer_TanhaTonu

আরশি আজ স্কুলে যায়নি।এর কারণটা হলো ওর বাসার সবাই আজ ওর নানুর বাসায় যাবে।কিন্তু আরশির মন খারাপ কারণ ওকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না।সেজন্যই সকাল থেকে প্যান করে যাচ্ছে যে ও যাবে।একা থাকবে না..
—”আম্মুউউ..এমন করো কেন?আমি গেলে কি সমস্যা?”
—”কোনো সমস্যা না।কিন্তু তুই হলি আধমরা মানুষ।তোকে নিয়ে গেলে দেখা যাবে সারা রাস্তা বমি করতে করতে শরীর একদম নেতিয়ে ফেলেছিস।পরে বাসায় না গিয়ে হসপিটাল যাওয়া লাগবে”

আরশি মুখ ফুলিয়ে বলল…
—”এটা কোনো লজিক?তোমরা সবাই যাবে।আয়িশা আন্টিরাও যাবে।আমি একা বাসায় থাকব?”
—”একা কিসের।মুন আর সিদ্রাত যাবে না।ওদের সাথে থাকবি তুই”

তখনই মুন আর সিদ্রাতের আম্মুও এসে বসল আরশিদের রুমে।আরশির তো এবার মন আনন্দে নেচে উঠল।অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে বলেই ফেলল…
—”আমি কি সিদ্রাত স্যারের সাথে থাকব?”

কথাটা বলে সাথে সাথে আরশি জিহবায় কামড় দেয়।আরশির আম্মু চোখ সরু করে তাকায় ওর দিকে।এদিকে মুন আর ওর আম্মু মিটিমিটি হাসছে।আরশি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে…
—”মানে,,উনাদের বাসায়,,থাকব কিনা?”

সিদ্রাতের আম্মু মৃদু হেসে বলে..
—”হুম তুই তোর সিদ্রাত স্যারদের বাসায়ই থাকবি এই তিনদিন”

আরশি মৃদু হেসে ছুটে রুমে চলে গেলো।এমন একটা কথা বলে ফেলায় খুবই লজ্জা করছিলো সবার সামনে।আরশির আম্মু মুখ ফুলিয়ে বলল…

—”আপা বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।এতো লাই দিও না।যদি হিতে বিপরীত হয়।তুমি জোর করে সিদ্রাতকেও গতকাল পাঠিয়ে দিলে ওকে পড়ানোর জন্য।এটা কি ঠিক হচ্ছে ওদেরকে একসাথে এতো মিশতে দেয়া?”
—”ওতো কিছু আমি বুঝিনা রাবিয়া।আরশি আমার বাড়ির বউ হবে এটাই শেষ কথা।আর হিতে বিপরীত হওয়ার কি আছে?”

আরশির আম্মু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
—”হুউউম..”

দুপুরে সিদ্রাত আসার পর পরই বাসার সবাই রওনা দেয় আরশির নানুর বাসার উদ্দেশ্যে।মূলত সিদ্রাতের বাবা-মাকে ওখান থেকে ঘুরিয়ে আনার জন্যই ওদের এই বেড়ানো…
এদিকে বাসায় থেকে যায় শুধু মুন সিদ্রাত আর আরশি।সবাইকে গেইট অব্দি পৌঁছে দিয়ে ওরা তিনজন বাসার ভিতর চলে আসে।আরশি আড়চোখে কয়েকবার সিদ্রাতকে দেখছে।সিদ্রাত সোফায় বসে টিভি দেখছে।তার পাশেই আরশি আর মুন বসে আছে।মুন আরশিকে খোচাতে লাগল।আরশি করুণ চোখে তাকায় মুনের দিকে।মুন বাঁকা হাসে আরশির দিকে তাকায়। তারপর ফোনে কথা বলার বাহানায় ছাদে চলে যায়।এখন পুরো রুমে আরশি আর সিদ্রাত শুধু।আরশির কেমন যেনো লাগছে একা একা সিদ্রাতের সাথে বসে থাকতে।সিদ্রাত টিভির দিকে তাকিয়েই বলল….

—”তুমি মুভি দেখতে পছন্দ করো?”
—”না..তেমন একটা দেখা হয়না”
—”ওহ..আমিও মাঝেমাঝে দেখি সময় না কাটলে”

আরশি মৃদু হেসে নিজেও সিদ্রাতের পাশে বসে দেখতে লাগল মুভিটা।এটা একটা ইংলিশ মুভি।দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে রোমান্স টাইম চলে এলো।এখনো তেমন কিছু হয়নি হিরো-হিরোইনের মাঝে।বাট দেখে বুঝা যাচ্ছে এখনি হয়ত খুবই ডিপ কিছু হবে।আরশির প্রচুর লজ্জা লাগছে।আর হলোও তাই।হিরো হিরোইনের দুই কোমর ধরে উঁচু করে টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়ে ডিপলি নাভিতে কিস করতে লাগল।
আরশির সামনে এমন সিন দেখতে হবে সিদ্রাত ভাবেনি।সিদ্রাত নিজেও থতমত খেয়ে গিয়েছে।আরশি তো লজ্জায় চোখ খিচে বন্ধ করে সিদ্রাতের হাত খামচে ধরে।সিদ্রাত তাড়াতাড়ি করে টিভিটা অফ করে দিলো।আরশি এখনো আগের মতোই আছে।সিদ্রাত মৃদু কন্ঠে ডাকল…
—”আরশি..প্লিজ বি কুলড।অফ করে দিয়েছি”

আরশি চোখ খুলে সিদ্রাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল।কিন্তু সিদ্রাতের হাত এখনো ছাড়েনি।এটা দেখে সিদ্রাত দুষ্টু হেসে বলে….
—”অন্যের রোমান্স দেখেই তুমি আমার হাতে পাঁচ আঙুলের নখের আচর বসিয়ে দিলে।ভাগ্যিস হিরো-হিরোইনের জায়গায় আমি আর তুমি ছিলাম না।তাহলে হয়ত আমার সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে যেতো”

আরশির কাশি উঠে যায় সিদ্রাতের কথায়।সিদ্রাত তাড়াতাড়ি পানি এনে দেয়।আরশি ঢকঢক করে খেয়ে নেয় পুরো পানিটুকু।একবার আড়চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় দৌড়ে মুনের রুমে চলে যায়।সিদ্রাত হেসে দেয় আরশির লজ্জা পাওয়া দেখে..

আরশি রুমে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।সিদ্রাত এমন একটা কথা বলেছে ওকে তা যেনো ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না।কিভাবে সম্ভব এটা!
—”আচ্ছা সত্যিই কি এরকম কিছু হয়েছিলো এতক্ষণ নাক সবই ভ্রম!”

আরশি ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে ওর।লজ্জায় আর সিদ্রাতের সামনে যায়না আরশি…

সিদ্রাত এরপর আরও তিন চারবার ড্রয়িং রুমে আসে কিন্তু আরশিকে দেখতে পায়না।মৃদু হেসে বেশ কয়েকবার মুনের রুমেও উঁকি দেয়।কিন্তু দরজা লাগানো ভিতর থেকে।লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যায়…

এশারের নামাজের পর আরশি বসে একটু পড়ছিলো।মুনও ওর পড়া পড়ছিলো।হঠাৎ মুন বই অফ করে আরশির পাশে এসে বসে ওর বইটাও নিয়ে নেয়।আরশি জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকায়।মুন বলে….

—”আরশি চলো শাড়ি পড়ি আর হালকা সাজি।আমার কেন যেনো শাড়ি পড়তে মন চাইছে”

আরশিও মুনের কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করে।হালকা হেসে বলে…
—”আমার তো শাড়ি পড়া অনেক পছন্দের কাজ মুন আপু।উফফ তুমি তো জানো না আমি প্রায় রাতেই শাড়ি পড়ে সাজি।তারপর পিক তুলে আবারও খুলে ফেলি”
—”ওহ তাহলে তো ভালো হলো আরও”
—”হুম..আচ্ছা আমি আমাদের বাসা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে আসি।এখানে এসে সাজব”

মুন হেসে সম্মতি জানায়।আরশি দৌড়ে গিয়ে ওর একটা রেড আর গোল্ডেন কালারের কাতানের শাড়ি আনে।শাড়ি আরশির অনেক পছন্দের।প্রতি মাসে দুইটা করে শাড়ি কিনবেই..
আরশি মুনের রুমে আসতেই দেখে মুন একটা নীল শাড়ি বের করছে।আরশি বলল…
—”আপু আমি গেস্ট রুম থেকে শাড়ি পড়ে সেজে আসি”
—”আচ্ছা যাও”

আরশি যেতেই মুন হেসে শাড়িটা আলমারিতে রেখে সিদ্রাতের রুমে যায়..
—”ভাইয়া আসব?”

সিদ্রাত আলমারিতে কি এনো খুঁজছিলো।মুনের কথায় ওর দিকে তাকায়..
—”হ্যাঁ আয়”
—”ভাইয়া আমার একটা শাড়ি গেস্ট রুমের আলমারিতে।প্লিজ এনে দাওনা”
—”তোর পায়ে কি হয়েছে?নিজে গিয়ে নিয়ে আয়”
—”ভাইয়ায়া প্লিজ প্লিজ..ওই রুমে ককরোচ।প্লিজ এনে দাও”
—”না”

সিদ্রাত না করেছে তো করেছেই।ও আনবে না।বেডে বসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে।প্রায় আধা ঘন্টা জোরাজুরি আর রিকুয়েস্ট করার পর সিদ্রাত রাজি হয়।বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে গেস্ট রুমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।মুন হেসে দেয়…

আরশি সাজুগাজু কমপ্লিট করে হাতে ওর আম্মুর সোনার চুড়ি পড়ছিলো যেগুলো ওদের রুম থেকে এনেছে।শাড়ি পড়ার পরই দরজা খুলে দিয়েছিলো এটা ভেবে যে যদি মুন আসে।রুমের দরজা খুলা থাকায় সিদ্রাতের কোনো অসুবিধাই হয়না রুমে প্রবেশ করতে। রুমে ঢুকেই সিদ্রাত হা হয়ে যায়।মনে হচ্ছে কোনো পরী দেখছে।একদম লাল পরী।ব্লাউজের পিছনের অংশটা একদম চিকন হওয়ায় আরশির ধবধবে সাদা পিঠটা পুরো দেখা যাচ্ছে।সিদ্রাত না চাইতেও ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে।চোখগুলো নেশায় ছোট ছোট হয়ে গিয়েছে।পাগুলো অটোমেটিকেলি সামনের দিকে এগুচ্ছে।সিদ্রাতের মস্তিষ্ক বলছে সরে যেতে।কিন্তু মনটা নেশায় আচ্ছন্ন যা সিদ্রাত কাটাতে পারছে না।হুট করেই আরশিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে নাক ডুবিয়ে দেয়।এমন অপ্রস্তুত আক্রমণে আরশি লাফিয়ে উঠে।শরীরে সিদ্রাতের স্পর্শ পেয়ে পুরো শরীর যেনো থরথর করে কাঁপছে।দুই হাত দিয়ে শাড়িটা খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।সিদ্রাত কিছুক্ষণ আরশির উন্মুক্ত পিঠে নাক স্লাইড করে তারপর ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।ছোট ছোট অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে সারা পিঠ জুড়ে।আরশি যেনো একদমই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।মনে হচ্ছে হেলে পড়ে যাবে।তবে সেটাও হচ্ছে না।কারণ সিদ্রাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে পেছন থেকে…

কিছুক্ষণ পর সিদ্রাত আরশিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে আলতো চুমু দেয়।তারপর ঠোঁটের কাছে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় আরশির গাল বেয়ে পানি পড়ছে।সিদ্রাত যেনো হুশে ফিরে আসে।ছিটকে সরে যায়।আরশি মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।সিদ্রাতের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে।সরি বলারও সাহস পাচ্ছে না।হনহনিয়ে রুম থেকে চলে যায়।আরশি ছলছল চোখে সিদ্রাতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে…

সিদ্রাত রুমে এসে দেয়ালে জোরে জোরে দুইটা ঘুষি দেয়।হাত কিছুটা ছিলে যায় এতে…
—”কিভাবে আমি এটা করলাম?উফফ..মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে।এমনটা করা উচিত হয়নি।একদমই না।আমার নিজেকে কন্ট্রোল করা দরকার ছিলো…দরকার ছিলো কন্ট্রোল করা…”

সিদ্রাত বিড় বিড় করতে করতে কপাল হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়ে।চোখগুলো লাল হয়ে গিয়েছে।খুবই অপরাধবোধ কাজ করছে ভিতরে….
_______________
ফজরের আজানের আওয়াজে আরশির ঘুম ভাঙে।চোখটা ডলতে ডলতে রুমের লাইট অন করে।ঘুমিয়েছিলো তিনটার দিকে।আর এখনি উঠে পড়ার কারণে মাথাটা হালকা ধরেছে…

রাতে ওই ঘটনার পরে আরশি কিছুক্ষণ কেঁদে হাত মুখ ধুয়ে মুনের রুমে চলে গিয়েছিলো।আরশির চোখ মুখের অবস্থা দেখে মুন আর কিছু জিজ্ঞাস করার সাহস পায়নি।কিছুক্ষণ গল্প আড্ডা দিয়ে দুজনই শুয়ে পড়ে।আরশি গেস্ট রুমে একা শুয়ায় কিছুটা ভয় পাচ্ছিলো।নিজের বাসায় অন্ধকার করেই ঘুমায়।কিন্তু নতুন জায়গায় একা শুতে ভয় লাগছিলো বলে আর ঘুমায়নি।তিনটার দিকে অবশেষে চোখ লেগেছিলো…

আরশি ওযু করে নামাজ পড়ে নেয়।তারপর কি যেনো ভেবে নিজেদের বাসায় গিয়ে কফি বানিয়ে দুকাপ কফি নিয়ে আবারও সিদ্রাতদের বাসায় চলে আসে।কাঁপা কাঁপা পায়ে সিদ্রাতের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।রুমের দরজা খুলা।হালকা উঁকি দিয়ে দেখে সিদ্রাত রুমেই নামাজ পড়ছে…
—”কি ব্যাপার উনি কি মসজিদে যায়নি?মনে হয় সজাগ পায়নি”

আরশি কফি দুটো হাতে নিয়ে দরজার এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।নক দেয়ার সাহস পাচ্ছে না।যতই হোক কালকের ঘটনায় বেশ লজ্জা লাগছে।আরশি মনে মনে ভাবল…
—”উফফ লজ্জা নিয়ে এখন ভাবলে হবে না।আমি উনার চোখে স্পষ্ট অপরাধবোধ দেখেছি।উনার সাথে ফ্রি না হলে হয়ত এই অপরাধবোধ কাটবেনা।তাছাড়া আমায় কাঁদতে দেখেই হয়ত উনি আরও বেশি গিলটি ফিল করেছে।কিন্তু উনি তো জানে না আমার কাঁদার আসল কারণ..”

আরশি মনে মনে এসব ভাবছিলো আনমনা হয়ে।এর মাঝেই সিদ্রাত আরশিকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা অবাক হয়।তাও জিজ্ঞাস করে…
—”কিছু বলবে?”

আরশি সিদ্রাতের ডাকে হুশে আসে।চোখটা নামিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে কফির মগটা বাড়িয়ে দেয়।সিদ্রাত কয়েক সেকেন্ড আরশির দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর কফির মগটা নিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।দুজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।কেমন একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার।সিদ্রাতই নীরবতা ভাঙল….
—”বারান্দায় যাবে?আমায় বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলে জোর করছি না”

আরশি মুচকি হেসে বারান্দার দিকে হাঁটা ধরল
সিদ্রাতও একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে আরশির সাথে দাঁড়ালো।আরশি সিদ্রাতের দিকে তাকালো।যতবারই তাকায় ততবারই যেনো প্রেমে পড়ে। আরশি মাঝে মাঝে কনফিউসড হয়ে যায় যে সিদ্রাত কী আসলেই এতো সুন্দর নাকি আরশির কাছেই শুধু সুন্দর লাগে!
—”কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো”

সিদ্রাতের কথায় আরশি হালকা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।আরশির এই লাজুক ফেইসটা দেখলে অটোমেটিকেলি সিদ্রাতের ঠোঁটের কোণে হাসি চলে আসে।এটা তো আজ নতুন না।সিদ্রাত ঠোঁটে সামান্য হাসি ঝুলিয়েই বলল….
—”জন্মের সময় কি আন্টি তোমার কপালে লজ্জাবতী গাছের পাতা ছুঁইয়েছিলো নাকি জুস বানিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলো”

আরশি ফিক করে হেসে দেয় আর নিচের দিকে তাকিয়েই লাজুক কন্ঠে বলে…
—”আমি সবার সামনে এভাবে লজ্জা পাইনা।শুধু আপনার,,,”

আরশি কথাটা শেষ করল না।থেমে গেলো।এটা কি বলতে পারবে নাকি মেয়েটা?লজ্জায় রক্তিম হয়ে যাবে।পরে সিদ্রাত যদি কিছু বুঝে যায়!
সিদ্রাত মৃদু হেসে বলে…
—”হুম আমার কী..”
আরশি লজ্জামাখা কন্ঠেই বলে…
—”তেমন কিছু না”

সিদ্রাত কফির মগে একটা চুমুক দেয়।তারপর আবার বলে….
—”গতকালের জন্য আমি সরি।আমি জানি যা করেছি তা ঠিক করিনি।বাট তোমায় কষ্ট দেয়ার কোনো ইচ্ছা ছিলো না আমার।প্লিজ মাফ করে দিও”

আরশি মৃদু কন্ঠেই বলল….
—”ইটস ওকে..বাদ দিন।মানুষের লাইফে তো কত এক্সিডেন্টই হয়।আর দুজন নর-নারী একসাথে থাকলে সেখানে থার্ড পারসন হয় শয়তান।আপনি হয়ত ধোঁকায় পড়ে গিয়েছিলেন”

সিদ্রাত আরশির শেষ কথাগুলোতে কেমন যেনো কষ্টের ছোঁয়া খুঁজে পায়।মনে মনে ভাবে..
—”সত্যিই কি আমি ধোঁকায় পড়েছিলাম!সব ছোঁয়া কি ধোঁকাতেই হয়।কোনো অনুভূতি কি থাকে না কিছু ছোঁয়ায়!”
—”স্যায়ায়ার..”

সিদ্রাত চমকে উঠে আরশির দিকে তাকায়।আরশি বলে…
—”আপনাকে কত্তগুলো ডাক দিলাম?দাঁড়িয়েও ঘুমোতে পারেন আপনি?”
সিদ্রাত হেসে দেয় আরশির কথায়।আরশিও ফিক করে হেসে উঠে….
চলবে…
#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_18
#Writer_TanhaTonu

আরশি আর সিদ্রাত অনেক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করে।প্রায় সূর্য উঠে গিয়েছে।পূর্ব আকাশ লাল বর্ণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।আরশি হঠাৎ বলে উঠে…
—”স্যার আপনি আজ মর্নিং ওয়াকে তো গেলেন না?”

সিদ্রাত সরু চোখে তাকায় আর মুচকি হেসে বলে…
—”তুমি কি করে জানো আমি মর্নিং ওয়াকে যাই?”

আরশি থতমত খেয়ে যায়।আমতা আমতা করতে থাকে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে।সিদ্রাত ভ্রু নাচায়
আরশি দৌড়ে চলে যায়।সিদ্রাত হেসে দেয়…
—”পিচ্ছি পাগলী!”

আরশি নিজেদের বাসায় এসে স্কুলের জন্য রেডি হয়ে নেয়। দরজার সামনে দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।উদ্দেশ্য সিদ্রাতের সাথে যাবে।কিন্তু সিদ্রাতকে কীভাবে এটা বলবে সেটাই ভাবছে।কিন্তু পরশু যখন সিদ্রাত বলল “কখন কি বিপদ হতে পারে কেউ তো জানে না” তখন থেকেই আরশি ভীষণ ভয় পেয়ে আছে।একা একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।

আরশি যখন এসব ভাবনায় বিভোর তখনই সিদ্রাত বের হয়।আরশিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে মৃদু হাসে।তারপর ইচ্ছা করেই বলে…

—”আরশি তোমাদের ড্রাইভার আসেনি?কখন যাবে স্কুলে?”

আরশি চমকে সামনের দিকে তাকায়।তারপর আমতা আমতা করতে থাকে।সিদ্রাত জিজ্ঞাস করে…
—”কোনো প্রবলেম?”
আরশি আমতা আমতা করে বলে….
—”স্যার আমায় আপনার সাথে নিবেন?”

সিদ্রাত যেনো এই কথারই অপেক্ষায় ছিলো।ও কিছুটা শান্ত কন্ঠেই বলে…
—”নো আরশি।তোমাদের নিজেদের কার আছে তাহলে আমার কারে করে কেন যাবে তুমি?”

আরশির এবার কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা।করুণ কন্ঠে মেয়েটা বলে…
—”প্লিজ স্যার.. আমি নিজেদের কারে করে,,যেতে পারলে আপনায় বলতাম বলুন?”
—”এক্সেক্টলি তাই..তুমি কেন নিজেদের কারে করে যাচ্ছো না?বলো আমায়..”

আরশি করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে।এই কথা কি মুখে আনা এতোটাই সহজ?সিদ্রাতও যেনো পণ করেছে আরশি সব না বললে ও যাবে না।সিদ্রাত শক্ত কন্ঠেই বলল…
—”ওকে বলতে হবে না।তুমি তোমার মতো যাও”

সিদ্রাত এটা বলে হাঁটা ধরে।আরশি দৌড়ে গিয়ে সিদ্রাতের হাত ধরে ফেলে।সিদ্রাত মনে মনে হাসে।মুখে আগের মতোই ভাব বজায় রেখে বলে…
—”আবার কি হলো?কিছু বলবে?”
আরশি ধরা গলায় বলে…

—”বলব..সব বলব।কিন্তু প্লিজ এখন না।স্কুল থেকে আসার সময় প্রমিজ সব বলব”

সিদ্রাত আর জোর করে না।আরশির হাতটা নিজের হাতে পুরে নিয়ে মাথা নাড়ায়।আরশি নিচের দিকে তাকিয়ে এক ফোটা অশ্রু ঝরায়।তারপর চোখটা সাথে সাথে মুছে সিদ্রাতের সাথে কারে গিয়ে বসে।সিদ্রাত কার স্টার্ট দেয় স্কুলের দিকে…

স্কুলের গেইটের সামনে কার থামলে সিদ্রাত টিচার্সরুমে আর আরশি নিজের ক্লাসরুমে চলে যায়।সিটে বসতে না বসতেই আরশি অবাক হয়ে যায়।কারণ নিরা আর ছোঁয়াও আছে এখানে..
—”কি ব্যাপার ওদের কী টিসি দেয়নি?কিছুই বুঝলাম না”

নিরা আর ছোঁয়াও আরশির দিকে রাগী চোখে তাকালো।আরশি হু কেয়ারস ভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল।কিছুক্ষণের মাঝেই ফারহা আর বনিও এলো।বনি বলল…
—”কিরে গতকাল আসিসনি কেন?”
—”গতকাল আমাদের বাসার সবাই নানুর বাসায় গিয়েছে।ভেবেছি আমিও যাবো কিন্তু নেয়নি”

ফারহা হেসে দিলো।হেসে বলল…
—”হুম তুই যেই বমি করিস সেজন্যই হয়ত নেয়নি”

আরশি মুখ বাঁকালো।ফারহা আফসোসের ভান করে বলল…
—”আহারে তার মানে আমাদের ম্যাথ কুইন ক্রাশ কুইন এবারও এক্সকার্শনে যেতে পারবে না..উহহু”

আরশি লাফিয়ে উঠল…
—”এএহ বললেই হলো?গত পাঁচ বছর ধরে আমায় একবারও শিক্ষা সফরে যেতে দেয়নি।এবার তো আমি যাবোই।যা-ই হোক না কেন”
বনি বলল…
—”তাহলে আর কি?দুইদিন টাইম আছে টাকা জমা দেয়ার।আজ আর কাল..এই দুইদিনের মধ্যে জমা দিতে না পারলে তোর স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে”

আরশি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল…
—”মানে??”
ফারহা বলল..
—”মানেটা হলো গতকাল প্রিন্সিপাল স্যার এসে বলে গিয়েছেন শিক্ষা সফরের কথা।কালকের মধ্যে টাকা জমা দিতে হবে। তিনদিন পর শিক্ষা সফর।বাস রওনা দিবে সকাল সাতটায়…”

আরশির মাথায় যেনো বাজ ভেঙে পড়ল।ও কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল…
—”আম্মু-আব্বু কেউ বাসায় নেই।আরও দুইদিন পর বিকালে আসবে।আমি এখন টাকা পাবো কোথায়?”

ফারহা আর বনির মুখটাও ছোট হয়ে গেলো।এতক্ষণ মজা করলেও ওরা আগেই ভেবে রেখেছিলো তিনজন একসাথে অনেক মজা করবে শিক্ষা সফরে গিয়ে…
বনি বলল…
—”আঙ্কেল বা আন্টিকে সিদ্রাত স্যারের নাম্বার দিয়ে ফোন দিয়ে বল”

আরশি অসহায় চোখে তাকালো।ফারহা বলল…
—”দেখ আরশি এখন এতো দ্বিধা নিয়ে থাকলে হবে না।তাহলে কিন্তু আর যাওয়া হবে না”

আরশি মন খারাপ করে বলল…
—”আচ্ছা টিফিন টাইমে ফোন দিবো নে”

তারপর যথারীতি ক্লাস শুরু হলো।পুরো ক্লাসে আরশির মুড অফ ছিলো যা সিদ্রাত খুব ভালো করেই দেখেছে।আরশি মুড অফ দেখে সিদ্রাতের মনটাও খারাপ হয়ে যায়।ক্লাসে ও একদম গম্ভীর ছিলো।ক্লাস শেষ হলে যাওয়ার সময় আরশির কাছে গিয়ে আস্তে করে একবার জিজ্ঞাস করে….
—”মন খারাপ?”
সিদ্রাতের কথাটা আরশির মাঝে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।ওর মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি বয়ে যায়।কিঞ্চিত হাসি ঝুলিয়ে না সূচক মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত মৃদু হেসে চলে যায়।সিদ্রাত চলে যেতেই আরশি দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে লজ্জায়।ফারহা হেসে বলে….
—”কিরে লজ্জাবতী কন্যা স্যারের এই সামান্য কথায় এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”

আরশি মুখ থেকে হাত সরিয়ে ব্লাশিং হয়ে বলে….
—”কথাটা সামান্য।তাৎপর্যটা বিশাল।জাস্ট ভাব উনি কিভাবে বুঝল আমার মন খারাপ?অবশ্যই আমার দিকে খেয়াল রেখেছে,,বারবার আমায় লক্ষ্য করেছে…উফফ আমি মরে যাবো রে.. এতো আনন্দ লাগে কেন?”

ফারহা আর বনি দুজনই হেসে দিলো আরশির কান্ডে।বনি মৃদু হেসে বলল….
—”তবে একটা কথা বলি।আমি সিউর না।জাস্ট মনে হয় স্যারও তোকে পছন্দ করে।কারণ তুই তো স্যারের সাথে প্রতিদিন কি কি হয় সবই আমাদেরকে বলিস।তাই আর কি তোর বর্ণনা অনুযায়ী মনে হয়”

আরশি লাজুক হেসে বলল…
—”উনার কিছু কিছু কাজে আমারও মনে হয়।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি বুঝি না আসলে উনার মনে কি চলছে”

ফারহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
—”বাদ দে।বেশি আশা করিস না।কারণ কোনো কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর যদি তা পাওয়া যায় তাহলে এতোটা খুশি লাগে যা বর্ণনা করা কঠিন।কিন্তু অতিরিক্ত প্রত্যাশিত জিনিসটা যদি পাওয়া না যায় তাহলে দুঃখটা পাওয়ার সুখটার চেয়েও হাজারগুণ।আমি চাইনা তুই এই দুঃখটা পা।নিয়তির হাতে আমাদের কারও হাত নেই”

আরশি ফারহার কথায় স্তব্দ হয়ে গেলো।আনমনেই ভাবতে লাগল…
—”কথাগুলো কষ্টের হলেও এটাই তো সত্য।নিয়তি যদি সত্যিই অন্যকিছু চায় তাহলে আমার কি হবে?আমি যে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি উনাকে।নিজেকে ভাবতে পারিনা আজকাল উনাকে ছাড়া..হে আল্লাহ আমার সাথে যেন এমন নির্মম কিছু না হয়।তুমি তো জানো তোমার এই বান্দার সহ্য ক্ষমতা কতটুকু।এর বেশি হলে মরে যাবো…”

ফারহার ডাকে আরশি হুশে আসে।ক্লাসে টিচার চলে আসে।আরশি সবার সাথে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়।তারপর টিচার বসতে বললে সিটে বসে মাথা নিচু করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ।আর চোখের টপ টপ পানিতে বইয়ের কিছু লিখা লেপ্টে যাচ্ছে।ক্লাস চলায় ফারহা আর বনি আরশিকে কিছু বলতেও পারছে না।তবুও কাঁধে হাত রেখে ইশারায় বলল কান্না থামাতে নাহলে টিচার দেখবে….

টিফিন টাইমে আরশি টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ইশারায় সিদ্রাতকে ডাকে।সিদ্রাত জরুরী ভেবে সাথে সাথে চলে আসে আর উদ্বিগ্ন হয়ে বলে…
—”আরশি এনিথিং রঙ?শরীর কি খারাপ লাগছে?”

—”স্যার না..একটু আম্মুকে ফোন দিবো।শিক্ষা সফরের টাকা কিভাবে জমা দিবো তা নিয়ে জিজ্ঞাস করার জন্য”

সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল…
—”এই নিয়ে তোমার মন খারাপ ছিলো তাহলে?পাগলী একটা!যাও ক্যান্টিনে গিয়ে টিফিন করো।টাকা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না”

আরশি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল…
—”না না তা বললে হবে না।আমি গত পাঁচ বছর ধরে যাইনা।এবার যাবোই।প্লিজ স্যার একটু ফোন দিন না আম্মুকে”

—”আরে পাগল রিলাক্স।আন্টি কি এখন টাকা পাঠাতে পারবে?ফোন দিয়ে কি হবে?আর মোস্ট ইম্পোর্টেন্টলি আমি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সকালেই তোমার টাকা জমা দিয়ে দিয়েছি”

আরশি অবাক হয়ে যায় সিদ্রাতের কথায়…
—”কিইইহ..আল্লাহ!কি বলেন?পুরো তিন হাজার টাকা দিয়েছেন??তার মানে তো আপনাকে সাত হাজার দিতে হয়েছে নিজেরটা সহ তাইনা?”

সিদ্রাত মুচকি হেসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ায়।আরশি মন খারাপ করে বলে…
—”আমার জন্য এতগুলো টাকা নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না স্যার।আপনি প্লিজ আমারটা ক্যান্সেল করে দিন।আমি যাবো না।আমার ভালো লাগছে না আপনার এতগুলো টাকা নষ্ট হওয়ায়”

সিদ্রাত আশেপাশে একবার তাকিয়ে আরশির গালদুটো আলতো করে ধরে।আরশি যেনো এমন স্পর্শে বরফ হয়ে যাচ্ছে।চোখ দুটো বুঝে আসছে ওর।অনেক কষ্টে চোখগুলো খুলা রেখে সিদ্রাতের চোখের দিকে তাকায়।সিদ্রাতও আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে…
—”সবসময় অন্যকে নিয়ে চিন্তা করলে হয়না।মাঝে মাঝে নিজেরটাও ভাবতে হয়।আমি কিন্তু টাকার চিন্তা করিনি।নিজের কথা ভেবেছি বলেই এতগুলো টাকা জমা দিয়েছি।মাঝে মাঝে একটু স্বার্থপর হওয়া খারাপ না”

আরশি চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকালো।সিদ্রাত হাতদুটো সরিয়ে ফেলল।আরশি ঠোঁটের কোণায় সামান্য মুচকি হাসি ঝুলিয়ে দৌড়ে ক্লাস রুমে চলে গেলো।সিদ্রাত হালকা হাসল আরশির যাওয়ার পানে তাকিয়ে…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here