#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ২৭
.
“বিয়ে করব মানে? কিসের বিয়ে? কাকে বিয়ে করব! তোমাকে!!! সকাল সকাল বিনোদন !”
“কি মজা করছ” বিস্ফোরিত চোখে আরিফের দিকে তাকায় রিদিমা।
“মজার শুরু তুমিই করেছ আমি শেষটা করলাম। তাতে কি সমস্যা?”
“যাও! কি বাজে বকছ!”
“সেটাই বলছি যেটা তুমি শুনছ”
“এসব কি বলছ, এই দেখো আরিফ, জান তুমি এই বিষয়টা নিয়ে মজা করো না অন্তত, এই বিষয়ে। আমি খুব সিরিয়াস, আমি তোমাকে ভালবাসি।”
“দুই বাচ্চার মা কে আমার মত অবিবাহিত ছেলে বিয়ে করতে যাবে কোন দুঃখে?”
“কি বলছ এসব!” আরিফের হাত চেপে ধরে রিদিমা।
আরিফ মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“দুই বাচ্চার মা সেটা তুমি কি করে জানো? একরাশ বিস্ময় রিদিমার চোখে। সে তো অনিকের বাবার কথা বলেনি আরিফকে! একটু থেমে আবার রিদিমা প্রশ্ন করে,
“ভালবেসেছিলে কেন? ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছিলে কেন!”
“ভালবাসা, তুমি জানো ভালবাসা মানে কি?”
এবার কেঁদে ফেলে রিদিমা।
“খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“আরিফ এভাবে বলো না প্লিজ”
“ন্যাকামি করবি না, দুই বাচ্চার মাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি আমার থাকবে না। কিন্তু সেটা তুই না!
আর আমি তোকে শুধু ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছি, তোর মতো নষ্টামি করিনি”
“মুখ সামলে কথা বলো আরিফ” উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে রিদিমা।
“ওই ড্রামা কুইন, ড্রামা বন্ধ কর! স্বার্থপর কোথাকার! আমি যে এখনো তোকে মারিনি তাই তোর কপাল” হাত মুঠো করে বলে আরিফ।
রাগে তার কপালের শিরা গুলো ফুলে উঠেছে।
আরিফের মুখ দেখে রিদিমা সহসা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
কোনো উত্তর জোগাল না তার মুখে।
আরিফ এসব কি বলছে!
কেন ই বা বলছে!
“আমি শুধু তোমার জন্যই ঘর ছেড়েছি”
“শোন রিদিমা আমি সায়ান নই, আর সায়ানের মতো ভাল মানুষও নই, তাই শুধু শুধু আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করবি না”
“কি তুই তুই করছ তুমি? এর মাঝে সায়ান আসছে কেন?”
“এর থেকে খারাপ ভাষা আর পাচ্ছি না।”
আচমকা আরিফকে জড়িয়ে ধরল রিদিমা।
আরিফ ভেবেছিল রিদিমা এমনটা করবে।
“ছাড়! আমাকে নোংরা করিস না” বলে ধাক্কা দেয় রিদিমাকে।
আরিফ তার ভালবাসার উষ্ণতাকেও উপেক্ষা করবে এতটা ভাবেনি রিদিমা।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরিফের দিকে।
দুচোখে পানি টলমল করছে।
আরিফ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
“আমি সায়ানের মতো উদার না বুঝলি? তাই আমার সাথে এর পর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিস তো মরেছিস! তোর অফিসের কাগজ গুলো আমি তোর বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি, পেয়ে যাবি, শুধু মাত্র সায়ান ছিল বলে তুই নিঃস্ব হলি না, আমি হলে তোর শেষ দেখে ছাড়তাম, তুই কি মা! তুই কলঙ্ক! ছিঃ”
একরাশ ঘৃণা নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় আরিফ।
আরিফের এই অভিনয় আরো কিছুদিন করার কথা ছিল।
কিন্তু আজ যখন শুনল সায়ান কালই চলে যাবে তখন আর সহ্য করতে পারেনি।
আরিফের কথা সায়ান শুনবে না।
মায়ার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আরিফের।
কিন্তু সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে সায়ানকে কিছুই বলেনি।
কারণ ও এখন কিছুই বুঝতে চাইবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরিফ।
রিদিমার মনে হচ্ছে তার মাথার উপর যেন আকাশটা ভেঙে পড়েছে।
কিছুই ভাল লাগছে না।
ঘন্টাখানেক ও খানেই চুপ করে বসে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে বাসায় গেল।
আরিফের মনে হচ্ছে রিদিমার ভাল হওয়ার সুযোগ ছিল হয়তো বা কিন্তু রিদিমাকে বিয়ে করলে সায়ানের সামনে কি করে দাঁড়াবে ও!!!
এটা ঠিক ও রিদিমাকে ভালবাসে না। কিন্তু রিদিমার চোখে ওর জন্য যে ভালবাসা দেখেছে তা তো সত্যি। নাকি রিদিমার এমন ভালবাসা সায়ানের বেলায়ও দেখিয়েছিল???
হয়তো বা… নাহ, রিদিমাকে কাছে নেওয়া যাবে না।… অসম্ভব মায়ার সামনে কি করে দাঁড়াবে!
নিজের মনের সাথেই সম্ভাবনা গুলো মেলাতে থাকে। কি ভাবছি আমি নিজেকেই ধমক দেয় আরিফ।
আসলেই মানুষ বড় জটিল, নিজের মনে খাতায় কখন কি আঁকে নিজেই বুঝতে পারে না।
.
নওশির বিয়ে পরবর্তী সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ।
সে দুইদিন হলো বাবার বাড়িতে আছে। কাল ঈশান চলে গেছে, ওর কলেজ।
ঈশান খুব ভাল কিন্তু…. না সেটা আমার মনে ভুল, নিজেকে প্রবোধ দেয় নওশি।
সে আসা পর্যন্ত তার পিছু ছাড়েনি মায়া।
রাতেও না।
এখন সায়ানের ঘরে ঘুমাচ্ছে মায়া।
নিশিকা শ্বশুরবাড়িতে।
রোশনি কলেজে ভর্তি হতে গেছে।
নওশি আস্তে আস্তে সায়ানের রুমে গিয়ে মায়ার পাশে গিয়ে বসল।
নতুন জীবনের এক আনন্দ, কিন্তু মায়ার দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়।
হঠাৎ সায়ানের টেবিলের নিচে কোনার দিকে একটা দলা পাকানো কাগজ চোখে পড়ল নওশির।
তুলে নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে গিয়ে এক দিকে প্রিয় রিদিমা শব্দটা দেখে চমকে উঠে নওশি।
দ্রুত কাগজ টা খুলে দেখে একটা চিঠি।
চিঠির অর্ধেক লিখেই কেটে দেওয়া।
নওশি চিঠির ওই অংশটুকু পড়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল।
দ্রুত রুমে এসে টেবিলে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই চিঠিটা পেয়ে গেল।
থমকে বসে রইল নওশি। অন্যের চিঠি না বলে পড়া যে অসঙ্গত সেটা ভাবনার সময় নেই তার।
কিন্তু এসব সায়ান তো কখনো কাউকে বলেনি!!!
এরপর কি করবে সে!!!
ভাইয়া কোথায় এখন! কি করে কি হবে! ভাইয়া চলে যাবে, কিন্তু কবে? কোনোমতেই না। কিছুতেই যেতে দেবে না ভাইকে।
কোনোরকম টলতে টলতে নিজের রুমে আসে নওশি।
.
অবেলায় কিসের চিঠি আসতে পারে! বেশ বিরক্ত হলো রিদিমা।
বাবা মায়ের সাথে থাকে না সে।
সায়ানকে ছেড়ে আসার পর থেকেই আলাদা থাকে।
মন মেজাজ কোনোটাই ভাল নেই।
আরিফের জন্য কান্না করেছে সারাসময়।
এক রাশ বিরক্তি আর ক্লান্তি নিয়ে চিঠি খুলে রিদিমা…!
সায়ানের চিঠি! নড়েচড়ে বসে রিদিমা।
“প্রিয় রিদিমা,
খুব অবাক হচ্ছো তাই না? এই যুগে এসেও চিঠি দিচ্ছি!
কথা গুলো আমি তোমাকে বলতে পারতাম কিন্তু এতটা কষ্ট দেওয়ার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলো না। পড়ে দেখো।
আচ্ছা রিদিমা তুমি এমন কেন করলে? তুমি কি ভেবেছিলে? জীবনে টাকা বড় হওয়ার স্বপ্ন সব? স্বপ্ন দেখা উচিত রিদিমা কিন্তু কারোর স্বপ্ন ভেঙে নয়।
তুমি কি ভাবছ আমি কিছুই জানিনা?
আরিফ আমার বন্ধু!”
এটুকু পড়েই চমকে চোখ বন্ধ করে রিদিমা।
মুহূর্তের মাঝে আরিফের খারাপ ব্যবহার, তার কাছে সায়ানের অনুরোধ না করা সব স্পষ্ট হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে আবার পড়তে শুরু করে,
“আমি জানি রিদিমা তুমি আরিফের আগে আরো একটা সম্পর্কে জড়িয়েছিলে, সেটা আমি জানতাম।
হয়তো তোমার বিজনেসটা তুমি হয়তো দিয়েই দিতে নোমানকে।
আমি সবই জানি।
আর তোমার বিজনের বাঁচাতেই তোমার বিশ্বাস গুলোকে পরখ করতেই আরিফ তোমার জীবনে গিয়েছিল। তোমাকে ভালবাসতে নয়।
আরিফকে আমি নোমানের বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম যে তুমি ভুল করছ, ভুল ভাঙিয়ে দিলেই ঠিক হবে।
আরিফ বিশ্বাস করেনি।
তোমার আর নোমানের গভীর সম্পর্কের কথা আমার কান এড়িয়ে যাইনি রিদিমা।
আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারতাম তোমার কিন্তু প্রথমত আমি তোমাকে ভালবাসি, দ্বিতীয়ত তুমি আমার সন্তানের মা।
যাই হোক যেটা বলছিলাম,
আরিফের সাথে তুমি খুব সহজেই সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আমার বিশ্বাসকে কবর দিয়ে।
তাই আর কি করার…. আর এই জন্যই তোমাকে ফিরে চাওয়ার ইচ্ছে আমার জাগেনি।
আজ আরো কয়েকটা প্রশ্ন তোমার কাছে রইল, উত্তর এখন দিতে পারবে না হয়তো জানিনা সেই জ্ঞান তোমার আছে কিনা…
আচ্ছা রিদিমা আমার ভালবাসাতে কি কম ছিল?
তুমি আসলে কি চাও? কখনো ভেবেছ তোমার ভবিষ্যৎ কি?
মায়া আর অনিকের সামবে তুমি কখনো দাঁড়াতে পারবে?
তুমি একটা মা! কিন্তু তুমি কি সেই মায়ের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য?
রিদিমা সন্তান প্রসব একটা ইতর প্রানীও করতে পারে, মা হতে পারে না, তোমাতে আর ইতর প্রানীর মাঝে কোনো পার্থক্য আমি পাইনি….!
ক্ষমা করো আমি বাজে কথা বলে ফেললাম। অবশ্য আমার মনে হয় তুমি এটার যোগ্য।
তোমার বিজনেস আমি নিয়ে নিতে পারতাম, কিন্তু নিলাম না… করুনা!
আমি চলে যাচ্ছি, মায়ার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস করো না কখনো ভাল হবে না।
আজ মনে নওশির কথা শোনাই উচিত ছিল।
মায়াকে নিয়ে বেশি কিছু লিখছি না, সামান্য মাতৃসত্ত্বা তোমার মাঝে থাকলে তুমি খুব ভাল করেই বুঝবে।
তুমি একা আমার পরিবার টাকে ধ্বংস করেছ।
ভুল নয় অপরাধ করেছ তুমি… আর সেটা বারবার।
বারবার ভুল করলে ক্ষমাও হয় না। আর তুমি বারবার অপরাধ করে চলেছ। তোমার শেষ রক্ষা হবে তো?
নিজের কাজ সম্পর্কে সচেতন হও।
রিদিমা জীবন ছেলেখেলা নয়, যখন যাকে ইচ্ছে তার সাথে ঘর বাঁধলাম মন চাইল না তাকে ছেড়ে দিলাম। এ কি করে হয়!
হ্যাঁ এখন মডার্ণ যুগে মানুষের ধারণা যাকে কিছুদিন ভাল লাগার পর আর ভাল লাগে না তার সাথে সারাজীবন কেন থাকব!
এমন খোঁড়া যুক্তি হয়তো তোমারও আছে।
আচ্ছা এই মডার্ণ যুগের ভাল না লাগলেই ছেড়ে দিলাম এই ধারণার ক্ষেত্রে বলি, আচ্ছা এই কিছু দিনের সংসারে যে বাচ্চাগুলো আলোর মুখ দেখবে তাদের কি ইচ্ছে হবে না বাবা মাকে একসাথে দেখতে? তাদের বাবা মায়ের ভালবাসা পেতে ইচ্ছে হয় না? তারা কেন অবৈধ সন্তানের মতো বাঁচবে?
আর তোমার এই যুক্তিই ছিল যদি আমাকে কেন বেছে নিয়েছিলে?
মায়া কেন এভাবে বাঁচবে! ওর অধিকার কেড়ে নেওয়ার তুমি কে!
অনিক কেন নিজের মায়ের পরিচয়ে বাঁচবে না? তোমার জন্য!!!!
আরো অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মাঝে যদি একটু মানুষের অংশ থাকে তুমি বুঝবে।
ভাল থেক, চললাম।
সায়ান…
.
(চলবে)