#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-২৯ (শেষ হইয়াও হইলো না শেষ)
রাহান,
তোমায় কি বলে সম্বোধন করবো এটা ভাবতে বসলে আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসে পরবে তবুও আমার ভাবনা শেষ হবে না। সহজ ভাষায় বলবো, তুমি আমার প্রাণভোমরা। এই ছোট্ট কণ্টকাকীর্ণ পৃথিবীটাতে আমি খুব করে যাদের ভালোবাসতাম, তাদের মধ্যে তুমি একজন। বিশ্বাস করো রাহান, তোমায় ছেড়ে চলে যেতে হবে এটা ভাবতে বসলে এখনি আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি পারছি না রাহান। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। পেটের সেই অসহনীয় ব্যথা আমার সারা গা জুড়ে এবার অভিষিক্ত করছে। আমি মরে যাচ্ছি রাহান।
জানো, আজ আকাশটা খুব মেঘলা ছিলো। ছাই রঙা আকাশ ধীরে ধীরে যখন কালো হতে শুরু করলো তখন বুঝলাম আজ ঝুম বৃষ্টি নামবে। তুমি বলতে না..? আমি ঝুম বৃষ্টি হয়ে তোমাকে ভিজিয়ে দি… রাঙিয়ে দিয়ে যাই। ঠিক তেমনি আমার মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি আমাকে রাঙাবে। আমি ঝুমকো আজ ঝুম বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে যাবো রাহান।
গত একটা বছর তোমার সাথে এক ছাদের নিচে কাটিয়ে আমি বুঝেছি জীবন কতটা মূল্যবান! জীবন আমাদের কতটা প্রিয়! এক জীবনের এই শেষ পাতায় এসে আমার না ভিষন অভিমান লাগছে…আমার জীবনের গল্পগুলোর প্রতি। কেনো এই পৃথিবীতে আমার আয়ু এতো কম নির্ধারিত ছিলো? আর একটু বেশি হলে কি খুব ক্ষতি হতো?
জানো রাহান, তুমি যখন ঝুমকোলতা বলে ডাকতে তখন মনে হতো মৃত্যু আমাকে কাছে ডাকছে। খুব কাছে…। আমি মৃত্যুতে শয্যাশায়ী হয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পরলাম এক বদ্ধ কালো কুটিরে। আল্লাহর কাছে গেলাম। আর তুমি থাকলে জেগে। আলোয় আলোয় ভরা পৃথিবীতে। আমার সন্তানের কাছে।
প্রকৃতির কি লীলাখেলা দেখেছো? আমার মাও আমাকে জন্ম দেওয়ার সময় মারা গিয়েছিলো। আর আমিও হয়তো চলে যাবো। আমিও মা ছাড়া, আমার বাচ্চাটাও মা ছাড়া হবে। কিন্তু আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসতো। তুমিও আমার সন্তানকে ভালোবেসো রাহান…খুব ভালোবেসো। আদরে আদরে ভরিয়ে দিও ওর ছোট্ট হৃদয়।
আচ্ছা তোমার মনে আছে? আমি তোমাকে বলেছিলাম আমরা এক হয়েও কখনো এক হতে পারবো না? শেষ হইয়াও শেষ হইলো না টাইপ। দেখেছো, আমরা মিলে গিয়েও মিল হতে পারলাম না।
শোনো রাহান, তুমি কিন্তু আমার উপর রাগ করতে পারবে না আমি আগে থেকেই বলছি। যদি কখনো এমন পরিস্থিতি আসে যে আমি কাকে বেছে নিবো আমাকে না কি আমার ওই পৃথিবীর আলো না দেখা নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে? আমি কিন্তু আমার বাচ্চাকেই বেছে নিবো। জানো, এই মুহুর্তে না আমি অনেক কাদছি। কান্নার কারনে আমার এই চিঠি ভিজে যাচ্ছে বারংবার। কথাগুলো লিখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাহান… তবুও লিখলাম।
আমার বাচ্চাকে বলে দিও রাহান, তার মা তার জন্ম হওয়ার পর আদর করতে পারেনি কিন্তু সে পেটে থাকা অবস্থায় তাকে খুব করে আদর করেছে। তুমি…তুমি আমার বাচ্চাটাকে দেখো রাহান। ওকে অবহেলা করো না। ও আমার শেষ চিহ্ন। তুমি ওকে সবসময় আগলে রেখো জান। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকেও খুব ভালোবাসি। আমার এই এতো সুন্দর সংসার রেখে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না রাহান। পারলে আমাকে বাচিঁয়ো….।
আর এই যে আমার সম্মানিত স্বামী আগেই বলে দিচ্ছি, কান্না ইজ নট এলাও। আমি না থাকাতেও সবসময় হাসিখুশি থাকো তোমরা।
ইতি,
তোমার ঝুমকোলতা।
——————
চিঠিটা পরে স্তব্দ, কষ্টে জর্জরিত রাহান হাউমাউ করে কেদে দিলো। কাগজটা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো বুকের ভেতর। আর্তচিৎকার করে বলল, ‘আমি পারলাম না ঝুম…আমি পারলাম না তোমাকে বাঁচাতে। কি অক্ষম স্বামী তোমার! আমাকে মাফ করে দাও। ‘
চিঠিতে অজস্র চুমু খায় রাহান এরপর আবার ধরে রাখে বুকের গহীনে। অন্তঃস্থিত অন্তরালের অন্তরেই একমাত্র সেই চিঠির স্থান। এই চিঠিতে যে গন্ধ মিশে আছে তার ঝুমকোলতার। রাহান কিছুতেই ছাড়বে না এই কাগজ আর।
দূরের ওই নীল আকাশের মেঘের ভেলার দিকে তাকিয়ে রাহান মাটিতে থাপ্পড় দিয়ে কেদে উঠলো। আহা! এই কান্না দেখলে শক্ত পাথরও যেনো কেদে উঠবে। নাড়া দিবে প্রতিটি মানুষের বুক। ঝুমকো যদি একবার দেখতো! শুধু একবার…। কেউ তার জন্য কাদছে পাগল হয়ে বেসামাল ভাবে তার প্রেমের অনলে পুড়ে একজন ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবে ঝুমকো কখনো রাহানকে ছেড়ে যেতো না। নিজে বাঁচতো।
“তুমি বলেছিলে না ঝুমকোলতা…একদিন আমার শাস্তি হবে। প্রকৃতি নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছে আমায়। এর চেয়ে ভয়ানক শাস্তি হতে পারে না। এই পৃথিবীতে তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকার মতো কঠোর শাস্তি আর কী হতে পারে! ”
রাহান মাটিতে লুটিয়ে পরে। ঘরে অন্যান্য ব্যক্তিরা চোখে অশ্রু নিয়ে সেই পানে তাকিয়ে থাকে। আজ কীসের জন্য তারা কষ্ট পাবে? ঝুমকোর মৃত্যুর জন্য? নাকি রাহানের আহাজারির জন্য?
‘তুমি কেনো চলে গেলে ঝুম…?’
রাহানের কণ্ঠে শান্ত কষ্ট। আহা! কি বেদনা সেই কন্ঠে! নিয়ন এগিয়ে গেলো টেবিলটার দিকে। টেবিল থেকে নিজের জন্য রেখে যাওয়া ঝুমকোর ছোট্ট চিরকুটটা হাতে তুলে নিলো।
“নিয়ন, এই পৃথিবীর প্রতি আমি অনেক অভিমান রেখে গেলাম রে দোস্ত। সাথে তোদের প্রত্যেককে শাস্তি দিলাম। আমি তোদের মাঝে নেই এর চেয়েও কি বড় শাস্তি হতে পারে?”
ছোট্ট একটা চিরকুট অথচ লিখে যাওয়া প্রতিটি বর্ণ ঝড় তুলল নিয়নের মনে। দাগ কাটলো কলিজায়। কেদে বুক ভাসানোর মতো বাসনা জাগলো নিয়নের…চোখ থেকে আপনা আপনি গড়িয়ে পরলো অশ্রুর চিকচিক দানাগুলো।
“প্রাপ্তি, আমার সঙ্গী। আমাকে হাসানোর সঙ্গী। আমার দুঃখের সময়ও দারুন দারুন ফাইজলামি করে যে সবসময় আমার মন ভালো করার চেষ্টা করে। আজও তো আমার দুঃখের সময়। করুন সময়। আমার বাচ্চাটাকে দেখিস দোস্ত? ও তো মা পাবেনা। তুই ওকে মায়ের স্নেহ দিস। আমার নানুমনিকে দেখে রাখিস। আর একটুও কাদবি না তোরা।”
চিরকুটটা পড়েই দাঁতে দাঁত লাগিয়ে প্রাপ্তি কেদে দিলো। বিছানায় ধপাস করে বসে বিরবির করে বলল, ‘তুই চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার ফাইজলামি গুলোও মিথ্যা, বানোয়াট আর মৃত হয়ে গেলো রে দোস্ত। ফিরে আয় না…আর একটাবার কি ফিরে আসা যায় না?’
______________________________
‘বাবা জানো আজ আমাদের স্কুলে ফাংশন ছিলো।’
রাহান স্মিত হাসে। মেয়ের বয়স পাঁচ বছর হলেও মুখের বুলি এখনো আধো আধো। মেয়ের মাথায় নিজের যত্নশীল ভরসাময় হাতটা রাখলো সে। মেয়ের নাম রেখেছে রুমঝুমি…।
হ্যাঁ, রাহান তার কথা রেখেছে…।রুমঝুমিকে এক মুহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করে না সে। রাহানের বেঁচে থাকার একমাত্র যুক্তিযুক্ত কারন যদি থেকে থাকে তাহলে তা হচ্ছে ওর মেয়ে। মেয়েও হয়েছে একদম বাবাভক্ত। মেয়েটা কি সুন্দর করে বাবা ডাকে! রাহানের পরানে তখন বিশুদ্ধতার প্রমিতপিতা ভক্তির বাতাস বয়।
বাবাকে অন্যমনস্ক দেখে রুমঝুমি টুপ করে বাবার গালে চুমু দেয়। সে এক আদুরী কন্যার কাহিনী! এরপর বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বাবার ঘাড়ে তার ছোট্ট থুতনি টা রেখে আধো আধো গলায় বলে,
‘সবার মা আছে কিন্তু আমার মা নেই। আমার মাটা না খুব পঁচা। পঁচা আম্মু। আমাকে কখনো দেখাই দেয় না। আম্মু আসে না কেনো বাবা? সবার আম্মু সবাইকে কত্তো…আদর করে। অথচ আমার আম্মুকে আমি দেখিই না। আম্মু আমার কাছে আসলে আমি কক্ষনো কথা বলবো না। তুমি বকে দিবে ঠিকাছে?’
রাহান মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে মেয়ের দু’ঝুটি ঠিক করতে করতে বলল, ‘আচ্ছা মা।’
কিছুক্ষণ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখার পর হঠাৎ ঘাড়ে ভেজা ভেজা অনুভব করলেই রাহান চমকে উঠলো। মেয়েকে ধরে তড়িঘড়ি করে নিজের সামনে আনে। রুমঝুমি তখন চোখ কচলাচ্ছে। রাহান উৎকন্ঠা হয়ে বলল,
‘একি আম্মু! কাদছো কেনো বাবা? প্রিন্সেসদের সবসময় কাদতে নেই তো বাবা আমার। কাদে না মা।’
আহ্লাদী আদুরী রুমঝুমি বাবার গলা আবার জড়িয়ে ধরে এবার একটু নাক টেনে দিয়ে ঠোঁট উল্টে কেদে উঠে। রাহান মেয়েকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরলো। মেয়ের চোখের পানি তার বুকের ভেতর ক্ষত এর উপর ক্ষত করে। মেয়েকে সামনে এনে রাহান তার মুখে অনেকগুলো চুমু দিলো। রাহানের চোখ তখন ভিজে উঠেছে।
রুমঝুমি বাবার দিকে ঠোঁট উল্টে তাকালো। ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো দু’ঝুটি করা। গায়ে সাদা-নেভি ব্লু স্কুল ড্রেস। ফর্সা পা জোড়া সাদা চকচকে মোজা দিয়ে ঢেকে গেছে। পায়ে কালো রঙের সু। মেয়েটা দেখতে একদম মোমের পুতুলের মতোন। কি সুন্দর তার নাক! কি সুন্দর টানা টানা চোখ! সবচেয়ে বড় কথা তার ঝুমকোর মতো চকচকে গাল হয়েছে। খাঁজকাটা গাল! রোদের তেজি রশ্মি আর চাঁদের পুলকিত আলোতে সেই গাল ঝিলমিল করে। রাহান সাবধানে চোখ মুছে মুখটাকে হাসি হাসি করে বলল,
‘চলো আমার পুতুল। আমরা আজ আইসক্রিম খাবো। তবুও আমার মা টা যাতে আর কক্ষনো না কাদে।’
রুমঝুমি কান্না থামালো কিন্তু তার মনের ঘোমট ভাবটা রয়েই গেলো। ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার গলা আদুরে ভাবে আবারো জড়িয়ে ধরলো থমথমে মুখে। যেনো আকাশে মেঘ আছে কিন্তু বৃষ্টি থেমে গেছে। রাহান একটু হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েকে অন্য বাচ্চাদের মতো কোনো কিছুর লোভ দেখিয়েও লাভ হয় না।
,
রাতের ঘন কালো তারকাখচিত রুপালি চাঁদ উঠা আকাশটার দিকে বেশ অনেকক্ষন থেকে তাকিয়ে ছিলো রুমঝুমি। এবার সে দু’হাত মোনাজাতের মতো করে তুলল। এরপর আবারো আধো আধো গলায় বলল,
‘আল্লাহ, আম্মুকে জলদি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আম্মু তুমি জলদি আমার কাছে ফিরে এসো তো। তাহলে কেউ আর আমাকে বলবে না যে আমি অনাথ। আম্মু অনাথ মানে কি? আজকে আমাকে আমার এক ফ্রেন্ড বলেছে আমি নাকি অনাথ! আমি তার সাথে আড়ি করে দিয়েছি। এই কথাটা শুনতে আমার কাছে খুব বাজে লেগেছে। আমি শুনতে চাই না। তুমি এসে ওদের বকে দিও তো, কেনো এতো বাজে কথা বলে ওরা। আচ্ছা আম্মু, তুমি কেনো আমাকে দেখা দেও না? আমার এত্তো এত্তো অভিমান হয় তুমি জানো আম্মু! তোমার সুন্দর মুখ দেখতে খুব ইচ্ছে করে আমার। ছবিতে কত্তো সুন্দর তুমি…। আমার আম্মুটা আসলেই এত্তো এত্তো সুন্দর। তোমাকে এত্তোগুলো উড়ন্ত ভালোবাসা আম্মু। উম্মম্মাহ… যত্নকরে রাখবে ঠিকাছে আম্মু?’
ছোট্ট রুমঝুমি হাপিয়ে যায় এতোগুলো কথা বলে। কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে সে আবারো বলে,
‘মা জানো এটা না রোজার মাস চলছে। আমি না কালকে দুটো রোজা রেখেছি। হিহি…একদিনে দুটো রোজা! সবাই করে একটা আমি করি দুটো কারন আমি তো টেলেন্ট মেয়ে…বাবা বলেছে। মা জানো, আমি না রোজ রাতে উঠে তাহাদুদ (তাহাজ্জুদ) নামাজ পড়ি। আল্লাহ নাকি তখন আমাদের অনেক কাছে আসে। আল্লাহ তখন কেনো আসে আম্মু সন্ধ্যায় আসতে পারে না? তাহলে আমি পড়া টড়া সব কিছু শেষ করে আল্লাহর সাথে কথা বলতাম। আমার যে ওতো রাতে উঠতে খুব কষ্ট হয় আল্লাহ বুঝে না আম্মু? আমি একটা রোজা নিয়ে কবিতা লিখেছি তুমি শুনবে মা? আচ্ছা শুনাই,,,
“রমজানের চাঁদ উঠেছে,
রোজা রাখার দিন এসেছে,
সারা মাস করবো মোরা সাওম সাধনা,
দুঃখ,কষ্ট,পাপ দূর হয়ে পূরন হবে বাসনা,
ফজরের পর ঘুমাবো আমরা সাহরি খেয়ে,
মাগরিবের সাথে ইফতার করবো মোরা আল্লাহর নাম নিয়ে।”
‘কেমন হয়েছে আম্মু? আমি একা একা লিখিনি। আমি কি এতো কঠিন কঠিন কথা বলতে পারি নাকি? আমাকে বাবা হেল্প করেছে। আমার বাবাটা না খুব সুইট। আমি আমার বাবাকে এত্তো এত্তো ভালোবাসি আম্মু। আই লাভ ইউ বাবা।’
‘আই লাভ ইউ টু মা।’
বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে ঠোঁটে হাসি নিয়ে রাহান বলল। পরনে তার নীল পাঞ্জাবি। চোখে চশমা। সে বই পড়ছিলো। এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় তপ্ত কয়েকটা চুমু দিয়ে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ো মা। আবার তো রাতে সাহরির সময় উঠে যাবে।’
রুমঝুমি বাবার এক কথায় ঘরে চলে গেলো। দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে ব্রাশ হয়ে এসে শুয়ে পরে। রাহান তৃপ্তি করে হাসে। মেয়েটা বড্ড পাকনা সাথে বাধ্যও। এই যে রাহান প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে। বাবা উঠে গেছে বুঝতে পারলেই মেয়েও উঠে যাবে। তখনি বাবার সাথে তার নামাজ আদায় করা চাই ই চাই। বাবা সাহরি খায় সেও খাবে। বাবা রোজা রাখবে সেও রাখবে। বাবা মসজিদে নামাজ পড়ে তাই সে প্রশ্ন করে, ‘মসজিদে মেয়েরা যেতে পারে না? না যেতে পারলে আমাকে ছেলে সাজিয়ে নিয়ে যাও তো বাবা।’ রাহান তখন জোরেজোরে হেসে মেয়ের গালে চুমু খায়।
ঝাপসা হয়ে উঠা চোখ থেকে রাহান চশমাটা খুলে হাতে নিলো। সুন্দর আকাশটার দিকে তাকিয়ে কষ্টের হাসি তুলে বলল,
‘জানো, মেয়েটা না বড্ড আহ্লাদী হয়েছে। খুব আদুরে সাথে ভীষণ অভিমানী ঠিক তোমার মতো। রুমঝুমি বড্ড অভিমান করে। আর যখনি অভিমান করবে তখনি আমার গলা জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলবে।’
রাহান হাসলো সাথে চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি পরে গেলো অনেকদিন বাদে। একমাত্র সে জানে এই কথাগুলো বলতে তার বুকের ভেতর কী নিঃসংশনীয় কষ্ট হচ্ছে! মনে হচ্ছে খুবলে কেউ হৃদপিন্ডের মাংস খেয়ে ফেলছে। কি অসহনীয় ব্যথা! আহ! রাহান হঠাৎ ভেজা গলায় বলল,
“কেমন আছো আমার ঝুম…..?”
এইটুকু বলতেই যেনো বাধনছাড়া কান্না গলায় এসে দলা পাকিয়ে গড়াগড়ি খেলো। রাহান চোখ দুটো মুছে নিলো। বুকের ভেতর দ্বিগুন অসহনশীল ব্যথাগুলোর অবচেতনে অশ্রুদানা গড়িয়ে পরলো। সেই অশ্রুদানা গুলো নিঃশব্দে বলছে, “আচ্ছা আমরা কি আর পাঁচটা ফ্যামিলির মতো হতে পারতাম না ঝুমকোলতা….?”
রেলিং এ ঠেস দিয়ে রাহান দাড়ালো। মহোবিষ্ট প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তার বোধ হলো, “Every pain gives a lesson and every lesson changes a life.” একটা কোমল নিঃশ্বাস বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিয়ে রাহান নিজের মতো করে বিরবির করে বলল, “জীবনের প্রতিটা বর্ণ ব্যথা শিখায়। আর সেই ব্যথা বদলে দেয় আমাদের জীবনের সকল মোড় ঘুরা গল্প।”
তখন উতলা উদ্ভ্রান্ত বাতাস শনশন করে বইছিলো। মরমর করে শব্দ তুলেছিলো শুকনো পাতার দল। পথের বাঁকে মিলিয়ে কিছু নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তুলে বিকট হাহাকার আওয়াজ! হালকা ফ্লুরোসেন্ট এর আলোয় রাস্তা ঝাপসা দেখা যায়। সেই ঝাপসা রাস্তার দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থেকে রাহান তার অভিমানী অযাচিত অভিযোগ পেষণ করে। ইশশ…কত্ত অভিমান সেসব কথার আড়ালে আছে লুকিয়ে!
[বাবা মেয়ের ভালোবাসা আজীবন অসমাপ্ত থাক। এরমাঝে একজনের স্ত্রী এবং আরেকজনের মায়ের সাথে কিছু অদেখা অভিমানী কথপোকথনও থাক]
__________________________________
বিঃদ্রঃ১- উপরের ইংরেজি বাক্যটি কালেক্টেড।
বিঃদ্রঃ২- এই গল্পটি প্রথম থেকেই কষ্টের ছিলো। আমি নানানভাবে ইংগিত দিয়েছে যে এটা সেড ইন্ডিং হবে। যেমন, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ, আমরা মিল হয়েও হতে পারবো না, ঝুমকোর বলা রাহান শাস্তি পাবে ইত্যাদি। কেউ ধরতে পেরেছে আবার কেউ পারেনি। তো এখন কেউ বলবেন না যে লেখিকার যা ইচ্ছা হয় তাই লিখে। আমি কিন্তু কোনো সুন্দর আমোদপূর্ণ গল্প হঠাৎ করে সেড ইন্ডিং দেইনি। প্রথম থেকেই এই গল্পটা সেড ছিলো। মাঝখানে কিছু পর্ব খুব হাসিখুশি ছিলো। আর তাছাড়া কিছু গল্পের সাথে হ্যাপি ইন্ডিং মানায় না।
বিঃদ্রঃ৩- আপনারা কি খেয়াল করেছেন? আজ ২৯ তারিখ আর আমার গল্পেরও আজ ২৯ এবং শেষ পার্ট।
বিঃদ্রঃ৪-ধন্যবাদ সবাইকে আমার পাশে থাকার জন্য। পরবর্তী গল্প ঈদের পরে আসবে। সবার কাছ থেকে গঠনমূলক মন্তব্যের আশা করছি।