#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব-১৮
উল্টোদিকে ফিরে নিঃশব্দে শুয়ে আছে ইনায়া। রেহানকে আরও প্রশ্ন করলেও উত্তর পায়নি ও। ঘুমোতেও ইচ্ছে করছে না। ভিষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছে সামনে শুধু বিশাল গোলকধাঁধা। যার শেষ প্রান্ত কোথায় ইনায়া জানে না।
-“তোমাকে কি বাচ্চাদের মতো গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে?”
ইনায়া মনে করেছিল রেহান ঘুমিয়ে পড়েছে তাই উঠে বসেছিল।
-“গল্প না। আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। সাদাফ কোন নিরাপরাধ মানুষ না সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। কেউ শুধু ভয়ে সাদাফের বিরুদ্ধে কিছু করেনি। নিজের চোখে দেখেছি আমি! এই মুহুর্তে আপনার কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস তো আমি করবো না! সাদাফের সাথে আপনার বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আমি জানি! সত্যি করে বলুন তো, আমার সাথে যা হয়েছে তাতে আপনার কোন…!”
শেষের কথাটা বলার আগেই রেহান ইনায়ার মুখ চেপে ধরলো। চোখ দিয়ে যেন রক্ত বেরুচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ইনায়ার!
বিকেলের দিকে অনলাইনে এক নিউজ ওয়েবসাইট থেকে সাদাফের চেহারা দেখে ও। সাদাফই ওকে কিডন্যাপ করেছিল! প্রত্যাশার কাছ থেকে আরও জানতে পারে সাদাফ প্রায়ই রেহানের সাথে দেখা করতে আসতো। রেহানের বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে গেলে। তাই অনেকের ধারণা সাদাফের সাথে রেহানও জড়িত। আবার অনেকের ধারণা ঠিক তার উল্টো।
-“অনেক বলেছো, সব সহ্য করেছি! এটা সহ্য করবো না আমি! আমাকে এতটা নিচ কি করে ভাবো তুমি!”
চিৎকার করে ওঠে রেহান!
ঘোলাটে হয়ে আসছে ইনায়ার চারদিক। রেহানের কোন কথা যেন ওর কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। নীল রঙের ড্রিম লাইটটা চোখের পলকে নিভে গেল। যেন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পুরো জগৎ। নিজের শরীরে আরো একটা হাতের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে ও। আবারও সেই নোংরা স্পর্শ!সেই বিভৎস হাসি, সেই বিভৎস চাহনি! বারবার হাত পা ছুড়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে ইনায়া কিন্তু প্রতিবারই ব্যার্থ হচ্ছে! ওর সামনে অতীত আর বর্তমান দুটোই যেন ধোঁয়াশা!
ইনায়াকে অনবরত কাঁপতে দেখে ঘাবড়ে যায় রেহান।ওর মুখ ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ইনায়া দুই হাতে মাথা ঢেকে আবারও পূর্বের ন্যায় গুটিয়ে যাচ্ছে। পারলে যেন দেয়ালেই মিশে যায়।
একটু পর খুব ভয়ংকর ভাবে নিজের হাতে গলায় আঁচড় কাটতে শুরু করলো ইনায়া। যেন কিছু একটা সরানোর চেষ্টা করছে ও! রেহান ওকে থামানোর চেষ্টা করতেই পাগল মতো হাত পা ছুড়তে থাকে ইনায়া। রেহানের মনে হচ্ছে ওর সামনে ইনায়া না বরং ও নিজেই বসে আছে! দুই একবার চোখের পলক ফেলে ছিটকে সরে যায় রেহান। স্তব্ধ হয়ে যায় ও। রেহান সরে যেতেই ইনায়া থেমে গেল। চোখ বন্ধ করে আগের জায়গাতেই চুপচাপ বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। দুজনের মধ্যে বিরাজ করছে ভয়ংকর নিরবতা!
ঘড়িতে সময় রাত দুইটা। ইনায়া গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে একটু পর পর কেঁপে উঠছে! ইনায়ার শরীরে আঁচড়ের দাগগুলোতে মলম লাগিয়েই সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো রেহান।
রেহানের বাবা পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ কড়া ছিলো। বিশেষ করে রেহানের ক্ষেত্রে। একটু এদিক সেদিক হলেই বাড়ির সবাই তার ক্রোধে কেঁপে উঠতো। রেহান ছোটকাল থেকেই মোটামুটি রকমের স্টুডেন্ট হলেও সেটা রেহানের বাবা রিয়াদ খানের জন্য গ্রহনযোগ্য ছিলো না। তার মতে রিয়াদ খানের ছেলেকে সবক্ষেত্রেই ফার্স্ট হতে হবে।
একসময় এই কড়া চাপে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে রেহান। ধীরে ধীরে পড়াশোনা থেকে মন উঠতে থাকে। রিয়াদ খান এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে রেহানের জন্য আরও বাড়তি একজন টিউটর রাখলো। দিনের বেশিরভাগ সময় স্কুল, টিউটর আর রাত জেগে পড়ার নিয়মে ওর পড়ালেখা থেকে মন তো গেলোই উল্টো রেজাল্ট আরও খারাপ হচ্ছিলো। একদিন ইয়াসমিনের সাথে এ বিষয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় রিয়াদ ইয়াসমিনকে রেহানের সামনেই চড় দিয়ে বসে। ছোট্ট রেহান এসব মেনে নিতে না পেরে কাউকে কিছু না জানিয়ে সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ঠিক এক মাস পর রেহানকে খুঁজে পাওয়া যায় নদীর ধারে অজ্ঞান অবস্থায়। এরপর প্রায় দুই মাস ও কারো সাথে কোন কথা বলে নি। এমনকি ওর গায়েও সেই পুরনো জামাকাপড় ছিলো। আর ছিল অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। আগের দিন রাতে এক বাচ্চা পাচারকারী জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পুলিশের ধারণা ছিল রেহান ঐ বাচ্চাদের মধ্যে একজন ছিল। তবে বেঁচে যাওয়া বাচ্চাদের সংখ্যাও ছিল কম।
রেহান এরপর থেকে বেশ বদলে যেতে শুরু করলো। কথায় কথায় চেচিয়ে উঠতো। ঘরে ভাঙচুর করতো। প্রথম প্রথম সবাই বিষয়টাকে সহ্য করলেও একসময় তা বদলে গেল। অনেকে তো বলেছিল রেহানকে কোন ভালো ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু রিয়াদ খান এতে বেঁকে বসলো। এতে না-কি তার মান সম্মানে আঘাত আনবে। লোক বলবে রিয়াদ খানের ছেলে পাগল! তিল তিল করে গড়ে ওঠা সামাজিক সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে! এটা সে কখনোই চায় না। তার ধারণা এসব রেহানের বদ মেজাজী স্বভাবের কারণেই হচ্ছে। তাই শাস্তি স্বরূপ ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াদ।
তবে ছেলের সেফটির ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজ করেনি সে। বডিগার্ড পর্যন্ত হায়ার করেছিলো। নতুন পরিবেশে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে রেহান। আগেই দিন রাতেও ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো। যেন ওকে কোথাও না পাঠায়। ও নিজেকে শুধরনোর চেষ্টা করবে। ইয়াসমিন সেদিন শুধু আঁচলে মুখ লুকিয়ে চোখের পানি মুছেছে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছু বলতে পারে নি। রিয়াদ কখনই ইয়াসমিনের কথা মানতো না!
হঠাৎ বজ্রপাতের আওয়াজে টনক নড়লো রেহানের। সিগারেট ফেলে রুমে এসে দেখে ইনায়া রক্তলাল চোখ নিয়ে বিছানার একপাশে বসে আছে হাতে রেহানের ফোন!
চলবে…
( গল্পের ব্যাপারে কমেন্ট করতে পারেন 😶)