দেশলাই – ১১ পর্ব
তারা ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
লোকটি টর্চ লাইট জ্বেলে জঙ্গলের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে।
শফিক ফিসফিস করে বলল,
– ‘কি রে এতো রাতে এদিকে যাচ্ছে কেন?’
– ‘কি জানি। আমাদের কোম্পানিতেই যাচ্ছে হয়তো। স্টাফের লোকেরা ছিটকিনি খুলে দেওয়ার জন্য কাউকে তো কল দিতেও পারে।’
– ‘হ্যাঁ, তাই হবে।’
– ‘কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। ভোরে কিন্তু লোকাল মানুষ বদনা হাতে পেছনের জঙ্গলে টয়লেট করতে আসে। তাদের খোলা আকাশের নিচেই টয়লেট করা নিয়ম।’
– ‘হ্যাঁ, এটাও চিন্তার বিষয়। এক কাজ করি। ব্যাগগুলো সব দূরে কোথাও ফেলে আসি৷ ভোরে শুধু জঙ্গলের এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে হবে।’
সকল ব্যাগ দূরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে ফেলে এলো তারা। রাফসান বসতে বসতে বলল,
– ‘টাকা দু’জনের মানিব্যাগে যা রাখা যায় রাখি। বাকি সব তোর ব্যাগে রাখ।’
কথামতো টাকা ভাগাভাগি করে নেয় তারা। রাফসান একবার চারদিকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে এসে বলল,
– ‘শোন, এখন আমাদের কাজ হচ্ছে বাইরে খাওয়া। আর কোথায় অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কাটা যায় তা বের করা।’
– ‘মানে? মরবি না-কি? নকল কার্ড দিয়ে টিকেট কাটতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি? স্কেন করলেই তো শেষ। সাধারণ ট্রেন চালু ছাড়া যাওয়া যাবে না৷ তাছাড়া আমাদের কাছে তো বর্তমানে কোনো দালালেরও নাম্বার নেই।’
– ‘আমরা প্রথমে অনলাইন টিকেট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখবো কার্ডের শুধু নাম্বার আর নাম নেয় কি-না। যদি সেরকম হয় তাহলে স্কেন না করতেও পারে। তার আগে তোর ব্যাগে দেখ আমার মোবাইলটা আছে কি-না। কোথাও মোবাইল চার্জ দিয়ে ব্যাগে পাওয়া সিমটি ঢুকাতে হবে। বাকি সব পরে দেখা যাবে।’
– ‘মোবাইল আছে। তাহলে আমাদের কাজ এখন অনলাইন কাউন্টার খোঁজা? আর রাতে থাকবো কোথায়?’
– ‘বললাম না পরে দেখা যাবে। আজকের কাজ কাউন্টার দেখা। মোবাইল চার্জ দেয়া।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
দু’জন গাছের শেকড়ে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মেরে চারপাশ দেখে আসে। কিন্তু মশার যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার গিলে আলো ফুটতেই লোকাল মানুষ বিড়ি টানতে টানতে বদনা হাতে জঙ্গলের ভেতরে আসা শুরু করে। রাফসান শফিক তখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে পথিকদের মতো হাঁটাহাঁটি করে। ছয়টা হতেই জঙ্গল থেকে বের হয় তারা। পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। ভোরের শীতল হাওয়া। পাখির কিচিরমিচির। কলকাতা ছাড়া ভারতের অন্যান্য সকল রাজ্যেরই অসাধারণ রাস্তা। রাস্তার মাঝ দিয়ে সারি সারি গাছ। প্রতিটি বাসার সামনে নানান ধরনের ফুল গাছ। রাতের ক্লান্তি তাদের দূর হয়ে গেল। লক্ষ্য হচ্ছে এই এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। ঘন্টা খানেক মেইন রাস্তা ধরে হেঁটে একটা ছোটখাটো বাজার পাওয়া যায়। দু’জন একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে নেয়। এখানকার বিরিয়ানিও কম দামে পাওয়া যায়। তারপর একটা অটোওয়ালাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো আশেপাশে কোন বাজারে অনলাইন টিকেট কাউন্টার পাওয়া যাবে কি-না। অটোওয়ালা মোবাইল ম্যাপে খানিক্ষণ ঘাটাঘাটি করে। ইন্ডিয়ান অটো ওয়ালারা মোটামুটি ইংলিশ পড়া এবং স্মার্টফোন চালানো জানে। তাদেরকে জানালো আশেপাশে অনলাইন কাউন্টার নেই৷ যেতে হবে নারসিঙ্গী বাজার। ভাড়া আসবে পাঁচশত টাকা। তারা উঠে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে দোকান বন্ধ করা। আশপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে জানে দুপুরের পর খুলবে। তারা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে। ভাগ্যগুণে সেই রেস্টুরেন্টেই পেয়ে গেল একজন কলকাতার ওয়েটার। রাফসান আর শফিকের কথাবার্তা শুনে এগিয়ে এসে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলো কি খাবে। রাফসান সমুসা সিঙ্গারার সঙ্গে বললো, আমার ফোনটা একটু চার্জ দিয়ে দিন দাদা। অফ হয়ে যাওয়ায় ঝামেলায় পড়েছি।’
ওয়েটার মোবাইল নিয়ে চার্জে লাগায়। টুকটাক বাক্যবিনিময় হলো। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উল্টাডাঙা। তারা বললো বনগাঁ। এখানেই সময় কাটাতে লাগলো তারা। ঘন্টা খানেক বাদেই কাউন্টার খুলে। লোকজন ভীড় করছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে দোকানী টিকেট হাতে কিসব করে বুঝা যায় না। স্কেন করে কি-না কে জানে৷
রাফসানের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। কার্ডের ছবি মোবাইলে তুলে দেখাবে। চাইলেও স্কেন করা যাবে না। আর যদি বলে মোবাইলের ছবি দিয়ে হবে না। তারমানে স্কেনের ঝামেলা আছে। তারা রেস্টুরেন্টে ফিরে যায়। মোবাইলে জিও সিমটাও ভরে নেয়। ছবি তুলে দু’জনের নকল কার্ডের। আসার সময় ওয়েটারকে অতিরিক্ত পঞ্চাশ টাকা দিয়ে খুশি করে ওর নাম্বারটাও আনে। কোনো তথ্যের জন্য কল দেয়ার দরকার পড়তে পারে। শফিকের বুক দুরুদুরু করছে। সে কাউন্টার থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল। রাফসান গিয়ে বলল, ‘দাদা ট্রেনের টিকেট আছে?’ (হিন্দিতে)
দোকানী হিন্দিতে জানায়, ‘আজকের টিকেট নাই। গতকাল সব শেষ হয়ে গেছে৷ এখনকার নিয়ম হচ্ছে একদিন আগে টিকেট কাটতে হবে। আজ আপনি আগামী কালের টিকেক বুকিং দেয়া লাগবে৷ আরও পিছিয়ে কাটতে চাইলে অগ্রীম এখন হবে না।’
রাফসান দ্বিধায় পড়ে গেল। সে কালকে টিকেট কেটে কোথায় যাবে? দালালদের কোনো নাম্বারই তো তার কাছে নাই। তবুও আমতা-আমতা করে বলল,
– ‘দু’টা টিকেট কত?’ ( হিন্দিতে)
– ‘করোনার কারণে একটু বেশি। বারোশ হবে৷’ ( হিন্দিতে)
সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সীদ্ধান্ত নেয় টিকেট কাটবে। ভাবাভাবির জন্য আজ পুরো রাত আছে। ট্রেনেও ভাবা যাবে৷ আগে কলকাতা যাওয়া যাক। সাহস করে মোবাইলে কার্ডের ছবি বের করে বলল,
– ‘দু’টা টিকেট দিন।’
লোকটি মোবাইল হাতে নিয়ে বলল,
– ‘কার্ড সঙ্গে নাই?’
– ‘কোম্পানি থেকে আমাদের ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে দাদা। বাড়ি থেকে মোবাইলে ছবি আনিয়েছি।’
লোকটি আর কোনো কথা না বলে কাজ করতে লাগলো। খানিক বাদে টিকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– ‘টাকা দিন।’
রাফসান টাকা দেয়। লোকটি বলল,
– ‘হায়দ্রাবাদ সিকান্দারাবাদ জ্যাকসন থেকে কাল বিকাল তিনটায় হাওড়ার ট্রেন।’
– ‘ঠিক আছে।’
রাফসান টিকেট নিয়ে বাইরে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচে। এবার তিনটি ধাপ, হায়দ্রাবাদ স্টেশনে ঢোকা, ট্রেন এবং হাওড়া স্টেশন থেকে বের হতে কোনো সমস্যা না হলেই হয়।
শফিক ঘেমে গেছে। রাফসানকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল,
– ‘কি অবস্থা রে?’
রাফসান রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
– ‘ভয় নেই। আগামী কালের টিকেট কেটেছি।’
– ‘কি! আগামী কাল?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘মরবি না-কি? দালাল ছাড়া কীভাবে যাবি? তাছাড়া করোনার সময় স্টেশনে ঢুকতে যদি সমস্যা হয়। ট্রেনে যদি টিটি এসে চেক করে? হাওড়া স্টেশনে যদি ঠিকানা দেখে কোয়ারান্টাইনে পাঠায়?’
– ‘হাওড়ার আগের স্টেশনে নেমে অটো করে আবার হাওড়া চলে যাবো।’
– ‘হাওড়ার আগের স্টেশনে এসে গেছিস বুঝবি কীভাবে?’
– ‘মোবাইলে রিচার্জ করতে হবে৷ একটা চার্জারও কিনতে হবে৷ ট্রেনে মোবাইল অফ হলে ঝামেলা। সবকিছু ম্যাপ দেখে বুঝতে হবে।’
– ‘আর হাওড়া যাওয়ার পর?’
– ‘বললাম না পরেরটা পরে। আগে যাই। অনিমেষ দা নাম্বার দিয়ে গিয়েছিল না। তাকে কল দেবো৷ একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
– ‘আজকে রাত কোথায় থাকবি?’
– ‘রাতের খাবার কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমাদের কোম্পানির পেছন দিকে কলোনিতে ঢুকে পড়ব। সিকিউরিটি তো এখন স্টাফদের সঙ্গে থাকে। কলোনি পুরো খালি।’
– ‘তা হবে।’
দু’জন আনমনে হাঁটাহাঁটি আর নানান আলোচনায় দিন কাটিয়ে দেয়। রাত হতেই খাবার খেয়ে অটো করে আবার চলে গেল হাফিজপেট। কলোনিতে গিয়ে চুপিচুপি দরজা খোলা দেখে একটা রুমে ঢুকে গেল। যদিও মশার কামড়ে রাতে এক ফোটাও ঘুম আসেনি। ভোরে আবার বেরিয়ে গেল রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল গতদিনের বাজারে। মোবাইলে রিচার্জ আর নাস্তা করে একটা অটো রিজার্ভ করে চলে যায় স্টেশনে। বাইরে বসে বিকেল তিনটা অবধি অপেক্ষা করতে হয়৷ কি হবে দুশ্চিন্তায় তাদের বুক ধুকপুক করে৷ কিন্তু স্টেশনে ঢুকতে কোনো সমস্যা হলো না। তারা বিকেল তিনটায় ট্রেনে উঠে। স্টেশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের ফাঁকফোকড়ে সকল সম্ভাব্য বিপদে থেকেও বেঁচে যায়৷ ট্রেনে একদিন কেটে যাওয়ার পর কল দেয় ফোর ম্যান অনিমেষকে। সে জানায় পুরো পশ্চিমবঙ্গ কালই এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন হয়ে যাবে। করোনা বেড়ে গেছে। সুতরাং হাওড়া এসে তারা বিপদে পড়বে৷ অন্যদের সরকারি গাড়ি পৌঁছে দেবে। রাফসান জানায় তারা আগের স্টেশনে নামবে।
অনিমেষ আরও বকাবকি করে ফোন রেখে দেয়। রাফসান আঁজলা করে মুখ ঘষে। চুল টানে। খানিকপর আবার অনিমেষ কল দিয়ে বলে, ‘কোনো দালাল তাদেরকে স্টেশন থেকে গিয়ে আনতে রাজি হচ্ছে না।’ তবে বনগাঁ চলে যেতে পারলে দালালরা বর্ডার পাস করতে পারবে। ট্রেন এক সময় হাওড়ার আগের স্টশনে থামে। তারা বাইরে বের হয়। কিন্তু লক ডাউনের জন্য বনগাঁ যেতে পারে না। অনিমেষ মোবাইলে কথা বলতে বলতে তাদেরকে একটা মন্দিরের সন্ধান দেয়। পাহাড়ের উপরের এই বিশাল মন্দিরের বারান্দায় তারা সপ্তাহ খানেক থাকতে হবে। অনিমেষ একটা নাম্বার দিয়ে বলেছে কেউ এসে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বাবলা দা’র পরিচিত মানুষ।
…. চলবে…
লেখা: MD Jobrul Islam