একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫০
রোকসানা আক্তার
বুকে একদন্ড বস্ত্র ছাড়া পুরো শরীর নগ্ন অবস্থায় বিছানায় লেপ্টে আছে।দু’হাত দড়ি দিয়ে চৌকাঠের সাথে শক্তভাবে বাঁধা।দড়ি ছিঁড়েফুঁড়ে এই জাহান্নাম থেকে বেরুতে অশ্রুর কতই না চেষ্টা।তারপরও নরকের আস্তাবল থেকে নিস্তার মিলছে না।শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে তারপরও সেই কান্না মুখে এসে আঁটকা পড়ে মুখে ভেতর ওড়না ঢুকানোর কারণে।কতটা কষ্ট মনে! দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে অশ্রুর!পৃথিবীতে সাধুবেশে এতটা হিংস্র মানুষ আছে ভাবতেই অশ্রুর অবিশ্বাস্য চোখ জ্বলেপুড়ে দগ্ধ।যার জন্যে অজস্র ভালোবাসা,বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে এসেছে আজ সে মানুষটি পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট,বিশ্বাসঘাতকতা কাজ করলো!
গড়গড়িয়ে অজস্র নোনা জল বেয়ে পড়ে।এই হিংস্র মানুষটিকে খুব করে বলতে ইচ্ছে হয়-কেন আমার সাথে এতটা অন্যায় করতেছেন?আমার দোষ-ভুলগুলোর প্রাপ্যতা এভাবে তো পাওয়ার কথা ছিল না!আমাকে এক জব্দায় খুন করে দিন তারপরও প্লিজজ জ্যান্ত দেহে এমন কলঙ্ক দিবেন না আমার-না খুব কষ্ট হচ্ছে।কষ্ট হচ্ছে আপনাকে বিশ্বাস করেছি অরুন নামের কোনো এক বিশ্বাসঘাতককে ভালোবেসেছি ভেবে!
শুনে কে কার কথা!মনের কথা অশ্রুর মনেই রয়ে গেল। হিংস্র অরুন অনবরত তার শরীরের প্রতিটি অংশ শকুনের মতো খুবলাচ্ছে।সাথে স্রোতধারা রক্তের সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে।প্রচন্ড ব্যথায় অশ্রু কুঁকড়ে একাকার তারপরও কাতর শরীরটাকে কিছুতেই রেহাই হচ্ছো না।এভাবে ভোগ চলতে চলতে হোটেল কর্মচারী,মালিকও রুমে প্রবেশ করে মুখে শতানী চাহনি ফুটিয়ে।হিংস্র সেই বিশ্বাসঘাতক তাদের পদার্পণে পণ্যের মতো ভোগ করে আবার ওদের দিকে ছুঁড়ে ফেলে।ওরাও অশ্রুর শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে অনবরত ধর্ষণ করতে থাকে।অশ্রুর শরীরের শক্তি একদম শূন্য কোঠায়।নিস্তেজ শরীরটাকে দিকে দিকে অসহনীয় যন্ত্রণা দিয়ে কেড়ে নেয় গলার চিৎকার,কেড়ে নেয় শরীরের নড়চড়। বাঁচার ইচ্ছে আশহত হয়ে যায়।এই পৃথিবীটা তাকে যে খুব তাড়াতাড়ি বিদেয় দেবে তা এই নিঃশক্তি শরীরটা বলছে।পরপারে পা রাখার আগ মুহূর্তে অশ্রু সেই বিশ্বাসঘাতককে একফোঁড় দেখে নেয় এতগুলো মানুষের মাথার ফাঁক দিয়ে।তার চোখমুখে পিচাশ হাসি।
হায়রে অভিমানী,হায়রে ছলনাময়ী তোরা কেন এত স্বার্থপর!কেন এভাবে স্বপ্ন দেখিয়ে নিরুদ্দেশ করলি!
নিমিষে অশ্রুর আস্তে করে দু’চোখ বুঁজে আসে।
এমন বেদম স্বপ্ন মাথায় বেশিক্ষণ ঠাই দিতে না পেরে তীক্ষ্ণ দু’চোখের পাতা খুলে যায়।তরহর উঠে বসে ড্রিম লাইট অন করে। প্রগাঢ় অশ্রু ঝরঝরে ঘেমে একাকার সাথে অতিমাত্রায় দিকে দিকে হাঁপাচ্ছে।হাঁপানিটার ঘোরটা ৫-১০ থাকে!যখন ক্ষিপ্রতা প্রশমিত হয় তখন চোখে জল ভরে যায়।কপালে হাত রেখে কান্নামাখা কন্ঠে বলল,
“এ আমি স্বপ্নে কি দেখলাম!এ কী দেখালে আল্লাহ!বাস্তবে এটা যদি এমনটা ঘটে যেত..!
শেষ কথাটি অশ্রুর অন্তরকে অতিমাত্রায় আঘাত করে।সঙ্গে সঙ্গেই চোখভরে পানি জমে যা।দিকে দিকে মনে একরাশ ভয় এবং আতঙ্ক এসে ঘিরে ধরে।স্বপ্ন জগতে অরুনের মুখটা কতটাই না বিবৎস ছিল যেন পশুকূলের সবথেকে হিংস্র প্রাণিটি!কিন্তু বাস্তবে?বাস্তবে যদি এমনটা হয়েই যেত…!
ভেবে অশ্রু ঝিম বসে থাকে।তাছাড়া,লোকমুখে শোনা,মানুষ রাতের স্বপ্নে যেমনটি দেখে, বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটে। তবে স্বপ্নতো স্বপ্নই। স্বপ্ন সত্যি হয়না।ভেবেই অশ্রু এবার মনে মনে নিজেকে আশ্বস্ত করে।স্বপ্নটাকে মনের কোণে বেশিক্ষণ ঘেঁষতে না দিতে দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয়।আর অরুনের সাথে কাটানো সবথেকে ভালো মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করার চেষ্টা করে।অরুনকে ভাবনাতুর কখন যে আবারো অবচেতন ঘুমে পাড়ি জমায় বলতেই পারেনি।
ঘুম থেকে যখন জাগে তখন সূর্যের ঝলমলে সোনালী আলো পুরো রুমজুড়ে ঝকঝক করছে।অশ্রু দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সকাল ন’টা বাজে।কাচুমাচু দিয়ে উঠে বসে।তারপর বাথরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়।আয়নার সামনে এসে দাড়াতেই দরজায় কেউ নক করে।অশ্রু গায়ের ওড়না জড়িয়ে দরজা খোলে।সামনে রাতের সেই কর্মচারী দাড়িয়ে। লোকটি মুচকি হেসে বলল,
“গুড মর্নিং,ম্যাম?”
“গুড মর্নিং!
লোকটি একটা খাবারের ম্যানু অশ্রুর দিকে এগিয়ে বলল,
“ম্যাম,ব্রেকফাস্টের জন্যে কোন ম্যানুটা চোজ কাইন্ডলি বলতেন…।”
অশ্রু ম্যানুর দিকে না তাকিয়ে কর্মচারীকে স্ট্রেট প্রশ্ন করলো,
“আবরার ভাইয়া কি নাস্তা করেছেন?”
“জ্বী,ম্যাম।”
“কখন?”
“আঁটটার দিকে মে বি।”
“ওহ আচ্ছা।
বলেই অশ্রু ম্যানুতে চোখ রাখে।তারপর বলল,
” এককাপ চা।আর পায়েস নিয়ে আসুন।”
“দ্যাটস এনাফ?”
“ইয়াহ!”
“ওকে ম্যাম।”
লোকটি ব্রেকফাস্ট আনতে নিচে চলে যায়।অশ্রু ব্রেকফাস্ট টা শেষ করে বিছানায় এসে বসে।কী ভেবে যেন ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে।মোবাইল বন্ধ রাখা ছিল আর তা কাল রাতে এখানে আসার আগেই করেছিল।তাছাড়া, পরিবর্তে আবরারও কাল রাতেই একটা নিউ সিম দিয়েছিল। ওটা এখন মোবাইলে ঢুকালে মোবাইল অন রাখতে সমস্যা হবে না ভেবেই অশ্রু তাই করে।
ওই সিমে দু’দুটো নাম্বার দেখতে পায় একটা আবরারের এবং অন্যটি অরুনের।হয়তো তা আবরারই করেছে।আবরারের এমন সুকৌশলী কাজে অশ্রু মনে মনে খুশি হয় অনেক।এখন ফ্রী।তাই এই ফ্রী সময়ে আবরারের সাথে কথা বলে কাটিয়ে দিবে ভেবে আবরারের নাম্বারে কল লাগায়।দুর্ভাগ্যবশত নাম্বারটি বন্ধ পায়।কোনো কারণে বন্ধ থাকতে পারে তাই মনে করে ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে দেয়।
প্রায় ত্রিশেক মিনিট কেটে যাওয়ার পর দরজায় আবার নক হয়।নিশ্চয়ই আবরার হবে ভেবে অশ্রু হর্ণপায়ে গিয়ে দরজা খোলে।হোটেলের কর্মচারী।অশ্রু খানিলটা বিচলিত হয়।কর্মচারী বলল,
“ম্যাম আপনার কোনোকিছু প্রয়োজন হলে কাইন্ডলি জানাবেন ?স্যার যাওয়ার আগে বললেন আপনার যা যা প্রয়োজন হবে তার এসে খোঁজ করতে।”
অশ্রু দ্বিধা প্রাপ্ত হয়।ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আবরার ভাইয়া কোথায় গিয়েছেন?”
” বাইরে।”
“কোথায় গিয়েছেন তা বলেছেন?”
“স্যরি ম্যাম,তা বলেনি।”
“আর আসবে কখন সে ব্যাপারে?
“তাও বলেনি।যাওয়ার সময় শুধু বললেন আপনার খোঁজ নিতে।”
“ওহ।আচ্ছা আমার এখন কিছু প্রয়োজন নেই আপনি আসতে পারেন।”
“জ্বী,ম্যাম।”
অশ্রু দরজা লাগিয়ে আবারো বিছানায় এসে বসলো।আবরারের নাম্বারে আবার কল।কিন্তু তাও একই কথা বন্ধ, বন্ধ!আবরার যেখানেই যাক যাওয়ার আগে একবারতো বলা উচিত ছিল বাইরে যাচ্ছে তাতো করলো না।তারউপর নাম্বারটাও অফ।মাথায় ঝিনঝিন করতে থাকে আবরারের এরকম অবচেতন কাজ দেখে।
আলম-আলাউদ্দিন চেয়ারের উপর ধপ করে বসে পড়েন।মেয়ের লিখে যাওয়া চিঠিতে আবারো চোখ রাখেন।
“প্রিয় বাবা,জানি চিঠিটা পড়ার পর আমায় খুব গাল দিবে,কুলাঙ্গার বলবে।অসভ্য,বজ্জাত মেয়ে বলবে।যে কথা আমি তোমাদের সামনে দাড়িয়ে মুখ ফুঁটে বলতে পারিনি তা এখানে বলছি।তুমি এবং মা আমাকে বিপুল ভাইয়ার কাছে বিয়ে দিতে হেঁচড়াহেঁচড়ি করছো।এমনকি বিয়ের সব এরেন্জও ফেলেছো।তোমার মহলের কচিৎ বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়-স্বজনদেরও দাওয়াত দিয়েছো।যাকে নিয়ে এত আয়োজন সে তাকেই তোমরা বুঝতে চেষ্টা করোনি।তার পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছে বোঝার একটিবারও প্রয়োজন বোধ করোনি।আমি একটা মানুষ, কোনো পশুপাখি নই।আমার নিজেরও একটা পছন্দ আছে।অথচ তোমরা সব এড়িয়ে এতদিনে যাকে আমি নিজের ভাইয়ের সমতূল্য দেখেছি তোমরা তার সাথেই আমায় বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছো।কিন্তু তার সাথে আমার সংসারের বিষয়টা আমি ভাবতেও পারিনি বাবা।তাই তোমাদের ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি।প্লিজজ বাবা মন খারাপ করো না।তোমার মনমতো আমায় বকো তবে কখনো অভিশাপ দিও না।ভালো থেকো।
তোমার স্নেহের
অশ্রু
দুবার চিঠিটা পড়া শেষ।তারপরপ আলম আলাউদ্দিন ঝিমসে আছেন।নিজেকে কিছুতেই স্বাভাবিক করতে পারছেন না। মেয়ে এরকম একটা কাজ করে বসলো।সমাজের সামনে মুখ দেখাবেন কী করে বন্ধুমহল,আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাচ্ছিল্য কন্ঠে অবমাননা করবে।বলবে-ছিঃ ছিঃ মেয়ে বিয়ের আসর থেকে অন্যছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে।কেমন মেয়ে জন্ম দিলো রো বাবা শেষপর্যন্ত মা-বাবার চোখেমুখে চুনকালি দিল।ভাবতেই আলাউদ্দিনের মনে একটা চাপা রাগ ধেয়ে যায়।মেয়েটিতো একটিবার বলতো পারতো যে বাবা বিপুলকে আমার পছন্দ নয়।অন্যছেলেকে বিয়ে করবো তখনতো মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নাঁখোশ করতে পারতেন অথচ মেয়ে..!
পারুল বেগম ফ্লোরে উপর পা ছড়িয়ে বসে থেকে গম্ভীর মুখ করে বলেন,
“তোমাকে কতবার বলেছি মেয়ের একটিবার সম্মতি জানতে।আর এখন মেয়ে…! ”
অশ্রুর মামী পাশ থেকে বলে উঠেন,
“আপা,যাই বলেন আমার মন বলছে অশ্রুর অন্যকারো সাথে সম্পর্ক আছে।নাহলে এত রাত একা একটা মেয়ে বাসা থেকে বেরুবার সাহস পায় কিভাবে! তাছাড়া কালরাত আমাকে দেখে কেমন গোমরা গোমরা করে রাখলো।আগে যেমন মামী মামী বলে পুরো বাসা মাথায় তুলতো আর কাল আমাকে দেখে যেন বিষ মনে হলো!কত ভালো ভাবছি।ভদ্রতা দেখিয়ে মা-বাবার মান খেলো খাটাস মেয়ে,অসভ্য!”
“প্লিজ ভাবী,এটা বলবেন না।আমার মেয়ে যেখানেই থাকুক সেইফ থাকুক। জানি না কোথায় আছে কী করে কেমন আছে।”
“উলালে আছে আপা,উলালে!আপনি ওর সেইফের কথা ভাবছেন?গিয়া দেখেন অন্যছেলের সাথে ফূর্তি করছে!”
“কোহিনুর চুপ থাকো। অশ্রু কোথায় আছে কিভাবে আছে সেটাই মেইন ফ্যাক্র।মেয়ে আবেগে একটা ভুল করেই ফেললো তাই বলে আমরা এখন এসব বলে ওকে কটাক্ষ করতে পারি না।” (বিপুলের বাবা)
কোহিনুর স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কথা তোলার সাহস পায়নি।চুপসে যায়।
বিপুল ডাইনিং সোফার কর্ণারে গা ঘেঁষে বসে। মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবে।আজ তারজন্যেই অশ্রু এমনটি করতে বাধ্য হলো।সে’ত খুব ভালো করেই জানতো অশ্রু তাকে দুচোখেও দেখতে পারে না। তারপরও তাকে সিনক্রিয়েট করা উচিত হয়নি।তার যা ভালো লাগতো,যা পছন্দ হতো,যা নিজ থেকে চাইতো তা মেনে নিলে আজ এমনটা হতো না।ভালোবাসা কখনো একপাক্ষিকে হয়না!নিজের সুখের কথা ভেবে অন্যের সুখের মুহূর্তটা ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার মানে হয়না।
ভাবতে ভাবতে বিপুল কপাল চুলকাতে থাকে!
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫১
রোকসানা আক্তার
থালার মতো বড় লাল সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তের আকাশে ঢাকা পড়ে চারদিকে সাঁ সাঁ অন্ধকার নেমে আসে।কৃষ্ণচূড়া গাছের একটা ডালে দুটো কাক আপমনে কিছুক্ষণ”কা কা” শব্দ করে পশ্চিম দিকে উড়ে চলে যায়।মাঘের শেষ ফাগুনের আগমণ।মুহূর্তে একঝাঁক ফাগুনের হাওয়া এসে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোকে নেড়ে দেয়।রক্তরঙ্গা ফুলগুলো দুলতে দুলতে হেসে উঠে।এই অপ্রতিম দৃশ্যটা কোনো সাহিত্যকের চোখে আঁটকালে তিনি নাহয় একটা ছড়া বানিয়ে ফেলতেন,নাহয় একটা কবিতা।আপাতত এই দৃশ্যটি দেখার মতো কেউই ছিলনা।বস্তময় এই শহরে যে যার ব্যস্ততার তাগিদে নিজ কাজে মনোনিবেশ।কৃষ্ণচূড়ার তীর্যক বরাবর অদূরে দালানটির জানলা ঘেঁষে বসে আছে অশ্রু।তার চোখের দৃষ্টি মুঠোয় ফোনে নিমজ্জিত।মন তার কালবৈশাখীর মতো বেসামাল।দিকে দিকে বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠছে।আবেগের বশে চলে এসছে এখানে।এখন মন বলছে এসেও যেন অনেক বড় ভুল করে ফেললো।আতঙ্কিত মনটা নিয়ে সেই সকাল যাবৎ আবরারকে কল করছে,রবি অফিস বারংবার একই বার্তা দিচ্ছে-“আপনার ডায়াল কৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে।অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন অথবা আবার চেষ্টা করুন।ধন্যবাদ।”
বিরক্তিতে দু’চোখ বুঁজে আসে অশ্রুর।হাতে রাখে ফোনটা গোল টেবিলের উপর রাখে। তারপর চোখদুটো বাইরের দিকে গুঁজতেই চমকে যায়।চারপাশ অন্ধকার। সবুজ প্রকৃতি আঁবছা আঁধারে বঁধির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলো তা অশ্রু টেরই পায়নি। রাতের বিভোর স্বপ্নটা আরো নিদারুণ আতঙ্কে চেপে বসে আবরারের মোবাইল বন্ধ থাকায় এবং হোটেলে এখনো না ফেরায়। মুহূর্তে মুহূর্তে মনের অস্থিমজ্জায় অরুনকে নিয়ে একটা ভয় কাজ করে রাতের স্বপ্ন যদি বাস্তব হয়ে যায় ভেবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।তারপর বারান্দা থেকে বেরিয়ে নিচে যায়।হোটেল ম্যানেজার অশ্রুকে দেখামাত্রই হেসে উঠেন।বলেন,
“কোনো কিছুর প্রয়োজন অশ্রু?প্রয়োজন হলে ফোন করে বলতে তা তোমার রুমে পৌঁছে যেত।দরকার কি এত কষ্ট করে এখানে আসার!”
অশ্রু ভ্যাবাচ্যাকা খায়।
নিজেই প্রশ্ন করছে আর নিজেই উত্তর দিচ্ছে।তাহলে তার আর এখানে বলার থাকে কী!যাইহোক,এখন স্বাভাবিকতা বজায় রাখাই শ্রেয়।
ভেবেই অশ্রু ম্যানেজার কেবিনে এগিয়ে যায়।স্মিত মুখ করে বলল,
“নাহ আঙ্কেল,কিছুর প্রয়োজন পড়ে নি।”
“তাহলে?”
“আঙ্কেল,আবরার ভাইয়ার নাম্বারটা বন্ধ পাচ্ছি সেই সকাল থেকে তাই খুব টেনশন হচ্ছে।কোথায় গেছেন তাও জানি না।”
ম্যানেজার অশ্রুর সম্পূর্ণ কথাটা কানে নিলেও ব্যবহৃত একটা শব্দে হোঁচট খান।বলেন,
“ভাইয়া?বয়ফ্রেন্ডকে কেউ ভাই বলে ডাকে?!”
“স্যরি,আঙ্কেল?”
ভদ্রলোক খানিকটুকু হাসার চেষ্টা করে বলেন,
“ইয়ে মানে বলতে চাইলাম–সম্পর্কে আবরার তোমার কি হয়?”
অশ্রু থতমত খায়।আবরার এ লোককে তার ব্যাপারে বোধহয় কিছু বলেনি তাই জিজ্ঞেস করছে।এখন যেকোনো একটা কিছু বলে বুঝিয়ে দিলেই হলো।ভেবেই অশ্রু বলল,
আঙ্কেল আবরার ভাইয়া সম্পর্কে আমার কাজিন।”
“শুধুই কাজিন?”
“জ্বী,আঙ্কেল।”
“ওহ,আমিতো ভাবলাম তুমি আবরারের গার্লফ্রেন্ড!”
অশ্রু মনে মনে রাগ হয়।লোকটা বয়সে পাঁকা,কিন্তু বুদ্ধি হাঁটুর নিচে।এইজ ইকুয়েশন জানে না!কারো মাইন্ড গেইজ করে না।অশ্রুর রাগের ভুবনের মাঝেই লোকটি আগের মতোই হেসে আবার বলেন,
আচ্ছা,মা?তুমি রাগ করো নিতো আমার কথায়?আমি একটু রসিক টাইপের।যেখানে যাই সেথাই খাতির।”বলেই দাঁত বের করে হাসেন।
অশ্রুও হেসে দেয়।এবার বুঝলো লোকটা রসিক মানুষ।আর রসিক টাইপের মনুষ মনখোলা থাকে।এদের দিলে একছটাও কালি পড়ে না।অশ্রু বলল,
“ইট’স ওকে,আঙ্কেল।আমি তা প্রথমেই বুঝতে পেরেছি।”
“তা এখানেই যেহেতু চলে এসছো একটা অফারতো অবশ্যই করতে পারি।কোল্ড কফি নাকি হট কফি,কোনটা খাবা?”
“আঙ্কেল এখন কফি খাওয়ার একদম মুড নেই।যদি খেতাম তাহলে আমি নিজ থেকেই বলতাম।আসলে আঙ্কেল আবরার ভাইয়ার সন্ধান করতে এসেছি।ফোনটাও অফ..”
ওহ,হ্যাঁ,হ্যাঁ।দেখছো,কথার তালে কোথায় চলে আসলাম!আবরার কোথায় গিয়েছে তা জানো না তাইতো?”
“জ্বী।আপনি জানেন?
” নাহ।সকালে আবরারের সাথে আমার দেখা হয়নি।কর্মচারীদের বলে গিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে হবে।”
“বলে নি।কাউকে।”
“আচ্ছা,কল করে দেখি।”
“ফোনও বন্ধ!”
“তারপরও দেখি।ওয়েট।”
বলেই ম্যানেজার উনার হ্যান্ডফোন হাতে নেন।তারপর আবরারের নাম্বারে কল করেন।ওপাশ থেকে কোনোরকম রেসপন্স না পেয়ে বেজার মুখ করে মোবাইল নিচে নামিয়ে বলেন,
“ফোনটা বন্ধ পাচ্ছি!”
“জানতাম।”
“টেনশন নিও না।হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।চলে আসবে।”
অশ্রু শব্দ না করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রুমে চলে আসে।দেয়াল ঘড়িতে তাঁকায়।৬টা বেজে পাঁচ চল্লিশ মিনিট।মনকে কিছুতেই সায় দিতে পারছে না এখানে থাকবে নাকি চলে যাবে।আর যাবে কোথায় এখন?যদি নিজ বাসায়।সেই ভাবতেই গায়ের লোমগুলো শিরশির খাঁড়া!কোনমুখ নিয়ে বাসায় যাবে সবার সামনে?দেখলেই তাচ্ছিল্যে ভরা কথা শুনতে হবে।মা-বাবা কখনোই ক্ষমা করবেন না!আর আত্মীয় -স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশীতো আরো হুজুগে।একহাত উঁচিয়ে পতিতালয়ের নাম তুলতেও দ্বিধাবোধ করবে না!মুখে চুূকালি এমনিই দিয়ে আসছে,তারউপর হুটহাট উপস্থিতি মা-বাবার মুখ লুকানোর জায়গা থাকবে না!
ভাবতে ভাবতে অশ্রু অগাধ ভাবনায়ন ডুবতে থাকে।তারপরও নিজেকে যথেষ্ট আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।বিশ্বাস অরুন কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।বিশ্বাস অরুন হুট করে এসেই কাঁধে হাত রেখে বলবে,”প্রিয়তম,খুব ভয় পেয়েছিলে?এইতো আমি চলে এসছি।আর কোনো ভয় নেই!”
দরজায় মৃদু করাঘাত পড়ে।অশ্রুর ভাবনার জগৎ বিদেয় নেয়।অশ্রু দরজার দিকে এগিয়ে যায়।ফুটোয় তাকাতে কোনোকিছু বুঝে উঠতো পারলো না।মনে জড়োসড়ো একরাশ ভয় কাজ করে।সন্তপর্ণে ঢোক গিলে বলল,
“কে?”
ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না।চুপ থাকা দেখে অশ্রু আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কে কর্মচারী?”
ওপাশ থেকে সুক্ষ্ম গলায় ভেসে আসে,
“ম্যাম,আপনার নাস্তা। ”
এবার অশ্রুর ভয় কিছুটা কমে।তারপর দরজা খুলে দেয়।সামনে তাকাতেই অশ্রুর চোখদুটো ছানাবড়া!এই বুঝি হিমেল মাঘে ফাগুনের হাওয়া হো হো করে উঠলো।মনের রঞ্জনে নৃত্য করে অপেক্ষাকৃত সময়ের অবসান ঘটলো।
আবরার একটা ফিঁকে হাসি দিয়ে বলল,
“কী?কথা বললাম না অরুনকে আজ নিয়েই আসবো।কেমন সারপ্রাইজড হলা ভাবি?”
তৎক্ষনাৎ অশ্রু মাথা নুইয়ে আনে।লজ্জায় দু’গাল টকটকে লাল হয়ে যায়।এখন যে আবরার অরুনকে নিয়ে এসে হাজির হবে তা অশ্রুর মাথায়ই ছিলনা।অরুনের মুখে একফোঁড় চাহনি পড়তেই অশ্রুর সব ভয়-আতঙ্ক-অবিশ্বাস ধুলোবালিতে উড়ে সূদূরে চলে গেল।এমনকি আবরারের প্রতি সন্দেহটাও পানি হয়ে গেল।আবরার আবার গলা খেঁকারি টেনে বলল,
“তো আমি গেলাম।কথা বলো দুজন।”
অরুন অবাক নয়নে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“এইতো নিচে।”
“ওকে।নিচেই থাকিস।আর কোথাও যাস না।কাজ আছে অনেক।”
“ওকে অরু।”
“আচ্ছা।”
আবরার চলে যায়।অশ্রু তড়িঘড়ি পা ফেলে বিছানায় এসে গুটিসুটি হয়ে বসে।লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে অশ্রুর এই মুহূর্তে।এই মানুষটার একটু অস্তিত্বও যেন অশ্রু কেঁপে কেঁপে হয়রান!বুকের পালস রেট দ্রুত গতিতে উঠানামা করতে থাকে।আর ধকধকে শব্দ বলছে-অশ্রু লজ্জা রে লজ্জা!
ওহ এই মনও-না বুঝে না।সেও লজ্জা দেয়!চোখদুটোর পাতা ছোট্ট করে আনে অশ্রু।অরুন দরজা খানিক ঠেসতে ঠেসতে বলল,
“দরজা টাও অনেক শক্ত।শরীরের শক্তি একমণ ব্যয় করলেও লাভ হবে না।বলেই অরুন পেছন ফিরে।অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কষ্টটা হয়না অশ্রু?এমন চাপা দরজা লাগাতে?”
অশ্রু মুখটা অন্যদিক রেখেই টান টান গলায় উত্তর করে,
“ন-নাহ।পেরেছি।”
“আমি ছেলে হয়ো লাগাতে কষ্ট হয়েছে।আর তুমি মেয়ে পারবে বিশ্বাস হয়না।”
“নাহ নাহ পেরেছি।”
“পেরেছো ভালো কথা।তবে লাগাতে কষ্টতো কম হয়নি।ওই আবরার ব্যাটাকে মারবো এক ছক্কা।”
অরুন ভাবছিলো এ কথায় অশ্রু হেসে দিবে।কিন্তু তা করেনি।তবে লজ্জায় যে লজ্জাবতী মুখ উন্মাদ করে রেখেছে তা বুঝতে অরুনের বেগ পেতে হয়নি।নিজমনে কুটিল হেসেই বলল,
“অশ্রু?তোমাদের বাসায় যাবো!”
অশ্রুর শুকনো কাশি উঠে।কুন কাশিতে গাল,চোখ অশ্রুর লাল হয়ে যায়।অরুন তাড়াতাড়ি টেবিলে রাখা জগ থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে অশ্রুর হাতে দেয়।অশ্রু কাঁপা কাঁপা হাতে অরুনের থেকে গ্লাস নেয়।তা দেখে অরুন বলল,
“এত লজ্জা পেলে হবে?” মুখে হাসি বজায় রেখে বলল।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫২
রোকসানা আক্তার
অশ্রু নিঃশব্দে পুরো পানি ঢকঢক উৎসারক করে। গ্লাস রাখতে টেবিল ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই অরুন নিজেই অশ্রুর হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর রাখে।তারপর মেরুদণ্ড সোঁজা করে
দাঁড়িয়ে দু’হাত দুদিকে ভাঁজ করে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ে।অশ্রু চুপচাপ মাথানিচু করে বসে আছে বিছানায়।অশ্রুর চুপচাপ থাকা দেখে অরুনও কিছুটা সময় নিজেকে সামলে রাখে।মিনিট একের মতো বিরাজ থাকে দুজনের নিরবতা। অতঃপর অরুন নিজেই অত্যন্ত নরম এবং কাহিল গলায় বলল,
“কেমন আছো, অশ্রু?”
অশ্রু মাথা তুলে মায়াবী নয়নে অরুনের চোখে দৃষ্টিপাত করে।প্রগাঢ় অনুভূতির দু’নয়ন দিয়ে অরুনের কষ্টগুলো পরখ করে।এ’কদিনে তার কতটা না পরিবর্তন। চোখদুটো তীব্র লাল।চুলগুলো উসকোখুসকো চারপাশ ছড়িয়ে।গালের দাঁড়ি গুলো দেড় ইঞ্চি করে বেড়েছে।পড়নের টি-শার্ট,প্যান্ট মলাটে মলাটে।হাতের নখ,পায়ের নখও অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।গায়ের ফর্সা রংটা বাদামী রং ধারণ করেছে।সবকিছু অস্বাভাবিকতার মাঝেও চোখ-মুখে কতই না স্নিগ্ধ!
অশ্রুর দু’চোখ টলমলে হয়ে আসে।চোখের পানি তার বাঁধ ভেঙ্গে এক্ষুনি যেন গড়াগড়ি খাবে।সব প্রতিকূল বেসামাল হবে।উপস্থিতি চোখের পানি অরুনকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। ভাববে, মেয়েটা আমার জন্যে নির্ঘাত পাগল।এমন পাগল কেউ কারো জন্যে হয়?ভেবেই অশ্রু তরহর আবার মাথা নুইয়ে আনে এবং কন্ঠস্বর ছোট করে বলল,
“ভালো।”
অরুন মুখে একটা মৃদু হাসি ফুঁটিয়ে দু’হাত ছেড়ে দেয়।বলল,
“যদি আগে জানতাম তুমি আসবে তাহলে আবরার আগেই জেল থেকে ছাড়ানোর একটা ব্যবস্থা করতো।যেই মুহূর্তে আবরার বলল সেই মুহূর্তে না কিছু করার ছিল, না হাইকোর্টে জাবিনের দরখাস্ত করতে সময় পেলো।সবটাই তখন মাথার উপর দিয়ে গেলো।ভাগ্যিস তুমি আমায় বিশ্বাস করে আমার মনের সকল অনুতপ্ততাকে ধুয়েমুছে এতদূর আসলে।আজ তোমাকে স্বচোখে দেখতে পেয়ে এমুহূর্তের আনন্দ বুঝাতে অক্ষম আমি!এই ভুবন জুড়ানো আনন্দের জন্যে আবরারের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার ভালোবাসাকে আমার কাছে এনে দিল!”
অশ্রু মাথা নুইয়ে আছে। কথা বলছে না।অরুন বলল,
“অশ্রু?এই অশ্রু?”
“হু।”
“এভাবে মাথা নুইয়ে রাখলে আমি তোমার সাথে কথা বলবো কিভাবে?”
“আপনি বলুন আমি শুনি!”
“এইতো লজ্জা! এত লজ্জা রাখলে হবে?এই মেয়ে মাথা উঠাও?”
“য়ু হু!”
“উঠাবে না?”
“না উঠালে?”
“বেলকনিতে গিয়ে হু হু কান্না করে দিব!যখন কাঁদতে কাঁদতে হয়রান হবো তখন কেউ এসে জিজ্ঞেস করলে বলবো, এই মেয়েটা আমার হৃদয়টাকে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ করেছে!এরজন্যে আমি মামলা করবো,হু!”
আবরারের কথায় অশ্রু মাথা উঁচিয়ে খিলখিল হেসে উঠে। অরুন সেই ফুটন্ত হাসির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃঢ় একটা শ্বাস নেয়।আবার বলল,
“এই মেয়ে তোমার পোঁকা!দাঁত ব্রাশ করো না কখনো?”
অশ্রু আরো বেশি হাসতে থাকে।অরুন কুটিল হেসে বলল,
“এই দ্যাখো মেয়েটা ছোট্ট বাচ্চাদের মতো কিভাবে হাসছে!”
অশ্রুর হো হো হাসির আওয়াজ এবার পুরো রুমে ছড়িয়ে যায়।হাসতে হাসতে যেন এখুনি লুতুপুুতু খাবে এমন অবস্থা!তারপর অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“প্লিজজ আর হাসাবেন না!আই’ম সো টায়ার্ড ফর ইউর জোকস!”
“ওকে।তো তুমি কিছু বলো।”
“আমি আর কি বলবো..।তবে আবরার ভাইয়ার নামে একটা অভিযোগ আছে।”
“কেমন অভিযোগ? ”
বলেই অরুন মনে মনে খুশি হয়।যাক এবার মেয়েটার মনের জড়তা একটু হলেও কমলো।
“আজ সকালে হোটেল থেকে বেরুবার সময় উনি আমায় নক করে যায়নি। তারউপর সারাটি দিন ফোন অফ ছিল!জানেন?কতটা চিন্তিত ছিলাম!
“বুঝেতে পেরেছি অশ্রু।আসলে,ও কাল আসার সময় সাথে করে চার্জার নিয়ে আসেনি।যতটুকু চার্জ ছিল তা দিয়ে রাতে কোনোমতে কেটেছে।সকালে বাবা কল করে খুব তাগাদা দেয় হাইকোর্টে আসতে।উনি এবং মহিবুর আঙ্কেল হাইহোর্টে অপেক্ষা করছেন।তাড়াহুড়ো তে বেরিয়ে ফোনটা আর চার্জ দেওয়াও হয়ে উঠেনি কোনো সার্ভেন্টের চার্জার দিয়ে।ফলে, তোমাকেও বলার সময় পায়নি,তারউপর তুমিও নাকি ঘুমে ছিলে।তাই এক্সট্রা ডিস্টার্ব করেনি।হাইকোর্টে হলো আবার কত ঝামেলা!এই সাক্ষ্যের পর সাক্ষ্য!বেশির ভাগ মানুষই আমার হয়ে সাক্ষ্য দেয়!বিষয়টিতে বেশ খুশি হলাম।ভালোবাসবো আজীবন ওই শীর্ণ দেহের জীর্ণমুখের মানুষগুলোকে।আজীবন পাশে থাকবো তাদের ভালোবাসবো প্রাণভরে। হাইকোর্ট মোটামেুটি আমার উপর বিরক্তি হলেও তাদের জন্যে প্রত্যুত্তর হয়নি।মেনে নেয় সব।তাছাড়া,আমার বাবার অবদানও কম ছিলনা অশ্রু।বড় বড় উকিল নিয়ে হাজির হয়েছে।আমার মন বলছে আমার বাবা এই কটা দিন ঠিকমতো ঘুমাননি।কতটা রাত ইনা নির্ঘুম কেটেছে। আজ চোখগুলা বেশ ফুলা ফুলা ছিল।চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে।চোখের সাদা অংশ টকটকে লাল ছিল।আর আবরার তোমায় না বলে এসে পরায় কতইনা চিন্তা করেছিল।আমি কোর্ট থেকে বেরবার পরই টুপ করে আমার কানের কাছে মুখ গুঁজে তোমার কথা বলতে বলতে মুখটা কালো করে ফেলে।বলে,অরুন যে করেই হোক চল আগে অশ্রুর কাছে যাই।ও একা।বা বলে এসছি
পরে আমি বাবাকে কিছু কেনাকাটা করবো বলে বুঝিয়ে এখানে চলে আসি।সত্যিই অশ্রু আবরারের কোনো দোষ ছিলনা।প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না। ”
“আরেহ এভাবে বলছেন কেন!আমি কিছু মনে করিনি! আমি তখনি গেইজ করি কোনো প্রবলেম হয়েছে হয়তো!”
“থ্যাংকস অশ্রু বুঝার জন্যে।”
“থ্যাংকস দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
অরুন ফিঁকে হাসি দেয়।তারপর বলল,
“আচ্ছা।আর অশ্রু আমার একটা কথা রাখবে?”
“কী কথা?”
” তোমাকে তোমার বাসায় যেতে হবে!”
অশ্রু অবাক নয়নে অরুনের দিকে দৃষ্টিপাত করে।বলল,
“বাসায় যাবো মানে!!!”
“হুম,বাসায় যাবে তোমার ভালোর জন্যে!”
“আ-মা-র ভা-লো-র জ-ন্যে মানে?কাঁপা গলায়!
” হুম তোমার ভালোর জন্যে।এই সিচুয়েশনে তোমায় বাসায় ফেরাটা একান্ত প্রয়োজন। ”
ব-সা-য় কে-ন?এসব কি বলছেন আপনি?আমিতো বাসায় যেতে এখানে আসিনি!”ঝাঁঝ গলায় বলে উঠলো অশ্রু।
অরুন হেসে দেয়।অশ্রুর প্রচন্ড রাগ উঠে যায়।টপটপ দু’নয়ন জল বেয়ে পড়তে থাকে।তা দেখে অরুনের মনটা বিবৎস হয়ে যায়।বলল,
“এই পাগলী?কাঁদছো কেন?আরেহ আমি কি এমন বললাম।”
“স্টপ!কথা বলবেন না আপনি!আপনাকে বিশ্বাস করে আমায় এখানে আসাটাই চরম ভুল হয়েছে।আপনার মতো ছেলেরা একটা মেয়ের জীবনকে নিয়ে এমন যে লুতুপুতু খেলবে তা জেনেও বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়েছি।বাসায় ফিরলে মা-বাবা এখন আমায় ক্ষমা করবেন! ইয়া আল্লাহ তুমিই বলো!এই কেমন ঘূর্ণিপাকে ফেললে আমায়!কাকে ভালোবাসতে এই হৃদয়টা খোলাসা করলে?কাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করালে..!”
অশ্রুর এমন ফুঁপানো কান্নার কথার বেগ বেশিক্ষণ স্থায়ী পায়নি।তার আগেই অরুন অশ্রুর পাশে বসে তার দু’হাত শক্ত করে ধরে মুঠিতে নিয়ে বলল,
“পাগল হয়েছো তুমি?মুখে যা আসছে তাই বলছো!আমি বলতে চাইলাম কি আর তুমি বুঝলে কি!”
“হাত ছাড়ুন আমার।আপনি ঠকবাক,প্রতারক।আমার স্বপ্ন কখনো মিথ্যে হতে পারে না।”
অরুনের রাগ উঠে যায়।মেয়েটির হঠাৎ হলো কি!সম্পূর্ণ কথার অর্থ না বুঝে এ কেমন উদ্ভট বিহেভ করছে।আবারে শান্ত গলায় বলল,
“আহা,আগে বুঝবে তো আমার কথা!”
“লজ্জা নেই আপনার?হাত ধরে আছেন কেন?বললাম না হাত ছাড়তেন!”
এবার অরুন নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলো না।ক্রোধানলে ফেঁটে উঠলো তার মন,হৃদয়,প্রাণ!আগুনের মতো বারুদ ছুটলো অশ্রুর দিকে।খুবই উঁচু গলায় বলল,
“ইউ স্টপ!”
পুরো রুমটা যেন কেঁপে উঠলো।সাথে অশ্রুর আত্মাও।
এই প্রথম সে অরুনের রাগান্বিত চোখ দেখতে পেল।যে চোখে ক্রোধানলের আগুন!পুড়তে পুড়তে মুহূর্তে দগ্ধ করে দেবে।ভয়ে অশ্রুর গলার পানি শুকিয়ে যায়।সন্তপর্ণে একটা ঢোক গিলে তড়িঘড়ি মাথা নিচু করে আনে।অশ্রুর চুপ হয়ে যাওয়া অরুন অনুভব করে।সে বুঝতে পারলো সে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।এটা করা তার মোটেও উচিত হয়নি।
মুহূর্তে নিজের ক্ষিপ্রতাকে মাটি চাপা দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বলল,
“আই’ম স্যরি অশ্রু।আমি কি বলতে চেয়েছি আসলে তুমি তা বুঝতে পারো নি অথবা বোঝার চেষ্ট করোনি।
বলেই বড় একটা শ্বাস ছাড়ে।তারপর আবার বলল,
” এই মুহূর্তে তোমায় আমি বিয়ে করে আমাদের বাড়ি সবার সামনে নিয়ে যেতে পারি। আমার বাবা প্রথম অবস্থায় নারাজ হলেও পরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বলতে সময় নিবেন না।আর আমার ফ্যামিলিতে আমার বাবা মানেই সব।বাবা যেখানে হ্যাঁ বলবে সেখানে কোনো প্রতিদ্বন্ধী না বলার সাহস পাবে না।দেখলেই তো রুমকি ভাবীকে কিভাবে মেনে নিলেন।তাই তোমার এবং আমার সম্পর্ক আমার ফ্যামিলির কারো কাছে সংঘর্ষ বাঁধবে না আই হোপ!
এবার যেটা বলতে চেয়েছি তা হলো তোমার বাবা-মা।অশ্রু প্রতি পিতা-মাতা তার সন্তানদের খুব ভালোবাসেন।তোমার বাবা-মাও তার কম নন। তাদের একসময় স্বপ্ন ছিল তোমাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবে।বড় অনুষ্ঠান করবে।মহল্লার মানুষজন,আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে ভোজন করিয়ে সবাই মিলে তোমাকে কোনো ছেলের হাতে তুলে দিবে।কিন্তু এখন সেই আশাটা উনাদের গুড়ে বালি।মেয়ে পালিয়ে গেছে। তারউপর পাড়া-প্রতিবেশীদের খোঁটা কথা শুনতে হবে নিত্যদিন!চোখবুঁজে ক’দিন সহ্য করবে?একদিন,মাস,বছর!অতঃপর এমন অনেক পিতা-মাতা মানুষের মুখের কূলে না থাকতে পেরে আত্মহত্যাও করে ফেলে…..”
কথার মাঝেই অশ্রু বলে উঠলো,
“তাহলে আপনি বলতে চাইছেন আমি আমাদের বাসায় এখন ফিরে গিয়ে বিপুলকে বিয়ে করে নি?
” নাহ,অশ্রু সেরকম কিছু নয়।আগে তুমি আমার সম্পূর্ণ কথা শোনো।ওহ কি যেন বললাম?হ্যাঁ আত্মহত্যা।এমন হাজারো পিতা-মাতা আছেন যারা সন্তানদের অপদস্ত কর্মে এমনটি করতে বাধ্য হয়েছেন।আমরা সেই পথের পথিক হতে যাবো না।আমি চাচ্ছি তুমি বাসায় ফিরে আমার কথা বলবে।বলবে তুমি আমায় ভালোবাসো। বিপুলকে স্বামী হিসেবে কখনো ভাবোই নি।ভাইয়া চোখে দেখে এসেছো।আমার ফ্যামিলি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে আর তা কালই!তাছাড়া,তুমি পালিয়ে তোমার বান্ধবীদের বাসায় গিয়েছো বিপুলকে বিয়ে করবে না তাই!বিয়েটা ক্যান্সেল করতে এরকমটি করতে বাধ্য হয়েছো।এসব বলবে।
মা-বাবার এমনিতে এখন মন খারাপ তোমাকে ফিরে আসতে দেখলে প্রাণ ফিরে পাবেন উনারা।বিলিভ মি অশ্রু!”
চলবে…..
(রাত বেশি হয়ে গেছে তাই সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলাম না।)
চলবে…
চলবে…