হঠাৎ_হাওয়া পর্ব ৩

#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৩

নিরুরা ওদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে বেশ খানিকক্ষণ হলো। নিরু ওর বাবা-মায়ের সাথে স্বাভাবিক থাকলেও ওর ভাই কথা বলছে না ওর সাথে। পুরোদমে এড়িয়ে চলছে। তবে ফারহানের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। যেহেতু ফারহানের সাথে তার কোনো মনোমালিন্য নেই তাই তার সাথে কথা না বলার কোনো প্রশ্নই উঠে না। নাহিদের রাগ তো তার বোনের উপরে। তারাই মিটিয়ে নেবে। এখানে ফারহানকে টেনে আনা নেহাতই বোকামি নাহিদের কাছে। তাই সে একদম স্বাভাবিক।

সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে ফারহানকে নিয়ে রুমে এলো নিরু। একে একে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নিল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কালো আঁধার নেমে এসেছে চারদিকে। নিরু ফারহানকে রেখেই রুমের বাইরে চলে গেল আর ফারহান বিছানায় বসে বসে ফোনে কী যেন করছে।

নিরু বাইরে গেলেও ওর মা আবার ওকে ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, “নতুন বিয়ে হয়েছে এখন তো সবসময় জামাইয়ের আশেপাশেই থাকবি। তাছাড়া বিয়ের পরে সে প্রথমবার এবাড়িতে এসেছে খাতিরযত্নের কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। তার সাথেই থাকতে হবে। কখন কী দরকার পড়ে যায় বলা যায় না তো।”

নিরুও বাধ্য মেয়ের মতো রুমে এসে ফারহানের পাশে এসে বসে পড়লো।

নিরুকে আবারো আসতে দেখে ফারহান ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো, “কী হলো? এইমাত্রই না বাইরে গেলে। মিস করছিলে না-কি? ইশ… কী ভাগ্য আমার! বউ আমাকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারে না।”

নিরু ভেংচি কেটে বললো, “মোটেও না। মা জোড় করে রুমে পাঠিয়ে দিল আপনার সাথে থাকার জন্য। কখন কী দরকার পড়বে তা জানাতে বললো।”

“মাকে জানাতে হবে না। আমার তো বউকে দরকার ছিল। বউ যখন এসেই পড়েছে তখন আর কিছুর দরকার নেই।”

নিরু অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, “বউকে দরকার বলেই তো এতক্ষণ বউ রেখে বসে বসে ফোন টিপছিলেন।”

ফারহান নিরুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো, “বউ অভিমান করেছে বুঝি?”

নিরু মাথা নেড়ে না জানালো। মূলত লজ্জা লাগছে তার। লোকটা ভীষণ বেহায়া।

কিছু একটা মনে পড়তেই নিরু চটপট উত্তর দিল, “আমি যাই। মা রান্না করছে সাহায্য করতে হবে।”

ফারহানকে কিছু বলতে না দিয়েই নিরু উঠে চলে গেল। ফারজান মুচকি হেসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিরুর লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখে বড্ড বেশিই ভালো লাগে। তাই তো হঠাৎ করেই লজ্জা দিয়ে বসে।

কিছুক্ষণ পরেই নিরু ফারহানকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এল। খাবার টেবিলে শুধু নিরুর বাবা আর ভাই বসে আছেন। নিরুর মা আর নিরু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নিরুর মা ও মেয়েকে জোড় করে খেতে বসিয়ে দিলেন। নিরু ওর মা কে সাহায্য করতে চেয়েছিল।

খাওয়ার পরে ফারহান কিছুক্ষণ নিরুর বাবার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে রুমে চলে এল। নিরু ওর মাকে সব গোছাতে সাহায্য করছে। নিরুর মা বারবার বলছে, “নিরু তুই রুমে যা। আমি একা পারবো। জামাই রুমে একা আছে।”

তবুও নিরু জেদ করে বলছে, “একা আছে তো কী হয়েছে? আমি তোমাকে সাহায্য করি। এতকিছু তোমার গোছাতে হবে না৷ কত রান্নাবান্না করলে এখন একটু রেস্ট নাও গিয়ে।”

নিরুর মা মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে রুমে যেতেই নিরু ওর ভাইকে ডাকলো, “ভাইয়া?”

নাহিদ নিরুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো, “কাল সকালে কথা বলি।”

নিরু খানিকটা মন খারাপ করে ফেললো। কী এমন দোষ করেছে সে যার জন্য এমন করতে হবে? নিরু খানিকটা অভিমান নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের দিকে যতই যাচ্ছে ততই একটু একটু ভয় লাগছে নিরুর।

তার অবচেতন মন ভাবছে, “উনি যদি আমার সাথে জোড় করেন। উনাকে দেখে, উনার কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কখনো সেরকম মনে হয় না। যথেষ্ট ভালো মানুষ উনি কিন্তু পাশের বাসার লিমা যে আরেকদিন বললো, ওর স্বামী না-কি ওকে অনেক জোড় করেছে। সব স্বামীরাই কী এমন হয়?”

এসব ভাবতে ভাবতেই নিরু বেশ সংকোচ নিয়ে রুমে এলো। ফারহান তখন বিছানায় বসে ছিল। নিরুর সংকোচ আর চোখে ভয় দেখে বিষয়টা আন্দাজ করতে বেশি সময় লাগেনি ফারহানের। ও উঠে নিরুর দিকে এগিয়ে যেতেই নিরু পিছিয়ে গেল। একপর্যায়ে দরজার সাথে ঠেকে গেল। ফারহান ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বেশ শান্তস্বরে বললো, “তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো নিরু?”

কণ্ঠটা বেশ করুণ শোনালো নিরুর কাছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কাচুমাচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ফারহান আবারো বললো, “তুমি কী এটা ভাবছো যে আমি তোমাকে জোড় করবো? অবশ্য ভাবারই কথা। তোমাকে হয়তো এসব বিষয়ে আগে বলা হয়েছে তাই ভয়টা একটু বেড়ে গেছে। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো আমি তোমাকে জোর করবো না কখনো। কাপুরষ হতে পারবো না। শুধু পুরুষ্যত্ব ফলানোতেই কেউ সুপুরুষ হয়ে যায় না। ধর্ষণকারী হতে পারবো না। নারী যতই আমার স্ত্রী, প্রেমিকা হোক না কেন তাকে জোর করাটাও একধরনের ধর্ষণের সামিল। বুঝেছো?” বলেই নিরুর নাক টেনে দিল।

ফারহানের কথা শুনে নিরুর মনের ভয়টা পুরোপুরি কেটে গেছে। বেশ স্বস্তি অনুভব হচ্ছে।

ফারহান এবার একটু দুষ্টু হেসে বললো, “তবে তুমি যখন আমাকে ভালোবাসবে তখন কিন্তু আমি কোনো বাঁধা শুনবো না। তাছাড়া একটু আধটু ভালোবাসা তো থাকবেই তাইনা?”

নিরু বেশ বুঝতে পারছে কথাগুলো ফারহান তাকে লজ্জা দিতেই বলেছে। লজ্জাও পাচ্ছে বেশ।

ফারহান নিরুর থেকে একটু সরে এসে মুচকি হেসে বললো, “চলো, ঘুমাবো এখন। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। আবার এটা বলো না যে, আমাদের আলাদা ঘুমাতে হবে। এটা কিন্তু মানতে পারবো না।”

নিরু মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা মানতে হবে না। এখন চলুন ঘুমাবো। আমারো প্রচুর ঘুম পেয়েছে।”

নিরু আর ফারহান পাশাপাশি শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে আগে ঘুম ভাঙলো ফারহানের। নিরু তার এক হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। চুলগুলো মুখের উপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফারহান অন্য হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে আলতো স্বরে নিরুকে ডাকলো। নিরু একটু নড়েচড়ে হাতটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ফারহান আরো বেশ কয়েকবার ডেকে ওকে ঘুম থেকে তুললো। আযান দিয়েছে নামায পড়তে হবে। দুজনে ওযু করে একসাথেই নামায পড়ে নিল।

নিরু বারান্দায় গিয়ে দাড়াতেই ফারহানও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

নিরু কিছু চিন্তা করে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা আপনি আমার সম্পর্কে এতকিছু জানেন কীভাবে? আমাকে আগে থেকে চিনেন?”

ফারহান অানমনে উত্তর দিল, “হুম।”

নিরু বিস্ময় নিয়ে বললো, “কবে থেকে?”

এবার ফারহানের টনক নড়তেই বললো, “একদিনে এত কিছু বলবো না।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”

“এমনি।”

নিরু মুখ ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললো, “না বললেন। বলতে হবে না।”

ফারহান সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বললো, “অভিমান করলেও কিন্তু বলবো না। আগে তোমার মনে আমার জন্য অনুভূতির সৃষ্টি হোক, ভালোবাসার সৃষ্টি হোক তারপরে বলবো। আগে বললে সেসব শুনে তোমার মনে হয়তো একটু হলেও ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমি সেটা চাই না।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন? বেশিরভাগ মানুষই তো এটাই চাইবে।”

ফারহান নিরুর দিকে ঘুরে বললো, “কারণ আমি চাই আমার সাথে থেকে, মিশে, আমার সম্পর্কে জেনে তারপরে তুমি আমাকে ভালোবাসো। কোনো কথার ভিত্তিতে নয়।”

নিরু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। লোকটাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে চিনছে সে। তার সাথে থাকার দুইদিনও এখনো পূর্ণ হয়নি অথচ মনে হচ্ছে কত আপন।

নিরুকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান আলতো হেসে বললো, “চলো একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি। আবহাওয়াটা বেশ লাগছে।”

নিরুও হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়িয়ে ফারহানের সাথে চললো। বাড়ির সামনে পুরোদমে শহরের ছাপ থাকলেও পেছনের দিকে রাস্তাটা একটু গ্রাম্য ধরনের। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। নিরুর প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। কথা বলতে বলতে শুনশান রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি শেষে আটটার দিকে বাড়ি ফিরে এল ওরা। নিরুর মা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। বাবা বসে বসে পেপার পড়ছেন আর নাহিদ তার পাশে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

নিরুর ওর ভাইকে দেখামাত্রই রাতের কথা মনে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, “ভাইয়া তো বলেছিল সকালে কথা বলবে। তাহলে কী এখন কিছু বলবো?”

ফারহান গিয়ে নিরুর বাবার পাশে বসে পড়লো।

নিরু নাহিদকে ডাকতে নাহিদ ওকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চললো। বলে গেল কীসের যেন জরুরী কথা আছে। ফারহানও আর সেদিকে কেমন মাথা ঘামালো না। ওদের ভাই-বোনের মাঝে ঢোকাও উচিত নয়। নিজেরাই না-হয় মনোমালিন্য মিটিয়ে নিক।

নিরু নাহিদের রুমে প্রবেশ করেই বললো, “ভাইয়া তুমি কথা বলছো না কেন আমার সাথে?”

নাহিদ বিছানায় বসে বললো, “আমি কিন্তু তোর ভালোর জন্যই বলেছিলাম নিরু। কিন্তু তুই শুনলি না আমার কথা।”

নিরু ওর পাশে বসে শান্তস্বরে বললো, “হ্যাঁ, মানছি। তুমি আমার ভালোর জন্যই বলেছো। কিন্তু টাকা দিয়েই কী সব সুখ পাওয়া যায়? তুমি দেখো উনি আমাকে ঠিক সুখী রাখবে।”

নাহিদ পাশ ফিরে হেসে বললো, “একদিনেই এত বিশ্বাস?”

নিরু নিচুস্বরে বললো, “বিশ্বাস করার মতোই মানুষ উনি। তুমি প্লিজ আমার সাথে আর রাগ করে থেকো না।”

নাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমি তোর সুখের কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্তটা জানিয়েছিলাম। এখন তুই যদি এভাবেই সুখে থাকিস তাহলেই আমি খুশি। তোর সুখে থাকাটাই আমার কাছে প্রধান।”

নিরু হেসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো, “থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া।”

বিনিময়ে নাহিদও আলতো হেসে বোনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো।

#চলবে__??

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here