আধখাওয়া অষ্টভুজ,পর্ব:১৭

#আধখাওয়া_অষ্টভুজ
#অন্তিম_পর্ব(১৭)
#উম্মে_নাদিয়া_তাবাসসুম

আলোয় রাঙানো বাড়িটায় থেকে থেকে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে।মেহমানে গমগম করতে থাকে বিয়েবাড়ি।আকাশটা কেমন গুড়ুম গুড়ুম হাঁক দেয়।এই বিয়ের উৎসবেও যেন বৃষ্টির জানান দেয়।ভারি অদ্ভুত!

ফিহা বেছে বেছে খুব শখ করে তার কেনা সাদা শাড়িটাতে হাত বোলাতে লাগলো।হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখা
“মেয়েদের সবচেয়ে ভালো মানায় ধবধবে সাদা শাড়িতে। আমাদের দেশের মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে না-কারণ সাদা বিধবাদের রঙ।”
এই কথাটা ওর বেশ ভালো লাগে।মেয়েরা যে কেন এটা ভাবে কে জানে!
এই শাড়িটা নিনাদের পছন্দের, ইন্তিকার বিয়ের জন্য কিনেছে ফিহা।
সন্ধ্যা অবধি এটা পরে রামিসার বিয়ের জন্য কেনা কাতান শাড়িটা পড়বে।নইলে আবার রামিসা বুড়ি ক্ষেপবে।

সাদা কাঁচের চুড়ি পড়ে নেয় হাত ভর্তি করে আর অন্য হাতে বেলির বালা।চুলে সুন্দর মত বাঁধা বেলির মালা।চোখে টেনে টেনে কাজল পরেছে।আর চুলের একপাশে ধবধবে সাদা রঙের ভয়ংকর সুন্দর একটা জারবেরা আটকানো।আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই কেমন লজ্জা পাচ্ছে ফিহা।কাল সারারাত গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য জেগে চোখের নিচে আরও বেশি কালো ছাপ পড়ে গেছে,এতে নাকি ফিহাকে আরও সুন্দর লাগছে নিনাদ বলেছে।
নিনাদের আসার কথা ছিল বিয়েতে সবাই খুব করে বলেছে,কিন্তু হুট করে নাকি কি কাজ পড়ে গেল।ফিহাকে সব ভিডিও কলে দেখাতে বলেছে।
ফিহা রেডি হয়ে কল করছে,কিন্তু নিনাদ রিসিভ করছেনা।

জমকালো আলোয় লাল টুকটুকে হয়ে আছে দুই বোন।দুজনের একই শাড়ি,একই গয়না,একই সাজ!লাল টসটসে টমেটোর মত লাগছে দুজনকে।এর দিকে তাকালে ওর দিকে তাকাতে আর ওর দিকে তাকালে এর দিকে তাকাতে ভুলে যায় লোকজন।চোখ যেন আটকে যায় এক মুহূর্তের জন্য।
দুটো লাল টুকটুকে পরীর মত লাগছে ইন্তিকা আর রামিসাকে।

সারা চোখ পিটপিট করে বলে,সুন্দর লাগবেনা?
“আমার জা রানীকে যে আমিই সাজিয়েছি তাইনা!হিহি..”

রামিসা মিষ্টি হেসে বলে,”আচ্ছা তুমি কোন পক্ষ আপু?বর না কনে?”
সবাই হেসে ওঠে।
“আরে আমি দুই পক্ষ।দুই নৌকায় না পা দিতে নেই?এই দেখ আমি কেমন পা দিয়েছি।”
সারার কথা শুনে হাসিতে গমগম করতে লাগলো বিয়ে বাড়ি।

হঠাৎ মাথাঘুরে ধপাস করে পড়ে গেল জমিলা।সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গেল রুমে।জ্ঞান ফিরতেই কোনোমতে চোখ খোলার চেষ্টা করছে।আর বিড়বিড় করছে,মরবে মরবে!ওর কথা শুনে সবাই হকচকিয়ে গেল।
ইন্তিকা উড়ে আসা মাছির মতো কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে বললো, “আসলে ও একটু অসুস্থ তাই এমন আজব কথা-বার্তা বলে,এসব কানে নিয়ে লাভ নেই।”

জানালার গ্রিল ধরে ওপাশের দৃশ্যে যেন হারিয়ে গেছে সারা।
মর্নিং গ্লোরিগুলো আগের চেয়ে অনেকটক বড় হয়ে ঝোপালো হয়ে গেছে।চাঁদের আলোয় কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে!সময়ে অসময়ে হেলছে,দুলছে তারা।বাতাসের তালে তালে সুর মেলাচ্ছে।ঝিরিঝিরি শ্রাবণধারায় কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে যায় সারা।
সায়ান পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো ভয় লাগায়।শিউরে উঠে সারা।
চশমায় হাত রেখে সারার ভীত অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে ফেলে সায়ান।

সাদীদ আর জারার বাচ্চা আহরিশ এসে কোথা থেকে পার্পল রঙের গোলাপের কয়েকটা পাপড়ি ছুড়ে সারার দিকে।কি আদুরে ভঙ্গিতে ছুড়ছে!
আহরিশকে কোলে তুলে নেয় সারা।নিচে নামার জন্য বায়না করলে ওকে মেঝেতে নামিয়ে আহরিশের গাল দুটোতে দু’দিক থেকে সারা,সায়ান দুজনে চুমু খেতে থাকে।আহরিশ ওদের মাঝখান থেকে থু থু থু করে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যায়।
সারা আর সায়ানের মুখ “ও” আকৃতির হয়ে থাকে।
ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে একসাথেই হেসে ওঠে।
সারা সায়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার এমন একটা আহরিশ চাই!”
সায়ান মিষ্টি একটা হাসি হেসে বলে,”আরে বউ!আমাদেরও তো হবে এমন একটা আহরিশ।”
ওপাশে ফিরে চোখ মুছে সায়ান।হুট করে যেন উটকো এক বিষণ্নতায় হারিয়ে যায় সায়ান।

-এই ফিহানি!এবার তো তোর পালা।প্রস্তুত হ জলদি হাহাহা।

রামিসার কথা শুনে ফিহা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
চোখে মুখে ভেসে ওঠে হাজারো স্বপ্ন, নিনাদ আসবে ঘোড়ায় চড়ে বর বেশে আর ও লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে থাকবে,নিনাদ ওকে নিয়ে যাবে রানীর মতন করে।ইশ! ভাবতেই ওর কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে ফিহার।এটা ফিহার বেশ বিরক্তিকর লাগে সবসময় এমন নাক ঘামে তার।
কিন্তু ওর নাকে যখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকে তখন ও কে যে কি ভারি অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে সে সম্পর্কে ওর কানাকড়িও ধারণা নেই।

ইন্তিকা,সারা,সায়ান তিনজনে একসাথে বলে ওঠে, “হ্যাঁ এবার তো ফিহার পালা কনে সাজবার!”
ওরা হেসে ফেলে নিজেদের সমস্বরে একসাথে একই কথা বলার ঘটনা দেখে।

টুং করে একটা ম্যাসেজ আসে ফিহার ফোনে।
“আপু তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।”

ফিহা রাহা আপুকে রিপ্লাই করে নিনাদের বেস্ট ফ্রেন্ড উনি।
টাইপিং হচ্ছে, ফিহা খুশি খুশি হয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।
যা উত্তর আসে তার জন্য ফিহা একদমই প্রস্তুত ছিল না।ওর আকাশ যেন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল।
“নিনাদ তোমাকে ভালোবাসেনা।আসলে ও অনেকদিন ধরে এটা তোমাকে বলবে বলবে করেও বলতে পারেনি।আমায় সবটা বলে নিনাদ, আর তোমায় জানাতে বলে।”

ফিহা বুঝে পাচ্ছেনা কি হয়ে গেল?ওর চোখ বেয়ে যেন রক্তবন্যা নামবে। কি করবে কিছুই মাথায় আসছেনা।ওর আকাশ যেন থমকে গেছে একেবারে।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে।
চোখে কাজল নাইয়ে অশ্রুবন্যা বইতে লাগলো।হুলস্থুল করে নিনাদ কে টেক্সট করলো,কলও দিল বেশ কয়েকবার।
নিনাদ কল রিসিভ না করে রিপ্লাই করলো “কি চাও?শুনলে তো সবটা।আর কি?”
ফিহা ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে।এক পাহাড় সমান হাহাকারে ওর সব ছেয়ে যায়।আবার কল দিতে থাকলো পাঁচবারের মাথায় কল রিসিভ করে নিনাদ বললো, “ভালোবাসা?কিসের ভালোবাসা?হাহাহাহা..আমি তো কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসিনি।আমি তোমায় ভালোবাসিনা,আর কতবার বলবো?আর ফোন করবেনা আমায়।তোমার মত বিচ্ছিরি দেখতে বিচ্ছিরি কন্ঠের মেয়ের সাথে আবার কিসের ভালোবাসা?ইট’স জাস্ট আ গেইম,গেইম!”

নিনাদ হাসছে একদম অসুরের মত।দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলেছে।কথায় কোনো মায়া নেই কিছু নেই,একদম ভিন্ন রূপ।ফিহা কেমন একটা হয়ে গেল।কত মানুষ ফিহার চেহারা নিয়ে কত কিছু বলেছে কিন্তু এভাবে,এভাবে তো কেউ কোনোদিন বলেনি।কাকে দেখছে ও?মুহূর্তের মধ্যেই কেমন একটা মানুষ পাল্টে গেল।কিভাবে হলো এটা? কিভাবে?এত দিনের তিল তিল করে জন্মানো সব স্মৃতি, স্বপ্ন,ভালোবাসা,কথোপকথন সব এক সেকেন্ডেই শেষ করে দিলো সে, এক সেকেন্ডে?
ফিহার দু-চোখ জুড়ে শুধুই অন্ধকার।নিনাদের কথাগুলো থেকে থেকে কানে এসে ঠেকছে।”ভালোবাসি না,কোনো দিন বাসিনি,ইট’স জাস্ট এ গেইম” কথাগুলোর প্রতিধ্বনি শুনতে পায় চারিদিকে ফিহা।পাগলের মত হয়ে যায় ও।

কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে একটা চিঠি লিখে ধড়ফড় করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ফিহা।কলমটা মেঝেতেই পড়ে রইলো।
“নাহ!এই জীবনের প্রতিটা অংশ একজনকেই সঁপেছিলাম আমি আজ তার এই পরিণাম!
যে পৃথিবীতে বিশ্বাসের কোনো ঠাঁই নেই সেখানে আমারও ঠাঁই নেই।”
সুইসাইড করবে বলে বেরিয়ে পড়েছে ফিহা।বেঁচে থাকার আর কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিজের পা জোড়াকে থামিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো।নিনাদের দেয়া সব উপহারের টাকার হিসাব করে সব টাকা নিনাদকে বিকাশ করে দিলো ফিহা।সাথে একটা টেক্সট করলো।
“সব ফেরত দিয়ে দিলাম।কিন্তু ভালোবাসা ফেরত দেবনা।যাকে তাকে তা দেয়া যায় না!”

ওর চোখে ভাসছে আর কিছুদিন পরই ধুমধাম করে বিয়ে হতো ওদের,বাড়িতেও ম্যানেজ করতে কোনো প্রবলেম হতো না।কত শত স্বপ্ন ছিল আমাদের।ইশ!নিনাদ একটাবার বলতো,আসলে আমি মজা করছিলাম ফিহা।দেখছিলাম কতটা বিশ্বাস তোমার আমার ভালোবাসার প্রতি হাহা।এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা ওর কিছু।সব তো ঠিক ছিল,কোথা থেকে কিসব হয়ে গেল?কেন এমনটা হলো,এত বড় পাপী আমি?আমার সাথেই এমনটা হতে হলো?
কেন নিনাদ কেন করলে এমন?কি করেছিলাম তোমার কি?
পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে ফিহা।
আশেপাশে একটা কাক-পক্ষীও নেই ওর আর্তনাদ শোনার জন্য।

ঐ তো সেদিনও কত সব প্ল্যানিং করেছে ওদের বেড রুমটা কিভাবে ডেকোরেট করবে?কিভাবে বিয়েতে সাজবে ফিহা?নিনাদ কি রঙের শেরওয়ানি পড়বে… কত শত স্মৃতি,স্বপ্ন।সাজানো সবকিছু,হঠাৎ কি হয়ে গেল?কেন এমনটা হলো নিনাদ কিভাবে পারলো এটা করতে,কিভাবে?
সত্যি নিনাদ তুমি আর আমায় ভালোবাসোনা আর না?একটা কল দাও বলো যে মজা করছিলে একটাকবার!
আমি জানি এসব সত্যি না না সত্যি না।আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো,এখনও বাসো।

তুমি কেন এমনটা করলে বলো?কেন? আমি এখ৷ কি নিয়ে বাঁচবো?কি নিয়ে?এই একটা পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে,কাকে ভালোবাসবো?আগলে,সামলে রাখবো?
আচ্ছা কেন তুমি এমনটা করলে বলোনা,প্লিজ বলো।তুমিহীনা একটা ক্ষণ কাটেনা আমার,কিভাবে সারাটা জনম কাটাবো বলোনা?বলোনা….
নাহ আমার বাঁচার কোনো মানে নেই কোনো মানে নেই।যেখানে বিশ্বাসের,ভালোবাসার মানে নেই সেখানে আমার বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই,নেই কোনো মানে…

ফিহা পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশিটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে মুখের কাছে নিয়ে এলো।এই মুখে দিয়ে দিল ঠিক সেই মুহুর্তেই ওর বাবা মায়ের মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠলো,গড়গড় করে চোখ বেয়ে পানি নামতে লাগলো।
মুখের কাছ থেকে নামিয়ে নিলো শিশিটা।জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকলো।ওর হাহাকারে ভেতরটা খাঁ খাঁ হয়ে যায়।আবারো হাত জোড়া শক্ত করে হাতে নেয় শিশিটা চোখ বন্ধ করে মুখে দিতে নিলো কিন্তু পারলোনা।

“নাহ!আমার বাবা-মায়ের তিল তিল করে গড়া এই একটাই জীবন যেটা আমি!আমি ছাড়া আর কিছুই নেই ওদের,কিছুই না।এক উটকো লোকের জন্য আমি শেষ করে দেব?কিন্তু কেন?এসব ছলনা কি এতই বিশাল কিছু ওদের সারাটা জনমের ভালোবাসা থেকে?
জীবনে বাঁচতে হলে যে কাউকে ভালোবাসতে হবে এমনটা তো নয়।আমি বাঁচবো আমার জন্য আমার মা-বাবার জন্য!
মরেই না হয় বাঁচবো।”

ছুঁড়ে ফেলে দেয় শিশিটা।সুনসান পথেই রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে।ওদের সবাইকে চমকে দেবে।সবাই নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে ওর জন্য, অপেক্ষা করে বসে আছে দুই বিয়ের কনে।এইসব ভাবতে ভাবতে খুশি খুশি মনে মেঠোপথে আচঁড় কেটে হাটতে থাকে সে।ইন্তিকা,রামিসার কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো চোখে ভেসে উঠলো এত দিনের তিল তিল করে স্বপ্ন দিয়ে জমানো একটা স্লাইড শো যেখানে ভাসছে ইন্তিকা,রামিসার মত টুকটুকে কনের মত সজ্জিত একটা মেয়ে।নাম তার ফিহা রাহমান।টসটসে স্ট্রবেরির মত একটা মিষ্টি কনে।হুট করে টগবগ টগবগ শব্দ শোনা যায়,টগবগ টগবগ করে আসতে থাকে একটা ছেলে,কি সুদর্শন একটা ছেলে!ধীরে ধীরে কাছে আসে,কে এটা?আরে এটা তো নিনাদ!
বরবেশে এসেছে ফিহাকে রানী করে নিয়ে যেতে।

বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে ফিহা।বারবার কেন এসব মনে পড়ছে।দম বন্ধ হয়ে আসে ওর।আচ্ছা ভালোবাসা কি এত কষ্টের?
ছলনার তিক্ততা এতটাই বেশি যে ভালোবাসার মত পবিত্রতাও এর সাথে পেরে ওঠেনা?

চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝিকঝিক করছে।কেমন ভয়ংকর সুন্দর জোছনা আজ!
ফিহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছে।হঠাৎ ও পিঠে কেমন একটা বাজে স্পর্শ অনুভব করে।

পেছন ফিরতেই কতগুলো দানব আকৃতির ছায়ামূর্তি!কোথা থেকে হঠাৎ এলো ওরা?এখানে তো কেউ ছিলনা!ধীরে ধীরে ওরা আরও আছে আসতে থাকে ফিহার ওর গলায়,মুখে,পিঠে ছুঁতে থাকে।ও চিৎকার করতে থাকে।ফিহা দৌড়ে পালিয়ে যেতে চায়।ওরা জোরে হেচকা টান দিয়ে হায়েনার ন্যায় ঝাপিয়ে পড়ে ফিহার উপর।ফিহা পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে,ছেঁড়ে দিতে বলে ওদের বারবার।কিন্তু নরপশুগুলো আরও নৃশংসভাবে ঝাপিয়ে পড়ে ওর উপর।ও আর নিঃশ্বাস নিতে পারেনা।চিৎকার করতে পারেনা, বাঁচার চেষ্টা করতে পারেনা।
ফিহার চিৎকার “আমি বাঁচতে চাই” “বাঁচতে চাই” বলাও থেমে যায়।ওকে হিংস্র হায়েনাদের থেকে বাঁচানোর মত পবিত্র কারো উদয় হলোনা।ওর পরনে থাকা ধবধবে সাদা জামদানী রক্তাক্ত লাল রঙে রূপ নেয়।যেন লাল টকটকে কোনো নারী সবুজের বুকে আপন মনে শুয়ে আছে।
নিঃশব্দেই আড়াল হয়ে হারিয়ে যায় একটা নিষ্পাপ প্রাণ।

আনিক সাহেব আজ বেশ সুস্থ।মেয়েদের বিয়ে বলেই বোধ হয়।ফিহাকে খুঁজছে সবাই তখন আসাদের মা বলেন ওয়াশরুমের দিকে যেতে দেখেছেন উনি ফিহাকে।তাহলে এসেই পড়বে ফিহা এই ভেবে বিয়ে শুরু করে দেয় ওরা।
রামিসাকে বলা হচ্ছে কবুল বলতে ও চুপ মেরে রইলো।কিছুক্ষণ পর বলে ওঠে আমি কবুল বলবোনা।বাড়িসুদ্ধ সকলে কেমন আঁতকে উঠলো। “এ কি বলছে মেয়ে?”
-রামিসা, কি হয়েছে?বল?কোনো সমস্যা?
আমায় বলতে পারিস,আয় এদিকে আয়!
-নাহ তা না তার চেয়েও বড় কিছু,আগে বলো তোমরা রাজি হবে?বলো হবে?
জবাব না পেয়ে নিজেই আবার বলা শুরু করলো রামিসা।
বিয়ের পরে কিন্তু ক্যারামেল আর স্প্রিংকেলসকেও আমার সাথে যেতে দিতে হবে।নাহলে আমি কবুল বলবো না।আমি ওদের ছাড়া কিভাবে থাকবো?বলেই রামিসা বুঝি এখনই কেঁদে ফেলবে এমন একটা একটা অবস্থা।
রামিসার কথা শুনে বাড়িসুদ্ধ সবাই খানিকটা অবাক হয়ে আবার হেসে ফেললো।

ফিহাকে ছাড়াই ইন্তিকা,রামিসার বিয়ে হয়ে গেল।ওর হদিস না পেয়ে পাগলের মত সবাই খোঁজা শুরু করে দিল।তখনই পুলিশের কল এলো,ফিহার মৃত্যুর কথা জানালো।সবার মুখের বুলি এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল।সায়ান ধড়ফর ফিহার রুমে গিয়ে দেখলো একটা চিঠি,”আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।আমি স্ব-ইচ্ছায় এ পথ বেছে নিয়েছি।অবিশ্বাসের পৃথিবীতে আমার কোনো চিহ্ন না থাকুক!”

ফিহা আত্নহত্যা করার মতো মেয়ে না।এই মেয়ে কিভাবে আত্নহত্যা করলো এটায় সবাইকে ভাবাচ্ছে।নিনাদকে নিয়েই কিছু হয়েছে তা সকলে বুঝছে,কিন্তু এই আত্নহত্যা! কিছুতেই মানতে পারছেনা কেউ।গমগম করা বিয়েবাড়ি শোকবাড়িতে রূপ নিলো।কান্নার শব্দে,আর্তনাদের শব্দে সারা রাত্রি ছেয়ে গেল।না শোনা যায় কোনো হাসি,না পাখির শব্দ, শহর জুড়েই শুধুই কান্নার চাপা ধ্বনি।

সায়ান সারার হাতের উপর হাত রেখে রামিসা-জিভান,ইন্তিকা-আরাদ একে একে তিন জোড়া হাত একত্র করলো তারপর ধরা গলায় বললো,”রামিসার বিয়ের পড়েই ফিহারটাও করিয়ে দেব ভেবেছিলাম।আমরা সবাই আছি শুধু একজন হারিয়ে গেল মাঝখান থেকে।স্বার্থেরও অনেক উর্ধ্বে ছিল প্রতিটা সম্পর্ক,ছিলাম একটা চক্রের মত।আমরা চারজোড়া হতাম এক সুন্দর অষ্টভুজ।মনে আছে সারা?আমাদের চক্রটার একটা সুন্দর নাম ঠিক করেছিলাম সেদিন?”দীপ্তমান অষ্টভুজ”!এই দীপ্তমান অষ্টভুজ আজ ঠাস করেই নিভে গেল।অষ্টভুজ আজ অপূর্ণই রয়ে গেল।খেয়ে নিলো এক সুন্দর বন্ধনকে,ছিন্ন করে নিলো সবটা, আধখাওয়া অবস্থায় রয়ে গেল এই অষ্টভুজ।এক আধখাওয়া অষ্টভুজ!”

রামিসা একদম পাগল ছাড়া হয়ে যায়।ফিহার সাথে ওর নিজের বোনের চাইতেও বেশি এমন রকমের সম্পর্ক।বিয়ের সাজ উল্টেপাল্টে গেছে একদম,শাড়ির ভাঁজ নষ্ট হয়ে ছন্নছাড়া অবস্থা ওর,পাগলের মত চিৎকার করছে শুধু “আমি বলেছিলাম ফিহানি তোকে কতবার সাবধান করেছি,শুনিসনি অন্ধের মত বিশ্বাস করে গেলি,অন্ধের মত..তবে ভাবিনি রে এতটা সব হয়ে যাবে,একটুও ভাবিনি।কি করে একা করে দিয়ে চলে গেলি রে কি করে?কিভাবে পারলি তুই কিভাবে?”

বাড়িসুদ্ধ সবার স্বরে শুধুই কান্নার শব্দ,প্রকৃতিও গুম হয়ে আছে যেন ফিহার শোকে।
আহরিশ কি বুঝছে কে জানে? ও ও থেকে থেকে কান্না করে ওঠে উচ্চস্বরে।
“লাল টুকটুকে বউ সাজবে স্বপ্ন দেখেছিলো বোন আমার।কিন্তু তুই যে মৃত্যুদিনেই সাজবি এ কথা তো বলিসনি বোন রে বলিস নি!কেন করলি বোন কেন? কেন?কেন?ছাড়বোনা নিনাদ প্রতারকের বাচ্চা ছাড়বোনা তোকে!”ইন্তিকা পাগলের মত আর্তনাদ করতে থাকে।

অপরূপ জোছনায় নির্মমভাবে নিহত হলো এক নিষ্পাপ নারী,নিষ্পাপ মন।
রক্তাক্ত হয়ে নাম লেখালো সবুজের বুকে।কেউ জানেনা ঐ এক থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠগোলাপের গাছটা ছাড়া।হত্যা হয়েও আত্নহত্যা অপরাধ নিয়েই পৃথিবীতে জলছাপ রেখে গেল ফিহা।কাঠগোলাপ গাছটা চোখ পাকিয়ে চেয়ে রয় ঐ হত্যাস্থানের দিকে।চিৎকার করে সত্যিটা জানান দিতে চায় পৃথিবীকে।
অসমাপ্ত জোছনা সাক্ষী হয়ে থাকে এই নির্মম ঘটনার।রক্তের মরা গন্ধে ভেসে ভেসে আসতে থাকে ফিহার সেই কথা,
“আমি বাঁচতে চাই,বাঁচতে চাই!”

-সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here