একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৪৭+৪৮+৪৯

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪৭
রোকসানা আক্তার

ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ছুই ছুই তারপরও বিপুল চোখের পাতা এক করতে পারছে না।বুকের মাঝখানটায় চিন্তার ভীষণ চাট বুনতেছে।।আজ স্মৃতিকে এ বাড়ি দেখবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।স্মৃতি এ বাড়িতে কেন এসছে তার কারণ বুঝতে পারছে না বা অশ্রু স্মৃতিকে কীভাবে চেনে তাও জানে না।এধরনের নানান প্রশ্ন মাথায় প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে কিছুতে তার উত্তর মিলছে না।তবে তা নিয়ে বিপুলের মোটেও ভ্রুকুটি নেই।ওসব ভাবনার থেকে আরো একটি ভাবনা মনের অন্তরালে ঢুকরে ঢুকরে খাচ্ছে তাকে এমুহূর্তে। তা হলো অশ্রু যদি কোনোভাবে তার এবং স্মৃতির রিলেশনের কথা জেনে যায় তখন বিষয়টা কোথায় গিয়ে পাকড়া হবে বুঝতে পারছে না।বিপুল এটা কখনো অপারগ যেতে পারবে না, সে কখনো সম্পর্কে জড়ায়নি।হ্যাঁ খুব জড়িয়েছিল স্মৃতির সাথে কোনো একসময়।কী গভীর ছিল তাদের ভালোবাসা।বলা যায় জোড়া শালিক।ঢাবিতে পরিক্ষা দিতে যেয়ে সিট নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে যখন বিপুল হয়রান তখন একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল,আপনার রোলটা বলুন আমি খুঁজে দেখতেছি!ব্যক্তির কথনীতে চোখ রাখে বিপুল।কোকড়া চুলগুলো বাদামী কালার করা। গায়ে জিন্স টপস এবং জিন্স প্যান্ট।পায়ে হাই হিল শো।অনেকটা স্টাইলিশ টাইপের মেয়ে।
এরকম মেয়ে বিপুলকে সাহায্য করার প্রপোজাল করলো তাতে তার খুশি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।তৎক্ষণাৎ দাঁত কেলিয়ে হেঁসে দিয়ে রোল বলল।রোলটা শুনে স্মৃতি আকস্মিক।কারণ এই রোলটাই তার বেঞ্চ সাইডে।অর্থাৎ দুজনেরই একই বেঞ্চে সিট পড়েছে।ব্যাপারটায় যতটা না খুশি স্মৃতি তারচেয়েও বেশি খুশি বিপুল।এতে দুজনের ভাবটা আরো জমে উঠে।পরিক্ষার শেষ পর্বে দুজন-দুজনের নাম্বার আদান-প্রদান করে।পরে বিপুল চট্রগ্রাম ব্যাক করলে শুরু হয় ফোনালাপ।বিপুল ভাবলো ভর্তি এক্সামের প্যারা শেষ। এখন নতুন ভার্সিটির সাথে লাইফে নতুন কাউকে ইনভলভ করলল লাইফটা আরো সেটেল।যদি তাই না হয় তাহলে শালা প্যারালাজড।স্মৃতি থাকুক মনের বাহিরে, আর অশ্রু হৃদয়ে।অশ্রুকে যতদিন না মনের কথা খুলে না বলতে পারবে ততদিন স্মৃতির সাথেই চলুক প্রেমালাপ ।এভাবে বিপুলের শুরু হয় লাভ নামের টাইম পাসের টার্নিং পয়েন্ট।প্রেমটা তাদের চলতে চলতে একসময় তরলে রূপ নয়।দিনরাত টেক্সট, ফোনালাপ চলতেই থাকে।।তবে এসব কিছুর মাঝে স্মৃতির অন্য কিছু চাহিদা ছিল।সে চাইতো বিপুল তারকাছে বসে বসপ দিনরাত আড্ডা দিতে।সময়-অসময় রেস্টুরেন্টে যেয়ে দুজন-দুজনের হাতের উপর হাত রেখে দু-চারটা কথা বলতে।ভালোলাগা, মন্দলাগা ফেইস টু ফেইস অনুধাবন করতে।এই ফোনলাপ,চেটিং করা এসব ধাবাং মার্কা প্রেম এখনকার যুগে চলে না।এসব প্রেম সেই চিঠি আদান-প্রদান যুগে ছিল।বর্তমানে প্রেমিক-প্রেমিকারা অনেক আপডেট।এভাবে দূরে দূরে রিলেশন হয়না।বোর হয়ে যাচ্ছিল স্মৃতি।বিপুল খুব করে স্মৃতির অভাববোধ চাহিদাগুলো বুঝতো তবে সম্ভব ছিলনা তারপক্ষে।কারণ স্মৃতি ঢাকা আর সে চট্রগ্রাম। এতদূর থেকে দুজন মানব-মানবী কীভাবে গভীর প্রেমে লিপ্ত হবে।হাউ পসিবল ইট ইজ!তাছাড়া,সে তো স্মৃতিকে চায়না।তাহলে তার চাহিদাগুলো পূরণ করতে মরিয়া হবার কিছু নেই।সেও মনে মনে চাইতো,ভাই তুই যা।ভালোই টাইম পাস করলাম এ ক’দিনে।শিক্ষাও বহুৎ হইলো।এবার মুক্তি চাই।তুইও আমায় মুক্তি দে এবং আমিও দিই!
অতঃপর রিলেশনের ছ’মাসের মাথায় স্মৃতি নিজ থেকেই ব্রেকাপ করার কথা তুলে।ডিসমিস হয় দু’দুটো প্রেম।কল,মেসেঞ্জার, টুইটার,ফেসবুক,ইন্সট্রাগ্রাম সবকিছু থেকে ব্লকড উভয় উভয়েরই।।
আর সেই আজ দুজনের দেখা হলো। বিপুলের প্রচন্ড রাগ হতে থাকে স্মৃতির প্রতি।তার বিয়ের সময়ই বা কেন স্মৃতি টুপ করে দেখা করতে এলো তাও তার অতি প্রিয় প্রিয়সীর সামনে!তার প্রিয়সী এসবের ছিটেফোঁটাও শুনে বর্বাদ হবে স্বপ্ন।পাবে না প্রিয়সীকে।বুকে প্রচন্ড রকম চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।বাবা-মা যত তাড়াতাড়ি আসবে বিয়েটা তত তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যাবে।দেরী হলে সব শেষ!
বিপুলের কল বাঁজে।অগাধ যন্ত্রণার মাঝে নাম্বার সিন না করে কল রিসিভ করে।ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
“হাই বিপুল,কেমন কাটছে দিনকাল?”
এহেন কথা স্মৃতি ছাড়া কেউই বলবে না।তাড়াতাড়ি মোবাইল সামনে আনে।সত্যিই স্মৃতি।কোনো ঝামেলা পাকানোর জন্যে কল দেয়নি তো!ভেবেই ছোট একটা ঢোক গিলে বিপুল।তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“যেমন চলার তেমন চলে।তো হঠাৎ কল করার কারণ?”
“অশ্রু সম্পর্কে আপনার কি?”
“তা দিয়ে তুমি কি করবে?”
“আরেহ বলুন না।শুনি।”
“স্যরি।”
“ওকে,না বললে আমি অশ্রুর থেকেই শুনে নিব।”
বিষম খায় বিপুল।শুনতে গিয়ে যদি অন্যকিছু বলে ফেলে এ!নাহ নাহ তা কিছুতে হতে দেওয়া যাবে না।তার আগেই অশ্রুকে এর থেকে সরাতে হবে!ভেবেই বিপুল গলা ঝাঁড়ে।গলার স্বর শক্ত করে বলল,
“ও আমার কাজিন।প্রায় দু’দিন আগে আমাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে।বিয়েটা যৌথ ফ্যামিলি সম্মেত।আর কিছু জানবে?”
“ম-মানে!সত্যিই অশ্রুর সাথে আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”
“হু।তবে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ। রাখবে প্লিজজ?”
“জ্বী,বলুন!”
“তুমি অতীতে আমার প্রেমিকা ছিলে।এখন প্রাক্তন। জানোইতো বউরা প্রাক্তনের কথা শুনলে মুখটা কেমন গুমরে যায়।বউ সন্দেহ করে।সন্দেহ করে ঝগড়া বাঁধে।তারপর সংসারে নেমে আসে অশান্তির ছায়া!তাই প্লিজজ তোমার সাথে আমার যে রিলেশন ছিল তা অশ্রুকে বলো না।তাছাড়া,ব্রেকাপটা আমাদের মিউচুয়ালি ছিল।এতে তোমার অথবা আমার কারোই মন ক্ষুন্ন হবার কথা নয়!”
স্মৃতি হেঁসে দেয়।হাসি থামিয়ে বলল,
“ওহ এই ব্যাপার?আরেহ এত চাপ নেওয়ার কিছু নেই।আই’ম ফ্রাঙ্ক দ্যাট ইউ নো।”
“ফ্রাঙ্ক ভালো।আবার ওভার ফ্রাঙ্ক হয়ে অশ্রুকে মুখ ফসকে বলে দিলে তখনতো এই প্রাক্তনের সংসারে আগুন লাগাবা!”
“ছ’মাস রিলেশন করে এই স্মৃতি একটুও বিশ্বাস হয়নি?”
“হয় হয় এবং ভবিষ্যৎ-এ ও হবে!”
“আচ্ছা।যাইহোক বিয়েটা হলো একটিবারও তো জানালেন না।অশ্রুই বা কেমন সেও একটু জানালো না।”
” আসলে চাপে পড়ে তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলেছিতো তাই আর কি কাউকেই জানানো হয়নি।”
“চাপ!কিসের চাপ!?”
“ওই যে ভুট্টো পোদ্দার এবং তার ছেলে হুমকি দিয়েছিল অশ্রুকে তুলে নিয়ে চ্যাংদোলা করবে তাই আর কি!”
“বুঝলাম না ঠিক!”
“মোবাইলে সবকিছু স্পষ্ট বলা যাবে না।একদিন সরাসরি সব বলবো।তা তোমার সাথে অশ্রুর এমন গভীর সম্পর্ক হলো কিভাবে?”
“হলো আর কি।”
“স্যরি?”
“একদিন সরাসরি দেখা হোক তারপর বলবো।”
“আমার কথা রিপিট!”
স্মৃতি হেসে দেয়।বিপুল বলল,
“আমার যে বিয়ে হলো খবরটা তোমার জিলাস ফিল হয়নি একটুও?”
“কেন বলুনতো?”
“নাহ মানে মানুষ যখন রিলেশন করে পরে তাদের যদি ব্রেকাপ হয় তখন তারা আগের স্মৃতিগুলো মনে করে।তা ভেবে ভেবে খুব খুব কষ্ট পায়।তোমার কথার মাঝে তেমন কিছুই দেখলাম না।”
“ব্রেকাপটা করলাম আমি।এখানে কষ্ট পাবো কেন?যাইহোক এমনিতেই আমার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।ভালো থাকবেন।ঘুমাবো।বায়!”
স্মৃতি কেটে দেয়।বিপুল আরেকটা বিষম খায়।সময় খারাপ যাচ্ছে মানে কী,হ্যাঁ?তবে আমার বিয়ের কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে নাকি?মুখে যাই বলুক আসলতো অন্তর যেটার ভাষা আমরা বুঝি না। তবে তার হাবভাবে বুঝে নিতে হয়।ইশ্ কষ্টমনে সবকিছু যদি আবার অশ্রুকে বলে দিলো!নাহ নাহ অশ্রুকে এর থেকে দূরে রাখতে হবে সেটা যেকোনো ফন্দি এঁটে হলেও!

পরদিন মধ্যাহ্নে বিপুল স্মৃতিকে নিয়ে একটা ফন্দি এঁটে অশ্রুর রুমে প্রবেশ করে।অশ্রু উপন্যাসের কি একটা সংলাপ খুঁজতে পাতা টুকিটাকি করছে।বিপুল টেবিলের কাছে যেয়ে গলায় খেঁকারি টেনে বলল,
“কী ম্যাডাম এ অবেলায়তেও উপন্যাস পড়ায় খুব বিজি?”
অশ্রু কথার জবাব না দিয়ে পাতা উলটচ্ছে। অশ্রুর চুপ থাকা দেখে বিপুল আবার বলল,
“ম্যাডাম রাগ আমার উপর?যাইহোক রাগ করলে প্লিজজ এখনকার জন্যে একটু প্রশমিত করুন।পরে আবার বাড়িয়ে দিয়েন।”
অশ্রু এবার বিরক্তি মুখে মাথা তুলে তাকায়।বলল,
“দেখছেন ইতো বিজি।তাও এত বকবক করছেন কেন?”
“আচ্ছা করবো না।তবে একটা কথা বলতে এসছি।শেষ করেই চলে যাবো ব্যাস।আর জ্বালাতন করবো না।”
“বলুন।”
“স্মৃতি যে কাল বাসা এসেছে সে কিন্তু খুবই খারাপ মেয়ে!একশো ছেলের সাথে ডেটিং ওর।ওর থেকে দূরে দূরে থাকিস।ভালো মানুষ খারাপ মানুষের সাথে চললে সেও খারাপ হয়ে যায়।পরে ফ্যামিলির কাঁধে চেপে বসে এসবের দায়। ওই মেয়ে আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করেছে।কাল যখন দেখলাম মনে হলো কোথায় যেন দেখেছি তখন মনে করতে পারেনি।তাই তোকে বলতে পারিনি।পরে রুমে গিয়ে মনে পড়লো এর পিক তো স্বপনের মোবাইলে দেখলাম।খুবই বাঁজে এ!তাই কাইন্ডলি রিকুয়েষ্ট ওর ত্রিসীমানায় পা দিবি না!”
অশ্রু সড়াৎ করে বই অফ করে দাঁড়িয়ে যায়।বলল,
“আমাকে জ্ঞান দিতে তোমায় মাইনে রাখি নি।”
বলেই চলে যায় ডাইনিং এ!

বিকেলের ঝলমলে আলো অশ্রু বেলকনির চেয়ারে বসে বসে দেখছে।কি মিষ্টি রোদ ঝিকঝিক করে নাচছে গাছের পাতা,ডালে।আবার বালুতেও।দূর থেকে এক-দুটো পাখির কিচিরমিচির আওয়াজও ভেসে আসছে কী সুরেলা তাদের ধ্বনি।প্রকৃতির এত নিঁখুত আনন্দেও অশ্রুর মনটা বিষেলা।
আরতো মাত্র একরাত।এই একরাত পার হলেই কাল বিপুল গর্দভের মতো ছেলের বউ হতে হবে তাকে। সে জীবিত থাকতে কিভাবে তা চোখবুঁজে মেনে নিবে।মেনে নেওয়াটা কি খুবই সহজ?পারবে তার সামনে বধূ সেঁজে চোখতুলে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিতে? তার হাতে হাত রেখে কথা বলতে?তার বলা প্রতিটি বাক্য পালন করতে?সম্ভব নয়।মোটেও সম্ভব নয়!তার আগে এই জীবনটা শেষ করে দেওয়াই ভালো।রাখবে কার জন্যে?কার জন্যে বাঁচবে?ইচ্ছেতো ছিল শেষ জীবনটুকু মা-বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁটিয়ে দিবে।অথচ আজ সেই মা-বাবাই আজ গলা উঁচিয়ে বলল,তোর ইচ্ছা-অনিচ্ছা দিয়ে কি করবি আমরা যা বলবো তাই হবে।তোরজন্যে যেটা খারাপ হবে সেটা আমরা কখনোই করবো না।
কিন্তু মা-বাবা?আমি যে বড্ড ব্যর্থ মানবী যে তোমাদের বুঝাতে অক্ষম বিপুলকে আমার পছন্দ নয়।যাকে ভাইয়ার মতো এতদিনে ভেবে এসছি তাকে স্বামীর চোখে কিভাবে দেখবো!মরে যাবো, সত্যি মরে যাবো!দু’ফুটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে অশ্রুর।
বিছানার উপর মোবাইল বাঁজে।অশ্রু সেদিকে তাকায়।ভাবে যদি আবরার ভাই কল করলো?ভেবেই ঘটাং দাড়িয়ে তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নেয়।মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে সত্যিই আবরার কল করেছে।খুশিতে অশ্রুর দু’চোখ ছলছল করে উঠলো।উচ্ছাসিত গলায় বলল,
“হ্যালো,ভাইয়া?কেমন আছেন?”
“ভালো আপু,একটা কথা বলতাম।”কথা বলার ধরন ছিল খুবই গুমোট।
“জ্বী,বলুন?”
“আগে বলুন সত্য কথা বলবেন?”
“আমাকে সেরকম মনে হয় ভাইয়া?আপনি বলুন।”
“বিপুল নামে আপনার একজন কাজিন আছে,রাইট?”
“জ্বী।কিন্তু তার কথা কেন?”
“উনার সাথে আপনার বিয়ে হয়েছে?”
কথাটি শুনামাত্রই অশ্রুর টপটপ চোখের পানি বেয়ে পড়তে থাকে।একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪৮
রোকসানা আক্তার

“বিয়ে ঠিক হওয়া” অথবা “বিয়ে হয়ে যাওয়া” দুটো কথার মাঝে তফাৎ পার্থক্য।বিপুলের সাথে বিয়ে হোক বা না হোক সেটা আবরারের জানার কথা নয়।আবরার কাল মন খারাপের কথা জিজ্ঞেস করলে অশ্রু নিজেই তো ঢোক গিলে কথার মোড় ঘুরে ফেলে।আর আজ হুড়মুড় সেই মন খারাপের কথাটিই আবরার জানান দিলো!তবে কথা হলো বিপুলের ব্যাপারটা সে জানলো কিভাবে! সংগোপনে কোনো গোয়েন্দা এমন কারসাজি করছে নাতো?শুনতে হবে ইনি এসব জানলেন কিভাবে!ভাবনা শেষ করেই অশ্রু আবরারকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“ভাইয়া, আপনি এসব জানলেন কিভাবে?”
“আপু তাহলে সত্যিই তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?!!”
“আগে আমার উত্তর দিন।তারপর আমি উত্তর দিচ্ছি।”
আবরার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“স্মৃতি বলেছে আপু!”
কথাটি শুনার সাথে সাথে তার বুকের মাঝখানটা ঝনঝন করে উঠে।স্মৃতি এমন আগ বাড়িয়ে কথা বললো কীভাবে! তাও বিপুলের সাথে তার বিয়ে হবে এমন সংবাদ তো স্মৃতির জানার কথা নয়।তাহলে প্রশ্ন হলে সে জানলো কিভাবে?আবার বিপুল বলে নাই তো?ভেবেই অশ্রুর চোখ বিস্ফোরক হয়ে যায়।দমমুখ খিঁচে বলল,
“ভাইয়া,স্মৃতি কার কাছ থেকে শুনেছে জানালে উপকৃত হতাম।”
“স্মৃতি সিগনেচার করতে আজ থানায় গিয়েছিল।সিগনেচার করা শেষেই অরুনের সাথে গিয়ে দেখা করে।।আর অরুনকে আপনার বিয়ের কথা বলে।আপনি অরুনকে জেলে ঝুলিয়ে নাকি নিজেই এখন চন্দন কপালে অন্যের গলায় ঝুলে আছেন এধরনের হ্যানত্যান কথাবার্তা বললো।অরুন যখন জিজ্ঞেস তাকে করলো আপনার বিয়ে হওয়া ব্যাপারটা সে কিভাবে জানে তখন সে সোজাসাপ্টা উত্তর করলো বিপুল নিজেই নাকি বলল।বিষয়টি আমার বিলিভ হয়নি প্রথমে।ভাবলাম এসব তার বানানো কোনো গৎবুলি।তবে, এখন যেহেতু বললেন বিপুল নামে আপনার একজন কাজিন আছে তাহলে এখানে আর সন্দিহান নেই।”
অশ্রুর কান থেকে গরম ধোঁয়া বেরুতে থাকে।তারনামে এতবড় মিথ্যে?এতবড় জঘন্য কথা বিপুল কিভাবে বলতে পারলো!আর ওই ঠোঁট পাতলা মেয়ে স্মৃতি ওকে সামনে ফেলেতো এই মুহূর্তে অশ্রু ছিঁড়েখুঁড়ে খেত।ভালোভাবে না জেনে, না বুঝে ডালে চালে খিঁচুড়ি কষালো!আর এখন…চোখবুঁজে দৃঢ় শ্বাস ছাড়ে অশ্রু।মনের চাপা জেদটা বিপুল এবং স্মৃতির প্রতি এখন হরদমে বাড়ছে।আবরারকে কিছু বলতেও মুখে হাঁক আসছে না।মাথায় এতটাই জেদ চেপে বসেছে তার।অশ্রুর চুপ থাকা থেকে আবরার নিজ থেকে একটা আক্ষেপ ধ্বনি ছাড়লো,
“প্রথমে হয়তো বলার সাহস হয়নি।তবে এখন বলতে মোটেও দ্বিধা হচ্ছে না আমার।জানেন আপু?ভাগ্য কার কোথায় উপরওয়ালা ছাড়া তা কেউই জানে না।অরুন লাইফে এই প্রথম কাউকে মন থেকে ভালোবাসলো।কাউকে বউ করার তীব্র আকাঙ্খা করলো।আমিতো অরুনের স্বপ্ন প্রিয়সীকে মনে মনে ভাবিই ডাকতাম।আজ সে আজ আপনি আমার ভাবীটা রিজেক্ট করলেন।কষ্ট পেলাম খুব।খুব কষ্ট পেলাম!ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে গেলে।তবে আমার কষ্টতো এক আনা।আর যে এখন একশো আনা কষ্ট বুকে নিয়ে জেলের চারদেয়ালে পিঠ ঠেকে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে তার কী হবে!জবাব আছে আপনার?এই আপনার জন্যে আজ অরুন জেলে।সব দোষ আপনার,সব দোষ আপনার!আপনি মেয়ে অপরাধী…!আবরার আপনাকে এতটাই ভালোবেসেছে তার পরিসীমা মাপা যাবে না।আমিই ছিলাম ওর পাশে সবটা আমিই ওর চোখে-মুখে স্পষ্ট দেখেছি।”
অশ্রু ফুঁপিয়ে উঠে।হৃদয়ের ক্রন্দন থেকে প্রকাশ্যে একটা আর্তনাদ ধ্বনি উঠে আসে।দমিয়ে রাখা ক্ষোভ,কান্না,জেদ,অভিমান সব একাকার করে বলল,
“নাহ,ভাইয়া সব মিথ্যে!সব মিথ্যে!ওই স্মৃতি যা বলেছে সব মিথ্যে।বিপুল যা বলেছে সব মিথ্যে।”
অশ্রুর কথা শুনে আবরার যেন অকূলে কূল খুঁজে পায়।ভেতর থেকে একটা শীতল হাওয়া বেরিয়ে আসে।শান্ত মুখে বলল,
“মিথ্যে মানে?তারমানে বিপুলের সাথে আপনার বিয়ে হয়নি?”
“নাহ!তবে বাবা তারসাথে আমার ঠিক করে ফেলেছে।”
আবরার এবার খানিক টুকু আশাহত গলায় বলল,
“বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে?”
“হুম।তাও কাল!আজ রাতের মধ্যেই মামা-মামী ঢাকায় পৌঁছে যাবেন।উনারা আসলে কাল সকালেই……বিশ্বাস করুন আমি ওই বিপুলকে বিয়ে করতে পারবো না।গলায় ফাঁস দিব।মরে যাবো আমি।তারপরও পারবো না উনাকে বিয়ে করতে।বাবা কেন বুঝে না আমার বিপুলকে একটুখানিও পছন্দ না।কেন বাবাকে আমি বুঝাতে পারছি না।”
বলেই অশ্রু ফুপরে ফুুপরে কাঁদতে থাকে।
“আপু?একটা রিকুয়েষ্ট! প্লিজজ উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না।সুইসাইড সবকিছুর সঠিক সমাধান নয়।আর হ্যাঁ এখন প্যাঁচাল কথা বলার সময় নেই।সময় খুবই কম।এই আবরার বেঁচে থাকতে দুটো ভালোবাসাকে মরে যেতে দিবে না।পরে কল করছি আপনাকে।দয়া করে একটু কোল্ড থাকুন,একটু।আর কল করলেই সাথে সাথে রিসিভ করবেন।রাখলাম।”
আবরার কেঁটে দেয়।অশ্রু নিভে যাওয়া আধারে একটুখানি যেন আলো খুঁজে পেল।অজানা কোনো এক উচ্ছ্বাসে ভেঁজা চোখ হেসে উঠলো।।

রাত আঁটটার দিকে মামা-মামী বাসায় এসে পৌঁছায়।অশ্রু তার মায়ের কঠোর নির্দেশে উনাদের সাথে কুশল বিনিময় করে।উনারা হবু বউমাকে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি।বারংবার মাথায় হাত বুলায়, চুল ঠিক করে দেয়,আদুরে হাতে গাল টেনে দেয়,নাঁক টেনে দেয়,কপালে চুমু করে ভালোবাসার যেন কমতি নেই।এই মুহূর্তে মামা-মামীর আদরগুলোকে তার এক একটা নিক্ষিপ্ত পাথর মনে হচ্ছে ।উপরের ভালোবাসায় ভেতরেরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।রুদ্ধ দমটা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।দিকে দিকে দম বন্ধ হয়ে আসছে।আগে যে মামা-মামীরা বাসায় আসলে সবার প্রথমে সে দৌঁড়ে তাদের গলায় ঝুলে পড়তো ঠোঁটের স্পর্শ কপালে বিঁধতো আজ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।ইচ্ছে হয় না আদর নিতে।ইচ্ছে হয় না কথা বলতে।ইচ্ছে হয়না উনাদের সামনে দাড়িয়ে থাকতে।বলতে গেলে খুবই অসহ্যকর লাগছে এদের আজ।
তারপর টুকটাক কথাবার্তা সেরেই রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।দৌড়ে যায় মোবাইলের কাছে।আবরা কল করেছে কিনা দেখতে তবে এখনো তার কল আসেনি।অশ্রুর ভীষণ চিন্তা হতে থাকে।আবরার কল করে কোনো বার্তা দিবে?নাকি উল্টো মিথ্যে মায়া দেখিয়ে পল্টি নিল?
নাহ নাহ এসব হবে না।বিশ্বাস আবরার কল করবে।বলবে অশ্রু আপু,তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নিন আমি এবং অরুন ওই ঝাঁকড়া গাছের নিচে আসতেছি।
মনের ঘরে এমন জাগতিক কল্পনা করতে করতে বেলকনির দিকে চলে আসে সে।আকাশে আজ বড় থালার মতো চাঁদ উঠেছে।তার স্বচ্ছ পূর্ণিমা চারদিকটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সোনালী ছড়িয়েছে।কী অদ্ভুত সুন্দর এই সোনালী আলো।বালুগুলো এর আলোয় চিকচিক করে নাচছে।গাছের পাতা টাতা বেয়ে এর আলোর ঝিলিক বেয়ে পড়ছে।প্রকৃতি ভীষণ খুশি এমন সুন্দর একটা রাত তাদের জীবনে এসেছে আজ।
আমিও কি আজ খুশি হতে পারবো ঠিই এই চাঁদটার মতো?মনের ক্ষীণ আশা উদ্দীপ্ত হয়ে ঝলমল করে অন্ধকারকে বিদেয় জানাবে তো?ভাবনার গোচরে কল বেঁজে উঠে অশ্রুর।বুকের মাঝখানটা ধক করে উঠে তার।আবরার ভাইয়ের কলতো?আচ্ছা যদি আবরার ভাইয়া হলো?এই চাঁদ প্রমিস করো তোমার আলোটুকু যেন আমার হৃদয়ঙ্গনে পৌঁছাতে পারে..
চাঁদের থেকে মুখ সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে।সুন্দর করে লেখা–“Abhrar vaiya”
ইয়েস,ইয়েস আবরার ভাইয়া!!!কী না খুশি অশ্রু,তার খুশিতে আকাশের ওই স্বচ্ছ চাঁদটাও হাসছে!!!
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪৯
রোকসানা আক্তার

একদলা কালো আঁধার শহরের বুকে গভীর রাত নেমে এসেছে।চারদিক পিনপতন নীরবতা!বাসার সবাই শেষ শীতের আয়েশে তৃপ্তির ঘুম দিচ্ছে।অশ্রু ড্রিম লাইটের আলোয় বিছানার উপর ছড়ানো ছিটানো জামাগুলো এক এক করে ভাঁজ করে ব্যাগে ফুরছে।তারপর হ্যান্ডওয়াশ,ফেসওয়াশ,হেয়ার ওয়াশ, টুথপেষ্ট, টুথব্রাশ, চিরুনি,সাজগোজ করার টুকিটাকি জিনিস সব ঢুকিয়ে ব্যাগটাকে ভরভরে করে নেয়।ব্যাগটা একটু হাতে তুলে চোখমুখ কুঁচকে আনে। ওজন বেশ।ওজনের কথা ভেবেও লাভ নেই এখন জান থাকতে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদ অশ্রুর।দ্রুতপায়ে হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে নিজের জমানো কানাকড়ি সবগুলো টাকা হ্যান্ড ব্যাগে ঢুকায়।নিজেকে মোটামুটি গুঁছানো শেষ হলে কাঁধে ব্যাগ াঅদ@াএবং হাতে হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে টেবিলের দিকে এগোয়।বাবার জন্যে লিখে যাওয়া একটা শিথিল চিঠি বইয়ের মলাটের উপর রাখে।অতঃপর পা বাড়ায় দরজার দিকে।কি ভেবে যেন হাঁটার গতি শ্লথ করে দাড়িয়ে যায়।হুড়মুড় বাতিটা জ্বালিয়ে আয়নার সামনে এসে নিজেকে একফোঁড় দেখে।গায়ে কালো-কাঁচ হলুদের থ্রী পিস।মাথা থেকে পিঠ অব্দি কালো ওড়না জড়ানো।মুখের অংশ পুরোপুরি দেখা না গেলেও চিকন দু’গাল,গোলাপী দু’ঠোঁট,ডাগর চোখজোড়া স্পষ্ট দেখা যায়।নিজেকে এই সাজুনিতে দেখে অশ্রু কিলবিল হেসে দেয়।উপায় নেই।সবার দৃষ্টি এড়াতে হলেও এই গেটআপ পার্ফেক্ট।বাইরেও যে গোয়েন্দা লোক আছে তা অশ্রুর বেখেয়ালে নয়।চারপাশে নজর রেখে খুব সন্তপর্ণে ডাইনিং ক্রস করে।তারপর আলতো হাতে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।এপাশে এসেই বুকে হাত রেখে একটা দৃঢ় শ্বাস ছাড়ে।বুকের ধুকধুকানি শব্দটা এখন আয়ত্তে আসছে।
“বাপরে বাঁচলাম।”
বলেই অশ্রু হাসি হাসি ভাবে মাথা ঝাঁকায়।হাত ঘড়িতে চোখ রাখে দেখে ১’টার কাঁটা ছুই ছুই।আবরার ঠিক ১ টাই বিল্ডিংয়ের বাইরের সেই ঝাউড়ি গাছটার নিচে দাড়িয়ে থাকবে বলেছে।এতক্ষণে বোধহয় দাড়িয়ে আছে।
অশ্রু তড়িঘড়ি দপদপ পা ফেলে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
দূর থেকে ওড়না দিয়ে নিজেকে পরিবেষ্টন করা একটি মেয়ে এদিকে আসতে দেখে আবরার ভ্রু কুঁচকায়।।আবরার বুঝে উঠতে পারলো না ও অশ্রু নাকি অন্যকেউ!তাছাড়া এসময় এদিকে অশ্রু ছাড়া কেউ আসার কথা না।ভেবেই মোটামুটি গেজ করে নেয় আবরার এ অশ্রুই হবে।অশ্রু যখন খুব কাছে চলে আসে তখন আবরার কুটিল হেসে দেয়।বলল,
“গেজ করেছি আপনিই হবেন।”
অশ্রু হাসার চেষ্টা করে ক্ষীণ গলায় জবাব দেয়,
“আপনার প্রখর শক্তি ভালো।”
আবরার পূর্বের ন্যায় হাসি বজায় রেখে বলল,
“মোবাইল অফ করেছেন?”
“হু করেছি।”
“আচ্ছা।আর ব্যাগটা আমার কাছে দিন।”
“আরেহ নাহ নাহ,আমিই রাখতে পারবো।”
“আপনাকে রাখতে বলিনি। গাড়িতে রাখবে।”
অশ্রু খিলখিল হাসি ছড়িয়ে দেয়।আবরারও সহিত।অশ্রু হাসি থামিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে আবরারের হাতে দেয়।আবরার গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ব্যাগটা রাখে।তারপর অশ্রুকে ভেতরে বসতে বলে।অশ্রু গাড়িতে উঠে বসে।আবরার ড্রাইভিং সিটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে।গাড়ি চলতে থাকলেই অশ্রু একনজর নিজেদের বাসার দিকে তাকায়।টপকে চোখে টলমল জল চিকচিক করে উঠে।মনের মাঝে এক বিষন্নতা ধেঁয়ে যায় এই ভেবে যে আগামী কাল সকালেই প্রিয় বাসার প্রিয় এই মানুষগুলো ভীষণ রকম কষ্ট পাবে।তাদের বাধ্য মেয়ে এমন অবাধ্য কাজ করে বসলো যা তারা আগে কখনো কল্পনাও করেনি।খুবই বদ,খারাপ,কুলাঙ্গার মেয়ে হিসেবে সম্বোধন হবে।
চোখবুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস টানে অশ্রু।তারপর সিটে মাথাটা এলিয়ে দেয়। দল দলা অন্ধকার বুক চিরে সা সা শব্দে গাড়ি চলছে তার গন্তব্যে।গন্তব্যস্থলের সেই ভরসা করা মানুষটির প্রতি অশ্রুর একরাশ ভয়,জড়তা,আকাঙ্খা,আশা,অনুভূতি,জড়তা। নিজের অতীত,স্মৃতি,মায়া-মমতা,ভালোবাসা সব জালান্জলি দিয়ে নতুন আশা-উদ্দীপনা বুকে নিয়ে বেরিয়েছে,কেমন হবে সামনের সেই জীবন?আঁট দশটা মানুষ রূপী হিংস্র জানোয়ারের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে নর্দমায় ফেলে দিবে নাকো?মনুষ্য মুখরে ধর্ষিতা ঠাই পেয়ে দিনরাত চোখ ফুলিয়ে ফুলিয়ে কেঁদে বুক ভাসাবে নাতো?!খুব শঙ্কা,খুব ভয়।তারপরও অন্তঃমন বিশ্বাসের রেখা আঁকে।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে অরুন সেই আঁট দশটা ছেলের মতো নয়।সে ভুবনের বুকে সবথেকে সুন্দরতম মানুষটি।অন্তরটা দিকে দিকে শুধু তার গানই গেয়ে উঠে,
“আমারও পরাণে যাহা চায় চায় গো, সে তুমি তাই তাইগো।”
কিছুক্ষণ সময় অশ্রুর গুমোট ভাবনায় কাটে।অশ্রুর চুপচাপ থাকা দেখে আবরার গলার খাঁকারি টানে।গাড়ির গতি বজায় রেখে বলল,
“মন খারাপ, আপু?”
অশ্রু মাথা তুলে তাকায়। ছোট স্বর টেনে বলল,
“নাহ,ভাইয়া।”
“আচ্ছা।
বলেই একটু থামে।তারপর একটা আক্ষেপতার নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বলল,
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ এখানে অরুন থাকার কথা।মানুষটির প্রিয়সী আছে অথচ মানুষটি নেই।পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত আর অদ্ভুত তার ছলাকলা!
অশ্রু চুপ থাকে।আবরার আবারও বলল,
“যাইহোক,আফসোস করেতো লাভ নেই।আপনাকে এতবড় বিপন্ন থেকে বাঁচাতে পারলাম এটাই অনেক।”
“অরুন কি কাল জাবিন পাবে?”
“আশা রাখছি আপু।আঙ্কেল এসপির সাথে কথা বলেছেন।কাল হাইকোর্টে নাকি যাবেন।এখন আল্লাহর যদি করুণা হয় ইনসাল্লাহ কালই জাবিন পাবে।”
অশ্রু আর কিছু বলেনি।সংগোপনে কষ্টমাখা একটা ঢোক গিলে।অশ্রুর মুহূর্ত ভালো যাচ্ছে না ভেবে আবরারও আর কথা বাড়ায়নি।চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকে।অতঃপর গাড়ি একটা হোটেলের সামনে এসে থামে।অশ্রু ব্যাগ হাতে গাড়ি থেকে নামে।আবরার অশ্রুর কাছে এসে বলল,
“আপু আজ রাত আপনি এখানে থাকবেন।সন্ধেই বুক করে রেখেছি।”
অশ্রু টানা টানা চোখে হোটেলের দিকে তাকায়।সুন্দর করে লেখা “স্পেশালিস্ট’স হোটেল”।
” এখানে থাকতে কোনো প্রবলেম হবে না আই থিংক।হোটেলের ম্যানেজার আমার পরিচিত।তাছাড়া,আমিও আজ এখানে থাকছি।এতরাত বাসায় ফেরা তো রিস্কি তারউপর আপনাকে একা রেখে যাওয়া।তাই আমাকেও থাকতে হচ্ছে।”বলেই হাসার চেষ্টা করে আবরার।অশ্রু মৃদু হাসে। বলল,
“ওহ আচ্ছা। ”
“তা ভেতরে চলুন।দাড়িয়ে এখানে কথা বলবো নাকি?”
“না।”
দুজন ভেতরে ঢোকামাত্র ম্যানেজার আবরারকে দেখে হেসে দেয়।কর্ণারের কেবিন থেকে গলা উঁচিয়ে বলেন,
“কি আবরার?গেস্টকে নিয়ে এসেছো?”
আবরার ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসে।সেদিকে এগিয়ে বলল,
“জ্বী,আঙ্কেল।”
ম্যানেজার অশ্রুর দিকে কড়া চোখে তাকান।ভ্রু নাঁচিয়ে বলেন,
“নাম কী গেস্টের?”
“অশ্রু।”
“শুধুই অশ্রু?”
পাশ থেকে অশ্রু ফোঁড়ন কেটে বলল,
” জ্বী।”
“ওহ,খুব ছোট নাম।”বলেই হাসার চেষ্টা করেন।তারপর অশ্রুর দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দেন এবং সেখানে নাম এন্ট্রি করতে বলেন।অশ্রু ফাইলটি হাতে নিয়ে নাম এন্ট্রি করে।অশ্রুর এন্ট্রি শেষ হলে আবরার তার নাম এন্ট্রি করে।ম্যানেজার দুটো চাবি আবরারের হাতে দিয়ে বলেন,
“রুম পাশাপাশি বুক করতে পারিনি আবরার।সকালে বললে ব্যবস্থা হত।তবে এক ফ্লোরেই ব্যবস্থা হয়েছে।”
আবরার রুম নাম্বার দেখে।অশ্রুর রুম নাম্বার-১০০,তার টা-১৪৫।সে হেসে বলল,
“ইট’স ওকে,আঙ্কেল।এক ফ্লোরে ব্যবস্থা হয়েছে এটাই অনেক।”
“আর যা যা প্রয়োজন ইনফর্ম কর জানাবে।ওকে?”
“জ্বী আচ্ছা।ধন্যবাদ,আঙ্কেল।”
“ওয়েলকাম।”
অাবরার অশ্রুকে নিয়ে উপরে আসে।পেছন পেছন হোটেল কর্মচারীও আসে রুম দেখিয়ে দিতে।সে আবরারের হাত থেকে চাবি নিয়ে অশ্রুর রুমটা খুলে দেয় ।অশ্রু ভেতরে ঢোকে রুমের চারপাশ তাকায়। রুমটার ডিজাইন একদম আধুনিকতার ছোঁয়া।নিঁখুত কাজের খচিতে ফোম বিছানা।সাদা চাদর,সাদা বালিশ কভার।রুমের একদম ডান সাইডে দু’পিস গোলকার সোফা তাও ফোম।সোফার টি-টেবিলের উপর গোলাপের ফুলদানি।সোফা বরাবর সোঁজা তাকালে অর্থাৎ রুমের কোণায় জীবন্ত একধরনের গাছ দেখতে পায় যেটা থেকে মৌ মৌ ঘ্রাণ নাকে আসছে।অশ্রু তা দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়।রুমের এই জিনিসটা তাকে সবথেকে বেশি মুগ্ধ করেছে।তারপর চোখ যায় দেয়ালে।দেয়াল ভরা শুধু ওয়ালেট আর্ট।পুরো রুম প্রদক্ষিণ করতে করতে অশ্রুর দু’মিনিট লেগে যায়।আবরার বলল,
“আপু?”
“অশ্রু পেছন ফিরে তাকায়। বলল,
” জ্বী,ভাইয়া।”
” পছন্দ হয়েছে রুমটা?”
“অনেক।”
আবরার হেসে দেয়।আবরার যে এতক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে তা অশ্রুর খেয়াল ছিলনা। বলল,
“ভাইয়া,আপনি বাইরে কেন?ভেতরে আসুন না?”
নাহ আপু, এখন ভেতরে হেঁটে যাওয়ার এ্যানার্জি নাই।কর্মচারী চা’টা দিয়ে যাক তারপর রুমে যেয়ে একটু রেস্ট নিব।আচ্ছা,আপনিতো চা খান,তাই না?”
“হুম,মোটামুটি।তেমন না। ”
“মোটামুটি বললে কম শোনায়।আপনি চা বেশ পছন্দ করেন তা অরুন আমায় বলেছিলো।”
অশ্রু থতমত খায়।চায়ের অফার রিজেক্ট করতে এই প্রথম একখানা মিথ্যে বললো তাও ধরা পড়লো।এই অরুনটাও না কী! পেঁটে কথাই হজম হয়না।ইনাকে উন থেকে চুন না বললে যেন রাতের ঘুম হারাম।ব্যাঁটা যাতাকল একটা!এরইমধ্যে কর্মচারী চা নিয়ে হাজির হয়।আবরার বলল,
“টি-টেবিলে নিয়ে রাখুন।”
কর্মচারী টি-টেবিলে চায়ের কাপ রাখে।এককাপ চা টি-টেবিলে দেখে অশ্রু বলল,
“ভাইয়া, আপনি খাবেন না?”
“না আপু্।এই মুহূর্তে পেঁট পুরো ডেমেজড।ইচ্ছে হলে তখনই অর্ডার করতাম।তাছাড়া,এগোরটার দিকে টঙ্গ দোকান থেকে একসাথে দু’কাপ খেয়েছি এখনও সেই গ্যাস পেটে বুদবুদ করছে।”
“ওহ আচ্ছা।”
“আমি চলে যাচ্ছি।আপনি ভীষণ ক্লান্ত।ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি চা টা খেয়ে নিবেন ঠান্ডা হয়ে যাবে।আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে সাথে সাথে নক করবেন।আমার রুম বেশি দূরে নয় কাছেই।অন্যকেউ রুমে এসে যদি নক করে খুলবেন না।দরজা ধাপাধাপি করলেও খুলবেন না।হুলস্থুল বেশি করলে সোঁজা আমায় কল করে জানাবেন।ঠিক আছে? ”
“যদি হোটেলের কর্মচারীরা আসে?”
“তাও না।”
“ওহ।”
“আমার প্রাণের কাজিনের হবু বউকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন একমাত্র আমার।কাল ওর হাতে সেইফলি তুলে দিতে পারলেই পরম শান্তি।এর আগে নয়।” বলেই আবরার হাসার চেষ্টা করে।অশ্রু লজ্জায় লাল হয়ে যায়।তাড়াতাড়ি মাথা নুইয়ে আনে।
আবরার তা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
“আপনার চাবি নিন আপু।”
অশ্রু দরজার দিকে এগিয়ে আবরারের থেকে চাবি নেয়।
“দরজা বন্ধ করুন।”
“জ্বী,ভাইয়া ।”
আবরার চলে যায়।অশ্রু দরজা বন্ধ করে ব্যাগটা কাঁধ থেকে বিছানার কিণারে রাখে।সেখানে ধপসে বসে একটা জোড় দম ছাড়ে।এতক্ষণ পর এখন একটু শান্তি আসলো মনে।এতক্ষণ তো দম রুদ্ধ হওয়া অবস্থা হয়েছিল।
বলেই মাথা ঝাঁকি দেয় অশ্রু।তারপর ব্যাগের চেইন খুলে ফেসওয়াশ,হ্যান্ডওয়াশ এবং তোয়ালে নেয়।ওগুলো হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢোকে।ফ্রেশ হয়ে এসে
তোয়ালেটা সোফার হাতলে রাখে।তারপর আয়নার সামনে এসে দাড়ায়।মুখে হালকা ক্রিম মেখে সরু চুলগুলোকে মুক্ত করে দেয়।লম্বা চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে যায়।নিজের দিকে কিছুক্ষণ সময় বিচক্ষণ চোখে তাকিয়ে কেমন উদ্ভট জল্পনা কল্পনা মাথায় চেপে বসে।
অরুন যদি এখন পাশে থাকতে ঠিক চুলগুলোতে আলতোভাবে হাত বুলাতো আর বেলীফুলের ন্যায় নাকের ছিদ্র দিয়ে সুভাস নিতে।মনভোলা গান গেয়ে গেয়ে মাতিয়ে তুলতো,
“তোমার ওই এলোকেশে,হলাম পাগল বেশে।নাক ডুবিয়ে হাওয়া হবো অথৈ প্রেমের সাগরে।ছিঁড়ে যায় বাঁধন,মরে যাই তোমার রূপে তবুও পারছি না নিজেকে বদ্ধ কায়!তোমার ভালোবাসা ভীষণ যে আমার প্রয়োজন!”
কল্পনার ঘোরে মাতিয়ে উঠে অশ্রু।এমন আনলিমিটেশন কল্পনাকে মাথায় বেশিক্ষণ ঠাই দিল সে যে তার বাঁধন হারিয়ে নিজেই নিজের কাছে লজ্জিতবোধ হবে!ভেবেই
অশ্রু নিজেকে সুপ্ত করে।মাথা ঝেঁড়ে তারপর প্রকাশিত মুখ করে বললো,
“ইশ্ অরুন যদি এসব দেখে ফেলতো কীই না হতো!লজ্জায় একদম মাটির সাথে মিশে যেতাম।”
বলেই তাড়াতাড়ি চোঁখ খিঁচে জিব কেটে!

ভাবনা-ঘোচর সব কেটে-কুটে সোফায় এসে বসে।হাতে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতেই জিহ্বায় অমৃত স্বাদ গরল!সে যে অনেক আগেই বরফে হীম হয়ে ভাটা পড়েছে স্বাদে!পরে ব্যর্থ মুখরে কাপটা রেখে দিয়ে হর্ণপায়ে বিছানা শুতে যায়।

চলবে…
(রি-চেইক করিনি।গল্পটা কবে যে শেষ হবে!)
চলবে….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here