ভালোবাসাটা_ঘৃণার পর্ব ১+২

–“ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমাকে। আমার মাথায় খুব লাগবে। সহ্য করতে পারব না। আমার বাঁধন খুলে দাও। নিশাপাখি কোথায় তুমি?”
ভেসে আসছে আর্তনাদ। মেন্টাল হসপিটালের অন্ধকার ঘর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ কিছু মানুষের শরীরে কাটা দিচ্ছে। অন্ধকার ঘরটির প্রত্যেকটি দেয়াল কাঁপছে। অনেকে সহ্য করে নিয়েছে এসব আর্তনাদ। কেননা গত একবছর ধরে এমনই চিৎকার শোনা যায় রাতে।
মেন্টাল হসপিটালে থাকা একজন মেন্টাল পেশেন্ট বলে উঠল….
–“এতো চিৎকার কিসের? মাঝে মাঝে আওয়াজটা পাই।”

কথাটা বলে কানে হাত দিয়ে গুঁতো দিতে থাকল। সব মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের জায়গা এই একটাই। ওপর পাশে বেডে পড়ে থাকা একজন বড় বড় চোখ করে বলল…..
–“আরে জানিস না? একটা রোগী আছে। সে তো পাগল।”
–“কি বলিস? কিভাবে পাগল হলো?”
–“ভালোবাসা রে ভালোবাসা। ভালোবাসা একজন মানুষরে পাগল করে ছাড়তে পারে। এইটা তার প্রমাণ। ভাগ্যিস কাউকে ভালোবাসার আগে আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিছে। নাহলে তো পাগল করে ছাড়ত।”
বেডের ওপর শুয়ে থাকা রোগীরা উল্টো হয়ে শুয়ে কথাগুলো গড়গড় করে বলল। একেই বোধহয় বলে পাগলের প্রলাপ। পাগলই বলছে পাগল করে ছাড়ার কথা। কি বিচিত্র পৃথিবী!!

২ বছর পর…..
বাজার থেকে ফিরছি সবে। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এখনো পুরোটা যায়নি। আমার পাশে হাঁটছে অহনা। আমি মায়াবিনী। আমার পাশে যে হাঁটছে সে আমার বন্ধু অহনা। আমার থেকে মনে হয় যদিও কয়েক বছরের ছোট। তবুও বেশ বন্ধুসুলভ। মেয়েটা অনাথ। মা-বাবা কেউ নেই। এমন একটা মেয়ে যে আমার সঙ্গ দিয়েছে সব সময়। ওকে তাড়া দিয়ে বললাম….
–“পা তাড়াতাড়ি চালাও। নয়ত বাড়িতে একজন আছে না? চিৎকার করে একাকার করে ফেলবে। মেঘ দার কান আর কান থাকবে না। খান খান হয়ে যাবে।”
আমার কথায় অহনা বিস্তর হাসলো। হাসলাম আমিও। তবে আমার হাসিটা শুষ্ক। যেটা আমি নিজেই জানি। অহনা হাসি থামিয়ে বলল….
–“উহু, খান খান হোক না। আমরা মজা লুটব। মায়াব….”

কানে একটা মৃদু চিৎকার ভেসে এলো। থেমে গেলাম। সেই সঙ্গে অহনার কথাও থামিয়ে দিলাম। আমার চোখজোড়া মূহুর্তেই ছোট থেকে বড় হয়ে গেল।
–“অহনা, তুমি একটা আওয়াজ পেলে?”
–“না তো!”
বিরক্ত হলাম। কপাল কুঁচকে বললাম….
–“তোমার কানে তালা লাগানো।”
সাইডে তাকালাম। পাহাড়ে ওঠার পথ। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল কিছু দৃশ্য। গা নাড়া দিয়ে ওপরে তাকালাম। আমার আশঙ্কা ঠিক ছিল। একটা মেয়ে ওপর থেকে চিৎকার করছে। তার ওড়না উড়ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। অহনাকে হাত দিয়ে ইশারা করলাম। ওপরে তাকাতে বললাম।

দ্রুততার সঙ্গে বললাম….
–“ওখানে মেয়ে আছে। মনে হচ্ছে ও কোনো বিপদে পড়েছে। বাঁচাতে হবে।”
কথাটা বলে আর দেরি করলাম না। সেই পাহাড়ি রাস্তার দিকে ঘুড়ে ছুটতে লাগলাম। পেছন থেকে অহনার জোর গলায় বলে উঠল….
–“এই শোনো, যেও না। এই পাহাড় ভূতুড়ে। হয়তো ভূতই আমাদের ডাকছে।”
খানিকটা রেগে গেলাম ওর কথায় কিন্তু পা থামালাম না। হাঁটতে হাঁটতেই বললাম….
–“ভূতুড়ে হলে সেদিন ভূতেরা এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটালো না কেন? যেটাতে আমরা বাঁচতে পারি? তুমি না এলে না এসো। আমি যাচ্ছি।”

দেরি করা যাবে না। এর ফলাফল ভয়ানক হতে পারে। এই পাহাড়টাই তেমন কেউ আসে বা যায় না। সবাই হরোর বা ভূতের পাহাড় মনে করে। যার কারণে এখানে বেড়ে চলেছে অন্যায়। যেটাকে মানুষ মনে করছে শুধুমাত্র ভূতের কর্মকান্ড!
হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। হাত-পা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ভয় করছে। আমার ব্যাগে সবসময় একটা করে ছুরি থাকে। বিপদ কখন কোন দিক দিয়ে আসে সেটা কেউ বলতে পারবে না।
উঠতে উঠতে প্রায় পনেরো মিনিট লেগে গেল। হাঁপাতে থাকলাম আমি। কপালের ঘাম মুছতেই সামনে তাকাতেই দম বন্ধ হয়ে আসল আমার। হাঁপানো বন্ধ হলো। সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

দুটো আমেরিকান ছেলে একজন মেয়ের ওপর উঠে পড়ে লেগেছে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে ও বাংলাদেশী। ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। এই ঘটনা যেন বহু বছর আগের ঘটনার মতোই। চোখ জ্বলতে শুরু করল আমার। ক্রমশ নিশ্বাস বড় হতে শুরু করল। ছুরিটা শক্ত করে হাতে ধরলাম। নিজের গায়ে থাকা লং কোটের হাতা জড়িয়ে নিলাম। স্থির করলাম। তৎক্ষনাৎ ব্যস্ততার সঙ্গে ছেলে দুটো দড়ি দিয়ে মেয়েটাকে বাঁধতে শুরু করল। এবার কোনো পদক্ষেপ নিতেই হবে। নয়ত আমার চোখের সামনে আবারও বড়সড় ভুল হয়ে যাবে।

শেষবারের মতো বড় শ্বাস ফেলে পা টিপে টিপে ওদের কাছে গেলাম। মেয়েটা চাপা আর্তনাত করছে।
–“প্লিজ লিভ মি। ডোন্ট ডু দিস।”
অমানুষের ন্যায় হেসে উঠলো দুটো ছেলে। রাগে গায়ের রগগুলো যেন শিরশির করে উঠল। মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই ওরা খেয়াল করার আগে নিজ কৌশলে পা এগিয়ে ওদের পেটে লাথি মারলাম। কুকিয়ে নিচে বসে পড়ল ওরা। মেয়েটা যেন তার প্রাণ ফিরে পেল। ওর চোখেমুখে আতঙ্ক জড়িয়ে থাকা পর্দা সরে গেল। আমার পা জড়িয়ে ধরল ও। আমি ব্যাপারটাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
–“আপনি আমাকে বাঁচান। নয়ত এরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমার সম্মান কেঁড়ে নিবে। আপনি বাংলাদেশীই তো না?”

আমি হ্যাঁ বলতে তার আগেই আমাকে পেছন থেকে জোড়ে ধাক্কা দেওয়া হলো। পড়ে গেলাম মেয়েটার ওপর। ফর্সা ছেলেগুলোর চোখমুখ লাল হয়ে আসছে। একজন দাঁতে দাঁত চেপে বলল….
–“ইউ স্টুপিড গার্ল!”
বলেই এগিয়ে আসতে লাগল। হাত কাঁপছে। হাতের কাছে পড়ে আছে ছুরি। সেটা হাতিয়ে মূহুর্তেই ঘটিয়ে ফেললাম ভয়ানক কান্ড। কাঁধে ছুরি বসিয়ে দিলাম। কাঁধের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠল ছেলেটা। চোখজোড়া আমার সরু হয়ে এলো। তখনই ঘটল অহনার আগমন।

ও এসেই এসব দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখেমুখে এসে পড়ল রক্তের ফোঁটা। ভয় পেয়ে গেল আরেকটা ছেলে। সামনে থাকা ছেলে কাতরাচ্ছে। উঠে দাঁড়াতেই দৌড়াতে লাগল ছেলেটা। আমি দ্রুত পাথর তুলে ছুঁড়ে মারলাম ওর পায়ে। থেমে গেল ও। এতো সহজে এদের দুজনকে ছাড়তে রাজি নেই আমি কোনোমতেই। পেছন থেকে ছুরি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওই ছেলেটার কাঁধেও ছুরি দিয়ে আঘাত করলাম।
অহনা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল….
–“কি করছো? প্রবলেম হয়ে যাবে।”
–“যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে অহনা। এখন এদের তো ছাড়ব না। কালকে নিজের যোগ্য শাস্তি পেয়েই ছাড়া পাবে এরা। নয়ত না।”
অহনা আমার হিংস্র কন্ঠে ভয় পেল। আমি তোয়াক্কা করলাম না মটেই।

পেছন ফিরে তাকালাম। ওই মেয়েটা এখন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় আমাকে দেখেও ভয় পেয়েছে। এগিয়ে যেতেই কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল ও। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম….
–“আর পেছনে যেও না। পড়ে যাবে আমার মতো।”
বলে হাসলাম। মেয়েটা অবাক নয়নে তাকাল। তারপর বিস্মিত হয়ে বলল….
–“ওরা যা করেছে তার ফল পাবে। মরবে না বেঁচেই থাকবে। এখন ওদেরকে বাঁধতে সাহায্য করতে পারবে?”

মেয়েটা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। আমি ওর উত্তরের আশায় থাকলাম না। ওরা পালিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। রক্তে মাখা ছুরি নিয়ে দৌড়ে গেলাম ওদের সামনে। হুমকি দিয়ে বললাম….
–“Kneel down or die.”
ওরা দুজনে দুজনের দিকে তাকাতাকি করে অসহায় ভঙ্গিতে বসে পড়ল। অহনার দিকে তাকিয়ে কিছুটা জোর গলায় বললাম….
–“তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? নাকি সব দেখতে এসেছো?”
অহনা ঢক গিলে এগিয়ে এলো। ছেলে দুটো কিছুই বুঝলো না। ছেলেগুলোর চোখজোড়া ভয়ে ছেয়ে গেছে। বার বার দুজনে নানানরকম কথা বলছে সেই সঙ্গে সরি বলছে। আমি মানার পাত্রী নয়।

অহনা দড়ি দিয়ে বাঁধতেই চেঁচিয়ে উঠল ওরা। আমি একজনের গলায় ছুরি আর একজনের গলা একহাত দিয়ে চেপে ধরে বললাম….
–“I will not kill you. Don’t force me to kill you!”
আমার কথায় সায় দিল ওরা। বেঁধে ফেললাম চটপট। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা জ্যাকেট পড়ে নিয়েছে। ওকে নিয়ে সেখান থেকে আসতে লাগলাম আমরা।
পেছন থেকে ছেলে দুটো বলে উঠল….
–“প্লিজ হেল্প।”
চোখ ফিরিয়ে তাকালাম একবার। এদের হাতে বন্দি থাকা মেয়েগুলোর অবস্থাও এমন হয়। আফসোস ওরা বোঝে না। আজকে মেয়েগুলোর অবস্থা ওদের বুঝতে হবে।

সবশেষে পাহাড় থেকে নেমে ওই মেয়েটাকে বললাম…..
–“ভবিষ্যতে নিজে কাছে ছুরি রাখবে। কাজে লাগবে।”
মেয়েটা হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালো। ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়ালো নিজের পথে। আমি আর অহনাও উল্টো হাঁটতে থাকলাম। অহনা হাফ ছেড়ে বলল….
–“তোমার প্লানিংটা কি বলো তো?”
আমি মলিন হাসলাম। আনমনে বললাম…..
–“কিছুই নয়। কালকে হর্স রাইডিং প্রতিযোগিতা আছে না?”
–“হ্যাঁ।”
আবার হাসলাম। আমার হাসিতে বিরক্তবোধ করল অহনা। কারণ আমি সবসময় হাসি। তবে হাসিতে যে বেদনা আছে সেটা কে বুঝবে? আদোও আছে কেউ বোঝার জন্য। হয়ত আছে। কেউ আছে!

——————–
কেউ আয়াশের উম্মুক্ত বুকে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। তার গাল আর কপাল চুমু দিতে বাদ রাখেনি। আয়াশের হৃদয়ে কোনো অনুভূতি কাজ করছে। মেয়েটার একেবারে স্পষ্ট নয়। অস্পষ্ট অপ্সরা যেন! একসময় মেয়েটার হাত চেপে ধরে আয়াশ। মেয়েটার বাঘিনী চোখজোড়া ছলকে ওঠে। অতঃপর লজ্জায় নিভে যায়। হালকা ঠোঁট নাড়িয়ে সে বলে ওঠে….
–“কে তুমি?”
মেয়েটা তার কানের কাছে আসে। ফিসফিস করে বলে….
–“এমন একজন যার নাম আপনার হৃদয়ে রয়েছে। কিন্তু তাকে আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও সে রয়ে গেছে আপনার শিরা উপশিরায়।”

বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে আয়াশ। ঘামতে শুরু করে সে। একসময় চোখটা খুলে ফেলে। বুকের হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। যেন এই হৃৎস্পন্দনও কারো নাম নিয়ে চলেছে। যা আয়াশ শুনতে পারছে না।
মেয়েটা প্রতিদিন তার স্বপ্নে, কল্পনায় ভেসে বেড়ায়। কখনো হাতেনাতে ধরা দেয় না। যার চোখজোড়া দেখলে আয়াশ মুগ্ধ হয়। বিমোহিত হয়। নেশা ধরে। শুধু চোখজোড়া দেখলে এমন হয়। তাহলে মেয়েটাকে পুরোপুরি দেখলে কেমন লাগবে তার?

আয়াশ গলায় হাত দেয়। শিরশিরে ঠান্ডায় গলা ঘামে ভিজে গেছে। গলা থেকে নিচে নামতেই তার হাতে বাঁধে একটা চেইন। আয়াশ নিজের বুকে তাকিয়ে চেইনটা টিশার্টের নিচ থেকে বের করে। চেইনের আটকানো একটা রিং। ছোট্ট রিং। এটার প্রতি অসম্ভব টান তার। নাড়িয়ে দেখে সে। কিন্তু এমন রিং কার মনে করতে পারে না সে।

এমন সময় দরজা ঠেলেঠুলে ঢুকে আসে এক বয়স্ক মহিলা। আয়াশ চেইন ছেড়ে পায়ের শব্দে সামনে তাকায়। বয়স্ক মহিলাটি মুখে হাসি নেই। মহিলাটি আয়াশকে পর্যবেক্ষণ করে বলে ওঠে….
–“আবার সেই স্বপ্ন দেখেছো?”
আয়াশ অবাক হয়। অবাক সুরে বলে….
–“তুমি জানো তাই না সেঁজুতি আন্টি?”
–“কি জানি?”
–“যে স্বপ্নের মেয়েটা কে! এটা তুমি জানো।”
ব্যাকুলতায় ভরা আয়াশের কন্ঠ। সেঁজুতি আঁতকে ঘরে থাকা একটা ফুলদানির দিকে তাকান। তারপর হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে ওঠেন….
–“একদমই না। আমি কি করে জানব? তোমার স্বপ্নে কোন মেয়ে আসে? তুমিই তো ভালো জানবে।”

আয়াশ আশাহত হয়। তবুও সেঁজুতিকে বুঝতে না দিয়ে বলে ওঠেন….
–“এতো সকাল সকাল কোনো কাজ ছিল?”
–“হ্যাঁ। তোমার মাহতাব আঙ্কেল তোমাকে ডেকেছে। কোনো কাজের জন্য।”
আয়াশ বেড থেকে নিজের পা ঝুলিয়ে দেয়। নিজের হাত দুটো লম্বা করে আবার মুড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে আলস্য ভেঙে নিল সে। তারপর বলল….
–“আচ্ছা আমি আসছি।”
কথাটা বলে ফ্রেশ হতে চলে যায় আয়াশ। আয়াশ চোখের আড়াল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন সেঁজুতি। কান্না ফেটে আসছে। বিগত এক বছর ধরে আয়াশের এই হাল। মনে মনে বলে ওঠেন….
–“আনিশা মা, কোথায় তুই? তোকে ছাড়া এই সাম্রাজ্যে যে আবার পাপের হয়ে উঠেছে। তোর আয়াশ হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। তুই কি সত্যি স্বার্থপরের মতো দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেলি?”

.
বাড়িতে ঢুকতেই কেউ আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুঝতে এক মূহুর্তও দেরি হলো না কাজটা কার। আমি তাকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁলাম না। বরণ তার থেকে দূরে সরে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। আমার দূরে সরে যাওয়ায় ঠোঁট উল্টে ফেলল সে। ব্যাপারটাই হেসে ফেলল অহনা। আমি হাঁটু গেঁড়ে বসে বললাম….
–“এটা কি হচ্ছে? মাম্মা সবে না বাইরে থেকে ফিরেছে? মাম্মার হাতে আর শরীরে কত জীবাণু আছে না? এভাবে জড়িয়ে ধরলে আমার সোনামনিরও তো জীবাণু লেগে যাবে।”

ও মনোযোগ দিয়ে আবার কথা শুনল। তারপর মিষ্টিভাবে আধো আধো গলায় বলল…..
–“মনে চিল না। সলি।”
আমি হেসে ফেললাম। তারপর বললাম….
–“এইতো লক্ষি আদ্রিতা আমার।”
লক্ষি শুনে হেসে দিল আদ্রিতা। আদ্রিতা। আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমার প্রাণের অর্ধেক অংশ। যাকে দেখে পূর্ব জীবনে যাওয়ার আকাঙ্খা আবারও জেগেছে।

চোখেমুখের রক্ত রুমাল দিয়ে মুছে নিলেও চোখমুখ লাল হয়ে ছিল। তাই দেরি না করে পানি আর সাবান দিয়ে মুখ পরিষ্কার করলাম। ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আদ্রিতার খিলখিল হাসি কানে আসতে থাকল। বেডের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম আদ্রিতাকে পেটে সুরসরি দিয়ে হাসিয়ে চলেছে এক প্রাণোচ্ছল মানুষ। সে আমার দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। আমি বিনিময়ে হেসে মুখ মুছে বললাম….
–“পাগল করে দিয়েছিল আদ্রিতা?”
–“এ আর নতুন কি? প্রিন্সেস এর হাতে পাগল হওয়া তো ভাগ্যের বিষয়।”
আমি শব্দ করে হাসলাম।

আদ্রিতা ছুটে আমার কাছে চলে এলো। আমি ওকে জড়িয়ে কোলে তুলে চুমুতে গাল ভরিয়ে দিলাম। ও কিছুটা অভিমানি কন্ঠে বলে উঠল….
–“মাম্মা, তুতি আমাতে নিয়ে যাওনি কেন?”
–“তুমি তো ঘুমোচ্ছিলে তাই নিয়ে যাইনি। আর তোমার বেস্ট আঙ্কেল ছিল তো তোমার সাথে।”
আদ্রিতা আমার গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর আধো আধো গলায় বলল….
–“এবাল থেকে আমাতে নিয়ে যাবা।”
–“আচ্ছা নিয়ে যাব।”
আকাশ ভাইয়া বলে উঠল….
–“আমি আসি তাহলে। আদ্রিতা মনি মাম্মার আদর খাও।”
কথাটা বলে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেলো আকাশ ভাইয়া। অহনা আর আকাশ ভাইয়া। এই দুজন মানুষকে দ্রুত আপন করে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। এরাই আমার একাকীত্বের সঙ্গী!

রাত প্রায় ১১ টা। আদ্রিতা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম পাড়ানোও যেন একটা যুদ্ধ! জানালার কাছে চেয়ার নিয়ে বসলাম আমি। জানালার সোজাসুজি চাঁদ নিজের আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলো গিয়ে পড়ছে দূরে থাকা আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার অতিরিক্ত ফর্সা চেহারাতে চাঁদের আলোতে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ওর ঘন পাপড়িতে ঢাকা চোখ, সরু নাক, ছোট কপাল আর গোলাপি আবরণের ঠোঁট একজনের কথায় মনে করায়। বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়ে এলো। এই দীর্ঘ নিশ্বাস এক ফোঁটাও যন্ত্রণা কমাতে পারছে না কেন?
চাঁদের দিকে তাকালাম। কি মোহময় চাঁদ! এমন চাঁদ তো সেদিনও উঠেছিল। যেদিন দুটো ভালোবাসার মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আজ তারা আলাদা কেন?

চাঁদের দিক থেকে চোখ সরালাম। কারো ছায়া দেখতে পেলাম ঘরের ভেতরে। বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চিনতে ভুল হলো না। মলিন কন্ঠে বললাম….
–“আকাশ ভাইয়া! কিছু বলবে? ভেতরে এসো।”
আকাশ ভাইয়া বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল। আকাশ ভাইয়া নামক ব্যক্তিটি এতো মার্জিত আর ভদ্র। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকলেও কখনো রাতে ঘরে ঢোকেনি। তাই বাইরে থেকেই বলল….
–“শুনলাম দুটো ছেলেকে নাকি বাঁধা অবস্থায় পাহাড়ে ফেলে এসেছো। কি করতে চাইছো ওদের সঙ্গে মায়াব…”
আমি তাকে থামালাম। অনুরোধের সঙ্গে বললাম….
–“মায়া। শুধু মায়া বল। মায়াবিনী ডাকার অধিকার কাউকে দিতে চাই না আমি।”

ভাইয়া আলতো হাসল। চোখ বুজে সায় দিতেই বললাম….
–“কালকে এমন কিছু হবে যে ওদের মতো ছেলে দুই বার হলেও মেয়েদের সঙ্গে অশ্লীলতা করার কথা ভাববে।”
–“পাসপোর্ট রেডি। তুমি যদি বলো আজকেই কালকের জন্য টিকেট কাটতে পারি।”
দরজার দিকে তাকালাম। গালে হাত দিয়ে বললাম….
–“এটারই তো দেরি ছিল। যখন কাজ হয়ে গেছে তবে কীসের অপেক্ষা? কালকেই যাব।”
–“ঠিক আছে।”

আকাশ ভাইয়া যেতে নিল। আমি আবার ডাকালাম। থামলো সে। শুকনো গলায় বললাম….
–“দেশে ফিরার পর যে তোমার হেল্প লাগবে আকাশ ভাইয়া।”
আকাশ ভাইয়া আমার দিকে তাকালো। তারপর বুঝে বলল….
–“আমি রাজি।”
আমি তৃপ্তির হাসি দিলাম। অবশেষে কি ঘটতে চলেছে দীর্ঘ তিন বছর পর অপেক্ষা অবসান? আবার দেখা হবে কখনো?
#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
#Anisha_Sabiha
পর্ব ২
বাংলাদেশে সন্ধ্যে নেমেছে। পৃথিবী জুড়ে নেমেছে আঁধার। আয়াশ সারাদিন বাড়ি থেকে বিরক্তি হচ্ছিল। তাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। চোখমুখটা হালকা কুঁচকানো। ওর গাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে ওর এক বন্ধুর বাড়ি। এক বছরে ক্লাবে হয়েছে তার পরিচয়। বাড়িতে থেকে এসে গেছে ওর এক ঘেয়ামি।
ইফাজ(আয়াশের বন্ধু) আয়াশকে তার ঘরে নিয়ে আসে। বাড়িতে ও ছাড়া কেউ নেই। ইফাজ মধ্যবিত্ত পরিবারের। ওর বাবা কলেজের প্রফেসর।

ঘরে ঢুকতেই আয়াশের চোখে পড়ে রুমের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানানরকম স্কেচ। অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে স্কেচ গুলোর মাঝে। ইফাজের ভালো লাগা ওর স্কেচ আঁকা নিয়েই। কোথাও চোখে পড়ছে পাহাড়ের দৃশ্য, নয়তো কোনো রমনীর গিটার ধরা ছবি আবার কোথাও কোনো যুবক বসে আছে গোলাপ নিয়ে।
আয়াশ শুধু দেখে সেসব। ইফাজ হাসিমুখে বলে….
–“বাড়িতে কেউ নেই! কি খাবি বল? দেখি বানাতে পারি কি না।”

আয়াশ বেডের এক কোণে বসে পড়ে। মাথার চুল নাড়িয়ে সে খানিকটা ভেবে বলে….
–“তেমন কিছু না। একটু ঠান্ডা পানি খাওয়া। এর বেশি কিছু নিয়ে আসিস তো খবর আছে!”
ইফাজের হাসি বিস্তর হয়। হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে পানি নেওয়ার উদ্দেশ্যে। আয়াশ নিজের চোখজোড়া এলোমেলো করে আবারও স্কেচ দেখতে শুরু করে। কি নিখুঁত আঁকা! চোখ বন্ধ করে আয়াশ। কারো চোখের ছলকানি ভেসে উঠতেই চমকে চোখ খোলে সে।

মাথা ধরে বসে। মনে করার চেষ্টা করে কে এই মেয়েটা। কেন মনে হয় মেয়েটা যেন অদৃশ্য হয়েই তার মন সহ প্রত্যেকটি লোমকূপে বিচরণ করে। একটা স্কেচ হাতে নেয় সে। কিছু একটা ভাবতে থাকে আনমনে। তখনই ঘটে ইফাজের আগমন। সে দেখে আয়াশ একটা ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখছে। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল….
–“তোর পছন্দ হলে নিয়ে যেতে পারিস।”
আয়াশ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। মৃদু হেসে পানি ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে গ্লাস খালি করে দেয় সে। তারপর বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলে…..
–“না। আমাকে অন্য একটা স্কেচ বানিয়ে দিতে পারবি? একটা মেয়ের।”

ইফাজ ভাবুক হয়ে বলে….
–“কে সেই মেয়ে? তোর প্রেমিকা?”
–“না। আমার ভাবনা, আমার কল্পনা। যাকে আমি রুপ দিতে চাই।”
ইফাজ অস্ফুটস্বরে বলে….
–“বুঝেছি। কিন্তু তার বর্ণনা হুবুহু বলতে হবে।”
আয়াশ ভাবনায় মগ্ন হয়ে বলে….
–“সে হবে।”
ইফাজ বসে পড়ে আঁকিবুঁকির সরঞ্জাম নিয়ে। আয়াশ গভীর মনোযোগ দেয়। নিজের সুন্দর চোখজোড়া বিমোহিত করে ফেলে। তার থুঁতনির ভাজে থাকা দাঁড়ির মাঝে তিলটা জ্বলজ্বল করে ওঠে।

–“একটা মেয়ে। ওর মুখমন্ডল গোল কিন্তু থুঁতনি থেকে সেটা সরু হয়ে গেছে।”
ইফাজ সেই অনুযায়ী আঁকে। তারপর থেমে আয়াশের দিকে তাকাতেই। আয়াশের গোলাপী আভার ঠোঁটজোড়া কাঁপতে কাঁপতে বলে….
–“তার কপাল চুল দিয়ে ঢাকা। চুল এক সাইডে সিঁতি করা। ওর চোখে যেন সারা জগতের মায়া। তবে ছোটজোড়া কিছুটা ছোট ছোট। তবে রেঙে গেলে তাকে দেখায় বাঘিনী। যেন তার চোখের চাহনী দিয়ে ঝলসে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে।”

ইফাজ সব ঠিকঠাকই আঁকল। কিন্তু চোখজোড়াতে ভুল করল সে। আয়াশের দেওয়া চোখের বর্ণনা ওকে পাগল করে তুলছে। তাই ভুলক্রমে একেবারে ছোট ছোট চোখ একে ফেলল সে। আয়ায় স্কেচের দিকে তাকিয়ে অসন্তুষ্ট হয়। অন্য পাতায় আবার স্কেচ করতে বলে ইফাজ কে। যেন সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে আজ ওই মেয়েটাকে একটা রুপ দিয়েই ছাড়বে।
ইফাজ নতুন করে শুরু করে। আবার চোখে ভুল করে সে। আয়াশ বিরক্তির সুরে বলে…..
–“দেখি উঠে পর। আমি আঁকব।”
ইফাজ চোখ বড় বড় করে বলে….
–“তুই আঁকবি? পারিস স্কেচ করতে?”
–“চেষ্টা তো করতে পারি নাকি।”

আয়াশের কন্ঠে আকুলতা। স্কেচ আঁকার আকুলতা। ইফাজ উঠে যেতেই আয়াশ বসে। সূক্ষ্ম চোখজোড়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে আঁকতে শুরু করে। ঠোঁটে এসে থেমে যায় সে। ইফাজ বিস্মিত হয় আয়াশের আঁকানো চোখজোড়া দেখে। চোখজোড়া আয়াশের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় যেন। অথচ ইফাজ কিভাবে আঁকবে খুঁজেই পাচ্ছিল না। আয়াশ আনমনে বলে ওঠে….
–“মেয়েটার দ্বিতীয় আর্কষণ হবে ওর ঠোঁটজোড়া। আলতো খোলা থাকবে। ঠোঁটের ওপরের অংশের ভাঁজটা একটু গাঢ় হবে। আর নিচের অংশে কোনো খুঁত থাকবে না। আর বাম গালে একটা উজ্জ্বল কালো তিল।”

ইফাজ হতভম্ব হয়। কি সুন্দর বর্ণনা! না জানি আয়াশ কাকে আঁকতে যাচ্ছে! নিশ্চয় কোনো মায়ার রাজ্যের মানবী হবে।
ইফাজের কল্পনা এমন হয়। চোখজোড়া আয়াশের দিকে স্নিগ্ধ হয়। প্রায় ১ ঘন্টা পর পেনসিল সরায় আয়াশ। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে নিজের স্কেচ কেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে সে। নিজে নিজেই বলে উঠলো….
–“এ কাকে আঁকলাম আমি?”
ইফাজ আয়াশের ঘাড়ে হাত রাখে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সে।
–“কে এটা?”

আয়াশ অতিরিক্ত উত্তেজনা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ওর হাত কাঁপছে। চাপা সুরে বলল….
–“আই ডোন্ট নো। কি এই মেয়ে? আদোও এই মেয়েটা আসলে আছে কি না তাও জানি না। আমার জল্পনা-কল্পনা, স্বপ্ন আর মন সব যেন ওকেই জুড়ে। ওকে নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। এমন কেন হয়?”
ইফাজ আয়াশের এমন কথায় চিন্তিত হয়। আয়াশকে আবারও প্রশ্ন করে….
–“তুই তো বলেছিলি তোর স্মৃতি নেই। তোর নাকি মানসিক সমস্যা হয়েছিল। তাই তোর মাহতাব আংকেল মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করেছিল! এসব সত্যি?”

আয়াশ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়।
–“হতেও তো পারে এই মেয়েটা এমন কেউ যে তোর আপন ছিল। স্মৃতি হারাবার পর তোর কিছুই মনে নেই।”
ইফাজের কথা ফিরে তাকায় স্কেচ টার দিকে আয়াশ। থমথমে গলায় বলে….
–“হতে পারে।”
–“আচ্ছা, তুই এক কাজ কর। তোর আংকেল তো তোর বাবসর বেস্টফ্রেন্ড ছিল। সো তোকে ছোট বেলা থেকেই দেখেছে। তোর সঙ্গে ওই মেয়েটার পরিচয় হয়ে থাকলে তোর আংকেল অবশ্যই জানবে। তুই বরং তোর আংকেল কেই জিজ্ঞেস কর।”

আয়াশ ইফাজের কথায় সায় দেয়। অতঃপর বলে ওঠে….
–“আংকেল বলেছে আমার নাকি পার্টি ক্লাব তৈরির বিজনেস ছিল। খুব নামি-দামি বিজনেস। আংকেলের বিজনেসের অবস্থা খারাপ। তাই আমাকে আবার নিজের বিজনেসের হাল ধরতে বলছে।”
ইফাজ মনোযোগ দিয়ে সব শোনে। আয়াশ থেমে আবার বলে….
–“আমি আর নিতে পারছি না। কবে যে স্মৃতি ফিরবে! ভালো লাগছে না। ক্লাবে যাবি?”
ইফাজ কিছুক্ষণ ভেবে সায় দেয়। ও নিজেও পার্টি পছন্দ করে। আয়াশ যাওয়ার আগে স্কেচটা নিজের সাথে নেয়। এক পলক দেখে কাগজটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে ভরে নেয় সে।

সকালে আদ্রিতা ঘুমের মাঝে দেখে আর উঠাতে ইচ্ছে করল না। তার কপালের চুল সরিয়ে চুমু একে দিলাম। আদ্রিতা নড়েচড়ে উঠল। ওপাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। আমি আনমনে হাসলাম।
–“তুমি রেডি? তাহলে চলো চলো।”
তাড়াহুড়ো করে দরজা দিয়ে ঢুকে কথাটা বলে উঠল অহনা। ও ব্যাগ ঘাটতে ব্যস্ত। আমি ওকে দেখে বললাম….
–“হুমম আমি রেডি।”
–“কালকের ওই ছেলেগুলো আছে কি না কে জানে!”

আমি রহস্যময়ী হেসে নিজের ওপর করে বাঁধা চুলগুলোর জট ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম….
–“যাবে আর কই? পাহাড়ের কিনারায় যেই ছোট জঙ্গলমতো আছে ওখানে ফেলে এসেছি। কোথাও যাওয়ার জো নেই।”
–“তুমি কি করতে চাইছো আমাকে বলবে?”
ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় গলায় বলল অহনা। আমি ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে নিজের ফোনটা নিয়ে বললাম…..
–“গেলেই দেখতে পাবে। আর হ্যাঁ ফ্লাইট কখন যেন?”
–“আজ রাত এগারোটায়।”
–“তাহলে তাড়াতাড়ি এসে প্যাকিং করতে হবে সময় নেই। এসো বের হও।”

ব্যস্ত কন্ঠে কথাটা বলে হাতের সেই মানুষটির দেওয়া আংটি ঠিকঠাক আছে কি না দেখতে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। পিছু পিছু এলো অহনা।
গাড়ি নিয়ে পৌঁছালাম সেই পাহাড়টার কাছে। গাড়ি থেকে নেমে ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লাম। অহনা পাহাড়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। আমি ভাবছি ওই দুটো ছেলেকে কি করে নিচে আনবো। ওরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কি করা যায়?
ভাবতে ভাবতেই চলতে শুরু করলাম। হাতে সময় খুব কম। অহনাকে প্রশ্ন করলাম….
–“হর্স রাইডিং কখন থেকে শুরু হতে চলেছে??”

অহনা ঘড়ি দেখে বলে….
–“উমম….মোটামুটি ১১ টার পরেই।”
আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। এসে পৌঁছালাম পাহাড়ের চূড়ায়। খানিকটা সন্দেহ হলো। দুটো ছেলের মুখ তো বেঁধে দিইনি। তাহলে ওরা তো আওয়াজ করে চেঁচানোর কথা! ওরা কি পালিয়ে গেল? ঝোপের আড়ালে যেতেই সন্দেহ দূর হয়ে গেল। ছেলে দুটো পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে হা করে ঘুমোচ্ছে। আমি দেরি না করে ছবি তুলে নিলাম ওদের। অহনা বিস্ফোরিত গলায় বলে উঠল…..
–“ওদের ছবি তুললে কেন? ওদের সিলেব্রিটি বানাবে নাকি?”

অহনা এই কন্ঠসুর দুটো ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। দুজন নড়াচড়া করতে লাগল। আমি অহনাকে জবাব দিলাম না। ওদের মাঝে একজন আকুতি নিয়ে বলল….
–“নাউ লিভ আস। উই প্রমিস, উই উইল ডোন্ট ডু দিস নেভার এভার।”
ওদের কথা শুনে আপনা-আপনি হাসি চলে এলো। অথচ আমার মায়া হওয়ার কথা ছিল। কেন জানি এসব মানুষ নামক অমানুষের প্রতি মায়া আর আসে না। আসা উচিতও নয়।

না হেসে গাম্ভীর্য রেখে বললাম….
–“How many girls have you harmed in your life?”
ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকালো। তারপর একজন ছোট্ট করে জবাব দিল…..
–“ডোন্ট নো। ইনফিনিটি।”
–“তাহলে শাস্তিটাও কল্পনাতীত হওয়া উচিত নয়কি?”
রাগের মাধ্যমে কথাটা বের হয়ে এলো। ছেলে দুটো বাংলা বুঝলো না। ওদের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। আমি নিজের ঘৃণা আর রাগ দাবিয়ে রাখলাম। নিজেই ওদের পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বললাম…..
–“I’m leaving you not to run away. To go with us.”

কোথায় যাব আমরা সেটা জানতে চাইল। ওদের বললাম না। হুমকি দিয়ে বললাম পুলিশের কাছে ধরা খেতে না চাইলে বা আমার হাতে মরতে না চাইলে আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানেই যেতে হবে। ওরা রাগল। আমাকে আক্রমণ করার সুযোগ ছাড়ল না। আমি ওদের গলা টিপে ধরলাম রাগের বশে। ওদের গলার চামড়ার প্রথম স্তর কেটে দিলাম। রক্ত পড়তে থাকল। চিরে গেলে যেমন হয়। অহনা কাঁপতে থাকল। ঢক গিলে অন্যদিকে তাকাল। ছেলেদুটো দমে গেল অবশেষে। ওদের নিয়ে এলাম।

একটা মাঠের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। মাঠের চারিদিকে সাদা বেঁড়া। তার মধ্যে অনেকগুলো ঘোড়া। গাড়ির ডেকিতে ওই ছেলে দুটো রয়েছে। একজন লোকের সঙ্গে কিছু আলোচনা করলাম গাড়ি থেকে নেমে। লোকটা চেনাজানা থাকায় আমার কথায় রাজি হয়ে যায়।
ছেলেদুটোকে বের করা হয়। আমি হাতে কালো রঙের মোটা গ্লাভস পড়ে নিলাম। অহনা আমার পাশে এসে বলল….
–“তুমি কি করতে চলেছো বলো তো?”
–“সামথিং নিউ।”

অহনা আর কিছু বলতে পারে না। ও হয়ত আন্দাজ করে ফেলেছে। আমি কথা না বাড়িয়ে চলে আসি অন্যদিকে। ছেলেদুটোকে নিচে রেখে দড়ির মাধ্যমে সিটের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। ছেলেগুলো চিৎকার করে। আমি গিয়ে ঘোড়ার ওপর চড়ে বসি। আশেপাশে হর্স রাইডিং এর জন্য অনেক মানুষই এসেছে। ওরা যেন অভূতপূর্ব কিছু দেখছে। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালাম ছেলে দুটোর দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম….
–“দ্যাটস ইউর পানিশমেন্ট।”
আমি ঘোড়ার মুখের সঙ্গে লেগে থাকা দড়ি টান দিয়ে জোরে ওপর নিচ করতেই ঘোড়া নিজের মুখ থেকে শব্দ বের করে ছুটতে লাগল।

শুরু হলো ছেলেগুলোর আর্তনাদ। আমি ঘোড়াকে জোরে ছুটাচ্ছি। ছেলেগুলো নিচে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিছুই না। আমার মন হয়ে উঠেছে হিংস্র। নেশা জেগেছে প্রতিশোধের। প্রায় বিশ মিনিট ঘোড়া ছুটাতে থাকলাম। তৃপ্তি মিটল। ঘোড়া থামালাম। এক লাফে নেমে গেলাম। সবাই আমাকেই ভিডিও করতে ব্যস্ত।
ছেলে দুটো পিঠে হাত দিয়ে কুকিয়ে যাচ্ছে। ওদের দিকে হিংস্র চাহনি দিয়ে বেরিয়ে এলাম। অহনা আমাকে চেপে ধরল।
–“এটা কি করলে তুমি? এতে কি কি হতে পারে জানো তুমি? ব্যাপারটা পুলিশ অবধি যেতে পারে!”

আমি নিজেকে ছাড়িয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম….
–“রিলাক্স অহনা। পুলিশ আমার ঠিকানা বের করে আসতে আসতে আমরা থাকবই না দেশে। আর পুলিশ এলেও উপযুক্ত জবাব আমার কাছে আছে। আমি ভয় পাই না। গাড়িতে ওঠো। প্যাকিং করতে হবে।”
অহনাও আর কথা বলল না। গাড়িতে উঠে পড়ল।

তখন দুপুর। সবে মাত্র দ্রুত প্যাকিং করে খানিকটা বসেছি আমি। তখনই আদ্রিতা কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে আমাকে চেপে ধরল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে এক গাল হাসলাম। আদ্রিতা বলল….
–“মাম্মা, তুমি লাকি বাইলাল হয়ে গেতো।”
আমি আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম….
–“কে বলল ভাইরাল হয়ে গেছি আদ্রিতা বাবু?”
তখনই দরজায় টোকা পড়ল। দরজায় তাকালাম। আকাশ ভাইয়া ফোন নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল….
–“আমি বলেছি। তুমি আজ যা করেছো সবাই তোমার ভিডিও ভাইরাল করে ফেলেছে। বাট ওনেস্টলি, মেয়ে হিসেবে তুমি ঠিক আছো। আমি তোমাকে সমর্থন করি। বাকিরা কি করে জানি না। তবে ইউ আর রাইট।”
–“জানি আকাশ ভাইয়া। এর থেকেও ভয়ানক পরিকল্পনা আছে আমার। যা সফল করতে তোমার সাহায্য লাগবে।”

আকাশ ভাইয়া কোনো দ্বিধা না করেই বলল….
–“আমি রাজি আনি…সরি মায়া।”
–“দেশে ভুলেও ওই নামটা উচ্চারণ করবে না কিন্তু। মায়া বলেই ডাকবে।”
আকাশ ভাইয়া মাথা নাড়ায়। আমি তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করলাম….
–“তোমাকে যা করতে বলেছিলাম করেছো? আর সাপ। ওই সাপগুলো এনেছো?”
আকাশ ভাইয়া দম ফেলে বলে….
–“অল ডান। মাহতাব রায়জাদার ব্যবসা খারাপ সো ওরা এক কথায় রাজি হয়ে গেছে।”

আদ্রিতা সব শুনে কিছু না বুঝে বলল……
–“মাম্মা, আমলা কোতায় যাব?”
আমি আদ্রিতার মাথায় চুমু দিয়ে মলিন গলায় বললাম….
–“তোমার পাপার কাছে।”
আদ্রিতা যেন খুশিতে হেসে উঠল। ও পাপার কাছে ফিরবে বলে ওর চোখমুখ চকচক করছে। একেই হয়ত বলে বাবার প্রতি টান। আমি নিচ দিকে তাকিয়ে বললাম….
–“এখন শুধু অপেক্ষা!”

২ দিন পর….
–“কত বিউতিপুল মাম্মা দেখো।”
–“হ্যাঁ মাম্মা। নিজের দেশ না? নিজের দেশের সব কিছু ভালো লাগে।”
আদ্রিতা আমার মুখে দিকে তাকিয়ে বলল….
–“দেচ মানে?”
–“পরে বলব। এখন জানালা দিয়ে দেখো।”
মেয়েটার কথার শেষ হবে না। আমি ভাবছি অন্যকিছু। এতোদিন পর আমাকে চিনতে পারবেন উনি? অবশ্যই পারবেন? কি রিয়েক্ট করবেন? ভালোবেসে আঁকড়ে ধরবেন? নিশ্চয় বাচ্চাদের মতো কাঁদবেন। মুচকি হাসি ফুটল। তখনি চুপসে গেলাম। গাড়ি নষ্ট থেমে গেল।
আকাশ ভাইয়া সামনে বসে ছিল। ড্রাইভারকে প্রশ্ন করল….
–“কি হয়েছে?”
–“বলতে পারছি না দেখতে হবে।”
ড্রাইভার দ্রুত নেমে গেল। বিরক্তি আমাকে ছেঁকে ধরল। আদ্রিতা বলল….
–“মাম্মা, বাইলে যাব।”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললাম….
–“আচ্ছা। বান্দরবানের রাস্তা সবসময় ফাঁকায় হয়। তার ওপর সকালের পরিবেশ। কোনো সমস্যা হবে না।”
অহনা আদ্রিতাকে নিয়ে খুশিতে নেমে গেল। অহনার যখন ১৮ বছর বয়স তখনই ওকে অনাথ আশ্রম থেকে বের করা হয়। তারপর আকাশ ভাইয়া ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল বলে ও আমেরিকা যেতে পেরেছে। তারপর থেকে আর দেশে ফেরেনি। তাই ওর আনন্দ টাও আলাদা। সেই চেনা রাস্তাতে নামতে ইচ্ছে করল আমারও। ইচ্ছেটা পূরণ করতে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।

আজ দিয়ে প্রায় দুইদিন অফিসে যাচ্ছে আয়াশ। তাই আজও সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে। মাঝরাস্তায় সে খেয়াল করে বাড়ির একটা ড্রাইভারকে। থামিয়ে দেয় সে তার গাড়ি। সামনে পর্যবেক্ষণ করে বিরবির করে বলে ওঠে…..
–“কামালদা এখানে কি করছে? ওর না এয়ারপোর্ট থেকে আংকেলের কাজের ইনভেস্টার আনতে যাওয়ার কথা ছিল?”
ভাবনা বাদ দিয়ে নেমে পড়ে সে। এগোয় ওই গাড়ির দিকে। প্যান্টের পেছনে হাত দিতেই পড়ে যায় তার আঁকা সেই মানবীর স্কেচটা।

চলবে…..🍂🍂
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…..??🍂🍂

#ভালোবাসাটা_ঘৃণার (সিজন ২)
#Only_Love
সূচনা পর্ব
#Anisha_Sabiha

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনাদের জন্য আবার গল্পটা নিয়ে এলাম। অনেকেই স্যাড ইন্ডিংয়ের জন্য নারাজ ছিলেন। তার জন্যই এটা। যারা সিজন ১ পড়েননি তারা এই সিজন ২ বুঝতে পারবেন না। সিজন ১ পড়ে নিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here