#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫
খুঁজতে খুঁজতেই অরন্যের আইডিটা দেখে আমি পুনরায় আশ্চর্য হলাম। আবির বলেছে অরন্য বিয়ে করেনি। আর আইডিতে প্রোফাইল পিকে দেখা যাচ্ছে অরন্যের বউ নাফিসার সাথে অরন্যের হস্যজ্জ্বোল ছবি যা ১ বছর আগে আপলোড করেছে সে। অরন্য সচরাচর ঘনঘন প্রোফাইল পিক চেন্জ করে না। হয়তো এখনও সে অভ্যাসটা রয়ে গেছে। তবে বাকি পোস্ট গুলো হয়তো ফ্রেন্ডস করা, তাই বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারছি না। কিন্তু আবির কেন বলছে অরন্য অবিবাহিত। আবিরের সাথে যদি অরন্যের পরিচয় ১ বছরও হয় তবুও তারা একে অপরের আইডিতে এড হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে আবির কী করে বলছে অরন্য বিবাহিত নয়। আমার ভাবনাগুলো আরও প্রশ্নের ঘুরপাকে জড়িয়ে যাচ্ছে। কী করা উচিত বুঝতেও পারছি না। নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিলাম অতীতটা ফেলে এখন সে অতীতটায় ব্যাগরা দিয়ে বসেছে। সে সাথে হাজারটা রহস্যে মুড়িয়ে যাচ্ছি। মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল অনেক। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। অরন্যের সাথে কথা বলতে হবে। আবিরের সাথে অরন্যের সকল যোগসূত্র বের করতে হবে।
মাথাটা বেশ ঘুরপাক খেতে লাগল। অরন্য আর আবিরের রহস্যে মুড়িয়ে যাচ্ছি একের পর এক। আবার কোনো নতুন ভুল করার আগে সে রহস্যের উদঘাটন করতে হবে। কেন অরন্য চার বছর আগের সব সামনে আনতে চাইছে আর আবির এতদিন অরন্যের কথা বলল না কিন্তু এনগেজমেন্ট এর দিন হুট করেই কেন অরন্য কে নিয়ে আসলো। আংকটিটাও অরন্য পড়াল। একের পর এক ঘটনা এটাই জানান দিচ্ছে অরন্য চায় অতীতটা সামনে আসুক। কিন্তু তার স্ত্রী বর্তমান থাকার পরও কেন এমন চাচ্ছে? কেনই বা আবিরকে সে তার স্ত্রী এর কথা লুকিয়েছে। আর স্ত্রী থাকলে অবশ্যই অরন্যের বাসায় আসার কথা আবিরও তার স্ত্রী কে দেখার কথা। সেক্ষেত্রে তার স্ত্রী কখনও হয়তো অরন্যের বাসায় আসে নি। দু বছর আগে সে ঢাকায় এসেছে এর মধ্যে তো স্ত্রী আসার কথা। আর অরন্য যদি বিয়ে না করে তাহলে এ মেয়েটা কে অরন্যের প্রোফাইল দখল করে আছে। অরন্যের স্ত্রী কে ও মেনশন করা। অরন্যের স্ত্রী এর আইডি হয়তো ডিএকটিভ তাই আইডিতে ঢুকা যাচ্ছে না। অরন্যের স্ত্রী নাফিসার সাথে যদি সম্পর্কচ্ছেদও হয় তাহলে তো নাফিসার ছবি প্রোফাইলে থাকার কথা না।
উফ… সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে বারবার। কী করব কীভাবে এ রহস্যের উদঘাটন করব৷ আবেগের বশে আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। চুপ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ । মনের অস্থিরতা বাড়তে লাগল। নিজেকে সামলে নিতে হবে। অস্থিরতা নিয়ে যেকোনো কাজ করলেই সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। মোবাইলটা রেখে চুপ হয়ে অতীতে ডুব দিলাম। সেই কালো অতীতটা সামনে এসে থুবরে পরলো যে অতীতটাকে ভুলতে চেয়েছি বহুবার। যে অতীতের করালগ্রাসে টানা তিন বছর পুড়ে মরেছি। কাউকে বলতেও পারে নি আবার সহ্যও করতে পারেনি।
সম্পর্কচ্ছেদ আর বিয়ে ভাঙ্গার দেড় মাস হয়েছিল সবে। সেদিন দুপুরের নাস্তা খেয়েছিলাম এশার সময়। খাবার টা হাতে নিয়েও গিলতে পারছিলাম না। অনেকটা জোর করেই খাবার টা খেয়ে নামাজে দাঁড়াই। নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে খুব কেঁদেছিলাম। মোনাজাত শেষে যখনই উঠে দাঁড়াই তখনই মাথাটা ঘুরে যায়। হালকা হালকা বমি ভাব হতে লাগে। নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিই। মুখ ধুয়ে রুমে আসতেই আমার মনটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। লুকিয়ে বিয়ে করার পর অরন্যের সাথে বেশ কয়েকবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। এখন কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি মা হতে চলেছি। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পাগলের মতো অরন্যকে কল দিলাম। বারবার মেসেজ দিলাম। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। কারও কাছে বিষয়টা শেয়ার করে হালকা হব সেটারও উপায় পাচ্ছিলাম না। পুনরায় নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলাম। অরন্য বিয়ে করেছে ইতিমধ্যে সেটা কানেও এসেছে। আমার সাথে লুকিয়ে বিয়ের ছয়মাস পর এবং পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার একমাস পরেই সে বিয়ে করে নেয় অন্যত্র। আর আজকে আমার এ অবস্থা হলে এর দায়ভার কে নেবে। কার কাছে আমি মুখ দেখাব। আমার এ সন্তান জারজ নামে পরিচয় পাবে। আর অরন্য যদি চাপে পড়ে আমাকে এর জন্য বিয়েও করে সেখানে আমি বা আমার সন্তানের কোনো মূল্য থাকবে না। আর আমার সন্তান বারবার পরিচয়হীনতায় ভুগবে। আমিও প্রতিষ্ঠিত না যে এ বাচ্চার দায়িত্ব নেব। সব মিলিয়ে বেশ অস্থির লাগছিল তখন।
তবুও শেষবার অরন্যের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অরন্যের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। সারারাত সেদিন এতটায় ছটফটানিতে কেটেছিল যে সেটা বলে প্রকাশ করার ভাষা আমার কাছে নেই। পরদিন নিজেকে সামলে নিয়ে টেস্ট করালাম পরিবারের থেকে লুকিয়ে। ক্লাস আছে বলে বের হয়ে হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করাই। টেস্ট করানোর পর, রিপোর্ট হাতে পেয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। কারণ রিপোর্ট পজিটিভ ছিল। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়েই আমি কাঁদতে লাগলাম। এ বাচ্চাকে আমি দুনিয়া দেখাতে পারব না ভেবেই আকুল হয়ে যাচ্ছিলাম। অথচ এ বাচ্চা ছিল পবিত্র। তবুও আমি মা হয়ে এ বাচ্চাকে খুন করব। অসহায় হয়ে সেদিন কাঁদছিলাম। এ অসহায়ত্বের মাত্রা ছিল প্রখর।
বাসায় এসে সেদিন কী পরিমাণ কেঁদেছিলাম বলতে পারব না। সবচেয়ে কাছের বান্ধবীকে কল দিলাম। সেও উপায় না পেয়ে বাচ্চা গর্ভপাত করাতেই বলল। হাতে তখন টাকা ছিল না। শুধু মোবাইলটা ছিল। এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সেদিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরও বড় একটা ধাক্কা খেলাম। অরন্য তার স্ত্রী এর সাথে ঘুরতে গেছে আর সেটার ছবি ওয়ালে আপলোড দিয়েছে সেটার স্ক্রিনশট অরন্যের এক বন্ধু আমাকে পাঠাল। ছবিটা দেখে যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম সে আমার গিফট দেওয়া শার্ট পরে বউয়ের সাথে ঘুরতেছে এটা দেখে। অথচ ভাবনায় আসলো শার্ট টা পরতে তার হাত কাঁপলো না একবারও। একটা বারও আমার কথা মনে হলো না। দশ বছর তো কুকুর, বিড়াল লালন পালন করলেও মায়া হয় আর আমিতো জলজ্যান্ত মানুষ ছিলাম। তার কী শার্ট টা পরার সময় আমার কথা মনে হয়ে বুক কাঁপে নি । যে শার্ট টিফিন, রিকশা ভাড়া, বইয়ের টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে, জমিয়ে ওর জন্য কিনেছিলাম। একদিকে ও নাফিসাকে নিয়ে ঘুরছে আর এদিকে আমি ওর চিন্হ বহন করে কাঁদছি। সেদিন মনে হয়েছিল দুনিয়া এত নিষ্ঠুর না হলেও পারত। অন্তত বাচ্চাটাকে পরিচয় দিতে পারত। অনেক কষ্ট হচ্ছিল। নিঃশ্বাস ভরী হয়ে যাচ্ছিল।
সেদিনেই আমার আইডিটা ডিএকটিভ করি। ১৭ হাজার টাকার মোবাইল এক বন্ধুর সাহায্যে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করি। আর নিজের জমানো কিছু টাকা গুছিয়ে আমার সন্তানকে এক সপ্তাহ পরে খুন করি। যেদিন সন্তান খুন করি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম মাতৃত্ব কতটা মূল্যবান একটা মেয়ের জন্য। কেউ বাচ্চা পায় না আর আমি আমার বাচ্চাটাকে পরিচয় দিতে পারব না বলে খুন করেছিলাম। নিজেকে সবচেয়ে পাপী মনে হয়েছিল। বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পাগলের মতো করছিলাম । বারবার মনে হচ্ছিল কী করলাম আমি। কিন্তু হাত পা ছিল বাঁধা।
কথাটা মনে করেই আমি শুয়া থেকে দরফর করতে করতে উঠলাম। সহ্য হচ্ছে না আর। এ অতীত আমি ভুলতে চাই। কেন সে অতীতটা সামনে আসছে। কেন সে অতীতটা আমার বর্তমানের সুখটা গ্রাস করছে। কেন সে অতীতটা আমার গুছানো জীবনটা অগুছালো করছে। আমি এর উত্তর চাই।
আবার দরফর করতে লাগল বুক। আজকের মতো যদি সেদিন থাকতাম তাহলে আমার বাচ্চার পরিচয় আমি আদায় করে নিতাম। কিন্তু সেদিনের মানসিকতা আর পরিস্থিতি ছিল একদম বিপরীত যার জন্য এত নিকৃষ্ট কাজ করতেও আমি বাধ্য হয়েছিলাম। অরন্যের প্রতি তীব্র ঘৃনা বাড়তে লাগল।ঘৃনায় গা গুলিয়ে বমি আসা শুরু করল। পৃথিবীতে যদি আমি কাউকে ঘৃনা করি সেটা অরন্যকে। আর আজ এত বছর পরও অরন্য একটুও বদলায় নি আমাকে নিয়ে খেলার প্রবণতা এত বছর পরও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।
মনে মনে এসব বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। নিজের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। নিভে যাওয়া আগুনটা যেন আবার জ্বলে উঠেছে।ছটফটানি বাড়তে লাগল আমার। সে সাথে মাইগ্রেনের চরম ব্যথা। মাথা দেয়ালে ঠুকতে লাগলাম অসহ্য এ যন্ত্রণায়। কড়া ডোজের ঔষধ সেবন করে মাথাটা খাটে এলিয়ে দিলাম। অনেক পরে ব্যথাটা মৃদু হলো। আর আমার চোখে হালকা ঘুম আসলো।
সেই সাথে সকাল হলো নতুন এক ব্যথার সূচনা নিয়ে। কারণ-
#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৬
কারণ সকালে ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ্য করলাম আবির কল দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এর্লাম দেওয়া ছিল ফজরের সময়ে। সেটাও বেজে কখন বন্ধ হয়ে গেছিল খেয়াল নেই। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আর এত প্রখর ঘুম হলো যে আবির ১১ বার কল দেওয়ার পরও ধরতে পারি নি। মুখে হাই তুলতে তুলতে আবিরকে কল দিলাম। আবির কলটা ধরতেই আমাকে ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো
– কোথায় ছিলে তুমি? এপর্যন্ত তো ফজরে তুমি আমাকে ডেকে দাও। আজকে তোমাকে এতবার কল দিলাম ফোন ধরলে না।
– মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছিল তাই ঔষধ খেয়েছিলাম। তাতেই এত ঘুম হয়েছে। কিন্তু এতবার কল দিলে কেন? কোনো বিশেষ দরকার ছিল?
– তেমন বিশেষ দরকার ছিল না। তবে এদিকে তো আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছিল। হাসপাতালে আছি এখন।
আমি কিছুটা বিমূর্ত গলায় বললাম
– কেন কী হয়েছে তোমার? আর এখন কেমন আছো? হুট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছো কেন?
– অপ্সরা অস্থির হইয়ো না। আমি এখন একদম ঠিক আছি। আর অরন্য যে হাসপাতাল জব করে সেটাতেই আছি।
– কিন্তু তোমার কী হয়েছিল?
– আরে বলো না প্রতিদিনের মতো মর্নিং ওয়াকে গেছিলাম। তবে ফাঁকা রাস্তায় হুট করে ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়। পা টা ভেঙ্গে গেছে। মাথায় ও বেশ আঘাত পয়েছি,হাতের অবস্থাও খারাপ। ঐ মূহুর্তে অরন্য না থাকলে কী যে হতো। অরন্যের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণী হয়ে গেলাম। ওর ঋণ শুধু বেড়েই যাচ্ছে।
– অরন্যের কাছে দ্বিতীয়বারের মতো ঋণী মানে? কী বলছো এসব? আর শরীর এখন কেমন? ডাক্তার কী বলেছে? কোন হাসপাতালে আছো বলো, আমি এখনি আসতেছি।
– আরে অপ্সরা এত প্রশ্ন করলে কোনটা রেখে কোনটার জবাব দিব? একটু স্থির হও। আমার কিছু হয়নি। এতটা অস্থিরতা তোমাকে মানায় না?
– তুমি কী পাগল আবির? তোমার ব্যপার নিয়ে আমি অস্থির হব না এটা কেমন করে বলো?
আবির আমার কথাটা শুনে হালকা হাসলো। হালকা হেসে বলল
– আরে আমার হবু বউটা যে আমায় এত ভালোবাসে সেটা তো জানতাম না। আস্তে আস্তে টের পাচ্ছি। এবার একটু শান্ত হও আমি তোমাকে সবটা বলছি। ঘটনা ঘটেছে সকাল সাতটায়। হাসপাতালে এসেছি সাড়ে সাতটায়। বড় কিছু হয়নি হাত পা ভাঙ্গা ছাড়া। ডাক্তার বলেছে তিনমাস বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব। আর সময় মতো অরন্য না থাকলে আমার অবস্থা খারাপ হতো। এর আগেও অরন্য আমাকে এভাবে বাঁচিয়েছে। সেদিন অরন্য না থাকলে আমাকে পেতে না।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম
– কেন এর আগে কী হয়েছিল?
– তখন সবে চাকুরিতে জয়েন করি। ছুটি পেয়ে ঘুরতে গেছিলাম এক জায়গায়। সেখানে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আমার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। খালি রাস্তায় পড়ে ছিলাম। অরন্য সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছে। হাসপতালে নিয়ে গেছে। নিজের রক্ত দিয়েছে। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে আমার পাশে ছিল। অরন্যের সাথে সেখানেই পরিচয় আমার।
– কোথায় ঘুরতে গেছিলে তুমি?
– অরন্য যে উপজেলায় চাকুরি করে সেখানেই। সেটা তো হাওর এলাকা ছিল। তাই সেখানে ছিনতাইকারীর উপদ্রব ও বেশি ছিল। সেদিন পেটে ছুরির আঘাত খেয়ে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। অরন্যের জন্যই সেদিন বেঁচে গেছিলাম।
– কত বছর আগের ঘটনা এটা?
– তিন বছর আগের। সেদিন থেকেই অরন্যের সাথে আমার বন্ধুত্বটা জমে উঠে। এরপর ঢাকায় পোস্টিং হওয়ার পর তো সে আমার ভাইয়ের মতোই হয়ে গেছে।
– আচ্ছা তখন অরন্য ভাইয়া কোথায় থাকত? আর পরিবার সাথে নিয়ে থাকত নাকি?
– তখন তো অরন্য ব্যাচেলর ছিল। সেখানের ব্যাচেলর কোয়াটারে থাকত।
উফ আবির এসব কী বলছে। অরন্য ব্যাচেলর ছিল। কী হচ্ছে এসব। এটা কী করে সম্ভব। কিছুটা উৎসুক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম
– ভাইয়ার চাকুরি হলো এতদিন বিয়ে করেনি কেন?
– ও একজনকে ভালোবাসে। সেখান থেকে বড় একটা আঘাত পেয়েছে। এরপর থেকে আর বিয়ের নাম নিলে সে রাজি হয়নি। কত মেয়ে দেখালাম কাউকেই নাকি ওর পছন্দ হয়না। একটা মেয়ের কথা অনেকবার বলেছে। বলেছে মেয়েটাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আর সেটা বুঝতে পেরেছে একটা সময় পর। যখন তার হাতে করার মতো কিছু ছিল না।
আমার ধারণা অরন্যের স্ত্রী নাফিসাকে হয়তো সে খুব ভালোবাসত। আর তার সাথে ঝামেলা হয়েছে হয়তো। তাই কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– মেয়েটার নাম কী? মেয়েটাকে কী তুমি চেনো? কথা হয়েছে কখনও?
– চিনি না, অরন্য কখনও ছবিও দেখায়নি, শুধু নামটা বলেছে।
– কী নাম মেয়ের শুনি?
– অপরাজিতা।
নামটা শুনে আমি থমকে গেলাম। ভাবনার সাগরে ডুবে গেলাম। চোখ মুখ ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। আবির অরন্যকে চেনে তিন বছর যাবত অথচ তার বউ নাফিসার সাথে তার পরিচয় নেই। তার বউয়ের ব্যাপারে সে কিছু জানে না। যদিও তার বউয়ের সাথে লাস্ট ছবি আপলোড হয়েছে গতবছর। এ বিষয়টায় একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। সে সাথে আবির যে নামটা বলল সে টা অরন্যের দেওয়া আমার একটা নাম। অরন্যের প্রিয় ফুল ছিল অপরাজিতা তাই সে ভালোবেসে আমাকে এ নামটায় ডাকত। আবিরের কাছে টানা তিন বছর সে আমার কথা বলে গেছে। তাহলে অরন্য আমাকে ছেড়েছিল কেন? আর অরন্য ব্যচেলর হলে নাফিসা কে? সব কিছু এলোমেলো লাগছে। এ মুহূর্তে এ প্রশ্নের উত্তর গুলো একমাত্র অরন্য দিতে পারবে। আমার উচিত তার সাথে কথা বলা। নাহয় রহস্যের গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে যাব।
– আবির হাসপাতালের ঠিকানা দাও। আমি এখনি আসতেছি।
– আমি ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। আর অপ্সরা সরি।
– সরি কেন?
– আমার বোকামো আর অসচেতনতার জন্য বিয়েটা পিছিয়ে গেল। তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে আমার জন্য। পারবে না অপেক্ষা করতে? হারিয়ে যাবে না তো? বড্ড ভালোবাসি তোমায়।
– একবার যখন তোমায় কথা দিয়েছি তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না সেহেতু যাব না। আমি জানি কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করা কতটা কষ্টদায়ক। আবির আমি তোমার পাশে আছি, পাশে থাকব কথা দিলাম। এ তো তিনমাসের ব্যপার। আমি আসতেছি আর মা কোথায়?
– মাকে বলার সাহস পাইনি। তুমি এসে একটু মাকে বলো। তোমার দায়িত্ব তোমার হবু শ্বাশুড়িকে কীভাবে বুঝাবা।
– হয়েছে বকাগুলো আমাকে খাওয়ানোর ধান্দা।।যাইহোক রাখলাম। এখনি তৈরী হয়ে আসতেছি।
কলটা কেটে তৈরী হয়ে নিলাম। একটা সি এন জি নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। মনে হাজারটা সংশয়ের অবসান আজকে ঘটাব আমি। অরন্যকে আজকে সব জিজ্ঞেস করব কেন এমন করছে।
সি এন জিটা তখন চলমান। শাহবাগ যেতে আরও কিছুক্ষণ বাকি। শাহবাগের পথ দিয়ে এগুতে এগুতেই পুরনো স্মৃতিতে ডুব দিলাম। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। অরন্য তখন এফ পি এস কোচিং করত নিকুন্জতে। দিলীপ স্যারের কোচিং নামেই সবাই চিনত। একদিন অরন্যের সাথে আমার বেশ ঝগড়া হলো। ঝগড়া করে ও ফোনটা অফ রেখেছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম সে কোচিং-এ যাবে। যত যাই করুক সে তার ক্লাস মিস দিবে না। আমি তখনও রাস্তা ঘাট চিনতাম না। তবুও বেশ সাহস করে রাস্তা চিনে চিনে কোচিং এর সামনে গেলাম। কোচিং এ তখন টিফিনের ব্রেক চলে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অনিশ্চয়তা নিয়ে অরন্যের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হুট করে অরন্য বের হলো। পরনে ছিল নীল রঙয়ের টি শার্ট। কালো মোটা ফ্রেমের চশমাতে চোখ গুলো আবদ্ধ। দোকানে এসে চা দিতে বলল। আমি দেখছিলাম দূরে দাঁড়িয়ে ও কী করছে। ও চা টা হাতে নিয়ে যখনেই চুমুক দিবে আমি ওর পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। অরন্য পেছন ফিরে আমাকে দেখে চমকে গেল। চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল
– তুমি এখানে?
– ফোন বন্ধ করেছো কেন?
– ভালো করেছি। সারাদিন ঝগড়া করো কেন? তোমার গালি খাওয়ার এত ইচ্ছা নাই। হুদাই গালি দাও।
– এতদিন তো গালি দিয়েছি এখন পিটাব কি না বলো?
– বাড়াবাড়ি করবা না।
আমি রাগী চোখে অরন্যের দিকে তাকালাম কথাটা শুনে। আর সাথে সাথে অরন্য গলে গেল। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলো
– দাঁড়াও এখানে ব্যাগটা নিয়ে আসি। তোমার সাথেই ঘুরতে যাব এখন।
– ভয়ে পালাচ্ছ না তো এখন?
– তোমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকা সম্ভব নাকি। অপেক্ষা করো আসতেছি।
বলেই ক্লাস রুমের দিকে গেল। পাঁচমিনিটের মধ্যেই ব্যাগ নিয়ে সামনে হাজির হলো। আমাকে হাসতে হাসতে বলল
– কোথায় ঘুরবা বলো।
– টি এস সি ছাড়া আর কোথায় গিয়েছি। সবসময় তো ঐ জায়গায়টাতেই যাই। টি এস সিতেই চলো।
অরন্যের সাথে সেদিন সি এন জি ভাড়া নিয়ে টি এস সির দিকে রওনা দিলাম। ফার্মগেট এসে আমার কী যেন হলো। হুট করে অরন্যকে বললাম
– ক্লান্ত বিকেলের রোদ হেলে পড়েছে চলো শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে যাই। ঐখান থেকে পরে রিকশা নিব। তোমার সাথে হাঁটতে মন চাচ্ছে।
– এত দূর হাঁটবা?
– ইচ্ছা হচ্ছে। হাঁটবা কি না বলো?
অরন্য সি এন জি থামিয়ে দিল। আমি অরন্যকে নিয়ে নেমে পড়লাম। দুজনের দুহাত একসাথে করে সেটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কখনও হাত মুষ্টি করে ধরছিলাম কখনও আলতো করে। কতশত পরিকল্পনা করছিলাম। বলতেছিলাম বিসিএস টা হয়ে গেলেই আর কোনো বাঁধা নেই। একসাথে হয়ে পড়ব দুজন। কত শত কথা আর স্বপ্ন দুজন মিলে গুছাচ্ছিলাম। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড়ে চলে আসলাম খেয়াল নেই। ফুলের দোকান গুলো সেখানে সারি বদ্ধভাবে সাজানো। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অরন্য কেমন করে যেন বুঝে গেছিল ফুল গুলো আমার চাই। সে দৌঁড়ে গেল ফুল আনতে। দুটো ফুল এনে আমার কানে গুজে দিল। আমি হাসতে হাসতে অরন্যের দিকে তাকালাম। সে আমাকে দেখে বলল নতুন বউ লাগছে একদম।
গাড়ির হর্ণে মধুমাখা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম। আশ্চর্য জনক ভাবে সি এন জি সে ফুলের দোকানগুলোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে এখন অনেকটা বদলে গেছে। ভেতরে ভতরে হালকা হাসলাম। আজকাল অতীত আর বর্তমান সব কিছু যেন আমাকে দেখে উপহাস করে।
সি এনজি টা আবার চলতে লাগল। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল। চলতে চলতেই গন্তব্যে পৌঁছালাম। গন্তব্যে পৌঁছানোর সাথে সাথে অরন্যকে দেখতে পেলাম মূল ফটকে। আমি সি এন জি এর ভাড়াটা তাড়াতাড়ি করে দিলাম। কারণ এখন অরন্যকে প্রশ্ন করব আগে তারপর যাব আবিরের সাথে দেখা করতে। আমি দৌঁড়ে ভাড়াটা দিয়ে অরন্যের কাছে যেতেই থমকে গেলাম।
( কপি করা নিষেধ চাইলে শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন)
রকমারিতে ইতি মধ্যে আমার প্রাকাশিত প্রথম উপন্যাস মায়াবতী কন্যা বইটির প্রি অর্ডার চলছে সবাই কে অর্ডার করার অনুরোধ রইল
( কপি করা নিষেধ। বেশি বেশি শেয়ার করে পাশে থাকুন।)