আধখাওয়া অষ্টভুজ,পর্ব:১৩+১৪

#আধখাওয়া_অষ্টভুজ
#পর্বঃ১৩
#উম্মে_নাদিয়া_তাবাসসুম

কুচিগুলো ঠিক করে নিয়েই বড় রাস্তার পার ধরে আনমনে হাঁটছে ফিহা। মনটা আজ ভীষণ ফুরফুরে। পরনে বেবি পিংক কালারের একটা হাফ সিল্কের শাড়ি। শ্যামলা বর্ণে একদম মানিয়েছে শাড়ির রঙটা।আকাশের রঙটাও আজ বড্ড ফুরফুরে রকমের। আকাশও বুঝি আজ খুব আনন্দিত? ফকফকা পরিষ্কার নীল, সাদার মায়া মেশানো আকাশ। বর্ষায় এরকম আকাশও বুঝি হয়? একদম শরতের মতো, এত সুন্দর রূপ আজ আকাশের! মনে তো হচ্ছে যেন ফিহার আনন্দে আজ আকাশও সেজেছে ইচ্ছেমতন। ছন্নছাড়া হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কি যেন ভেবে লজ্জায় মুখে হাত দেয় ফিহা।এর কারণও আছে বেশ। শাড়িটা নিনাদ পাঠিয়েছে, সাথে ম্যাচিং চুড়ি, পায়েল, টানা নথ, গাজরা, আর ৫৭৮ টা কিটক্যাট। ফিহা বসে বসেই পরম ধৈর্য্যের সাথে গুনেছে। নিনাদের দেয়া প্রথম গিফট বলে কথা!

“ছাগলটা গিফটগুলো দিয়েছে,কিন্তু কারো জন্যে আম,কাঠাল,বাঙ্গি পাঠালে যেমন পেপার দিয়ে মুড়িয়ে মুড়িয়ে বাঁধে ওভাবে বেঁধেছে”, বলেই ফিহা হাসছে। এভাবে কেউ নিজের প্রেমিকাকে উপহার দেয়? এত আনরোমান্টিক,আল্লাহ! আমি যে এত সুন্দর করে নিজের হাতে একটা গিফট বক্স বানিয়ে, কার্ড বানিয়ে এত্ত এত্ত চিরকুট আর ডেকোরেশন করে কি সুন্দর করে পাঞ্জাবি, জুতা, টি-শার্ট, হাতঘড়ি আর বই দিয়েছিলাম। কত কী দিয়েছে আমাকে, একটু গুছিয়ে দিলেই তো হতো। গাধা একটা!”

ফিহা হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছে একটা ব্লু ডেইজির বাগানে। এতক্ষণ পথ-ঘাটের কিছুতেই তার খেয়াল ছিলনা। কল্পনাতেই বিমগ্ন ছিল। চোখ পড়তেই চোখ জুড়িয়ে গেল তার। এত সুন্দরও কি কোনো বাগান হয়?ওপরে কিছুটা লতানো ব্লু ডেইজির মেলা। নীল-সাদা এই ফুলের সাথে আকাশটাও একদম মিশে গেছে। “এরা কি একসাথে প্ল্যান করে এসব করেছে নাকি?” বলেই ফিহা হাসলো।ফুল-টুল ফিহার অত পছন্দ না।আবার খারাপও লাগে না, ব্যাপারটা এমন। তবে ইন্তিকার ভীষণ মাতামাতি এসব নিয়ে। নীল আর গোলাপির ব্যাপারটা ভালোই যাচ্ছে।মনে হচ্ছে যেন নীল পৃথিবীর মাঝে একটা গোলাপি পরী দাঁড়িয়ে আছে।ফিহার দু – চোখের নিচে গর্ত করা ডার্ক সার্কেলগুলো তার সৌন্দর্য্য যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।ফিহা দেখতে অত ভালো না। তবু ওর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভয়ংকর রকমের মায়ায় পড়ে যেতে হয়। ফিহার চোখের নিচের কালচে ছাপ নিয়ে কথা বলেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তবে মায়াময়ী চেহারাটার দিকে সুন্দর দৃষ্টিতে তাকালে শ্যামবর্ণী মেয়েটার চোখের বাদামি ছাপগুলোই যে তার সৌন্দর্য্য ভীষণ রকমের বাড়িয়ে দিয়েছে তা বেশ বোঝা যায়। ছোট চোখ সচরাচর এত সুন্দর হয়না। এই চেহারা নিয়ে যে লোকের কত কথা। তবে ফিহার এসবে কোনো মাথাব্যথা নেই। কখনো ভালোমতো মুখে কিছু মাখেও না। যেমন-তেমন খাপছাড়া ভাবেই দিন কাটায়।

জায়গাটা দেখে ফিহা খানিকটা আনন্দে নেচে উঠল। নিনাদ যে ছবি চেয়েছে, এর চেয়ে ভালো জায়গা তো ও আর পাবেনা। কয়েকটা ছবি তুলতেই ভিডিও কল আসলো নিনাদের। রিসিভ করেই ঝাড়ি শুরু, “রামছাগল! এভাবে আম-কাঠালের বস্তার মত করে কেউ শাড়ি,চুড়ি এসব পাঠায়? ইঞ্জিনিয়ার নাকি আরও গোবরে ঠাসা মাথা! ছাগল ছাগল ছাগল একটা! এমন করে বেঁধেছে, খুলতে খুলতেই আমার তিন-চার ঘন্টা চলে গেল।”

নিনাদ হাসছে। চশমার গোল কাচ ভেদ করে তার ডিমের মতো চোখজোড়া যেন এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে। এমন হাঁ করে তাকিয়ে আছে, আর খুব আনন্দ নিয়ে ফিহার বকা শুনছে। ফিহা আরো ক্ষেপে গেলো যেন। ফিহা রাগলেই নিনাদ একদম চুপ করে বাধ্য ছেলের মতো শোনে। ফিহা এতে আরও রেগে যায়। তখন নিনাদ হাহা করে হেসে ফেলে।
-কিইইই আমি চিল্লাচ্ছি, আর তুমি মিনমিনে বিলাইয়ের বাচ্চার মতো হাসছো?
-ফিহা!তোমার ঠোঁট জোড়া ভিষণ সুন্দর।

রামিসা টানতে টানতে ইন্তিকা, সারা, জমিলা, বুয়াদাদী সবাইকে ছাদে নিয়ে গেল। ছাদে গিয়ে একসাথে মজা করে গানের কলি খেলবে আর পাকোড়া, বেগুনী, পেঁয়াজু খাবে।সাথে ওরিও মিল্ক শেক ও বানিয়ে নিয়েছে রামিসা।

-‘তোমার খোলা হাওয়া’ আ তে শেষ হয়েছে ইন্তু আপু আ দিয়ে গান ধরো।কুইক কুইক কুইক!
-রামিসা, তোরা খেল আমি আর ইন্তিকা একটু আসছি।
“আমি গাই আমি গাই ছুডো আপা!আইয়্যাম্মা ডিসকো ঢানছার। বিড়ি খাইলে হয় ক্যানসার।”
জমিলা গাইতে গাইতেই পাগলের মত হাসছে। বাকি সবাই ও হাসছে জমিলার কান্ড দেখে।

ইন্তিকার হাবভাব বুঝতে চেষ্টা করছে সারা। তখন থেকেই কেমন মনমরা হয়ে আছে। কাউকে বুঝতে দিচ্ছেনা কিন্তু সারা ঠিকই ধরে ফেলেছে। মনে মনে একটু খুশিও হয়েছে সারা। যা ভাবছে তা-ই।
“কি গো বিয়ের কনে? আরাদ মশাইয়ের কথা ভাবা হচ্ছে, কী তাইতো?”
সারার এই কথায় ইন্তিকা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সারার কথার মাথামুন্ডু কিছু বুঝছেনা ইন্তিকা।মুখটা কাচুমাচু করে তাকিয়ে রইল ইন্তিকা।

ফিহা এসে পেছন থেকেই একটা চিৎকার দিল। ইন্তিকা আবার চমকে উঠলো। ইন্তিকার অবস্থা দেখে ফিহা আর সারা জোরে একসাথে হাহা করে হেসে উঠলো। ইন্তিকার তো জট পাকিয়ে যাচ্ছে, কী হচ্ছে এসব!
আসলে আমার হবু জা’কে একটু খুঁতিয়ে দেখছিলাম।আরাদ কে বিয়ে করবি ইন্তু?

সারার কথার শেষ লাইনটা দুয়েকবার কানে ঠেকলো ইন্তিকার।মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরোচ্ছেনা ইন্তিকার।
-কি রে বিয়ে করবি?
-কি বলছিস এসব বল তো। উনি তোর দেবর। একই বাড়িতে তুই আর আমি! কী করে বলছিস এসব বল তো?
-তোর এত ভাবতে হবেনা। তুই আরাদকে ভালোবাসিস তো বল?বাসিস তাই না? ছোট্ট জা আমার হাহাহা
-না বাসিনা। তুই ব্যাপারটা যেভাবে দেখছিস সেটা সেরকম না। তোর ফ্যামিলি, শ্বশুরবাড়ি, আমার ফ্যামিলি – তিনটা পরিবারের এত সুন্দর সম্পর্ক টা তুই নষ্ট করে দিতে চাইছিস বল?
-কে বললো নষ্ট হবে? তুই ব্যাপারটা এত জটিল দৃষ্টিতে দেখছিস কেন?সহজ করে ভাব। আরাদ তোকে পাগলের মত ভালোবাসে রে ইন্তু। কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস? একটা খবর তো অন্তত নিতে পারতি। এমন কী অন্যায় করেছে আমার দেবরটা?
-দেখেছি। ইন্তিকা স্বর নিচু করে বললো।
সারা মিটিমিটি হাসছে।
-শোন। তোর ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলির কোনো আপত্তি হবেনা আমি জানি। সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। আমরা দুই শয়তান এক বাড়িতে থাকবো হিহিহি।
-আর উনার ফ্যামিলি? আমাকে মেনে নেবেন ওরা? আমি তো সুন্দরী না, না আর কোনো গুণ আছে।
-হোপপ ঢংগী! সুন্দরী না তাইতো ছেলেদের লাইন লেগে থাকে, আরাদ মশাইয়ের পাবনায় যাবার উপক্রম হয়েছে! আর এত সুন্দর রান্না করতে পারিস, ছবি আঁকিস, ডাক্তারি পড়ছিস, এত সুন্দর করে ডিজাইন করিস বিভিন্ন কিছুর। এসব কি কম?ঢপ মারার আর জায়গা পাস না!
কী? আমার দেবরের গলায় ঝুলতে রাজি তো আমার জা’রানি?ভালোবাসিস তাই না বল?আমি জানি তো!
-জানিনা আর তুই ও কিচ্ছু জানিস না। যা তো যা,ভাগ এখান থেকে!

চলবে…

#আধখাওয়া_অষ্টভুজ
#পর্বঃ১৪
#উম্মে_নাদিয়া_তাবাসসুম

নদীর পানি থেকে থেকে পাড়ে এসে ঠেকছে। ছলছল শব্দটায় যেন নিনাদ কোনো ছন্দ শুনতে পেল।ঝিনুকেরা যেন গান গাইছে বেসুরেলায়।পা দুটো নদীর পানিতে এলিয়ে দিয়েই আত্মহারা হয়ে গেল নিনাদ। মন যে কোন ঠিকানায় হারিয়ে গেছে ঠিক,তা তারও জানা নেই।

ল্যাভেন্ডার কালারের প্রথম ওয়াশ দেয়া হয়ে গেছে।ইন্তিকা ক্যানভাসটা রেখে উঠে চলে গেল জমিলার কাছে।ওর শরীরটা খুব একটা ভালো না।জমিলা ঘুমের ঘোরে কিসব জানি বকে রাতে।যদিও এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।তবে ইন্তিকার কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক ঠেকছেনা।
কারণ জমিলা ঘুমের চাইতে দিনে এসব বলে বেশি।কতদিন বলে,”এই ঘরটা ধসে ফড়বো”।আবার কয়েকদিন যাবৎ বলছে একটা মেয়ে নাকি মারা যাবে।খুব কাছের একজন।
ইন্তিকা অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।এসব ভুলভাল কথা বিশ্বাস করার কোনো মানে হয়না।কিন্তু জমিলার ঠিক কি হয়েছে তা নিয়ে টেনশন হচ্ছে তার।নিজে সবটা খুঁতিয়ে দেখেছে,কোনো ব্যাখ্যা পায়নি কেন এমনটা করছে,অবশ্য সে পুরোপুরোও তো এখনি ডাক্তার হয়নি।বেশ ভালো নামকরা ডাক্তার মিস লুবানাকে দেখিয়েছে,উনি টেস্ট ফেস্ট দিয়েছে অনেকগুলো। কিন্তু তাতেও কিছু ধরা পড়েনি।ব্যাপারটা ঠিক কি হচ্ছে বুঝতে পারছেনা ইন্তিকা।বাসার সবাইকে তেমন কিছুনা বলেই আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু নিজেকে কিভাবে করবে?

ল্যাভেন্ডার কালার ভালোমতো সেট হয়ে গেছে ক্যানভাসে।যেভাবে ব্যাকগ্রাউন্ডটা করবে ভেবেছে ঠিক মনের মতন হয়েছে।ইন্তিকার পিচ্চি পিচ্চি ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল।

রাতে বারান্দায় যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় কাটায় তখন বারান্দা থেকে শহরটাকে কিছুটা ভিনসেন্ট ভ্যান গগ এর বিখ্যাত ছবি “দ্য স্টারি নাইট” মতন মনে হতে থাকে।ইন্তিকা ঠিক করেছে আজ বারান্দা থেকে দেখা সেই দৃশ্যটা আঁকবে।ছবিটার কি নাম দেয়া যায় ভাবতে ভাবতে ঠিক করলো “দ্য স্টারি নাইট ইন মাই বেলকনি” হবে ছবিটার নাম।ভিনসেন্ট ইন্তিকার ভিষণ পছন্দের।আঁকতে আঁকতে দ্য স্টারি নাইট আঁকার অদ্ভুত ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।
মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে ১৮৮৯ সালে জুন মাসে এ ছবিটি আঁকেন ভ্যান গগ। তিনি সেবার মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে নিজের কান নিজেই কেটে ফেলেছিলেন। আবার নিজ থেকেই ভর্তি হয়েছিলেন এক মানসিক হাসপাতালে। ভোর হবার কিছুক্ষণ আগে তার ঘরের জানলা থেকে বাইরে তাকান এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবিটি এঁকে ফেলেন তিনি। তিনি বলতেন, আমার প্রায়ই মনে হয় যে, রাতেই অন্ধকার দিনের চেয়ে অনেক বেশি রঙিন। রাত্রির সেই চঞ্চলতা, আলোর ছুটোছুটি বা টার্বুলেন্সের অপরূপ নির্মাণ স্টারি নাইট।

হোয়াইটস্মোক আর হানিডিউ কালার প্যালেটে মিক্স করে তুলির আঁচড়ে স্রোত তুলে নিয়েছে চাঁদটাতে।চাঁদটাকে কোনো ঘূর্ণনায়মান রহস্যময় চাকার মতন লাগছে।ছবি প্রায় শেষের দিকে,ইন্তিকার খুশির মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল।আজ উনাকে হ্যাঁ বলতে যাবে।ভাবতেই কেমন শিহরণ জেগে উঠছে।হাসতে হাসতেই তুলিতে আটকে থাকা রঙ লাগিয়ে ফেললো নিজের গালে।

ধড়ফড় করে উঠে কাবার্ড থেকে ইন্ডিয়ান রেড রঙের বাটার সিল্কের সুন্দর শাড়িটা বের করলো।
সুন্দর মতো একটা বিনুনি খোপা করে তাতে বেলির গাজরা আটকে নিলো।
রামিসা রুমে ঢুকেই হেসে ফেললো।
-আপু শাড়ি পরার সময় তো আমায় ডাকতে পারতে।কি পরলা এটা?
-একটু ঠিক করে দে না।তুই তো জানিস শাড়ি পরতে পারিনা আমি।

ফিহা ঘুমঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিলো,এই সারা সপ্তাহে ভালোমতো যোগাযোগ হয়নি নিনাদের সাথে সামনে ফাইনাল এক্সাম সেই নিয়েই একটু বিজি ফিহা।ফোন চেক করতেই দেখলো না কোনো ম্যাসেজ,না কোনো টেক্সট!
খানিকটা অবাক হলো ফিহা এরকম তো কখনো হয়নি তবে হঠাৎ কি হলো নিনাদের?
মাথা থেকে দুশ্চিন্তা ফেলে দিয়ে ভাবলো, “হয়তো রেগে আছেন মিঃ! পুরু গোলাপের ন্যায় ঠোঁটে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,”যাই রাগ ভাঙ্গাই গিয়ে,আর কাজ কি আমার?”

নিনাদ কল রিসিভ করেই হপ হয়ে আছে।ফিহা এত করে রঙ-ঢং করছে তবুও নিনাদের রাগ কমছে না।
-নাহ পড়ালেখাই করো তুমি,আমায় মনে না রাখলেও চলবে!

আরাদ ব্যাগ প্যাক করে নিলো ও আজই ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাক করবে।সায়ান এতকরে বুঝিয়েও আটকাতে পারলোনা।সারা ওর বাবার বাড়ি গেছে।এতসব কিছুই জানেনা।

আকাশটা কেমন যেন হয়ে আছে।তুখোড় রোদে মাংসপেশি বোধ হয় এই বুঝি ফেটে যাবে।চোখ মেলে তাকানোরও জো নেই।আরাদের ভিষণ বিরক্ত লাগছে আজকের প্রকৃতিটা।তাকাতেই মনে হচ্ছে মেঘগুলো কেমন হেসে হেসে বেড়াচ্ছে।
এমন বিষাদ মাখা দিনেও এদের কি এত ফুর্তি বুঝিনা।
জানালায় মুখটা রেখে চারিদিকটা দেখতে থাকলো।কুঞ্জলতা জড়ানো একটা বাতায়ন দেখে চোখ থমকে গেল তার।
আচমকা কানে বেজে উঠলো একটা লাইন,
“ইশ কি সুন্দর!”
স্বরটা ভীষণ চেনা।মনে করতে পারছেনা তা না,বরং মনে করতে চাইছেনা।
এতক্ষণ আকাশের উপর করা রাগটা আরও তীব্র হলো।এখন কুঞ্জলতাগুলোর দিকে তাকালেও রাগ লাগছে তার।কেন কে জানে?

“এই একটা মানুষকে ও কখনো কাছে পাবেনা,দেখবেও না,একটু ছুঁতেও পারবেনা।শুধু দূর হতে রাগ করতে পারবে,অভিমান করতে পারবে।রাগ,অভিমান,দুঃখ এসবও তো সে দেখবেনা।তাহলে এদের পুষে কি লাভ,রেখে কি ই বা হবে?
আসলে ভালোবাসা বলতে না কিছু নেই,সত্যিই নেই।আর কখনো আসবেও না।চলে গেছে যাক।দূরেই থাকুক।এসব ছাড়াও তো মানুষ বাঁচে,তাইনা?খুব করে বাঁচে।”
আরাদ এসব বলতে বলতেই কখন যে কেঁদে ফেললো নিজের অজান্তে টেরই পেলনা।

চোখের পানি শুকিয়ে গালেই আটকে যায়।দেখতে দেখতে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল।
লাগেজ হাতে নিয়ে নামলো আরাদ।ড্রাইভার শামসু মামা নিতে চাইলেও নিতে দিল না আরাদ।উনাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে নিলো।

এয়ারলাইন কোম্পানির চেক-ইন কাউন্টারে পাসপোর্ট দেখাতে বললে পাসপোর্ট বের করতে গিয়ে বড়সড় একটা চমক খেল আরাদ।তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাসপোর্টের হদিস মিললো না।
কিভাবে এত বড় ভুল করলো সে?
“ওহ শিট!কিভাবে এটা হলো?”
নিজের মাথায় নিজেই একটা বারি দিলো।
এখন আর সময়ও নেই।সায়ান বা কাউকে বলেও লাভ হবেনা।ফ্লাইট ছাড়তে আর বিশ মিনিট মতো বাকি।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো চেয়ারে।তখনই তার কাঁধে একটা স্পর্শ অনুভব করলো আরাদ।
পেছন ফিরে দেখে ইন্তিকা।দেবীর মতন রূপে সজ্জিত হয়ে হাসি হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে।আরাদের সময়ের গতি যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিল।
তাড়াহুড়া করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল আরাদ।
“নাহ, এই সৌন্দর্য্য দেখার অধিকার আমার নেই।” মনে মনেই এসব বলে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো সে।

-এই নিন আপনার পাসপোর্ট!
আরাদ আবারো চমকালো।
-চলে যাবেন যেহেতু দেরি করে লাভ নেই, যান।

ইন্তিকার কাছে কিভাবে তার পাসপোর্ট সেই বিষয়টা আরাদের মাথা থেকেই চলে গেছে,ও ভাবছে শুধু ইন্তিকাকে নিয়ে।
আরাদ দেখলো ইন্তিকা হাসি হাসি মুখ করে ঠিকই কথাগুলো বলছে,কিন্তু চোখজোড়া অশ্রুতে ছলছল করছে।আরাদের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো।

-কি হলো দাঁড়িয়ে আছেন যে?চলুন এগিয়ে দিই আপনাকে।ফ্লাইট তো মিস হয়ে যাবে নয়তো!প্রাণের শহর লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে যাবেন না?যেখানে সব প্রাণের মানুষ আছে আপনার।

আরাদ পাসপোর্টটা হাতে নিয়েই হাঁটা শুরু করলো।কি বলবে বুঝে পাচ্ছেনা সে।তোতলাতে তোতলাতে পেছন ফিরে বললো,”ভালো থাকবেন!”

ইন্তিকা থ মেরেই দাঁড়িয়ে রইলো।
-ভালো থাকার জন্যই তো চলে যাচ্ছেন তাইনা?থাকবো নাই বা কেন বলুন!ভালো থাকার জন্যই এতদূর এসেছি সেজেগুজে….আসছি!বলেই ইন্তিকা রওনা দিল।

আরাদের ভেতরটা এক পাহাড় সমান হাহাকারে ফেটে যাচ্ছিলো।ইচ্ছে করছিলো মাটিতে ধপাস করে পড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here