মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪০
মোনার বুকের ভিতর একটু আগের যে উদ্দীপনার সর্জন হয়ে ছিলো ক্ষণকালেই তা ভয়ঙ্কর যন্ত্রনায় পরিণত হয়। মোনার হৃদস্পন্দন স্প্রিংয়ের বলের ন্যায় দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে লাফাচ্ছে। মোনার চোখে মুখে ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি’তে প্রকট ভাবে বুঝা যাচ্ছে লিলি বেগমের কথায় তীব্র কষ্ট পেয়েছে। মোনা কষ্ট আড়াল করতে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখে।নিশানের আঁকা যে ছবি গুলো দেয়ালে টাঙ্গানো অকারণেই সেগুলো দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করল,
– “প্রিয়ম ভাই রাজি এই বিয়েতে? তাঁর কোন পছন্দ নেই?”
– “প্রিয়মের বিষয় তোর খালু দেখবে।আর বিভা’কে ছোট বেলা থেকেই আমার খুব পছন্দ।”
প্রচণ্ড এক কষ্ট মোনার বুকের ভিতর সমুদ্রের মহাতরঙ্গময় ঢেউয়ের মত গর্জে উঠছে। লিলি বেগম হৃষ্টচিত্তে পুনরায় মোনা’কে সতর্ক করে বলে,
– “এই মোনা খবরদার!ভুলেও এই কথা প্রিয়ম’কে বলবি না। প্রিয়মের জন্য সারপ্রাইজ এটা।”
বেদনায় মোনার গলা ছলছল করে ওঠে। এই কষ্ট চাপিয়ে রাখা অত্যাধিক কঠিন কাজ। কথা বললেই যেন সব কষ্ট গলার স্বরে আত্মপ্রকাশ করবে। মোনা নিচু গলায় আস্তে করে বলে,
– “আমি কিভাবে বলব এসব তোমার ছেলের কাছে?তোমার ছেলের সাথে কি আমার দেখা হয় নাকি কথা হয়?”
মোনার কথা প্রত্যুত্তরে লিলি বেগম যা বলেছে তা মোনার কান অবধি পৌঁছালেও মস্তিষ্কে পৌঁছায় নি। উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোনা।লিলি বেগম আরো অনেক কিছু বলল। সেদিকে মোনার খেয়াল নেই।
– “মোনা আমি উঠি,বিভা ওরা আসলে তোকে যেতেই হবে আমাদের বাসায়।সেই আসলি আর গেলি না। আমাদের বাসায় যেতে তোর কি এমন মহা সমস্যা?”
লিলি বেগম বেশ তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। মোনা ফোন’টা খাটের উপর ছুঁড়ে রেখে দিলো। মোনার বুক চিঁড়ে বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসতে লাগলো। জীবনের এই অধ্যায়ে মোনা প্রগাঢ় ভাবে উপলব্ধি করল ভালো থাকা কিংবা সুখ-প্রশান্তি ওর জন্য নয়। আজন্ম কোন পাপ ছিলো হয়ত, যার জন্য প্রতিনিয়ত যন্ত্রনায় জর্জরিত হচ্ছে। মোনার অবচেতন মন সৃষ্টিকর্তার উপর ক্ষুব্ধ হয়।কয়েক মুহূর্ত পর আবার তওবা করে। সৃষ্টিকর্তা সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী। তাঁর পরিকল্পনায়’ই মঙ্গল অন্তর্নিহিত। মোনা নিঃশব্দে ঢুকরে উঠে। অভিশপ্তময় এই জীবন নিয়ে তিক্ত হয়ে গেছে, ক্লান্ত হয়ে গেছে। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকায় নিশানের দিকে। নিশান ঘুমিয়ে গেছে।নিশান’ই একমাত্র পিছুটান নয়ত কষ্ট,দুঃখ,যন্ত্রনা কিংবা বিষণ্ণতার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত।
কেউ খুব শব্দ করে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। হাঁটার শব্দে মনে হচ্ছে মানুষ’টা প্রচুর ক্ষুব্ধ মনে হাঁটছে। মোনার রুমের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো ক্রমশ। হঠাৎ যেন মোনার সম্বিত ফিরে। প্রিয়ম এসেছে?মোনা দ্রুত বেগে দিয়ে দরজা লক করতে উদ্যত হতেই, প্রিয়ম দরজা লক করার আগে ঢুকে পড়ে বাসায়। প্রিয়ম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মোনার দিকে অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে থাকে। রাশি রাশি অভিমান সে চাহনি’তে। কত দিন বাদে প্রিয়মের মুখোমুখি হয়েছে। মোনা তাকায় না প্রিয়মের দিকে, চোখ মেঝেতে নিবদ্ধিত। কিছুক্ষণ শব্দহীন ভাবে কাটলো। শব্দহীন পরিবেশ’টা বিলীন করে দিয়ে প্রিয়ম গভীর আবেগময় গলায় বলে,
– “মোনা পাখি এখনো অভিমান? একশ দশ ঘন্টা ,বারো মিনিট,চল্লিশ সেকেন্ড পর দেখা।”
প্রিয়ম প্রগাঢ় অনুরাগে দুই হাতে মোনার গাল আলতো করে চেপে করে। চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে মোনার। মোনা চোখ দুটি যেন নিভু নিভু দীপক।
– “কেন এসেছেন আপনি?”
এ যেন কপট রাগ, তীব্র অভিমান।গলার স্বরে তেমন জোর নেই।
– “তুমি চেয়েছ আমি আসি।আমি প্রতিদিন এসেছি নিয়ম করে এসেছি।তুমি চেয়েছ আজ আমার সাথে কথা বলতে।”
মোনা মনে মনে চমকে যায়। কিভাবে বুঝলো প্রিয়ম? নিস্তেজ গলায় বলে,
– “আমি কখনো চাই নি আপনি আসেন।”
– “মিথ্যা বলো না মোনা।আমায় ছাড়া তো ভালো নেই তুমি।ভালো থাকতে পারছো না। তবুও কেন মিছে মিছে অভিমান?দেও না আরেকবার সুযোগ। জগদ্বাসীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হবো।”
মোনার অন্তরতম অঁচলে থাকা অভিমান গুলো ঘন জলমুক্ হয়ে জমাট বেঁধেছে।একটু বাদে’ই তা নেত্র কোটর বেয়ে বৃষ্টির ন্যায় ঝড়ে পড়ছে। মোনার এতদিনের ধারণা বদলে গেল। মোনার মনে হত ভালোবাসার মানুষ’টা কে ভোলা সহজ এক কাজ। কিন্তু না ,যে একবার হৃদয় থেকে প্রেমে পড়ে সেই প্রেম থেকে বেরিয়ে আসা কঠিনতর কাজ।প্রিয়ম মোনার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো গভীর যত্নে মুছিয়ে দেয়। সুললিত কন্ঠে মোনা’কে শাসিয়ে বলে,
– “আর এক ফোঁটা পানি চোখ থেকে পড়লে খুব খারাপ হবে মোনা। এরপর যদি কখনো কাঁদো সে কান্না সুখের হবে,কষ্টের নয়। তোমায় ছাড়া থাকা আমার সম্ভব না। প্রমিস মোনা পাখি আর কাঁদতে দিবো না কখনো।”
কান্নার ধকলে মোনার গলা ধরে আসছে, কথা বলতে পারছে না। লিলি বেগমের বলা কথা গুলো বুকের ভিতর ধারালো ছুরির মত আঘাত করেছে যেন। প্রিয়ম মোনা’কে আলতোভাবে জড়িয়ে রাখে। প্রিয়মের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হওয়ার কোন চেষ্টা করল না মোনা,জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে,
– “গাল দুটো তো পলি মাটি,এত কাঁদলে গলে যাবে। নাক’টা তো ভয়াবহ ভূমিকম্পের মত কাঁপছে রিখটার স্কেলের এর মাত্রা ৯.৫ হবে। যাও ওইদিনের ছুরি’টা নিয়ে আসো। গলা’টা কেটে ফেলো আমার।”
প্রিয়মের ছোঁয়ার উষ্ণতায় মোনার সমস্ত রাগ, অভিমান মোমের মত গলতে শুরু করে। হাত দুই’টা প্রিয়মের কাঁধের উপরে রাখে। রুক্ষ, বিষণ্ণ মোনা হঠাৎ আহ্লাদিত হয়ে উঠে। আহ্লাপূর্ণ গলায় বলে,
– “খুন করে ফেলবো আপনায় আর কখনো আমায় কষ্ট দিলে।”
প্রিয়মের বুকে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে। প্রিয়মের মুখে হাসি, প্রশান্তির হাসি। প্রসস্থ ঠোঁটে গাঢ় হাসি ফুটিয়ে বলে,
– “হাতে শক্তি নেই?কি কিল ঘুষি দিচ্ছো গায়েই লাগে না।আর কষ্ট দিলে শূলে চড়িয়ো।”
মোনা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।ছয় ফিট উচ্চতার প্রিয়মের বুক অবদি পড়ে থাকে মোনার মাথা।মোনা প্রিয়মের শার্ট খামচে রাখে।
– “আহা মোনা কি করতেছ?তোমার নাকের পানি, চোখের পানি’তে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে।”
মোনা কাঁদো কাঁদো মুখেও হেসে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত পরই লিলি বেগমের বলা কথা গুলো মনে পড়ল।প্রিয়ম’কে এখন বলতে ইচ্ছে না, বলার মানসিকতা নেই। নিঃশব্দে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো ওভাবে। কেউই কোন কথা বলেনি।
– “মোনা?”
– “হুম।”
– “ক্ষুধা লেগেছে,খাওয়া যাবে?”
মোনা মুখ তুলে তাকায়।প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেক্ষণ। স্থির, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।এই কয়দিন যে যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সে যন্ত্রনা গুলো লাঘব হচ্ছে ধীরে ধীরে।প্রিয়ম বলে,
– “কি তাকিয়ে আছো কেন?”
মোনা ঈষৎ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।আবার প্রিয়মের বুকে মাথা রাখে। খানিকক্ষণ পর বলল,
– “চলুন খাবেন।”
প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মোনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
– “কি হলো খাবেন না? আচ্ছা আপনার ব্যথা ভালো হয়েছে?”
প্রিয়ম উত্তর না দিয়ে মোনার দুই কাঁধে হাত রেখে গভীর মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকায় মোনার দিকে।
– “সেদিন যদি ছুরি’টা আমায় গলায় বিঁধত?”
– “ফল কাটার ছুরি, তেমন ধারালো না। গলায় পরলেও খুন হতেন না।”
প্রিয়ম হেসে ওঠে। মোনার কপালে কপাল ঠেকায়। মোনা চোখ বুঁজে ফেলে। মোনা শিরায় উপশিরায় শিহরণ জাগে। প্রিয়ম’কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে লজ্জা মিশ্রিত গলায় কপট বিরক্ত দেখিয়ে বলে,
– “ধ্যাত!”
মোনা টেবিলে খাবার সাজায়।প্রিয়ম চেয়ারে বসে আছে। প্রিয়মের দৃষ্টি মোনার দিকে। কাজ শেষ করে এসে প্রিয়মের পাশে চেয়ার টেনে বসে। প্রিয়মের সামনে প্লেট দেয়।প্রিয়ম কপাল কুঁচকে মোনার দিকে তাকিয়ে বলে,
– “আমার সামনে প্লেট দিলে কেন?”
প্রিয়মের কথায় মোনা অবাক হওয়া গলায় বলে,
– “কেন?আপনি’ই তো বললেন খাবেন।”
– “হ্যাঁ বলেছি খাবো। কিন্তু নিজের হাতে খাবো তা তো বলিনি।”
মোনা চুপ।প্রিয়ম মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে পুনরায় বলে,
– “তোমার হাতে খাবো।”
মোনার মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠে। লাজুক লতার মত মাথা নিচু করে ফেলে। কিছুক্ষণ পর খাবার মেখে প্রিয়মের দিকে তাকায়।প্রিয়মের মুখে তুলে দিতে নিদারুণ এক অস্বস্তি’তে পড়ে।
– “এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে মোনা পাখি?”
– “আমায় জান, পাখি এসব ডাকবেন না। লজ্জা লাগে আমার।”
প্রিয়ম হেসে উঠে মোনার অভিব্যক্তি দেখে। মোনা অস্বস্তি কাটিয়ে প্রিয়মের মুখে খাবার তুলে দিতে লাগল। মোনার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে প্রিয়মের সাথে সম্পর্ক’টা এমন সুন্দর থাকলে ও ভালো থাকবে। কষ্ট,দুঃখের নাগালের বাইরে থাকবে। প্রিয়ম খেতে খেতে বলল,
– “এই পাঁচ দিন আমায় মিস করো নি?”
মোনা সহজ গলায় বলল,
– “করেছি।”
কথা বলতে বলতে প্রিয়মের খাওয়া শেষ হলো। রাত তখন অনেক হয়ে গেছে। প্রিয়ম ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল,
– “রাতে থাকবো নাকি যাবো মোনা?”
মোনা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলে,
– “থাকবেন মানে? এখুনি বাসায় যান।”
প্রিয়ম আবার হেসে উঠে।মোনা তাকায় প্রিয়মের দিকে। হঠাৎ করেই কেন জানি প্রিয়মের হাসি খুব বেশি সুন্দর মনে হলো। মোনার কথার প্রত্যুত্তরে প্রিয়ম বলে,
– “আমাদের বিয়ে’টা হয়ে গেলে ভালো হতো না?এত রাতে কষ্ট করে বাসায় যেতে হতো না।”
বিয়ের কথা শুনে অন্য আরেক রকম অনুভুতি হলো মোনার। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে বলে,
– “এত চিন্তা করতে হবে না। যাচ্ছি আমি।”
– “আমি কখন চিন্তা করলাম?”
– “আই’স আর দ্যা মিরর অফ দ্যা মাইন্ড।”
মোনা প্রিয়মের সাথে দরজার কাছে আসলো। দরজার সামনে এসে প্রিয়ম হাঁটার গতি থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মোনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। প্রিয়ম বলে,
– “আমায় তুমি বলো নয়ত আমি যাবো না।”
মোনা নাক-মুখ কুঁচকে বলে,
– “আমি তুমি বলতে পারবো না। আমার লজ্জা লাগে।আপনি যান আমি পারবো না।”
প্রিয়ম নিজের জিদ রক্ষার্থে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক সময় পেরিয়ে যায়। মোনা অধৈর্য হয়ে বলে,
– “এই যে বলছি তুমি। এখন যান।”
মোনার কথা শুনে প্রিয়ম শব্দ করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বললো,
– “কোন ধরণের তুমি বলা এটা?হয়নি। আমি যাচ্ছি না।”
– “তাহলে কিভাবে বলবো তুমি?”
– “বলো,প্রিয়ম আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
মোনা হাঁ হয়ে যায় প্রিয়মের কথা শুনে। চোখে-মুখে চাপা আতঙ্ক।যেন এটা বলা পৃথিবীর কষ্টসাধ্য কাজে ভিতর একটি। মোনা গম্ভীর মুখে বলে,
– “আমি বলতে পারবো না।এসব বলা আমায় দিয়ে হবে না।”
– “তাহলে আমিও যাচ্ছি না।”
প্রিয়ম অনেকক্ষণ ধরে মোনার দিকে তাকিয়ে দরজার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মোনা কপট রাগ দেখিয়ে আবার বলল,
– “যান তো।আমি পারব না।”
– “আমিও যাবো না।”
মোনা কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কিভাবে এটা বলবে তাই নিয়ে চিন্তিত।কয়েক মুহূর্ত মুখস্থ পড়ার মত করে বলল,
– “প্রিয়ম আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
এই টুকু বলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রিয়ম’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা আটকে দেয়।দরজা আটকানোর আগের মুহূর্তে ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেছে। মোনা ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাসলো চোখ বুঁজে। অনেকক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। লিলি বেগমের কথা গুলো আবার মাথা চারা দিয়ে উঠলো। মোনা তীব্র শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে গেল। লিলি বেগম বিভা’কে পছন্দ করে ছেলের বউ হিসেবে।লিলি বেগমের আশা ভঙ্গ করবে?মোনা নিরুপায়, অনিচ্ছাকৃত ভাবে আটকে গেছে এই মায়ায়। কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছে না। হাবিব সাহেবের কথা মনে পড়তে মোনা আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কিন্তু এসব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসা আপন নিয়মে হয়ে গেছে। মোনার কি দোষ এখানে?এসব নিয়ে ভাবনায় বিমগ্ন থাকতে থাকতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মোনা।
____
একটু বেশি রাত করে ঘুমানোর ফলে সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়।মোনা দ্রুত রেডি হয়ে নিশান’কে নিয়ে বের হয়।ভার্সিটির কাছে যেতেই প্রিয়ম ম্যাসেজ করে,
– “তুমি ভার্সিটি’তে চলে গেছো?আমি তোমার বাসার সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
মোনা উত্তর দেয়,
– “আমি তো ভাবছি আপনি অফিসে চলে গেছেন। আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল।”
– “আমারও আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। তুমি ভার্সিটি’তে চলে গেছো? ভার্সিটির সামনে দাঁড়াও না প্লীজ মোনা। আমি তোমায় দেখে অফিসে যাবো।”
ম্যাসেজ’টা দেখে মোনার ঠোঁটের কোণে আপনাআপনি একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
– “আচ্ছা ,আমি ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়েছি।আপনি আসুন।”
মোনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অস্থির চোখে তাকাচ্ছে।প্রিয়মের আসতে দশ মিনিট লাগলো।গাড়ি থামিয়ে মোনার দিকে তাকিয়ে হাসলো।মোনাও একটু হাসলো।
– “খেয়েছ তো সকালে তুমি?”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে।প্রিয়ম তড়িঘড়ি করে বলে,
– “আমার যেতে হবে মোনা পাখি।দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
– “আপনি খেয়েছেন সকালে? ভার্সিটি ছুটির পর একটু আসতে পারবেন কথা ছিলো?”
প্রিয়ম মোনার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– “কি কথা? আমি তো ঠিকঠাক আছি।কোন ভুল করিনি। ভয় পাচ্ছি কিন্তু।”
মোনা হেসে বলল,
– “আমি কি বলেছি আপনি ভুল করেছেন?”
– “তুমি যখন বলেছো যেভাবে হয় আসবো। প্রয়োজন বোধে চাকরি ছেড়ে দিবো তবুও আসবো।”
– “আচ্ছা যান।দেরি হয়ে যাচ্ছে আপনার।আমি অলরেডি লেইট।”
প্রিয়ম চলে গেল।মোনা ক্যাম্পাসে ঢুকে।শ্রুতি আর ওয়াটস এগিয়ে আসে মোনার দিকে। শ্রুতি ওয়াটসের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
– “ভার্সিটির সামনে এতক্ষণ প্রেম চলেছে, আমরা কিছু দেখিনি তাই না ওয়াটস?”
মোনা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওয়াটস বলে,
– “মোনা এগুলো কি? আমাদের ট্রিট দিবে না? লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করো কেন? তোমরা বাঙালিরা এত অদ্ভুত কেন?”
শ্রুতি ওয়াটসের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলে,
– “চুপ কুত্তার বাচ্চা।এত কথা বলিস কেন?”
ওয়াটস শ্রুতির কথা বুঝলো না। মোনা শ্রুতির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,
– “এই শ্রুতি কি সব বলছ এগুলো? বেচারা বাংলা বুঝে না বলে এভাবে গালি দিবে?”
শ্রুতি উচ্চস্বরে হেসে উঠে। মোনার হাত ধরে বলল,
– “এখন বলো তোমার কি অবস্থা সব ঠিক হয়েছে তো?”
– “হ্যাঁ ঠিক হয়েছে। ধন্যবাদ তোমায়।”
– “শুধু ধন্যবাদ?”
– “না ,না ট্রিটও দিবো।সমীর’কে ও দাওয়াত করবো।”
শ্রুতির সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে। আজকাল শ্রুতি’কে অদ্ভুত এক কারণে ভালোলাগে মোনার। শ্রুতি আর মোনা অধিকাংশ সময়’ই বাংলায় কথা বলে। এতে করে ওয়াটস খুব বিরক্ত। মাঝে মাঝে তীব্র বিরক্ত’তে ওদের সাথে কথা বন্ধ করে দেয়।
ভার্সিটি শেষ হওয়ার পর মোনা গেটের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায়।প্রিয়মের দেখা নেই।মোনা কয়েকবার ফোন করে ফোন রিসিভ করছে না।এক ঘন্টার মত অপেক্ষা করেছে, শেষে ব্যর্থ হলো। মোনা অফিসে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ম্যাসেজ আসে,
-“মোনা স্যরি। অফিসে খুব জরুরি কাজে আটকে গেছি।অনেক রাত হবে বাসায় ফিরতে।”
লিলি বেগমের বলা কথা গুলো বলতে প্রিয়ম’কে ডেকেছে। আর আজকেই কাজ পড়তে হলো। মোনার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো। মোনা অফিস শেষে বাসায় ফিরে। অনেক রাত হয়ে যায়। প্রিয়ম শুধু একটা ম্যাসেজ করে,
– “রাগ করো না খুব ব্যস্ত আমি।”
মোনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তীব্র অভিমান নিয়ে শুয়ে পড়ে। আগামীকাল আসবে বিভা। এসে তো প্রিয়ম’দের বাসায় থাকবে! মোনা নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে। প্রিয়ম আর বিভা এক বাসায় থাকবে?মোনা মানতে পারছে না। মোনা অনেক রাত পর্যন্ত ওয়েট করে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে দেখে প্রিয়ম রাত তিনটার সময় ম্যাসেজ করেছে।
মোনা নিশান’কে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে প্রিয়মের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রিয়ম আজ অনেক দেরি করে আসে।মোনা প্রিয়ম’কে দেখেই গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল,
– “বিভা এসেছে না?”
মোনার কথায় অভিমান স্পষ্ট। প্রিয়ম অবাক হয়ে বলল,
– “এসেছে নিপা খালা,খালু,বিভা।তুমি জানলে কিভাবে? আমি তো জানি না।”
– “খালা বলেছে। আরো অনেক কিছু বলেছে।কালকে এই কথা শোনার জন্যই আসতে বলেছি।”
– “কি বলেছে আর?তুমি রাগ করছ কেন?আমার কি দোষ এখানে বলো?”
মোনা একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল।মোনা’কে নিরুত্তর দেখে প্রিয়ম আবার জিজ্ঞেস করল,
– “বলো আম্মু আর কি বলেছে?”
মোনা বিষণ্ণ মুখে বলে,
– “আপনার আর বিভার বিয়ের ব্যাপারে এসেছে তাঁরা।যত দ্রুত সম্ভব আপনার বাবা বিয়ে সেরে ফেলতে চায়। খালা এসব বলতে না করেছে আপনায়। খালা যেন না জানে যে আমি আপনায় বলেছি এসব।”
প্রিয়ম বজ্রাহত মুখে তাকিয়ে রইলো। চোখে – মুখে চাপা বিস্ময়। নির্বাক হয়ে গেছে যেন। অস্ফুট স্বরে বলল,
– “হোয়াট দ্যা হেল!”
প্রিয়ম থেমে আবার বলে,
– “তুমি এ কথা দুই দিন পর বললে আমায়?”
মোনার মুখের অবস্থা সঙ্গিন। গম্ভীর মুখে চুপ করে রইলো। তীব্র একটা কষ্ট মোনার চাহনি’তে। উদাস গলায় বলে,
– “আপনি তো আপনার বাবার কথার অবাধ্য হতে পারবেন না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,
– “আপনি আর বিভা এক বাসায় থাকবেন। ভালো তো।”
প্রিয়ম রাগে নিজের ঠোঁট কামড়ে রেখেছে। চোখ গুলো লালচে দেখাচ্ছে।মোনার হাত ধরে বলে,
– “তুমি ভার্সিটি’তে চলো।আমার উপর ভরসা রাখো।তোমার খালা খুব খারাপ কাজ করল।”
মোনা ক্রোধপূর্ণ গলায় বলল,
– “আমার খালার দোষ, আপনার বাবার দোষ নেই?”
প্রিয়ম উত্তর দেয় না। সাঁওতাল শিকারীর কোচে ঘা খাওয়া গুঁইসাপের মত রাগে গড়গড় করতে থাকা প্রিয়ম।গলার দুই পাশের রগ ফুলে শক্ত হয়ে আছে।
– “মোনা তুমি এসব বাদ দেও। দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার।চলো ভার্সিটি’তে যাবে। থাকব না আমি বাসায়, কোন এক বন্ধুর বাসায় থাকব।”
– “আপনি তো আপনার বাবার কথার অবাধ্য হতে পারবেন না।”
এই কথার প্রত্যুত্তরে প্রিয়ম জোর খাটিয়ে কিছুই বলতে পারলো না। হাবিব সাহেবের অবাধ্য হতে পারে না প্রিয়ম। মোনা খুব সন্তর্পণে একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। চোখে মুখে প্রচণ্ড বিষণ্ণতা। প্রিয়ম রেগে আছে।মোনা’কে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমি অফিস শেষে তোমার বাসায় যাবো।”
মোনা ভালো লাগছে না কিছু।প্রিয়ম’কে ভালোবাসা যে কত’টা ভুল হয়েছে সেটা মোনা প্রতিটা পদক্ষেপে অনুভব করছে। তবুও নিরুপায়, ভালোবাসা যে সব কিছুর ঊর্ধ্বে। মোনা ভার্সিটি শেষে অফিসে যায়।কাজে মন বসছে না। সব কিছু তিক্ত লাগছে। ক্লান্ত ভর করা শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে। প্রিয়ম বলেছে অফিস শেষে আসবে। অনেক রাত হয়ে গেল প্রিয়মের দেখা নেই।
প্রিয়ম পারেনি হাবিব সাহেবের অবাধ্য হতে। মোনা’কে দেওয়া কথাও রাখতে পারেনি। সেরোয়ানি পরে বর সেজেছে।তাহলে কি ছিলো প্রিয়মের ভালোবাসা?
(চলবে)