গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৪.
ইশানের মুখ রাগে আবারো লাল হয়ে উঠলো। টকটকে লাল,একদম টমেটোর মতো। সে খুব শান্ত স্বরে বললো,
— এত বেশি বুঝো কেনো? বেশি বুঝা কি তোমাদের মেয়েদের স্বভাব? ডিবোর্স চাও,ডিবোর্স?
আমি জবাব দিলাম না। এ মুহূর্তে কথা বলার অর্থই হলো কান্না করা। চোখ পর্যন্ত জল পৌঁছে গেছে। যেকোনো সময় কান্না চলে আসার সম্ভবনা রয়েছে।হুট করে ইশান আমার দুই বাহু খামচে, চেপে ধরলেন। তার নখ বোধহয় শরীরে গেঁথে যাচ্ছিলো। আমি ব্যাথায় আহ্ করে উঠলাম। ইশান সেদিকে পাত্তা দিলেন না।
—কি হলো চুপ করে আছো কেনো? জবাব দাও। আন্সার মি ড্যাম ইট!
আমি কেঁপে উঠলাম। আমার শরীরের ঘুমন্ত লোমগুলোও জেগে উঠলো। আশ্চর্য! ইশান চিৎকার দিয়ে কথা বলছে কেনো? সে কি জানে না, বাসায় আমার বাবা আছেন। আমি বলতে না বলতেই ‘ আমার নাম উচ্চারণ করতে করতে বাবা এসে দাড়ালেন। ইশানকে দেখে পর-মুহূর্তেই তিনি চমকে গেলেন।
—এই,ছেলে,এই আমার মেয়েকে ছাড়ো। তুমি ওর সাথে এমন করছো কেনো?
ইশান আমাকে তো ছাড়লোই না উল্টো অন্যদিকে তাকিয়ে দ্বিগুণ জোরে আওয়াজ করে বললো,
—সেটা নিতান্ত আমার আর আমার ওয়াইফের ব্যাপার। আমি ওর সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। আপনি বলার কে? প্রভা, তোমার বাবাকে এখান থেকে এক্ষুণি যেতে বলো। এক্ষুণি!
বাবা বিষ্মিত হয়ে বললেন,
—আমি বলার কে মানে? আমি ওর বাবা। তুমি আমার বাড়ীতে এসে আমার মেয়ের সাথে অত্যাচার করবে আমি চুপ থাকবো?
ইশান আমাকে দাত চেপে বললো,
— তুমি উনাকে যেতে বলবে?
—বাবা তুমি এখন যাও।
আমার নিষ্প্রাণ কন্ঠে বাবা আরো বিষ্মিত হলেন। তিনি বললেন,
—কিন্তু…
—কোনো কিন্তু নয় বাবা। তুমি এখন যাও, আমারও উনার সাথে কথা আছে।
বাবা যাবার পাত্র ছিলেন না। থম মেরে দাড়িয়ে ছিলেন। অতঃপর আমার রিকুয়েস্টে যেতে বাধ্য হলেন। বাবা যেতেই ইশান আমাকে ছেড়ে দিল। হন্তদন্ত হয়ে ছুট দিলো দরজা লাগাতে। দরজা আটকানোর পর বোধহয় তার হুশ চলে গিয়েছিলো। সে এদিক-ওদিক চক্কর কাটছিলো। হঠাৎ তার বিছানার পাশের ছোট্ট টুলের উপর পানির দিকে নজর পড়লো। সে দ্রুত পায়ে হেটে জগ টি হাতে নিলো। প্রথমে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি পান করে নিলো তারপর বাকি পানি মাথায় দিলো। তবে সেখানে দাড়িয়ে নয়, জানালার পাশে যেয়ে মাথা টা বের করেই দিয়েছিলো। জগ টা রেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে মাথাটা তাক করে রেখেছিলো। সম্পূর্ণ বিষয় টা কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলাম। তিনি এমন করছেন কেনো? সে কি রাগ কমাচ্ছিলেন নাকি অন্যকিছু। আমার ভাবনা চিন্তার মাঝেই ঘটে গেলো বিষ্ময়কর ঘটনা। সে কখন আমার নিকটে এসে হাত ছুঁয়ে ক্ষমা চাচ্ছিলো টের ই পেলাম না।
—আই এম সরি প্রভা। রিয়েলি ভেরি সরি। আই সোয়্যার আমার তোমাকে হার্ট করার কোনো ইনটেনশন ছিলো না। তুমি ডিবোর্সের কথা বলায় আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। আই নো এতটা রিয়েক্ট করার বিষয় ছিলো না,কিন্তু কীভাবে যে হয়ে গেলো আমি বুঝি নি। আই এম সরি! সরি!সরি!
সরি বলতে বলতেই তিনি আমার হাতের পৃষ্টের উপর চুমু খেলেন। একটা নয় পরপর অনেকগুলো। তার কারনামা দেখে আমার রিয়েকশন বাটন কাজ করা বন্ধ করে দিলো।আমি শুধু তাকিয়েই ছিলাম। সে যে এতকিছু করেছে, আমার কোনোরকম প্রতিক্রিয়ায় ছিলো না। আমি জানি তিনি ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট পারসন। কখনো কোনোরকম অনুভূতি এক্সপ্রেস করেন না। ফুফুমণি এ কথা জানানোর পূর্বেই আমি অবগত ছিলাম। কারণ উনার সাথে যখন কাজ করতাম তখন থেকেই দেখেছি,তিনি এমন। ব্যবসায় লাভ-লোকসান যা ই হোক তিনি কোনোরকম অনুভূতি দেখাতেন না। সে সবসময় চুপচাপ গম্ভীর থাকতেন।
আমার ভাবনা-চিন্তার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে পড়লাম ইশানের আরেক দফা কান্ডে। তিনি আমার কাপড় গুছাচ্ছেন। আর বলছেন,
—আমরা এক্ষুণি চলে যাবো, ঠিক আছে? তুমি ফ্রেশ হয় নাও তো। এই যে এই লাল শাড়ী টা পরো তো। আজ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
আমি বললাম,—এদিকে আসুন। কাপড় রাখুন। আপনার সাথে কথা আছে।
—রাখার দরকার নেই। তুমি বলো আমি শুনছি।
—না,আগে আপনি এদিকে আসুন। আমি এখন যাবো না তো। আগে কথাবার্তা ক্লিয়ার করে নিন।
ইশানের হাত থেমে গেলো। সে একপলক আমার দিকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে কাপড়গুলো রেখে দিলেন। আমার সামনে একটা টুল টেনে বসলেন। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—এবার বলো, কি বলবে?
আমি বললাম,
— আপনি যে এতক্ষণ অস্বাভাবিক কার্যকলাপ করেছেন সেটা বুঝতে পারছেন?
ইশান কয়েক মুহূর্ত নিরব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা নেড়ে সায় জানালো।
—গুড। এবার আমার কথা শুনুন, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমি আপনার সাথে যাবো না। অর্থাৎ আমার দ্বারা আপনার সংসার করা সম্ভব না। চাপে পড়ে বিয়ে টা তো করেছিলাম,কিন্তু এখন আমার দ্বারা এ সংসার হবে না। একদম না। তো বেটার অপশন হলো, আপনি আমাকে ছেড়ে দিন।আর আবার নতুন বিয়ে করুন, যাকে আপনার পছন্দ হবে,যে জারজ সন্তান হবে না। টেনশন করবেন না এ ছাড়াছাড়িতে আপনার উপর একটা আঙ্গুলও উঠবে না। কারণ সবাই জানে আমার মা বোন কেমন ছিলো আর আমি ও কেমন হবো। বুঝতে পারছেন?
ইশান জবাব দিলেন না। বিনিময়ে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বুঝতে পারলাম কথাগুলো তার হজম হচ্ছে না। আমিও তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। বেশ খানেক সময় পর সে অস্পষ্ট আওয়াজ করে বললো,
—কে্ কেনো ছ্ ছেড়ে দিতে চ্ চাইছো?
—কারণ আমার দ্বারা আপনার সাথে সংসার করা সম্ভব নয়। আমি পারবো না।
— ওহ!
ইশানের নিস্তেজ কন্ঠ আমার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। কিছুক্ষণ পর সে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নাড়াতে লাগলো। এরপর কয়েক মুহূর্ত সেখানেই ঝিমুতে লাগলো।
অনেক ভাবনা চিন্তার পর–‘ওকে’ শব্দটা উচ্চারণ করে দরজার দিকে পা বাড়ালো। আমি খেয়াল করেছিলাম, তখন তার পা দুটো টলছিলো। সে দরজার খিলে হাত রেখেই উঠিয়ে নিলো। কি মনে করে পুনরায় আমার কাছে এসে বললো,
—আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি? বেশি নয় একবার। শুধু একবার!
আমি কোনো জবাব দিলাম না।তার আকুতি ভরা চাহনি দেখে আপনাআপনি আমার মাথা নড়ে সায় জানালো। এতটা বিমোহিত হয়েছিলাম যে মুখ দিয়ে শব্দই বের হচ্ছিলো না। ততক্ষণে ইশান শক্ত বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলো। সে এত টাইট করে ধরেছিলো যে মনে হচ্ছিলো ছেড়ে দিলেই বুঝি আমি পালিয়ে যাবো। আমি জানি তার সাথে আমার এইজ গ্যাপ অনেক বেশি। গ্যাপ টা প্রায় বিশ বছরেরও অধিক হবে। যদিও কাগজে কলমে পার্থক্য সতেরো হবে। আমাদের যে মতের মিল হবে না তা পূর্ব থেকেই তার বোধহয় জানা ছিলো। সে একদিন আমায় বলেছিলো, ‘ তুমি তো আমার সাথে সারাজীবন থাকবে না। তাই নিজের জন্য কিছু করো। নিজের একটা অবস্থান করো। যাতে পরবর্তীতে অন্যের উপর নির্ভরশীল না হতে হয়।’ আমি জানি না সে কেনো বলেছিলো। ব্যাস একদিন কাজ থেকে ফিরে হুট করেই বলেছিলো। একটা বিষয় বলতে ভুলে গেছিলাম, সে কিন্তু বিয়ের ৩য় দিন থেকেই আমাকে আমার পড়ালেখা করার কথা বলেছিলো। আমি ক্ষীণ সন্দেহ আমার শাশুড়িকেও সে ই বলেছিলো, আমাকে পড়ার কথা বলতে। আমিই আগ্রহী ছিলাম না। সেইদিনের মিটিং এর উদ্দেশ্য কিন্তু এটাই ছিলো। এটা ফুফিমা আমাকে জানিয়েছিলো।
#চলবে….
®সোনালী আহমেদ
গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১৫
ইশান জড়িয়ে ধরা অবস্থায় আমাকে চুমু খেলেন। কাঁধে,গলায়। একটা নয় পরপর অনেকগুলো। আমি বললাম,—আপনি কথার বরখেলাপ করছেন। শুধু জড়িয়ে ধরবার কথা ছিলো,চুমু দেবার নয়।
ইশান সরে গেলেন। মুখ দিয়ে বারংবার সরি উচ্চারণ করলেন। আমি কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। তিনি মাথা নিচু করে সদর ফটিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এক দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম আমি। অজানা ব্যাথায় বুকটা কাঁপছিলো।
.
ইশান চলে যাবার পর সারাটা দিন আমার অন্যরকম কাটলো। একদম অন্যরকম!আমি কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। কেনো, জানি না! সারাক্ষণ সকালের কথাগুলোই ভেবেছিলাম। তিনি চলে যাবার অনেক্ষণ পর আমি বেরিয়ে আসলাম। তখন বাবা ভীষণ উতলা হয়ে বললেন, — ও কেনো এসেছিলো?
আমি বললাম,— আমাকে নিতে।
—তুমি কি বলেছো?
— বললাম আমি যাবো না। সাথে ডিবোর্স চাইলাম।
বাবা হকচকিয়ে গেলেন। পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। ডাক্তার শিলার কাছ থেকে ফেরার পর বাবা আমার সবকিছুতে তাল মিলান। কোনো ধরনের আদেশ-উপদেশ দেন না। আমি যেমন আচরণ করি তিনি চুপ থাকেন। মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে কাঁদেন।অপারেশনের কথা আমি শুনতে পারি না দেখে তিনি বলেন না। আমি জানি এই মুহূর্তে বাবা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। করুক না। আমি আমার সিদ্বান্তে অটল ছিলাম। শান্তস্বরে বললাম,
—বাবা,ডিবোর্সের পর যদি তোমার সাথে থাকি কোনো অসুবিধা হবে না তো? বেশিদিন তো আর থাকবো না। তবুও যদি তোমার অসুবিধা…
বাবা তৎক্ষণাৎ বললেন,
—তুই এসব কি বলছিস? আমার অসুবিধা কেনো হবে। চাইলে সারাজীবন আমার কাছে থাকবি। কিন্তু ডিবোর্স কি সবকিছুর সমাধান? আমি বলি, নিজেকে একটু সময় দে। ভালোমতো ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নে। তোর অসুখের কথা বল, দেখ না ওরা কি বলে….
—-আমি অনেক ভেবেছি বাবা। তাছাড়া তুমি আমার এত চিন্তা করলে উনার সাথে বিয়ে দিতে না।
বাক্যটি শেষ করেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বাবা নিশ্চই কষ্ট পেয়েছেন? কষ্টা পাবার ই কথা। কখনো এভাবে মুখের উপর কথা বলি নি। আমি গায়ে মাখলাম না। অসুখের কথা শোনার পর থেকে কেমন যেনো পাথর হয়ে যাচ্ছি। পুনরায় রুমে চলে আসলাম। এই মুহূর্তে আমি সত্যিই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আমার মন বলছে ইশানের কাছে ফিরে যেতে,কিন্তু মষ্তিষ্ক বলছে উনাকে ছেড়ে চলে আসতে। জেনেশুনে শুধু শুধু একজনের জীবন কেনো নষ্ট করবো? যেখানে আমার জীবনের নিরাপত্তা ই নেই। চিকিৎসার এত ব্যয়বহুল খরচ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আচ্ছা যদিওবা কোনোভাবে বেঁচে যাই,তখন তো আরো কষ্ট।কারণ আমি যে সন্তান জন্ম দিতে পারবো না। ডাক্তার তো বলেছেন,টিউমার জরায়ুসহ কেটে ফেলতে হবে। যার অর্থ দাড়ায় আমি সারাজীবন বন্ধ্যা থাকবো। আচ্ছা একজন স্বামী একজন বউয়ের কাছে কি চায়? সন্তান ই তো, তাই না? আর আমি যদি সেটাই উনাকে দিতে না পারি তাহলে তো আমার বেঁচে থাকার দরকার ই নেই। তাছাড়া তখন আমার জন্য বেঁচে থাকা টা হবে মৃত্যুর সমান। কারণ সারাজীবন এই অক্ষমতা আর অপবাদ বয়ে বেড়ানো আমার জন্য সম্ভব হবে না। লোকজনের কানাঘুষো সহ্য করতে পারবো না, পারবো না বাচ্চা না হওয়ার শূন্যতায় কেঁদে কেঁদে দিন পার করতে। আমার কান্ডজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই কথা শুনে আসছি, আর পারবো না। আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। এসব সহ্য করা সহজ নয়।জানি না উপরওয়ালা কেনো আমার এত ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন? কেনো এত কষ্ট দিচ্ছেন। এটুকু আশা রাখি তিনি নিশ্চই ভালো কিছু প্ল্যান করে রেখেছেন। যা হবে ভালোর জন্যই হবে। আজ যদি মা থাকতো তাহলে হয়তো কবেই এই অসুখ থেকে নিস্তার পেতাম। কখনো এত বড় সমস্যা হয়ে দাড়াতো না। কেননা এসব সমস্যা তো মায়েদের সাথেই শেয়ার করা যায়। তিনি চলে যাওয়ার পর দেখা দিয়েছিলো আমার সমস্যাগুলো। কাউকে কিছু বলতেও পারতাম না। একদিন সাহস করে মাধবি আপাকে বলেছিলাম। তিনি কি বললেন? তিনি এসব বুঝেন না,আরো বললেন,এগুলা হয়তো নরমালি মাঝে মাঝে হয়ে থাকে। তখন থেকেই সমস্যাগুলো নিজের মাঝে নিয়ে বড় হলাম। কাউকে বললাম না। আমার আর বলার কেউ ছিলোও না। বাবাকে নিশ্চই এসব বলা যেতো না। তাই বলতে পারি নি। ধীরে ধীরে আমি বড় হলাম সাথে আমার রোগগুলোও বড় হলো। যা আজ এত বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। জানেন আমার এই অবস্থা দেখে আমি মনে মনে বড় এক সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটা কি জানেন? সেটা হলো– “কখনো যদি মা হতে পারি তবে কোনোদিন আমার সন্তানদের ছেড়ে যাবো না। সবসময় ছায়ার মতো তাদের সাথে থাকবো। ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞেস করবো তাদের সমস্যার কথা। সাধারণ সমস্যা বলে কোনো অসুখ-বিসুখ কে হেলাফেলা করবো না সবসময় তাদের খেয়াল রাখবো। ” জানি আমার এসব কথা স্বপ্ন ই থেকে যাবে কখনো পূরণ হবে না। তবে ভাবতে ক্ষতি কি? সামান্য একটু ভেবেই নাহয় নিজেকে খুশি রাখি……
–
রাত বারোটা উনত্রিশ বাজে।এ সময়ে শশুড়বাড়ী থেকে ফোন আসলো। আমার চোখে তখন গভীর ঘুমের লেশ । কোনোরকম হাত বাড়িয়ে ফোন নিতেই দেখলাম আমার শাশুড়ির ফোন। আমি হকচকিয়ে উঠলাম। এত রাতে ফোন? কিছু কি হয়েছে? তিনি তো ওই একবার ই কথা বলেছিলেন। তাহলে এই মুহূর্তে কেনো ফোন? আমার মাথায় নানারকম উদ্ভট চিন্তা এসে ভীড় জমালো।
আমি ফোন রিসিভ করে কানে নিয়ে বললাম,
—-আসসালামু আলাইকুম।
ওপাশ থেকে গমগমে সুর ভেসে আসলো,
—- ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো তুমি?’
আমি অবাক হলাম। ভীষণ অবাক! এত রাতে ভালো থাকার খবর জিজ্ঞেস করতেই কি ফোন দিয়েছেন? সেটা তো সকালে বা বিকালেও বলা যেতো। ভাবনাচিন্তার মাঝেই আমার তন্দ্রাভাব টা কেটে গেলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,
—জ্বি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
—- ভালো আছো এটা তো ভালো কথা। খুব ভালো কথা। আজ কি ইশান তোমাকে আনতে যায় নি?
—-জ্ব, জ্বি।
—আসো নি,কেনো?
আমি নিরব রইলাম। এ মুহূর্তে কোনো জবাব মাথায় আসছে না। কি বলবো?কি বলা উচিত-কিছুই ভাবনায় আসছে না।
আমার নিস্তব্ধতায় শাশুড়ি শান্তস্বরে বললেন,
—তুমি জানো, আজ আমার ছেলে তোমাকে নিয়ে আসবে বলে সকালে না খেয়ে বেরিয়েছে। এলোমেলো পোশাকে তোমাদের বাড়ীতে উপস্থিত হয়েছে। যেখানে সে বিয়ের দিন শপথ করেছিলো সে কোনোদিন তোমার বাবার বাড়ীতে পা রাখবে না। কোনোদিন তোমার বাবার সাথে দেখা করবে না। সেখানে সে ভোর সাড়ে চারটা বেরিয়ে গিয়েছে। তোমার কাছে অবাক লাগলো না? কেনো সে আজ ই তোমাকে নিয়ে আসতে চেয়োছিলো? জানতে ইচ্ছে করলো না। থাক আমার সেসব বলার দরকার নেই।
তোমাকে যে কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি, সেটা শুনো। তুমি কি জানো,বিয়ের পর তোমার সাথে কেনো আমরা কেউ কোনো অসন্তোষজনক আচরণ করি নি? কেনো তোমার সাথে কোনো অন্যায় করি নি?জানো না,নিশ্চই। আচ্ছা আমি বলছি, সেই কারণ হলো ইশান যে বিয়ে করেছে এতেই আমরা খুশি ছিলাম। কাকে করেছে, কাকে করার কথা ছিলো সেসব আমরা ভাবি নি। ইশান কোনোদিন বিয়ে করবে না, এই কথাই বলেছিলো আমাদের। আমরা কম চেষ্টা করি নি ওকে রাজি করাতে, কিন্তু পারি নি। কতশত মেয়ে দেখালাম,তার পছন্দ হলো না। সে তার সিদ্ধান্তে ছিলো অটল। শেষেমেশ আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এক দিন তোমার বোন সেই নিভে যাওয়া প্রদীপ জ্বলিয়ে পুনরায় আমাদের আশা দেখালো। আমার ছেলে এসে বললো, তোমার বোনকে বিয়ে করবে। আমরা বিনাবাক্যে রাজি ছিলাম। তোমাদের সাথে আমাদের আকাশ-পাতাল তফাৎ জেনেও রাজি ছিলাম। কিন্তু শেষে কি হলো-তোমার বোন চলে গেলো। বিয়ে টাও ভেঙ্গে গেলো। আবারো আমাদের আশার প্রদীপ নিভে গেলো। কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার ছেলে আর কোনোদিন বিয়েই করবে না। ঠিক সেই-সময় ইশানের ফুফু বুদ্ধি করে তোমার সাথে ইশানের বিয়ে ঠিক করলেন। কিন্তু তোমার বাবা রাজি ছিলেন না, তিনি সরাসরি ইশানকে বললেন,’ দশবছর পর তোমার কি অবস্থা হবে আর আমার মেয়ের কি অবস্থা হবে? সেটা কি একবার ভেবেছো?’ আমি তখন তাকিয়ে দেখেছিলাম আমার ইশানের শরীর কেঁপে উঠেছিলো, মন ভেঙ্গে গিয়েছিলো। সে কিছুতেই রাজি ছিলো না তোমাকে বিয়ে করতে। তার কথার স্বর বদলে গিয়েছিলো। সে তোমার বাবার কথায় এতটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো যে রেগে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু আপা মানলেন না। তিনি তোমার বাবার উপর চাপ দিয়ে ইশানের সাথে জোর পূর্বক তোমার বিয়ে দিলেন। আমরা সবাই অরাজি ছিলাম। তবুও কি হলো?বিয়ের পর সবাই মেনে নিলাম, তোমার সাথে আট-দশটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো ব্যবহার করলাম। অথচ দেখো তুমিও তোমার বোনের মতো নিজে প্রদীপ জ্বলিয়ে, নিজেই নিভিয়ে দিলে। এই মুহূর্তে আমার একটা কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, সেটা কি জানো? তোমরা দুবোন আসলেই তোমাদের মায়ের মতো। মা যেমন মেয়েও তেমন। কথাটি বলেছি বলে দুঃখ পেয়েও না। আমি তোমাদের কর্মে বাধ্য হয়েই বললাম।
শাশুড়ি মা এবার থামলেন। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। ফোনের স্পীকার দিয়ে সেই নিঃশ্বাস স্পষ্ট আমার কানে বাড়ি খাচ্ছিলো। আমার হাত পা ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে এসেছিলো। ইশান এই কারণে বাবাকে দেখতে পারে না। তার মানে হাসপাতালে চিঠির জন্য নয় বরং বাবাকে দেখে রেগে গিয়েছিলো। শাশুড়ি মায়ের কথায় আমার ভেতর বিস্তর ফারাক এলো। আমার কন্ঠস্বর বদলে গেলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
—মাদার-ইন-লো আম্ আমি আ্ আসলে….
শাশুড়িমা আমাকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে বললেন,
—-দাড়াও, আমার কথা শেষ হয় নি। আরো কথা আছে। শুনো, মনোযোগ দিয়ে শুনো।
আমার ছেলের জন্য যে তোমার ভেতর টান ছিলো তা তোমার ও অজানা নয় আমারও নয়। কারণ আমি নিজের চোখে স্পষ্ট দেখেছিলাম, তুমি কেমন ছটফট করতে আমার ইশানকে এক পলক দেখার জন্য। কত মায়া, ভালোবাসায় স্নিগ্ধ থাকতো তোমার দুটি চোখ। জানো,আমার একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা থাকতো। তোমাদের বয়সের এত পার্থক্য, কখনো কি মিল হবে? কখনো কি তোমরা একে-অপরকে ভালোবাসবে? যদিও ইশানের লুক আর চলাফেরায় তার বয়সের ছাপ দেখা দেয় নি, দেখতে এখনো জোয়ান কম বয়সী ছেলেদের মতো দেখায়। তবুও কি? বয়স তো হয়েছে, চিন্তা-ভাবনা তো বদলেছে। আমার ক্ষীণ সন্দেহ ছিলো,তুমি কখনো আমার ছেলের প্রতি এট্রাক্টিভ হবে কি না, কখনো তার প্রতি কেয়ার করবে কি না। কিন্তু দেখো আমার ধারনা ভুল প্রমান করে মাত্র কয়েকদিনেই আমার ছেলের মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিলে নিজেকে। তার প্রতি কত উইক হয়ে পড়লে। এসবে আমি কত খুশি ছিলাম, আমার পরিবার কত খুশি ছিলো সেসব তোমার ধারনার বাহিরে। কিন্তু দেখো শেষে এসে আবারো আমার ধারনা সত্য প্রমাণ হয়ে গেলো। অল্প বয়সী মেয়ে তুমি, আবেগপ্রবণ হয়ে ইশানের প্রতি এট্রাক্টিভ হয়েছিলে।কিন্তু দেখো আজ তোমার আবেগ কেটে গেলো, চলে গেলে বাবার বাড়ীতে। ফিরিয়ে দিলে আমার ছেলেকে। জানি না সেদিন কি হয়েছিলো তোমাদের মধ্যে আর না জানি আজ কি হয়েছে তোমাদের মধ্যে। তবে এটুকু বলি, আমার ছেলে খুব ভালো, সে তোমার উপর দূর্বল। ভীষণ দূর্বল। তোমাকে নিশ্চই পছন্দ করে,হয়তো ভালোওবাসে। এ কথা মা বলে বলছি না, নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম। আজ এত বিশেষ একটা দিন অথচ দেখো আমার বাচ্চাটা বাড়ী ফিরলো না। হয়তো ফিরবেও না। তোমার জন্য দোয়া রইলো, ভালো থেকো। সুখে থেকো।
—মা, আমার জরায়ুতে টিউমার। অপারেশন না করলে আমি বাঁচতে পারবো না। আর অপারেশন করলে আমি বাচ্চা জন্ম দিতে পারবো না।
কোনোকিছু না বুঝেই কথাটি বলে ফেললাম। আমার মনে হলো এখন একদম সঠিক সময় শাশুড়িমাকে এ কথা জানানোর। ইশানকে নাহয় অভিমানের জন্য বলি নি,কিন্তু শাশুড়ি? উনাকে তো বলা যায়। বলা যায় না বরং বলতে হবেই। উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছিলো। খেয়াল করেছিলাম, ফোনটিও ঠিকঠাক ধরতে পারছি না। বারবার কান থেকে সরে যাচ্ছে।
চলবে…..
®সোনালী আহমেদ