অনুভূতি,পর্ব-২৮+২৯+৩০

অনুভূতি
পর্ব ২৮
মিশু মনি
.
৪৩.
দুপুরের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো মেঘালয়ের। মেয়েটি দিব্যি হাসিখুশি ছিলো, বোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার মুখ এমন আষাঢ়ে আকাশের মত হয়ে গেলো কেন? কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে।
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দুপুরের মুখের দিকে। দুপুর দ্রুত চিন্তা করছে কি উত্তর দেবে সে? যদি মিথ্যে বলে তবে ব্যাপারটা বাজে হয়ে দাঁড়াবে। হতে পারে মিশু তার বোনকে কোনোভাবে চেনে। অস্বীকার করলে মিশু ওকে মিথ্যাবাদী ভাব্বে। দুপুর একটু ভেবে উত্তর দিতে যাবে এমন সময় অরণ্য বললো, “না, ওর কোনো বোন নেই।”
মিশু আর কিছু বললো না। দুজনের বিকৃত মুখ দেখেই মনেহচ্ছে ব্যাপার টা গোলমেলে। কোথাও একটা গোপন রহস্য আছে যেটা ওরা লুকাতে চাইছে। অযথা কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। মেঘালয় ঠিক একই কথাই ভাবছিলো। অরণ্য হানিমুনে এসেছে, তারমানে হয়ত দুদিন আগেই অরণ্য ‘র বিয়ে হয়েছে। ঠিক সেদিন ই বিয়ের কনে পালিয়ে এসে ট্রেনে উঠেছিলো। এদের মাঝে একটা যোগসূত্র নিশ্চয়ই আছে। সেসব আর জিজ্ঞেস করে ওদেরকে বিবৃত করার কোনো মানেই হয়না। ওরা যে মিথ্যে বলছে সেটা দুপুরের গম্ভীর মুখ দেখেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
মেঘালয় কথা ঘুরানোর জন্য বললো, “কবে আসলি এখানে?”
অরণ্য হাসার চেষ্টা করে বললো, “কিছুক্ষণ হলো পৌছেছি। তোরা?”
– “আমরা আজকে সকালেই এসেছি। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগে আগে ফিরলাম। এখন আবার একটু বেরোবো।”
অরণ্য জানতে চাইলো, “এখন কোথায় ঘুরতে যাবি আবার? রাত তো হয়েই এসেছে প্রায়।”
মেঘালয় জবাব দিলো, “একটা কাজ আছে। চা বাগানের মালিকের সাথে মিটিং আছে একটু। ”
অরণ্য মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ও আচ্ছা। ডিনার তো বাইরেই করবি তাইনা? আমরা একসাথে ডিনার করতে পারি?”
মেঘালয় বললো, “অবশ্যই। আমার সাথে আরো তিনজন ফ্রেন্ড আছে। সবাই একসাথে ডিনার করতে পারবো। তো তোরাও চলনা আমাদের সাথে। একটু ঘুরেফিরে একেবারে ডিনার করেই হোটেলে ফিরবো।”
অরণ্য দুপুরের দিকে তাকিয়ে বললো, “না রে। জার্নি করে এসে টায়ার্ড হয়ে গেছে দুপুর। দুপুরে রাত নেমেছে। এখন আর বাইরে যাবো না।”
দুপুর অরণ্য’র কথার মাঝখানে বলে উঠলো, “আমি একদম ঠিক আছি। রুমে বসে থাকতে বরং ভালো লাগছে না। যাই না ঘুরে আসি? আমি আর ভাবি মিলে গল্প করবো আর আপনারা কথা বলবেন।”
দুপুর নিজে থেকে যেতে চাইছে বলে অরণ্য আর না করলো না। কফি খাওয়া শেষ করে ওরা বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। দুপুর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। মিশুর সাথে গল্প করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবুও কেন যেন সহজ হতে পারছে না। কিন্তু মিশুর সাথে খুব গম্ভীর মানুষ ও ঠিকই গল্পে মেতে উঠতে বাধ্য। মিশু যে পরিমাণ বকবক করতে থাকে, না চাইলেও মুড আপনা আপনি চালু চলে যায়। দুপুর ও মিশুর রাতারগুলে ভ্রমণের গল্প শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলো। দুদিন পর দুপুরকে এরকম স্বাভাবিক ভাবে হাসতে দেখে অরণ্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
মেঘালয় কে বললো, “তোর বউয়ের শুধু রূপ নয়,গুন ও আছে দেখছি।”
মেঘালয় হেসে হেসে বললো, “আমার বউয়ের কি দেখলি তুই??”
– “আহা! যেটুকু দর্শনীয় সেটুকুই দেখেছি। দ্যাখ আমার বউয়ের সাথে কেমন গলায় গলায় ভাব জমিয়েছে যেন ওরা মায়ের পেটের বোন।”
বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো। মেঘালয় ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, “ঠিকই আছে। আমরা তাহলে ভায়রা ভাই।”
অরণ্য বললো, “উহু, তোর বউ মানে আমার বউ,আর আমার বউ মানেই তো তোর বউ তাইনা?”
মেঘালয় অরণ্য’র কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “উহুম না। তোর বউ মানে আমার বউ,আর আমার বউ মানে তোর ভাবি।”
দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলো। মিশু ও দুপুর ওদের ফিসফিস কথাবার্তা আর উচ্চস্বরে হাসতে দেখে ওরাও হাসলো। যাক, ঘুরতে এসে একটু আনন্দ হলে সেটাও অনেক। বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই সারাক্ষণ কান্না পেত দুপুরের।
গাড়ির কাছে এসে মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। একটু চাপাচাপি করে বসতে হবে দোস্ত। কষ্ট হবে না তো?”
অরণ্য বললো, “তোর বউকে তো আমার মানুষ মনেই হয়না।”
মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অরণ্য’র দিকে তাকালো। মানুষ মনেহয় না মানে? মিশু কি তাহলে?
অরণ্য বললো, “না মানে মিশুকে আমার বারবি ডল বারবি ডল লাগে। ওকে তো অনায়াসে কোলের উপর বসিয়ে নিয়ে যেতে পারিস।”
মিশু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। মেঘালয়ের বন্ধুরা অনেক দুষ্টমি করলেও এত বেশি ফাজলামি কখনো করেনা। অরণ্য একটু গভীর টাইপের কথাবার্তা বলে,শুনতে কেমন যেন লাগে। ছেলেটার মুখে কিচ্ছু আটকায় না। মেঘালয় ইয়ার্কির মোক্ষম জবাব দিতে সত্যি সত্যিই মিশুকে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। মিশুর ইচ্ছে করলো লজ্জায় মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না ও। মেঘালয় ওকে কোলের উপর বসিয়ে পাশের সিটে অরণ্যকে বসতে বললো। অরণ্য’র পাশে দুপুর বসে পড়লো। সামনের সিটে বাকি তিনবন্ধু বসে গেলো। আরাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে। ছোট্ট একটা গাড়ি হওয়ায় বসতে কষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু মেঘালয়ের এই গাড়িটাই খুব পছন্দের।
মিশু মেঘালয়ের কোল থেকে নেমে পাশে বসলো। মেঘালয় ওর চোখের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু চোখ রাঙাল ওকে। কিন্তু মেঘালয়ের দৃষ্টি খুব গভীর। ভেতরটা কেঁপে উঠলো মিশুর। ও দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
গন্তব্যস্থলে পৌছে গাড়ি থেকে নেমে মিশু ও দুপুরকে একটা টেবিলে বসতে বলা হলো। ওরা দুজন সেখানে বসে কফি খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠলো। আর মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা তাদের জরুরি আলাপ সারতে অন্য টেবিলে মিটিং এ বসে গেছে। অরণ্য’র যদিও কোনো কাজ ছিলোনা, তবুও ও মেঘালয়ের সাথেই সেখানে বসেছে। ওরা কথা বলছিলো আর অরণ্য ফাঁকে ফাঁকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিলো দুপুরের দিকে। দুপুর সেটা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে রইলো। ও মিশুর সাথে মিশে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। মিশু মেয়েটা অনেক ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার বলা যায়। জগতের যত সব অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা ওর মগজে কিলবিল করে। সেসব বলে বলে অন্যের মাথা ধরিয়ে দেয় ও। শুনতে যে খারাপ লাগে তাও না, বরং বেশ মজা লাগে সেসব আজগুবি কথাবার্তা। সচরাচর এমনটা তো দেখা যায় না। দুপুর ও মেতে উঠলো ওর সাথে। আস্তে আস্তে মন খারাপ ভাবটা কেটে যেতে আরম্ভ করেছে।
মিটিং শেষ হলে রেস্টুরেন্ট এ চলে এলো ওরা। খাবার টেবিলে বসেও মিশু ও দুপুর গল্প করছিলো। মেঘালয় মিশুর বকবকানি শুনে হাসছে আর ভাবছে, মেয়েটা আজীবন যেন এমনি থাকে। খাবার চলে এলে ওরা খেতে আরম্ভ করলো। মিশু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা তোমরা কেউ ব্যাঙ খেয়েছো?”
মেঘালয় কেশে উঠলো, “ব্যাঙ কেউ খায় নাকি?”
মিশু উৎসাহ নিয়ে বললো, “কেন? বর্ষাকালে আমাদের এলাকায় বাড়ির আশেপাশে কত ব্যাঙ পাওয়া যায়। আমরা সেগুলা ধরে ধরে রান্না করে খাই। এত্ত টেস্ট লাগে, ইয়াম্মি।”
সবাই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। পূর্ব ফাজলামি করে বললো, “মঙ্গা এলাকার লোকরা আরো কত কিছুই খাবে।”
মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “আমাকে মোটেও মঙ্গা এলাকার লোক বলবা না।”
– “মঙ্গা এলাকার লোকেদের কি বলবো তাহলে? সারাবছর খরা আর দূর্ভিক্ষ লেগেই থাকে।”
– “রংপুর সবচেয়ে শান্তির এলাকা। আমাদের এলাকার মানুষ খুব সরল আর মানুষকে খুব ভালোবাসতে পারে। সাজেক থেকে ঘুরে এসে তোমাদের সবাইকে আমি রংপুর নিয়ে যাবো। দেখে এসো আমাদের গ্রামের মানুষ গুলি কত সরল।”
পূর্ব হেসে বললো, “ব্যাঙ খেয়ে খেয়ে সরল হয়েছে তাইনা?”
মেঘালয় বললো, “মিশুকে ক্ষেপাচ্ছিস কেন তুই?”
– “ক্ষেপালাম আর কোথায়। সত্য কথাই বলেছি। দূর্ভিক্ষ এলাকার লোক। সে সবসময় বিজনেস প্লান মাথায় নিয়ে ঘোরে। রাতারগুলে গিয়েও চাটনি বেচে আর বলে এক পিছ তিন টাকা। সেটা আবার ফ্রিতে দিয়ে বলে,এমনি দিছি। এমনির আরেক নাম তিন টাকা।”
সবাই মুখ টিপে হাসলো।
সায়ান বললো, “তোর মত গুবলেট নাকি? সে সারাক্ষণ বিজনেস প্লান নিয়ে ঘোরে, তার মগজ অলটাইম সক্রিয়। তোদের মত না। তোরা শালা ইচ্ছেকৃত ভাবে আমার ব্রেকাপ ঘটালি।”
সবাই অবাক হয়ে তাকালো। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “ব্রেকাপ হয়ে গেছে সিরিয়াসলি?”
সায়ান মুখ কাচুমাচু করে বললো, “হুম। হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় কল দিয়েছিলাম, বললো তুই তোর ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়াই থাক। গালি দিয়ে আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেছে। আমিও যা বলার বলেছি।”
আরাফ বলল, “আমাকে তোর থ্যাংকস জানানো উচিৎ। তোকে আমি ফকির হওয়ার হাত থেকে বাঁচাইছি।”
মেঘালয় বললো, “দোস্ত মন খারাপ করিস না। সাজেক থেকে ফিরে মিশু আমাদের রংপুর নিয়ে যাবে। সেখানকার সহজ সরল হাবাগোবা মেয়েদের মধ্যে একটাকে বেছে নিস। আজীবন তোকে মাথায় তুলে রাখবে। আমার একটা সুইট শালীকাও আছে।”
মিশু ক্ষেপে কাটা চামুচ তুলে মেঘালয়ের মুখের সামনে ধরে বললো, “তুমি বলতে চাচ্ছো আমি সহজ সরল হাবাগোবা মেয়ে?”
– “নাহ, আমি বলতে চাচ্ছি রংপুরের সব মেয়েই হাবাগোবা, শুধু আমার বউটা বাদে।”
সবাই শব্দ করে হাসলো। পূর্ব বললো, “ঠিকই বলছিস তবে উলটা করে। সঠিক উত্তর হবে, রংপুরের সব মেয়েই চতুর শুধু তোর বউটাই হাবাগোবা।”
এরপর টেবিল সুদ্ধ সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। রেস্টুরেন্টের অন্য টেবিলে বসা লোকজনরা ওদের দিকে তাকাচ্ছে অবাক হয়ে। কত সুন্দর হাসাহাসি করতে করতে খাবার খাচ্ছে ওরা। সাথে আবার চারজন সদ্য বিবাহিত তরুণ তরুণী! আহা! কি সুখী ওরা!
সবাই যখন হাসছিলো মেঘালয় সবার অগোচরে এক হাত দিয়ে মিশুর কোমরে হাত রেখে ওকে একটু কাছে টেনে নিলো। কানের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললো, “তোমাকে আজ এত আকর্ষণীয় লাগছে কেন? আমিতো চোখ ফেরাতে পারছি না।”
মিশু মুখ বাঁকা করে ফিসফিস করেই জবাব দিলো, “আমি তো সহজ সরল হাবাগোবা মেয়ে। আমাকে আবার সুন্দর লাগে?”
– “তোমার সরলতার জন্যই তুমি পবিত্র দেখতে। কিন্তু আজকে কেন জানি খুব বেশি স্মার্ট দেখাচ্ছে তোমায়। সবার চেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে। স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী মনেহচ্ছে। আমার তো মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”
– “থাক, বাড়াবাড়ি রকমের কিছু বলতে হবেনা। গুতো মেরে সরি বলতে এসেছে। মন ভুলানো হচ্ছে?”
মেঘালয় ফিসফিস করে বললো, “সত্যিই তোমাকে একদম এত্ত বেশি সুন্দর লাগছে যে তোমার ভাষায় খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে খরছে।”
– “আমি মোটেও অতটা সুন্দরী নই।”
– “যেমন আছো, তাতেই তো আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে।”
– “কই? আমিতো ঠিকই দেখতে পাচ্ছি মাথা সোজাই আছে। ঘুরছে না তো।”
মেঘালয় মিশুর কোমরে আলতো চাপ দিয়ে গভীর ভাবে ওর চোখের দিকে তাকালো। ফিসফিস করে বললো, “আজকে হোটেলে ফিরে তোমার খবর ই আছে।”
মিশুর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে খেতে আরম্ভ করলো। কিন্তু মিশু আর একটুও খেতে পারছে না। রীতিমত পা কাঁপছে। মেঘালয়ের গভীর দৃষ্টি একদম হৃদয়ে পৌছে গেছে ওর। টেবিলের নিচে সবার আড়ালে মেঘালয় মিশুর পায়ের উপর পা রাখলো। আরো কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো মিশু। কিন্তু যখন ই পা একটু সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, মেঘালয় আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে পায়ের পাতা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ওর পা। মিশুকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। লাজুক রাঙা হয়ে উঠেছে ওর মুখটা। খাবার তুলে মুখে দেয়ার মত শক্তিটাও পাচ্ছেনা। মেঘালয় এমন কেন?
দুপুর মিশুর পাশেই বসেছে। এদিকে সবাই নানান রকম ইয়ার্কি ফাজলামি করছে আর হাসছে। দুপুর একবার নিচের দিকে তাকাতেই মিশু ও মেঘালয়ের পায়ের খেলা চোখে পড়লো ওর। মিশু পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও পারছে না। পায়ে পা রাখার অনুভূতি ও এত সুখকর হতে পারে সেটা ও প্রথম অনুধাবন করলো আজ। দুপুর কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। অন্যরকম কষ্ট অনুভূত হচ্ছে ওর। মিশুর বয়স মাত্র আঠারো। একজন সদ্য বেড়ে ওঠা তরুণী হিসেবে খুব সুখী ও। একইসাথে মিশু একজন পরিপূর্ণ প্রেমিকা, একজন স্ত্রী, একজন অর্ধাঙ্গিনী। দুপুরের ও ইচ্ছে করছে মিশুর মত সুখী হতে। একজন প্রেমিকা হতে, একজন স্ত্রী হতে। আজ যদি অরণ্য’র জায়গায় নিখিল থাকতো, তবে দুপুর ও নিঃসন্দেহে মিশুর মত উচ্ছল থাকতো। এসব ভেবে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
সায়ান মিশুর প্লেটের দিকে চেয়ে বললো, “ম্যাশ ভাবি তো কিছুই খাচ্ছেন না। ওনাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?”
মিশু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু তবুও ওকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিলো। মেঘালয় বললো, “তোমার ম্যাশ ভাবি গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে।”
– “কি হইছে ওর? কিসের চিন্তা?”
মেঘালয় মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো, “সে চিন্তা করছে টেবিলের নিচে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা।”
মিশু এই কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। কিন্তু মেঘালয়ের বন্ধুরা সবাই আরেক দফা হেসে নিলো এটা নিয়ে। সবাই হাসছে তো হাসছে ই। কারো আর হাসি থামছে না। মিশু মনেমনে ভাবছে, সবাই খুব খারাপ। শুধু হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। আর খুব পঁচা পঁচা ফাজলামি করে। আজকালকার দিনের ছেলেরা খুব সাংঘাতিক। মারাত্মক রকমের ইয়ার্কি করে শুধু।
হোটেলে ফেরার সময় পর্যন্ত সবাই হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো। ফিরে এসে যে যার রুমে চলে গেলো। মিশু রুমে এসে বসে আছে, মেঘালয় ওকে রেখে একটু পূর্বদের সাথে কথা বলতে গেছে। কালকেই এই হোটেল ছেড়ে দেয়া হবে। আগামী দুদিন ওরা চা বাগানের বাংলোয় থাকবে। সেসব নিয়ে কথা বলে এসে রুমে ঢুকলো।
রুমে ঢুকতেই মিশু মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলো, “আমার এত ঘোর ঘোর লাগে ক্যান মেঘমনি?”
চলবে..

অনুভূতি
পর্ব ২৯
মিশু মনি
.
৪৪.
মেঘালয় ও মিশু দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। মিশুর পাগলামি দেখে হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে মেঘালয়। মিশু রাক্ষসের মত তেড়ে এসে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মেঘালয়কে, মেঘালয় ভাবে বোধহয় খুব জোরে ঘুষি বসাবে ওর নাকে। কিন্তু না, মিশু ঘুষি দিতে এসে হাতটা মেলে আলতো করে মেঘালয়ের থুঁতনিটা টিপে ধরে বললো, “ভাত দে নয়ত মানচিত্র খাবো থুক্কু হাত দে নয়ত ঘাড় মটকাবো।”
মেঘালয় হাত বাড়িয়ে দেয়, মিশু ওর হাত ধরে মটকানোর চেষ্টা করে হাতটা তুলে হাতের পিঠে চুমু দেয়। মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠে। বাচ্চাদের মত খেলা শুরু করেছে মেয়েটা। হাস্যকর থ্রেড দেয়, “সেচ্ছায় হৃদসমর্পণ করো নয়ত চুমু ছুড়তে বাধ্য হবো।”
মেঘালয় বললো, “হৃদয় সমর্পণ করবো না। আপনি হুমকি কার্যকর করুন।”
এরপর মিশু সত্যি সত্যি যা ছুড়তে চেয়েছে, সেটা ছুড়তে আরম্ভ করে। মেঘালয় ওর অত্যাচারে রীতিমত সুখের সমুদ্রে ভাসছিলো। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করলো। মিশু বিরক্ত হয়ে বললো, “এই সময়ে কে এলো বলোতো? ভাল্লাগেনা।”
মেঘালয় দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
ওপাশ থেকে দুপুরের গলা শোনা গেলো, “আমি দুপুর। একটু দরজা টা খোলা যাবে?”
মেঘালয় লাফিয়ে বিছানার উপর উঠে শুয়ে পড়ল। মিশুকে বললো, “তুমি যাও।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে দরজা খুলতে চলে গেলো। সামান্য একটু খুলে মাথা বাড়িয়ে বললো, “ভাবি কি হইছে?”
দুপুর ওর হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “আমাদের দুজনের একই ফোন আর একই কভার। ভূলেই ফোনটা বদল হয়ে গেছে। তোমার টা আমার ব্যাগে চলে গিয়েছিল।”
– “ওহ আচ্ছা। থ্যাংকস ভাবি।”
– “আমার ফোনটা মনেহয় তোমার ব্যাগে, ওটা একটু দাও। বাসায় কথা বলবো তো।”
– “একটু কষ্ট করে দাঁড়ান নিয়ে আসছি।”
মিশু ওর ফোনটা নিয়ে দ্রুত গিয়ে ব্যাগ খুলে দুপুরের ফোনটা বের করলো। দরজার একটু ফাঁক দিয়েই বিছানায় শুয়ে থাকা মেঘালয়ের শরীর চোখ এড়ালো না দুপুরের। মেঘালয় উপুর হয়ে শুয়ে আছে, খালি গায়ে। ওর ফর্সা পিঠে অজস্র ঠোঁটের চিহ্ন। অমন প্রশস্ত আর আকর্ষণীয় পিঠ টায় লাল লিপস্টিকের দাগ দেখেই ভেতরে কাঁপন ধরে গেলো। দুপুরের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। ও চোখ ফিরিয়ে নিলো।
মিশু ফোন নিয়ে এসে যখন হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলো ওর দিকে, দুপুর একবার মিশুর আপাদমস্তক তাকালো। গেঞ্জি ও কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া মিশুকে সন্ধ্যায় দেখা শাড়ি পড়ার মিশুর থেকে একদম আলাদা লাগছে। তখন দেখে একজন পরিপূর্ণ স্ত্রী মনে হয়েছিলো, আর এখন মনেহচ্ছে উচ্ছল কিশোরী। ঝর্ণার মত উচ্ছল মেয়েটিকে প্রকৃতি নিজ হাতে গড়েছে। রূপ যেন উপচে পড়ছে পুরো শরীরে। আর চোখে মুখে একটা অপার্থিব সুখের নেশা লেগে আছে। অসম্ভব ঘোর ওই চোখে। মিশুকে দেখে এখন যে কেউ বলবে, এই মেয়েটা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। এত সুখী বোধহয় কেউ কক্ষনো হয়না। মুখে প্রসন্ন হাসি, চুলগুলো এলোমেলো,আকর্ষণী
য় চেহারাটা টি শার্টে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। লাজ রাঙা চিবুক গোলাপি আভা ধারণ করেছে। এত সুখী কেন এই মেয়েটা?
ফোন নিয়েই দুপুর আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। ওর কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে মেঘালয় ও মিশুকে এরকম অবস্থায় দেখে। আত্মা ফেটে কান্না আসতে চাইছে। মনেহচ্ছে গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হিংসা, ক্ষোভ,হারানোর কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা, অরণ্য’কে মেনে নেয়ার চাপ, নিখিলকে জোর করে সরানো সবকিছু মিলে এত বেশি কষ্ট হচ্ছে যা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না।
দুপুর ছুটতে ছুটতে এসে সিঁড়ির কাছে এসে থামলো। ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়ে হাফাতে লাগলো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে ওর ভেতরে। অন্যরকম একটা যন্ত্রণা মাথায় যেন পিন ফুটাচ্ছে। দুপুর নিখিলকে কল দিয়ে ফেললো।
নিখিল রিসিভ করামাত্রই দুপুরের কান্নার শব্দ শুনতে পেলো। হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। নিখিল হতবাক হয়ে গেলো ওর কান্নার শব্দ শুনে। বললো, “দুপুর কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?
দুপুর কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। কোনমতে একটু সামলে নিয়ে বললো, “নিখিল,আই লাভ ইউ।”
নিখিল নির্বাক! হঠাৎ দুপুরের মুখে এই কথাটা তাও আবার এমন সিচুয়েশনে, অকল্পনীয় লাগছে ওর কাছে। নিশ্চুপ হয়ে রইলো ও।
দুপুর বললো, “নিখিল, আমি তোমার। আমি শুধুই তোমার। আমার শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ তোমার। নিখিল আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে প্লিজ।”
আচমকা এমন কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নিখিল। ওর ভেতরের চাপা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে দুপুর?”
দুপুর বললো, “আমি তোমাকে অজস্র কামড় দিতে চাই। তোমার গলা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠ, বুক সবখানে। দাগ বসিয়ে দিবো আমি। নিখিল প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও। প্লিজ নিয়ে যাও আমাকে।”
নিখিল দুপুরের এমন পাগলামি কথাবার্তা শুনে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। দুপুর কখনোই এ ধরণের কথাবার্তা বলেনা। আজকে তার কি হলো হঠাৎ করে? নিখিলের মুখে কথা ফুটছে না।
দুপুর বললো, “আমিও মিশুর মত সুখী হতে চাই। আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
– “মিশু কে?”
দুপুর বললো, “মিশু মেঘালয়ের স্ত্রী। জানো মেঘালয় ওকে কত ভালোবাসে? আজকে পাক্কা দুই ঘন্টা মিশুর মুখে ওর আর মেঘালয়ের ভালোবাসার গল্প শুনেছি আমি। মিশুর কি পরিমাণ কেয়ার করে জানো না। ওদেরকে দেখলে মনেহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ওরা। আমার সহ্য হচ্ছেনা নিখিল। এমনিতে সবদিক থেকে মানসিক চাপ, আর এখন এমন যন্ত্রণা হচ্ছে যে আমার নিজের শরীরটা ব্লেড দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমার ও খুব ইচ্ছে করছে মেঘালয়ের মত তোমার গলায় অজস্র দাগ করে দেই।”
নিখিল বললো, “এসব পাগলামি কেন করছো? তুমি কোথায় এখন?”
দুপুর বললো, “আমি হোটেলের সিঁড়িতে। আমি রুমে যাবো না। ওই লোকটাকে আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। আমি গাড়িতে উঠে ফাঁকি দিয়ে স্লিপিং পিল খেয়েছিলাম। পুরোটা রাস্তা ঘুমিয়েছি আমি। আর হোটেলে ফিরেই মিশুদের সাথে বাইরে বেড়িয়ে গেছি। আমার একদম ই ওই লোকটার সাথে একটা সেকেন্ড কাটাতে ইচ্ছে করছে না।”
নিখিল বললো, “সেদিন তো এসব ভাবোনি। আমি এখন কি করবো তুমি বলো? তুমি তো আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদছ, আমি কার কাছে বলবো আমার কষ্টের কথা?”
– “আমার ইচ্ছে করছে রৌদ্রময়ীকে খুন করে ফেলতে। ওর মত বড় বোন দুনিয়াতে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। কোনোদিনো সামনে পেলে ওকে খুন করে ফেলবো।”
দুপুর খুব অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। শুনতে খারাপ লাগছে নিখিলের। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই যে করার নেই আর। দুপুরকে সান্ত্বনা দেয়ার মত কোনো শব্দও খুঁজে পাচ্ছেনা ও।
দুপুর বললো, “মিশুকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। মিশুকে একটু আগে দেখে ইচ্ছে করছিলো ওর চুল টেনে ধরে গলা টিপে মেরে ফেলি ওকে।”
নিখিল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এভাবে বলছো কেন? মিশুর কি দোষ? অন্যকে দেখে এভাবে হিংসে করতে হয়না দুপুর। তুমি তো এমন ছিলে না।”
দুপুর বললো, “আমার পুরো শরীরে কষ্ট হচ্ছে নিখিল। তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট, সারাজীবনের মত হারানোর কষ্ট, অরণ্যকে মেনে নেয়া,রোদের এই কাজ সবকিছু আমাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে যাচ্ছে। আমি এই কটা দিন পাথর হয়ে ছিলাম। আজ মিশু আর মেঘালয়কে দেখে আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে নিখিল। সহ্য করতে পারছি না আমি। প্লিজ আমাকে খুন করে রেখে যাও।”
-“পাগলামি করোনা দুপুর,রুমে যাও। তুমি এখন হোটেলে, মাথায় রাখো সেটা। কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলো না। অরণ্য’র একটা প্রেস্টিজ আছে।”
দুপুর চুপ করে গেলো। কথাটা সত্যি কিন্তু প্রচণ্ড তিক্ত লাগছে শুনতে। ও বলল, “আমার কথা শুনে রাগ হচ্ছে তাইনা? আমাকে এখন ঘৃণা করো তুমি?”
– “কি উলটা পালটা বলছো এসব? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যাও রুমে যাও।”
– “হ্যা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেও পারতাম না। সেই আমি কিভাবে আছি ভাবতে পারো?”
– “বুঝতে পারছি। এখন রুমে যাও, সিঁড়িতে বসে এসব কথাবার্তা বলছো? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?”
– “আমাকে এখন আর সহ্য হয়না বললেই পারো। ফোন রেখে দাও ”
– “অযথা ভূল বুঝছো দুপুর। তোমাকে ভালোর জন্য বলছি রুমে যাও।”
– “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কষ্ট হচ্ছে বলে তোমাকে ফোন দিলাম আর তুমিও এমন করছো?”
নিখিল কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগেই কল কেটে গেলো। এরপর কল ব্যাক দিয়ে দেখলো নাম্বার বন্ধ। নিখিলের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিলো। দুপুর এমন একটা মেয়ে, যে নিখিলকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে চাইতো না। পাগলের মত ভালোবাসতো ও নিখিলকে। এইতো সেদিন, নিখিলের মেসে রান্না হয়নি, ও দুপুরবেলা অব্দি না খেয়ে ছিলো। দুপুর কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলে ও বললো, “রান্না হয়নি আজকে। আমি ঘুমাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে খাবো।”
– “এখনি যাও প্লিজ।”
– “আমার এখন একদম ই ভালো লাগছে না। মেজাজ খারাপ লাগছে, আজকে রুম থেকে মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে। রুমমেটরা সবাই বাসায় চলে গেছে, আমি মানিব্যাগ রেখে গোসলে গিয়েছিলাম। এসে আর পাইনি।”
– “ফোন নিয়ে যায়নি শুধু মানিব্যাগ নিয়ে গেছে?”
– “তার হয়ত শুধু টাকাই দরকার ছিলো। সেজন্য মানিব্যাগ নিয়ে গেছে। এখন হাতে একটা পয়সাও নাই, আব্বু টাকা পাঠাবে তারপর নীচে নামবো।”
কথাটা শুনে দুপুরের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন বিকেলে আবারো নিখিলকে কল দেয় ও। নিখিল রিসিভ করলে বলে, “তুমি একটু গুলিস্তান আসতে পারবা?”
– “কেন?”
– “আমি গুলিস্তানে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। একটু রিক্সা নিয়ে চলে আসবা প্লিজ? রিক্সাভাড়া আমি দিয়ে দিবো।”
হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিখিল বলল, “তুমি দাড়াও আমি আসছি।”
দ্রুত পাগলের মত ছুটে চলে এসেছে নিখিল। এসে দেখে ফ্লাইওভারের নিচে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দুপুর দাঁড়িয়ে। তিন বাটির টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার রান্না করে এনেছে। নিখিল দৌড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেন আসছো এত কষ্ট করে?”
– “তুমি সকাল থেকে না খেয়ে আছো আর আমি বুঝি খেতে পারি? তোমার বাবা কখন টাকা দেবে সেই আশায় বসে থাকবো?”
– “আল্লাহ! সেজন্য তুমি মুন্সিগঞ্জ থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে গুলিস্তান আসবা? তুমি কি পাগল দুপুর?”
দুপুর হেসে টিফিন বাটিটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিলো, “বেশি কিছু রাঁধি নাই। পোলাও আর দেশী মুরগি রানছি। খুব তাড়াতাড়ি রান্না করছি তো, হয়ত ভালো হয় নাই।”
– “তুমি খাইছো?”
– “না, আমি বাসায় গিয়ে খাবো। আগে তুমি খেয়ে নিও পেট ভরে। রাতেও খাবা, আর বেশি হইলে ফ্রিজে রাইখো। কালকে সকালে খাইতে পারবা। অনেক গুলা পোলাও দিয়া দিছি।”
বলেই দাঁত বের করে হাসলো দুপুর। নিখিল হা করে চেয়ে রইলো ওর দিকে। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে নিখিল মুগ্ধ হয়ে ওর পানে চেয়ে আছে, চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো নিখিলের। দুপুর একটা ৫০০ টাকার নোট নিখিলের বাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আর যাই করো, খাওয়াদাওয়া ঠিকমত কইরো। এইটা রাখো। আমি যাই, বাড়ি যাইতে রাত হবে এম্নেতেই।”
কথাটা বলেই দুপুর নিখিলের সামনেই মাওয়ার বাসে গিয়ে উঠলো। নিখিলের কথা বলা কিংবা হাত পা নাড়ানোর শক্তিটাও ছিলোনা। মাঝেমাঝে এরকম হুট করেই একদম বাকরুদ্ধ করে দেয়ার মত কাজ করে দুপুর। সারপ্রাইজের চেয়ে বেশি কিছু থাকলে সেটাই হতে হয়। দুপুর দিব্যি হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলো, আর জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাত নাড়ছিলো। সেই মায়াবী মুখখানার দিকে তাকিয়ে নিখিলের নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। কত যত্ন করে দুপুর রান্না করে আবার কষ্ট করে দিয়েও গেলো, নিজে কিচ্ছু খায়নি সকাল থেকে। নিখিল না খেলে কখনোই ও খায়না। আবার ৫০০ টা টাকাও হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো। এমন কেন মেয়েটা? এত ভালোবাসতে হয় বুঝি!
নিখিলের সেদিন পায়ের নিচে শিকড় গজানোর মত অবস্থা হয়েছিল। অনেক্ষণ নড়াচড়া করতে পারেনি ও। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিলো হাইওয়ের দিকে। দুপুর মাত্র তিন/চার মিনিটের জন্য এসেছিলো, অথচ আকাশ সমান কিছু অনুভূতি দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। যে মেয়েটা এভাবে ওকে ভালোবাসতো, নিখিলকে ছাড়া একটা মুহুর্ত ওর চলতো না। সে কিভাবে নিখিলকে ছাড়া থাকবে?
দুপুর কক্ষনো বাবার অবাধ্য হয়নি। বড় বোন রৌদ্রময়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতো। বাসায় আসতো অনেক দিন পরপর। দুপুর ই নিজে রান্না করে ওর বাবাকে খাওয়াতো, খুব ভালোবাসে ও বাবাকে। বাবা বিয়ে করতে বলার পর আর কোনোকিছুই মাথায় আসেনি ওর, অন্তত বাবার সম্মান তো রক্ষা হবে। বাবার জন্য নিজের জীবনটাও দ্বিধা করবে না দুপুর। সেখানে একটা বিয়েই তো, নাহয় বাকি জীবনটা কষ্ট করেই কাটলো। তবুও বাবার মুখে একটু হাসি থাকুক। এই ভেবেই দুপুর বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে নিখিলের শূন্যতাটুকু। যদিও নিখিলের জন্য দুপুরই বেশি পাগল ছিলো, তবুও দুপুর খুব করে অনুভব করতে লাগলো নিখিলের শূন্যতা। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁঁচবে দুপুর?
৪৫.
ছাদে বসে বসে সিগারেট টানতে টানতে এসব ই ভাবছে নিখিল। রৌদ্রময়ী হঠাৎ এসে পিছনে দাঁড়ালো। ছাদে সুন্দর চাঁদের আলো ছড়িয়েছে। নিখিল সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে ভুসভুস করে। কাকে যেন কল দিয়ে কথা বলতে লাগলো। রোদ একটা কথা শুনতে পেলো,
– “একটা বোতল হলেই চলবে। চাঁচড়া মোড়ে আয়,আমি যাচ্ছি।”
রোদ কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কই যাবি তুই? কিসের বোতল?”
নিখিল জবাব দিলো না। সিগারেট টানটেই লাগলো। এমন ভাব করতে লাগলো যেন রোদকে ও চেনেনা। রোদ বলল, “তুই নেশা করবি নিখিল? ছি,আমি ভাবতেও পারছি না তুই নিখিল এভাবে চেঞ্জ হয়ে গেছিস।”
নিখিল হাতের সিগারেট সহ ই এসে দুহাতে গলা টিপে ধরলো রৌদ্রময়ীর। সিগারেটের আগুন রৌদ্রময়ীর বাম গালের নিচে কানের দিকে লেগে পুড়ে যাচ্ছিলো, যন্ত্রণায় মুখটা কুঁচকে গেলো রোদের। ও তবুও টু শব্দটিও করলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে মরে যাওয়ার ই ইচ্ছে হচ্ছে ওর। নিখিল গলা টিপে মেরে ফেলুক তো।
নিখিল ওর গলা ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর ধপ করে বসে পড়লো ছাদের উপরেই। দুহাতে নিজের চুলগুলো টানতে টানতে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাবো। এত স্ট্রেস আর নিতে পারছি না। আমার লাইফটা দুপুরকে ছাড়া অচল। ও ছাড়া কে আমার একটু কেয়ার করবে? সারা দুনিয়া খুঁজলেও ওরকম একটা দুপুর আমি কোথাও পাবো না।”
রোদের গালটা জ্বালা করছে ভীষণ। সিগারেটের আগুন খুবই তীব্র। জ্বলছে আর খুব খারাপ লাগচে রোদের। তবুও ও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। নিখিল আপনমনেই বলে যেতে লাগলো, “ওরে আমি যা কিছু দিতাম, ও বলতো তুমি নিজের কাজে লাগাও।আমার জন্য কক্ষনো কিচ্ছু কিনবা না। অথচ নিজে টাকা জমিয়ে আমারে পাঞ্জাবি, শার্ট গিফট করতো।আমারে বলতো, তুমি ভার্সিটিতে পড়ো। কত মানুষের সাথে মেলামেশা করতে হয়। তোমার অনেক গুলা জামাকাপড় দরকার।আমি বলতাম আমি নিজেই কিনতে পারি। তুমি পছন্দ করে দাও। দুপুর বলত,পাঞ্জাবীতে আমার কষ্টের আবেশ মিশে থাকবে। এটা গায়ে থাকলে আমারে কখনোই ভূলতে পারবা না।”
নিখিলের কথা শুনতে শুনতে গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে রোদের। দুপুর খুব ভালো একটা মেয়ে সেটা ও জানে। কিন্তু নিখিলকে এতটা ভালোবাসতো সেটা জানা ছিলোনা ওর। দুপুরকে জিজ্ঞেস করলে কখনোই বলতো না ওর কারো সাথে সম্পর্ক আছে।
রোদ এসে নিখিলের পাশে বসলো।
নিখিল বললো, “জানিস রোদ ও আমারে একদিন ও কাপড় কাঁচতে দিতো না। আমি কাপড় কাঁচতে পারতাম না ভালোমতো। সেজন্য ও জেদ করতো, কয়দিন পরপর আমার সব জমানো ময়লা কাপড় ব্যাগে ভরে ওরে দিয়ে আসতাম, আর ও সব সুন্দর করে ধুয়ে লণ্ড্রী করে আমারে দিতো। এত ভালোবাসত মেয়েটা আমারে। কখনো কখনো আমারে বলতো হলের সামনে বাইর হও। আমি বাইরে গিয়া দেখতাম দুপুর আসছে। বলতো, তোমার জন্য সরষে ইলিশ রান্না কইরা আনছি। তোমার খুব পছন্দের না? ওর কথা শুনে আমি কান্না কইরা ফেলতাম রে রোদ। মেয়েটা আমারে ছাড়া বাঁচলেও আমি পারবো না। মুন্সিগঞ্জ থেকে এক পলক দেখার জন্য ও আমার হলের সামনে এসে দাঁড়াই থাকতো।”
নিখিল হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো এসব বলতে বলতে। ভালোবাসা রা হয়ত এমনই হয়। দুপুরের সমস্ত পাগলামি গুলোকে শুধু পাগলামি ই মনে হতো নিখিলের। আজকে ওর অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারছে ওকে হারানোটা জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হয়ে গেলো।
রোদ আর চুপ করে থাকতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে হুট করেই নিখিলের পা ধরে বললো, “আমাকে মাফ করে দে নিখিল। আমার জন্য তোদের এই অবস্থা হলো।”
নিখিল পা থেকে দুপুরের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর প্রতি আমার অভিযোগ নেই। ভাগ্যে যা ছিলো তাই তো হয়েছে।”
– “আমি যদি জানতাম দুপুরের সাথে অরণ্য’র বিয়ে হবে তাহলে কখনোই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতাম না।”
অরণ্য’র নাম মুখে নিতেই নিখিল আবারো ভেঙে পড়লো। একটু আগে দুপুর ফোন দিয়ে যা যা বলেছে সবই বলে ফেললো রোদকে। সব শুনে রোদ বললো, “তুই তাহলে ওর কাছে যা। ওকে নিয়ে আয় ”
নিখিল রেগে বললো, “পাগলের মত কথা বলবি না। তোর বাবার সম্মানের জন্যই দুপুর বিয়েটা করছে। এখন আমি ওরে নিয়ে এলে যেটুকু বাকি আছে তাও যাবে।”
রোদ কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমার অপরাধের জন্য তোদের পবিত্র ভালোবাসা আর দুটো লাইফ এভাবে নরক হয়ে যাবে আমি সেটা মানতে পারবো না। আমার ভূলের জন্য আমাকে অনুতপ্ত হতেই হবে। যা হবার হবে, তুই গিয়ে ওকে নিয়ে আয় প্লিজ। পায়ে পড়ি তোর।”
নিখিল নির্বাক হয়ে গেলো রৌদ্রময়ীর কথায়। সে নিজে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে,আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাকি নেই? তাহলে পালালো কার কাছে যাওয়ার জন্য? দুপুরের বিয়ে হয়ে গেছে সেটা শুনে তখন থেকে গম্ভীর হয়ে গেছে,এখন আবার বলছে দুপুরকে নিয়ে আসতে। রোদের সমস্যাটা কোথায়?
নিখিল রোদের হাত ধরে বললো, “দয়া করে কি বলবি কেন তুই বাড়ি থেকে পালালি?”
রৌদ্রময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “হুম। আজকে আর না বলে থাকতে পারবো না রে। সবটা তোকে জানাতেই হবে। আর তুই ওকে গিয়ে নিয়ে আসবি প্লিজ?”
নিখিল কৌতুহলী হয়ে তাকালো রোদের দিকে। চাঁদের আলোয় রোদের কান্নাভেজা কন্ঠ শুনে মায়া লাগছে ওর। রোদের গাল পুড়ে গিয়ে জ্বালা করছে তবুও ও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তিনটা মানুষের ভেতরে যে দহন চলছে, বাহ্যিক আগুনের চেয়েও সেটার যন্ত্রণা কয়েক গুন বেশি।
রোদ বলতে আরম্ভ করলো-
চলবে..

অনুভূতি
পর্ব ৩০
মিশু মনি
.
৪৬.
রোদ বলতে আরম্ভ করলো,
“আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো বাড়ি থেকে। অরণ্য’র বাবা আমার বাবার ভালো বন্ধু, উনি চেয়েছিলেন আমাদের পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতে। সেজন্যই বিয়ে পর্যন্ত আসা। আমি আগেই অরণ্যকে দেখেছিলাম কিন্তু অরণ্য আমাকে দেখেনি। ও দেখেছিলো দুপুরকে। আর ভেবেছিলো দুপুরের সাথেই ওর বিয়ে। তাই ওর বাবার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলো। আমাদের প্রায় এক সপ্তাহের মত শুধুমাত্র ফোনেই কথা হয়েছে। তারপর বিয়ের দুদিন আগে আমরা আলাদাভাবে বাইরে দেখা করি। আমাকে অরণ্য’র পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে ব্যাপারে কিছুই ও আমাকে বলেনি। ঠিকমত ফোন ধরত না আর। আমি ভাবতাম বিয়ের ঝামেলায় হয়ত ব্যস্ত আছে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে ও আমাকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করে বলে, ‘যেভাবে পারো বিয়েটা আটকাও। তোমাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি জানতাম না তুমি এমন দেখতে। আমি চাই, আমার বউ অন্তত আমার চেয়ে ফর্সা হোক। তোমাকে বিয়ে করলে সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না। অযথা দুজনের লাইফে তিক্ততা বাড়ানোর কোনো মানে হয়না। যেভাবে পারো বিয়েটা আটকাও।’ সেদিন অরণ্য’র কথা শুনে আমার ইচ্ছে করছিলো মাটির ভেতর ঢুকে যাই। আমিও ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আর এক সপ্তাহে অনেক স্বপ্নও দেখে ফেলেছিলাম। সব কষ্ট মেনে নিয়েও ওকে বলেছিলাম যেন নিজেই ওর বাবাকে বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে। ও বলেছিলো, ‘আমার বাবাকে বললে আমাকে মেরে ফেলবে নয়ত ত্যাজ্য করবে।আব্বু খুব রাগী।’ আমি ওকে অনেক কিছুই বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও মাত্র একটা কথা বলে আমাকে চিরতরে থামিয়ে দিয়েছে। ওর কথাটা ছিলো, ‘তুমি কি চাও তোমার স্বামী ঘরে তোমাকে রেখে অন্য মেয়ের কাছে যাক? যদি চাও তাহলে বিয়ে করো।”
নিখিল হতবাক হয়ে তাকালো রোদের দিকে। রোদ চোখ মুছে বললো, “একটা মেয়ের জন্য এরচেয়ে বড় অপমান আর হয়না রে নিখিল। যার সাথে রাত পোহালেই আমার বিয়ে,সে আমাকে বিয়ের আগের রাতে বলছে তুমি কি চাও তোমার স্বামী অন্য মেয়ের কাছে যাক? এটা কতটা অপমানের ভাবতে পারিস নিখিল?”
নিখিল রোদের হাত ধরে বললো, “কাঁদিস না প্লিজ। শক্ত হ রোদ। তুই এসব বাবাকে বলিস নি কেন?”
রোদ বললো, “আংকেলের সাথে আব্বুর খুব ভালো সম্পর্ক। আব্বু সারাক্ষণ বলতো ওনার কাছে সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। আমি যদি এসব আব্বুকে বলতাম, আব্বু জনসম্মুক্ষে অরণ্য আর ওর বাবাকে অপমান করতো। আমিতো একটু হলেও অরণ্যকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। আমি চাইনি আমার জন্য ও অপমানিত হোক। কি করবো কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিয়ে হলেও আমি দাম্পত্য জীবনে কখনোই সুখী হতাম না। আর বিয়ে ভাঙতে চাইলে আব্বুকে বলতেই হবে, সেটাও পারছিলাম না। আমার ইচ্ছে করছিলো সুইসাইড করতে তাও পারিনি। অতটা সাহস আমার নেই। আমি সারারাত আর বিয়ের দিন সারাটা দিন কেঁদেছি, সন্ধ্যায় এমন অবস্থা হলো যে আর কিছু চিন্তাই করতে পারছিলাম না। চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো হয়ত। কিছুতেই কি করবো মাথায় কাজ করছিলো না আমার। অরণ্য সন্ধ্যার পর কল দিয়ে বলেছিল, ‘দোহাই লাগে তুমি বাড়ি থেকে চলে যাও। সেটাই আমাদের দুজনের জন্য ভালো হবে। আমার তখন মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ, আমি সত্যি সত্যিই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকি। আমি তখন বুঝিনি সে দুপুরকে বিয়ে করার জন্যই আমাকে পালাতে বলেছিল। জানলে আমি বাড়ি থেকে চলে যেতাম না নিখিল। বিশ্বাস কর আমাকে।”
রোদ আর কথা বলতে পারছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। অরণ্য রোদের হাত ধরে বললো, “একটু বোকামি করে ফেলেছিস। তোর উচিৎ ছিলো বাবাকে সবকিছু খুলে বলা। তাহলে একটা সমাধান হয়েই যেতো।”
রোদ বললো,”আমি ওর আর ওর বাবার সম্মানের কথা ভেবেছি, আমার বাবার সম্মান নিয়ে ভাবিনি। আমার চিন্তা করার মত অবস্থা ছিলোনা। তুই তো জানিস আমি লাইফে কখনো রিলেশনে জড়াইনি, জীবনে প্রথম অরণ্যকেই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আমার সমস্ত স্বপ্ন নিমেষেই চুরমার হয়ে গেছে। আর এভাবে কেউ কখনো আমাকে অপমান করবে আমি সেটা ভাবিনি।”
রোদ কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লো নিখিলের কাঁধে। নিখিল ওকে ধরে বললো, “এখন তো আমার মাথা কাজ করছে না। দুপুর কখনোই আমাকে ছেড়ে অরণ্যকে নিয়ে সুখী হতে পারবে না। আর এখন সবচেয়ে বড় কথা, অরণ্য ছেলে হিসেবে ভালো হলে কি হবে ওর তো চাহিদা দুপুরের শরীরের প্রতি। বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই ও দুপুরকে এত কেয়ার করছে। তার হাতে কিভাবে দুপুরকে ছেড়ে দেই আমি? আমি যে ওকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ওরকম একটা লোকের হাতে ওকে ছেড়ে দিতে আমার ঘৃণা হচ্ছে।”
রোদ কান্না থামিয়ে মাথা তুলে বললো, “তোদের ভালোবাসা একদম পবিত্র ছিলো। আমার মতে তুই গিয়ে ওকে নিয়ে আয় সেটাই ভালো হবে। আমার ভূলের জন্য তোরা প্লিজ লাইফটা নষ্ট করিস না। তুইও আজীবন পুড়বি,দুপুর ও কখনো সুখী হতে পারবে না। সবকিছু জেনেও কি তুই ওকে অরণ্য’র সাথে থাকতে দিবি?”
নিখিল একটু চুপ থেকে বললো, “আমি দুপুরকে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভাবছি, হঠাৎ কথাটা শুনলে তোর বাবা নিজেকে সামলে নিতে পারবেন তো?”
রোদ নিশ্চুপ হয়ে গেলো। রাগ হচ্ছে ওর নিজের প্রতি। অরণ্য’র ভালোর কথা ভাবতে গিয়ে নিজের বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। ভালোবাসা এমন ই হয়,বিবেক বোধ লোপ পেয়ে যায় ধীরেধীরে। এখন অনুশোচনা করেও লাভ হবেনা। দুপুরকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।
নিখিল বললো, “আমি যতদূর জানি, আংকেল দুপুরকে খুবই আদর করেন। দুপুরকে অনেক বিশ্বাস করেন উনি। দুপুর যদি গিয়ে সবটা ওনাকে বুঝিয়ে বলেন তাহলে নিশ্চয়ই উনি বুঝবেন। তখন আর কষ্ট নিয়ে থাকবেন না, আর তোকেও ঠিকই বুঝবেন উনি।”
রোদ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ঠিক বলেছিস। আমার ভূলের জন্য এতকিছু হচ্ছে। আমার ভূলটা তুই শুধরে দিবি প্লিজ? তুই দুপুরকে নিয়ে গিয়ে বাবার কাছে সবকিছু বুঝিয়ে বলবি।”
– “চিন্তা করিস না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি,আংকেল নিজে থেকে তোকে ডেকে বাসায় নিয়ে যাবে দেখিস।”
– “তাই যেন হয় রে। মান সম্মান যা যাবার তা তো গেছেই, দুপুরের লাইফটা নষ্ট করিস না। খুব ভালো মেয়ে ও।”
নিখিল রোদের হাত ধরে ওকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বললো। ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে অনেকটা চিন্তা দূর হলো রোদের। নিখিল ওর বন্ধু শিহাবকে কল দিয়ে বলল ওর গাড়িটা নিয়ে নিখিলকে সিলেট রেখে আসতে পারবে কিনা।
শিহাব বললো, “হুট করেই সিলেট কি জন্য?”
– “তোকে আমি যেতে যেতে সব বলবো। বাসে গেলে অনেক সময় লাগবে, কিন্তু আর একটা সেকেন্ড ও দেরি করার ইচ্ছে আমার নেই। প্লিজ দোস্ত চলনা যাই।”
– “আমিতো মনিহারে,মুভি দেখছি। গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে আসছি।”
– “শো শেষ হবে কখন? অনেক রাত তো হয়েই গেলো, এত রাতে হলে তুই? আমার দম বন্ধ হয়ে আসতাছে দোস্ত। আমাকে যেতেই হবে।”
– “আচ্ছা হাফ এন হাওয়ার টাইম দে। তুই রেডি হয়ে মোড়ে আয়, আমি ওকে বাসায় রেখে আসছি।”
নিখিল ফোন রেখে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি বের হচ্ছি। এখানকার এক ফ্রেন্ড আসবে গাড়ি নিয়ে।”
নিখিল রুমে এসে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। রোদ ওর রুমে এসে বিছানার উপর বসে আছে। ওর চোখ এখনো ভেজা। নিখিল রেডি হতে হতেও ওকে অনেক কিছু বোঝালো। বড় বোনকে ডেকে সিলেট যাওয়ার কথা বুঝিয়ে বললো নিখিল। তারপর যখন বের হতে যাবে রোদ এসে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমাকে নিয়ে যাবি নিখিল?”
নিখিল রোদের দিকে তাকালো। রোদ বললো, “আমার বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসবে। টেনশন হবে খুব। তোরা তো গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিস, আমাকে সাথে নিয়ে যা। আবার তোর ফ্রেন্ডের সাথে না হয় ফিরে আসবো। তোরও এতটা পথ ভালো লাগবে না। আমরা দুজন কথা বলতে বলতে যেতে পারবো।”
নিখিল একটু ভেবে বললো, “আচ্ছা শাড়িটা বদলে আপুর একটা ভালো শাড়ি পড়ে আয়। আপুর তো জামাও নেই,সব শাড়ি।”
রৌদ্রময়ী শাড়ি বদলে একটা ভালো শাড়ি পড়ে আসলো। বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বেড়িয়ে পড়লো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
ওরা পুরোটা রাস্তা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলো। নিখিল রোদ আর শিহাব মিলে প্লান করে ফেললো দুপুরকে নিয়ে ও সোজা ঢাকায় চলে যাবে। বিয়ে করে তারপর রোদের বাবার সামনে গিয়ে হাজির হবে। এই কটা দিন রোদকে নিখিলের বোনের বাসায় থাকতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবা নিজে থেকে ডেকে নেয়ার পর রোদ বাসায় ফিরবে, তার আগে নয়। দুপুরকে হারানোর পরও আবার ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়ে রইলো নিখিল। রোদ শুধু প্রার্থনা করছে সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।
৪৭.
হোটেল থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলো দুপুর ও অরণ্য। লবিতে এসে মেঘালয়দের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অরণ্য গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়েছে। দুপুরের বসতে ইচ্ছে করছে না। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে।
আজকে মেঘলয়রা হোটেল ছেড়ে দেবে। সেজন্য ওদের একটু সময় লাগছে বের হতে। হঠাৎ চোখ ঘুরাতেই একটা সোফায় নিখিলকে দেখে চমকে উঠলো দুপুর। ওর সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। নিখিল এখানে বসে আছে এটা কিভাবে সম্ভব! রাতেই তো ওর সাথে কথা হলো। সত্যি সত্যি চলে এসেছে ও! ভাবতেও পারছে না দুপুর। এখন কি করবে? হাত পা কাঁপতে লাগলো ওর।
নিখিল ইশারায় ফোনে কথা বলার ইংগিত দিলো। দুপুর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অন করলো। একটা মেসেজ এলো নিখিলের নাম্বার থেকে, “tomar sathe onek kotha ache. any how hotel theke ber hoba. amake ektu somoy dao please.khub important.”
দুপুর গিয়ে অরণ্য’কে বললো, “আমার সানস্ক্রিন টা একটু নিয়ে আসবেন রুম থেকে? আজ বাইরে খুব রোদ উঠবে মনেহচ্ছে।”
অরণ্য হেসে উঠে দাঁড়াল। দুপুর সোফায় বসে বললো, “আমি এখানে বসছি। নিয়ে আসুন একটু কষ্ট করে। বউয়ের সেবা যত্ন করতে হয় একটু।”
বলেই হাসার চেষ্টা করলো। ব্রান্ডের নাম শুনে নিয়ে অরণ্য দ্রুত লবি থেকে বেড়িয়ে রুমের দিকে যেতে লাগলো। দুপুর ইশারায় নিখিলকে বাইরে বের হতে বলে লবি থেকে বের হলো। ওর পিছনে নিখিল ও উঠে বেড়িয়ে আসলো। এক ছুটে এসে লিফটের সামনে দাঁড়ালো। নিখিল এসে ওকে নিয়ে লিফটে ঢুকেই বোতাম টিপে দিলো। দুপুরের দিকে এক পলক চেয়েই ওর হাত টেনে ধরে বুকে জাপটে ধরলো। এত কষ্টের পর নিখিলকে দেখতে পেয়ে দুপুর ও নিজেকে সামলাতে পারলো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে এসে গাড়িতে উঠতে বললো দুপুরকে। দুপুর সংকোচ করছিলো উঠতে। নিখিল বলল, “অনেক কথা আছে। ওঠো।”
দুপুর গাড়িতে উঠে বসামাত্রই ডানপাশে রৌদ্রময়ীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। নিখিল গাড়িতে ওঠামাত্র শিহাব গাড়ি স্টার্ট দিলো। দুপুর একবার নিখিলের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার রোদের দিকে তাকাচ্ছে। ওর চোখ কপালে উঠে গেলো একেবারে। কি হতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর কোথায় এসে দাঁড়ালো দুপুর বুঝতে পারলো না। গাড়ি থেকে নেমে একটা পার্কের মতন জায়গায় চলে এলো ওরা। বেঞ্চিতে দুপুরকে বসিয়ে নিখিল একদম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবটাই বুঝিয়ে বললো দুপুরকে। সব শুনে কান্নাভেজা চোখে রোদের দিকে তাকালো দুপুর। নিজেকে সামলাতে পারলো না কিছুতেই। বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
কান্নাকাটি থামলে নিখিল দুপুরকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি আমার হাত ধরতে চাচ্ছো দুপুর?”
প্রশ্নটা সরাসরি হৃদপিন্ডে গিয়ে আঘাত করলো দুপুরের। এই ছেলেটাকে ছাড়া বাঁচার কথা চিন্তাও করতে পারতো না ও। কিন্তু এখন যে ও অন্য কারো স্ত্রী। একটা বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছে সে, হাজার চাইলেও অরণ্য এখন ওর স্বামী। তাকে ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? করুণ চোখে নিখিলের দিকে তাকালো দুপুর।
নিখিল জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো? তুমি না চাইলে জোড় করবো না। তবে আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই। কিন্তু তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিৎ। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
ভালোবাসা শব্দটা শুনে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো দুপুর। ভালোবাসার জন্য চরম স্বার্থপরতাও করা যায়। নিখিলের মত করে অরণ্য এ জীবনেও ওকে ভালোবাসতে পারবে না। তাছাড়া সবকিছু শোনার পর অরণ্য’র সাথে সংসার করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ওর নেই। বরং ঘৃণা হচ্ছে অরণ্য’র প্রতি। রোদের মত একটা মেয়েকে যে এভাবে অপমান করতে পারে, সে আর যাই হোক কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।
দুপুর এগিয়ে এসে নিখিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “হারানোর যন্ত্রণা কতটুকু জানো না? এই কয়টা দিনে আমি হারে হারে বুঝেছি। হারিয়েও আবার ফিরে পেয়ে কি করে ফেরাই তোমায়?”
সবকিছুর সমাধান তো হয়েই গেলো। রোদ ভয় পেয়েছিলো দুপুর আসতে আপত্তি জানায় কিনা সেটা ভেবে। এখন আর চিন্তা নেই। বাবার সাথে দুপুর মুখোমুখি হলে সবই ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। রোদ দুপুরের হাত ধরে বললো, “তোরা খুব সুখী হবি দেখিস।”
দুপুর বললো, “সবই ঠিক আছে। কিন্তু এখনি বাসায় যাওয়া যাবে না। অন্তত কটা দিন আমাদের গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। এখনি অরণ্য আমাদের দেখা পেলে একটা ঝামেলা বাঁধবে।”
কথাটা একেবারে খারাপ বলেনি। কোথাও উঠতে পারলে বেশ হতো। তারপর বাবাকে সেখানেই ডেকে নিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু নিখিলকে গ্রামের লোকজনের সামনে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এলাকাবাসী নানান কথা বলবে। কিন্তু থাকার মত কোনো জায়গা তো দরকার। ভাবতেই দুপুরের মিশুর কথা মনে পড়ে গেলো। মিশু বলেছিলো মেঘালয় একটা বাড়ি দিয়ে দিয়েছে ওকে। ওর বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন নিরাপদে থাকা যাবে। মিশু আর মেঘালয়ের মত কাউকে জীবকে দেখেনি দুপুর। ওরা খুবই অন্যরকম একটা জুটি, ওদেরকে বুঝিয়ে বললে একটা ভালো উপায় বের হবে।
দুপুর নিখিলকে কথাটা বলতেই নিখিল রাজি হয়ে গেলো। দুপুরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করা যায়। রাতে যখন মিশুর ফোনটার সাথে ফোন বদল হয়ে গিয়েছিলো, তখন মিশুর ফোন থেকে দুপুর নিজের নাম্বারে কল দিয়েছিলো একবার। তারমানে মিশুর নাম্বার ওর ফোনে আছে।
দুপুর ফোন বের করে দেখল অরণ্য অসংখ্যবার কল দিয়েছে। ও মিশুর নাম্বার টা নিখিলের ফোনে তুলে নিয়ে নিজের ফোন একেবারে বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলো। তারপর মিশুর নাম্বারে একটা টেক্সট পাঠালো, “আমি দুপুর। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে, কিন্তু অরণ্যকে বুঝতে দিওনা আমি মেসেজ পাঠিয়েছি। মেসেজ দেখে থাকলে সাইডে এসে কল ব্যাক করো।”
কিছুক্ষণ পরেই মিশুর নাম্বার থেকে কল এলো। দুপুর মেঘালয়কে ফোন দিতে বললে মিশু মেঘালয়ের হাতে ফোন দিলো। মেঘালয় বললো, “হ্যালো।”
– “ভাইয়া আমি দুপুর। আপনারা এখন কোথায়?”
– “আমরা এখনো রুমে। এখন বের হবো। তোমরা কি লবিতেই আছো?”
– “আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। আপনি কি একটু কষ্ট করে আসতে পারবেন? আসলে সবকিছু খুলে বলবো। কিন্তু দয়া করে কাউকে বুঝতে দিবেন না আমি ফোন দিয়েছিলাম।”
কথা শেষ করে মিশুকে রুমে রেখে দুপুরের নাম্বার টা নিজের ফোনের ডায়ালে নিয়ে মেঘালয় হোটেল থেকে বেড়িয়ে এলো। নানান প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। গাড়ি নিয়ে দ্রুত এসে হাজির হলো ওদের কাছে। কিন্তু রৌদ্রময়ীকে দেখে আরো একটু অবাক হলো মেঘালয়। তারমানে একটা জট এই মেয়ের সাথেই আছে। রৌদ্রময়ীও বিস্মিত হলো মেঘালয়কে দেখে। ওদেরকে ট্রেনে দেখেছিলো ও। ওর সাথে থাকা মেয়েটা খুব করে এসে আলাপ জমাতে চাইছিল। সেই মেয়েটাই তাহলে মিশু! চমকালো রৌদ্রময়ী।
সবকিছু শোনার পর মেঘালয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “একদম ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনারা আমার বাসায় গিয়ে উঠতে পারেন। বাড়ি একদম ফাঁকা। যেকোনো হেল্প লাগলে শুধু একবার স্মরণ করবেন আমাদের।”
দুপুর মেঘালয়ের হাত ধরে বললো, “আমার কোনো ভাই নেই। আজ থেকে তুমি আমার ভাই। তোমাকে দেখেই আমার হিংসে হচ্ছিল, আর নিখিলকে কল দিয়ে কাল কান্নাকাটি করেছিলাম। নয়ত ওকে সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলতাম।”
মেঘালয় হাসলো। রৌদ্রময়ী দুপুরের বোন সেটা কালকেই ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। আর রোদের সাথে অরণ্য’র বিয়ের কথা ছিলো, কিন্তু রোদ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কারণে দুপুরের সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলো মেঘালয়। আজকে সমস্ত জট খুলে গেলো।
মেঘালয় বললো, “নিশ্চিন্তে চলে যাও বোন। মিশুর মুখে আমার গল্প শুনে বিশ্বাস করে আমাকে ডেকে এনে এসব শেয়ার করলে তাতেই আমি অনেক বেশি সন্তুষ্ট। এরকম বিশ্বাস আজকাল কে কাকে করে? হাজার হলেও আমি অরণ্য’র বন্ধু।”
– “আপনার মত মানুষ হয়না মেঘালয় ভাইয়া। পৃথিবীর সব মানুষ যদি আপনার মত হতো!”
– “তোমরা তাহলে এখনি বেড়িয়ে পড়ো। আমি আম্মুকে জানিয়ে দিবো, চাবি পাঠিয়ে দিবে। আর বিয়ে পড়ানো সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতায় আমাকে কল দিও। আর হ্যা, টাকার দরকার হলে লজ্জা না পেয়ে জাস্ট একটা ছোট্ট মেসেজ দিবা ওকে?”
নিখিল এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মেঘালয়কে। এরকম ছেলেও পৃথিবীতে আছে! শিহাব ও জড়িয়ে ধরলো মেঘালয়কে।
মেঘালয় রৌদ্রময়ীকে বলল, “আপনার মানসিক অবস্থা ভালো নেই এখন। একা একা ওনার বোনের বাসায় গিয়ে কি করবেন? তারচেয়ে বরং আমাদের সাথে এখানে তিনটা দিন থেকে যান। আমরা আজকে হোটেল ছেড়ে দিচ্ছি। চা বাগানে পুরো বাংলোটাই আমাদের জন্য। থাকার কোনো সমস্যাই হবেনা।”
দুপুর উচ্ছ্বসিত হয়ে রোদকে বললো, “আপু, মিশুর মত একটা চমৎকার মেয়ে কোথাও পাবিনা। আর ওনার সব বন্ধুরাই এত ভালো আর মজার। তোর খুব ভালো লাগবে, মনটা ভালো হয়ে যাবে দেখিস।”
রোদ বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে। আমি তাহলে থেকে যাই। তোরা নিজেরা সাবধানে থাকবি।”
এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠলো রোদের মুখে। নিখিল ও দুপুর বিদায় নিয়ে চলে গেলো শিহাবের গাড়িতেই। অন্য কোথাও থেকে ঢাকার গাড়িতে উঠবে ওরা। আর মেঘালয় রৌদ্রময়ীকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে ওকে বসিয়ে রেখে নাস্তা দিতে বললো। তারপর নিজের ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বললো, “এটা আপাতত আপনার কাছে রাখুন। ফোন খুব দরকারি। আমি এক্ষুনি হোটেলে যাবো আর ওদেরকে নিয়ে চলে আসবো।”
রোদ খুব অবাক হলো মেঘালয়ের উদারতা দেখে। এতকিছুর পর আবার নিজের দামী মোবাইল টাও ওর হাতে দিয়ে যাচ্ছে। এতটাও বিশ্বাসী কেউ হয়? সত্যিই দুপুর ঠিকই বলেছে। মিশু অনেক ভাগ্য করে এমন একজন মানুষ পেয়েছে। দুপুরের হিংসে হওয়ার কারণ যথার্থ। এমন একজনকে পেলে সুখী না হয়ে উপায় আছে?
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here