সম্পর্ক
অলিন্দ্রিয়া রুহি
|পর্ব ৫|
_____________
‘আমাকে দুইটা হাজার টাকা দিবে আবির?’ ফোনের মধ্যে বলল দুপুর। আবির বিনিময়ে একটা হাসি ছুঁড়ে দিল। দুপুরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘আজ কোচিং-এ ক্লাস করোনি কেন?’
দুপুর মিথ্যে করে বলল, ‘আমি তো আজ কোচিং যাইনি।’
আবির আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তে বলল, ‘তাহলে ভাবি যে আমাকে বলল, তুমি আজ কোচিং গিয়েছো। মিথ্যে কেন বলছো দুপুর?’
‘আজকেও ভাবির সাথে কথা হইছে তোমার?’
‘হ্যাঁ, হইছে।’ আবির মিথ্যে বলে। রতির সাথে আর কথা হয়নি। কিন্তু মিথ্যের মাধ্যমেই দুপুরের মুখ থেকে সত্যি আদায় করা যাবে।
দুপুর রতির উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। সকালেও যেটা নিয়ে ঝগড়া হল, মারামারি হল, পুনরায় ঠিক একই কাজ করেছে রতি!
‘কথা বলছ না কেন? আমাকে মিথ্যে কেন বললে তুমি?’
‘না, মানে, আসলে আবির…’
‘আমতা আমতা করছ যে! উত্তর নেই?’
দুপুর চুপ করে থাকে। আবির আর কিচ্ছুটি না বলে ফোন কেটে দেয়। দুপুরের মেজাজ আবার চড়ে যায়। রতিকে আজকে সে দেখেই নিবে।
রতি আর আরাফ মাত্রই শুয়েছে, দুপুর গিয়ে দরজায় নক করে।
‘দরজাটা খুলে দেখো তো কে।’ বলল আরাফ৷ রতি উঠে দরজা খুলতেই দুপুর হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ল। রতির দিকে বিষাক্ত এক চাহনি নিক্ষেপ করে আরাফকে ডাকতে লাগল, ‘ভাইয়া, এই ভাইয়া।’ দুপুর কেঁদে ফেলল। আরাফ চকিতে দ্রুত উঠে বসল।
‘আরে, আরে! কাঁদছিস কেন? কী হইছে দুপুর?’
‘তোমার বউ আবার আবিরের কানে উল্টাপাল্টা কথা লাগাইছে। আবির আমাকে সন্দেহ করতেছে এখন। রেগে কল কেটে দিছে। ভাবিকে জিজ্ঞেস করো, কী সমস্যা তার? কেন আমার সাথে এরকম করে? আমার সুখ সে দেখতেই পারে না। আমার আর আবিরের মধ্যে কেন সবসময় থার্ড পার্সন হয়ে আছে সে?’
রতি অবাক হয়। সে আবার কী করল? আবিরের সাথে তো কোনো কথাই হয়নি!আরাফ রতির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে সকালে যেটার জন্য মারলাম, তারপরও শিক্ষা হলো না?’
‘আমি কিছু করিনি আরাফ। আবির ভাইয়ের সাথে আমার আর কথা হয়নি তো। তুমি চাইলে আমার ফেসবুক… ‘
রতির কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই আরাফের পাঁচ আঙুলের ছাপ রতির গালে বসে। রতি ছিটকে নিচে পড়ে যায়। আরাফ রতির বাহু ধরে টেনে তুলল। তারপর এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল। লিলি বেগম আর তাশরিফ ছুঁটে আসে। তাশরিফ একবার দেখে চলে যায়। দুনিয়া জাহান্নামে যাক, তার এসবে ভাবান্তর নেই। লিলি বেগম দুপুরের মুখ থেকে সব শুনে নিজেও রতির গালে চড় লাগান। তখনই আহ্নি ছুটে আসল, ‘ছাড়ো ভাইয়া, ছাড়ো। ভাবিকে মারছ কেন? কী করছে ভাবি?’
লিলি বেগম জঘন্য ভাষায় মা-বাপ তুলে গালাগালি করতে থাকেন রতিকে। শাপশাপান্ত করেন। রতি দুর্বল গলায় বারবার বলছে, ‘আমি কিছু বলিনি কাউকে। বিশ্বাস করো, আবির ভাইয়ার সাথে আমার কথা হয়নি।’
আহ্নি সব শুনে দ্রুত নিজের ফোন দিয়ে আবিরের ইমোতে কল করে। আবির কল ধরতেই বলে, ‘ভাইয়া ভাবি কী আপনাকে আজকে বলছে আপার কোচিং যাওয়ার বিষয়ে কিছু?’
‘না বলেনি। কেন আহ্নি? তুমি কাঁদছো কেন?’
‘আপা সবাইকে মিথ্যা বলছে। আর সেসব বিশ্বাস করে আম্মু, ভাইয়া ভাবিকে অনেক মারতেছে। আমি কী করব, বুঝতেছি না।’
‘কী বলো! তুমি দ্রুত গিয়ে আরাফ ভাইকে ফোন টা দাও।’
‘ঠিক আছে।’
আহ্নি আরাফ কে টেনে এক পাশে সরায়। শশব্যস্ত গলায় বলল, ‘আবির ভাই লাইনে, তোমার সাথে কথা বলবে।’
আরাফ একটু থামল। ফোন কানে নিয়ে বলে, ‘হ্যালো।’
‘লাউড স্পিকার দিন। আমি যা বলব, সবাই শুনুক।’
আরাফ ফোন লাউড স্পিকার মুড করে।
‘ভাবির কোনো দোষ নেই। ভাবি আমাকে কিছু বলেনি। ইনফ্যাক্ট, ভাবির সাথে আজকে কথাই হয়নি আমার। আপনাদের মেয়ে, দুপুর, কোচিং এর নাম করে আবার ঘোরাঘুরি করছে। আর সেসবের প্রমাণ আমি অনেকটাই পেয়েছি। সে কোচিং যায় না অথচ আমাকে মিথ্যে বলে! তাই আজকে আমি আন্দাজে বলছিলাম যে, ভাবির থেকে জানছি। আর এইজন্যে এতকিছু হবে আমি ভাবতেও পারিনি। সরি ভাবি।’
রতি মেঝেতে আলুথালু চুলে বসে আছে। কাঁদছে না তবে কাঁপছে।
আবির এবার কঠিন সুরে বলল, ‘দুপুর তোমার রুমে যাও। আর আমাকে আলাদাভাবে কল দাও।’
দুপুর ছোট্ট করে বলে, ‘আচ্ছা।’
‘আরাফ ভাই, অন্যের মেয়ের উপর অত্যাচার করার আগে এটা ভাবুন যে আপনার নিজের কিন্তু বোন আছে। রাখছি।’
আবির কল কেটে দেয়। দুপুর দ্রুত নিজের ঘরে যায়। লিলি বেগম ও চলে যান। আহ্নি আরাফের দিকে ঘৃণাভরা একটি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে রতির কাছে যায়। রতিকে ধরে ধরে দাঁড়া করালো।
‘ভাবি কে আমি নিয়ে গেলাম। আজকে আমার সাথে ঘুমাবে।’
কথা ছুঁড়ে দিয়ে পাথরের মতো জমাট হয়ে যাওয়া রতিকে নিয়ে চলে যায় আহ্নি। আরাফের মন আচানক অনুশোচনায় ভর্তি হয়ে উঠল।
____________
প্রান্ত ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল,মঈনুল হোসেনের সাথে বাগানে দেখা হয়ে গেল। তিনি গাছে পানি দিচ্ছেন।
‘ভার্সিটি যাচ্ছ?’
‘জি স্যার। আপনি আজ যাবেন না?’
‘না বাবা। আজ আমার ক্লাস নেই। একটা কাজ করবে প্রান্ত?’
‘জি, বলুন।’
‘মৌনিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসবে? তুমি গেলে আমি আর যাব না।’
‘সমস্যা নেই।’ অনিচ্ছা স্বত্তেও বলল প্রান্ত। মৌনির সাথে আবার কথা বলতে বা মিশতে ইচ্ছে করছে না তার কিন্তু স্যারের মুখের উপর তো না করা যায় না! মৌনি রেডি হয়ে বাইরে এলো তখুনি..
‘কই বাবা, চলো।’ বলল মৌনি।
‘প্রান্ত ওদিকেই যাচ্ছে। তুই আজ প্রান্ত’র সাথে যা।’
‘উনার সাথে?’
‘হ্যাঁ, সমস্যা কী?’
মৌনি প্রান্ত’র দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘না, কোনো সমস্যা নেই।’
শেষমেশ প্রান্তের সাথেই স্কুলে রওনা হলো মৌনি। রাস্তায় দু’জনেই চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। হুট করে মৌনি বলল, ‘আপনি আমার আগে হাটুন, নইলে পিছে হাটুন। সাথে সাথে হাটবেন না।’
প্রান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কেন, সাথে সাথে হাটলে কী?’
‘মানুষ দেখলে ভাববে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড। এই এলাকায় সবাই আমাকে চিনে। সবার চোখে আমি অনেক ভালো মেয়ে। আমি চাই না আমার ভালোর রেকর্ড টা নষ্ট হোক।’
প্রান্ত কপট রাগ নিয়ে বলল, ‘বয়ফ্রেন্ডই ভাববে? আর কিছু ভাবতে পারে না? মানুষের কী এতোই ঠ্যাকা? আর কেউ তো জানে না তোমার ভেতরে কী, তাই ভাবে কত ভালো মেয়ে তুমি! কচুর ভালো মেয়ে!’
‘এই কী বললেন, কী বললেন আপনি?’ মৌনি রেগে গেল।
‘কানে কমও শোনো নাকি? শুনতে পাওনি কী বলেছি?’ কাঠখোট্টা কণ্ঠেই জবাব দিল প্রান্ত।
‘আপনি কিন্তু লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছেন আপনার।’
‘লিমিট আমি ছাড়াচ্ছি নাকি তুমি ছাড়াচ্ছো? আমি যে তোমার শিক্ষক, মিনিমাম রেস্পেক্টটুকু তো দেও না।’
‘বাবার জন্য পড়তে হচ্ছে আপনার কাছে। নয়তো কে মানে আপনাকে শিক্ষক?’
প্রান্ত লাল চোখে মৌনির দিকে তাকায়, মৌনিও বিনিময়ে আগুন গরম দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়। এ যেনো এক জোড়া শালিকের খুনসুটিময় ঝগড়া! আচমকা কী যেন হয়, প্রান্ত কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও সামলে ফেলে নিজেকে। তাকিয়ে দেখে একটি মেয়ে রাস্তায় বসেই পড়েছে। প্রান্ত মৌনির দিকে তাকিয়ে থাকায় সামনে কে আসছে খেয়াল করেনি, আর দুর্ঘটনা ঘটে গেল!
প্রান্ত এগিয়ে যেতে যেতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। হাত তালি দিয়ে হাতের বালু ঝাড়ে, শরীর থেকে বালু ঝেড়ে ফেলে দেয়। তারপর প্রান্ত কিছু বলার আগেই বলে, ‘ইটস ওকে। আমি বুঝেছি আপনি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেননি। শুনুন ভাইয়া, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাটছেন ভালো কথা। একটু দেখে হাটবেন, নয়তো অন্যকেউ হলে ছাড়বে না। ঝামেলা বাধাবে।’
গটগট করে হেটে চলে যায় আহ্নি। কলেজ যাওয়ার সময়েই একটা ভেজাল হলো, না জানি পুরো দিনটা কেমন যায় তার! আহ্নির চলে যাওয়ার পথে চেয়ে রইল প্রান্ত। আর প্রান্তের দিকে চেয়ে রইলো মৌনি। মৌনি আকস্মিক আবিষ্কার করল, অন্য একটি মেয়ের দিকে প্রান্তের এভাবে তাকিয়ে থাকা, মৌনির ভালো লাগছে না। একদমই না.. মৌনির বুকে অনিশ্চয়তার চিন্তারা গুটিগুটি পায়ে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে… তবে কী এখান থেকেই ‘ভালবাসার ত্রিভুজ’ শুরু হলো তাদের?
আকাশ মেঘে-মেঘে ছেয়ে গেছে। গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে, এই বুঝি মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামল।
ক্লাস চলছে, মৌনির পাশে বসে তার ফ্রেন্ড রূম্পা নিচু গলায় এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে, ‘হাবিবকে হ্যাঁ বলে দিবো ভাবছি। কতদিন হলো ও ঘুরছে আমার পেছনে! আচ্ছা মৌনি, হাবিব কে তোর কাছে কেমন লাগে এমনিতে? আমার কিন্তু ভালোই লাগে। আরো আগে যে কেন হ্যাঁ বললাম না, তাই ভাবছি! কী সুন্দর ছোট্ট একটা মুখ, দেখলেই কেমন নিষ্পাপ নিষ্পাপ লাগে, তাই না বল? আর চোখ জোড়া তো… উফ, এত্তো মায়াবী। এই মৌনি,শুনছিস আমি কী বলছি? মৌনি..’ রূম্পা মৌনির গায়ে আস্তে ধাক্কা দিলে মৌনি কেঁপে উঠে বাস্তবে ফিরে আসে। রূম্পার মুখ থেকে ভালবাসার কথা শোনার সময় আচমকাই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গিয়েছিল মৌনি। চোখের তারায় বারবার প্রান্তের মুখটা ভেসে উঠছিল। প্রান্তের মুখটাও নিষ্পাপ, বড় চোখে মায়া ভরা, মুখ জুড়ে মাদকতা। এক কথায় কিউট!
উফ, আবার প্রান্ত? আজ এতো প্রান্ত প্রান্ত করছে কেন মৌনির মন? মাত্র একদিন হলো প্রান্তকে চেনে সে। এত অল্প সময়ে কারো প্রতি কারো মায়া হয়? ভালোলাগা জন্মায়? বাকি পুরোটা ক্লাস মৌনি অমনোযোগী থাকল। মন বসাতে পারল না কিছুতেই। নীরবে মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ চলে ভেতরে ভেতরে.. যেখানে মন জিতে যায় বারংবার।
_______
দুপুরের প্রতি আবির প্রচুর রেগে আছে। দুপুরের কারণেই রতির উপর এত টর্চার হলো, আবির কিছুতেই মানতে পারছে না এটা। দুপুরও আবিরের উপর ক্ষুব্ধ। সবসময় রতিকে নিয়েই এত কেন ভাবে আবির? রতি কী হয় তার? দুপুরের থেকেও রতির প্রতি এত কেন মায়া? দরদ?
দুপুর ভাবছে, আর সম্ভব না। এবার এখানেই এই সম্পর্কের ইতি টানবে সে। লিলি বেগম দুপুরের ঘরে আসেন৷ দুপুরকে এত অন্যমনস্ক থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘কীরে, কী ভাবছিস?’
দুপুরের ধ্যান ভাঙে, ‘ও, মা.. বসো তো। তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।’
লিলি বেগম বসলেন, ‘কী?’
‘আবিরকে নিয়ে। আম্মু, আমার কাছে আবিরের হাবভাব একদম ভালো লাগে না। ও সবসময় এতো কেন ভাবির সাপোর্ট করে? আমাকে নিয়ে ওর যতটা মাথাব্যথা এরচেয়েও বেশি মাথাব্যথা ভাবিকে নিয়ে। কালকে ও আমাকে কতকিছু শুনিয়েছে, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না আম্মু।’ দুপুর ডুকরে উঠল।
লিলি বেগম চুপ করে রইলেন। দুপুর নিজেকে সামলে আবার বলল, ‘আমার আর সহ্য হয় না আম্মু। বিয়ে হইছে তো কী হইছে? আমাকে একদম কিনে ফেলছে? আজীবন এখানেই পড়ে থাকতে হবে? আমি আর নিতে পারছি না। আমি এই সম্পর্কের থেকে মুক্তি চাই আম্মু, মুক্তি চাই।’
দুপুরের মুখ থেকে মুক্তির কথা শুনতেই লিলি বেগম আঁতকে উঠলেন। এই মেয়ে ভীষণ জেদি, একবার যখন ঠিক করে নিয়েছে, আবিরের থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন আসবেই! আবির হলো সোনার ডিম পাড়া হাঁস, এমন হাঁসকে তো কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না।
‘আপাতত একটু ধৈর্য্য ধর দুপুর। আবির বড়লোক ঘরের ছেলে। ওদের অনেক টাকাপয়সা। ওর নিজের নামে বাড়ি হচ্ছে। এখন কিছু বলিস না। ও যা চায়, যেভাবে বলে ওভাবে চল। তোকে উঠিয়ে নিক, তারপর ওই বাড়ি তোর নামে লিখিয়ে নে কোনোভাবে। তারপর দেখা যাবে।’ বললেন লিলি বেগম, খুব সন্তপর্ণে, পাছে কেউ টের পেয়ে যায় দুই লোভী মা-মেয়ের কীর্তি কথা!
দুপুর কিছু বলতে যাবে, তখনি চাঁদ ফোন করল। দুপুর চোখ মুছে ফোন রিসিভ করে। বিষন্ন গলায় বলল, ‘হ্যালো।’
ওপাশ থেকে চাঁদ বলল, ‘হ্যালো ডার্লিং, টাকার জোগাড় হইছে?’
দুপুর জবাব দেয় না।
দুপুরের নিশ্চুপতা চাঁদকে তার উত্তর দিয়ে দেয়, ‘হয়নি? আর একদিন সময় আছে দুপুর। যদি না দিতে পারো..’
দুপুর মিনমিনিয়ে বলল,’আমি কোথায় পাবো এত টাকা?’
চাঁদ খেঁকিয়ে উঠল, ‘ওটা আমি কী জানি? কালকে আমাকে টাকা দিবে, ব্যস। রাখছি।’
চাঁদ ফোন রেখে দেয়। দুপুর তারপরও ফোন কানে নিয়ে বসে থাকে। বুক ধুকপুক করছে তার। টাকা না দিতে পারলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে!
লিলি বেগম দুপুরের ফ্যাকাশে চেহারা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। বললেন, ‘কী হইছে রে? কে ফোন দিছিলো? আর কীসের টাকা?’
দুপুর জবাব দিলো না। তার ভয় লাগছে।
‘কীরে বোবা হয়ে আছিস কেন? বল.. কীসের টাকা।’
দুপুর ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আমাকে দুইটা হাজার টাকা জোগাড় করে দিতে পারো আম্মু? নয়তো অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে।’
‘কীসের ঝামেলা?’ চমকে উঠলেন লিলি বেগম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবকিছু খুলে বলল দুপুর। লিলি বেগম ঠাস করে দুপুরের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। দুপুর কেঁদে ফেলল।
দুপুরের মুখ চেপে ধরে কাঠখোট্টা গলায় বললেন, ‘এত অঘটন কীভাবে ঘটাস তুই? এখন আমি কোথাথেকে জোগাড় করব? হুঁ?’
দুপুর কিছু বলার জন্য মুখ নাড়াতেই লিলি বেগম হাত সরিয়ে নিলেন, দুপুর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আর হবে না আম্মু, এই শেষবার। প্লীজ আম্মু, নইলে চাঁদ সবকিছু আবিরকে দেখিয়ে দিবে। তখন…’
দুপুর কাঁদছে, কথা জড়িয়ে আসছে। লিলি বেগম মেয়েকে বুকে টেনে শান্ত করার চেষ্টা করেন। আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘কাঁদিস না দুপুর। আরাফ আসুক, দেখি কোনো ব্যবস্থা হয় কীনা। তবে এই শেষবার.. ‘
আজ কতদিন ধরে রতির প্রস্রাবে সমস্যা হচ্ছে। সেই সাথে কোমরে সবসময়ই ব্যথা থাকে। জরায়ুর নাড়েও মাঝে মাঝে চিলিক দিয়ে উঠে ব্যথা করে। রতির অনুমান, জরায়ুতে কোনো সমস্যা হচ্ছে নইলে কিডনিতে। একবার পরীক্ষা করাতে পারলে বেশ ভালো হয়। আরাফ লেপটপে অফিসের কাজ করছিল বসে বসে। রতি গিয়ে তার সামনে বসল। আরাফ কোল থেকে লেপটপ সরিয়ে রাখল। গতকাল রতির সাথে যেটা করেছে এরপর থেকে আরাফের মনে একটু অনুশোচনাবোধ কাজ করছে। না জেনে না বুঝে রতির উপর এভাবে টর্চার করা ঠিক হয়নি,এই জিনিসটা আরাফও বুঝেছে।
আরাফ নিজে থেকেই বলল, ‘কিছু বলবে?’
রতি শান্ত গলায় জবাব দিল,’আমাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? আজ অনেকদিন ধরে প্রস্রাবে সমস্যা হচ্ছে। জ্বালাপোড়া করে।’
‘কতদিন ধরে?’
রতি একটু ভেবে বলল, ‘তিন সপ্তাহ। আনুমানিক।’
‘আচ্ছা, আমি নিয়ে যাবে কালকে।’
রতি অবাক হলো, সেই সাথে খুশিও। অবাক হলো এই কারণে যে, এর দ্রুত আরাফ তার কথা মেনে নিবে তাও একদম বাকবিতন্ডা ছাড়া! ব্যাপারটা রতির কাছে চমকপ্রদ। মাস দুই আগে রতির জ্বর উঠেছিল একবার, আরাফ তাই নিয়ে কত বকল! কত কথা শুনালো.. ‘মেয়ে মানুষ, ঘরে শুয়ে বসে এত জ্বর হয় কেমনে? বাইরে কামলা খাটি আমরা। আমাদের জ্বর হলে মানা যায়। এখন শুধুশুধু ঔষধ আনো, টাকা গছাও! বেহুদা ঝামেলা করো সবসময় তুমি..’ আর আজ একদম বিনাবাক্যে মেনে নিল! রতি নিশ্চুপ হয়ে এসব ভাবছে, ওদিকে আরাফ রতিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। একসময় চেহারায় আলাদা একটা উজ্জ্বলতা ছিল রতির, আজ তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, গালে গর্তমতো, চোখের তলায় কাজলের ন্যায় গাঢ় কালির ছাপ! মেয়েটা তো প্রতিদিন রাতে ভুসভুস করেই ঘুমায়, তাহলে এত কালি পড়ল কীভাবে?
‘বাবু জাগনা আছিস?’ বলতে বলতে লিলি বেগম ঘরে ঢুকলেন। রতি একটু সরে বসল। আরাফও রতির থেকে মন হটিয়ে মায়ের দিকে তাকাল।
‘একটা কথা বলতে আসছি বাপ।’ বলতে বলতে লিলি বেগম বসলেন।
‘কী মা?’
‘আমারে দুইটা হাজার টাকা দে তো তোর কাছে থাকলে। আজ কয়দিন ধরে মাজায় ব্যথা। নড়তে চড়তে বহুত কষ্ট হয়। বড়টা তো টইটই করে ঘুরে সারাদিন। ওর কাছে আর কীইবা চাইব? তাই তোর কাছে আসলাম। আছে টাকা?’ লিলি বেগম কোমরে এক হাত চেপে ‘উঁউঁউঁ’ করে উঠলেন, ‘দেখছোস, একটু হাইটা আসছি দেইখা কেমন চড়মড় করতেছে কোমরটা…’
আরাফ একবার রতির দিকে তাকাল। রতির চোখে জল চকচক করছে, সে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল। আরাফ মানিব্যাগ থেকে একহাজার টাকার দুইটা নোট বের করে মায়ের হাতে দিতেই লিলি বেগম উঠে দাঁড়ালেন,স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে বেরিয়ে আসলেন। এই তার কোমরে ব্যথা? রতি সব বুঝেও চুপ করে রইল। বলে লাভ কী?
আরাফ রতির হাত ধরে তাকে টেনে খাটে বসালো। বলল, ‘সামনের মাসে বেতন পেয়েই নিয়ে যাব, ওকে? আর তুমি পানি কম খাও দেখেই এইসব হচ্ছে। বেশি পানি খাও দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে।’
রতির একবার ইচ্ছে করল বলতে, ‘সবকিছুর নিরাময় যদি আমরা পানি খেয়েই করতে পারতাম তাহলে ডাক্তারি পড়ত না কেউ এত কষ্ট করে আরাফ!’ কিন্তু বলল না, শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াতে চায় না সে। রতি ক্ষীণ একটু হাসি ছুঁড়ে দিল, তবে তখনো চোখে তার চিকচিক করছে জল!
চলবে…
কতবড় একটা পর্ব দিলাম, এবার তো একটু ভাল, বড় কমেন্ট করেন সবাই🥺 খালি নাইস আর নেক্সট!! 😔