একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪৪
রোকসানা আক্তার

“প্রেম কেমন চলে তোর?”
“মানে!?”
“অভিনয় করিস না অশু!”
“কীসের অভিনয়!আর আপনি কি বলতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“বাংলা বলছি।না বুঝার কিছু নেই এখানে।
বলেই একটু থামে তারপর আবার বলল,
যার সাথে প্রেম করিস তার নাম কী,কী করে,কোথায় থাকে ডিটেইলস বল।দেখি ফুপার সাথে কথা বলে তোদের বিয়ের ডেট ফাইনাল করে ফেলবো।”
অশ্রু বিপুলের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো।ইনসাল্ট করার মতো কথা!তাছাড়া,হুটহাট প্রেম- পিরীতের কথা আসলো কইত্তে।বাবার কথাতে ইনিও নাচছেন নাকি ভেতরে ভেতরে।পরে ভেতরের কথা লুটেপুটে বাবার উপর ফসকাবে।বাবাতো আবার বিপুল বলতে একদম অন্ধ।বিপুল হ্যান,বিপুল ত্যান।ওর মতো ভদ্র, মার্জিত বিহেভের ছেলে লাখে একজনও নেই।এতই উচ্চ সম্ভাষণে রেখে এখন আমার মাথাটা খাচ্ছে।ভেবেই বলল,
“ভাইয়া,বাবার মতো আপনার মাথায়ও ভূত চেপে বসেছে?মানলাম বাবা আন্দাজ করে সব বলছে।সাথে আপনিও!হাউ এ নাইস জোক্স হিহিহিহি।”
অশ্রু খুব আঁটভাবে কথা বলার চেষ্টা করছে যাতে তার দুর্বলতার পয়েন্ট মোটেও খুঁজে না পায়।
বিপুল ভ্রু কুঁচকে অশ্রুর দিকে তাঁকায়।বলল,
“আমি ফুপার কথায় কিছু মনে করে বলিনি।আমি আমার মন থেকে বলেছি।”
“ওহ আচ্ছা।তো মনের বানানো কথা আরো কি কি আছে, বলুন?আমি একটু শুনবো।”
“বানানো নয়।যেটা সত্যি সেটাই বলছি।”
“ম-ম-মানে?”
“পরসু রাত তুই কার সাথে বলেছিলি? সময়টা দশটা-এগোরোটার মধ্যে হবে মে বি!”
“ক-কার সাথে বলব!কী বলছেন এসব?”
“আচ্ছা আমি ভুল বললাম।পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছি,হুম ডিনার হয়েছে,তাহলে একটা বিয়ে করে ফেলুন ইত্যাদি ইত্যাদি এসব কথা তাহলে কি মিথ্যে?”
অশ্রু এবার হরদমে একটা বিষম খায়।অরুন এসব ব্যাপারে জানলো কিভাবে!?মাথার ভেতর তার এ প্রশ্নটি কুটকুট করে উঠে।গত পরুসু রাত অরুনের সাথে কথা বলার সময় বিপুল দরজার ওপাশ থেকে সবটা শুনতে পায়!নিজের রুমে যাবে বলে কলোনির সামান্য দূরে যেতেই অশ্রুর ক্ষীণ আওয়াজ কানে আসে।কার সাথে কথা বলে ভেবে পেছনি ফিরে আবার অশ্রুর দরজার সামনে এসে দাড়ায়।তাছাড়া,অশ্রু সেদিন সাজুগুজু অবস্থায় বাসায় আসায় বিপুলের মনে সন্দেহের দানা বুনে।তাই অশ্রুকে সে থেকে বেশিটুকু না হলেও কিছুটা সন্দেহ করে আসছে কারো সাথে রিলেশন চলছে ভেবে।
“ক-কেন মিথ্যে হবে।ফ-ফ্রেন্ড ছিল।”
“শুধু ফ্রেন্ড নাকি বয়ফ্রেন্ড?”
“কারো পার্সোনাল লাইফে হার্ট করা আপনার অধিকার নেই ভাইয়া।”
“আমি তোকে হার্ট করছি না।জাস্ট কাজিন হিসেবে জানতে চেয়েছি।”
“আমিতো কখনো আপনার পার্সোনাল কিছু জানতে চাইনি।তাহলে আপনি কেন আমার পার্সোনাল ইস্যু ঘাটতে আসছেন?”
“দেখ অশ্রু,তুই ওভাররিয়েক্ট করছিস।আমি সেরকমটি ভাবছি না।ব্যাপারটা একদম সিম্প্লি ভেবে নিতে পারিস।তুই বড় হয়েছিস এ বয়সে তোর একটা নয় হাজারটা বয়ফ্রেন্ডও থাকতে পারে।এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
“সো?”
“নাথিং।যাই করিস ভেবেচিন্তে করিস।এমন কিছু করিস না যেখানে ফ্যামিলির মানসম্মানের প্রশ্ন উঠে।আমি তোর বড়। তাই তোকে উপদেশ দেবার অধিকার আমার আছে,ওকে?গেলাম।দরজা বন্ধ করিস।”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠতে অশ্রু থামিয়ে দেয়।বিপুল ভ্রু বেঁকে পেছনে তাকায়।বলল,
“দাঁড় করিয়েছিস কেন?”
“কারো সাথে আমার রিলেশন আছে আপনি এতটা সিউর কিভাবে বলুনতো আমাকে?”
“সবকিছু সিউরিটি দেওয়া যায় না।গেইজ করে নিতে হয়।”
“গেইজ কি সবসময় সত্য হয়?”
“দেখ, তোর সাথে এখন আমার তর্ক করতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না।”
“নিজেই কথার ফসলা তুলছেন।তার ভুল-শুদ্ধ ঘেটে বলতে গেলেই চুপ!?বাহ।একটা কথা বলে দিই শুনুন?কারো ব্যাপারে ভালোভাবে না জেনে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসবেন না।কোনো ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে হেসে হেসে কথা বললেই সে বয়ফ্রেন্ড হয়ে যায়না।”
“তাহলে তোর সেই ছেলে ফ্রেন্ডটা কে আমাকে তার কল ধরিয়ে দে।কথা বলে দেখবো।”
অশ্রুর মাথা গরম হয়ে যায়।এ তো আস্ত একটা ঝামেলা বাজ।কথা বলার লিমিটেশনই জানে না।মামী কি খাইয়ে যে গাদার ড্রাম বানাইছে আল্লাহই জানে।রাগে ফঁসফঁস করতে থাকে অশ্রু।অশ্রুর চুপ থাকা দেখে বিপুল বলল,
“কি হলো দিবি না?”
“ছোটদের থেকে অহেতুক কথা যদি না শুনতে চান, তাহলে প্লিজজ.. সবিনয়ে আকুল আবেদন আমার রুম থেকে চলে যান।”
বিপুল ষোল পাটি দাঁত বের করে হেসে দেয়।অশ্রু গাল ফুলিয়ে চোখ বুঁজে রাখে।অতঃপর বিপুল অশ্রুর দিকে তাকিয়ে চলে যায়।অশ্রু চোখ খুলে। বিড়বিড় করে বলল,
পাগল কোথাকার!

পারুল বেগম যতবার চোখ বুঁজেন ততবার পাতা ফাঁক হয়ে আসে।একশো বোল্ড পাওয়ারের বাতি জ্বলে আছে রুমে।এখন রাত এগোরটা বাজে আলাউদ্দিন এখনো শয়ন গ্রহণ করছেন না।ঘন পায়ে রুমের এ’পাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করছেন।পারুল বেগমের চোখের ঘুম এবার হারাম হয়ে যায়।মুখে একগাদা বিরক্তি নিয়ে উঠে বসেন।বলেন,
“এবার পায়চারীটা বন্ধ করে শুতে আসো।যেভাবে বাতি জ্বালিয়ে রাখছো ঘুমাতে পারছি না।”
আলাউদ্দিন থেমে যান।স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কীভাবে ঘুমাই কও?এই মেয়ে মাথায় যে চিন্তার চাট গেঁথে দিয়েছে চোখে ঘুম আসবে কই থেকে?”
“আহা,তুমি খামোখা উটকো চিন্তা করছো।মেয়েকে নিয়ে যেসব ভাবছো সেসব হয়তো নাও হতে পারে।আমার মেয়েকে আমি চিনি ও আমাদের গোপনে অন্যকারো সাথে প্রেমে জড়াবে এরকম মেয়ে ও নয়!”
“পারু তুমি জানো না।কিছুই জানো না।আজ কালকার মেয়েরা এসব এসব বিদ্যায় পন্ডিত।ওদের খুব কাছ থেকে মনের রগ ধরতে পারবে না।তাছাড়া,ইদানীং ওর বিহেভিয়ার আমার ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না।”
“তাহলে তুমি কি করতে চাও বলোতো?”
“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“কি সিদ্ধান্ত!? ”
“বিয়ে দিয়ে দিন।”
“হঠাৎ বিয়ে!?ভেবেচিন্তে বলতেছ তো?”
আলাউদ্দিন পারুল বেগমের কাছে এসে বসেন।অধীর আগ্রহে বলেন,
“হুম,পারু।তুমি দুইটা জিনিস চিন্তা করো।মেয়ের যদি অন্যকারো সাথে লাইন-ফাইন থাকলো, ও এখন আমাদের যেভাবে মিথ্যে বলছে যেকোনো সময় অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।এমনকি তখন আমাদের মানসম্মানের প্রশ্নও উঠবে।দ্বিতীয় জিনিসটা হলো মেয়েকে ভুট্টো পোদ্দারের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তার এখন একটা শক্ত খুটি দরকার।যে খুটি ধরে সে নিজের মান হারানোর ভয় থাকবে না।লুকোচুরি যাপন করতে হবে না।”
“হুটহাট এমন সিদ্ধান্তে মেয়ের জন্যে ভালো কোনো ছেলে নাও পেতে পারো।কেমন না কেমন হয়।মদ খায় নাকি জুয়া খেলে..ইত্যাদি।বিয়ের ব্যাপারটা বললেই হয়ে যায় না!”
আলাউদ্দিন পারুল বেগমের কথায় কিছুক্ষণ থম মেরে ভাবতে থাকেন।কিছু একটা মাথায় আসতেই বলেন,
“ছেলেতো আছে!”
“কে?”
“কেন আমাদের বিপুল!বিপুলতো দেখতে শুনতে খারাপ না।এক বাবার এক ছেলে।দেখতে শুনতে খারাপ না।ওভারঅল স্মার্ট। ওই পারবে অশ্রুকে সকল ঘুর্ণিপাক থেকে বাঁচাতে।ওর সাহসও বেশ।
“বিপুলের ফ্যামিলি যদি না মানে?তাছাড়া,বিপুলের স্টাডিও শেষ হয়নি!”
“মানবে না কেন!আমার মেয়ে দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ।বিপুল অশ্রুর কথা শুনলে নাঁখোশ করবে না আমার মন বলছে।আর ওর স্টাডির কথা ভাবছো তাই না?এখন বিয়েটা পড়িয়ে কাবিন করে রাখলে পরে ওদের যখন স্টাডি কম্প্লিট হবে তখন মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।সমস্যা কি!আর ছেলে যদি বিয়ের পরআমাদের বাসায় এসে ক’দিন থাকতেও চায় থাকবে সমস্যা কি।তখনতো সে আমাদের বাড়ির জামাই।”
“তুমি কীসব বলছো তোমার কথা আমার মাথায়ই ঢুকছে না।তাড়াহুড়োর কাজ কখনো ভালো কিছু নিয়ে আসে না।তাছাড়া, মেয়ে রাজী হবে কিনা তাওতো জানা দরকার।”
“ওর সম্মতির কোনো প্রয়োজন নেই পারু।ও যদি আমাদের সম্মতির আশ্বাস্ত রাখতো তাহলে কখনো মিথ্যে বলতে না।তুমি বিশ্বাস করতে পারছো? মেয়ে এই অসময় বাসা থেকে বেরুবার সাহস পায় কিভাবে!আমার মাথায়ই আসছে না।মেয়েকে বিশ্বাস কিভাবে করবো বলো?”
“আমি কিছু জানি না।তবে,এটুকুই বলবো মেয়ের সাথে এ ব্যাপারে আগে কথা বলে নাও একবার।আর ঘুমালাম।সুইচ অফ করো।”
বলেই পারুল বেগম গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়েন।

সকাল হয়।শীতের সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে পুরো শহরের বুকে চিরে।আর এই ব্যস্তময় শহরের অলিগলিতে ধূলোয় কণার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সহস্র মানুষ।চারপাশের বাস,রিক্সা,মোটরবাইক, সি এন জির চালানোর শব্দে উত্তাপিত পুরো শহর। মাথায় হেলমেট পড়ে বাইক নিয়ে বেরিয়েছে আবরার।অরুনের সাথে দেখা করবে বলে খুব সকালেই বেরিয়েছে।কিন্তু রাস্তাঘাটে যানজটের যে অবস্থা দশ মিনিট পরপর একফোঁড় এগোয়।গাড়ি যেন চলছেই না।হেঁকেবকে অতঃপর এগোরটায় গিয়ে পৌঁছায়।
চারদেয়ালে মাঝখানের জায়গাটায় অরুন দু’পা ভজ করে বসে আছে।মাথাটা নিচের দিকে নিমজ্জিত।আবরার লোহার শিকের সামনে যেয়ে ছোটস্বরে অরুন বলে ডেকে উঠে।আবরারের ধ্বনির আওয়াজ কানে আসতেই অরুন মাথাতুলে তাকায়।আবরারকে দেখেই মৃদু হাসার চেষ্টা করে।আবরারের দু’চোখ টলমলে হয়ে আসে।মুখটা শুকনো শুকনো।চোখদুটো লাল।মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো। হাতপায়ের চামড়া শুষ্ক শুষ্ক।অবস্থা দেখেই বুঝা গেল এ তিনরাত ভালোভাবে ঘুমোয় নি সে।বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আবরারের।ইচ্ছে হয় অরুনকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা কান্না করতে।আবরারের ভাবনার জড়তার মাঝেই অরুন শিকের সামনে চলে আসে।টপকে বলল,
“কি ভাবছিস?”
আবরারের টনক নড়ে।কোনোমতে চোখের পানির টাল সামলে মায়া জড়ানো গলায় বলল,
“কেমন আছিস অরুন?”
“দেখতেইতো পাচ্ছি ভালো।একা সময়,নিরিবিলিতে বেশ ভালোই কাটছে।তা তোর কি অবস্থা?” হেসে হেসে বলল।
“ভালো আর কিভাবে!তোকে ছাড়া ভালো থাকা যায়?”
“আরেহ বোকা এইজন্যে বুঝি মন খারাপ!একদিন বললাম না হালকা পাতলা কিছু নিয়ে মন খারাপ করবি না?উফস, তোর এই অভ্যেসটা না?আর আমি অনেক ভালো আছি।আমি ভালো থাকবো বিধায়ইতো নিজেই এখানে চলে এসেছি।জানিস এ’কটাদিন বাড়িতে ছিলাম যেন জাহান্নামে ছিলাম।আর এখানে আসার এখন অনেকটা হালকা হালকা লাগছে।দোয়া কর পাপের ফল যেন আরো বেশি সময় নিয়ে ফুরোয়।তাহলে আরো বেশি হালকা লাগবে।”
এবার আবরারের দু’চোখ লাল হয়ে যায়।পানিভরা চোখের দীঘি থেকে যেন এখুনও টুপটুপ করে বেয়ে পড়বে। কিন্তু ছেলে মানুষের চোখ দীঘি থেকে সাগর হলেও একফোটা পানি গড়ালেই যেন বেমানান।আবরারের এখন এমন হাবভাব অরুনের বিরক্তি লেগে যায়।বলল,
“আবার!এভাবে পিরীত না দেখিয়ে বল বাসার সবাই কেমন আছে!”
“ভালো।সবাই ভালো।”
“বাবা?”
“বুঝতেছি না কেমন ভালো।তবে,তুই জেলে আসার পর থেকে উনি খুব বেশিই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছেন।”
অরুন একটা আক্ষেপ শ্বাস ছাড়ে।বলল,
“দৌড়াদৌড়ি করেও লাভ নেই।আমি যতদিন নিজেকে সম্পূর্ণ হালকা বোধ না করবো ততদিন জেলের এই চারদেয়ালেই কাটাবো।”
“কি বলিস অরুন তুই এসব!তুই এখানে থাকবি আল্লাহ না করুক বাসায় যদি কোনো একটা বিপদ ঘটে। বলাতো যায় না মানুষের কোন দিক থেকে কোন বিপদ আসে।”
“বাদ দে।তা অশ্রুর সাথে কথা হয়েছে তোর?ফোন করেছিস ওকে?”
“য়ু হু।”
“কথা বলিস।খোঁজ নিস।কি অবস্থায় আছে।”
“আচ্ছা নিব।”
এভাবে অনেকক্ষণ অব্দি দুজনের কত অকথন কথা চলতে থাকে।টাইম ওভারের পর থানার কয়েদী এস বলল,
“সময় শেষ।”
আবরার কাঁপা পাতায় অরুনের দিকে তাকায়।অরুন অভয় চোখে যেতে বলে।
“আরেহ যা।টেনশন নিস না।আমি ঠিক আছি।”
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪৫
রোকসানা আক্তার

অশ্রু জামাকাপড় ছাদে মেলে এসে ডাইনিং হয়ে নিজরুমের দিকে যেতেই পেছন থেকে বাবার ডাক পড়ে।অশ্রু পেছনে ফিরে তাকায়।বাবা কিছু বলবে তা মুখের অবয়বে ফুটে আসছে অশ্রু বুঝতে পেরে বাবার দিকে এগিয়ে বলল,
“কিছু বলবে,বাবা?”
“হু,বস।”
অশ্রু বাবার সাইড সোফায় গিয়ে বসল।বলল,
“কী বলবে, বলো?”
“বিপুলকে তোর কেমন লাগে?”
হঠাৎ বাবার এহেন প্রশ্নে অশ্রু বড়সড় একখানা ধাক্কা খায়।ভ্রু,কপাল চামড়া,চোখর চারপাশ কুঁচকে আসে।বলা নেই কওয়া নেই বিপুলের কথা এভাবে টেনে আনা কোনো জটলা অবশ্যইতো আছে।ভেবেই অশ্রু আস্ত গলায় একটা ঢোক গেলে।স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবার কথার জবাব দেয়।
“হু,ভালোইতো বিপুল ভাইয়া।”
আলাউদ্দিন ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে উঠেন।অশ্রুর জবাবটা উনার মনে বেশ শান্তি জুড়িয়ে দিল।আরেকটু আমেজে বলেন,
“বিপুলকে আমারও অনেক ভালো লাগে ।ওর চলাফেরা,কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি ওভারেল নর্মাল। এমন সোনার টুকরো লাখে একজন।”
“ওহ।” ছোটকন্ঠে বলল।
“তা বলতে চাইলাম আজকালকার ছেলেরা জানিসইতো বড্ড খারাপ।রাতে বন্ধুদের সাথে মদ খেয়ে খেয়ো আড্ডা,ফূর্তি করে।বেশি রাত করে ঘরে ফিরলে বউ যখন রিজন জানতে চায় তাকে ঠাস ঠাস করে মা।উপরের হাবভাবে কখনো মানুষকে চেনা যায় না।মানুষ তখনই চেনা যায় যখন মানুষটির সাথে দীর্ঘদিন উঠবস থাকে।এই যেমন ধর-আমাদের বিপুলটা।তার সবগুলো বিহেভিয়ার একেবারে পিচ্চি থেকে মুখস্থ আমার।”
আলাউদ্দিন কথা গুলো বলেন আর ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের মুখের দিকে তাকান মেয়ের মনের হাবভাব বুঝতে।।মেয়েকে তো ডিরেক্টলি বিপুলের কথা আর বলতে পারবেন না।তাই ইনিয়ে বিনিয়ে এটা ওটা বলেই বিপুলের সাথে ওর বিয়ের কথাটা তুলবেন।কিন্তু এমন লেফাফাদুরস্ত গ্যাঁনগ্যাঁন অশ্রুর অসহ্য লাগতেছে।এক টপকে রুমে যেতে পারলেই যেন প্রাণটা বেঁচে যেত।আলাউদ্দিন গলা খাঁকারি টেনে আবার বলতে লাগলেন,
“তোর মামী সে তো মাশাল্লাহ অনেক ভালো।আর মামাতো তারতো গুণ গাইতে হলে এক দিবস সোফায় বসে বসে কাটাতে হবে।মাঝে মাঝে এই ফ্যামিলিটির প্রতি আমার হিংসে হয়।কত মায়া,কত ভালোবাসা,কত দায়িত্ব রক্ষণশীলতা বাহ বড়ই তৃপ্ততা লাগে।আর তোর মা সেতো মায়া,আবেগ কেন উল্টো কতক্ষণ আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তারজন্যে একপায়ে খাঁড়া হয়ে থাকে।”
“বাবা এসব পরে শুনবো।আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে।”
“আরে শোন না কথাতো এখনো শেষ হয়নি।আরেকটু বস।তা বললাম কি ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে-লাইক ফাদার এন্ড লাইক সন।তেমনি বিপুলও দেখিস তার বাবার মতন।”
“ওহহ।”
“তাই বিপুলকে আমার সর্বদিক দিয়ে ভালো লেগেছে।তোরও ওতোটা লাগে নি, তাই না?তা মা আমি চাইছিলাম কি বিপুলতো আমাদেরই তাকেই নাহয় আমাদের বাড়ির জামাই করি।আমারতো কোনো নিজের ছেলেও নাই।বিপুলকে পেলে আমার কোনো আক্ষেপ থাকবে না।ওই হবে আমার একমাত্র ছেলে।”
অশ্রু এবার সম্পূর্ণটা ক্লিয়ার হয় তার বাবা ইনিয়ে বিনিয়ে এতক্ষণ কি বলতে চেয়েছিলেন।তবে সে তো পারবে না বিপুলকে স্বামী হিসেবে একসেপ্ট করতে।বিপুলকে তো কখনো ওভাবে দেখেওনি বা মনের কিণারে ভাবতে দেয়নি।তাহলে বাবার বলা এই প্রস্তাব কি একসেপ্ট করা সম্ভব?মুহূর্তে মাথাটার মধ্যে ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ হতে থাকে।আলাউদ্দিন মেয়ের জবাবের অপেক্ষা না করে আবার বলেন,
“বিপুলের সাথে সকালে আমি এ ব্যাপারে কথা বলেছি।সে রাজি হয়েছে।তার মা-বাবাকে এ ব্যাপারে বলে ঢাকায় নিয়ে আসবে।
কথার মাঝেই অশ্রু দাড়িয়ে যায়।মাথায় হাত রেখে নিমজ্জক চোখে বলল,
” আমার প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে।তোমার সাথে পরে কথা বলবো।”
বলেই রুমে চলে আসে।দরজা বন্ধ করে।ওড়না বিছানার একপাশে ফেলে ফুঁপিয়ে উঠে।সহস্র অশ্রু ধারা চোখের কিণার বেয়ে বেয়ে পড়তে থাকে।গাল দু’খানা লাল টকটকে হয়ে যায়।হাত-পা নিস্তেজ হয়ে আসে।বুকফাটা কান্না করতে ইচ্ছে হয়।খুব খুব ইচ্ছে হয়।পারছে না।আঘাতটা কলিজায় এমনভাবেই লেগেছে জোরে চিৎকার করার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না।বিয়েটা যদি বিপুলের সাথেই হয়ে যায় তাহলে এতদিনের বুকে জমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলো বড্ড কষ্ট পাবে।বুনা স্বপ্নটা কাচের মতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে অভিশাপ দেবে আর বলবে-কেন তখন এলে?এখন যে পারছি না চলে যেতে।ভালোবাসা এভাবে টিকিয়ে রাখা যায় মনকে শক্ত রেখে নিজের স্বপ্ন,স্বপ্নের মানুষটাকে বুকে ধারণ করে নিজের করে নিতে হয়।যেভাবে হোক যে কোন মূল্যে হোক!আর তুমি?পারলে নিজের স্বপ্নকে নিজের করে নিতে।নিজের করে একটুখানি ভালোবাসতে!পারলে না, পারলে না।এখন কষ্টটা আমিই পাচ্ছি।তুমি নও…
ভাবতে ভাবতে অশ্রু ফুপিয়ে যায়।মন থেকে বারংবার গ্লানির আর্তনাদ কম্পন করে উঠে অরুন,অরুন,অরুন,অরুন!অরুন ছাড়া এ জীবন অর্থহীন।উষার মরুভূমি।না তাকে কোনোভাবে হারিয়ে ফেলতে পারবো না।তাকে আমি ভালোবাসি,আমি শুধুই তার বিপুলের নয়!

বিকেলের একরাশ মৃদু বাতাস পুরো ছাদ জুড়ে বয়ে যায়।শীতল হাওয়ায় গুটিসুটি মেরে বিপুল ছাদের কর্নারের বেতের চেয়ারটায় বসে আছে।তার এলোকেশ গুলো বাতাসের দোলায় দোলে দোলে নেতিয়ে পড়ে আবার আগের সামন্জস্যতায় স্থবির হয়।সে শীতকণা গাঁয়ে গেঁথে ধোঁয়া উড়া চায়ে চুমুক লাগায় আর দিকে দিকে ফোনে বন্ধুদের সাথে কথা বলে।সকাল থেকে তার মোবাইল ভরা ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে।এই কল যায়,এই আসে।রেস্ট নেওয়ার জো টুকুও কুলচ্ছে না।বিপুল বিরবির করেও অক্লান্ত।এতদিনের একপাক্ষিক ভালোবাসার প্রিয়সীকে ক’দিন পরে তার নিজের করে পাবে।এতো তার কাছে মেঘ না চাইতে পানির মতো।শিরায়-উপশিরায় সুখের আগমনী হচ্ছে তার মাঝে।।বিপুল অন্যান্য দিন থেকে আজকের দিনটিতে সবথেকে বেশি খুশি।এমন খুশির দিন তার জীবনে দ্বিতীয়টি আর আসেনি অথবা কখনো আসবে বলে মনে হয়না।অশ্রুর বাবা যখন তাকে অশ্রুকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।তখন সে কিছুটি না ভেবে ফেলফেল করে রাজি হয়ে যায়।জড়েসড়ো বন্ধুদের কল লাগাতে থাকে।বলতে থাকে তার ভালোবাসার কথা,তাকে বউ করার কথা। চট্রগ্রাম ও মা-বাবাকে কল করে জানায় বিষয়টা।উনারাও রাজি হয়ে যান।কারণ উনারা আগ থেকেই জানতেন বিপুল অশ্রুকে খুব ভালোবাসে।তাই ডিসাইড করেন অশ্রুর বাবার সাথে কথা বলে শীঘ্রই ঢাকা আসবেন। তাদের বিয়ে পড়িয়ে আবার ব্যাক করবেন৷
সন্ধের শেষ মাথায় চুপিসারে অরুন অশ্রুর রুমে প্রবেশ করে।গলায় খাঁকারি টেনে অশ্রুকে তার উপস্থিতির জানান দেয়।অশ্রু তখন আধশোয়া চোখদুটো বুঁজে আছে।রুমে খচখচ শব্দের আওয়াজ শুনতেই চোখ মেলে বামদিকে ফেলে।বিপুল পকেটে হাত গুঁজে দাড়িয়ে।বিপুলকে দেখামাত্রই বিছানা থেকে নেমে যায়।হর্ণপায়ে বেলকনিতে চলে যায়।বেলকনির দরজা ঠেসে বলল,
“আপনি আমার রুম থেকে যান।প্লিজজ আপনার সাথে আমার কথা বলতে একদম ইচ্ছে হয় না ”
বিপুল ধাপে ধাপে পা ফেলে বেলকনির দরজা সড়াৎ খুলে অশ্রুর দিকে তাকিয়ে ভ্রঁ নাচায়।বলল,
“তোমার পছন্দ দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না।আমি ভালোবাসলে হলোই।একপাক্ষিক ভালোবেসে বিয়ের প্রস্তাব পেলাম।এবারতো আরো হপ্পে খেলা।”
“প্লিজজ যান তো!আমি আপনার মুখও দেখতে চাইনা।”
“উফস,বেইবি এতো রাগ করোনা।তবে তুমি রাগলে তোমাকে হেব্বি লাগে সিরিয়াসলি। ”
“আপনার লজ্জা বলতে কিছুই নেই?”
“আহা, তোমাকে লজ্জা পেয়ে তো কোনো নেই বেইবি।কারণ তুমি কিছুদিন পর আমার বউ হবে।”
“সেটা শুধুই কল্পনা।ভুলে যান আমাকে বউ করার ”
“ফুপা জান যা বলেন তাই হবে।তোমার বামহাতি কথা কারো কানে গুঁজবে না।এবার ভদ্র মেয়ের মতো নববধূ হবার প্রস্তুতি নাও।গেলাম।”
বলেই ঘাড় ঘুরায় হঠাৎ কি ভেবে আবার পিছনে তাকায়।বলল,
“ওহ হ্যাঁ,তোমাকে আজ মেরুন কালার ড্রেসে বেশ লাগছে।নজর লেগে যাবে।পারলে কানের নিচে কাজল লেপে নিওও।বায়য়য়।”
বিপুল এক সড়াৎ-এ রুমের বাইরে চলে যায়।অশ্রু স্বস্তি পায়।যাক গাধা সামনে থেকে চলে গিয়েছে।
রুমে ঢোকে মোবাইলটা হাতে নেয়।ফোন এ্যাপ-এ গিয়ে ডায়াল নাম্বারগুলো একে একে দেখতে থাকে।চোখে পড়ে অরুনের নাম্বার।ইচ্ছে হয় তাকে কল দিতে।কিন্তু এখন কল দিলে নাম্বার বন্ধ পাবে।কল দিয়ে লাভ নেই।
খামেখা মোবাইল ঘাটাঘাটি অকাজের ভেবেই বিছানা রাখে।পরক্ষণে কী ভেবে যেন মোবাইলটা আবার হাতে নেয়।এবার আর কল করা থেকে বিরত থাকেনি উল্টো ডায়ালিং এ টাস করে।ওপাশ থেকে ভেসে আসে-এই মুহূর্তে আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি সংযোগ দেবার সম্ভব হচ্ছে না।অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন।অশ্রু ব্যর্থমনে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।মোবাইলটা আবার আগের জায়গায় রেখে দেয়।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৪৬
রোকসানা আক্তার

সন্ধে সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট।দরজায় বারংবার কলিংবেল বাঁজছে।এখন বাসায় কে আসতে পারে ভেবে পারুল বেগম দরজার দিকে এগিয়ে যান।কপাল,ঘাড়ে ঘামের চুপচুপ বিন্দু।সন্ধের নাস্তা রেডি করছিলেন তাই কিছুটা গরম গরম লাগছে।তিনি ব্যস্তমনে দরজা খুলেন।সামনে তাকিয়ে মুখের মসৃণ চামড়া কুঁচকে আসে ।খুশিমনে বলেন,
“স্মৃতি তুমি?এ অসময়ে?”
“জ্বী,আন্টি।অশ্রুর সাথে একটু দেখা করতে আসছি।”
“আচ্ছা আচ্ছা।ভেতরে আসো।”
স্মৃতি সম্মতি দিয়ে হাসি হাসি মুখে ভেতরে ঢোকে।পারুল বেগম দরজার ছিটকানি লাগাতে লাগাতে বলেন,
“রুমে যাও মা।ও রুমেই আছে।”
“জ্বী,আন্টি যাচ্ছি।”
স্মৃতি টাসটাস পায়ে অশ্রুর রুমে ঢোকে।অশ্রু তখন সাহিত্যিক বই ঘাটাঘাটি করছিল।মন ভালো নেই।তাই অবসর সময়েতে বইয়ে একটু আধটু মুখ গুঁজে রাখলে মনের অশান্তিটা একটু হলেও কমবে।স্মৃতি অস্থির মনে বলে উঠলো,
“অশ্রু প্রবলেম হয়ে গেছে!”
এহেন শব্দে পুরো রুমে আওয়াজটা আবার রিপিট হয়।অশ্রু বই থেকে মুখ সরিয়ে পাশ ফিরে তাকায়।স্মৃতি দাড়িয়ে।এমন ধু ধু সন্ধে স্মৃতিকে দেখে অশ্রু কিছুটা অবাক হয়।বই বন্ধ করে বলল,
“তুমি?”
স্মৃতি ধাবাং পায়ে বিছানায় এসে বসে।ভয়ার্ত মনে বলল,
“জানো অনেক বড় সমস্যা হয়ে গেছে।”
“কী সমস্যা।”
“থানায় কে জানি আমার নামে রিপোর্ট করেছে।শুধু আমার নয়।অনেকের নামেই।এসপিকে জিজ্ঞেস করলাম কে এহেনটা করলো।উনি বাঁকা হেসে বলেন, স্যরি ম্যাম তা বলা যাবে না।হাউ ফানি!দোষীর সাথে আমাদেরও ইনভলভ করেছে।তুমি বুঝতে পারছো ওই অরুন মেয়েদের মান-সম্মান ছিঁড়েখুঁড়ে এখন পুলিশ উল্টো আমাদেরও দোষী সাব্যস্ত করছে।ভুল নাকি একা ওর নয়,আমাদেরও আছে।আমাদের কী দোষ?আমরা মেয়েরা মুখফুটে কিছু না বললে অবলীলায় আমাদের বিরুদ্ধে যা তা বলবে এতোটা হাবু আমরা নয়।সোঁজা মামলা করবো,মামলা।”
অশ্রু একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এবার নড়েচড়ে বসে।শান্ত গলায় বলল,
“কোনো মানুষ অনৈতিক কাজ করলো।আমরা জানি সেটা অনৈতিক কাজ।আমাদের ইসলামে অনৈতিক কাজগুলোকে সম্পূর্ণ হারাম বর্ণিত হয়েছে।ফলপ্রসূ পরকালে তার জন্যে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তির বিধান রয়েছে ।তা জেনেও যদি আমরা ওই ব্যক্তিটার সাথে মেলবন্ধন হই তাহলে সমান দোষী আমরাও নয়?
“দোষী বলা যেতে পারতো যদি ওই ব্যক্তিটা এসবে প্রপোজাল না করতো!”
“এ হলো তোমার একপাক্ষিক চিন্তা।প্রপোজাল করলো তাই বলে তুমিও রিসিভ করবে এমন হয়না।নিষেধ করার নিয়ম নেই নাকি?”
স্মৃতি অশ্রুর কথায় ভ্রু কুঁচকায়।অশ্রুর কথাগুলো কেমন উদ্ভট উদ্ভট মনে হচ্ছে তার।তাই সে স্থির থাকতে না পেরে অশ্রুকে পাল্টা প্রশ্ন করলো।বলল,
“তুমিওতো গিয়েছিলে তারসাথে রাত কাটাতে!তাহলে দোষী তুমিওতো।”
অশ্রু সামান্য হাসার চেষ্টা করে।তা দেখে স্মৃতির রাগ হয়।কঠিন গলায় বলল,
“আমার কথার জবাব দাও!?”
“আমার রুমডেট ছিল একটা বাহনা মাত্র সেটা তুমি জানো।রুমডেটতো আর করিনি।”
“করেছো কি করো নি বিলিভ করবো কিভাবে?স্বচোখে দেখলে বিশ্বাস করতাম।অরুনের মতো স্মার্ট ছেলেকে কেউ এমনি এমনি ছেড়ে দেবে সেটাতো আনবিলিভেবল।”
“পৃথিবীর সব মেয়েকে কি এক?সব মেয়েই কি রূপ-টাকা-পয়সার প্রতি লোভাতুর?”
“হতেও কতক্ষণ বৈ-কি।একটা সুন্দর ছেলে,টাকা-পয়সার গাদা দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে বর্তমানে এমন মেয়ে জিরো পার্সেন্ট।আমি আমার নিজচোখে আমার কাজিনকে এমন পরিবর্তন হতে দেখেছি।সে একটা গরীবের ছেলেকে ভালোবেসেছিলো।কত জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসতো রাজি হতো না প্রেমিকের কথা ভেবে।এভাবে প্রায় বিশটা সম্বন্ধ রিজেক্ট করেছে।হুট করে বাসায় একটা সম্বন্ধের আগমন ঘটে।যেমন হাড়িভরা টাকা পয়সা,তেমনি ছেলেও।আর হুড়মুড় করে ওই সম্বন্ধ একসেপ্ট করে।সে যে সম্বন্ধটা একসেপ্ট করবে তা তার পিতামাতার আকাশকুসুম কল্পনা ছিল মাত্র।উনারা জানতেন সে ওই রিহাবকে ভালোবাসে।কোনো বিয়েতে সম্মতি হবে এমন মেয়ে সে নও। আর জানো এখন কি সুন্দর সংসার করছে বিয়ে ওই ছেলের সাথে।আর প্রেমিক রাতভর চোখের জল ফেলে কেঁদে কেঁদে একাকার হচ্ছে।”
এমন লেকচার শুনে অশ্রুর প্রচন্ড রাগ উঠে যায়।মন চায় মুহূর্তে একে চিবুতে চিবুতে এর রস চুষতে।ফাজিল মেয়ে কোথাকার।পৃথিবীর সবাইকে নিজের মতো ভাবে তবে এর সাথে কথা বাড়ানো অনুচিত।যে বোঝে না তারসাথে বেকার তর্ক করে লাভ নেয়।ছেচেফুচে নিজের দাম্ভিকতাকেই উপস্থাপন করবে।ভেবেই অশ্রু হাত উঁচিয়ে বলল,
” স্মৃতি, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্যা ইন দিস ম্যাটার।প্লিজ স্যা আদার্স।”
স্মৃতি ভ্রম হয়।অশ্রুর মাঝে পরিবর্তনের দিকটা তার চোখে পড়ে।সেও পুলিশের সাথে বারংবার আঙ্গুল নাচিয়ে বলছে দোষ বিপরীত পক্ষেরও।রিপোর্ট এ করেনি তো?তবে সে কেন রিপোর্ট করবে।তার বাবাই তো রিপোর্টগুলো নিউজ করেছে!দোষতো এদেরও আছে!স্মৃতির এমন ভাবাবেগের মাঝে রুমে বিপুলের আগমণ।বিপুল সং দাড়িয়ে বলল,
“হেই তোমরা মিট করছো?”
স্মৃতির টনক নাড়ে।পাশ ফিরে তাকায়।মুহূর্তে চোখমুখ কুঁচকে আসে।বসা অবস্থায় দাড়িয়ে যায়।বিপুল স্মৃতিকে দেখে চোখদুটো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।এদের হাবভাব দুজন দুজনকে বোধহয় আগ থেকে চেনে।স্মৃতি ব্যাগটা হাতে নিয়ে স্থবির থাকে নি।তাগাদা পেড়ে বলল,
“তোমার সাথে সম্পূর্ণ বিষয়টা পরে ডিসকাস করবো।এখন গেলাম।
” বলেই দাড়িয়ে থাকেনি।হর্ণপায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।অশ্রুর বিষয়টা গোলামাল লাগে।স্মৃতি বিপুলকে দেখে চলে গেলো।আবার স্মৃতিকে দেখে বিপুলেরও চোখদুটো টকটকে লাল হলো। কি এমন কারণ থাকতে পারে যে স্মৃতি এভাবে চলে গেলো।
“বিপুল ভাইয়া স্মৃতিকে আপনি চেনেন?”
বিপুল অপ্রস্তুত হয়ে যায়।গলা টেনে টেনে বলল,
“ন-না তো।আ-মি কিভাবে চিনবো।জীবনে দেখেছি বলে মনে হয় না।”
“ওহ।”
বলেই অশ্রু চুপ হয়ে যায়।এ যদিও না বলে ব্যাপারটা স্মৃতি না বললে এর বন্ধুর থেকে জানা যাবে।অশ্রু আর কথা না বাড়ায় বিপুল নিজ থেকে আবার বলল,
“তোর কেন এমনটা মনে হলো যে ওকে আমি চিনি?”
“জানি না।আসতে পারো।পড়বো।”
“পড়ার জন্যে তো অনেক সময়ই থাকে। যাইহোক আমাকে একটা উপন্যাস ধার দে।”
“কোনটা?”
“সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন।”
“দ্বিতীয় তাঁকে চেক করেন পেয়ে যাবেন।”বলেই বইয়ের পেইজ খুলে।
“থ্যাংকস।”
বলেই বিপুল বইয়ের আলমারির দিকে এগিয়ে যায়।দ্বিতীয় তাঁকে বইটা খুঁজতে গিয়ে গলা উঁচিয়ে অশ্রুকে বলল,
“পাইনি।এসে বের করে দে।”
“ভালোভাবে খুঁজে দেখেন।”
বিপুল তাঁকটা শব্দ করে গুঁটিয়ে-ঘাঁটিয়ে ব্যর্থ মনে আবার পেছনে ফিরে বলল,
“পাইনি।তাড়তাড়ি খুঁজে দে তাহলেতোএই অসহ্যকট ব্যক্তিটা রুম তোর থেকে বেরিয়ে যাবে।”
অশ্রু মুখে একগাদা বিরক্তি চাপিয়ে বিছানা থেকে নামে।আলমারীর সামনে এসে দ্বিতীয় তাঁকে চোখ রাখতেই লাল কপাটের বইটির দিকে চোখ চলে যায়।সুন্দর করে লেখা-“সাতকাহন।”বিপুল যে মিথ্যে বলছেে তা অশ্রুর বুঝতে সমস্যা হয়নি।সে বইয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে আড়নয়নে বিপুলের দিকে তাকায়।বলল,
“এই যে বই!”
বিপুল দেখেও না দেখার ভান করে সিউরিটি হতে অশ্রুর পেছনে এসে দাঁড়ায়।বলল,
“ওহ এখানে?”
“রাতকানা সাজলে দেখবেন কীভাবে?”
বিপুল উত্তর দেয়নি।তার দু’চোখ যায় এই মুহূর্তে অশ্রুর ঘাড়ের দিকে।ধবধবে সাদা ঘাড়ে কালো কেশ ছড়িয়ে।বিপুলের ইচ্ছে হয় সেখানে তা ছুতে।নিজের গলদ মাখা আবেগটাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে সে তার দু’নাকের ফাঁক খাঁড়া করে। ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হয় অশ্রুর ঘাড়ের সমান্তরালে স্পর্শহীন।নাক টেনে সুঘ্রাণ নিতে থাকে।মন আমোদিত সুভাস এই মানবীর দেহে।মন হারিয়ে যায় হাজারো গোলাপ,বকুল,গাদা,রজনীগন্ধার সুভাসের বুকে।
বিপুলের সাড়াশব্দ না পেয়ে অশ্রু পেছনে তাকায়।বিপুল তাড়াতাড়ি মাথা সরিয়ে নেয়।স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে হেসে দেয়।ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“অশ্রু তোর কাছে “লাভ ক্যান্ডি” বইটা আছে?”
“নাহ।”
“থাকলে বেশ ভালো হতো।সেখানে স্বামী-স্ত্রীর রোমাঞ্চ, অভিনয়,রাগ-অভিমান,বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ইত্যাদি বিষয়গুলো থাকে।”
“তা দিয়ে আমি কি করবো?”
“ক’দিন পরতো তুই বধূ হবি।তাই এসব বিষয়ে জেনে রাখা ভালো!”
“খামোখা আজাইরা কথাবার্তা। ”
বলেই অশ্রু স্থান ত্যাগ করে রুমের বাইরে চলে আসে।

রাত দশটা।অশ্রু ড্রিম লাইট বন্ধ করে ঘনঘটা অন্ধকারের মাঝে বিছানায় বসে আছে।তার বিমূর্ত মুখটা অসাড় হয়ে আছে। মন কেমনের অনুভূতিগুলো শহরের রাস্তার দু’পাশের অয়ন আলোর মতো বুকটাও ঢিপঢিপ করছে।ডিনার সময় বিপুল বলল,কাল তার মা-বাবা আসছে।আলাউদ্দিন খবরটা শুনে আহ্লাদে আটখান।খুশির তালে তালে বললেন পরসু দিনই মেয়ের বিয়েটা ভালোয় ভালোয় সম্পূর্ণ করবেন!এইকথাগুলো অশ্রুকে মুহূর্তের জন্যে নিস্তব্ধ করে দিল।শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।সময় বেশি নেই।মাত্র দু’রাত!আর এই দু’রাত।দু’রাত কেটে গেলেই বিপুল নামের ওই জবরদস্যুর কাছে নিজেকে বলি হতে হবে!কীভাবে পারবে তা মেনে নিতে সে?সম্ভব নয়।মোটেও সম্ভব নয়।
ওখান দিয়ে অরুন জেলে।মাঝখানে সে অথৈ নদীর মাঝখানে দাড়িয়ে যেকোনো মুহূর্তে ডুবে যাবে নিজের সব ইচ্ছে,আশা,আকাঙ্খা,স্বপ্ন।ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে উঠে অশ্রু!মাথাটা দুই হাটুর গুঁজে গলদশ্রু ফেলতে থাকে একের পর এক!
চারদিকে শুনশান নিরবতা।সাইলেন্ট মুডে রাখা ফোন আলো ছড়িয়ে যায়।অশ্রুকে মাথাতুলে সেদিকে তাকায়।একটা আননউন নাম্বার থেকে কল এসেছে।ইচ্ছে হয় না আননউন নাম্বারে গ্যাঁনগ্যাঁন করতে।রিসিভ হলেই বলবে,হ্যালো এটা কি মোহাম্মদপুর? আপনি কি মিস্টার জোহা বা অন্যকারো নাম বলবে।রং নাম্বার গুলো এরকই।বিশেষত ফ্লেক্সিলড দোকানে যেয়ে টাকা লোডিং করলে এমন বিপাকে বশীভূত হতে হয়।এদের তো খেয়েদেয়ে কাজ থাকে না।দোকানে সময় দেবে আর মেয়েদের সাথে টাংকি মারবে!
অশ্রু মোবাইলটা হাতে নিয়ে কটাং কটাং করে কলটা কেটে অপোজিটে ছুঁড়ে ফেলে।আবারো আগের বিষন্নতায় নিমজ্জক হয়। তবে তা বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি।সেই কল আবারো আসে..!একবার নয়। একে একে তিনবার বাজে।চতুর্থবার বাজতে গেলেই অশ্রু বেদম প্রহরের মতো কল রিসিভ করেই বলল,
“এটা রং নাম্বার! রাখতে পারেন!”
বলেই কাটতে যাবে।কিন্তু তার আগেই ওপাশ আসে ভেসে আসে,
“হ্যালো,অশ্রু আপু?আমি আবরার।কলটা রাখবেন না প্লিজ? ”
অশ্রু হুড়মুড় হয়ে অপ্রস্তুত বোধ করে।মনে মনে একটা জিব কেটে ভাবে,ইস অনেক সময় রং নাম্বারগুলোও কাজে লাগে।
অশ্রু ভাবনাটা ঝেড়ে পরমুহূর্তে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছো আপু?কি অবস্থা তোমার?”
“জ্বী,ভালো।”
“ভালো বলাটা খুবই গাম্ভীর্য শুনাচ্ছে।মন খারাপ নাকি?”
“নাহ নাহ মন খারাপ হতে যাবে কেন।” বলেই হাসার চেষ্টা করে।
“তো আপু, বাসার সবাই কেমন আছে।”
“জ্বী,ভালো।”
“ওহ।ডিনার করেছো?”
“হু।”
“পরিক্ষা কবে তোমার আপু?”
“নেক্সট মান্থ।”
“প্রিপারেশন কেমন?”
“চলে আর কি!”
“আপু আমার মন বলছে তোমার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।অরুনের থেকে জানা হাসিখুশি মেয়েটার মুখের কথা গুমোট হয়না।মন বিষন্নতায় থাকলেই তাদের কন্ঠধ্বনি পরিবর্তন হয়।”
অশ্রু প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
“অরুনের কি অবস্থা?জানেন কিছু?দেখা হয়েছে?”
“জ্বী।আজই দেখা করে আসলাম।দেখে বুঝা গেল মনের অবস্থা তেমন ভালো নয়।”
অশ্রু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তারপর বলল,
“ওহ।আচ্ছা আমার নাম্বার পেয়েছেন কিভাবে?”
“জ্বী আপু,অরুন দিয়েছিল জেলে যাওয়ার আগে।বলল তোমার খোঁজ নিতে।কিন্তু আজ খোঁজ নিয়েও সঠিক খোঁজ-খবরের সন্ধান মিললো না।” শেষ কথাটি বলেই হাসলো আবরার।
“বললামতো ভালো।”
“ভালো থাকা আর না থাকা দুটো কথাতেই মানুষের বলার ভঙ্গিমাই বলে দেয় সে কতটুকু ভালো।”
“আরেহ না আমি ভালো আছি।”
“সত্যিটা বললে ভালো হতো।অন্তত অরুনকে জানাতে পারতাম।”
“ওহ।”
“তা ঘুমান।পরে আবার কল করে খবর নিতে পারি।”
“আচ্ছা শুনুন?”
“জ্বী বলো,আপু?”
ভাবছিলো অরুনকে কবে ছাড়া পাবে সে ব্যাপারে কথা বলবে।কিন্তু বলেও দমে যায়।আবরার যদি উল্টো রিয়াক্ট করে ফেলে তখন!ভেবেই সংগোপনে একটা ঢোক গিলে।বলল,
“নাহ কিছু ভাইয়া।” হেসে হেসে।
“মিথ্যে বলো কিন্তু আপু!তুমি নিশ্চয়ই কিছু বলতে চেয়েছো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে চেয়েছি।কিন্তু বলতে যেয়ে ভুলে গেলাম।আচ্ছা তাহলে রাখলাম।একটু পড়বো।”
“আচ্ছা।”গম্ভীর শব্দ করে বলল।
অশ্রু কেটে দেয়।বুকে হাত রেখে এক ক্লেশ দম ছাড়লো।

চলবে….
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here