উপন্যাসঃ
#আধখাওয়া_অষ্টভুজ
#পর্বঃ৪
#উম্মে_নাদিয়া_তাবাসসুম
পেছন ফিরতেই দেখে হাফ ছেঁড়া ফ্রক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ছ’/সাত বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে।বৃষ্টিতে পুরোই কাকভেজা হয়ে গেছে।করুণ সুরে বললো “আফা,আমারে একটু দাড়াইতো দিবেন?বিষ্টি তে বহুত শীত লাগতাছে।”
ছিমছাম সরু জায়গা।ইন্তিকা ফট করে সরে গিয়ে ওকে জায়গা করে দেয়।
-এই তোমার নাম কি?
নিচু হয়ে বসে ওর কাছে গিয়ে ইন্তিকা জিজ্ঞেস করলো।
-জ্বে জমিলা।
বলেই ফোকলা দাঁতের একগাল হাসি দিলো।হাতে একটা শুকনো পাউরুটি।কিছুক্ষণ পরপর একটা কামড় দেয়।
-মাশাআল্লাহ,বাহ বেশ সুন্দর নাম তো!
টপ করে পাউরুটির টুকরোটা পড়ে গেল।জমিলা পাউরুটির টুকরোটা মাটি থেকে তুলেই ফ্রকে এক ডলা দিয়ে হাতের তালুতে নিয়ে দুইটা ঝাড়া দিলো।
-ওটা খেয়ো না..বলতেই জমিলা পাউরুটিতে কামড় দিতে গিয়ে তার হাতে কামড় দিয়ে ফেললো।পরক্ষণেই আবার সব দাঁত দেখিয়ে হা হা করে হাসতে লাগলো,যেনো খুব মজার একটা কান্ড হয়েছে।
ইন্তিকা বৃষ্টিতেই দাঁড়িয়ে রইল।বৃষ্টির পানিতে আড়াল হয়ে যায় ওর দু-চোখের জল।
সবার সমস্ত দুঃখ অশ্রুজল রূপে একত্রিত হয়ে যদি সমুদ্রে গড়িয়ে পড়ত তাহলে সমুদ্রের জল কতটা নোনা হতো?
-বুবু জমিলা কে আমাদের সাথে নিয়ে যায়?
-হ্যাঁ,চল।ওকে একা ফেলে রাখবি কি করে এখানে।
বৃষ্টি কমে গেছে।তবে আকাশের বিষন্নতা এখনো কমেনি।যেনো কি দুনিয়ায় সব রাগ জমে এক হয়েছে তার একার।হপ করে গালফুলিয়ে থাকা অভিমানিনীর মতো লাগছে।
জমিলা হাঁটতে হাঁটতে রাজ্যের গল্প করতে থাকে।
জানেন আফা,”ফজরের সময় আমি উঠছিনা?তহন একটা কুত্তা আমার দিকে ছাইয়া হা কইরা আছে।আমি হেতেরে দৌড়ানি দিলাম।আমার দৌড়ানি খাইয়া কতক্ষণ পরে আবার কাছে আইসা ফিক কইরা কি হাসিটাই না দিলো।আমি তারে বদের হাড্ডি কইয়া ছেক ছেক কইয়া তাড়াইয়া দিলাম,ও যেমন কি কত বুজে সুরসুর কইরা হাঁটা দিলো।”
রামিসা হাসতে হাসতে শেষ,”কুকুরকে নাকি ও তাড়া করেছে,কি পাকা পাকা কথা!”
ইন্তিকাও হেসে ফেললো।
জমিলা অপরাধির মতো মুখ করে কি বুঝলো কে জানে আমাদের হাসি দেখে সেও তার ফোকলা দাঁত বের করে হাত পা ছুঁড়ে হাসতে লাগলো।
সারা একটা নীল রঙের শাড়ি পরে,সায়ানের দেয়া নীল চূড়িগুলো পরে,চোখে কাজল লাগিয়ে চট করে রেডি হয়ে বের হয়ে গেল।হাঁটতে হাঁটতে পাশের বস্তির ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখলো।ওরা সারাকে দেখেই এক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।”আফা,আপনে এহন?”
-একটু ফার্মেসিতে যাচ্ছিলাম। তোরা কি করছিস এখন এই রোদে?
-কিছুনা এমনেই খেলতাছি।
সারা ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে ওদের মধ্যে একজনকে দিলো।”নে এগুলো দিয়ে তোরা সবাই কিছু কিনে খাস,আমি গেলাম….বিকেলে আবার আসবো।”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বলতে লাগলো,”আবার আসবা তো আফা?ফত্যেকদিন তো বিকালবেলা আসো,এ সময় তো কুনোদিন আসোনাই..আসবা তো আফা?”
-আরে আসবো আসবো রে একটু তাড়া আছে এখন যাই কেমন?
সারার ফোন বেজে উঠল,সায়ানের কল।
রিসিভ করতেই সায়ান বললো কিরে,আজ সাথে সাথেই কল রিসিভ হয়ে গেল!সারার উপর কি কিছু ভর করেছে নাকি?তাই আজ সাইলেন্ট করতে ভুলেই গেছে।
কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে সায়ান মিষ্টি করে হাসছে।ওর ভয়েসটা যে কি ভালো লাগে সারার।
সারাও হেসে ফেললো।আসলে গান শুনছিলাম তো তখন সাউন্ড বাড়াতে গিয়ে….এরপর আর সাইলেন্ট করতে মনে নেই।
-আচ্ছা আচ্ছা,তো আজ কোনো পার্টি হবেনা নাকি?
-পার্টি!কিসের পার্টি?
-ওমা!পার্টি হবেনা কেন?পার্টি না হলে কিভাবে চলবে।আজ তো ইতিহাসের একটা মহামূল্যবান দিন।আজ যদি কিছু সেলিব্রেশন না হয় তো…
-ঝেড়ে কাশো তো সায়ান!কিসের সেলিব্রেশন আবার?
হা হা করে হেসে উঠলো সায়ান।
-আরে আজ তোমার ফোন সাইলেন্ট নেই।এর মতো চিরস্মরণীয় দিন কি আর আছে বলো তো?
এই এতবছর কেউ দেখেছে এরকম,কি করে হলো বলোতো?আমার তো ডাউট হচ্ছে জ্বিন-টিন আসর করলো নাকি আবার তোমার উপর?
-উফ সায়ান!রেডি হচ্ছিলাম তাই হইতো ভুলে গেছি।
-রেডি হচ্ছিলে কই যাচ্ছো তুমি?আমায় বললে না তো?গাড়ি নিয়েছো সাথে?
-না,তেমন কিছু না একটু ফার্মেসিতে যাচ্ছি।আচ্ছা তুমি বলো খেয়েছো কিনা?ওষুধ নিয়েছো তো?কেমন লাগছে এখন?
-আমায় বললে কি হতো?আমি নিয়ে আসতাম কি লাগতো,একা একা কেনো বের হও বলোতো?কতবার না করেছি।ইন্তিকাকে নিয়ে যেতে,নাহলে ভাবিকে বলতে।গাড়ি নিয়েই তো বেরোতে পারতে।কতবার বলেছি দেশের অবস্থা ভালো না,তার উপর এত ব্যস্ত শহর।তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।
-সায়ান কাছেই তো,আমি পারবো।টেনশন করো না তোমার আসতে হবেনা।
-সারা আমি আসছি।তোমার জন্য কি নিয়েছি দেখলেই তুমি…..
ফোনের ওপাশ জুড়ে সারার চিৎকারে ডান কান অবশ হয়ে গেলো সায়ানের।কিসের শব্দ?সারা!
সারা এই সারা সারা…………
হাত থেকে সারার জন্য নেয়া বেলি ফুলের মালাটা পড়ে গেলো।সায়ান ধপ করে বসে গেলো রাস্তায়।
নীল শাড়িটা রক্তাক্ত লালে রূপ নিলো।যেনো লাল পুকুরে নাইছে সারা।হাতের কাছে ফোনটা পড়ে থাকে।ফোনের ওপাশ থেকে সায়ানের গলাফাটা আর্তনাদ কোলাহলে শোনা যায় না ভালো,অস্পষ্ট হতে থাকে।ভিড় জমে যায় সারাকে ঘিরে। সায়ানের নামটা অস্পষ্ট শোনা যায় থেকে থেকে সারার স্বরে।লোকজন কিছু করার আগেই গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি রেখে পালিয়ে যায়।সাড়া শহরে শোরগোল পড়ে যায়।অস্পষ্ট হয়ে শোনা যেতে থাকে সারা আর সায়ানের আর্তনাদ।দুজনের কাছে পৌঁছোয় না দুজনের বার্তা।
অস্ফুট গোঙানির শব্দ শোনা যায় সারার…..
-জমিলা এরকম ছুটোছ ক্যান?তোর মতো বল আছে আমার?ভাত মাখছি সেই কহন হাত শুকাইয়া ঝুনা হইয়া গেছে।
বুয়াদাদি চেঁচাতে থাকে।
ধড়ফড় করে দরজা খুলে ইন্তিকা বের হতে গেলেই,বুয়াদাদি বলে, “কিরে ইন্তুমা বাসার জামা পইড়া এমন ফড়ফড় কইরা কই যাস?”
-দ্যাখ এই বজ্জাতে কি অবস্থাডা করতাসে।আমার বুইড়াকালেও আর শান্তি নাই বুঝোস!
ইন্তুিকা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “সারার এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে!”বলেই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।
হসপিটালে সবাই ওয়েট করছে ডক্টরের মুখে সারার অবস্থা জানবে বলে।ইন্তিকাকে আসতেই সারার ভাবি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো।ইন্তিকা ভাবিকে আশ্বাস দিয়ে বললো,”কিছু হবেনা। এই দেখবেন এখন সারা এসে হাসাহাসি করে পুরো হলটা মাতিয়ে ফেলবে।ভাবি আপনি বসুন তো,কিচ্ছু হবেনা।আপনার এই অবস্থায় এভাবে কান্নাকাটি করা,ছটফট করে একদমই ঠিক না।”
ইন্তিকার চোখ মুখ ফুলে করুণ অবস্থা।পায়চারি করছে এদিক থেকে ওদিক।সায়ানের অবস্থা দেখার মতো না। আধমরার মতো হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পরপরই খালি বলে
“আমার জন্যই হয়েছে সব।আমি আজ কল না করলে সারার কিছুই হতোনা।কিছু না!কি লাভ আমার বেঁচে থেকে।সারার যদি কিছু হয়ে যায়….”
ইন্তিকা কি করবে বুঝছেনা।সায়ান ভাইয়াকে কিভাবে সামলাবে,কি করবে মাথা কাজ করছেনা।
সায়ান নার্স এর কাছে জায়নামাজ চেয়ে ওযু করে নামাজের জন্য বসে পড়ে।আল্লাহর কাছে সারার প্রাণ ভিক্ষা চাইতে থাকে।বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে।সায়ানকে এর আগে কেউ কোনোদিন এভাবে কাঁদতে দেখেনি।এ দৃশ্য যেন চোখে দেখা যায় না!
-জানোতো ইন্তিকা,সারা হুরহুর করে যখন বেরোচ্ছিলো তখন আমি বলেছিলাম
এহেম এহেম..ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে নাকি এত সাজুগুজু করে সায়ানবাবুর সাথে হুম?আমায় বললো,”ধুর,ভাবি!কি যে বলো,আরে ফার্মেসীতে যাচ্ছি একটু,এক্ষুনি চলে আসবো।”
-গাড়ি নিয়ে যাও।একা যাবা না,ইমার্জেন্সি নাকি?নাহলে তোমার ভাইয়া কে বলি কি লাগবে আনতে?
-না ভাবি লাগবেনা,আমি এক্ষুনি আসবো।
বলেই হুরহুর করে বেরিয়ে গেলো।
ধপাস করে চেয়ারের হাতলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো সারার ভাবি।সাদীদ ভাইয়া এসে ভাবিকে নিয়ে গেলো চেকআপের জন্য।ভাবির অবস্থা ভালো না।তার ভেতরে এক নতুন অস্তিত্ব বাস করছে,এত স্ট্রেস তার জন্যে ভালো না।কি ই বা করবে বড্ড ভালোবাসে সারাকে।ননদ-ভাবির সম্পর্ক যে কত সুন্দর হতে পারে ওদের না দেখলে বোঝা যায় না।ইন্তিকাকেও খুব পছন্দ করে ভাবি।
“তুমি হলে আমার আরেকটা ননদ বুঝলে ইন্তু!কিছু দরকার হলে আমায় বলবে বুঝেছো?”এই কথাগুলো ইন্তিকার কানে এসে বাড়ি খেতে লাগলো।
ইন্তুিকার খুব টেনশন হচ্ছে হাঁত পা কাঁপছে।সবচেয়ে বেশি সায়ান ভাইয়ার জন্য।কত কি হয়ে গেলো হুট করে।আল্লাহর কাছে দোয়া করছে শুধু।সারার কিছু হলে সবকিছু কিভাবে সামাল দেবে,সায়ান ভাইয়া কে কিভাবে সামলাবে?
আইসিইউ রুমের দরজায় কাছে হেলান দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাত পা ছেড়ে বসে পড়লো।ওর পাগল পাগল অবস্থা।আন্টি-আঙ্কেল হার্টের রোগী ওদের কিছুই জানানো হয়নি,ভাবিকেও জানানো হতোনা.. ভাবি আড়াল থেকে শুনে ফেলেছে।ওরা জানলে যে কি হবে….ইন্তিকা পুরোই ভেঙে পড়লো…ওর আম্মুর কথা খুব করে মনে পড়ছে।
চলবে…